0

ছোটগল্পঃ মমতা দাস (ভট্টাচার্য)

Posted in


ছোটগল্প



আহত বিশ্বাস 
মমতা দাস (ভট্টাচার্য)



ডাক্তার দেখাতে দেখাতে ক্লান্ত বুলি আর পারে না। বিধ্বস্ত, বিরক্ত সে। সকালে প্রকাশ ডাক্তারের কথা বলতেই তেতে উঠলো তাই, "আবার ? তুমি কি থামবে না ? ক্ষান্ত দেবেনা এই মিথ্যে খেলায় ? যা হবার নয় তা হবে না। ডাক্তার কি করবে, সে কি ভগবান?" -হাঁপাতে থাকে বুলি। "আরে না না " -শান্ত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে প্রকাশ, " এই ডাক্তার খুব নামকরা, জার্মানি থেকে এসেছেন "....বউ-এর পিঠে হাত রাখে সে। ঝটকা মেরে হাত টা সরিয়ে দেয় বুলি। "জার্মানি, রোম, আমেরিকা যেখান থেকেই আসুক, ফল তো সেই এক-ই হবে, গম্ভীর মুখে একশোটা টেস্ট বলবে, বিরাট লিস্ট ধরাবে। টেস্ট সব হবে, কিন্তু প্রাপ্তি ফল শূন্য সব কাগজ-পত্র দেখে, ভুরু কুঁচকে ডাক্তার বলবে, 'না কোনো দোষ নেই ওনার, তবে...’ -বলতে না বলতেই তুমি তাড়াহুড়া করে, ‘thank you’ -বলে আমাকে টেনে নিয়ে ছুটে বেরিয়ে আসবে। কি যে বলতে চায়, একটা ডাক্তারের কথা শেষ অব্দি শোনা হলো না। সব-ই তো জানা, তাহলে আর কেন? কম তো দেখানো হলো না !" একটু হতাশা বাজে বুঝি বুলির স্বরে। একটু বুঝি নালিশ-ও! পাত্তা দেয় না প্রকাশ, "তৈরী থেকো, তাড়াতাড়ি এসেই বেরোবো, ছটায় appointment আছে কিন্তু! ওকে টাটা " -বলে একরকম পালিয়ে যায় প্রকাশ, সরে পড়ে স্ত্রীর মর্মভেদী দৃষ্টির সামনে থেকে, পালিয়েই বাঁচতে চায় যেন বউ-এর দৃষ্টি থেকে। 

সারাটা দিন খুব বাজে কাটে বুলির। আনমনা, শিথিল, কাজে মন লাগে না, আর কত ডাক্তার দেখানো হবে ? কম তো হলো না ! মনে মনে হিসাব করে, এই নিয়ে বারো জন। বারোজন , পুরো এক ডজন ? এত ডাক্তার দেখেছে তাকে? নারী-পুরুষ, জোয়ান-বুড়ো বাদ নেই কেউ ! আশার কথা শোনাতে পারেনি কেউ। না তা বলা যায় না বোধ হয় ! ভালো করে কিছু শোনা, বোঝার ধৈর্য কই প্রকাশের ? উত্তর positive কিন্তু নিরর্থক। বুলির শরীরে কোনো দোষ নেই, তবে ? এই প্রশ্নের উত্তর কেউ জানে না। জানে না, নাকি ? নাঃ! নিঃশ্বাস ফেলে ঘরের কাজে মন দেয় বুলি। কতক্ষণ ? একটু পরেই আবার সেই চিন্তা! প্রকাশ কেমন যেন এড়িয়ে যায়, কোনো ডাক্তারের কথায় শেষ অব্দি শোনে না সে। যেন ট্রেন ধরার তাড়া, এভাবে বুলিকে নিয়ে ছুটে বেরিয়ে আসে। কেন কে জানে ! একটা সন্দেহ আসি আসি করে মনে, পাত্তা দেয় না বুলি।

সন্ধ্যায় আবার ডাক্তার। ঠিক কথাই বলেছিল বুলি, দেখে-টেখে ডাক্তার একগাদা টেস্ট লিখে দিলেন। সেগুলোর রিপোর্ট পেলে ডাক্তারকে দেখাতে হবে। বুলির আসার দরকার নেই, প্রকাশ যেন দেখিয়ে যায়। আগেরগুলো দেখে তিনি sure বুলির স্বাস্থ্য একদম ঠিক, তবু আর একবার দেখে নেওয়া আর কি ! তারপর নাহয় , এই অব্দি শুনেই বুলিকে প্রায় হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসে প্রকাশ। তরপর বলে, 'চল আজ একটু ঘুরে-ফিরে, হোটেলে খেয়ে বাড়ি যাই '। বুলি রাজি হয় না, তার মুড অফ হয়ে গেছে, কি যেন ভাবছে। অগত্যা দুই অসুখী প্রাণী বাড়ি ফিরে আসে। বিরস হয়ে যায় সন্ধ্যা, কিছুক্ষন T V দেখে ঘুমিয়ে পরে প্রকাশ। বুলির ঘুম আসেনা, বড় বড় খোলা চোখে অন্ধকারের দিকে চেয়ে সাত-সতেরো ভাবতে থাকে, কখন যে ঘুম এসে চিন্তা মুক্তি ঘটায় জানতে পারে না। 





'বুলি মারা গেছে', প্রকাশের ফোনে এই খবর পেয়ে ছুটে আসে বুলির ছোটবোন মলি আর তার স্বামী। " কি হয়েছিল প্রকাশ দা, এমন হঠাৎ করে, হার্ট এটাক, স্ট্রোক? আমরা তো দিদির এসব অসুখের কথা জানি না " -অবাক জিজ্ঞাসা মলির, 

'অসুখ নয় , অন্য ব্যাপার ' গম্ভীর, দুঃখী মুখে একটা খাম এগিয়ে দেয় প্রকাশ। 

"চিঠি ,কার ?" -অবাক জিজ্ঞাসা মলির -

'পড়, সব বুঝবে ' -গলাটা ভেঙ্গে যায় প্রকাশের, কান্না লুকোতে মুখটা ঘুরিয়ে নেয়, চিঠিটা নিয়ে স্বামীর হাতে দেয় মলি, সমীর খোলে খামটা, 

'একি, এটাতো আপনাকে লেখা দিদির চিঠি, তাহলে আমি...’ দ্বিধাগ্রস্ত সমীর

'পড় না, এখন আর গোপন বলে কি আছে ? মানুষটাই তো নেই, আমার এখন আর গোপন, private কিছু নেই। এটা পড়লে তোমরা সব জানতে পারবে , তারপর যা মনে কর বোলো, যা শাস্তি বলবে...’ -কথা শেষ না করেই ভিতরের ঘরের দিকে চলে যায় প্রকাশ। সেদিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে মলি ও সমীর, তারপর পড়তে শুরু করে, বুলি লিখেছে ,

প্রকাশ, হঠাৎ বিরাট শকে পাথর হয়ে গেছি। প্রিয় বা প্রিয়তম শব্দ আসছে না কলমের মুখে। আজ তোমার আলমারি গোছাতে গিয়ে কাগজ পেলাম কটা। একটা নয়, বিভিন্ন ল্যাবরেটরির টেস্ট-এর রিপোর্ট সেগুলো। সবগুলোর বিষয় বস্তু এক। এগুলো ছিল তোমার আলমারির লকারে, কেন প্রকাশ ? মেডিক্যাল রিপোর্ট আলমারির লকারে থাকে, শুনেছে কেউ কোনদিন ? কার কাছ থেকে লুকোচ্ছিলে প্রকাশ ? আমি-তুমি ছাড়া আর তো কেউ নেই বাড়িতে ! আমাকেই জানতে দিতে চাওনি যে তুমি স্টেরাইল ? তোমার স্পার্ম কাউন্ট খুব কম, প্রায় nil . কোনদিন সন্তান দিতে পারবে না তুমি আমাকে। মনটা তেতো হয়ে গেল। না সন্তান দিতে পারবে না বলে নয়, তুমি এ কথা লুকোলে কেন আমার কাছে ? তুমি তো বেশ কিছুদিন আগেই জেনেছ, পুরনো রিপোর্ট সবগুলোই। এই জন্যই কিছুদিন ধরে তুমি চাবি হাতছাড়া করনা, আলমারি গুছাতে দাওনা আমাকে, তোমার নাকি দরকারী কগজ-পত্র আছে, হারালে মুশকিল ! আজ তাড়াহুড়ায় কি করে যেন ভুলে ফেলে গেছ, আমি ভাবলাম আলমারিটা গুছিয়ে দি, তুমি খুশি হবে, ভালবাসবে আমাকে। কিন্তু খুলে আমি তো বোকা হয়ে গেলাম, এই তোমার দরকারী কাগজ প্রকাশ ? যা আমাদের দুজনের জানার কথা, একা জেনে, লুকিয়ে রেখেছ আমার কাছ থেকে !

তুমি নিজের অক্ষমতা জেনেছ অনেক আগেই, তবু কেন আমাকে টেনে নিয়ে যেতে ডাক্তারের কাছে ? সব বুঝতে পারছি প্রকাশ, প্রতিটা ডাক্তার দেখানোর আগে কি করে যেন সবাই জেনে যেত। এক থেকে এক বড় ডাক্তার দেখছে আমাকে, সবাই জানত, করুণা দেখাত। আমি অবাক হতাম, রাগ করতাম। সন্তান হীনতা স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপার, সারা দুনিয়া জানবে কেন ? তুমি বলতে... 'ওরা যে জানতে চায়' ...কেন জানাতে প্রকাশ ? সবাইকে দেখাতে চাইতে যে আমার দোষেই সন্তান হচ্ছে না ! কি বলতে তুমি ওদের ? কেন ওরা ডাক্তারের কাছে যাওয়ার আগে কৌতূহল দেখাত, কিন্তু দেখানোর পরে আর নয় ? তাহলে ওরা কি কোনো ভুল খবর পেত প্রকাশ ? বুঝে ফেলত আমার দোষেই আমাদের সন্তান হয় না ! আমার মা না হতে পারার জন্য তুমি দায়ী নও, তাই ইদানিং সকলে আমাকে কেমন একরকম করে দেখত, আজ বুঝতে পারছি সব। পরিচিত লোক সকলে জানে আমি বন্ধ্যা। 

নিতে পারছিনা আমি, মানতে পারছিনা। এত তঞ্চকতা, তোমার পৌরুষের গর্বে যাতে এতটুকু আঁচ না লাগে, তাই আমার নারীত্বের অপমান হতে দিলে অক্লেশে, একবার তোমার বিবেকে বাঁধলো না ? এই প্রকাশ কে আমি চিনি না তো ! এত বছরের বিবাহিত জীবন ( কত যেন? হ্যা, কুড়ি বছর ), তার আগে সাত বছরের ভালবাসা আমাদের, তোমাকে কখনো এমন জানিনি তো ! এতো সম্পূর্ণ অচেনা একজন পুরুষ, যে কিনা স্ত্রীর সম্মান খাটো করে নিজের ঠুনকো পৌরুষের অহংকার বজায় রাখতে চায় ! মিথ্যা বলতেও বাঁধে না তার জন্য। সেই চিরাচরিত পুরুষ, নারীর মানের পরোয়া না করে, নিজের পৌরুষের গর্ব অক্ষুন্ন রাখতে চায় ! এই পুরুষ তো আমার স্বামী নয়, সে কেবলমাত্র গর্বিত এক পুরুষ ! আমার ঘেন্না করছে প্রকাশ, তোমাকে, নিজেকেও। এমন স্বামীর ঘর করেছি, তাকে ভালোবেসেছি, তার ভালবাসা পেয়ে গর্বিত হয়েছি। আজ আমি নিঃস্ব প্রকাশ, সব বিশ্বাস ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। সন্তান হীনতার দুঃখ তো মেনে নিয়েছিলাম আমি, না হয় দত্তক নিতাম আমরা ! কিন্তু অত বড় কথাটা আমার কাছে লুকোলে কেন তুমি ? এটা আমাদের দুজনের ব্যাপার, কিন্তু এখন অব্দি তোমার একার ইচ্ছেয় সব হয়েছে। ভাবিষ্যতেও হবে, তুমি যে পুরুষ, জগতে তোমার কথাই তো শেষ কথা ! না প্রকাশ, আর হবে না, আমি পারব না তোমাকে আর মেনে নিতে। তোমার মুখ দেখতেও অনীহা আমার ! চিরদিনের জন্য ভেঙ্গে দিচ্ছি আমাদের সম্পর্ক। লোকেদের কি বলবে সে তুমি জানো, অনেক মিথ্যা বলেছ, আরো দুটো না হয় বললে ! এ সম্পর্ক এমনিতেও টিঁকতো না প্রকাশ ! বিশ্বাসের ভিত আলগা থাকলে টেঁকে না। আমি ভেঙ্গে দিচ্ছি, আমি চলে যাচ্ছি !"

চিঠিটা পড়ে হতভম্ব হয়ে যায় মলি ও সমীর, সত্যি তারাও তো জানত বুলির-ই কি সব প্রবলেম আছে, তাই ছেলে-মেয়ে হয় না, অথচ... 'কোথা থেকে এত ঘুমের ট্যাবলেট পেল কে জানে ! মাঝে মাঝে ঘুম হত না অবশ্য, ডাক্তারদের কাছে চেয়ে নিত ঘুমের ওষুধ, খেত না খুব একটা, রাখা থাকত, সেগুলো যে এভাবে কাজে আসবে,'...কথা শেষ হয় না গলা বুজে যায় প্রকাশের, কখন যেন ও ঘর থেকে এসে এদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে, ওরা জানেও না। এখন প্রাপ্ত বয়স্ক তিন পুরুষ ও নারী নিজের নিজের ভাবনায় নিমগ্ন বসে থাকে, পুরনো গ্র্যান্ড ফাদার ক্লক-এর পেন্ডুলামে শুধু আওয়াজ ওঠে টিক্‌ টিক্‌, টিক্‌ টিক্‌ ...





0 comments: