1

ধারাবাহিকঃ নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in


ধারাবাহিক



ছুটি কথা ৭ 
নন্দিনী সেনগুপ্ত


ছুটির দিন, অর্থাৎ রবিবারগুলো আমাদের শিশুকালে সর্ব-অর্থে ছুটির দিন ছিল। কারণ, ঐ দিনগুলোয় আমি বা আমার সমবয়েসী অনেক বাচ্চারাই পড়াশুনা তো দূরের কথা, আজকালকার শিশুদের মত এতরকম নানাবিধ ক্রিয়াকলাপে জড়িত থাকতাম না। একটু বুঝিয়ে বলি, এখন দেখতে পাই, রবিবার মানেই বাড়ির শিশুটির গানের, আঁকার, আবৃত্তির কিংবা সাঁতার, ক্রিকেট, টেনিস বা দাবা এসবের ক্লাস। না, আমাদের শিশুকাল সত্যি এমনটি ছিল না। পড়াশুনা এবং পড়াশুনার বাইরে এতকিছু করে দেখাবার চাপ থেকে আমাদের অভিভাবকেরা আমাদের মুক্তি দিয়েছিলেন। রবিবার মানে ছিল একটা নির্ভেজাল ছুটির দিন এবং খাওয়া-দাওয়ার দিন। সকাল থেকেই শুরু হত, ঐ খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারটা। লুচি-আলুরদম দিয়ে শুরু। মা ক্ষিপ্র হাতে লুচি বেলছে আর ঠাম্মা একের পর পর লুচি ভাজছে। আগুনের তাতে ঠাম্মার ফর্সা মুখটা লাল হয়ে উঠছে। রবিবারে আমাদের বাড়িতে সকালবেলা থেকেই কেউ না কেউ আসতেন। সেই সময় ফোন থাকলেও ফোন করে কারও বাড়ি যাবার রেওয়াজ ছিল না। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন যারা আসতেন, ওইরকম হঠাৎ করেই চলে আসতেন, সর্বদাই তারা স্বাগত ছিলেন। একটা সম্ভাব্য সময় ছিল রবিবার সকালবেলা, কাজেই ঠাম্মা আলুরদম মোটেই কোনও হিসেবনিকেশ করে বানাতো না আর লুচির ময়দা ঠাম্মার ভাষায় ‘বেশ পরিমাণমত মাইখ্যা থুইলাম, মাইনষে আইবো’। হ্যাঁ, রবিবার মানুষজন আসবে, তাই ঠাম্মা প্রস্তুতি নিয়ে রাখত। ‘অতিথি দিনক্ষণ দেইখ্যা আইবো নাকি?’ প্রায়ই বলত ঠাম্মা এমনটি, ঐ একটা কথার মধ্যেই স্পষ্ট করে যেন ব্যাখ্যা করে দিত ‘অতিথি’ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ।

রবিবারগুলো ভীষণ মজা হত, কেউনা কেউ আসতেনই। বাবার অনেক তুতো ভাইবোন বা বন্ধু-বান্ধব, যারা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ঠাম্মাকে ডাকতেন। আমাদের বাড়ির প্রবেশপথ মুখর থাকতো, ‘মাইমা’, ‘মাসিমা’, ‘মাঐমা’ এই ডাকে। সব্বাই এসে ঠাম্মাকে খুঁজতো আগে। অনেকসময় বাবার বন্ধু-বান্ধব এসে বায়না ধরতো যে ‘মাসিমার হাতের রান্না তো খাইই আমরা, আজ মাসিমার হাতের বাজনা শুনবো’। হ্যাঁ, ঠাম্মা অরগ্যান বাজাতো। আমার স্মৃতিতে এরকম মুহূর্ত উজ্জ্বল হয়ে আছে যে ঠাম্মা রান্না করতে করতে হলুদমাখা হাত আঁচলে মুছে এসে হাসিমুখে অরগ্যানের চাবিতে হাত রাখলো আর সারাবাড়িতে ছড়িয়ে পড়লো সুরের আলো। রবিবার সকালবেলার এই গানের আসরের উদ্বোধন করে দিয়ে ঠাম্মা আবার ঢুকে পড়ত রান্নাঘরে। চলতে থাকতো গানের রেশ। বাবা হারমোনিয়াম এবং উদাত্ত কণ্ঠ নিয়ে বসে পড়তো, কখনো কখনো কাকা সঙ্গত করতো তবলা বা ঢোল নিয়ে। যারা আসতেন বাবার বন্ধুরা বা আত্মীয়রা এই সুরের টানে, অনেকেই ছিলেন ভীষণ গুণী। তারাও কেউ গাইতেন, বা কবিতা পাঠ করতেন। রবিবারের সকাল জমজমাট হয়ে উঠতো। 

রবিবারের দুপুর মানেই ছিল ঠাম্মার হাতে রান্না পাঁঠার ঝোল আর ভাত। না, তখন আমাদের রান্নাঘরে মুরগীর প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। অনেক পরে একটা বিশেষ কারণে মুরগী ঢুকেছিল, কিন্তু সে অন্য গল্প। কি করে যেন রবিবার আমি বেশী ভাত খেয়ে ফেলতাম মাংসের ঝোল দিয়ে, ঠাম্মা এবং মা দুজনেই ভারি হাসাহাসি করতো এই নিয়ে। কিন্তু আমি দুপুরে ঘুমাতে চাইতাম না কিছুতেই, কারণ ঐ রবিবারের দুপুরটাই ছিল ঠাম্মার কাছে গল্প শোনবার সময়। দুপুরবেলার খাওয়াদাওয়ার পাট চুকলে ঠাম্মাকে কোনদিন বিছানায় শুয়ে গড়াতে দেখিনি। কোনও সেলাই-ফোঁড়াই অথবা গল্পের বই নিয়ে বসে যেত। গল্পের বই বাড়িতে যা ছিলো তাতে ঠাম্মার মোটেই কুলিয়ে উঠতো না। অতএব, ঠাম্মা ছিল ঢাকুরিয়া পাব্লিক লাইব্রেরীর মেম্বার। প্রতি সপ্তাহে নিজে লাইব্রেরীতে যেতো বা কাকাকে পাঠাতো বই বদলে নতুন বই নিয়ে আসবার জন্য। প্রচুর গল্প মুখে মুখে বলে যেতে পারতো। রামায়ণ-মহাভারত থেকে শুরু করে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা-সংগ্রামের কাহিনী, মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল থেকে শুরু করে রুশ বিপ্লব, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ- যেকোন বিষয় নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলে যেতে পারতো ঠাম্মা। ঠাম্মার কাছে গল্প শুনতে বসলে অবধারিত ভাবেই এসে পড়তো ঠাম্মার বাপের বাড়ি, বার্মা(অধুনা মায়ানমার)-র কথা। ঠাম্মা হয়তো বুঝতে পেরেছিল যে আর কোনদিন রেঙ্গুনে যেতে পারবে না, তাই বারে বারে সেই স্বপ্নের দেশের কথা বলতো, বলতো এক অদ্ভুত প্যাগোডার কথা, যার চূড়া সোনা দিয়ে বাঁধানো। আর বলতো সে দেশে মেয়েমানুষের দাপটের কথা। বলত, ‘আরে ঐ দ্যাশের পুরুষগুলান এক্কেরে অকর্মণ্য, মাইয়ারাই ঐ দ্যাশ চালাইতাসে, তাই তো ঐ মাটি এমন সুন্দর আর নদী, কত সুন্দর সুন্দর নদী যদি দ্যাখস কি কমু ; ইরাবতী, রেঙ্গুন, পেগু, মিটমাকা —কি নীল, কি নীল জলের রঙ!’ ঠাম্মার গল্প শুনতে শুনতে বিকেল গড়িয়ে যেত। পশ্চিমের বারান্দা গলে শেষ সূর্যের আলো এসে পড়ত ঠাম্মার রূপালী চুলে আর হীরার কানফুলে; ঐ ঝিকিমিকি আলো দেখতে দেখতে আমার মনে হত যে শোয়েডাগন প্যাগোডার সোনার চূড়া কি আর এর থেকেও সুন্দর! 

ঠাম্মার চরিত্রে যে জিনিসটা ঐ শিশুবেলাতেই আমার নজরে পড়েছিল তা হল অসম্ভব ধৈর্য। হাসিমুখে অবলীলায় সারা বাড়ির দরজা-জানালার পর্দা সেলাই করে ফেলতো অবিশ্বাস্য রকমের কম সময়ের মধ্যে। আমি দোকান থেকে কেনা ফ্রক বিশেষ পরতাম না, আমায় খুব সুন্দর সুন্দর কাট এবং ডিজাইনের ফ্রক ঠাম্মাই বানিয়ে দিত। অনেকেই দেখে জানতে চাইতো কোন দর্জি সেলাই করেছে। আমাদের সময় প্রাইমারী স্কুলেও সেলাইয়ের ক্লাস বলে একটা বিভীষিকা ব্যাপার ছিল। কিন্তু ঠাম্মা আমাকে হাতে ধরে পরম ধৈর্যের সঙ্গে এত সুন্দরভাবে নানা রকমের সেলাই শিখিয়েছিল যে ঐ ক্লাসে আমায় কোনও দিন বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। 

আর একটা ব্যাপার ঠাম্মার চরিত্রে যেটা ছিল সেটা হল এক অদ্ভুত সংস্কারমুক্ত মন। ঐ সময়ে ঠাম্মার সমবয়েসী কোনও মহিলার মধ্যে আমি এই জিনিস দেখেছি বলে মনে পড়েনা। ধর্মাচরণ যে কোনও মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত গোপনীয় ব্যাপার, এই মতে ঠাম্মা বিশ্বাস করতো এবং জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই বিশ্বাস অটুট ছিল। এই ব্যাপারে এমনকি ঠাকুরদার সঙ্গেও তীব্র মতপার্থক্য ছিল। ঠাম্মা পূজার্চনা, উপবাস করে ব্রতপালন ইত্যাদির পরিবর্তে বই পড়ে সময় ব্যয় করা অধিক পছন্দ করতো। কিন্তু বাড়িতে পূজার সময় নিয়ম-কানুন, আচার-ব্যবহার এই ব্যাপারে জ্ঞানগম্যি কোনও অংশে কম ছিল না। ঠাম্মার হাতের ভোগের রান্না খিচুড়ি আর লাবড়া তরকারি খাবার লোভে লক্ষ্মীপূজার দিন বাবার বন্ধুবান্ধবরা ভিড় করে চলে আসতো আমাদের বাড়ি। পূজানুষ্ঠান অধিকাংশ সময়ে ছিল মানুষের মিলনোৎসব, আনন্দের হাট। আজ যখন এই অশান্ত সময়ে দেখতে পাই মানুষজন ধর্মের জিগির তুলে তুল্যমূল্য বিচারে রাজনৈতিক বা নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির কাজে ব্যস্ত, তখন ঠাম্মার কথা খুব মনে পড়ে। আজ ছুটিকথায় ঠাম্মার কথাই লিখলাম বেশী করে, কারণ সদ্য সদ্য পেরিয়ে আসা আন্তর্জাতিক নারী দিবসে যেন নতুন করে অনুভব করলাম আমার জীবনে গভীরভাবে প্রভাব রেখে যাওয়া এই মানবীর কথা, যে প্রায় তিন যুগ আগে এক সংস্কারমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখেছিল।

1 comment: