0

ধারাবাহিকঃ সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in


ধারাবাহিক


বানরায়ণ, পর্ব চার
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়


বুড়ো সোমুক তার নিজের ঘরে আগুনের পাশে বসে মালসায় করে কি যেন শিকড়বাকড় ঘুঁটছিলো। ঘরের দেওয়ালে ঝোলানো নানারকম পশু-পাখির হাড় আর মাথার খুলি। এক কোণে একটা বাঁশের খাঁচায় ফাঁদ পেতে ধরা কতগুলো ইঁদুর। সবাই জানে, ওগুলো বুড়ো সোমুকের পোষা আত্মা। ইঁদুরের ভিতর ভরে রেখেছে। আমি জানি, ওই বেচারা প্রাণীগুলোর উপর ঠাকুর্দা তার ওষুধ পরীক্ষা করে। করতেই হয়। ওষুধ পরীক্ষা না করে তো আর মানুষকে দেওয়া যায় না! ঘরের আর এক পাশে খড়ের বিছানায় ঘুমিয়ে কাদা রত্তি, বুড়োর নতুন ঘরনী। বয়সে আমার থেকে অল্পই বড়।

আমি পা টিপে টিপে ঢুকলাম। তবু বুড়োর সজাগ কান এড়াতে পারলাম না। আমার দিকে পিছন করে বসা অবস্থাতেই ঠাকুর্দা চাপা গলায় বললো, ‘‘তোর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম রে ছোঁড়া। আস্তে আস্তে আয়। মেয়েটা উঠে না পড়ে।’’

আমি যথাসম্ভব নিঃশব্দ পায়ে গিয়ে ঠাকুর্দার পাশে উবু হয়ে বসলাম। বাইরে অল্প শীত শীত ভাব হলেও ঘরের ভিতরটা আগুনের তাপে বেশ উষ্ণ। বুড়ো সোমুক হাতের মালসাটা এক পাশে সরিয়ে রেখে আমার দিকে চাইলো।

‘‘আমি জানি, তুই-ও যেতে চাস। যাবিই। সেটাই ভবিতব্য।’’ মুখ ফিরিয়ে খানিকক্ষণ আগুনের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলো ঠাকুর্দা। তারপর ধীরে ধীরে মাথা নাড়তে নাড়তে আমার পানে চেয়ে আবার বললো... ‘‘কিন্তু সে বড় সহজ জায়গা নয় রে ঋচিক! প্রথমে সেতু তৈরি হতেই প্রচুর জীবন বিসর্জন যাবে। সে কত বড় জলের পারাবার, তোরা ভাবতেও পারবি না।’’ বুড়ো সোমুক একটু যেন শিউরে উঠলো। ‘‘তারপর হবে যুদ্ধ। ভয়ংকর যুদ্ধ। তেমন যুদ্ধ কোনওদিন হয়নি কোথাও। লাখে লাখে প্রাণ যাবে...’’

বলতে বলতে থেমে গেলো ঠাকুর্দা। দু’চোখ বন্ধ করে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর আমার দিকে চেয়ে গভীর স্বরে শুধালো... ‘‘তুই পারবি তো সে সব সহ্য করতে?’’

আমি কিছু না বলে চুপচাপ চেয়ে রইলাম ঠাকুর্দার দিকে। যেতে আমাকে হবেই। ভবিতব্য। বুড়ো সোমুকের থেকে বেশি সে কথা কেউ জানে না। কিন্তু যাওয়ার আগে জেনে যেতে হবে যতখানি পারা যায়। সেই জন্যই আসা। আর কারও সাহস হবে না এত রাতে গুণীনের ঘরে আসার। সবাই জানে, গুণীন এই সময় ভূত নামায়।

‘‘তোর মা, আমার বড় বেটার প্রথম ঘরনী, তোকে বিয়োতে গিয়ে মরে গেলো...’’ বুড়ো সোমুক কেমন ধরা ধরা গলায় বলতে আরম্ভ করলো... ‘‘আমার যোয়ান বেটাটাও একদিন জঙ্গলে গিয়ে আর ফিরে এলো না। তুই তখনও দুধের শিশুসেইদিন থেকে তোকে বুকের পাঁজরের মতন আগলে আগলে রেখিচি রে ঋচিক...’’

আবার কিছুক্ষণ চোখ বুজে চুপ করে রইলো ঠাকুর্দা। মনে হলো ওর বুকের ভিতর কষ্ট হচ্ছে। এসব কথা আমার জানা। বহুবার শোনা। তবু, বোধ হয় সেই প্রথমবার, আমারও গলার কাছটা হঠাৎ কেমন চিনচিন করে উঠলো...

‘‘তোর যেদিন জন্ম হলো, সেইদিন আমি স্বপ্ন পেইছিলুম... যোজন যোজন জোড়া জলের স্বপ্ন... আর যুদ্ধের স্বপ্ন! ভয়ানক যুদ্ধ! সেদিন বুঝতে পারিনি সে সব কি ব্যাপার। ভেবেছিলুম, ওমনিই দেখলুম বুঝি। যেমন ঘুমিয়ে দেখি। ভুলেও গিয়েছিলুম সে সব কথা। কাল সম্বর্তর কথা শুনতে শুনতে আবার স্বপ্ন হলো। সেই একই স্বপ্ন। আরও পষ্ট, পরিস্কার। দিগন্ত জোড়া অথৈ জলের পারাবার... তার উপর তৈরি হচ্ছে কাঠ-পাথরের সেতু... হাজার হাজার লোক অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছে দিনে রাতে... সেই সেতু পার হয়ে চলেছে সারবাঁধা সৈন্যের দল... তারপর যুদ্ধ! ভয়াবহ যুদ্ধ! অস্ত্রের শব্দে কান পাতা দায়। মেদ-বসা‌-রক্তের গন্ধে নাক বন্ধ হয়ে আসে! চারধারে শুধু মৃতদেহ আর মৃতদেহ!’’

কথা বন্ধ করে খানিকক্ষণ কেমন যেন ঘোলাটে চোখে সামনের আগুনের দিকে চেয়ে রইলো বুড়ো সোমুক। তারপর আস্তে আস্তে মাথা নাড়তে নাড়তে বললো, ‘‘তুই যুদ্ধ করিস না, ঋচিক। যুদ্ধ তোর জন্য নয়।’’ একটু  থেমে আমার দিকে চেয়ে বললো, ‘‘তুই মানুষকে বাঁচাস। আমার কাছে যা শিখেছিস, সে সব উজাড় করে দিস সেথায়। শত্রু-মিত্র ভাবিস না। ওঝা-গুণীনদের সে সব বিভেদ করতে নেই রে। আমাদের কেউ শত্রু হয় না। হলেও তার অসুখে-আঘাতে সে কথা মনে রাখতে হয় না। মনে রাখিস, আমাদের জন্য সব মানুষ সমান। যুদ্ধ আমাদের কাজ নয়।’’

আবার কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর আবার কথা... ‘‘সে যে কার যুদ্ধ, তাও আমি ভালো বুঝিনি। সম্বর্তর কথার মাঝখানে স্বপ্ন এলো যে! শুধু দেখলাম... দেখলাম...’’ আবার কেমন তন্ময় হয়ে গেলো বুড়ো সোমুক।

‘‘কি দেখলে?’’ প্রথমবার কথা বললাম আমি। ওদিকে রত্তি, সম্ভবত অনভ্যস্ত কন্ঠস্বর কানে যাওয়ায়, ঘুমের মধ্যেই একবার পাশ ফিরলো। ঠাকুর্দা একবার তার দিকে একটা অন্যমনস্ক দৃষ্টি দিয়ে আমার দিকে ফিরলো।

‘‘হুঁ? কি দেখলাম? বলছি... কিন্তু তার আগে আরও ক’টা কথা বলার আছে তোকে।’’

আমি উৎকর্ণ হয়ে রইলাম। ঠাকুর্দা বলতে লাগলো... ‘‘আমি জানি, তুই চক্রপর্ণীর মলম বানাতে শিখে গেছিস। আরও অনেক ওষুধ বানাতে শিখে নিয়েছিস তুই, আমি জানি। এই সব বিদ্যে তোর ওখানে কাজে লাগবে। যখনই মানুষের সেবা করবি, মন-প্রাণ দিয়ে করবি। যত্নে কোনও ফাঁক রাখবি না। সবসময় চেষ্টা করবি আরও যত পারিস, যা পারিস শিখে নিতে। অনেক কিছু শেখার আছে, জানার আছে রে ঋচিক এই পৃথিবীতে।’’

প্রায় এক নিশ্বাসে কথা গুলো বলে একটু দম নেওয়ার জন্য থামলো ঠাকুর্দা। আমি সেই ফাঁকে আমার মনের ভিতর অনেকক্ষণ ধরে পাক খেতে থাকা প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করে ফেললাম... ‘‘এই পৃথিবী কত বড়?’’

একটু হাসলো বুড়ো সোমুক। কেমন যেন বিষন্ন হাসি। বললো... ‘‘সে তো তুই ফিরে এসে আমায় বলবি রে ব্যাটা! আমার তো আর এই গ্রাম আর ওই পাহাড়-জঙ্গল ছাড়া আর কিছুই দেখা হলো না এ জীবনে। তুই পৃথিবীটা দেখে ফিরে আসবি। এসে বলবি আমায়, সেটা কত বড়, কি কি আছে তাতে। আমি শুনবো... যদি ততদিন বেঁচে থাকি।’’

আমার গলার কাছের চিনচিনে ভাবটা হঠাৎ বেড়ে গেলো। এরকম কথা ঠাকুর্দার মুখে শুনিনি কখনও। আমার একটা হাত অজান্তেই বলিরেখাঙ্কিত হাতখানার উপর চলে গেলো। সেই হাতে অল্প চাপ দিয়ে বুড়ো সোমুক বললো... ‘‘ভবিতব্য খণ্ডানো যায় না রে ঋচিক। যা হবার, তা হবেই। আমি তোর ভবিতব্য দেখেছি। তুই ফিরে আসবি এখানে, আমাদের এই তাম্বলি গ্রামে। ফিরে আসবি অন্য মানুষ হয়ে। যাদের সঙ্গে তোর দেখা হবে’’

একটু থেমে, যেন একটু শিউরে উঠে আবার বলতে লাগলো ঠাকুর্দা... এবার আর রত্তির উঠে পড়ার পরোয়া না করে... ‘‘তাদের মতন মানুষ এ জঙ্গলের, এই পাহাড়ের কেউ কোনওদিন দেখেনি। তাদের গায়ের রং ওই গাছের বাকল ছাড়ালে ভিতরের কাঠের মতন। তাদের শরীরও ওই পিপল গাছের মতন বিশাল আর দৃঢ়... তাদের একজন তোর জীবন পালটে দেবে, ঋচিক। তোর মনের চোখ খুলে দেবে। আমি তাকে আমার মনের চোখে দেখেছি।’’

খানিকক্ষণ নীরবতা। দূরের জঙ্গল থেকে একটা গর্জন ভেসে এলো। বাঘের হুঙ্কার। বোধহয় শিকার ধরেছে। রত্তি আরেকবার পাশ ফিরলো তার খড়ের বিছানায়। আমি প্রায় ফিসফিসে স্বরে শুধোলাম... ‘‘সে কে? তাকে চিনবো কি ভাবে?’’

‘‘তাকে আলাদা করে চিনতে লাগে না রে পাগলা! সে নিজের আলোয় তোকে চিনে নেবে।’’ দু’চোখে সামনের আগুনের ফুলকি জ্বেলে বললো বুড়ো সোমুক... ‘‘সে এক অনির্বাণ জ্যোতির্ময় পুরুষ!’’


0 comments: