প্রবন্ধঃ অরূপ জ্যোতি ভট্টাচার্য
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রাসঙ্গিকতা - সমাজে ও সাহিত্যে
অরূপ জ্যোতি ভট্টাচার্য
চেতন ভগত এর one night @ the call center পড়তে গিয়ে ভূমিকাতেই একটা আশ্চর্য ঘটনা দেখলাম। আমার মত চেতন ভগতও ট্রেন চড়ার সময় রিজার্ভেসন চার্ট এ নিজের কনফার্মেসন দেখার সাথে সাথে চোখ বুলিয়ে নেন পাশাপাশি কোনো মহিলা যাত্রী আছেন কিনা, বিশেষ করে অনুর্ধা চল্লিশ । এই একটা বিষয়ে আকবর বাদশা থেকে হরিপদ কেরানি সবাই একই রকম। উগ্র নারীবাদী বলবেন - পুরুষের যৌনাকাঙ্ক্ষা। বায়োলজি বলবে হরমোনের খেলা। সাহিত্যিক বলবে নারী পুরুষের অমলিন অদৃশ্য সুতোর টান।
সাহিত্য আর সমাজের এখানেই বোধহয় মিল, আবার এখানেই বিচ্ছেদ। সাহিত্য সমাজের প্রতিফলন। কিন্তু সাহিত্যে গরু গাছে ওঠে, ঘোড়া আকাশে উড়ে যায় ডানা মেলে। সমাজে তা হয় না। যদিও গরু, ঘোড়া পাখি সবই সমাজের উপাদান। ববডিলান এর অভিমতে - কোনো নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে বা সমর্থন ছাড়া কোনো পুরুষ তাকে ছুঁতে পারে না। তাই নারীরাই এই পৃথিবী শাসন করে। কিন্তু সমাজে আমরা রোজই দেখি কিছু পুরুষের বিকৃত লালসার শিকার হচ্ছে নারী। যেখানে নারীর সমর্থন নেই, আছে পুরুষের পাশবিক নির্যাতন। আছে সমাজের বুকে প্রতি রাতে হারিয়ে যাওয়া নারীত্বের অভিশাপ এর বিষবাস্প। সমাজ আর সাহিত্যের এখানেই পার্থক্য। সাহিত্যের কান্তাসম্মিত বাণী আত্মিক লোকের সর্ব মানব চিত্তের মহাদেশে ছড়িয়ে দেয় নারী পুরুষের চিরন্তন প্রেমের বার্তা। যেখানে মিলন আছে, বিরহ আছে, সম্ভোগ আছে, বিচ্ছেদ আছে, কিন্তু লালসা নেই, নির্যাতন নেই আর নেই নারীত্বের অপমান। নারী পুরুষের প্রেমই যুগে যুগে ইতিহাস রচনা করে চলেছে।
সমাজ আর সাহিত্যের সংযোগ সেই ঐতিহাসিক যুগ থেকে। আর যুগ থেকে যুগান্তরে সেই ইতিহাসের চাবিকাঠি কোনো না কোনো নারীর হাতে। পুরাণে পঞ্চ নারী -অহল্যা, কুন্তী, দ্রৌপদী, তারা, মন্দোদরী। নারী জাতির আদর্শ (স্বামী বিবেকানান্দর চোখে) সীতা, সাবিত্রী, দময়ন্তী। বুদ্ধদেবের জীবন রক্ষায় সুজাতা। অথবা ইতিহাস স্বীকৃত গ্রন্থ কলহনের রাজতরঙ্গিনী | সুলতান যুগে 1202 সালে সুলতান রাজিয়া প্রথম ভারতীয় নারী শাসক। ঝাঁসীর রানী লক্ষ্মী বাই-এর মহাবিদ্রোহে মহাসংগ্রাম। অথবা বৈদিক যুগে সপ্তর্ষির পাশাপাশি অপালা, লোপামুদ্রা, গার্গী, মৈত্রেয়ী-দের আত্মপরিচয়। অথবা শুদ্রক রচিত মৃচ্ছকটিক-এর অনুসরণে বলিউড ফিল্ম উৎসব-এ দেখানো হয়েছে বাৎসায়ন-এর কামসূত্র রচনার পেছনে বসন্তসেনার অবদানের কথা। নারী জাতির অবদান নির্ণয়ের পরিসংখ্যান এখানে বিচার্য বিষয় নয়। সমাজের সাথে নারীর অবিচ্ছেদ্য সংযোগই এখানে পর্যালোচিত। পুরাণে `পার্বতীর স্তন পানের বাসনা থেকে নারায়ণের মাটির পুতুলে প্রবেশ। সেখান থেকে গনেশের জন্ম বৃত্তান্ত আরম্ভ। গৌড়ীয় বৈষ্ণব রসে রাধা আনন্দদায়িনী। কৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি। আবার মা দূর্গা শক্তি রূপে সংস্থিতা। দানবদলনী। মুণ্ডমালা ধারী মা কালীর পায়ের তলায় দেবাদিদেব। একদিকে নারী আনন্দদায়িনী, অন্যদিকে সংহারিণী।
সাহিত্য হলো ভাষা বহন শিল্প। আর এই শিল্প কর্মের সার্থকতা হলো মনের ভাব থেকে রস এ পর্যাবরণ। রস আমাদের ভালো লাগা, মন্দ লাগা, ভয়, বিস্ময়, সুখ, বিষাদ, সব কিছুতেই নতুন অনুভূতির সজীবত্ত্ব আনে। রতি হাস, শোক, ভয়, জুগুপ্সা, বিস্ময় -এই ভাব গুলো পরিপূর্ণতা পায় না নারীর স্পর্শ ছাড়া। তা সেটা সাহিত্যেই হোক বা সমাজে। সাহিত্যে নারীর স্থান প্রসঙ্গে মনে এলো প্রথমেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রহর শেষ এর আলোয় রাঙ্গা সেদিন চৈত্র মাস … তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ …” । সাহিত্যে নারীর স্থান প্রসঙ্গে এর থেকে যথার্থ উক্তি আর মনে এলো না। কালিদাসের কুমারসম্ভব-এ মহাদেবের জঙ্ঘায় পার্বতীর গুরু নিতম্বের শোভা, বা স্তন নির্মানে সৃষ্টিকর্তার উজাড় করা রস ভান্ডার, কোমরের হিল্লোল, সম্ভোগ কালে পার্বতীর লজ্জা, শিবের দু চোখ হাত দিয়ে ঢেকে দিলে শিব তৃতীয় নয়ন খুলে পার্বতীর আরক্ত যৌবন রসাস্বাদন, সব কিছুই সাহিত্যের ভাষায় হৃদয়সংবাদী । কালিদাসের শকুন্তলা, রবীন্দ্রনাথের বিচারে, প্রথমে সারল্য, তারপর তাতে অপরাধের অনুপ্রবেশ, তারপর লজ্জা, গ্লানি, কষ্টের মধ্যে দিয়ে সর্বশেষে পরিনতি শান্তি। শেক্সপীয়ারের মিরান্দা আর কালিদাসের শকুন্তলা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন মিরান্দা শক্তি তো শকুন্তলা শান্তি। নারীর নারীত্ব বিচারে সমাজের দর্পনে পোশাকের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর বাণী ও রচনায় পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য প্রসঙ্গে পোশাক নিয়ে চর্চা করেছেন। পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে মেম বুক খোলা সান্ধ্য পোশাকে অতিথি দের আপ্যায়ন করে। প্রাচ্য সংস্কৃতি তে ঘরের বউ মাথায় ঘোমটা টানতে গিয়ে কাপড় যে কোমর ছেড়ে উঠে যাচ্ছে সেটা খেয়াল করে না। অর্থাৎ সাহিত্যের দর্পনে স্বামী বিবেকানন্দ এই পোশাক নিয়ে অযথা পাগলামি আর সংকীর্ণতা কাটিয়ে উঠতে বলেছেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তো সরাসরি বলেছেন স্বামীর অবর্তমানে অন্য পুরুষের সামনে মহিলাদের আচরণ একটু পাল্টে যায়। একটু অন্য রকম আনন্দ করলে ক্ষতি নেই। অথবা বয়স বেড়ে যাওয়াটা মেয়েরা সহজে মেনে নিতে পারে না। তাই সাহিত্যই সমাজকে শিখিয়েছে কি করে সম্পর্কের সংকীর্ণতাকে কাটিয়ে উদার আর মুক্তমনা হতে হয়।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রাসঙ্গিকতা খুঁজতে গেলে প্রথমেই মনে আসে রাজা রামমোহন রায়ের নাম। যিনি সতী দাহ প্রথা বন্ধ করে ভারতবর্ষে রেনেসাঁ বা নবজাগরণের সূচনা করেন। সেই ছিল নারীত্বের প্রথম জয়ধ্বব্জা, যা মধ্যযুগীয় অন্ধকার থেকে আলোর দিকে যাত্রা শুরু করে। এরপর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাল্য বিবাহ রদ আর বিধবা বিবাহের প্রচলন করেন। তৎকালীন নারী স্বাধীনতা বিহীন ঘুন ধরা সমাজে বিধবা বিবাহের প্রচলন ছিল সব থেকে তীব্র কশাঘাত। সেই সময়ে তুলনামূলক প্রগতিশীল ঠাকুরবাড়িতে মেয়েরা ধীরে ধীরে সমাজের বুকে নারীত্বের জয়গান গাইতে শুরু করে। এরপর একশ বছর পার হয়ে গেছে কিন্ত আজ ও আমরা নারীদিবসের প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে চলেছি। আজ ও আলো থেকে অন্ধকারে হারিয়ে যায় কত ফুল। ফুলের কুঁড়ি ফোটার আগেই ঝরে যায় অনাদরে। বর্বরতা আজ ও পথে ঘাটে ঘুরে বেড়ায়। এই তামসিকতা কাটিয়ে উঠতে সাহিত্যকেই এগিয়ে আসতে হবে। কবি তবে উঠে এস যদি থাকে প্রাণ। পুরুষ আর নারীতে প্রতিযোগিতা নয়, সহযোগিতাই নিয়ে আসতে পারে এক অন্ধকার মুক্ত সমাজ। পুরুষ বিদ্বেষ নয়, নারী পুরুষের একত্র সমাবেশই খুঁজে আনবে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রাসঙ্গিকতা; শুধু নারী নয় নারীত্বের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করবে নারী দিবসের প্রাসঙ্গিকতাকে।
ভালো লেখা। কিন্তু একটা প্রশ্ন, বিদ্যাসাগর মহাশয় কি বাল্য-বিবাহ রদ করেছিলেন ? আমি যতদূর জানি উনি কিন্তু গৌরীদান প্রথার সপক্ষে ছিলেন।
ReplyDeleteBidyasagar bidhoba bibaho procholon korechilen ,ballo bobaho rod korechilen ,bohubibaho rod korechilen bolei jani.lekhati bhalo laglo.
ReplyDelete