0

ছোটগল্পঃ সুভাষ মিত্র

Posted in


ছোটগল্প



ইজ্জত
সুভাষ মিত্র


নাম টা ধরা যাক "সুধাময়ী"। স্বামী, পুত্র, কন্যা নিয়ে সুখী সংসার। সম্পত্তি, অর্থ কিছুরই অভাব নেই। নিবাস কল্লোলিনী কলকাতার পাশে গঙ্গার ওপারে একটি গ্রাম্য শহরে। ধরা যাক, সেই গ্রাম্য শহরের নাম আমতা। স্বামী একটি মাঝারি কোম্পানির বড় বাবু, মাস মাহিনা যা পায় তাতে হেসে খেলে চলে যায়, ছেলে মেয়ে সকলে ভালোভাবে লেখা পড়ায়, উচ্চশিক্ষায় প্রতিষ্ঠিত। ঠিক সময় ভালো মধ্যবিত্ত ঘরে কন্যা দান সম্পূর্ন হয়। পরে পুত্র একটি মাঝারি কোম্পানিতে চাকুরী পায়, বছর দুই পরে পুত্রের ও বিবাহ সম্পূর্ণ হয়, ধীরে ধীরে পুত্র কন্যার সংসারের বৃদ্ধি ঘটে। কয়েক বছর খুব ভালো কাটল, সুখের সংসার, ভরা কোটাল। হঠাৎ একদিন সংসারে অন্ধকার ঘনাল, অফিস থেকে ফেরার পথে স্বামী দুর্ঘটনাগ্রস্থ হয়ে ঘটনাস্থলেই মৃত। সুধাময়ীর জীবনে প্রথম অন্ধকার নেমে এলো। দিন যায়, একদিন নিজেকে সামলে নিতেই হলো।

ছেলের ঘরের নাতির পরিচর্যা নিয়ে সুধাময়ীর দিন কাটে। নাতি ক্রমশ বড় হয়ে উঠছে ।

স্কুলে ভর্তি করা হোলো, ঠাকুমার দায়িত্ব বেড়ে গেল । ঠিকমত লেখাপড়া করানো, স্কুলে নিয়ে যাওয়া, নিয়ে আসা ইত্যাদি, বেশ কয়েকদিন পর পুত্র কর্মস্থল থেকে ফিরে অসুস্থ বোধ করল। কয়েকদিন চিকিৎসার পরে ধরা পড়ল "ক্যান্সার"। সুধাময়ীর মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল, স্বামীর জমা টাকা, ছেলের কিছু জমানো টাকা নিয়ে ছেলের চিকিৎসা, নাতির পড়ার খরচ চালানো দুঃসাধ্য হয়ে উঠছে। সুধাময়ী আর পুত্রবধূ মিলে সংসারের কাজ সামলে পাড়ার ছোট বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে যাওয়া নিয়ে আসার কাজ নিয়ে কিছু উপায় করার কাজে নেমে পড়ল। তাতেও ছেলের হাসপাতাল এ রেখে চিকিত্সার খরচ চালানো কষ্টকর হয়ে উঠলো। পুত্রবধূর এত কষ্ট সইল না। একদিন সে সন্তান কে রেখে সেই যে পিত্রালয়ে চলে গেল আর ফিরে এলো না, শোনা যায় পুনর্বিবাহ করেছে।

এ দিকে সঞ্চিত টাকায় আর কত দিন চালানো যায়। সুধাময়ীর কষ্ট আরও 
বেড়ে যায়। স্বামী, পুত্র, পুত্রবধূ সবই হারালো নিজের অদৃষ্ট মেনে নিয়ে কোনো মতে নিজের আর বংশধরের দায়িত্ব সামলাতে লাগলো।

ভাগ্য আরো বিরূপ । বেশ কয়েক বছর পর একমাত্র জামাই একদিন তার ছোটবেলার প্রেমিকার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবধ্য হয়ে নিজের স্ত্রীকে ছেড়ে চলে গেল। সুধাময়ীর মেয়ের ঘরের নাতনিসহ তার মেয়েকে মেয়ের শ্বশুর বাড়ির লোকেরা পিত্রালয়ে রেখে গেল, এ কথাও জানিয়ে গেল, যে আর সুধাময়ীর মেয়ের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই ।

এখন সুধাময়ীর বয়স ৮৪, এখনো জীবন যুদ্ধ চালাচ্ছে, রোজ ৪ টি পেটের অন্ন সংস্থান চালিয়ে যাচ্ছে, ভিক্ষা করে নয়, ইজ্জত নিয়ে, কি করে? শুনবে ? প্রতিদিন সুদূর আমতা থেকে কলকাতার কেন্দ্রের কাছে একটি জনবহুল রাস্তায় বিশাল অট্টালিকার নিচে রোজ শুকনো খাবার বিক্রি করে ।

এখন আর একটি নতুন সঙ্গী হয়েছে, সেটা কাশি, এই কাশি নিয়েও এখনও সুধাময়ীর মুখে হাসি লেগে আছে, জীবনের পরম অবলম্বন, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই নতুন সঙ্গী কে নিয়ে থাকতে চায়।

কোনো অনুদান নেবে না। এখনো মানুষ সহৃদয়, অফিস ফেরত, টিফিন সময় অনেকে এখনো সুধাময়ীর কাছ থেকে শুকনো খাবার কেনে, এখনো সুধাময়ীর সেই হাসি মুখ অমায়িক মমতা ঝরে পরে, অশ্রু শুকিয়ে গেছে আর ঝরে না । তুমি ভালো থেক "সুধাময়ী", তোমাকে স্যালুট ।

ইজ্জত কে অস্ত্র করে বেঁচে থাকা তোমার কাছে শিখলাম । ভালো থেক, তোমাকে সেলাম।

অনেক দিন দেখা হয় নি, জানি না কেমন আছে, ভালো থেকো সুধাময়ী , তোমার কাছে আসল সংগ্রাম শিখলাম।

0 comments: