0

ছোট গল্পঃ সকাল রয়

Posted in


ছোট গল্প


চিরচেনা অসহায়ত্ব
সকাল রয়





০১.
সাহেরা চলে গেছে দূর দিগন্তে। হয়তো তারা হয়ে আছে। হয়তো মিটিমিটি আলো দেয়। হয়তো খানিকটা আফসোসও করে মিটিমিটি আলো নিয়ে জোনাক জ্বলা রাতে। তারা হয়ে থাকে আকাশে। আকাশে তার বাড়ি এখন। সে মরহুমা সাহেরা।

যে দুটো জীবন সে এনে দিয়েছিলো ধরণীর বুকে তার উপহার স্বরূপ তাকে অন্তিম বিদায় দিয়েছে ধরণী। তাকে বিদায় দিয়েছে গগনবিদারী চিৎকার সমেত। সে অসহায় ছিলো; উত্তাল জোয়ারে যেমন অসহায় থাকে জেলেরা নিজেকে নিয়ে ঠিক তেমনটাই ।

নারী হয়তো কখনো কখনো সব সইবার জন্যই তৈরি থাকে। থাকে অবলীলায় মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে। 

আর তাই সাহেরার জীবনে ঘটে গেছে সেটা। ছেড়ে গেছে তার প্রিয় আবাস ভূমি ও তার প্রিয় সন্তানদের। আজ তার ছোট্ট মেয়েটা ট্যা ট্যা করে কাঁদে এক ফোটা দুধের জন্য; বুড়ো দাদী রওশন বিবি দুধ যোগান দিতে হিমশিম খায়। কিন্তু সন্তানের জন্মদাতা সাহেরার স্বামীর ভ্রুক্ষেপ নেই সেদিকে। মায়ের সাথে সাথে সন্তানটাকেও অপরাধীর চোখে দেখে।

স্বামীর চোখে অপরাধ হয়েছে মস্ত। সাহেরার কেন সে পুত্র সন্তান জন্ম দিতে পারলোনা? সে নারী, সে মায়ার শিকলে বন্দি একজন মা। সে মাতৃত্বের স্বপ্ন গায়ে জড়িয়ে পেটে ধরেছিলো সন্তানটাকে। কিন্তু ধরনীর বুকে যে মুখটির আবির্ভাব ঘটলো সেটা তো ট্যা ট্যা করে কাঁদছে; তার কান্না আজ ঘুরে ফিরে আসছে বাতাসে ভেসে ভেসে। আকাশ ফাটিয়ে সাহেরার বলতে ইচ্ছে করে হতভাগী পোড়ামুখী কাঁদ আরো জোরে, একফোঁটা দুধও মিলবে না গগন ফাটা চিৎকারে। গগন ফাটা, তবু আওয়াজ পৌঁছাবে না তোর জন্মদাতার কানে; সে বধির হয়েছে!

কিন্তু সেই জন্মদাতা বধির হলেও হাতটা তার বড় সেয়ানা। যে হাতে সে তোকে আদর করবে; সে হাত খুনির হাত রক্তে রঞ্জিত হবার; কিংবা সে হাত শ্বাসরুদ্ধ করবার। সে হাত আস্তাকুঁড়ে ও ফেলতে পারে! পোড়ামুখী তুই যতো জোরে পারিস কাঁদ!
তবুও যদি সাড়া মেলে...



০২. 
সময়টা তখন আকালের। সেই আকালের দিনে এক দুপুরে সাজ সাজ রব। লাল নীল কাগজে রাঙানো উঠোনে নতুন বউ হয়ে দাড়িয়ে আছে সাহেরা। চারপাশ থেকে সুন্দর আমেজে নিয়ে আসে তার স্বপ্নরা; একটা সুন্দর সংসার বাঁধবে বলে। সাহেরা ভালোবাসার আবেশে কাছে টেনে নেয় পতি দেবতাটিকে। ঘর সংসারের কাজের ফাঁকে দু’জনার খুনসুটি জমে উঠে সকাল দুপুর। কখনো কখনো মান অভিমানের পালা চলে। এভাবেই কাটে দিন এক সময় নতুন অতিথির আগমনি বার্তা আসে। স্বভাবতই বাবা হবার আহ্লাদে খুশি হয় সাহেরার স্বামী। বাবা ডাক শোনার আকুলতাটা তাকে পেয়ে বসে। এক ভর বিকেলে এক হাড়ি মিষ্টি তুলে দেয় সাহেরার হাতে, সবাই মিষ্টি মুখ করে। কিন্তু সময়ের ধারা বয়ে যে নতুন অথিতি আসে, প্রথম সন্তানের আনন্দটা ঠিক ভাবে তাকে স্পর্শ করতে পারেনা। কন্যা সন্তান হওয়ায় তদ্রূপ তার মনের আকাশে কেমন যেন ক্লেশ জমা হয়।

কপট হাসিতে বলে, কি আর করা যাইবো?

সেই সন্তান কে ঘিরে যখন সাহেরার উচ্ছলতা বাড়ছে ক্রমশই ।

কিন্তু নতুন মুখ পুরোনো হবার আগেই আর একটা নতুন মুখের তাগিদ দেয় সাহেরার স্বামী। একটা ছেলে সন্তান তার চাই-ই-চাই। আমি মইরা গেলে তোরে কে দেখবো? একটা পোলা থাকলে তো সমস্যা হইবো না। সাহেরা বলে, মাইয়া আমার পড়ালেখা শিইখ্যা বড় হইয়া আমাগো দেখবো। কিন্তু স্বামী মানে না। একটা ছেলে সন্তানের সুফল বর্ণনায় সাহেরাকে বোঝায়। তাই সে আরেকটা নতুন মুখ ধারণ করে ফেললো পেটে। কিন্তু সাহেরা ঘুনাক্ষরেও টের পেলনা যে ভ্রুনটা জন্মেছে, তা আবারও মেয়ে সন্তান। যদি জানতে পারতো তাহলে হয়তো ঠেকে যেত একটা অকাল মৃত্যু।

সাহেরা জানতে পারেনি। যখন আবারো ভূমিষ্ট হলো কন্যা সন্তান তখন স্বামীর ভালোবাসা আর থাকলো না, বিষের গোলা হতে লাগলো আস্তে আস্তে। শুরু হলো অকথ্য নির্যাতন। এভাবেই চলতে চলতে একদিন শেষ হয় যন্ত্রণা; সেদিন সন্ধ্যেয় আকাশটা থমকে দাঁড়ায় মুখ কালো করে। সাগর কখনো কখনো একটু থামে একটু উত্তাল তরঙ্গ মেলে। কেমন যেন ধূসর লাগে সব । আকাশ কাঁদে, বাতাস কাঁদে। কি যে আহাজারি করেছিলো সাহেরা। পায়ে পড়েছিলো।

সাহেরা বাঁচতে চেয়েছিলো কন্যা সন্তানটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে। সাহেরা বলেছিলো, তুমি দেইখো আমাগো মাইয়া বড় হইয়া লেখাপড়া শিইখা তোমার কষ্ট দূর করবো। হু করবো, কচু করবো –ব’লে রেগে উঠে সাহেরার স্বামী। তারপর পাশে থাকা শক্ত কাঠের টুকরোটা তুলে মাথায় বসায় রক্তের একটা ধারা বয়ে চলে...



০৩.
মায়ের কাছে সন্তান সবচেয়ে দামি। হোক সে ছেলে কিংবা মেয়ে। হোক সে বাকশূন্য কিংবা অন্ধ। সন্তানের মূল্য মায়ের চোখে কখনো কমতি হবার নয়। তার সেই কন্যা সন্তান আজ কাঁদছে এক ফোটা দুধের জন্যে। কান্নাটা ফিরে ফিরে আসছে। যদি না মেলে বেঁচে থাকার উপকরণ গুলো, তাহলে সেও হয়তো একদিন তারা হয়ে জ্বলবে আকাশে সাহেরার মতই।

যদি এভাবেই চেতনা শূন্য হয়ে পড়ে থাকে গ্রাম্য সমাজ তাহলে হয়তো এভাবেই একদিন একটি একটি করে সাহেরা হারাবে অবমূল্যায়নের প্রান্তরে।

শুধু শান্তনা আর উপদেশ দিলেই থেমে যাবেনা এরকম হাজার সাহেরার মৃত্যু। সেই সব পুরুষদের প্রতি রুখে ধারাতে হবে। যারা এখনো ভ্রান্ত পথে চলছে আর নারী সত্তা কে গলাটিপে ছুড়ে ফেলেছে আঁস্তাকুড়ে। তাকে চেতনায় ফেরাতে হবে, কেননা সেও একদিন এসেছিলো পৃথিবীতে কোন এক নারীর অবদানে।

0 comments: