0

ছোটগল্পঃ মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী

Posted in










ছোটগল্প


আয় বৃষ্টি ঝেঁপে 
মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী



আকাশ আজ শিখার মনের সাথে তাল মিলিয়েছে, চোখের জল ঝরেই চলেছে। বৃষ্টিস্নাত শহরের কোনো একটা ঘিঞ্জি পাড়ায় শিখার শ্বশুরবাড়ি। যে পাড়ায় বৃষ্টি একটুও রোম্যান্টিক নয়; সেখানে বৃষ্টি একটা উৎপাত, জল জমে যায় এক হাঁটু, চতুর্দিকের নোংরা ময়লা জলের সাথে দৌড়য়; শিখার মানসিক অবস্থাও যেন আজ কতকটা ওই রকমই। ছাদের থেকে আধভেজা কাপড় জামা নামিয়ে এনে ঘরে টাঙানো দড়িতে মেলছে। মেয়ে দুটো স্কুলে গেছে ওদের কোনো বিপদ না হয়, মন খানিকটা সেদিকেও। আবার নিজের বর্তমান পরিস্থিতির সাথে কি করে মানিয়ে নেবে, সেই ভেবে বড্ড কষ্ট হচ্ছে। একজন কেউ যদি থাকত যার কাছে মন খুলে সব বলতে পারত, যে তার দিকে আঙ্গুল তুলত না। 

শিখা নিজেও বুঝতে পারছে সে ক্রমশঃ অতলে তলিয়ে যাবে, তবু সাময়িক আনন্দ টুকুর যে তার জীবনে কি অর্থ বহন করে সেটা বোধহয় একমাত্র সে ই বোঝে। শোবার ঘরের জানলা দিয়ে পাশের বাড়ির কচুর জঙ্গলে বৃষ্টি দেখতে লাগল। চোখ পাল্লা দিচ্ছে দিক, আজ একটুও থামাতে চায়না সে, কোনো একটাদিন তো অন্ততঃ প্রাণ ভরে সে যা চায় করুক, আর কিছু না হলে কান্নাটাই প্রাণ ভরে কাঁদতে চায়। 

বিধবা মায়ের বড় মেয়ে সে, সাধারণ বাঙালি ঘরের সুন্দরীর পর্যায়ে পড়ে। লম্বা, ফর্সা, হাত পায়ের নিটোল গড়ন, কাজল কাজল টানা চোখ সদা হাস্যময়ী। বিয়েবাড়ি টাড়িতে সাজলে গুজলে লোকের দৃষ্টি পড়েই ওর ওপর। পড়াশোনা চালাচ্ছিল দিব্যি, হঠাৎ বাবার মৃত্যু সব এলোমেলো করে দিলো। মা তাদের খাবারের সংস্থান করবে, না লেখাপড়া শেষ করাবে, না সুযোগসন্ধানী দের নোংরা থাবা থেকে বাঁচাবে। আশ্রমের গুরু বোন একজন বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে এলেন। একই আশ্রমের বিশাল ভক্ত বোসমশাই, যাঁর বড় বাজারে দোকান তাঁরই অকালকুষ্মান্ড ছোটোছেলের সাথে। বোসমশাই জিরো থেকে শুধু নিজের চেষ্টায় কোটিপতি হয়েছেন। পা তাঁর এখনও মাটিতেই, গরীবদের জন্য অবারিত দ্বার, প্রসারিত হস্ত। স্বাভাবিক ভাবেই বোসমশাই ও তাঁর স্ত্রীয়ের এক দর্শনেই পছন্দ হয়ে যায় শিখাকে। বেশিরভাগ মেয়েদেরই স্বপ্ন থাকে যে, কেমন স্বামী কেমন শ্বশুরঘর হবে। নিজে সুন্দর হলে একজন সুন্দর সুপুরুষ কেই স্বামী হিসাবে পাবার বাসনা থাকে। শিখার শ্বশুরঘর, শ্বশুর শাশুড়ি অসম্ভব ভালো হলেও স্বামী যেমন কুশ্রী, তেমন বিশ্রী তার স্বভাব। কি করবে পিতৃহারা হলে বোধহয় এমনটাই হয়, যে কারোর গলায় ঝুলিয়ে পরিত্রাণ পায় মা। অমন মানুষকে শ্বশুর হিসাবে পাওয়া সত্যি ভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু ঘর করবে যার সে যদি পছন্দসই, মানানসই, এমনকি কাজ চালানোর মতোও না হয়, তবে? 

তবু তাকে নিয়েই খুশী আছি, এমনটাই দেখাতে হয় সংসারকে। শিখার তুলনায় তার স্বামী সব দিক দিয়ে পিছনে, কি রূপ, কি গুন, কি পড়াশোনা। ঠিক মতো দোকানের দেখভালও করতে জানেনা ছেলেটা, সব কিছুতে হাত তোলা হয়ে থাকতে হয়। নিজের দুর্ভাগ্যকে মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনো রাস্তাও নেই শিখার। নিতান্ত জৈবিক এবং সামাজিক কারণে সন্তান ধারণ করতে হয়েছে, দ্বিতীয় বারে আশা ছিলো, যদি পুত্র সন্তান হয় -তাহলে সংসারে তার কথার দাম তা ও থাকবে। কারণ বাড়ির বড়বৌ এর দুটিই মেয়ে, শিখার প্রথমটিও তাই। মেয়েদের যে অবহেলা হয় এই সংসারে, তা নয়। তবু পুত্র সন্তানের আকাঙ্ক্ষা একটা আছেই টের পায় শিখা। আর তার থেকেও বেশি করে যেটা বোঝে, একই রকম না হয়ে একটু অন্য হলেই তার কদর পাল্টে যেতো। মানে যদি এমন হোতো বাড়িতে সব ছেলে তার একটা মেয়ে হোলো, তাতেও কিন্তু একইরকম সমাদর পেতো। সত্যিই পোড়া কপাল। দ্বিতীয়টি ও মেয়ে হওয়ায় বোঝা বাড়ল, কিন্তু অবস্থানের পরিবর্তন কিছুই হোলোনা। 

"ছোটি" মাথায় একটা স্নেহের পরশে চমকায়, রিমঝিম কখন এসে যেন দাঁড়িয়েছে পিছনে। আকুল হয়ে খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো রিমঝিমকে জড়িয়ে ধরে, কান্নার বেগ বাড়ে। কতো সময় কাঁদার পর ক্লান্ত হয় শিখা, ক্ষান্তও। রিমঝিম কিচ্ছুটি না বলে শুধুই মাথায় হাত বুলিয়েছে, শিখার বোধহয় এই কোলটুকু দরকার ছিলো। রিমঝিম তার ননদ হলেও নিজের দিদির মতোই ভালোবাসে তাকে। দুনিয়ায় সবাই তাকে দোষারোপ করেছে দুই সন্তানের মা হয়েও সে কেন সম্পূর্ন অপরিচিতের প্রেমে পড়েছে। কেউ এটা বুঝল না শিখার মনের খামতিটা রয়েছে, সে তার স্বামীর থেকে যেটা পায়নি, স্বামীর মধ্যে যেটা পায়নি, সেটা যদি অন্য কারোর মধ্যে পায় -তাতে তার মন চঞ্চল হওয়া কি খুব অন্যায়? শিখা ভুল পদক্ষেপ নিয়ে থাকতে পারে, কিন্তু দোষ করেছে বলার আগে বোধহয় দু'বার তার পরিস্থিতিটা ভাবা উচিত। কিচ্ছু পায়নি যে মেয়েটা সে যদি হঠাৎ দুই সন্তানের জননী হবার পরেও রূপের প্রশংসা পায়, স্বাভাবিক ভাবেই বোঝার ক্ষমতা হারিয়ে যায় -যে প্রশংসা করছে, সে সত্যি বলছে, না কি সুযোগ নিচ্ছে। 

ফেসবুক, এমন এক অদ্ভূত দুনিয়া যেখানে সব যেন হাতের মুঠোয়। কতো সেলিব্রিটি দের সাথে সরাসরি যোগাযোগ হয়ে যায়। কতো পরিচিত পুরোনো বন্ধুকে খুঁজে পাওয়া যায়, পৃথিবীর উল্টো পিঠে থাকা ভাই বোনদের খোঁজখবর রোজ রাখা যায়, যা হয়ত এমনিতে অসম্ভব মনে হত, আবার নতুন বন্ধুও হয়। আর নিজের প্রশংসা শুনতে কারই বা মন্দ লাগে? নিজের একটা ছবি পোস্ট করলেই পূর্বপরিচিত নতুন পরিচিত সকলে এমন প্রশংসার বন্যা বইয়ে দেয়, মনে হয় দুনিয়ায় আমারও কদর আছে, কিছু মূল্য আছে। শিখা হঠাৎই সন্ধান পায় সেই অলীক জগতের। যেখানে অপর প্রান্তে কে আছেন না জেনেও দিব্যি তার সাথে কথপোকথন চালানো যায়। 

তেমনই এক বন্ধু অলোক, ফেসবুকের দৌলতে পরিচয়। পরস্পরকে শুধু ছবিতে দেখেছে, ইনবক্সে কথা বলেছে। অলোকের মতে তার সাথে শিখার রুচির অনেক মিল। আর তাই ক্রমশঃ বন্ধুত্ব গাঢ় হতে শুরু করে। শিখা নিজেকে সকলের সামনে সুখী দম্পতি হিসাবে উপস্থাপনা করলেও অলোক তার সাথে কথা বলতে বলতে কেমন করে যেন ঠিক সন্ধান পেয়েছে শিখার মনের ক্ষতটার। সুপুরুষ অলোকের দাবী সে দারুণ ভালো চাকরী করে, আর কথা প্রসঙ্গে জানায় সে শিখার দুঃখে ব্যথিত। অলোক নাকি শিখাকে ভালোবেসেছে, আর সেই সূত্রেই শিখার এমন অসম বিয়ে এমন লোকদেখানি প্রেমবিহীন জীবন দেখে কষ্ট পাচ্ছে সে। স্বাভাবিক ভাবেই এতো সুন্দর কথায় মন গলতে শুরু করেছে শিখার। 

সেদিন দুপুরে ঘরে সকলের অনুপস্থিতিতে অলোক এসে উপস্থিত হয়, সারাটা দুপুর একটা অবিবাহীতা কলেজে পড়া মেয়ের মতো প্রেমের ছোঁওয়া পেয়েছে, লজ্জা পেয়েছে, ভালো লাগার অনুভূতি টের পেয়েছে প্রথমবার। কিন্তু ধরা পড়ে গেছে শ্বশুড় বাড়ীর কাছে, ছিছিক্কারে ভরে গেছে ওর জীবন। শিখাদের যে নিজের ইচ্ছে মতো কিছুই করতে নেই; কারণ পিতৃহারা, কারণ স্বামীর ট্যাঁকের জোর নেই। 

রিমঝিম পুরো ঘটনা শুনে সে সবার থেকে অনুমতি নিয়েছে শিখাকে বোঝানোর। একটা মেয়ে হয়ে, একটা মেয়ে সন্তানের মা হয়ে রিমঝিম কি করে তার বোনসম আরেকটা মেয়ের কষ্ট লাঘব না করে? যতো তাকে দোষারোপ করবে সমাজ ততো হয় জেদ করবে শিখা নয় হতাশায় শেষ করে দেবে নিজেকে। নাঃ কোনোমতেই মেয়েটার ক্ষতি হতে দিতে পারেনা রিমঝিম। যে মানুষ পরিবারের অনুপস্থিতির সুযোগে লুকিয়ে চোরের মতো আসে, সে শুধুমাত্র ভোগ করতেই চাইবে, শিখাকে তার না পাওয়াটা কিন্তু পাইয়ে দেবেনা। সে কোনোদিনও দুই সন্তান সহ শিখাকে নিয়ে সংসার পেতে তাকে পূর্ণতার সংসার দেবেনা। বরং শিখার সাথে সাথে তার দুই মেয়ের দিকেও লোভের থাবা বাড়াতে পারে। অলোক যদি সত্যি ভালোবাসত তবে চোরের মতো নয়, বীরের মতো আসত। শুধু কি সুন্দর চেহারা, মিষ্টি কথার ঝুড়ি হলেই হয়? সাহসও লাগে, ভালোবাসার প্রতি ডেডিকেশনও থাকতে হয়। সাথে অলোক যে কথা গুলো দাবী করছে, মানে সে সুচাকুরে বা শিখার রুচির সাথে তার রুচি হুবাহু মেলে -তার সত্যতাই বা কোথায়? শিখাকে ভোলানোর জন্য সে তো মিথ্যাও বলে থাকতে পারে? 

শিখাও যে এগুলো একদম ভাবেনি তা নয়, তবু অলোকের কথাগুলো কেমন মোহময়, শুনতে শুনতে নেশা লেগে যায় শিখার, কিছুতেই এড়িয়ে থাকতে পারেনা। রিমঝিম আরোও বলে যে শিখার ছবি বিকৃত করে তাকে চূড়ান্ত হেনস্থা করতেই পারে অলোক; কতো কতো সহজ সরল মেয়ের জীবন যে দুর্বিষহ হয়েছে এই ভাবে। সমস্ত বিপদের দিক গুলো একে একে রিমঝিম তুলে ধরে শিখার সামনে, আর বুদ্ধি দেয় নিজেকে কোনো ব্যস্ততায় জড়িয়ে ফেলার। ব্যস্ত থাকলে শিখার ভাববার সময় থাকবেনা যে, সে কি কি পায়নি। শিখা কিছু শিখতে চাইলে শিখুক, যদি পড়তে চায় পড়ুক, যদি ব্যবসা করতে চায় করুক। আজকাল হামেশা যেমন করে বাড়ীর বৌরা, তবু অলোকের মতো মানুষদেরকে কাছে ঘেঁষতে না দিক। আর এইসব করলে রিমঝিমদের সবার সাহায্য পাবে সে, কিন্তু প্রেম করে একটা পরিনামহীন জীবনের দিকে ঝুঁকে সকলকে ব্যতিব্যস্ত করলে রিমঝিমের পক্ষেও কিছু করা সম্ভব হয়ে উঠবে না হয়ত। এখন শিখার জীবন হয়ত সুখের নয় তবু স্বস্ত্বি আছে, সিকিয়র্ড তো বটেই। সত্যিকারের প্রেম বড় দুর্লভ বস্তু, তাকে যারা সহজলভ্য করে ফেলে, সে সব মানুষদের চিনতে শুরু করুর শিখা। তাহলেই দেখবে সাময়িক মোহোর থেকে তার এই সংসার, সন্তানরা অনেক প্রিয়, দুনিয়াটার চেহারাই বদলে যাবে।

বৃষ্টি আজ বোধকরি সারাদিন চলবে, চলুক, ধুয়ে দিক সব গ্লানি একটা নতুন ঝকঝকে দিন আসুক শিখার জীবনে। রিমঝিমের কোলে মাথা রেখে আজ কতো দিন পর যেন শান্তিতে ঘুম গেল শিখার।

0 comments: