ব্যক্তিগত গদ্যঃ তন্ময় গুপ্ত
Posted in ব্যক্তিগত গদ্য
ব্যক্তিগত গদ্য
ফল্গু
তন্ময় গুপ্ত
(২)
বছর দশেক পর। অফিসের কাজে এসেছি গৌহাটি। কয়েকটা চা বাগান ও চায়ের কারখানাকে পরিদর্শন করার কাজ আছে। চা বাগানের ম্যানেজারটি বেশ তৎপরতার সাথে আমাকে সবকিছু দেখাতে লাগল। সঙ্গের ড্রাইভারটিও বেশ চটপটে, নির্দিষ্ট দিনের দুদিন আগেই সমস্ত কাজ সেরে ফেলা গেল। সেদিন সন্ধ্যা বেলায় ম্যানেজার বলল- “স্যার আপনার ফেরার ফ্লাইট তো আগামী পরশু, হাতে এখনো দুদিন সময়। শিলং-এর আবহাওয়া এখন জবরদস্ত। যাবেন নাকি?”
-যাওয়া যেতে পারে, যদি আপনি সঙ্গে চলেন। হেসে বলি।
-কি যে বলেন, স্যার। আপনি বললেন, এতেই আমি সম্মানিত বোধ করছি। আমি রামদিন কে বলে দিচ্ছি। সে সব ঠিক করে রাখবে। গাড়ী, হোটেল সবকিছু।
পরদিন ভোরবেলায় শিলং পৌঁছে গেলাম। আগেও এসেছি দুবার। শহরটাকে বেশ লাগে আমার। দুপুরে বিশ্রাম নিয়ে বিকেলবেলায় বেরিয়ে পড়লাম। পোলিশ বাজার শিলং এর মুখ্য বাজার। উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছি। একটা দোকানের শো-কেস এর সামনে দাঁড়িয়ে কি কেনাকেটা করা যায় ভাবছি, হঠাৎ মনে হল একটা লম্বা লোক যেন দ্রুত সরে গেল। কেউ কি আমার পিছু নিয়েছে? শিলং এমনিতে খুব নিরাপদ। এছাড়াও রামদিন একটু তফাতে থেকে নিঃশব্দে ছায়ার মতো আমার ওপর নজর রাখছে। আমি তাই চাপমুক্তই আছি। দোকানে ঢুকে স্থানীয় বাসিন্দাদের হাতে তৈরি একটা জ্যাকেট কিনলাম।
শিরশির করে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। বাইরে বেরিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়েছি, হঠাৎ পিঠে একটা থাবড়া –হেইই বাপি! তুই?
আমি প্রচণ্ড চমকে ঘুরে দাঁড়ালাম। দেখি একগাল হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার ছোটবেলার সেই খ্যাপাটে বন্ধু-শোভন।
-আরিব্বাস! তুই? এখানে?
-আরে, আমিতো এখন এখানেই পোস্টেড।
-তাই নাকি? বাহ্। তো বাড়ি যাস না? কলকাতায়?
-না রে! ভাল্লাগেনা।
আমি চুপ করে গেলাম। কথা ঘুরিয়ে বললাম-কফি খাওয়াবিনা? ব্যাটা কিপটে?
বলেই দুজনে হোহো করে হেসে উঠলাম।
-কফি কিরে? চ’ আজ তোকে ডিনার করাব।
রামদিনের সাথে আলাপ করিয়ে দিই-মেরা বচপন কা দোস্ত।
কিছুদূর এগোতেই আমায় অবাক করে দিয়ে একটা বছর দশেকের ফুটফুটে ছেলে দৌড়তে দৌড়তে এসে শোভনের কোমর জড়িয়ে ধরল।
-কত্ত দেরি করছ বাপি? আমরা আরও কতক্ষণ ওয়েট করব?
আমি অবাক হয়ে শোভনের মুখের দিকে তাকাই। শোভন হাসি ছড়িয়ে বলে-সান্নি। আমার ছেলে। বাবা এই দেখো-বাপী কাকু।
ছেলেটা ঝপ করে নিচু হয়ে আমায় প্রনাম করল। ফর্সা টুকটুকে। ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল। আমি আদর করে দিলাম। শোভন একটা রেস্টুরেন্টএর সামনে এসে বলল-সান্নি, তুমি কাকু কে নিয়ে মাম্মির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দাও। আমি ডিনার-এর অর্ডারটা দিয়েই আসছি।
আমায় বলল-যা ব্যাটা। আমার বৌয়ের সাথে পরিচয় কর গিয়ে। আমার মুখে তোর অনেক কথা শুনেছে। যা চমকে দে গিয়ে।
আমারও কৌতূহল ছিল। কেমন হল শোভনের বৌ।
ছেলেটা হাত ধরে নিয়ে গেল একটা টেবিলের কাছে। ভদ্রমহিলা দরজার দিকে পিছন ফিরে বসে ছিলেন। সান্নি বলল-মাম্মি, দেখো একটা কাকু এসেছে।
ভদ্রমহিলা মুখ ঘোরাতেই আমি চমকে উঠলাম।–একি? মুন্নি? তুই?
মুন্নিও একই ভাবে চমকে উঠল-আরে বাপীদা! তুমি!
আমি হতভম্ব হয়ে বসে পড়লাম মুন্নির সামনে। এরপর মুন্নি যা বলল তাতে আমি হতবাক।
মুন্নির জীবনে তখন সেই চরম দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে। সদ্য পরলোকগত স্বামী তার চিহ্ন রেখে গিয়েছেন। মুন্নি সন্তানসম্ভবা। অকূলপাথারে পড়ে মুন্নি কি করবে বুঝে উঠতে পারছেনা। ভাস্কর নিজে গিয়ে মুন্নিকে নিয়ে এসেছে বাড়ীতে। শ্বশুরবাড়ীর লোকেরাও মেনে নিয়েছেন যে মুন্নি তার বাবার কাছেই বাকী জীবনটা কাটাবে।
এমন একদিন শোভনকে দেখা গেল। ঝড়ের মতো ভাস্করদের বাড়ি গিয়ে সিধা মুন্নির সামনে দাঁড়িয়ে গিয়ে খেঁকিয়ে বলল-“হয়েছে? লোকের বাড়ীতে গিয়ে থাকার শখ মিটেছে? এবার চল” ভাস্কর বাইরে থেকে সব শুনছিল। সেও বিলক্ষণ জানে শোভনের আচার-ব্যবহার। এবার ঘরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করে-“কি করতে চাস তুই শোভন”? শোভন সপাটে উত্তর দেয়, “ওকে আর আলাদা রাখবনা। আমার কষ্ট হয়। তুই ব্যবস্থা কর”।
-“তুই সবকিছু জানিস?”
-“জানি,সব জানি। কিছুদিনের মধ্যে আমি বাবা হ’ব, এও জানি”।
মুন্নি বলতে চায়, এ হয়না।
শোভন ছোটবেলার মতই ধমক দেয়-“তোকে কে পাকামো করতে বলেছে?”
মুন্নির বাড়ীর লোকেরা প্রচণ্ড অবাক হয়। শোভন ছোটবেলা থেকে তাদের বাড়ি যাতায়াত করেছে, কিন্তু কেউ কোনদিন শোভনের মনের মাঝের এই ফল্গু নদীর হদিশ পায়নি।
শুধু মুন্নি জিজ্ঞাসা করে ছিল-“দয়া করছ?” ওর প্রশ্ন শুনে খেপে গেছিল শোভন।
যথারীতি বলেছিল-“মারব একটা কিল? অনেক তো কষ্ট দিলি এবার দয়া কর। আমি কি করব? কষ্ট হয়। তোকে ছাড়া আমার কষ্ট হয়। অসুবিধা হয়। হয়েছে”?
এরপর রেজিস্ট্রি ম্যারেজ, সান্নির জন্ম আর সবাই মিলে শিলং-এ চলে আসা।
এই ঘটনা বলে মুন্নি বলল- ব্যাপীদা, ও খ্যাপা ভোলানাথ।
শোভন এসে হাসতে হাসতে বলল- কিরে? কেমন বুঝছিস?
আমি হাসব কি রাগব! ওকে বেশ কয়েকটা বাছা বাছা গালাগালি দিতে ইচ্ছে হচ্ছিল, কিন্তু তাও হলনা। সান্নি আছে সামনে।
সবাই মিলে বসলাম। অর্ডার সার্ভ করা হয়ে গেছে। আমার পাশে সান্নি, সামনে শোভন আর মুন্নি। মুন্নি খাওয়া শুরু করতে যাবে এমন সময় শোভন খেপে গেল-“আবার? দেখলি দেখলি বাপী? তোকে বলেছিলাম না?”
-কি হল রে?
-হাত ধোয় নি । নোংরা।
এই বলে পরম স্নেহে মুন্নির হাত টা সযত্নে ভেজা রুমাল দিয়ে মুছিয়ে দিতে লাগল। আনন্দাশ্রুতে আমার দু চোখ ভিজে গেল। আমি শোভন-মুন্নির “সান্নি’ কে আদর করতে লাগলাম, আর অনুভব করলাম প্রেম যতো পুরনো হয়, ততই পবিত্র হয়, খাঁটি হয়, গাঢ় হয়।
0 comments: