2

প্রবন্ধঃ ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

Posted in


প্রবন্ধ



অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরা
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়



[প্রাক্‌ কথন – আমি গবেষক নই, উনিশ শতকের বাংলার সামাজিক বিন্যাস ও বিবর্তন জানা আমার এক আগ্রহের যায়গা । সেই আগ্রহ থেকে ইতিহাসের তথ্য ঘেঁটে সেই সময়কার সমাজের ছবি ও এক বারাঙ্গনা কন্যার আলোয় ফেরার সংগ্রামের কাহিনী তুলে আনতে চেয়েছি ]

পুরুষতান্ত্রিক আমাদের সমাজে নারীর অবস্থান কোথায় সেই প্রশ্নে পুরুষ দোদুল্যমান সেই বেদ-পুরাণের কাল থেকেই । নারী ‘নরকের দ্বার’ আবার সে শক্তি রূপিণী । তার বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণের অধিকার নেই কিন্তু দৈব আরাধনার সমস্ত উপচার করবেন নারী । অসুর নিধনে প্রবল শক্তিধর দেবতারা স্মরণ নেন দেবী দূর্গার । কিন্তু অসুর নিধনে তার যাবতীয় প্রহরণ পুরুষ দেবকুল প্রদত্ত । তুমি দেবী বটে কিন্তু তোমার শক্তির উৎস আমরা পুরুষ দেবকুলই । ভাবখানা এই ।

মাত্র দুশো বছর আগেকার কথা । নারী নিপীড়নে সমাজের তেমন কোন হেলদোল থাকতো না । কারণ নারী নিপীড়নের নানান বন্দোবস্ত তখনকার সমাজই অনুমোদন করতো । কুলিন হওয়ার গৌরবে বহু বিবাহ, একাধিক উপ-পত্নী রাখা, বেশ্যালয় গমন তখনকার বাঙালির আভিজাত্য বলেই মান্য হ’ত । দুশ’ বছর আগে মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনে নৈতিকতার বালাই ছিলনা । পরের একশ’ বছরে বাঙালির সমাজ প্রভুত এগিয়েছে, শিক্ষার প্রসার হয়েছে, নারী সচেতনতা বেড়েছে চোখে পড়ার মতো । বিশ শতকের গোড়াতেই নারীর প্রতিবাদী কন্ঠ শুনতে পেয়েছি । ধর্মই যে নারীকে বেঁধে রেখেছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে তার যাবতীয় অবমাননার ঢাল হিসাবে, সে কথাও উচ্চারিত হতে শুরু করেছে । তারপর সমাজ অনেক এগিয়েছে, কিন্তু নারীদের প্রতি সমাজের মনোভঙ্গির কিছুমাত্র বদল হয়নি । ইতিহাসের সুদীর্ঘ পথচলায় কত পরিবর্তন হয়ে গেছে – হয়ে চলেছে নিয়ত । আমাদের সমাজ ও পরিবারের কাঠামোয় কত বদল হয়ে গিয়েছে, পরিবারের বন্ধন শিথিল হয়েছে, আমাদের মূল্যবোধগুলির কত রূপান্তর ঘটে গিয়েছে, কিন্তু নারীর প্রতি সমাজের মনোভাবের বিষয়টি সেই এক সনাতনী বিশ্বাসের অচলায়তনে বন্দি । নারী পুরুষের আশ্রিতা, পুরুষের ভোগ্য সামগ্রী, লিঙ্গ-বৈষম্যের কারণে সে যেন এক আলাদা প্রজাতি । পিতৃপ্রধান যৌথ পরিবার ভেঙে এখন অনু পরিবার, কিন্তু সেখানেও আধুনিক সমাজ কতটুকু স্বাধীনতা দিতে সম্মত নারীকে ? স্ত্রী তার পুরুষ স্বামীর আশ্রিতা – এ ভিন্ন অন্যকিছুই পুরুষ ভাবে না । সমাজ তাকে অন্য কিছু ভাবতে শেখায় না । নারী নিজেও এই ভাবনার অচলায়তনে বন্দি, ধর্মের বাঁধন তাকে অন্য কিছু ভাবতে দেয় না ।

