প্রচ্ছদ নিবন্ধঃ অমৃত অধিকারী
Posted in প্রচ্ছদ নিবন্ধ
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
নার্যায়ণ
অমৃত অধিকারী
গত ৮ই মার্চ, রবিবার, গিন্নির বিধান অনুযায়ী গৃহস্থালীর সব দায়িত্ব আমার ছিলো। দোকান-বাজার, ছেলেমেয়েকে পড়ানোর মতন সাধারণ পুরুষজনোচিত রবিবাসরীয় কর্মগুলি ছাড়াও রান্না, ঘর গোছানো, কাজের মেয়ে, দুধওয়ালা, ধোপা, ইত্যাদিকে ধমকধামক দেওয়া জাতীয় গুরুদায়িত্বগুলিও আমাকেই পালন করতে হয় সেদিন। কারণ? ওই দিন ছিলো নারীদিবস।
আধুনিক বাঙালির বারো মাসের পাঁচ তেরোং পঁয়ষট্টি পার্বণের নবতম সংযোজনগুলির অন্যতম এই উৎসবটি আমাদের মতন শান্তশিষ্ট-পত্নীনিষ্ঠ-সুযোগ-পেলেই-হই-পাপিষ্ঠ ভদ্রলোকদের জন্য বেশ সরেস। আমরা বাঙালিরা আবহমান কাল ধরে শক্তিমতী মহীয়সীদের ভক্ত। আমাদের শস্যশ্যামলা দেশে তাই দেবতাদের চাইতে দেবীদের রমরমা চিরকাল বেশি। কালী-দুর্গা-জগদ্ধাত্রী-সরস্বতীর মাতৃভক্ত সন্তান আমরা। তাই নারী দিবসে আমরা যে উৎফুল্ল হয়ে উঠবো, তাতে আর আশ্চর্য কি? সেই সঙ্গে আছে বামপন্থার প্রতি আমাদের দীর্ঘ আনুগত্য ও ভরসা।
প্রসঙ্গত, আন্তর্জাতিক নারী দিবস প্রথমবার পালিত হয় নিউ ইয়র্ক শহরে, ১৯০৯ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি, সোশ্যালিস্ট পার্টি অফ অ্যামেরিকার তত্ত্বাবধানে। ১৯১০ সালের অগস্ট মাসে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহ্যাগেনে আয়োজিত হয় সোশ্যালিস্ট ইন্টারন্যাশনালের একটি মহিলা সম্মেলন। সেখানে সমাজবাদী নেত্রীদ্বয় লুইজে জিয়েৎস (LuiseZietz)ও ক্লারা জেটকিন (Clara Zetkin) প্রস্তাব করেন একটি আন্তর্জাতিক নারী দিবস প্রবর্তন করার। তারপর থেকে দীর্ঘ সময় ধরে পূর্ব ইওরোপের বিভিন্ন দেশের বামপন্থীরা, বিশেষত মহিলারা, নারীস্বাধীনতা ও নারীদের আর্থসামাজিক অধিকার নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যান। এরই মধ্যে ১৯১৪ সালে প্রথমবার ৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়। কেন সেই দিনটিকে বেছে নেওয়া হয়েছিলো, তার কোনও নির্দিষ্ট কারণ পাওয়া যায় না। সেদিন কোথাও কোনও প্রতিবাদ মিছিল বা সম্মেলনেরও কোনও খবর নেই ইতিহাসের কাছে। সম্ভবত রবিবার ছিলো বলেই ওই দিনটি নির্ধারিত হয়েছিলো। কি জানি, হয়তো এবারের মতন সেদিনও পত্নীভক্ত পতিকুল গৃহস্থালির সব দায়িত্ব অসমসাহসিকতায় কাঁধে তুলে নিয়ে স্ত্রীদের কিটি পার্টিতে পাঠিয়েছিলেন...! কিন্তু সে যাই হোক, ঘটনা হলো তার পর থেকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের জন্য ওই দিনটিই নির্দিষ্ট হয়ে যায়।
মোট কথা, নারীভক্তি এবং বামানুরাগ মিলিয়ে আমরা বাঙালিরা নারীদিবস পালনে যারপরনাই আগ্রহী। কিন্তু বাদবাকি ভারতবর্ষ? একটু ভাবনার বিষয়। দেশটা যে বেশ দ্রূতগতিতে বিবর্তিত এবং পরিবর্তিত হচ্ছে, সে কথা বলা বাহুল্য। একটা সময় পর্যন্ত, এই কিছুদিন আগে অবধিও, আমাদের মতন হ্রস্ববুদ্ধি আশাবাদীদের মনে হচ্ছিলো যে পরিবর্তনের অগ্রভাগটা সম্মুখস্থিত। কিন্তু কিছুদিন যাবৎ এই রকম একটা সন্দেহ মনের ভিতর দানা বাঁধতে আরম্ভ করেছে, যে সেটা আসলে পশ্চাৎমুখীও হতে পারে! ধর্মের ধ্বজা যত উড়ছে, সন্দেহটা তত বেশি গেড়ে বসছে আমাদের দুর্বল, অবিশ্বাসী মনের ভিতর। তার উপর আবার সরকার বাহাদুর আমাদের নৈতিক চরিত্রশুদ্ধির জন্য নানারকম নিষেধাজ্ঞা জারি করতে আরম্ভ করেছেন। সদুদ্দেশ্য নিশ্চয়ই। কিন্তু তাতে করে নিজেদের বিচারবুদ্ধি-বিবেচনার উপর ভরসা যে আমাদের ক্রমে তলানিতে এসে ঠেকছে, সেইটাই সবিশেষ চিন্তার বিষয়।
এবং সমস্যার মূলটাও সেইখানে। নিয়ম-কানুন, বিধি-নিষেধের আধিক্য সেখানেই, যেখানে ব্যক্তির বিবেচনা ও মূল্যবোধের উপর সমাজের ভরসা কম। ভারতবর্ষের মতন দেশে, যেখানে প্রকৃত মুক্তমনা, শিক্ষিত মানুষ খুঁজতে গিয়ে জীবাশ্মবিজ্ঞানের অবতারণা করতে হয়, সেখানে এই শিব ঠাকুরের আপন দেশ মার্কা সমস্যাটা যে সহজে যাবে না, সে কথা অনস্বীকার্য। কিন্তু সেই সমস্যা নিবারণ করতে করতে দেশের নারীর যে হাঁড়ির হাল হচ্ছে, একবিংশ শতাব্দীর বয়ঃসন্ধিতে দাঁড়িয়ে সেটা মেনে নেওয়া মুশকিল।
ভারতীয় নারীর হাঁড়ির হাল অবশ্য আজকের কথা নয়। যতই বেদে গার্গী-মৈত্রেয়ীদের নাম থাকুক, তাঁরা যে নিতান্তই ব্যতিক্রমী ছিলেন, তাই নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। হাতে গোনা এই কয়েকজন ছাড়া আর ক’জন নারী সুমহান বৈদিক সভ্যতার লিঙ্গসাম্যের(gender equality) জয়গান গাইতেন, গুণতে গেলে বোধহয় এক হাতের কড়ই যথেষ্ট হবে। পৈতৃক সম্পত্তির অধিকারের কথা যদি ছেড়েও দেওয়া যায়, গুরুগৃহে বাস করে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাটুকু লাভ করার সুযোগ আর্য রমণীদের কোনওকালে ছিলো, এমন প্রমাণও পাওয়া যায় না। উদারচেতা ব্রাহ্মণ ঋষিদের কন্যারা বা পত্নীরা তাঁদের পিতাঠাকুর বা স্বামীদেবতাদের কাছ থেকে যতটুকু শিক্ষা লাভ করতেন, তাতেই তাঁদের সন্তুষ্ট থাকতে হতো। সে যুগে পুত্রের গুরুত্ব যে কি অপরিসীম ছিলো, মনুসংহিতার ‘‘পুত্রার্থে প্রিয়তে ভার্যা’’ থেকেই তা পরিস্ফুট। পু্ত্রহস্তের পিণ্ডলাভ না করলে পুন্নাম নরকে ঠাঁই হতো বৈদিক আর্য পিতাদের! মাতাদের কথা জানি না। অথর্ববেদের প্রান্তিক কোনও সূক্তে উল্লেখ থাকলেও থাকতে পারে। অধমের পড়াশোনা অদ্দূর নয়।
তবে বৈদিক যুগে নারীদের প্রেম-ট্রেম করার অধিকার পুরোদস্তুর ছিলো। নিজেরা নিজেদের সঙ্গী নির্বাচন করতে পারতেন অবাধে। সঙ্গমও যাচনা করতে পারতেন তেমন তেমন তাড়না হলে। সে সবের নজির ছড়িয়ে আছে বেদ-পুরাণ-মহাকাব্যের পাতায় পাতায়। অধুনা যাঁরা সনাতন ভারতীয় কৃষ্টিরক্ষার মহান দায়িত্ব আপন স্কন্ধে স্থাপন করে ভ্যালেন্টাইন দিবস জাতীয় অর্বাচীন উৎসবগুলিকে উৎখাত করার প্রবল প্রচেষ্টায় প্রায় শহীদ হতেও রাজি, তাঁরা যদি জানতেন যে প্রাচীন ভারতে বসন্তোৎসবের দিন নারীপুরুষের মিলন ও সঙ্গমে কোনও বিধিনিষেধ থাকতো না, এমন কি পরস্পর পূর্বপরিচিতি না থাকলেও নয়, তবে হয়তো তাঁরা ভ্যালেন্টাইন দিবসের নির্দোষ, নেহাতই চন্দ্রাহত ছেলেমেয়েগুলিকে অব্যহতি দিতেন। প্রসঙ্গত, সম্রাট আকবর তাঁর রাজত্বকালে এই বসন্তোৎসবের পুনর্প্রবর্তন করেন। কিন্তু ততদিনে এ দেশের যা সর্বনাশ হওয়ার হয়ে গেছে। পর্দানশীন হাসীনা আর অবগুন্ঠিতা সুন্দরীদের দিয়ে আর যাই হোক, বসন্তোৎসব হয় না!
কিন্তু নারীদিবসের আলোচনায় নেমে একটু ফাঁক পেয়েই কেমন সরসরিয়ে সরস মাধুরীর দিকে এগিয়ে চলেছি! পুরুষের মন, আর কি! ওই... সুযোগ পেলেই হই ...! সে যাই হোক, এই সেদিন এক বিদ্বান বন্ধু দুঃখ করছিলেন, কেন নারীদের জন্য আলাদা সুরক্ষা, সংরক্ষণের ব্যবস্থা লাগবে? নারীরা কি অনুন্নত জাতি নাকি? তাতে এক রসিক বন্ধু বললেন, অনুন্নত না হলেও, বিপন্ন তো বটেই! যে দেশের পুরুষকে বোঝানোর প্রয়োজন হয় যে নারীধর্ষণ তার জন্মসিদ্ধ অধিকারের মধ্যে পড়ে না, সে দেশে নারীকে বিপন্ন ছাড়া আর কি বলা যাবে? আরেক মহিলা বন্ধু প্রশ্ন করলেন, যে দেশের নারীরাই স্বয়ং বলেন, ধর্ষণের প্রধান কারণ নাকি মেয়েদের খাটো পোষাক পরে পুরুষবন্ধুদের সঙ্গে বেলেল্লাপনা করা, সে দেশে নারীর ন্যূণতম দৈহিক সুরক্ষার অধিকার কে সুরক্ষিত রাখবে?
সদুত্তর দেওয়া গেলো না। সত্যিই তো, নগরকোটাল থেকে আরম্ভ করে মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত সবাই মেয়েদের সাবধানে থাকার উপদেশ দিচ্ছেন। হিতোপদেশ নিঃসন্দেহে। কিন্তু ব্যাপারটা কেমন যেন পায়ে জুতো না পরে চামড়ার আস্তরণ দিয়ে মাটি ঢাকার চেষ্টার মতন। বা হয়তো এক্ষেত্রে সেটাই সমস্যার সমাধান। আমাদের অল্পবুদ্ধিতে মালুম দিচ্ছে না। হয়তো আমাদের মেয়ে-বোনেদেরই আরও সতর্ক, আরও অবগুন্ঠিত হতে হবে আধুনিক ভারতবর্ষে সসম্মানে বাঁচার জন্য। যেমন সৌদি আরবে বা ইরানে বা সিরিয়ায় হয়। হয়তো আমাদেরও শহরগুলির পথে পথে আর ক’বছর পর বেত্রহস্ত ধর্মপুলিশ দেখা যাবে, যারা সরকার অনুমোদিত মাপজোকের বাইরে পোষাক পরিহিতা মহিলাদের দেখলেই সপাসপ বেত্রপ্রদান করবেন!
অথচ আমাদের সরকার বাহাদুর কিন্তু নারীক্ষমতায়ন(woman empowerment)-এ সম্পূর্ণ বিশ্বাসী। মহিলাদের জন্য সরকারি চাকরি থেকে আরম্ভ করে বিধানসভার আসন পর্যন্ত সংরক্ষণে তৎপর আমাদের সুমহান সরকার। চারদিকে নারীসন্তানের সমাধিকার নিয়ে সোচ্চার ঘোষণা, নারীজাগরণের জিগির। তাহলে আজকের নারীর কিংকর্তব্য?
কঠিন প্রশ্ন। কারণ পুরুষের যা প্রধান কর্তব্য, অর্থাৎ নিজের শিক্ষা ও কর্মজীবনকে প্রতিষ্ঠিত ও সুরক্ষিত করা এবং পরিবার প্রতিপালন করা, সেই সব কিছু আজ নারীরও কর্তব্য। সে সব কর্তব্য পালন না করলে লিঙ্গসাম্যের দুর্ভাগ্যজনক প্রতিযোগিতায় অবধারিত ভাবেই পিছিয়ে পড়বে নারী, যেমনটা চিরকাল পড়েছে। কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে নারীর আরও কিছু অতিরিক্ত কর্তব্যও আছে। অন্তত সমাজচেতনায় আছে। গৃহস্থালীর কাজ এবং সন্তান জনন ও পালন সেই অতিরিক্ত কর্তব্যগুলির মধ্যে মুখ্য। সে সব সামলে নিজের পেশায় সম্পূর্ণ মনোনিবেশ ও আত্মনিয়োগ করার সুযোগ আমাদের সমাজে কম নারীই পান। তবে সংখ্যাটা বাড়ছে, এটাই যা আশার কথা।
অন্তত গত বছর অবধি পরিসংখ্যান সেইরকমই বলছে। কিন্তু মুশকিল হলো, এর মধ্যে আবার মহান হিন্দুধর্মের পুনর্জাগরণ হয়েছে। গৈরিকধারী মহাপুরুষরা বিধান দিয়েছেন, হিন্দু নারীর নাকি জীবনের চরম সার্থকতা গৃহকর্ম সম্পাদনে, এবং সেই সম্পাদনার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ নাকি অন্তত পক্ষে চারটি সন্তান উৎপাদন করা! সনাতন ধর্মের যা সব থেকে বড় মন্ত্র, অর্থাৎ ‘‘সবই বেদে বলা আছে’’কে পাথেয় করে আমরা সগৌরবে পশ্চাৎমুখে অগ্রসর হয়ে চলেছি, এবং সে আগ্রাসনে এক বিরাট সংখ্যক শিক্ষিত মানুষের উৎসাহ বিস্ময়কর!
তবু আমরা, নারীভক্ত বাঙালিরা এবং আমাদের মতন দুর্বলচিত্ত আর যাঁরা আছেন, এই আশায় বুক বাঁধবো যে খুব শিগগিরি একদিন আমাদের নারীরা সমাজ ও অর্থনীতি পরিচালনার দায়িত্বখানি নিজস্কন্ধে উত্তোলন করবেন। নিঃসন্দেহে সেদিন সন্ত্রাসবাদ বা আন্তর্জাতিক শত্রুতা ও যুদ্ধের মতন সভ্যতাজনিত রোগগুলির থেকে পৃথিবীর মুক্তি ঘটবে... এবং আমরা, পুরুষরা, মনের আনন্দে সারাদিন ঘরকন্না সামলে বিকেলের দিকটা ফ্রেশ-ট্রেশ হয়ে বেরোবো পাপী(puppy… kitty-র সম্ভাব্য পুং)পার্টির উদ্দশ্যে। উফ্! ভেবেই অনাবিল আনন্দ হচ্ছে!
মম্নোরম উপস্থাপনা।
ReplyDeleteধন্যবাদ, স্বপন দেব।
ReplyDelete