বিশেষ রচনাঃ ঈশানী রায়চৌধুরী
Posted in বিশেষ রচনা
বিশেষ রচনা
কৃষ্ণচূড়া আখ্যান
ঈশানী রায়চৌধুরী
সে ছিল এক পাগলী কৃষ্ণচূড়া | এক্কেবারে পাগলী | তার বাবা সামান্য কেরাণীর চাকরি করতেন | মাসের মধ্যে অর্ধেক দিনই ট্যুরে | মা নিপুণ হাতে দরাজ বুকে আগলে রাখতেন খুব স্বল্প স্বাচ্ছন্দ্যের সংসার | অর্থের অভাব ছিল হয়ত, প্রাচুর্য ছিল না ; কিন্তু মনের দৈন্যও তো ছিল না ! দু'টি খুদে ভাই বোন ছিল | তাদের জন্য পরাণ ফাটত তার | ভাই বড় চঞ্চল | সারা দুপুর উঠোনে ক্রিকেট | দিদির সঙ্গে | মা দুপুরে দু'চোখের পাতা বুজতে পারেন না | রেগেমেগে গুমগুমিয়ে কিলোতে এলে দিদি পিঠ পেতে দেয় নিজের | ভাইটা যখন একবছরের , ওরা থাকত বেঙ্গল কেমিক্যালে | সেখানে খালের জলে ডুবে যাচ্ছিল ভাইটা | সাঁতার না জেনেই তার ছ'বছরের খুদে দিদি জলে ঝাঁপ দিয়েছিল সেদিন | বাকিটা মাঝিমাল্লার গল্প |
মেয়েটা বড় বুদ্ধিমতী | অঙ্কে খুব মাথা | কিন্তু ওই যে, খালি ঝোঁক পড়ার বইয়ের ফাঁকে গল্পের বই লুকোনোর | বই কিনে আর কত পড়বে ! চেয়েচিন্তে আনে | আর ক্যারাম | এখন ওরা বেঙ্গল কেমিক্যালের পাট চুকিয়ে ভবানীপুরে | বাবা বড্ড কড়া |নিম্ন মধ্যবিত্ত বা টেনেটুনে মধ্যবিত্তের সংসারে পড়াশুনো করতেই হবে ! তাই অসময়ে ক্যারাম পিটলে লালচোখ করে বাবা দেশজ ভাষায় বলেন , " ছেমড়ি , তর ওই ক্যারাম বোর্ড কাইট্যা আজ আখায় দিমু অনে |"
তাহলে মেয়েটা পাগলী কেন ? কারণ সে সাজুগুজু নিয়ে মাথা ঘামায় না | বায়নাবাটি করে না | এলোঝেলো হয়ে থাকে | আঁক কষা তার নেশা | চটি ছিঁড়ে গেলে সেফটিপিন লাগিয়ে কাজ চালায় | দুপুরে ইস্কুল থেকে ফিরলে একটা বড় বগি থালায় ভাত মেখে গোল্লা পাকিয়ে তার মা খাইয়ে দেন তিনজনকে | সে দেখেই না , তার ভাগের মাছটা ভাই খেয়ে নিল কিনা...সে পিঁড়িতে বাবু হয়ে বসে কোলে গল্পের বই রেখে পড়েই যায়, পড়েই যায় |
স্কুল শেষ হল | রেজাল্ট ভালো হল, কিন্তু আশানুরূপ হল না | কারণ একটা জ্যামিতির এক্সট্রা, ১২ নম্বরের, সে প্রশ্ন পড়তে ভুল করেছিল | সেটা নিয়ে রগড়াতে রগড়াতে চলে গেল সময় | অঙ্কে লেটার হল. একশ' হল না |
হল না তো আরও অনেক কিছুই | সার্জেন হতে চেয়েছিল, বায়োলোজি ক্লাসে নিখুঁত ডিসেকশন করত | বাবার টাকার জোর ছিল না | ডাক্তারী পড়তে, প্রতিষ্ঠিত হতে সময় লাগে | ইঞ্জিনীয়ারিং ? ছবি আঁকার হাত খুব ভালো | একমাত্র মেয়ে, যে অত বছর আগে পরীক্ষা দিয়ে খুব ভালো রেজাল্ট করে চান্স পেয়েছিল আর্কিটেকচার পড়তে | হল না | শিবপুরে তখন এ. সি . রায়ের আমল | তিনি বলেছিলেন, " তুমি একা মেয়ে | হোস্টেল দিতে পারব না | তুমি বাড়ির কাছে কোনো কলেজে পড় | তুমি তো অঙ্কে এক্সেলেন্ট, ফিজিক্স নিয়ে পড় |"
তাই সই | মর্নিং কলেজ | খুব ঘুমকাতুরে | সকালে রোজ দেরী | তাই রাতেই চুলে দু'বিনুনি বেঁধে শুতে হয় | সকালে উঠে চায়ে রুটি ডুবিয়ে খেয়ে কোনক্রমে আলনা থেকে একটা শাড়ি নামিয়ে শরীর ঢেকেঢুকে একছুটে কলেজ | তাকে কলেজে সবাই চেনে | যে মেয়েটা চুল না আঁচড়ে আসে রোজ রোজ, যে মেয়েটা দেখনহাসি |
পাগলী এবং দেখনহাসি | তার প্রেমে পড়েন অন্যবিভাগের এক সুপুরুষ অধ্যাপক | তিনি আবার বাপ মায়ের এক পুত্র এবং সুপুত্র | তাঁদেরও মধ্যবিত্ত সংসার | কিন্তু তাতে কী ? পাত্রপক্ষ তো ! প্রেমপর্ব চলছে | দাদারা, বন্ধুরা মধ্যস্থতা করছে | এর মধ্যে মেয়েটি স্নাতক স্তর উত্তীর্ণ হয়ে যায় | তার বাবা তখন উইদাউট পে বাড়িতে | দুর্ঘটনায় মারাত্মক জখম | মেয়েটি স্কুলে চাকরি করছে | বাড়িতে টাকার তো দরকার খুব | মাস্টার্স ? সে হবে'খন | না হয়, এক বছর পর | পাত্রের বাবা গোবেচারা, ভালোমানুষ | মা রণং দেহি | এই মরকুটে হাভাতে গরীবঘরের কালো মেয়ের হাসিতে মজেছে ছেলে ! বিয়ে হবে | কিন্তু গোড়া থেকে মেরে রেখে দাও | "আমাদের বাড়ির বউরা চাকরি করতে বাইরে যায় না |" মেয়েটি তখন মাত্রই উনিশ | তার বাবা বলেছিলেন, " এত ভালো পাত্র , আমি যেভাবে পারি চালিয়ে নেব | তুই চাকরিটা ছেড়েই দে | ওঁদের যখন ইচ্ছে নয় !"
ছেড়ে দিল সে চাকরি | স্কুলের চাকরি | সাউথ পয়েন্ট স্কুল | চেয়েচিন্তে কিছু ধারধোর করে বিয়ে হয়ে গেল তার | ছোট ভাইবোন কপাটের আড়াল থেকে দেখল দিদি যাচ্ছে শ্বশুরবাড়ি |
ফুলশয্যার রাতেই তার বর বলে দিয়েছিল, " আমি এক ছেলে | মায়ের অবাধ্য হতে পারব না | তোমায় মারুক, কাটুক..সইতে হবে |"
" আমি মাস্টার্স করব না ?"
" করবে | কিন্তু তা বলে সংসার চুলোয় দিয়ে নয় |"
রান্নার লোক ছিল এতদিন | এখন বউ এসেছে | কী দরকার ? আর এ বাড়ির সবাই টুকটুকে ফর্সা | বৌয়ের না আছে রূপের জোর .না আছে রুপোর | আর কালো রঙে উনুনপাড়ে গেলেই কী, না গেলেই কী |
সে রান্না করে , ঘর গোছায় | তোলা কাজের লোক না এলে বাসন মাজে , কাপড় কাচে| তারপর হাতের কাজ মিটলে ধুঁকতে ধুঁকতে ইউনিভার্সিটি যায় | আর ফিজিক্স নয় |এবার বিশুদ্ধ গণিত | প্র্যাক্টিকালের ঝামেলা নেই... তাই | সে ঠিক আছে | অঙ্ক মেয়েটির বিশল্যকরণী |
যেদিন বাড়িতে অতিথি এসে পড়েন কেউ, সেদিন কলেজ কামাই | চা জলখাবার দেবে কে ! তবে কোনো কোনো বিশেষ অতিথি এলে, বড়মানুষ অতিথি...সেদিন চা জলখাবার বানাতে হয় না বটে, তবে কলেজেও যাওয়া হয় না | সেদিন তাকে পুরো সময়টা তার শাশুড়ি বাথরুমে বন্ধ করে রাখেন | কালো বউ | ছি :|
মেয়েটি ভাবে, বাবার টাকা থাকলে তার রঙের জলুস বাড়ত কি ? একটু ?
সন্তানসম্ভবা হয় সে | এবং জন্ম দেয় এক কন্যার | এখানেও শাশুড়ি মুখ বেঁকান | "হয়েছে তো এক ডোমের চুপড়ি ধোয়া মেয়ে ! " প্রথম প্রথম নাতনীকে কোলেই নিতেন না | তারপর অবিশ্যি নাতনির গায়ের রংটি দেখে কিঞ্চিত মজেন | মেয়ের জন্ম দিয়ে তরুণী মা মরমে মরে থাকে | তার লেখাপড়া শিকেয় ওঠে | এত কথা... এত কথা... এত অত্যাচার... সে যখন ৭ মাস গর্ভবতী, মনের জ্বালা সইতে না পেরে গিয়েছিল গর্ভপাত করাতে | বলেছিল, "চাই না "| অনেক দেরী হয়ে গেছে | ডাক্তার রাজী হননি| সেই খুকী জানে, সে অবাঞ্ছিত ছিল | তার মায়ের কাছে | জানে, অনেক যন্ত্রণায় তার মা ছুটে গিয়েছিল ডাক্তারের কাছে | এও জানে, খোঁটার ভয়ে, যদি আবার মেয়ে হয়... সেই ভয়ে... তার মা কাকবন্ধ্যা রয়ে গেছে |
এরপর হল এক মজা | খুকী যেই বড় হল একটু, তার ঠাকুমা তাকে কুক্ষিগত করলেন| খুকী তাঁর কাছে খাবে, ঘুমোবে | খুকীর মা দূর থেকে দেখে, মেয়ে ঠাকুমার আঁচল ধরে গুটিগুটি হাঁটে | ঠাকুমার গলা জড়িয়ে গল্প শোনে | খুকীর মা বলে, "আয় না, আমার কাছে শুবি |" খুকি গা মুচড়ে বলে, "যা:, ঠাম্মা কাঁদবে |"
তরুণী মা রাঁধে বাড়ে, কর্তব্য করে | আত্মীয়স্বজনের যত্ন করে দু'হাতে | এখন লোকের চোখে কালো রং সয়ে গেছে | খুকী পড়ে -..তার মায়ের কাছে | ফ্রক সেলাই করে... মা | চুল বেঁধে দেয়... মা | মা তার প্রয়োজনের জায়গা | ঠাকুমা তার আব্দারের, আহ্লাদের |
তরুণী মা | চারাগাছ থেকে ফুলধরানো ডাল | খুকী | খুকী বড় হয় | ইস্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি...
খুকী অঙ্কে ভালো | কিন্তু মেধায় সে তার মায়ের পায়ের নখের যুগ্যি নয় | খুকীও চারাগাছ ছিল, কিন্তু তাতে জল পড়েছে, সার পড়েছে | খুকীর মা ? গাছ বেড়েছে, পরিচর্যা পায়নি |
খুকীর মায়ের চুলে রুপোর তার | অনেক | অনেক | কিন্তু চুলের আড়ালে তীক্ষ্ণ মেধায় এখনও যেকোনো অঙ্ক কষা হয়ে যায় হেলায়, কঠিনতম সুডোকু বা অঙ্কের ধাঁধা রেকর্ড সময়ে, যেকোনো হাতের কাজ নিখুঁত পারদর্শিতায়, আই কিউ লেভেল পরীক্ষা করতে ভয় পায় খুকী | জানে, মায়ের কাছে হেরে ভূত হয়ে যাবে |
দেখনহাসি আছে আগের মতোই | চোখের দীপ্তিও | তেমনই ঝকঝকে | বয়সের সর পড়েছে সামান্য | তাতে সৌন্দর্য এখন অন্য মাত্রায় |
খুকী চোখ বুজলেই দেখতে পায় , তার মায়ের ডুরে শাড়ির আঁচল মিলিয়ে যাচ্ছে ট্রামলাইন পেরিয়ে | ইউনিভার্সিটির দিকে |
দেখনহাসি নাকি নিজের কথা লিখেছে একটা | মোটা রুলটানা খাতায় | কাউকে পড়ায়নি | কে জানে ! সঙ্কোচে, নাকি অভিমানে?
এ এক অন্য কৃষ্ণচূড়া | কতটা আকাশ ছুঁয়েছিল.. জানি না | তবে ছায়া দিয়েছিল | ফুলও |
অসাধারণ শব্দটা খুব ক্লিশে হয়ে গেছে। শুধু বলি, অনেক লেখার মাঝে থেকেও ঈশানী সবসময়েই স্বতন্ত্র। তাঁর মননে, শব্দ চয়নে এবং লেখন ভঙ্গীতে।
ReplyDeleteThis comment has been removed by the author.
ReplyDeleteইংরেজ কবি Shelley বলেছিলেন, ''our sweetest songs are those / that tell of saddest thought...''.। একটু পাওয়া, আর অনেক না পাওয়ার সুতোর টানাপোড়েনে বোনা এই লেখাটি একখানি সার্থক পূর্ণ উপন্যাস হয়ে ডানা মেলে দিতে পারে সহজেই ।মন-ছুঁয়ে যাওয়া লেখা ।।
ReplyDelete