উনিশ শতকের চেয়ে অনেক পরিবর্তন হয়েছে সত্য । উনিশ শতকে যখন অনভিজাত নারী অন্দর মহল থেকে বাইরে বেরিয়েছিলেন কাজের সন্ধানে, সমাজের চোখে তারা ছিল কুল কলঙ্কিনী । যাদের শ্রমশক্তির ওপর দাঁড়িয়েছিল সেকালের হিন্দু সমাজ, তারা হয়ে গিয়েছিলেন গণিকালয়ের মালিকদের শিকার আর নতুন গজিয়ে ওঠা বড়লোকদের গৃহ পরিচারিকা । এ যুগে শিক্ষিত মহিলারা অনেক উচ্চ ও প্রশাসনিক দায়িত্বে কিংবা ব্যবসা বানিজ্যের ক্ষেত্রে সাফল্যের শিখরে উঠছেন সত্য, কিন্তু প্রান্তিক নারীসমাজ, কৃষক রমণী, খণি শ্রমিক, আয়া, পরিচারিকারা নারীত্বের সম্মান থেকে বঞ্চিতই থেকে যান । 

অথচ এই প্রান্তিক কিংবা অন্ধকার জগত থেকে সমাজের মূলস্রোতে আশার আকাঙ্খায় নারী কি নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়েছেন, তা আমরা মনে রাখি না । আমি এই প্রসঙ্গে বিনোদন জগতের কথা বলবো । বিনোদন জগতের মহত্তর সৃষ্টির ক্ষেত্রে নারীর অবদান সর্বাধিক । নগর কলকাতার আদিযুগের থিয়েটার ও সঙ্গীত জগতকে সমৃদ্ধ করে গেছেন সমাজের অন্ধকার জগত থেকে উঠে আসা নারীরা, রেখে গেছেন অনেক মহত্তর অবদান । এবং তা ছিল অন্ধকার জগতের গ্লানি থেকে সমাজের মূলস্রোতে ফেরার সংগ্রাম । মাত্র একশো বছর আগের কথা, বাঙ্গালির সমাজ তখন মেয়েদের গান গাওয়া অনুমোদন করতো না । এদিকে কলের গান এবং গানকে রেকর্ড করার প্রযুক্তিও এসে গেছে । কিন্তু গান গাইবে কে ? রেকর্ড কোম্পানী স্মরণাপন্ন হল দুই বারাঙ্গনা কন্যার । কলের গানে প্রথম গান গাইলেন শশীমুখী ও ফণিবালা নামে দুই থিয়েটারের নৃত্যশিল্পী ১৯০২এ ।

তারও দেড়শো বছর আগে নগর কলকাতার নাগরিক বাবুসমাজ পেয়ে গিয়েছিল তাদের বিনোদনের নতুন মাধ্যম থিয়েটার । আর এই থিয়েটারকে ঘিরেই পিতৃপরিচয়হীনা এইসব কন্যারা থিয়েটারকে আঁকড়ে ধরে মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন আত্মগ্লানি থেকে মুক্তি পেতে । উনিশ শতকের ধনী বাবুদের পরস্ত্রী গমন, রক্ষিতা পোষা তখনকার সমাজ অনুমোদন করতো, তাদের নারীলোলুপতা আর অনৈতিক জীবনযাপনের ক্লেদাক্ত বিবরণ আমরা জানি । কলকাতার নাগরিক জীবনের অঙ্গ স্বরূপ তখন কলকাতায় গণিকার সংখ্যা বৃদ্ধি পায় । সম্ভ্রান্ত বাবুদের লালসার শিকারে গর্ভবতী হয়ে অনেক তরুণী বিধবা আশ্রয় নিতেন গণিকালয়ে । ধনাঢ্য ব্যক্তির রক্ষিতারাও গর্ভবতী হয়ে পড়তেন । বারাঙ্গণা নারী স্বপ্ন দেখতেন তাদের কন্যারা যেন এই গ্লানিময় জীবনের স্পর্শ না পায় । থিয়েটার তাদের সামনে গ্লানিমুক্তির পথ হয়ে দেখা দিল । 

এর পেছনে একজন মানুষের অবদান আমাদের স্মরণ করতে হবে, তিনি মাইকেল মধুসূদন দত্ত । বাংলা থিয়েটারের সেই শৈশবকালে ধনকুবের আশুতোষ দেবের(ছাতুবাবু) দৌহিত্র শরৎচন্দ্র ঘোষ ‘বেঙ্গল থিয়েটার’ নামে থিয়েটার খুললেন এবং মাইকেল মধুসূদন দত্তকে তাঁদের থিয়েটারের জন্য দুটি নাটক লিখে দিতে অনুরোধ করলেন । মধুসূদন সম্মত হলেন কিন্তু একটি শর্তে, নাটকে স্ত্রী চরিত্রের রূপায়ণ মেয়েদের দিয়েই করাতে হবে । উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, সেইসময় বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণী থিয়েটার সম্পর্কে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন । থিয়েটারের দরজা সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত হয়ে গেছে ১৮৭২এর ৬ই ডিসেম্বর ন্যাশানাল থিয়েটারের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে । ভালোভাবে থিয়েটার পরিচালনার জন্য বেঙ্গল থিয়েটার একটি উপদেষ্টা সমিতি গঠন করেছিল । উপদেষ্টা মন্ডলীতে ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, উমেশচন্দ্র দত্ত প্রমুখ । অভিনেত্রী নিয়োগ সংক্রান্ত জরুরি সভায় বিদ্যাসাগর বিরোধীতা করলেন থিয়েটারে অভিনেত্রী নিয়োগের । উমেশচন্দ্র দত্ত ও মধুসূদনের সমর্থন পেয়ে বেঙ্গল থিয়েটার কর্তৃপক্ষ বিদ্যাসাগরের মত মানুষের বিরোধিতাও অগ্রাহ্য করে বারাঙ্গনাপল্লী থেকে চারজন অভিনেত্রীকে নিয়োগ করলেন যাদের একজন ছিলেন গোলাপ সুন্দরী । ১৮৭৩ সালের ১৬ই অগস্ট মধুসূদনের ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক দিয়ে বেঙ্গল থিয়েটার তার যাত্রা শুরু করলো । নাট্যাভিনয়ে পুরুষের একচেটিয়া অধিকার খর্ব করে থিয়েটারে নারীদের অংশগ্রহণও শুরু হল সেইদিন থেকে । শুরু হলো সেকালীন রক্ষণশীল সমাজের প্রবল বিরোধিতা অগ্রাহ্য করে । এ ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা । নারীদের থিয়েটারে অংশগ্রহণের প্রথম প্রবক্তা মধুসূদন দত্ত অবশ্য এই যুগান্তকারী ঘটনা দেখে যেতে পারেন নি । থিয়েটারে গোলাপ সুন্দরীদের পথচলা শুরুর আগেই তাঁর দেহাবসান হয় (২৯ জুন, ১৮৭৩) ।

মেয়েদের জন্য থিয়েটারের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ায় অন্ধকার জগতের মেয়েরা মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার একটা অবলম্বন পেলেন । তাদের একটা তাগিদ ছিল – মুক্তির তাগিদ । থিয়েটারকে তাই তারা নিজেদের মুক্তিতীর্থ মনে করলেন, থিয়েটারকে ভালোবেসে পবিত্র হতে চাইলেন । এই পথ ধরেই থিয়েটারে এসেছিলেন গোলাপসুন্দরী, বিনোদিনী, তারাসুন্দরী, কুসুমকুমারী, কৃষ্ণভামিনীরা । বস্তুত, নাট্যাভিনয়ে তাঁদের যোগদানের কারণেই বাংলা থিয়েটার তার শৈশব কাটিয়ে পুরো মাত্রায় পেশাদারী হয়ে ওঠার দিকে পা বাড়িয়েছিল । গোলাপসুন্দরী, বিনোদিনীরা বাংলা থিয়েটারের নির্মাণে ঐতিহাসিক গুরুত্ব দাবী করে । পরবর্তী সত্তর/আশি বছর বাংলা থিয়েটারকে আলোকিত করেছেন, সমৃদ্ধ করেছেন এরাই ।

পরিতাপের কথা আমাদের সমাজ পঙ্কজা থেকে মহিয়ষী হয়ে ওঠা এই সব নারীদের প্রাপ্য মর্যাদা দেয় নি, দিতে চায় নি । গত বৎসর নটী বিনোদিনীর সার্ধশত জন্মবর্ষ উদযাপনের সুবাদে কিছু আলোচনা হয়েছে, আমরা নাটক ও মঞ্চের জন্য বিনোদিনীর ত্যাগ ও বঞ্চনার কথা জেনেছি । কেমন করে সমাজের গভীর অন্ধকার স্তর থেকে উঠে আসা এক অসহায় নারী তাঁর তন্ময় সাধনায় ও দুরূহ সিদ্ধি আয়ত্ব করেছিলেন, স্থায়ী রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন এবং খ্যাতির শীর্ষ বিন্দু স্পর্শ করেও নীরবে মঞ্চের অন্তরালে চলে গিয়েছিলেন বঞ্চনার শিকার হয়ে মাত্র তেইশ বছর বয়সে, তা ভাবলে বিস্ময়ে হতবাক হতে হয় । রঙ্গালয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগের ছাব্বিশ বছর পরে, ৪৯ বছর বয়সে, বিনোদিনী তাঁর আত্মজীবনী ‘আমার কথা’ গ্রান্থাকারে প্রকাশ করেন । তার আগে এবং পরেও বিনোদিনীর লেখনি চর্চা অব্যাহত ছিল । প্রকাশ করেছিলেন ‘বাসনা’ এবং ‘কনক ও নলিনী’ নামে দুটি কাব্যগ্রন্থ । কিন্তু বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা আত্মজীবনী লেখিকার মর্যাদা কিংবা দুটি কাব্যগ্রন্থের লেখিকার মর্যাদা বিনোদিনী পান নি । বারারাঙ্গনা কুলোদ্ভবা যে !

বিনোদিনীর মস্তক স্পর্শ করে রামকৃষ্ণদেব আশির্বাদ করেছিলেন, এক সমভ্রান্ত পুরুষ শিশুকন্যা সহ বিনোদিনীকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে আশ্রয় দিয়েছিলেন। সমাজের মানী লোকেরা যারা তাঁর অভিনয় দেখার জন্য রাতের পর রাত প্রেক্ষাগৃহে ছুটে যেতেন, তাঁকে ধন্যধন্য করতেন, তাঁরা বিনোদিনীর কন্যাকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করতে দেন নি, বাধা দিয়েছিলেন । বিনোদিনী পারেননি তার কন্যা শকুন্তলাকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করতে । শকুন্তলাকে বাঁচাতে পারেন নি বিনোদিনী, ১৩ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয় ।

বিনোদিনী পারেন নি । গোলাপসুন্দরী পেরেছিলেন । গোলাপ তখন স্বনামে সুকুমারী দত্ত । মেয়েকে মানুষ করার জন্য গোলাপ থিয়েটারও ছেড়ে ছিলেন বেশ কয়েক বছর । মেয়েকে শিক্ষা দিয়েছিলেন, প্রচুর অর্থব্যয় করে তার বিবাহ দিয়েছিলেন এক সমভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে । যদিও মেয়েকে দেখার জন্য তার শ্বশুর গৃহে প্রবেশের অধিকার তাকে ত্যাগ করতে হয়েছিল । জানা যায় সুকুমারীর নাতি বিহারের এক প্রসিদ্ধ ডাক্তার হয়েছিলেন । 

মাইকেল মধুসূদনের পরামর্শে বাংলা থিয়েটারে আসা প্রথম চার অভিনেত্রীর একজন গোলাপ সুন্দরী বা সুকুমারী দত্তর অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরার সংগ্রাম বিস্ময়কর । সাহায্য পেয়েছিলেন এক মহতী হৃদয় মানুষের, তিনি বেঙ্গল থিয়েটারের নাট্যপরিচালক উপেন্দ্রনাথ দাস । উপেন্দ্রনাথ গোলাপের বিবাহ দিয়েছিলেন থিয়েটারেরই এক অভিনেতা গোষ্ঠবিহারী দত্তর । এই ঘটনায় তখনকার সমাজে প্রবল নিন্দাবাদ হয়েছিল । উপেন্দ্রনাথকে পিতৃসম্পর্কও ত্যাগ করতে হয়েছিল । গোষ্ঠবিহারী – সুকুমারীর মর্যাদাপূর্ণ দাম্পত্যজীবনের ব্যবস্থা উপেন্দ্রনাথ করেছিলেন । তারা ভদ্রপল্লীতে বাসা বেঁধে ছিলেন । এই সময় উপেন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর পিতার সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হয় । তিনি উপেন্দ্রনাথকে বিলাতে পাঠিয়ে দেন । উপেন্দ্রনাথকে অনুসরণ করে গোষ্ঠবিহারীও জাহাজের খালাশি হয়ে বিলাত চলে যান । গোলাপ স্বামী পরিত্যক্তা হন ।

সুকুমারী কিন্তু থেমে থাকেন নি । গোষ্ঠবিহারী তাঁকে ত্যাগ করে চলে যাওয়ায় নিদারুণ অর্থকষ্টে পড়লেন । সেখান থেকেই ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা শুরু করলেন। মেয়েদের নাচ ও অভিনয় শেখাবার একটা স্কুল খুললেন । কিন্তু বেশি দিন চালাতে পারলেন না। ন্যাশানাল ফিমেল থিয়েটারের উদ্যোগে শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য নাটক করলেন । ইতিমধ্যে এক সহৃদয় মানুষ, নবভারত পত্রিকার সম্পাদক, বাবু দেবপ্রসন্ন রায়চৌধুরী সুকুমারীর কন্যার শিক্ষা ও প্রতিপালনের দায়িত্ব নিয়েছিলেন । অর্থকষ্ট সামাল দিতে সুকুমারী নাট্যরচনায় মন দিলেন, নিজের ব্যক্তিজীবন ও নাট্যজীবনের অভিজ্ঞতা উজাড় করে রচনা করলেন ‘অপূর্ব সতী’ নামে একটি নাটক । নাটকটি অভিনীতও হয়েছিল । বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাস সুকুমারীকে প্রথম মহিলা নাট্যকারের স্বীকৃতি ও মর্যাদা দিয়েছে । 

দেড়শো বছর আগে লেখা দুষ্প্রাপ্য নাটকটি গবেষক অধ্যাপক বিজিতকুমার দত্তর সম্পাদনায় পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাডেমি পুনঃপ্রকাশ করে ১৯৯২এ । ‘অপূর্ব সতী’ নাটকটি নানা দিক দিয়েই তাৎপর্যপূর্ণ । শুধু একজন নারী রচিত প্রথম বাংলা নাটকের মর্যাদা পাওয়াই নয়, নাটকে তখনকার সমাজের এক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার কথা, অসহায়া বারাঙ্গনা কন্যাদের কথা তুলে ধরা হয়েছে । উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের সেই সময় বারাঙ্গনাদের সংখ্যা বৃদ্ধি সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি করেছিল । তখনকার নানান সরকারী প্রতিবেদনে এর উল্লেখ আছে । সুকুমারীর ‘অপূর্ব সতী’ নাটকের নায়িকা নলিনী বারবণিতার মেয়ে । সে স্কুলে পড়ে, কবিতা লেখে, লেখাপড়ায় আগ্রহী । বিদ্যাচর্চার মহিমায় সে বুঝতে পারে তার মায়ের বারবণিতা জীবন নরকের জীবন । সে চায় পবিত্র জীবন আর সংসার যাপন । গবেষকদের অনুমান সুকুমারীর জীবনবৃত্তান্তই তাঁর নাটকে প্রতিফলিত হয়েছে ।

সুকুমারী আবার থিয়েটারে ফিরে এসেছিলেন পুরোদমে, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন সেই যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী রূপে । কত বড় অভিনেত্রী ছিলেন গোলাপসুন্দরী সেই বিবরণ পেশ করা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়, আমি বুঝতে চেয়েছি দেড়শো বছর আগে, যখন আমাদের সমাজে নারী নির্যাতনের প্রশ্নে কোন হেলদোল ছিলনা, তখন সমাজের রক্তচোখ অগ্রাহ্য করে এক বারাঙ্গনা কূলজাতা বালিকা কি ভাবে অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরার সংগ্রাম জারি রেখেছিলেন । 

সেকালের অনেক অভিনেত্রীর শেষ জীবন দুঃখময়, নিঃসঙ্গ । গোলাপের শেষ জীবনও কোন ব্যতিক্রম ছিল না । শোকসংবাদ বা সংবাদপত্র প্রতিবেদন দূরের কথা, অনেকের মৃত্যুর তারিখটিরও কোন লেখাজোখা থাকে না । বিনোদিনীর শেষ জীবন নিঃসঙ্গ দুঃখময় ছিল, আর গিরিশ-অর্ধেন্দুশেখর যুগ পেরিয়ে শিশির ভাদুড়ী যুগেও দাপটে অভিনয় করা কুসুম কুমারী শেষ জীবনে হাতিবাগানের রঙমহল থিয়েটারের গেটে দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করতেন । অভিনেত্রী কৃষ্ণভামিনী মৃত্যুর আগে তাঁর সমস্ত সঞ্চিত অর্থ ও সম্পত্তি উইল করে দিয়ে গিয়েছিলেন শিক্ষা বিস্তারের কাজে ও দুঃস্থ মানুষের চিকিৎসার কাজে । কৃষ্ণভামিনীরা ইতিহাস নির্মাণ করেন কিন্তু ঐতিহাসিকের সম্মান অর্জন করেন না, এমনই পরিহাস ! 

১৮৯০-৯১ পর্যন্ত সুকুমারীর নানান রঙ্গমঞ্চে অভিনয়ের সংবাদ জানা যায় । কিন্তু জানা যায় না কবে নিঃশব্দে চলে গেলেন বাংলা থিয়েটারের প্রথম অভিনেত্রী, প্রথম মহিলা নাট্যকার ও প্রথম নারী নাট্যসংগঠক গোলাপসুন্দরী ।





গ্রন্থসূত্র – (১) ‘নাট্য আকাডেমি পত্রিকা’ জানুয়ারি ১৯৯২, (২) ‘রঙ্গালয়ে বঙ্গনটী’ – অমিত মৈত্র, (৩) ‘আমার কথা’ – বিনোদিনী দাসী, ও (৪) ‘বাংলার নট-নটী’ – দেবনারায়ণ গুপ্ত ।



2 comments: