ছোটগল্পঃ ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী
Posted in ছোটগল্পছোটগল্প
মঞ্জু
ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী
আমার বাড়ীর কাজের মহিলা ‘মঞ্জু’ বয়েস বেশি না , কিন্তু তিন মেয়ের মা ।
বর অটো চালায় । মেয়েগুলোকে স্কুলে পড়ায় । আজকাল রোজ দেরি করে আসে নয় তাড়াতাড়ি কাজ সেরে পালায় অন্য বাড়ীর কাজ করতে । মহা মুস্কিল এরকম ত ছিলনা ।
মঞ্জু আমাদের দুজনের দুপুরের খাবার, আমার জন্য সকালে তরিবাতের জলখাবার, এই সব রান্না করতে করতে প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় নিত। আগে আসত সকাল ৭ টায় যেত প্রায় সকাল ৮.৩০ । এখন আসে ৮ টায় এক ঘণ্টায় সব কাজ সেরে চলে যায় । কিছু বললে হেসে বলে, “মেসো খাওয়াটা কমাও । ওত খেলে শরীর খারাপ করবে ।” আমি এক ঘণ্টায় তোমাদের রান্না বান্না সব করে দিচ্ছি । আরেকজন দাদার বাড়ীর বৌদি, তারাও আমাকে রেখেছে রান্না করার জন্য আধ ঘণ্টায় সব করে দি । সকালের জলখাবার ওট আর দুধ । ডিম সিদ্ধ ডাল ভাত একটা ভাজা, নয় সবজি, নয় মাছের ঝাল আর ভাত খেয়ে দুজনে অফিস চলে যায়, ফিরে রাতে দুখানি রুটি আর সকালের তরকারি, এক কাপ দুধ খেয়ে ঘুমোয় ।
আমি বলি - তুই কি করে জানলি ওরা কি খায় আর না খায় ! ওরা হয়ত বাইরে কিছু খেয়ে আসে । তোর যা রান্না, নেহাত তোর মাসির অসুখ বলে আমি তোর হাতের রান্না খাচ্ছি নাহলে কে খাবে তোর হাতের রান্না ! নুনের মাপ জানলিনা, তুই কি রান্না করিস রে । সর্বদা আমার খাওয়ার দিকে তোর নজর । আমরা খানদানি ঘরের ছেলে । বাপ দাদার আমলে খাওয়াটা পরিপাটি ছিল ...আছে... থাকবে ।
দাদা আমেরিকা থেকে আমার জন্য নেল কাটার, আমার মেয়ের জন্য টকিং ডল, গায়ে মাখার সাবান, পারফিউম সব এনে দিয়েছে । তোমরা মাস মাহিনা ছাড়া কি দাও আমাকে ।
আমি বলি, আমি কি তোর জন্য আমেরিকা যাব । যত সব, চা দে ! তুই চিটফান্ডে যে টাকা রেখেছিলি পেলি ?
না পাবনা আর । কি আর হবে ? কিচ্ছু হবে না । যে যেমন আছে সেইরকম ই থাকবে । কি লাভ আমাদের টাকা তো পাবনা আর ... হতাশ হয়ে বলে ! গরীবের টাকা এভাবেই যুগ যুগ ধরে রাঘব বোয়ালের পেটে যায় । কিছু করার নেই। ও টাকা পাওয়ার আর আশা করি না মেসো ! চোখ পুঁছে মঞ্জু চলে যায় ওখান থেকে।
তা তোদের মতন লোকেরা আবার আরেকটা কোন চিট ফান্ডের ফাঁদে পড়বি । আহ্লাদে আটখানা, দেখিস ?
সেটা আবার কি গো মেসো ? তুমি এতসব দ্যাখ মেসো ?
হ্যাঁ, দেখি। আর কি করব বল ? তোদের বয়েসে খাওয়ার সময় পেতাম না । এখন বসে শুয়ে দিন কাটে না । সকাল বিকেল হাঁটি, বাজার করি, মাঝে মধ্যে ব্যাঙ্কে যাই, বিকেলে কারে ঘুরি কখন সখন, তাও ড্রাইভার থাকলে । ড্রাইভার না এলে নিজের গাড়ী নিজেই পুঁছি ।
মেসো দাদা কবে আসবে ? অনেক দিন আসে না ।
ও আমেরিকা গিয়েছে আসবে কি করে ? ওকে আরও বছর খানেক থাকতে হবে । বৌমা, নাতনী সব ওখানে । ফিরবে কিনা কে জানে ?
তা তুমি কি আমার হাতের রান্না খেয়ে দিন কাটাবে ? তোমার বৌমা এলে তোমায় রান্না করে দেবে না ?
আকাশ থেকে পড়লি নাকি ! তোর এতো প্রশ্নের কি দরকার । যা মাসির ঘরে যা । বৌমা রান্না করবে ? কি সব বলে ! খুব আস্পর্ধা হয়েছে তোর । আমার ঘরে আর আসবিনা । তুই জানিস ওর বিষয় ?
যাইগো বেলা হল । ও মাসী যাই ।
হ্যাঁ আয় । কি ফুটুর ফুটুর করছিলি শুনি ?
নাগো মেসোক বৌদির রান্না করার কথা বলাতে রেগে গিয়ে আমাকে যেতে বলছে ।
ও হরি । ও রান্না করবে কিরে ? ওরা কি আমাদের আমলের মেয়ে ? ওখানে ছেলেটা কি খায় কি করে কে জানে ? তুই আয় এবার । কেন ফটর ফটর করিস মেসোর সঙ্গে ? জানিস তো ও বৌমার নিন্দে একদম শুনতে ভালো বাসেনা । আমাকেই হাটিয়ে দেয় । নিজে দেখে এনেছে না ! খুব ভালো বাসে তাই । আমাদের মেয়ে নেইত । ওকেই মেয়ের স্নেহ দেয় । বৌমাও তোর মেসোকে খুব যত্ন করে এলে । চা নিজের হাতে বানিয়ে দেয় । ও থাকলে আমার হাতের চা খায়না । বৌমাকে বলে লেমন টি বানাতে, নয় হার্বাল টি ।
সেতো দেখেছি আমি । মেসোর মন রাখতে খুব জানে তোমার বৌমা ।
এই মঞ্জু তুই গেলি ............. । আমার গলার আওয়াজ শুনে মঞ্জু পালায় ।
মঞ্জু যাওয়ার পর আমি গিন্নীকে বলি ... ওকে ছাড়িয়ে অন্য লোক রাখবো । খুব
বাড় বেড়েছে ওর।
অন্য লোক ওই মাইনেতে আর এখন পাবে না ।
দু হাজার টাকা কি কম ? মাস-গেলে আমার নতুন চাকরীতে ওই মাইনে পেতাম না ।
তখন দিন কাল আলাদা ছিল। লোকে শান্তিতে ছিল। এখনকার কালে দু হাজার টাকার কি দাম বল।
তা অবশ্য ছিল ।
তবে ?
মঞ্জুর মতন কাজের লোক আর পাবে না । তোমার অনেক ফাই ফরমাজ খাটে । তোমার জামা কাপড় সব মুখ বুজে কাচে । ও নিজেই বলে ওয়াশিং মেশিনের
দরকার নেই মাসি, ওইটুকু আমি নিজেই পারবো। ওকে তাড়ানো চলবেনা । মঞ্জু আমাদের বিশ্বাসী মেয়ে ওর ওপর ভরসা করে সব ছেড়ে যাওয়া যায় । এখনকার কাজের লোক কে কোথায় চুরি করে নিয়ে যাবে ! না বাবা মঞ্জুই ভালো । আমরা দুজন থাকি এত বড় ঘরে । ঘর ভর্তি জিনিস । কিছু হাত সাফাই করলে কিছুই বোঝার উপায় নেই । ও তাও চেয়ে নেয় । এইতো সেদিন দুটো সিলিং ফ্যান দিলাম । বলে গরমে মেয়েরা পড়াশুনো করতে পারে না মাসি । তোমাদের ত এসি আছ, আমরা গরমে সিদ্ধ হয়ে যাই । নতুন ফ্যান গুলো, তাও দিয়ে দিলাম । মেয়েটার ওপর মায়া হয়। ওর বরটা কিছুই করেনা । তার ওপর শাশুড়ি আছে । সব শুষে খাবার লোক, কেউ কোন উপকারে আসেনা । ওর বাড়িতে ওই একমাত্র রোজগার করে বাকি সবাই ওর ওপর নির্ভরশীল ।
এই ভারতবর্ষে এরকম অনেক মঞ্জু নিজের গতর খাটিয়ে পয়সা রোজগার করে স্বামী, পুত্র, কন্যার ভরনপোষণের দায়িত্ব নিয়েছে । নিজেকে নিংড়ে টাকা রোজগার করে, মুখে কোন প্রতিবাদ নেই... আছে শুধু ফেকাশে হাসি ।
0 comments: