0

ছোটগল্পঃ অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

Posted in


ছোটগল্প


নাকের ডগায়
অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী



ট্যাক্সিতে উঠেই ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিলাম পেছনের সিটে। অনেক রাত হয়ে গেল আজ। হঠাৎ ড্রাইভারের সিটের পিছনে লেখা ট্যাক্সির নম্বরটা চোখে পড়তেই চমকে উঠলাম। উত্তেজনায় যাবতীয় ক্লান্তি নিমেষে উধাও। চোখ বুজে স্মৃতি থেকে বের করে নম্বরটা আওড়ালাম। তারপর মিলিয়ে নিলাম লেখা নম্বরটার সঙ্গে। কোন ভুল নেই। এটাই সেই নম্বর। 

আজ থেকে ঠিক পঁচিশ দিন আগে অর্থাৎ ২৩ জানুয়ারি রাত দশটায় তিলজলা থানায় একটা ফোন যায়। নিজের পরিচয় না দিয়ে এক ব্যক্তি জানায় যে বাইক নিয়ে আসতে গিয়ে ধাপা সংলগ্ন বাই পাশের ধারে সে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা একটি লাশ দেখেছে। কিন্তু সেখানে দাঁড়ানোর সাহস হয়নি তার। এটা জানিয়ে সে কর্তব্য পালন করল মাত্র, পরিচয় জানিয়ে পুলিশি ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার কোন ইচ্ছে তার নেই। পুলিশ তৎক্ষণাৎ গিয়ে লাশ নয়, অচেতন এক ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে গিয়ে বাইপাশ সংলগ্ন একটি নার্সিং হোমে ভর্তি করে। ডাক্তাররা বলেন মাথার পিছনে ভারি কোন বস্তু দিয়ে আঘাত পাওয়ার ফলে লোকটি জ্ঞান হারিয়েছে। আঘাত কতটা গুরুতর বিশদ পরীক্ষার আগে সেটা বোঝা যাবে না। লোকটির পকেট থেকে তার মোবাইল, কিছু কাগজপত্র, একটি পকেট ডাইরি উদ্ধার করে পুলিশ। তা থেকে সেই রাত্রেই তার পরিচয় জানা যায়। শ্যামলাল বসাক, বয়স ৪২, বড়বাজারের সোনাপট্টিতে তার সোনার দোকান। তদন্তে পুলিশ জানতে পারে, ঘটনার দিন নেতাজির জন্মদিন উপলক্ষে সোনাপট্টি বন্ধ ছিল। কিন্তু একটা বড় বরাত সেদিনই ডেলিভারি দেওয়ার কথা থাকায় শ্যামলালবাবু দুপুরের খাওয়া সেরে দোকানে যান। কাজ সামান্য বাকি ছিল। দোকানের দরজা বন্ধ করে সেটুকু সেরে সন্ধে নাগাদ খদ্দেরকে মাল ডেলিভারি দিয়ে তাঁর পাটুলির ফ্ল্যাটে ফিরবেন বলে খদ্দেরের দেওয়া নগদ চার লাখ টাকা একটি বাজারের থলেতে নিয়ে ট্যাক্সিতে ওঠেন। ট্যাক্সিতে ওঠার আগে এই সব কথা জানিয়ে তিনি বাড়িতে ফোন করেন। সেদিন সারা দিনই আকাশ মেঘলা ছিল। সন্ধ্যের পর কলকাতার প্রসিদ্ধ ধোঁয়াশায় ভরে গিয়েছিল চারিদিক। ছুটির দিন হওয়ায় রাস্তায় লোকজনও কম ছিল। ট্যাক্সি ড্রাইভার কোনভাবে নিশ্চয় জানতে পেরেছিল থলের মধ্যে কী আছে। অনুকূল পরিস্থিতিই বোধ হয় তাকে প্ররোচিত করেছিল সুযোগ বুঝে গাড়ি দাঁড় করিয়ে শ্যামলালবাবুর মাথায় বাড়ি মেরে তাঁকে রাস্তার পাশে ফেলে রেখে টাকার থলে নিয়ে পালিয়ে যেতে। তার কোন সহকারী ছিল কিনা পুলিশ জানতে পারেনি। শ্যামলালবাবু কোমায়। বাঁচার আশা কম। তবে তিনি বিচক্ষণ ব্যক্তি। কারণ, তাঁর পকেট ডাইরি থেকে ট্যাক্সির একটা নম্বর পেয়েছে পুলিশ। তাঁর ডাইরিতে ওটাই শেষ এন্ট্রি। পুলিশ নিশ্চিত ট্যাক্সিতে উঠে নম্বরটি তিনি লিখে রেখেছিলেন খারাপ কিছু ঘটলে কাজে লাগবে বলে। তদন্তের স্বার্থে পুলিশ নম্বরটি গোপন রেখেছে, কিন্তু আমার কাগজের অফিস থেকে ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টিং করার দায়িত্ব পেয়ে আমি সোর্স মারফৎ নম্বরটি পেয়ে যাই। 

আমি দ্রুত ভাবতে শুরু করলাম। নম্বরটি পেয়েও পুলিশ তদন্তে একটুও এগোতে পারেনি। কলকাতা ও আশেপাশের সমস্ত গ্যারেজ ঢুঁড়েও ট্যাক্সিটি পাওয়া যায়নি।

বেলতলার আর টি এ অফিস থেকে মালিকের নাম ঠিকানা ও গাড়ির চেসিস নম্বর পেয়েও কিছু লাভ হয়নি। ঠিকানায় তালা দেখে পুলিশ ভাবছে সে সেই রাত্রেই গাড়ি নিয়ে ভিন রাজ্যে গা ঢাকা দিয়েছে। এখন ব্যাপারটা পরিষ্কার আমার কাছে। পুলিশকে সম্পূর্ণ বোকা বানিয়েছে লোকটি। গা ঢাকা দেওয়ার বদলে প্রকাশ্যেই ট্যাক্সি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সম্ভবত – সম্ভবত কেন, নিশ্চয়ই নম্বরপ্লেট বদলে দিয়েছে। ফলে বাইরে থেকে ট্যাক্সিটিকে চিনে নেওয়ার উপায় নেই। কিন্তু ভেতরে তার সিটের পিছনে থাকা নম্বরটির কথা সে বেমালুম ভুলে বসে আছে। ইতিকর্তব্য ঠিক করতে আমার সময় লাগল না। মোবাইল থেকে একটি নির্দিষ্ট নম্বরে একটা মেসেজ পাঠিয়ে দিলাম। 

আমার বাড়ির সামনে ট্যাক্সি থেকে নামতেই চারিদিক থেকে পুলিশ ট্যাক্সিটিকে ঘিরে ফেলল।

0 comments: