3

অতিথি সম্পাদকের কলমেঃ পিয়ালি বসু

Posted in


অতিথি সম্পাদকের কলমে

পিয়ালি বসু



ফেব্রুয়ারী মাস ! আর অবধারিত ভাবেই এসে পড়ছে ২১ শে ফেব্রুয়ারী, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস -এর কথা । 

মাতৃভাষা দিবসের প্রাক্কালে বরং একবার দেখে নেওয়া যাক বাংলা (ওটিই আমাদের মাতৃভাষা কিনা) ভাষা টিকে ।

মাগধী প্রাকৃত আর সংস্কৃত ভাষা-র অপভ্রংশ হিসেবেই বাংলা ভাষাটির জন্ম বলে ভাষাবিদ্‌রা দাবী করে থাকেন, Most Spoken language এবং ভারতবর্ষের দ্বিতীয় বৃহত্তম হিসেবে এ ভাষাটিই স্বীকৃত, নিজেকে বাঙালী ভেবে গর্বিত না হওয়ার কোন কারণ আছে কি এরপর ? পশ্চিমবঙ্গ আসাম, ত্রিপুরা আর বাংলাদেশ মিলিয়ে বাংলা ভাষাভাষী দের সংখ্যা নেহাত কম নয় কিন্তু । বাংলা নামক এই ভাষাটির ইতিহাস ঘাঁটলে এটুকু জানা যায় যে বাংলা ভাষাটিকে প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক এই তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়, প্রাচীন বাংলাভাষার নিদর্শন হিসেবে চর্যাপদ এর কথা বাংলা সাহিত্য নিয়ে নাড়াচাড়া করা যে কেউই বলতে পারবেন । 

পঞ্চদশ শতাব্দী থেকেই বাংলা ভাষা বেশ স্বাবলম্বী হল বলা যায় ! যতই আমরা ধর্মের নামে গলাবাজি করি না কেন, আসল ভিত কিন্তু সেই কৃত্তিবাসী রামায়ণ, বড়ু চণ্ডীদাস বা মালাধর বসুরই তৈরি করা । চৈতন্যভাগবত, চণ্ডীমঙ্গল আদতে কিন্তু ধর্মের মোড়কে গল্প কাহিনী । সপ্তদশ শতকে দৌলত কাজীর সতিময়না উপাখ্যান ছাড়া চোখে পড়ার মতো তেমন কিছুই নেই । 

বেশ ঢিমে তালে চলতে চলতে বাংলা ভাষা এসে বিরাট এক ধাক্কা খেলো উনবিংশ শতকে...বঙ্গ পণ্ডিতরা তাকে রেনেসাঁ বলেই চিহ্নিত করে থাকেন । ইতালীয় শব্দ রেনেসাঁ অর্থাৎ নবজাগরণ, নতুন ভাবে জেগে উঠলো বাংলা ভাষা তার শতবর্ষের নিদ্রা ভেঙে । মাইকেল মধুসূদন দত্ত আর বঙ্কিমচন্দ্র চট্ট্যোপাধ্যায়  এসে হাল ধরলেন, জাগিয়ে তুললেন বাংলা কে। বঙ্কিমের আলালের ঘরের দুলাল, দুর্গেশনন্দিনী, কপালকুণ্ডলা-র পাশাপাশি নতুন আঙ্গিকে রামায়ণ কে দেখালেন মধুসূদন, তাঁর মেঘনাদ বধ কাব্যের মাধ্যমে । রাবণ নয়, বরং রামই হয়ে উঠলেন Anti Hero । 

এ সময়ে বাংলা সাহিত্য এতোটাই flourish করেছিলো, যে সত্যিই তাকে তালিকায় বেঁধে রাখা অসম্ভব, বিহারীলাল চক্রবর্তী, মোহিতলাল মজুমদার, গিরিশ্চন্দ্র ঘোষ, বিদ্যাসাগর, দীনবন্ধু মিত্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র চট্ট্যোপাধ্যায়, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, নজরুল ইসলাম, আরও পরে কল্লোল গোষ্ঠীর উদ্ভব এবং এক ঝাঁক নব্য টগবগে লেখকবর্গের আবির্ভাব ! বিভূতিভূষণ, মানিক, তারাশংকর বন্দ্যপাধ্যায়ের পাশাপাশি প্রমথনাথ বিশী, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, রাজশেখর বসু, পরে সমরেশ বসু, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বিজন ভট্টাচার্য, মহাশ্বেতা দেবী, সুনীল গাঙ্গুলি, বুদ্ধদেব গুহ... তালিকাটা বড়োই দীর্ঘ এবং কোনোভাবেই সম্ভব নয় সে যুগের প্লাবন কে এভাবে তালিকাবন্দি করা, উচিতও নয় সম্ভবত । 

“এখনও যে টুকু বাংলা এটুকু থাকবে তো ? এটুকুও? আগে বাংলা ছিল, পরে টুকরো হয়ে পূব ও পশ্চিম; পূবে পাকিস্তান হল, পরে তাই হল বাংলাদেশ--- সাবেক বাংলার দুই তৃতীয়াংশ, তবুও তো, তবুও তা পুরো বাংলা নয়" ... 

দুঃখজনক, তবুও এটাই আপাত সত্যিই, দেশ ভেঙেছে, ভেঙেছে সংসার, ঘর বাড়ি, এমনকি মন টাও...তবুও কষ্টে শিষ্টে আমরা টিকিয়ে রাখতে পেরেছি বাংলা ভাষাকে...

আজ বরং ২১ শে ফেব্রুয়ারীর দিকে তাকিয়ে আরও একবার ভালবাসি আমাদের মাতৃভাষাকে !

3 comments:

1

প্রচ্ছদ নিবন্ধঃ ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ



ভাষা দিবসের তাৎপর্য
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়


১৯৯৯এর ১৭ই নভেম্বর বিশ্ব সংগঠন ইউনেসকো ২১শে ফেব্রুয়ারি দিনটিতে ‘বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস’ পালনের আহ্বান জানানোর পর বিশ্বের নানা প্রান্তের সঙ্গে এ বাংলাতেও ‘ভাষাদিবস’ পালনের রেওয়াজ শুরু হয় । ওপার বাংলাতো বটেই এ বাংলাতেও দু একটি ভাষাসংগঠন আরো আগে থেকেই ‘ভাষা শহিদ দিবস’ পালন করে আসছে প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটিতে । এপারের বরাক উপত্যকার বাংলাভাষীরা বিনম্র শ্রদ্ধায় একষট্টির ভাষা আন্দোলনে হত এগারো শহিদের স্মৃতিতর্পন করেন প্রতি বছর ১৯শে মে । এটা ভাষাদিবস পালনের একটি দিক ।

একুশে পালনের তাৎপর্য শুধুমাত্র ভাষা শহিদদের স্মৃতিতর্পন নয়, আরো কিছু । একুশে যেমন ভাষা শহিদ দিবস তেমনই মাতৃভাষা দিবস । মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা এবং আমাদের জীবনচর্যায় মাতৃভাষাকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দানের প্রত্যয়কে প্রসারিত করার দিনও । ১৯৫২র ভাষা আন্দোলন – মাতৃভাষার মর্যাদার দাবিতে সেদিনের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম অবশেষে এক স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিল যার রাষ্ট্রভাষা বাংলা । একুশের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ওপারে বাংলার মত এক সমৃদ্ধ ভাষার সম্ভাব্য বিলুপ্তি রোধ করেছিল । ১৯৬১র ১৯শে মে’র বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন সেখানে মতৃভাষার অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করেছিল । মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য এমন নজির বিশ্ব ইতিহাসে আর নেই । কিন্তু এই ইতিহাস চর্চার বাইরে ভাষা দিবসের তাৎপর্য নবীন প্রজন্মের কাছে কতটা পৌঁছাতে পেরেছে, সে বিষয়ে সংশয় থেকে যায় ।

ভারতে বাংলা ভাষা দুটি রাজ্যের সরকারী ভাষা । কিন্তু এই যে গত ষোল বছর ধরে আমরা ঘটা করে ভাষাদিবস পালন করছি, নবীন প্রজন্মের কাছে তার আবেদন কতটুকু পৌঁছায় কিংবা ভাষা-আবেগ তাদের কতটুকু স্পর্শ করে তা বোঝার উপায় নেই । এখানে বাংলা চাকুরি পাওয়ার ভাষা নয়, উচ্চশিক্ষা লাভের ভাষা নয়, এমনকি রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ভাষাও নয় । কিন্তু সেটাই বাংলা ভাষার নিজভূমে দুয়োরানী হয়ে থাকার একমাত্র কারণ নয় । তবে হ্যাঁ, ক্ষীণ কন্ঠে এটা জানান দেওয়া গেছে যে বছরের ৩৬৫ দিনের একটা দিন ভাষা দিবসের নামে বরাদ্দ করা হয়েছে । অনেকে আবার ভাবতে পারেন, ভাবেনও যে, তা হোক না । নারী দিবস, প্রবীণ নাগরিক দিবস, বাবা দিবস, এমনকি হুইস্কি দিবসও তো বরাদ্দ আছে । আশঙ্কা হয়, এদেশে ভাষাদিবস ভাষা উৎসব না হয়ে যায় । কারণ উৎসবের ফন্দি-ফিকির খুঁজতে আমরা বেশ দড় । তাই ভাষাদিবসের তাৎপর্য যাদের সবচেয়ে বেশি জানা দরকার সেই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা থেকে যায় অন্ধকারে ।

আশির দশকের মধ্যভাগ থেকে ‘বিশ্বায়ন’ নামক পাঁচ অক্ষরের এক দানবীয় বন্দোবস্ত তার অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের কৌশল হিসাবে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির ভাষাগত বহুত্ববাদ ও সাংস্কৃতিক ভারসাম্য ধ্বংস করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে । সেই প্রক্রিয়ারই অঙ্গ হিসাবে আমরা টেলিভিশন, সংবাদপত্র, বিজ্ঞাপন, মোবাইল ফোনের এসএমএস ইত্যাদির মধ্য দিয়ে এক বিকৃত ভাষা রপ্ত করে নিচ্ছে নবীন প্রজন্মের শিশুরা, গড়ে তুলছে নিজ মাতৃভাষার সঙ্গে অনাত্মিয়তা ।

বিশ্বের আদিম জনগোষ্ঠীগুলির মাতৃভাষার ক্রমবিলুপ্তি রাষ্ট্রসঙ্ঘকে বিচলিত করেছিল । বস্তুত, বিশ্বের ভাষাবিজ্ঞানীরা ধারাবাহিক গবেষণা শুরু করেছিলেন, বিশ্বায়ন কি ভাবে অনুন্নত জনগোষ্ঠীগুলির ভাষাগত ভারসাম্য এলোমেলো করে দিতে পারে সেই বিষয়ে । রাষ্ট্রসঙ্ঘের অধীনে এই বিষয়ে একাধিক গবেষণা হয়েছে, যেখান থেকে উঠে এসেছিল এক ভয়াবহ ছবি । তারা রাষ্ট্রসঙ্ঘকে সতর্কিত করেছিলেন যে এই শতাব্দীর মধ্যে বিশ্বের ছয় হাজার মাতৃভাষার বিলুপ্তি ঘটবে, যদি না ভাষা বিলুপ্তির এই প্রবণতাকে ঠেকানো যায় । আমরা জানি আদিম ভাষাগোষ্ঠীর ক্রমবিলুপ্তি ছিল উপনিবেশবাদের অনিবার্য ফল । আজকের অর্থনৈতিক উপনিবেশবাদের আবহে সেই ট্রাডিশনের অন্যথা হবার কথা নয় ।

কোন ভাষার বিলুপ্তি ঘটে তখন, যখন সেই ভাষায় কথা বলার আর একটি লোকও থাকে না । আমরা জানি, গত দুশো বছরে ইউরোপীয় উপনিবেশবাদ বহু জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষাকে চিরতরে লোপাট করে দিয়েছে । আমেরিকার আদিম জনগোষ্ঠী বা কালো মানুষরা জানে না, তাদের মাতৃভাষা কেমন ছিল । মেক্সিকো কিংবা মরিসাসের মানুষ জানে না তাদের মাতৃভাষা কি ছিল । আমরা আত্মপ্রসাদ লাভ করতে পারি এই ভেবে যে, বাংলার মত এতো সাহিত্য-সম্পদ সমৃদ্ধ ভাষা, যে ভাষায় রবীন্দ্রনাথ আছেন, সে ভাষার মৃত্যু হতে পারে না কোন দিন । হ্যাঁ, পারে । সংস্কৃতেও তো কালিদাস, ভারবি, ভাস ছিলেন, সে ভাষাও মৃত । অহম ভাষা একসময় খুব সমৃদ্ধ ভাষা ছিল । ১৩ থেকে ১৮ শতাব্দী পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় শাসন করতো অহম জনজাতি । ১২২৮ থেকে ১৮২৬ পর্যন্ত অহম গণরাজ্যের প্রধান ভাষা ছিল ‘অহম’। ১৯ শতাব্দীর মধ্যে এই ভাষাটি সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে । বিষয়টা তো এই যে আমরা সেই ভাষায় কথা বলছি কি না, সেই ভাষাতেই আমার সৃজনশীলতা পুষ্ট হচ্ছে কি না । শিশুরা বা নবীন প্রজন্ম যদি তাদের দৈনন্দিন জীবনে, জীবনচর্যায় মাতৃভাষার উচ্চারণ থেকে বিরত থাকে তবে সেই ভাষার মৃত্যু ঠেকানো যায় না । এপারের বাঙ্গালাভাষীদের অশেষ সৌভাগ্য যে বাঙ্গালী জাতিসত্তার একটা স্থায়ী ঠিকানা আছে – বাংলা দেশ, যার রাষ্ট্রভাষা বাংলা । 

ভাষা বিলুপ্তি সম্পর্কে সারা বিশ্বকে প্রথম যিনি সচেতন করেছিলেন, সেই আলাস্কা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপ্‌ মাইকেল ক্রাউস ২০০৭এ একটি তথ্য দিয়েছিলেন যে, সারা বিশ্বে সক্রিয় ভাবে চালু সাত হাজার ভাষাকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যায় নিরাপদ, প্রায় বিপন্ন ও বিপন্ন ভাষা । তাঁর মতে সেই ভাষাকেই নিরাপদ বলে মনে করা হয় যদি শিশুরা ও নবীন প্রজন্ম আগামী একশো বছরে সেই ভাষা ব্যবহার করে তার দৈনন্দিন জীবনে । না করলে সেই ভাষা বিপন্ন ভাষা রূপেই চিহ্নিত হবে, ক্রম বিলুপ্তিই যার অনিবার্য পরিণাম । ২০০৯এ ইউনেসকোর বিশেষজ্ঞ সমিতির প্রতিবেদনে একই কথা বলা হয় যে, “একটি ভাষায় কথা বলা জনগন যদি তার দৈনন্দিন ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োগ করা থেকে বিরত থাকে, সেই ভাষায় আদান প্রদান করা মানুষের সংখ্যা যদি ক্রমাগত হ্রাস পেতে থাকে এবং সেই ভাষায় কথা বলার ধারা যদি পরবর্তী প্রজন্মে হস্তান্তরিত না হয় তবে তা বিপন্ন ভাষা রূপেই চিহ্নিত হবে” । 

তৃতীয় বিশ্বের ভাষাগত বহুত্ববাদ ও সাংস্কৃতিক ভারসাম্য তছনছ করে দেওয়াই উন্নত দেশগুলির অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের লক্ষ্য । তাঁরা চাইছেন সারা বিশ্বে মাত্র পাঁচ-ছটি ভাষায় মানুষ কথা বলবে । কারণ তাঁরা মনে করেন ভাষার কাজ শুধু সংযোগ সাধন করা বা ‘কমিউনিকেট’ করা । ভাষার নৃতাত্বিক উপযোগিতা তাঁদের কাছে গৌণ । তিন ধরনের প্রবণতা কোন জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করে দেয় । প্রাধান্য বিস্তারকারী কোন ভাষার চাপে নিজের মাতৃভাষার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এবং এই বিচ্ছিন্নতার ফলেই কয়েকটি প্রজন্ম ধরে কোন জনগোষ্ঠীর ভাষা ‘ভাষামৃত্যু’র দিকে এগিয়ে যায় । আবার কোন ভাষাগোষ্ঠী নিজের মাতৃভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে চায় সেই প্রাধান্য বিস্তারকারী ভাষার প্রকরণকে নিজ ভাষার সঙ্গে মিশ খাইয়ে দিয়ে । বিশ্বায়নের আড়কাঠি কর্পোরেট সংস্থাগুলি এই প্রক্রিয়ায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছে । তাদের বিজ্ঞাপন গুলিতে ব্যবহার হচ্ছে অদ্ভুত সব খিচুড়ি ভাষা ‘এ দিল মাঙ্গে মোর’, ‘ঠান্ডার নতুন ফান্ডা’ ইত্যাদি । 

দু বছর আগে , ২০১২র অক্টবরে লখণৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে ভাষা সংক্রান্ত এক সেমিনার হয়েছিল । সেই সেমিনারের প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংবাদপত্র ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’ জানিয়েছিল যে, ভারতে চালু ৩৮০টি আঞ্চলিক ভাষার ৯৬শতাংশ ভাষাই বিলুপ্তির পথে । ইউনেসকোর তথ্য অনুযায়ী ভারতে মৃত্যুর অপেক্ষায় দিন গুনছে ২৪২টি আঞ্চলিক ভাষা । এখন ভারতে মোট জনসংখ্যার ৪শতাংশ মানুষ এই মৃত্যুপথযাত্রী ভাষাগুলিতে কথা বলে, আর ৯৫শতাংশ মানুষ যে প্রধান ভারতীয় ভাষায় কথা বলে, তা ভারতে চালু ভাষা সম্মূহের ৪শতাংশ মাত্র । কি ভয়ঙ্কর ছবি উঠে আসছে ভারতকে ‘বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য’র গর্ব করা আমাদের কাছে ! 

এখন সারা বিশ্বে ৭৩৫৮টি ভাষা আছে, যার ৯০ শতাংশই ২০৫০এর মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে যাবে বলে ভাষা বিজ্ঞানিদের অনুমান । এর মধ্যে ৩৩০টি ভাষায় কথা বলে ১০লক্ষের বেশি মানুষ, ১৭৮টি ভাষায় কথা বলে ১০জন মানুষ, ২০০টি ভাষায় ১০জনেরও কম আর ৫১টি ভাষায় মাত্র একজন করে কথা বলার লোক আছে । সেই শেষতম মানুষটির মৃত্যুর সঙ্গেই সেই জনগোষ্ঠীটি তার ভাষাপরিচয় হারিয়ে ফেলবে । পরের প্রজন্ম জানবেও না তার পূর্বজদের মুখের ভাষা কেমন ছিল, কেমন গান তারা গাইতো, কি রকম ছড়া-গল্প-গান শুনতে শুনতে তাদের শিশুরা ঘুমিয়ে পড়তো ! ঠিক পাঁচবছর আগে ২০১০এর ২৬শে জানুয়ারি ভাষাপ্রেমিকদের সামনে এসেছিল এক বিষন্ন দিন, যেদিন আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের ৮৫ বছরের নিঃসন্তান বৃদ্ধা বো সিনিয়রের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গিয়েছে আন্দামানী জনজাতিরন্যতম প্রাচিন ভাষা ‘আকা বো’ । বো সিনিয়র ছিলেন সেই ভাষায় কথা বলা শেষতম মানুষ । ১৮৫৮তে ইংরাজরা আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে উপনবেশ করার সময় বো জনজাতির লোকসঙ্খ্যা ছিল পাঁচ হাজার আর বো সিনিয়রের মৃত্যুর সময় সেই সংখ্যাটা দাঁড়ায় ৫৮ জনে, যাদের মধ্যে তিনিই একমাত্র সেই ভাষাটি জানতেন । এই ভাবে ইতিহাসের একটি পৃষ্ঠাই যেন মুছে গিয়েছিল সে দিন ।

ভাষা বিলুপ্তির এই প্রক্রিয়া তীব্রতর হচ্ছে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলির ওপর উন্নত দেশগুলির প্রাধান্য বিস্তারের গতির সঙ্গে তাল রেখে । খোদ আমেরিকাতেই ১৯২টি জনজাতির ভাষা বিলুপ্তির পথে । ইন্দোনেশিয়ায় ১৪৭টি ও ভারতে ১৯২টি ভাষা অবলুপ্তির পথে । ভাষা বিলুপ্তির এই প্রবণতা রোখা না গেলে ভাষা বিজ্ঞানীদের অনুমান এই শতাব্দীর মধ্যেই ছ’হাজার ভাষাগোষ্ঠীর ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সংকট ঘনিয়ে আসবে ।

দু’বছর আগে ২০১৩তে বিশ্ব মাতৃভাষা দিবসের প্রাক্কালে ইউনেসকো একটি উদ্বেগজনক তথ্য জানিয়েছিল যে, বিশ্বে এখন কথা বলা অর্থাৎ চলতি ভাষাগুলির মধ্যে ২৫০০ ভাষাই বিপন্ন ভাষা এবং গত তিন প্রজন্মে দু’শটি ভাষার বিলুপ্তি ঘটে গেছে । এই যে আড়াই হাজার ভাষাকে বিপন্ন বলে চিহ্নিত করেছে সেগুলিকে তারা ভাগ করেছে এই ভাবে –

নিরাপদ নয় (আন-সেফ) – ৬০৭টি ভাষা

নিশ্চিত ভাবেই বিপন্ন – ৬৩২টি

মারাত্মক বিপন্ন – (সিভিয়ারলি এনডেনজার্ড)- ৫০২টি এবং

ভয়ঙ্কর বিপন্ন (ক্রিটিকালি এনডেনজার্ড) – ৫৩৮টি ভাষা ।

ভাষাবিজ্ঞানীরা বিশ্লেষণ করেছেন যে যখন তরুণ প্রজন্মএর মানুষ তার ভাষায় কথা বলে কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে, যেমন বাড়িতে – সেও ভাষা বিপন্ন ভাষা । শিশুরা যখন তার মাতৃভাষায় কথা বলে না, তখন সে ভাষা নিশ্চিত ভাবেই বিপন্ন । আবার যে ভাষায় বৃদ্ধ বা প্রবীণ অর্থাৎ দাদু-দিদিমারা কথা বলেন, পরের প্রজন্ম অর্থাৎ শিশুটির পিতা-মাতা সে ভাষা বুঝতে পারেন, কিন্তু তৃতীয় প্রজন্ম অর্থাৎ তাদের সন্তানদের সঙ্গে সেই ভাষায় আদান-প্রদান করেন না, সেই ভাষা ভাষা বিজ্ঞানীদের বিশ্লেষণে মারাত্মক ভাবে বিপন্ন । আর একটি ভাষায় শুধুমাত্র প্রবীণরাই কথা বলেন নিজেদের মধ্যে – সে ভাষা ভয়ঙ্কর ভাবে বিপন্ন । 

স্বাধীন ভারতেও উপজাতি ভাষাগোষ্ঠীর মাতৃভাষাগুলিকে রক্ষা করার কোন অর্থবহ প্রয়াস দেখা যায় না । ভারতে অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষাগুলি কতটা বিপন্ন সে হিসাব কোন সমাজতাত্বিক করে উঠতে পেরেছেন কি না জানা নেই । কিন্তু এটা তো জানি এদেশেও অনেক প্রাধান্য বিস্তারকারী ভাষা অনেক আঞ্চলিক ভাষাকেই গিলে ফেলেছে । ১৯৯১সালের জন গণনায় স্বীকার করা হয়েছিল যে ভারতে হিন্দিভাষী মোট জনসংখ্যার ১০কোটি ৭২ লক্ষ মানুষের পৃথক ভাষা পরিচয় আছে । ভোজপুরি, বুন্দেলখন্ডি, মৈথিলী গোষ্ঠীগুলির পৃথক ভাষা পরিচয় থাকা সত্বেও সেগুলোকে হিন্দি গিলে ফেলে নিজের কলেবর মোটা করেছে । ১৯৯১ ও ২০০১এর দুটি জনগণনার প্রতিবেদন পাশাপাশি রাখলে দেখা যাবে এই দুটি জনগণনার মধ্যবর্তী সময়কালে সব প্রধান ভাষায় কথা বলা মানুষের সংখ্যা কমেছে, কিন্তু হিন্দির ক্ষেত্রে বেড়েছে। ১৯৯১ তে ভারতের মোট জনসংখ্যার ৮.২২% মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলতেন আর ২০০১এর জনগননায় এই সংখ্যাটা হয়ে গেছে ৮.০১% অর্থাৎ দশ বছরে ০.২১% মানুষ দশ বছর আগে যারা বাংলায় কথা বলতেন তারা অন্য ভাষায় কথা বলা শুরু করেছেন ।

কোন ভাষার লিখিত রূপ বা সাহিত্য থাকা বা না থাকা সেই ভাষার বেঁচে থাকার একমাত্র শর্ত নয়, জরুরিও নয় । ভাষার লিখিত রূপ বা সাহিত্য এসেছে অনেক পরে । আমরা জানি যে, মৌখিক ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্য ও সম্পদ অনেক বেশি । এই যে আমরা শিশুতোষ ছড়া-গল্প-গান শুনে বড় হই, চিরকাল শিশুরা মায়ের মুখে যে সব ছড়া-গল্প-গান শুনতে শুনতে ঘুমাতে যায়, সে তো মৌখিক সাহিত্য – আঞ্চলিক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অসামান্য সম্পদ, আমরা জানিনা, জানার প্রয়োজনও নেই, সেগুলি কার রচনা । সব আঞ্চলিক ভাষারই এই মৌখিক সাহিত্য-সম্পদ আছে । ভাষাচার্য সুকুমার সেন এই মৌখিক সাহিত্য বা শিশুতোষ ছড়া-গল্প-গান প্রসঙ্গে লিখেছেন “শিশু-বেদ বয়স্কের সাহিত্য-ভুবন ধরে আছে বাসুকীর মতো । শিশু-বেদের মধ্যে ধরা আছে সমগ্র মানবজাতির জন্মপত্রিকা” । কোন জনগোষ্ঠীর ভাষা বিলুপ্তির অর্থ সেই ভাষাগোষ্ঠীকে ঘিরে যে যে জ্ঞানভান্ডার, তারও বিলোপ । আদিম জনগোষ্ঠীর মৌখিক ভাষায় সঞ্চিত থাকে তার পরিবেশ, সংস্কৃতি, বন্য-প্রজাতি সম্পর্কিত জ্ঞানভান্ডার । সমস্ত জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রেই একই কথা বলা যায় । কারণ মানুষের জ্ঞানভান্ডারের অতি সামান্য অংশই লিখিত ও সাহিত্য রূপে থাকে, মানুষের মৌখিক জ্ঞানসম্পদ অনেক বেশি ব্যাপক ও বৈচিত্র্যপূর্ণ । কোন ভাষাগোষ্ঠীর বিলুপ্তির অর্থ অতয়েব সেই ভাষা অঞ্চলের নৃতাত্বিক ভারসাম্য তছনছ হয়ে যাওয়া ।

এই উদ্বেগের যায়গা থেকেই মাতৃভাষা পালনের আহবান জানিয়েছিল ইউনেসকো । মাতৃভাষায় কথা বলার পরম্পরাকে প্রজন্মের পর প্রজন্মে হস্তান্তর করতে না পারলে – শিশুদের নিজ মাতৃভাষায় কথা বলতে শেখানো আর আমাদের দৈনন্দিন জীবনে মাতৃভাষার ব্যবহারের মধ্য দিয়েই ভাষা-মৃত্যুর প্রবণতাকে রোধ করা যায় – অন্য কোন বিকল্প পন্থা নেই । এটাই ভাষাদিবস পালনের তাৎপর্য । একুশে যেমন ভাষাশহিদ স্মরণ দিবস তেমনই নিজ মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার প্রত্যয় প্রসারিত করার দিনও ।

1 comments:

2

বিশেষ প্রবন্ধঃ স্বপন দেব

Posted in


বিশেষ প্রবন্ধ


ভাষা ও মাতৃভাষা 
স্বপন দেব 



১৯৫২ সালে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের ৪৮ বছর পর ১৯৯৯ সালের ১৭ ই নভেম্বর ইউনেস্কো ২১শে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে ঘোষণা করে। প্রথমেই ভাষা শব্দের তাৎপর্য সম্পর্কে একটু আলোচনা করে নেওয়া যাক। কথোপকথনে আমরা যে ভাষাই ব্যবহার করিনা কেন, তা কিন্তু কোন নির্দিষ্ট জনসমষ্টির ভাষা। ভাষা হঠাৎ একদিনে গড়ে ওঠেনা। কোন জনগোষ্ঠীর ভাষা গড়ে ওঠে ক্রমাগত অনুশীলনের মাধ্যমে এবং তা কখনই স্থায়ী একটা রূপ নিয়ে থেমে থাকেনা। ভাষা একটা চলমান এবং বহমান প্রক্রিয়া, যা ভাঙ্গা গড়ার মধ্যে দিয়েই এগোতে থাকে। আর ঠিক এই কারণেই রবি ঠাকুরের মত কবি যে ভাষায় কথা বলতেন, এখন আর আমরা সেই ভাষায় কথা বলিনা; আবার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও ঠিক আমাদের এখনকার ভাষায় কথা বলবেনা। 

ভাষার ক্ষেত্রে প্রথমেই যেটা মনে আসে, তা হচ্ছে, মানুষের মুখে ভাষা ফুটলো কি করে ! ভাষা বলতে যদি গলা দিয়ে নির্দিষ্ট আওয়াজ তথা ধ্বনি ( সাউণ্ড) সৃষ্টি করে কিছু শব্দ ( ওয়ার্ড ) বা শব্দগুচ্ছ দিয়ে নিজের ধারণাকে অন্যের ধারণার সাথে যুক্ত করা বোঝায়, অর্থাৎ কথা বলা বোঝায়, তাহলে সেটা এমন কিছু শব্দ হতে হবে যার অর্থ কথক এবং শ্রোতার কাছে অভিন্ন। ব্যবহৃত শব্দগুলিকে খাপছাড়া ভাবে ব্যবহার করলেও চলবেনা। ভাষার ক্ষেত্রে এই পর্বে পৌঁছতে প্রতিটি জনগোষ্ঠীকে সুদীর্ঘ সময় পেরিয়ে আসতে হয়েছে। শুধু ভাষা কেন, মানুষের মানুষ হয়ে ওঠার ঐতিহাসিক পর্বগুলোও, কোনদিন বা কোন সময়ে স্থাণু নয়, হতে পারেনা। প্রকৃতির গতিশীলতা থেকে কোন কিছুই মুক্ত নয়, হতে পারেনা। তাই ভাষাও সর্বদাই চলমান এবং বহমান। 

মানুষের মস্তিষ্কের অসাধারণ উন্নতি অন্য সমস্ত জীবকুল থেকে আমাদের অনেকাংশেই পৃথক করে দিয়েছে। আর মস্তিষ্কের এই উন্নতির ফলে আমাদের স্বরযন্ত্রও হয়ে উঠেছে এতটাই উন্নত যে তার ধারে কাছেও অন্য কোন প্রাণী পৌঁছতে পারেনি। অন্য প্রাণীদের থেকে আমাদের মূল তফাৎ কিন্তু এই স্বরযন্ত্র বা বাকযন্ত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং, অন্য প্রাণীদের থেকে আমাদের মৌলিক তফাৎ হচ্ছে আমাদের স্বরতন্ত্র ( ভোকাল কর্ড )। স্বরযন্ত্র বা বাকযন্ত্রের সাথে কিন্তু এই স্বরতন্ত্রের পার্থক্য অনেক। মস্তিষ্ককে কেন্দ্র করে, প্রথম সাঙ্কেতিক তন্ত্র আর স্বরযন্ত্রের সমন্বয়েই গড়ে উঠেছে এই অতি উন্নত দ্বিতীয় সাঙ্কেতিক তন্ত্র যা মননক্রিয়া পরিচালনা করে। বিজ্ঞানের পরিভাষায় এটাকেই বলা হয় স্বরতন্ত্র। আমাদের নতুন নতুন ভাষা সৃষ্টির সাথে সঙ্গতি রেখে এই স্বরতন্ত্র উন্নত থেকে উন্নততর হয়েই চলেছে, আবার বিপরীতে এই স্বরতন্ত্রের ক্রমান্বয় উন্নতির সাথে সাথে আমাদের ভাষাও দিন দিন উন্নত থেকে উন্নততর হয়ে উঠছে। অর্থাৎ একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে চলেছে। এই দ্বিতীয় সাঙ্কেতিক তন্ত্রের ভিত্তি হচ্ছে ভাষা। ভাষার সৃষ্টি কিন্তু চিন্তা থেকে হয়নি। মানে ভাষা আগে চিন্তা পরে। ভাষার উন্নতির সাথে সাথে কথা বলার শক্তি আয়ত্ত করার পর, দ্বিতীয় সাঙ্কেতিক তন্ত্রের সাহায্যে পরাবর্ত গঠন করার শক্তি অর্জনের পরেই মানুষ চিন্তা শক্তির অধিকারী হয়েছে। এই ভাষা এবং ধারণা থেকে গড়ে ওঠা চিন্তার বিষয়টি, আমাদের জীবন প্রক্রিয়ায়, জাতি গঠনের প্রক্রিয়ায় বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে থাকে। পড়াশোনা, জ্ঞানার্জন, ভাব-বিনিময়, আচার আচরণের সংস্কৃতি, শিল্প-সাহিত্য-কলা ইত্যাদি সমস্ত কিছুর উৎকর্ষতা নির্ভর করে ভাষা এবং ধারণা ও চিন্তার সম্মিলিত মেল-বন্ধনে।

ভাষা হচ্ছে ধারণার বাহক। মানুষ যখন থেকে মানুষ হয়ে উঠতে শুরু করেছিল, তখনই দলবদ্ধ জীবনে মনের ভাব আদান প্রদানের জন্যে নানারকম স্বরবর্ণের ধ্বনি দিয়েই ভাষার জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল। জীবনযাত্রায় অগ্রগতির কারণে , এক অক্ষরের তথা সরল স্বরধ্বনি যখন ভাব-বিনিময়ে কুলিয়ে উঠছিলনা, তখনই নূতন নূতন দ্বি-আক্ষরিক ধ্বনি দিয়ে সেই অভাব পূরণ করার চেষ্টা শুরু হয়েছিল। আর তার সঙ্গে প্রয়োজনের তাগিদে , অনুশীলনের বাস্তবতায় , স্বরবর্ণের সাথে ব্যঞ্জন বর্ণের ব্যবহার থেকে কালক্রমে , বহু অক্ষরের ব্যবহার, একাধিক শব্দ সহযোগে বাক্যের ব্যবহার ইত্যাদি আয়ত্ত করার অধিকারী হতে থাকলো মানুষ। 

এবার আসা যাক মাতৃভাষা প্রসঙ্গে। মাতৃভাষা বলতে ঠিক কি বোঝায়, তা নিয়ে একটা সংশয় শিক্ষিত সমাজে বিদ্যমান। মাতৃভাষা কি আমাদের জন্মদাত্রী মায়ের কথ্য ভাষা, নাকি আমাদের জাতীয় ভাষা অথবা যার যার ক্ল্যান বা গোত্রের ভাষা সেই প্রশ্ন এখনও পরিষ্কার নয়। একটি শিশুর পিতা যদি ফরাসী ও মা বাঙালী হয় ( যা আকছার ই হচ্ছে এখন ) আর দুজনে যদি দু’টো ভাষাতেই সন্তানের সাথে কথা বলে তাহলে শিশুটি কিন্তু ৬ বছর বয়েস হওয়ার আগেই দু’টো ভাষাই শিখে নেবে সহজেই। তখন তার মাতৃভাষা কোনটা হবে ? আবার, একজন অবাঙালি মা, নিজের প্রদেশ থেকে বাসস্থান পরিবর্তন করে অন্যত্র চলে গিয়ে , একমাত্র সেই স্থানের ভাষায় যদি নিজের শিশু সন্তানের সাথে কথা বলে, তখনও কিন্তু সেই শিশুটি, সেই স্থানীয় ভাষাই শিখে যাবে। এমন টা কোলকাতায় হামেশাই দেখা যায়। এসব ক্ষেত্রে অন্য প্রদেশ থেকে চলে আসা বাবা মাকে কোলকাতার স্থানীয় বাংলা ভাষাতেই কথা বলতে দেখা যায়। অথচ মায়ের মাতৃভাষা কিন্তু এসব ক্ষেত্রে তিনি যেখান থেকে এসেছেন, সেই প্রাদেশিক ভাষাই ! আবার অন্যদিকে, মাতৃভাষা বলতে বোঝাতে পারে মাতৃভূমির ভাষা। আর মাতৃভূমি বলতে বোঝায় কোন জাতির বিশেষ নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অবস্থান। 

আসলে এই ধরণের বিভ্রান্তির কারণ কিন্তু শব্দের যথাযথ প্রয়োগ ও মান্যতার সাথে জড়িত। সমগ্র বিশ্বের বিভিন্ন সমাজের অগ্রগতির ধারাবাহিকতা আর পারস্পরিক সামাজিক আদান-প্রদানের দ্রুততা, প্রায়শই কোনো কোনো শব্দের দ্বারা কোন কোন বিষয়কে বোঝাতে অক্ষম হয়ে ওঠে। জাতিতে জাতিতে ভাব বিনিময়ে তাই নূতন শব্দ প্রয়োগ করা জরুরী হয়ে দাঁড়ায়। নূতন নূতন বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত আবিষ্কারের সাথে হাত মিলিয়েই উদ্ভব হয় নূতন শব্দ। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি ভাষাতেই এমন অনেক অজস্র শব্দ আছে যেগুলি আর এখন মানুষের ভাবপ্রকাশে কাজে না এসে বিভ্রান্তিকর হয়ে দাঁড়ায়। ইন্টারনেট প্রযুক্তির ব্যবহারে এই বিষয়টি লক্ষ্য করে দেখার মত। এই ভাবে এগোতে এগোতে মানবসমাজ দ্রুতলয়ে একটি আন্তর্জাতিক ভাষার দিকে এগিয়ে যাবে। 

তাই সবদিক বিচার করে মাতৃভাষা শব্দটির যথাযথ অর্থ বুঝে ওঠা একটু মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। কোন শব্দ সময়োপযোগী না হলে তার স্থানে সঠিক অর্থবহ একটি নূতন শব্দ দিয়ে তা প্রতিস্থাপিত করা যেতেই পারে। আবার এমনও দেখা যায়, প্রয়োজন তথা পরিস্থিতির তাগিদে, নূতন নূতন শব্দ অনবরত সব ভাষাতেই স্থান করে নিচ্ছে। 

একটা জাতির পরিচয়ে যেমন ভৌগোলিক স্থান একটা শর্ত, ঠিক তেমন ই সেই জাতির নিজস্ব ভাষাও একটি শর্ত। তাই কোনও জাতির পরিচয়ের প্রশ্নে, ভাষাকে টিঁকিয়ে রাখতেই হবে। নাহলে সেই জাতি ইতিহাসের বস্তু হিসেবেই স্থান করে নিতে বাধ্য হবে। হারিয়ে যাবে তার সমস্ত সাধ আহ্লাদ, হারিয়ে যাবে তার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি। হারিয়ে যাবে সেই জাতি। এমন ঘটনা অবিরত ঘটে চলেছে, এবং যেহেতু এটা একটা দীর্ঘকালীন প্রক্রিয়া তাই চট করে নজরে পড়েনা। 

এই প্রেক্ষাপটেই তাৎপর্যময় হয়ে উঠতে পারে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ইউনেস্কো, জাতিসংঘ এমন কি তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলো, এই প্রবণতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে। তাহলেই এই মাতৃভাষা দিবস পালন হয়ে উঠতে পারে আক্ষরিক ভাবেই অর্থবহ। পৃথিবীর শত শত ভাষার মতো বাংলা ভাষাও আজ আসন্ন এক বিপন্নতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রয়েছে।

2 comments:

2

প্রবন্ধঃ সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in


প্রবন্ধ



ভাষা
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়


ভারতবর্ষের মতন এত ভাষার সম্ভার ও সমারোহ যে পৃথিবীর অন্য কোনও দেশে নেই, সে তথ্য যতখানি নির্ভুল, ভারতবাসী বা ভারতপ্রেমীর জন্য ঠিক ততখানিই আনন্দজনক। দশ লক্ষের উপর মানুষ কথা বলেন, এমন ভাষা এ দেশে ব্যবহৃত হয় ঊনত্রিশটি। এক লক্ষের উপর মানুষ ব্যবহার করেন, এমন ভাষা আছে আরও আঠেরোটি। এ ছাড়াও আছে একশো কুড়িটির উপর বিপন্ন আদিবাসী ভাষা, যে গুলির ব্যবহার দ্রূতগতিতে কমে আসছে। প্রায় পৌনে দু’শোর উপর অল্পাধিক ব্যবহৃত ভাষা নিয়ে সাক্ষাৎ ভাষাতাত্বিক গবেষণার বিষয়ের মতন পৃথিবীর পূর্ব প্রান্তের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে ভারতবর্ষ, বাদবাকি বিশ্বের কাছে যে দেশ ইণ্ডিয়া নামে পরিচিত।

এই নাম দুটির ভাষাতাত্বিক ইতিহাসও যথেষ্ট চিত্তাকর্ষক। ভারত কথাটির অর্থ ভরতের উত্তরাধিকার বা বংশধারা। আমাদের পুরাণখ্যাত রাজা দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার পুত্র মহারাজ ভরত নিজ পরাক্রম, ঔদার্য ও শাসনগুণে এতখানিই প্রসিদ্ধ হয়েছিলেন, যে এই বিস্তৃত ভূখণ্ডটি কালক্রমে তাঁর নামে চিহ্নিত হয়ে যায়। বর্ষ শব্দের অর্থ দেশ। অর্থাৎ, যে দেশের উপর রাজা ভরত রাজত্ব করেছিলেন, সেই দেশ হলো ভারতবর্ষ। এত প্রাচীন, প্রাগৈতিহাসিক কোনও শাসকের নামে পৃথিবীর আর কোনও দেশ সম্ভবত নামাঙ্কিত নয়।

ইণ্ডিয়া নামটি হিন্দু শব্দের উচ্চারণগত বিকার। হিন্দুও কিন্তু আদতে সিন্ধু শব্দের অপভ্রংশ। সম্ভবত আক্রমণকারী পারসিকদের মুখে মুখে প্রচলিত। কোনও প্রাচীণ ভারতীয় গ্রন্থে হিন্দু শব্দের উল্লেখ নেই। যে ধর্মকে নিয়ে আজ ভারতবাসীর এত গর্ব, তাকে যদি সত্যিই অন্যান্য religion গুলির পংক্তিভুক্ত করতে হয়, তাহলে তার সঠিক পরিচয় হওয়া উচিত বৈদিক ধর্ম হিসেবে।

ভারতবর্ষের অধুনা জনপ্রিয় আরেক নাম হিন্দুস্তান অনেক পরে মুসলমান আক্রমণকারীদের মুখে প্রচলিত। যাঁরা ভারতবর্ষকে হিন্দুদের দেশ ভাবতে ভালোবাসেন, তাঁরা এই বিষয়টা নিয়ে ভেবে দেখতে পারেন।

সে যাই হোক, আমরা আপাতত ফিরে আসবো ভারতবর্ষের প্রাচীন শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত যে ভাষাটি, তার প্রসঙ্গে। সংস্কৃত। কবে, কি ভাবে যে এই অনন্য সাধারণ ভাষাটির জন্ম, তা আজ আর নির্ণয় করা সম্ভব নয়। শুধু নাম থেকে বোঝা যায়, যে প্রাকৃত জনের ভাষার সংস্কার হয়েছিলো এ ভাষার জন্ম দেওয়ার জন্য। 

গবেষণা বলে, যে ভাষায় ঋগ্বেদ লেখা হয়েছিলো, জেন্দাভেস্তার ভাষার সঙ্গে তার প্রচুর মিল। যে ইন্দো-ইওরোপীয় ভাষাসমষ্টির মধ্যে এখনকার আমেরিকা, ইওরোপ, পশ্চিম এশিয়া, মধ্য এশিয়া এবং ভারতীয় উপমহাদেশের বেশির ভাগ ভাষা পড়ে, তারই দু’টি প্রধান শাখা ইন্দো-ইরাণীয় এবং ইন্দো-আর্য ভাষাগোষ্ঠীর দুই মূল ভাষা যথাক্রমে আভেস্তীয় ও সংস্কৃত। দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড়জাতীয় ভাষাগোষ্ঠীর বিবর্তণের ইতিহাস কিছু জটিল, যার সম্পূর্ণ নির্ণয়ন এখনও সম্ভব হয়নি। ভাষা গুলির শব্দভাণ্ডার মূলত দ্রাবিড় হলেও তাদের ব্যাকরণের বিন্যাস অধিকাংশই সংস্কৃত নিয়মানুসারে। ঠিক কোন সময়ে, কবে থেকে এই মিশ্রণের আরম্ভ, তা আজ নির্ণয় করা দুরূহ। এর বাইরে আদিবাসীদের অস্ট্রিক জাতীয় ভাষাগুলি এবং পূর্বপ্রান্তের মোঙ্গোলীয় উৎসের কিছু ভাষা ছাড়া ভারতবর্ষের মূল ভূখণ্ডের উত্তর-পশ্চিম-পূর্বাঞ্চলের প্রায় সব ভাষাই আদিতে সংস্কৃত থেকে উৎপন্ন। এর একমাত্র ব্যতিক্রম ঊর্দূ। আরবি ও হিন্দির সংমিশ্রণে তৈরি এই মধুর ভাষাটি ভারতবর্ষকে মূঘল সাম্রাজ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপহার।

বেদান্ত-পুরাণ-মহাকাব্যের ভাষাতাত্বিক বিশ্লেষণ বলে, সে যুগের আর্যরা কথ্য ভাষা ব্যবহার করতেন মূলত দু’টি – শৌরসেনী প্রাকৃত ও মাগধী প্রাকৃত। প্রথমটি প্রচলিত ছিলো শৌরসেন, অর্থাৎ মথুরা অঞ্চল থেকে আরম্ভ করে গান্ধার প্রদেশ, অর্থাৎ এখনকার আফগানিস্তান অবধি। আর দ্বিতীয়টি বলা হতো যমুনার এদিকে, অর্থাৎ এখনকার উত্তরপ্রদেশের অনেকখানি অংশ, মধ্যপ্রদেশ, বিহার, উড়িষ্যা, বঙ্গ, কামরূপ (অহম), ইত্যাদি অঞ্চলে। এই দু’টি মৌখিক ভাষার মধ্যে খুব বেশি প্রভেদ ছিলো না। দুই অঞ্চলের মানুষদের পরস্পর বাক্যালাপে বিশেষ অসুবিধা হতো না। অন্তত প্রাচীন সংকলন গুলি পড়ে তাই-ই মনে হয়।

এই দুটি প্রাকৃত ভাষা থেকে কালক্রমে ভারতের আঞ্চলিক ভাষা গুলির জন্ম হয়। শৌরসেনী প্রাকৃত থেকে জন্ম হয় উত্তর ও পশ্চিম ভারতীয়, অর্থাৎ হিন্দি, পঞ্জাবি, গাঢ়ওয়ালি, রাজস্থানি, মরাঠি, গুজরাতি, প্রভৃতি ভাষাগুলির। আর মাগধী অবহট্ঠ থেকে শাখা মেলে বাংলা, ওড়িয়া, অহমিয়া, মৈথিলি, ভোজপুরি ইত্যাদি ভাষা। উদ্ভবকাল থেকে আজকের পরিপূর্ণতায় পৌঁছতে সবগুলি ভাষারই বহু সময় লেগেছে। এবং এই ভাষাগুলির বিকাশের ক্ষেত্রে প্রভূত সাহায্য করেছে ধর্ম।

পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র কথ্য ভাষাগুলির ইতিহাস এই একই সাক্ষ্য দেয়। যখনই নতুন ধর্মের আবির্ভাব ঘটেছে, তখনই ঘটেছে আঞ্চলিক প্রাকৃত ভাষার বিকাশ। কেন? কারণ প্রচারকরা সর্বাগ্রে চেষ্টা করেন সাধারণ দরিদ্র মানুষকে নিজেদের ধর্মে দীক্ষা দিতে। কাজটি সুপ্রতিষ্ঠিত নাগরিকদের প্রভাবিত করার চাইতে অপেক্ষাকৃত সহজতর। দরিদ্র মানুষ, যাঁরা বহু সময় অবধি অধিকাংশ ক্ষেত্রে সমাজবৈষম্যের শিকার হয়েছেন, জীবনযাত্রায় পরিবর্তনের আশায়, আশ্রয় ও স্বীকৃতির ভরসায় তাঁরা দলে দলে ধর্মান্তরিত হয়েছেন। ভারতবর্ষে এ ঘটনা ঘটা শুরু হয়েছে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার ও প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে। এই সব সাধারণ, অধিকাংশ ক্ষেত্রে অশিক্ষিত মানুষের কাছে পৌঁছনোর জন্য বৌদ্ধ পণ্ডিতরা পালি, অবহট্ঠের মতন ভাষা গুলি প্রণয়ন করেন, কারণ প্রধাণত আর্ষ ভাষা সংস্কৃত ছিলো এই প্রাকৃতজনের আয়ত্ত ও বোধ বহির্ভূত। বাংলা ভাষায় যা একেবারে প্রাথমিক রচনা বলে প্রমাণিত হয়েছে, খ্রিষ্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে লেখা সেই চর্যাপদ গুলি ছিলো মূলত বৌদ্ধ গান ও দোহা। 

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসের একেবারে প্রথম যুগে বৌদ্ধধর্ম যে কি অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো, তা সর্বাংশে আলোচনা করার পরিসর এখানে নেই। শুধু এই টুকু বললেই বোধহয় বোঝার কিছুটা সুবিধা হবে, যে বহুযুগ ধরে ভারতীয় রাজনৈতিক শক্তির কেন্দ্র, শিশুনাগ-মৌর্য-গুপ্ত রাজবংশের প্রতাপদিগ্ধ যে মগধ, সেই মগধের রাজধানী পাটলিপুত্রে প্রথম যে বাঙালি রাজবংশটি রাজত্ব করে, সেই পালরাজারা ছিলেন ধর্মে বৌদ্ধ। এই রাজবংশের হাত ধরেই বাঙালির সর্বভারতীয় ক্ষমতার রাজনীতিতে প্রবেশ ও প্রতিষ্ঠা, এবং এঁদের পৃষ্ঠপোষকতাতেই বঙ্গসংস্কৃতির প্রসারলাভ। প্রসঙ্গত, পাল রাজারা খ্রিষ্টীয় সপ্তম থেকে দশম শতাব্দী পর্যন্ত চারশো বছরেরও বেশি সময় ধরে পাটলিপুত্রে রাজত্ব করেছিলেন। মগধের ইতিহাসে অন্য কোনও রাজবংশ এত দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।

বৌদ্ধধর্মের পর যে ধর্ম ভারতবর্ষে ব্যাপক হারে প্রচারিত হয়, সে ধর্ম ইসলাম। কুরাণ শরীফ, হজরৎ মুহম্মদ ও ইসলামীয় দর্শনের উপর পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেও এ কথা অস্বীকার করা যাবে না, যে প্রাথমিক যুগে ইসলাম এ দেশে প্রচারিত হয়েছিলো মূলত অস্ত্রাগ্রে। তারপর এক সময়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন ততদিনে অত্যধিক ঋজু হয়ে ওঠা ব্রাহ্মণ্যধর্মের অত্যাচারের কবল থেকে মুক্তি পাবার তাড়নায়। তীব্র জাতিভেদ জনিত নিম্নবর্ণের অসহ অপমান ছাড়াও কন্যাপণ, বিধবাদের উপর অকথ্য পীড়ণ ও সতীদাহের মতন ভয়াবহ প্রথাগুলি তখন তথাকথিত হিন্দুধর্মের গলায় ফাঁসের মতন চেপে বসেছে। কেন এই অবস্থা হয়েছিলো, তার ধার্ম-সামাজিক বিশ্লেষণ সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গ। আমাদের বক্তব্যটুকু হলো, এই অবস্থার কারণে ইসলামকে সাধারণ মানুষের হৃদয়ে স্থানাধিকার করতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। তাই বৌদ্ধধর্মের মতন আঞ্চলিক ভাষাগুলিকে জনসংযোগের কাজে ব্যবহার করার প্রয়োজন, বা সেই কারণে সেগুলিকে পুষ্ট করার দায়, কোনওটাই ইসলামের ছিলো না।

যে ধর্মের ছিলো, সে হলো অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে ভারতবর্ষে প্রচারিত হতে শুরু হওয়া খ্রিষ্টধর্ম। ইওরোপীয় পাদ্রিরা প্রচণ্ড উৎসাহের সঙ্গে ‘অনগ্রসর’ ভারতবাসীদের ‘সদ্ধর্মের’ আলোয় অলোকিত করে তোলার প্রয়াসী হলেন, এবং সেই প্রয়াসের কার্যসিদ্ধির জন্য তাঁদের দ্বারস্থ হতে হলো গ্রামে-গঞ্জে-হাটে-মাঠে ফেরা মানুষের মৌখিক ভাষাগুলির। এঁদের নিরন্তর প্রয়াসের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কতজন মানুষ সদ্ধর্মের ছত্রছায়ায় এলেন বলা কঠিন। কিন্তু বিস্তর লাভ হলো ভারতবর্ষের আঞ্চলিক ভাষা সমূহের। উইলিয়ম কেরি, উইলিয়ম জোন্সের মতন পণ্ডিতরা পুনরুজ্জিবীত করে তুললেন বাংলার মতন মৃতপ্রায় ভাষাগুলিকে। কেরি সাহেবের শ্রীরামপুর মিশনের ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত হলো বাংলা ভাষায় প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ, বাইবেলের বঙ্গানুবাদ।

তারপর থেকে তো বাংলা ভাষার ইতিহাস ইতিহাস-ই! এত কম সময়ের মধ্যে এতখানি বৈদগ্ধ্য, বৈচিত্র পৃথিবীর অন্য কোনও ভাষায় সমাবিষ্ট হয়েছে বলে মনে হয় না। সর্বজনপাঠ্য বাংলা গদ্যের জন্ম ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, এবং তখন থেকে আজ অবধি, এই দেড়শো বছরের ন্যূনাধিক কিছু সময়ের মধ্যে শুধু বাংলা গদ্যসাহিত্যই পৃথিবীর সেরা সাহিত্যসম্ভারের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে। কবিতার কথা আলোচনা না করলেও চলে, কারণ পরিসংখ্যান বলছে, শুধুমাত্র প্রকাশিত কবিতার সংখ্যা বাকি সব ভারতীয় ভাষায় মিলিয়ে যত, বাংলায় একা তার থেকে বেশি।

কিন্তু এত বিশ্লেষণ ও গৌরবান্বিত পরিসংখ্যানের পরেও এ কথা বোধ হয় অনস্বীকার্য, যে বাংলা সাহিত্যের মান পড়তির দিকে। তার নানা রকম কারণ গত কয়েক দশক যাবৎ শোনা যাচ্ছে। বাঙালির সার্বিক নৈতিক অধঃপতন থেকে আরম্ভ করে কয়েকটি সাহিত্যব্যবসায়ী সংস্থার মৌরসিপাট্টা অবধি সব কিছু আছে তার মধ্যে। কিন্তু সে সব কিছুর বাইরে যে কারণটি সম্ভবত সব আঞ্চলিক ভাষারই সাহিত্যমানের পতন ঘটাচ্ছে, তা হলো আন্তর্জাতিক বাজারের লোভনীয় হাতছানি।

গত দু’দশকে যত বাঙালি তথা ভারতীয় লেখক ইংরেজি ভাষায় লিখেছেন, তত তার আগের দু’শো বছরের ইতিহাসেও লেখা হয়নি। বলা বাহুল্য, শিক্ষামাধ্যম হিসেবে ইংরেজি ভাষার ব্যাপক বিস্তারের ফলেই এ ঘটনা সম্ভব হয়েছে। এই সব রচনাই যে অতি উচ্চ মানের, তা নয়। কিন্তু উচ্চ মানের আঞ্চলিক সাহিত্যের থেকেও তাদের প্রায় সবারই বিক্রয়যোগ্যতা বেশি। একটি প্রকৃত অর্থে বিশ্বায়িত ভাষায় রচিত সাহিত্যের এই সুবিধা তো থাকবেই। তাই অনিবার্য কারণেই আজ ভারতবর্ষের মতন দেশের আঞ্চলিক ভাষাগুলির ভবিষ্যৎ বিপন্ন।

কিন্তু তার মধ্যেও আশার আলো দেখাচ্ছে ঋতবাকের মতন web পত্রিকারা। বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে, সমৃদ্ধতর করে তুলতে হলে এই পত্রিকাগুলিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। নিয়মিত সংগ্রহ ও প্রকাশ করতে হবে উচ্চমানের সাহিত্য। সেই কাজে সাহায্য করা সম্ভবত আমাদের মতন প্রত্যেকজন মাতৃভাষাপ্রেমী সাহিত্যপ্রিয় মানুষের কর্তব্য।

2 comments:

0

প্রবন্ধঃ শ্রীশুভ্র

Posted in


প্রবন্ধ



মাতৃভাষা দিবসের ছটায় ঝাপসা একুশ
শ্রীশুভ্র



একুশ এখন মাতৃভাষাদিবস! ২১শে ফেব্রুয়ারীর পূণ্যলগ্ন এখন আর শুধুমাত্র বাংলাদেশের জাতীয় তিথি নয়। আবিশ্ব সকল দেশেরই নিজস্ব মাতৃভাষা দিবস। ঐতিহাসিক যে ঘটনাটি কেবলমাত্র বাংলাদেশের অস্তিত্বের সঙ্গেই সম্পৃক্ত ছিলো এতদিন, আজ সেই ঘটনার সূত্র ধরে আবিশ্ব প্রতিটি দেশেরই অস্তিত্বের সাথে জরিত মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করে ২১শে ফেব্রুয়ারীর বিশ্বায়ন ঘটে গেছে। বিশ্বায়নের এই শতাব্দীতে বিশ্বের দরবারে বাঙালি জাতির এই এক অনন্য কীর্তিগাঁথা। এই যে ২১শে ফেব্রুয়ারী আবিশ্ব মাতৃভাষা দিবস পালন, এই ঘটনা বাঙালি হিসেবে আমাদের শ্লাঘার বিষয় সন্দেহ নাই।

কিন্তু সকল প্রদীপের তলাতেই যে অন্ধকার লুকিয়ে থাকে, সেকথাও শাশ্বত সত্য। বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের পর ইতিহাসের পাতায় অনেক জল গড়িয়ে গিয়েছে, কেটে গিয়েছে অর্দ্ধশতাবদীরও বেশী সময়। ওলোট পালোট হয়ে গিয়েছে বাংলাদেশের মানুষের রোজকার জীবন যাপনের ছন্দ। লেখা হয়েছে নতুন ইতিহাস নতুন দিনের পাতায়। বাহান্নোর ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের ভাষা সহিত্য সংস্কৃতিকে পরিপুষ্ট করেছে বিপুল পরিমাণে। জেগে উঠেছে একটি ঘুমিয়ে থাকা জাতি। ছিনিয়ে নিয়েছে তার প্রাপ্য স্বাধীনতা; তবু এই আলোর তলায় জমে উঠছে কি না কোন অন্ধকার, সেদিকেও খেয়ল রখা দরকার কিন্তু।

সবচেয়ে মজার বিষয়টি ঘটেছে আজকের আবিশ্ব এই মাতৃভাষা দিবস পালনকে কেন্দ্র করেই। আমরা যারা ২১শে ফেব্রুয়ারীর মাতৃভাষা দিবসে উত্তরণে আনন্দে আত্মহারা, গর্বে উদ্বেলিত তারা কি একবারও ভেবে দেখেছি ২১ ফেব্রুয়ারীর এই উত্তরণে বাংলা ও বাংলাভাষার কতটা সমৃদ্ধি হল? কিংবা কতটুকু ঘটলো আ মরি বাংলাভাষার বিশ্বায়ন। কিংবা আদৌ তা ঘটলো কিনা? তার থেকেও বড়ো প্রশ্ন, বাংলাভাষার বিশ্বায়ণ নিয়ে আমরা কি আদৌ চিন্তিত? আমাদের আবেগের সিংহ ভাগ জুড়ে কতটুকু ব্যাপ্ত বাংলাভাষার বিশ্বায়ন নিয়ে স্বপ্ন সাধ সাধনা- আশা আকাঙ্খা আনন্দ?

অনেকেই হয়তো ভ্রু কুঁচকাবেন, বাংলাভাষার বিশ্বায়ন! সে আবার কি জিনিস? বিশ্বজুড়ে ভাষা তো একটাই, আবার বাংলা নিয়ে টানাটানি কেন? আমাদের প্রতিবেশী দেশ ও প্রদেশগুলিতেই তো বাংলা অচল। আর কেনই বা অবাঙালিরা বাংলা নিয়ে মাতামাতি করতে যাবে। বাংলা থাক বাংলাতেই! 

বাংলা থাক বাংলাতেই! অথচ ইংরেজী থাক ইংল্যান্ডেই, সেকথা যদি ভাবত ইংরেজরা! কেউই সে কথা ভাবে না। প্রতিটি সমৃদ্ধ জাতিরই বাসনা থাকে তার ভাষা ও সংস্কৃতিকে আবিশ্ব ছড়িয়ে দিতে, পারুক আর না পারুক। নিজ মাতৃভাষার সেই বিকাশের অভিমুখেই উন্মুখ থাকে অধিকাংশ জাতির মন মনন মানসিকতা। 

আমাদের বাঙালি জাতির কথা একটু ভিন্ন সন্দেহ নাই। কারণ অনেকেই গর্ব অনুভব করেন আধুনিক বাংলাভাষার উৎপত্তি ইংরেজী ভাষার সাহচর্যে মনে করেই। কাউকে কাউকে এমন কথাও বলতে শোনা যায়, বাংলা ভাষায় বুৎপত্তি অর্জন করতে হলে ভালো করে ইংরেজীটাও শেখা দরকার। এবং আধুনিক যুগে আমরা প্রায় স্মরণেই রাখি না, বাংলাভাষার উদ্ভবে সংস্কৃত ভাষার গুরুত্বের কথা। আর আমাদের এই মানসিকতার কারণেই বর্তমানে বাংলা ব্যকরণ ও বানান বিধির তোয়াক্কা না করেই চর্চিত হয় বাংলা! যার সুদূর প্রসারী ফল ভাষার পক্ষে কখনোই সুখকর হতে পারে না! এই যে নিজের মাতৃভাষা সম্বন্ধেও আত্মনির্ভরতার একন্ত অভাব এইটি যে কোনো জাতির মাতৃভাষার পক্ষেই চিন্তার বিষয়। আর এই আত্মনির্ভরতার অভাব থেকেই বাধাগ্রস্ত হয় ভাষার সমৃদ্ধি ও প্রসার। তাই বাঙালি মাত্রেই আমরা ভাবতেই পারি না বাংলা ভাষার বিশ্বায়নের কথা। ভাষার বিশ্বায়ন বলতে আমরা ধরেই নিই একটি মাত্র ভাষার কথা। ভাষার বিশ্বায়ন প্রাথমিক ভাবে মূলত নির্ভর করে সাম্রাজ্যবাদের উপর। যেভাবে ইংরেজী ও স্প্যানিশ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ ছাড়াও সাংস্কৃতিক আদান প্রদান ব্যাবসা বাণিজ্যের মাধ্যমেও ভাষার বিশ্বায়ন ঘটতে পারে। বর্তমানে যার কিছুটা নমুনা দেখা যাচ্ছে হিন্দী ভাষার ক্ষেত্রে। বোম্বাই সিনেমা, ও টিভির দৌলতে হিন্দীর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিই তার অন্যতম প্রমাণ। কিন্তু দুঃখের কথা বাংলার বাইরে বাংলাভষার জনপ্রিয়তা শূন্য। পরিতাপের কথা বাংলার অভ্যন্তরেই বাংলার জনপ্রিয়তা বিশেষ কিছু নয়। কারণ আমরা সবাই জানি, জীবনে সুখে সমৃদ্ধিতে থাকতে গেলে বাংলা ভাষার উপর নির্ভর করা যায় না কোনো ভাবেই। দুই একজন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যক কি সঙ্গীতশিল্পীর দৃষ্টান্ত তো বড়ো কথা নয়! ফলে সাধারণ ভাবে আমরা ধরেই নিয়ে থাকি বাংলা ভাষার কোনো ভবিষ্যত নেই। নেই কোনো কার্যকারিতা। তাই বাঙালির কাছে মাতৃভাষা চর্চা আজ আর খুব একটা প্রাসঙ্গিক বিষয় নয়। 

নয় বলেই কাঁটাতারের দুই দিকেই ইংরেজী স্কুলগুলির এত জনপ্রিয়তা। সব বাবা মায়েরাই চান তার সন্তানকে ইংরেজী মাধ্যমে শিক্ষিত করে তুলতে। ভবিষ্যত জীবনের সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তার কথা ভেবে। আর ঠিক এইখানে এসেই উপলব্ধি ঘটে আমাদের, বাহান্নোর ভাষা আন্দোলনের বাষট্টি বছর পরেও মাতৃভাষা রূপে বাংলাভাষা বাঙালির জীবন ও জীবিকায় সদর্থক ভূমিকা রাখতে সফল হয়নি আজও। হয়ত অনেকেই প্রতিবাদ করবেন, বিশেষ করে স্বাধীন বাংলাদেশের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাইবেন। যেখানে বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসাবেই প্রচলিত। এমনকি বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গেও রাজ্যের সরকারী কাজকর্মে বাংলার ব্যবহার ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে তাঁরা য়ুক্তি সাজাবেন। ঠিক, কিন্তু দেখতে হবে একটি জাতির উন্নতির পিছনে যে মেধাসম্পদের চর্চা ও বৃদ্ধির প্রয়োজন; সেই কাজটিতে সেই জাতির মাতৃভাষা কতখানি সদর্থক ভূমিকা রাখতে পারছে! এইটিই সবচাইতে মূল্যবান প্রশ্ন! আর এইখানে এসেই ঠেকে যাচ্ছে আ মরি বাংলা ভাষা। আবহমান কালব্যাপি এইটিই বাংলাভাষার দুঃখজনক হলেও সত্য ইতিহাস। আমরা স্বীকার করি আর না করি।

আমাদের বুঝতে হবে কোনো জাতিই কোনো বিদেশী ভাষাকে মাধ্যম করে তার মেধাসম্পদের সার্বিক চর্চা ও সমৃদ্ধি ঘটাতে পারে না, ইতিহাসে কোনদিন কোথাও পারেনি। আমরাও পরবো না। আর, একটি দেশের মেধাসম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার ছাড়া সেই দেশ সেই জাতি কখনো উন্নতি করতে পারে না! কাঁটাতারের দুই দিকেই আমরা যে যে বিষয়গুলিকে দৃষ্টান্ত হিসেবে খাড়া করে উন্নয়নের জয়ঢাক পেটাতে যাই, একটু ভালো করে তলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে- সেগুলি সার্বিক উন্নয়নের প্রমাণ্য কোনো ছবি নয়। হলে আমরা প্রায় সকল রকমের আন্তর্জাতিক পরিমিতিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিশ্বের উন্নত দেশগুলি থেকে বহূ বছর করে পিছিয়ে থাকতাম না। আর এই ব্যাপারে কাঁটাতারের উভয় প্রান্তেই আমাদের অবস্থা ঊনিশ বিশ সমান।

তাই একুশ নিয়ে আমাদের আবেগ যতটা- মাতৃভাষা বাংলা নিয়ে দায়বদ্ধতা ততটা নয় আদৌ। একুশের পূণ্যলগ্নে শহীদবেদীতে মালা দেওয়ার লাইন যত দীর্ঘই হোক না কেন, সাধের ইংরেজী মাধ্যমের স্কুলে সন্তানকে ভর্ত্তির করার লাইন তার তুলনায় দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে উঠছে প্রতিদিন! এটাই দুই বাংলার বাস্তব চিত্র। আর এই চিত্র একটি জাতির ভবিষ্যতের পক্ষে ভালো নয়, বর্তমানের পক্ষে সুস্থ নয়। দুঃখের কথা এই সত্য উপলব্ধি করার মতোন প্রজ্ঞা বাঙালি হিসেবে আমাদের অস্থিমজ্জায় আজ আর অবশিষ্ট নেই। আজ আমরা সবাই একটি দুটি বিশেষ ভাষা ও সংস্কৃতির বিশ্বায়নে গা ভাসাতে পারলেই নিশ্চিন্ত বোধ করি। তাই আজ দুই বাংলাতেই ইংরাজী ও হিন্দী এত জনপ্রিয়। সেই ভাষাদুটির চর্চায় আমরা যতটা যত্নবান হতে স্বচেষ্ট হই, মাতৃভাষা বাংলার সম্বন্ধে ঠিক ততটাই উদাসীন থাকাটাই পছন্দ করি। এইটিই হল সেই অন্ধকার, ২১শে ফেব্রুয়ারীর বিশ্বমাতৃভাষা দিবস হয়ে ওঠার আলোর তলায় যা জমাট বাঁধছে কেবলই।

এবং আরও মজার কথা হল, ২১শে ফেব্রুয়ারী বিশ্বমাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হওয়াতে আবিশ্ব প্রতিটি দেশেই মাতৃভাষা সচেতনাতা বৃদ্ধি পাবে, সকলেই নিজ নিজ ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে গর্ব অনুভব করবে সন্দেহ নাই। কিন্তু সকল জাতির নিজ নিজ মাতৃভাষার উৎসবের এই দিনে বাঙালির একুশ আটকে থাকবে সেই বাংলাতেই। কজন আর জানবে ২১শের ইতিহাস ও বাঙালাদেশের ইতিহাসে তার যথার্থ ভূমিকা? তাই বিশ্বমাতৃভাষা দিবসের রোশনাইতে একুশ আটকে থাকল বাংলাদেশেরই অভ্যন্তরীন ইতিহাস হয়ে। একুশেরও ঘটল না যথার্থ বিশ্বায়ন আর আমরাও একুশের চেতনাকে ক্রমেই ঝাপসা থেকে ঝাপসা করে দিয়ে নিজ মাতৃভাষাকেই জাতির জীবনে করে তুলছি অপ্রাসঙ্গিক! রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী জীবিত থাকলে বলতেন কী, ইহাই বাঙালিত্ব?

0 comments:

0

প্রবন্ধঃ মৌসুমী ঘোষ দাস

Posted in


প্রবন্ধ



ভাষা নিয়ে কিছু কথা 
মৌসুমী ঘোষ দাস 


ছোটবেলায় আমরা অনেক কল্প কাহিনী পড়েছি । সেসব কাহিনী নিয়ে এখন প্রচুর কার্টুন ছবিও তৈরি হয়েছে। যেমন ধরা যাক শিশুদের প্রিয় কার্টুন ‘মুংলি’ তৈরি হয়েছে ‘ নেকড়ে গুহায় মানব শিশু’ এই কাহিনিকে নিয়ে । কাহিনীটা এইরকম, একটি ছোট্ট শিশু মা বাবার কাছ থেকে হারিয়ে গিয়ে একটি নেকড়ের গুহায় আশ্রয় পায়। নেকড়ে মা- এর কাছে আর চারটে নেকড়ে শিশুদের সাথেই সে মানুষ হয় । এবং দেখা যায় যে সেই শিশুটি কথা বলতে পারেনা। জঙ্গলের পশুদের ভাষা ছাড়া ‌ কোন মানুষের ভাষা সে জানেনা বোঝে না । টারজানের গল্পটাও কিছুটা এমন ছিল । জঙ্গলে থাকতে থাকতে টারজান শুধু জঙ্গলের পশুদের ভাষা বুঝতে পারে , কিন্তু মানুষের ভাষায় সে কথা বলতে পারেনা বা বোঝেও না। এ তো গেল গল্প কাহিনীর কথা। শোনা যায়, সম্রাট আকবরও একবার একটি শিশু কে বেশ কিছুদিন নিঃসঙ্গ অবস্থায় রেখে পরীক্ষা করে দেখেন যে, শিশুটি মানুষের ভাষায় কথা বলতে শেখে নি। [ সুত্রঃ ভাষার ইতিহাস ভাষাতত্ত্ব / অধ্যাপক তপন কুমার চত্তপাধ্যায় ] 

ভাষা বিজ্ঞানীদের মতে, মানব শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। অনুকরণের দ্বারা তারা শব্দ শোনে, শব্দ শেখে, শব্দ বলে। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে একটি শিশু তার আশেপাশে যা শোনে , তাই শেখে। তবে একেবারে ছোট শিশু যারা, তারা মুখে বিভিন্ন রকম অর্থহীন ধ্বনি বা আওয়াজ করে থাকে, যার মর্মার্থ একমাত্র তার মা ই বুঝতে পারেন, সেই ধ্বনিকে কিন্তু ভাষা বলা যায় না। যদিও সেই ধ্বনি বাগ যন্ত্রের সাহায্যেই উচ্চারিত হয়। ছোট মানব শিশু ছাড়াও প্রাণীজগতে অন্যান্য জীবজন্তুদেরও বাগ যন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত ধ্বনি বা আওয়াজ আছে। যেমন , খাবারের সন্ধানে কাকের ডাক, আর একটি কাক দুর্ঘটনাগ্রস্ত হলে অন্য কাকদের কা কা রবে পাড়া মাথায় করা ধ্বনি এক নয়। চোর বা অপরিচিত মানুষ দেখলে গৃহপালিত কুকুরের ঘেউ ঘেউ ধ্বনি , আর তার প্রভুকে দেখলে আদরের কুঁই কুঁই ধ্বনি এক নয়। গাছে পাখির বাসার কাছে কোন প্রানীকে এগোতে দেখলে মা পাখির বাচ্চাদের সতর্ক করে দেওয়ার জন্য তীক্ষ্ণ চিৎকার, আর সঙ্গী বা সঙ্গিনীকে দেখে মিলনের আনন্দে মুখ থেকে বেরনো ধ্বনি বা আওয়াজ এক নয়। যদিও এইসব প্রাণীর ধ্বনি বা আওয়াজ থেকে আমরা মোটামুটি তাদের মানসিক অবস্থার একটা ধারণা করে নিতে পারি। তথাপি এই ধ্বনি বা আওয়াজকে ভাষা বলা যায় না।কারন, এই উচ্চারিত ধ্বনি মনের ভাব প্রকাশ করে না বা সকলের বোধগম্য হয় না। 

সকল প্রাণীর মধ্যে সব চেয়ে উন্নত প্রাণী হল মানুষ। আর এই মানুষ হল সমাজবদ্ধ জীব। মানুষ বুঝেছে সমাজে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে গেলে একে অপরের সাথে মনের ভাব বিনিময় একান্ত প্রয়োজন। আর এভাবেই ধীরে ধীরে ভাষা সৃষ্টি হয়েছে। ভাষাবিদদের মতে, ভাষা হল মনের ভাবপ্রকাশের একটি মাধ্যম। বাগ যন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত ধ্বনি যা মনের সুস্পষ্ট ভাব প্রকাশ করে তাই হল ভাষা । বড়দের চেয়ে ছোট্ট শিশুদের মধ্যে প্রবৃত্তিগত কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে , যার ফলে তারা শিশু বয়সেই প্রথম মাতৃভাষা অর্জন করতে পারে। তাছাড়া যে ভাষা তাদের আশেপাশে বলা হয়, তারা সেই ভাষাই চট করে শিখে ফেলে, এমনকি যদি তাদের পিতামাতা বা পরিবারের কেউ অন্য কোন ভাষাতে কথা বলেন, তা হলে সেই অন্য ভাষাটিও সে শিখে ফেলে। শিশুরা বংশগত ভাবেই এই দক্ষতা নিয়েই জন্মগ্রহণ করে। ছোট্ট ছেলে তিতির সারাদিন টিভিতে কার্টুন দেখে কাটাত। ওর মা একা ঘরে ছেলেকে টিভির সামনে বসিয়ে কার্টুন চালিয়ে ঘরের কাজ সারত, কার্টুন চালিয়ে ছেলেকে খাওয়াত। আর তখন তার প্রিয় কার্টুনের চরিত্রদের মুখে হিন্দি ভাষা শুনতে শুনতে নিজে মুখে আওড়াতে আওড়াতে স্বাভাবিক নিয়মেই তিতির হিন্দি ভাষা শিখে ফেলে। অথচ ওর পরিবারে কেউ হিন্দি জানে না বা বলেও না। মনে পড়ে আমার পাশের বাড়িতে এক তেলেগু পরিবার বাস করতেন। ওদের ছোট্ট বাচ্চা ছেলেটি মাতৃভাষা তেলেগুর সাথে সাথে সুন্দর বাংলা ভাষাও বলতে শিখেছিল। অথচ আমরা বড়রা চেষ্টা করেও দু একটা তেলেগু শব্দ ছাড়া ভাষাটা শিখতেই পারিনি। 

ভাষাবিদদের মতে, যেকোন সুস্থ স্বাভাবিক মানব শিশু পৃথিবীর যেকোন ভৌগোলিক, সামাজিক, জাতিগত বা অর্থনৈতিক পরিবেশে ধাপে ধাপে একাধিক ভাষা শিখে ফেলতে পারে। অবশ্য বয়ঃসন্ধির পরে দ্বিতীয় কোন ভাষা শিখতে মানুষকে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয় এবং প্রায়শই সেই ভাষাতে সে উচ্চ স্তরের দক্ষতা অর্জন করতে পারে না। যদিও বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় ভাষা শেখার ওপর জোর দেওয়া হয়, তবুও মাতৃভাষার মত দক্ষতা, অন্য কোন ভাষায় অর্জন করতে সবাই পারে না। মানুষ ছোট বেলায় যে ভাষায় কথা বলতে সবচেয়ে বেশি পারদর্শী, যে ভাষাটি সে তার পিতামাতা বা অভিভাবকের কাছ থেকে ছোটবেলায় শিখেছে, ও যে অঞ্চলে সে বড় হয় সে অঞ্চলে যে ভাষাটি বহুল প্রচলিত, তাকে সাধারণভাবে মাতৃভাষা বলা হয়।

আমরা বাঙালি। আমাদের মাতৃভাষা, প্রাণের ভাষা [?] বাংলা। ভাষাবিদদের মতে, ‘মাগধী অপভ্রংশ’ থেকে বাংলা ভাষার জন্ম। যদিও অনেকে বলেন সংস্কৃত ভাষাই বাংলা ভাষার জননী। সংস্কৃতের সঙ্গে বাংলার শব্দকোষ ও রূপতাত্ত্বিক নিয়মের মিল আছে বলেই হয়তো তাঁরা একথা বলেন। তাছাড়া মধ্য যুগে বাংলা সাহিত্যের ওপর সংস্কৃতের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তবুও ভাষাবিদদের মতে, সংস্কৃত হল একটি কৃত্রিম ও লেখ্য ভাষা। এ ভাষায় কেউ কখনও কথা বলেনি। যে ভাষায় কেউ কখন কথা বলেনি সে ভাষার কোন পরিবর্তন হয় না। আর পরিবর্তন হয় না বলেই সে ভাষা একটি মৃত ভাষা। মৃত ভাষা কখন কোন ভাষার জন্ম দিতে পারে না। তথাপি বাংলার প্রায় আশি শতাংশ শব্দ সংস্কৃত থেকে জাত। বাংলা ভাষা যে আজ আন্তর্জাতিক মান অর্জন করেছে তার জন্য সংস্কৃতের অবদান কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না [সুত্রঃ বাংলা ভাষাতত্ত্ব/ কৃষ্ণ গোপাল রায়]। 

আন্তর্জাতিক ভাষা তালিকায় বাংলা ভাষা পঞ্চম স্থান অধিকার করেছে। অথচ প্রতিনিয়ত আমাদের প্রিয় এই ভাষাটির দূষণ ঘটিয়ে আমরা এর বিশুদ্ধতা নষ্ট করে চলেছি। পৃথিবীর বহু জাতি কেবলমাত্র মাতৃভাষাকে আশ্রয় করে উন্নতি করেছে। স্বয়ং রবিঠাকুর বলেছেন, ‘কোন শিক্ষা স্থায়ী করিতে হইলে, গভীর করিতে হইলে, ব্যাপক করিতে হইলে, তাহাকে চিরাচরিত মাতৃভাষায় বিগলিত করিয়া দিতে হয়’। আর আমরা আমাদের আভিজাত্য দেখানোর জন্য বাংলা বাক্যের সাথে হিন্দি বা ইংরাজি মিশিয়ে কথা বলে গর্ববোধ করি। বুক ফুলিয়ে বলি, সন্তান একটু আধটু বাংলা বলতে পারলেও লিখতে একদম পারে না। মাতৃভাষা বাংলা নিয়ে এই অবহেলা ভবিষ্যতে সমূহ বিপদ ডেকে আনবে না তো? কোনও একটি ভাষা ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫০ হাজারের কম হলে ওই ভাষাকে বিপন্ন ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করেন গবেষকরা। আইসল্যান্ডে মাত্র ২ কোটি ৭৫ হাজার মানুষ যদি মাতৃভাষায় কথা বলে সেই ভাষাটি স্ব মহিমায় বাঁচিয়ে রাখতে পারে, তবে আমরা পারব না কেন? তাই আসুন, আজ এই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে সবাই মিলে আমরা আমাদের মাতৃভাষাকে রক্ষা করার শপথ গ্রহণ করি।

0 comments:

0

প্রবন্ধঃ সুধাংশু চক্রবর্ত্তী

Posted in


প্রবন্ধ


(বাংলা) ভাষা ও বাংলা সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস 
সুধাংশু চক্রবর্ত্তী





মানুষের সবচেয়ে কালান্তকারী আবিষ্কার :

মানুষের সব চেয়ে কালান্তরকারী বিবর্তন হলো – কথা ও লিখিত ভাষার বিবর্তন । যার ফলে আমাদের পক্ষে ভাবের আদানপ্রদান করা, হাজার হাজার মাইল দূরে থাকা প্রিয়জনদের চিঠি লেখা এবং কয়েকশো বছর আগে মৃত লেখকের লেখা পড়ে তাঁর বক্তব্য উপলব্ধি করা সম্ভব হয়েছে । মধ্যপ্রদেশের ভীমভেটকা,ফ্রান্সের লাসকা,স্পেনের আল্‌তামিরা প্রভৃতি জায়গায় গুহার ভিতর বিশ-ত্রিশ হাজার বছরের পুরনো মানুষের হাতে-আঁকা অপূর্ব ছবির মধ্যে দিয়েই আমাদের দাগ কাটা ভাষার জন্ম হয়েছে । এই ধরণের ছবিই ক্রমশ সরলতর হয়ে অনেক সময় প্রাথমিক মানে বদলে গিয়ে মানে-হীনও হয়ে পড়েছে । এই অসাধারণ মানে-হীনতার মধ্য দিয়েই অক্ষরের সৃষ্টি হয়েছে আমাদের জীবনে । যেমন – গরু লেখার জন্য প্রথমে গরুর মুখ আঁকা হয়েছিলো । সেই মানেই বদলে যে লিপি তৈরি হলো তা আর গরু লেখার জন্য ব্যবহারই হয় না । উপরন্তু সেই লিপি থেকে A বা a অন্যান্য হাজার শব্দের জন্ম হলো । এই ধরনের সাধারণ মানে-হীনতার জন্য এই লিপি ব্যবহার করে বিভিন্ন শব্দ লেখা শুরু হলো । যেমন – 



সাধারণ মানে-হীন লিপি ব্যবহার করে বিভিন্ন শব্দ লেখা শুরু হলো । আবার শব্দ যোগ করে বাক্য তৈরি হলো । এক-একটা বাক্য এক-এক ধরণের মানের বোঝা বহন করে । ক্রিয়াই বাক্যের গমন-শক্তির উৎস । আমাদের ছয় ইন্দ্রিয়ের মধ্যে চোখের দেখা এবং সেই দেখার মাধ্যমে যে ভাবের আদান-প্রদান,মানের বিনিময়, সেটাই প্রধান । প্রত্যেক ইন্দ্রিয়ের নিজস্ব এক-একটা সংকেতময় জগৎ আছে । তার ব্যবহার এবং ব্যাখ্যা দিয়ে আমরা এক ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ গড়ে তুলেছি । তাই কথা বলার সময় হাত নেড়ে, শরীর দুলিয়ে, চোখ নাড়িয়ে অনেক ভাব প্রকাশ করে থাকি । লেখার সময়ও ম্যাপ,ডায়াগ্রাম,ছবি ইত্যাদি ব্যবহার করে মনের কথা বোঝানোর চেষ্টা করি । তবুও অনেক কিছুই ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয় । যেমন,কোনো দুর্ঘটনায় মৃত ব্যক্তির নিকটজনের বিয়োগ-ব্যাথা বা তাঁর বুক ফাটা কান্নার সীমাহীন আকুলতা কোনোমতেই ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয় । আবার কোনো বস্তু বা বিষয় কতটা ভালো লাগছে তাও পুরোপুরি ভাষায় বোঝানো সম্ভব নয় ।

হাজার হাজার বছর আগে মানুষ পাহাড়ের গুহায় দোয়ালে দাগ কেটে তাদের মনের চিন্তার ছবি এঁকেছিলো । এ রকম ছবিরই বিবর্তন হয়েছে আজকের হরফে । বাংলা বা দেবনগরী হরফ ‘ক’-এর বিবর্তন একধরনের যোগ-চিহ্ন থেকে হয়েছে । যেমন –



প্রায় সমস্ত হরফের শুরুই হয়েছে ছবি থেকে । ছবি থেকে রোমান হরফও এসেছে । দাগ কাটা এবং দাগ কাটার মাধ্যমে ভাষা প্রকাশের মূল কারণই হলো অন্য মানুষের সঙ্গে এক ধরণের একাত্মীকরণ, শ্রদ্ধা ও দরদ – অন্য মানুষকে নিজের মনের কথা বোঝানোর চেষ্টা ।



বাংলাভাষার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস :

বাংলা ভাষার বয়স হাজার বছরের ওপর । এর সাহিত্যও অত্যন্ত ঐশ্বর্যমণ্ডিত । পৃথিবীর প্রায় সাড়ে সাত হাজার ভাষার মধ্যে বাংলা হলো পঞ্চম অথবা ষষ্ঠ বৃহত্তম ভাষা । বাংলা ভাষা মূলত সংস্কৃতের সন্তান হলেও বাংলা ভাষার মধ্যে তথ্য সংস্কৃতির মধ্যে এমন সব অজস্র শব্দ মিশে আছে যাদের সংস্কৃত বলে ভুল হয় । আসলে সেগুলো প্রাক-আর্য-অষ্ট্রিক-দ্রাবিড় অথবা ভোট-তিব্বতিয় ও মন-খুমের উৎস থেকে গৃহীত । স্বাভাবিক কারণেই সংস্কৃতে গৃহীত হওয়ার কালে সেগুলোর রূপ বা আকার সংস্কৃতায়িত হয়েছে মাত্র । যেমন বাংলা ভাষায় বহুল ব্যবহৃত - লিঙ্গ,কুড়ি,পণ,নোড়া,খাঁকার,ঠেঙ,ছোট,ঝাড়,চোঙ ইত্যাদি শব্দসমূহ অষ্ট্রিক উৎস থেকে এসেছে । আবার একান্ত সংস্কৃত বলে মনে হওয়া শব্দ যথা - অণু,কামার,কলা কুণ্ড,নানা,নীল,পুষ্প,সায়ম-কাল,পুকুর,ফেণা ইত্যাদি সবই দ্রাবিড় ভাষা সমুহের অবদান । আবার নাথ,তিস্তা ইত্যাদি সবই ভোট-তিব্বতীয় । এমনকি কোল-সাঁওতাল ‘দ্যা্‌’(জল) সংস্কৃতের বহুল ব্যবহৃত ‘ক’, ‘কা’ প্রত্যয় যোগে ‘দ্যা্‌’>দ্যা্‌ক>উদক (জল)-এ রূপান্তরিত হয়েছে বলে ইতিহাসকার নীহাররঞ্জন রায় লিখেছেন । 

এসব আদিবাসী জাতি-সত্তার অসংখ্য শব্দ সংস্কৃতায়িত হয়ে বাঙলার অজস্র স্থানের নামের সাথে জুড়ে রয়েছে । যেমন করে অষ্ট্রিক ‘সাঁকো-টিকর’ দ্রাবিড় ‘দামল-লিত্তি’ যথাক্রমে ‘শক্তিগড়’ ও ‘তাম্রলিপ্ত’ হয়ে গৃহীত হয়েছে । গুড়ি (শিলিগুড়ি), জোড় (মুলাজোড়), জুড় (ডোমজুড়), দহ (শিয়ালদহ), জুলি (নয়নাজুলি), হাট ((রামপুরহাট), হাটি (বামনহাটি) ইত্যাদি নামগুলি অষ্ট্রিক-দ্রাবিড় নামেরই অবশেষ । অষ্ট্রিক শব্দ দাম+দ্যা্‌ক বর্তমানের দামোদর নদ হয়েছে । কব+দ্যা্ক হয়েছে কপোতাক্ষ নদী । ভোট-তিব্বতীয় ‘দিস্তাং > তিস্তা > ত্রিস্রোতা হয়ে সংস্কৃতায়িত হয়েছে । আর্যদের সংস্কৃত ভাষার ‘সংস্কৃত’ শব্দের অর্থই হলো – যা কিছু অনার্য শব্দকে সংস্কার করে গৃহীত হয়েছে তাই সংস্কৃত । খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ অব্দ পর্যন্ত বঙ্গীয় এলাকায় বসবাসকারী বাঙালীদের ভাষা ছিলো প্রাকৃত ভাষা । শেষ পর্যায়ে আর্যদের সংস্কৃত ভাষার মিশ্রণের কাজ শুরু হয়েছিলো । সমসাময়িক কালে বৌদ্ধ ধর্ম এসে আছড়ে পড়েছিলো বঙ্গীয় ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় । তখন স্বয়ং গৌতম বুদ্ধের নির্দেশে পোশাকি পালি ভাষার জন্ম হলো । খ্রিষ্টপূর্ব ২০০ অব্দ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ অব্দ পর্যন্ত পালি ভাষা এবং সংস্কৃত বিবর্জিত প্রাকৃত ভাষা বিশেষ প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলো ।

ভাষাবিদদের মতে, মাগধী প্রাকৃত হচ্ছে বাংলা ভাষার আদিপুরুষ । বাস্তবে তখনও বাংলা ভাষার জন্ম হয়নি । এরপর ৬০০ খ্রিষ্ট থেকে ১০০০ খ্রিষ্ট পর্যন্ত গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলের জনগোষ্ঠী কোনো রকম ব্যাকরণের নিয়ম-কানুননের তোয়াক্কা না করে মাগধী প্রাকৃত ভাষার ব্যবহার শুরু করে । এই সময়কালকে ‘অপভ্রংশ যুগ’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে । বঙ্গীয় অঞ্চলের বৌদ্ধ পাল বংশের আমলেই সংস্কৃত-প্রাকৃত-অপভ্রংশের খোলাস ছেড়ে খ্রিষ্টীয় দশম শতাব্দীতে বাংলা ভাষার জন্ম হলো । সংস্কৃত পণ্ডিতেরা একেই মাগধী অপভ্রংশ বাংলা হিসাবে চিহ্নিত করেছেন । খ্রিষ্টীয় দশম শতাব্দী থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত কালকে চার্যপদের যুগ হিসাবে অবহিত করা হয় । চর্যাপদের পুরো নাম হলো ‘চর্যাচর্য বিনিশ্চয়’ । বিশিষ্ট ভাষাবিদ ও পণ্ডিতেরা মত প্রকাশ করেছেন যে, সবদিক বিবেচনা করে ‘চর্যচর্যাবিনিশ্চয়’-কেই আদি যুগের বাংলা সাহিত্যের একমাত্র নির্ভরযোগ্য ও প্রামাণিক নিদর্শন বলে গ্রহণ করা যায় । প্রখ্যাত ভাষাবিদ ও পণ্ডিত মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯০৭ সালে নেপালের রাজদরবারে হাজির হন পুঁথির সন্ধানে । তিনি এখানেই আবিষ্কার করেন বৌদ্ধ ভিক্ষুদের প্রাচীন বাংলা অক্ষরে লেখা অমূল্য সম্পদ ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’ বা চর্যাপদ । প্রকৃতপক্ষে ‘সন্ধ্যাভাষা’ নামে হেঁয়ালিভাষায় এসব চর্যাপদ রচিত হয়েছে । সেকারণেই চর্যাপদের ভাষা বেশ দুর্বোধ্য ও রহস্যময় । 

বাংলা ভাষার ইতিহাস ঘাঁটলে লক্ষ্য করা যায়, এই ভাষা মাতৃজঠরে অবস্থান করছিলো প্রায় ১২০০ বছর পর্যন্ত । খ্রিষ্টপূর্ব ২০০ অব্দের পালি ভাষা । খ্রিষ্টপূর্ব ২০০ অব্দ থেকে ৬০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সংস্কৃত বিবর্জিত প্রাকৃত ভাষা । ৬০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১০০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বৌদ্ধ পাল রাজাদের আমলের মাগধী অপভ্রংশ ভাষা । এই সময় কালকেই ‘বাংলাভাষার মাতৃজঠরে অবস্থানের যুগ’ বলা যেতে পারে । বাংলাভাষার ইতিহাসবিদ্‌দের মতে বৌদ্ধ পাল বংশের আমলে অর্থাৎ খ্রিষ্টীয় দশম শতাব্দীতে সংস্কৃত প্রাকৃত অপভ্রংশের খোলস ছেড়ে যে-সময়ে বাংলাভাষা ভূমিষ্ট হলো সে-সময় থেকেই বাংলাভাষার সূচনা হলো । তাও হাজার বছর আগে । ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাভাষার ইতিহাসকে চারটি পর্যায়ে বিভক্ত করা যেতে পারে । প্রথমতঃ খ্রিষ্টপূর্ব ২০০ অব্দের পালিভাষা থেকে দশম শতাব্দীর বৌদ্ধ পাল রাজাদের আমল পর্যন্ত ‘বাংলাভাষার বিস্মৃতির যুগ’ । দ্বিতীয়তঃ খ্রিষ্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বিস্তৃত যুগ হলো ‘আদি যুগের বাংলাভাষা বা প্রাচীন বাংলাভাষা’ । তৃতীয়তঃ খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ‘মধ্যযুগের বাংলাভাষা’ । চতুর্থতঃ ইংরেজ আমল । সেসময়ে ইংরেজি, ফরাসী আর পর্তুগিজ শব্দ সম্ভার বাংলাভাষায় স্থান পেলো । বাংলাভাষা ও সাহিত্য নতুন খাতে বইতে শুরু করলো । 



বাংলা সাহিত্য :

একটা লোকের চিন্তা, ভাবধারা ও পারিপার্শ্বিক জগতের ঘটনাসমূহ পর্য্যবেক্ষণ করে যখন ভাষায় লিপিবধ করা হয়, তখন তাকে বলা হয় সাহিত্য । সাহিত্যের মধ্যে আমরা সমাজতত্ত্বের মাপকাঠি দিয়ে প্রত্যেক যুগের কৃষ্টির পরিচয় পেতে পারি । এইজন্য সাহিত্যে সনাতনধারা বা অখণ্ড বস্তু বলে কিছু নেই । জাতীয় জীবনের প্রত্যেক যুগের চিত্র আমরা সাহিত্যের মধ্যে অঙ্কিত হতে দেখি ।

সাহিত্যের মধ্যেই সমাজতত্ত্বের সন্ধান পাওয়া যায় । আবার সাহিত্যের বড় অবদান হলো ভাবপ্রচার । একেই বলা হয় সাহিত্যের ‘আক্টিভ রোল’ । সকলে স্বীয় চিন্তার ধারাকে মাতৃভাষায় লিখে জনসমাজে প্রচার করার চেষ্টা করে সেই বিষয়ে একটা সাহিত্য সৃষ্টি করেন । তাই যে সমাজে যত সংঘর্ষ সেই সমাজে ততই সাহিত্যের নানামুখী বিকাশ দেখা যায় । সমাজে যেমন কোনো সনাতন ধারা নেই সাহিত্যেও তেমন কোনো সনাতন ধারা নেই । সাহিত্য একটা নির্দিষ্ট যুগ বা সামাজিক গণ্ডী বা চিন্তাধারার মধ্যে আবদ্ধ থাকতে পারে না । বাংলা সাহিত্য ১০০০ বছরেরও পুরনো । গৌড় প্রাকৃত নানা অভিব্যক্তির মধ্যে দিয়ে বাংলাভাষা আকার ধারণ করেছে । ঐতিহাসিকেরা বাংলার সঠিক ইতিহাস খ্রিঃ ৭ম শতকের শশাঙ্ক ও নরেন্দ্র গুপ্ত থেকে আরম্ভ করেন । 

বাঙলার মানুষ এবং বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উন্নতিকল্পে জেমস লং-এর ভূমিকা বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে আছে । তিনি দৃঢ় ভাবেই বিশ্বাস করতেন মাতৃভাষাই শিক্ষার উপযুক্ত বাহন । জেমস লং বাংলায় সমাজবিজ্ঞান চর্চায় পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন । উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে জেমস লং প্রবাদ সংগ্রহে ব্রতী হয়ে নবীনচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহায়তায় প্রবাদগুলি তিন খণ্ডে প্রকাশ করেন । ১৮৫০ সালে ঠাকুরপুকুরে একটা প্রাইমারি স্কুল স্থাপন করে সেখানেই বসবাস করতে থাকেন । এই সময় থেকে শুরু হয় তাঁর বাংলাভাষা-সাহিত্য নিয়ে বহুমুখী চর্চা । তিনি কলকাতায় একটি বাংলা বইয়ের লাইব্রেরি গড়ে তোলেন । ১৮৫১ সালে কলকাতায় ‘বঙ্গভাষানুবাদক সমাজ’ স্থাপিত হয় । জেমস লং এই সমাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন ঘনিষ্ঠভাবে । ১৮৫২ সালে প্রকাশ করেন তাঁর প্রথম পুস্তকতালিকা ‘গ্রন্থাবলী’ । তিনি তাতে ১০৪৬টি বাংলা বইয়ের কথা উল্লেখ করেছেন । 

উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কে আগ্রহীজনের কাছে এর মূল্য অপরিসীম । ভার্নাকুলার লিটারেচার কমিটির লাইব্রারীতে রক্ষিত ৯৫৪টি বই ও পত্রপত্রিকার তালিকা প্রস্তুত করতে গিয়ে জেমস লং লক্ষ্য করেন প্রচুর বই ফরাসী ও উর্দু মিশিয়ে একটি বিচিত্র ভাষারীতিতে লেখা হয়েছে । তিনি এটাও লক্ষ্য করলেন বইগুলি কলকাতা ও ঢাকার মুসলমান সমাজে খুবই জনপ্রিয় । তিনি বিচিত্র এই ভাষারীতির নাম দেন ‘মুসলমানি বাংলা’ । ১৮৫২ সালে ‘ফ্রেন্ড অফ ইন্ডিয়া’য় ‘মুসলমান বেঙ্গলি লিটারেচার’ নামে যে-লেখাটি তিনি প্রকাশ করেন তাতে এই বিচিত্র ভাষায় লেখা ছত্রিশটি বইয়ের সংক্ষিপ্ত বিবরণ পাওয়া যায় । ১৮৫৩-৫৪ সালে সরকারের অনুরোধে তিনি কলকাতার বিভিন্ন ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত বই-পত্রের একটি তালিকা প্রস্তুত করে প্রকাশ করেন । এই কাজে তাঁকে কলকাতার বিভিন্ন ছাপাখানায় ঘুরে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করতে হয়েছে । বাংলায় বই ছাপার কাজ শুরু হবার প্রায় সূচনাকাল থেকে প্রকাশিত বইগুলির তালিকা প্রকাশ করে জেমস লং সেগুলিকে চিরতরে হারিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করেন । এই তালিকা প্রকাশনার পেছনে তাঁর একটাই উদ্দেশ্য ছিলো । তিনি বলেন, দেশীয় প্রকাশনার দিকে জনসাধারণ বিশেষ করে সরকারী কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণই ছিলো তাঁর উদ্দেশ্য – কারণ এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশীয় ভাষাশিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি । 



প্রাচীন কালের পুঁথি ও তার লিখন পদ্ধতি :

মানুষ তার মনের ভাব প্রকাশ করে লিখিত, খোদিত বা অঙ্কিত সাংকেতিক চিহ্নসমূহের মাধ্যমে যাকে বলা হয় লিপি । বাংলাসহ ভারতীয় উপমহাদেশের প্রায় সব লিপিই ‘ব্রাহ্মীলিপি’ থেকে উদ্ভব হয়েছে । এই ‘ব্রাহ্মীলিপি’ ক্রমবিবর্তনের মধ্য দিয়ে নাগরী / দেবনাগরী ও বাংলা লিপিতে রূপান্তরিত হয়েছে । আবার পুঁথি হলো সেই মাধ্যম যার মাধ্যমে পুরোনো আমলে কবি বা লেখকের জ্ঞানানুশীলনের যাবতীয় সম্ভার লিখিত রূপ পেতো । লেখকের লিখিত গ্রন্থটিকে বলা হতো মূল পুঁথি যা হাতে লেখা হতো । মূল পুঁথি থেকে এক বা একাধিক প্রতিলিপি লেখা হতো । তারপর প্রতিলিপিগুলি থেকে আরও অনেক প্রতিলিপির উদ্ভব হতো । প্রাচীন কালে হাতে লেখা পুঁথিকে বলা হতো ‘পুস্তক’ । পুঁথি প্রথম দিকে চামড়া’র উপর লেখা হতো বলে প্রাচীন কালে সাহিত্যকৃতিকে ‘পুস্তক’ বলা হতো । ‘পুস্তক’ সংস্কৃত শব্দ । ‘পুস্তক’ শব্দ এসেছে ‘পোস্ত’ বা ‘পুস্ত’ শব্দ থেকে । ‘পোস্ত’ শব্দের অর্থ চামড়া । প্রাচীন কাল থেকেই ভারতবর্ষে পুঁথির প্রচলন ছিলো ।

পুঁথি সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে – (১) আদর্শ পুঁথি বা মূল পুঁথি – যা লেখক স্বহস্তে লিখতেন । এই পুঁথি খুবই বিরল ।

(২) অনুলিখিত পুঁথি বা প্রতিলিপি – আদর্শ পুঁথি থেকে লিপিকরের দ্বারা লিখিত এক বা একাধিক প্রতিলিপিই হলো অনুলিখিত পুঁথি । আবার অনুলিখিত পুঁথি’ও তার প্রকৃতি অনুযায়ী তিন ধরনের হয়ে থাকে – (ক) ‘সুরক্ষিত প্রতিলিপি’ যা লিপিকর সতর্কতার সঙ্গে অনুলিখন করে থাকেন । (খ) ‘অরক্ষিত প্রতিলিপি’ যা লিপিকর স্বাধীনভাবে অনুলিখন করে থাকেন এবং (গ) ‘সংশোধিত প্রতিলিপি’ যাতে লিপিকর সংশোধন চিহ্ন প্রয়োগ করে শুদ্ধপাঠ রচনা করেন । পুঁথি লেখার কাজে বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহৃত হতো । যথা - শিলালিপি, তাম্রলেখ, মৃৎফলক, তালপাতা, গাছের ছাল, তুলট কাগজ, কাপড়, চামড়া, কাঠের তক্তি ইত্যাদি । প্রাচীন যুগে পুঁথি লিখন কার্যে সীলমোহর, তাম্রফলক, ধাতবপাত, পাথর, পশুচর্ম, কাষ্ঠফলক, ইট, কার্পাস, কাপড় ইত্যাদি উপকরণ ব্যবহৃত হতো । তবে বর্তমানে যে সমস্ত পুঁথি পাওয়া গেছে সেগুলি তালপত্র, ভূর্জপত্র, তেরেটপত্র, কদলীপত্র, বৃক্ষবল্কল, তুলট কাগজ, হাতে তৈরি পাতলা মাড়ের কাগজ ইত্যাদি উপাদানে প্রস্তুত । পুঁথি লেখার কাজে তিনটি উপকরণ ব্যবহৃত হতো । যথা - লেখপত্র, লেখনী এবং কালি ।

লেখপত্র : এতে লেখা হতো । বিভিন্ন ধরণের লেখপত্র ব্যবহৃত হতো । যথা - ১) শিলালিপি, ২) ধাতবপাত, ৩) কাষ্ঠফলক, ৪) ইট, ৫) সুতি কাপড় বা কার্পাস কাপড়, ৬) পশুচর্ম , ৭) ভূর্জপত্র, ৮) তালপত্র, ৯) বৃক্ষবল্কল এবং ১০) কাগজ ।

লেখনী : ভারতবর্ষে লিখন পদ্ধতির প্রচলনের সঙ্গে সঙ্গে বাঁশের কঞ্চি, শর, ময়ুর বা শকুনের পালক, ধাতব লেখনী, মোটা ঘাস, খাগ ইত্যাদি উপাদানের অগ্রভাগ সরু করে বা সূচালো করে কলম তৈরি করা হতো । 

কালি : হাতে লেখা পুঁথিতে সাধারণত কালো কালি ব্যবহৃত হতো । কালি তৈরীর উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হতো শিমুল গাছের ছাল, ছাগলের দুধ, তেল, লাক্ষা, লোহার গুঁড়ো, মাদার কাঠের কয়লা, জবার কুঁড়ি, গাবের ফল, হরীতিকী, আমলকী, বাবলা গাছের ছাল, জাটির রস, কচি ডালিমের রস, অর্জুন গাছের ছাল প্রভৃতি । কখনো কখনো চাল পুড়িয়ে ভূষাকালি তৈরী করা হতো । লোহার গুঁড়ো মিশিয়ে কালিকে উজ্জ্বল করা হতো । আতপচাল মাটির হাঁড়িতে ভেজে গুঁড়ো করে লাউয়ের ডগার রস ও জল মিশ্রিত করে স্বল্প ব্যয়ে স্বল্পমেয়াদী কালি তৈরী করা হতো । লেখার সময় বেশী কালি পড়ে গেলে বালির পুটলি ব্যবহার করা হতো অতিরিক্ত কালি শুষে নেওয়ার জন্য । 



বাংলা অভিধান :

বাংলা ভাষার পরিবর্তনের ইতিহাস জানার মস্ত একটা হাতিয়ার হলো বিবর্তনমূলক অভিধান । এমন এক অভিধান যাতে থাকে শব্দের চেহারা এবং তার অর্থের বিবর্তন । বাংলা ভাষার কোনো বিবর্তনমূলক অভিধান রচিত হয়নি । অথচ রোমান হরফে প্রথম বাংলা অভিধান ছাপা হয়েছিলো ১৭৪৩ সালে - ২৭২ বছর আগে । ইংরেজি-বাংলা প্রথম অভিধান প্রকাশিত হয় ১৭৯৩ সালে । তারপর ১৭৯৯ ও ১৮০১ সালে হেনরি পিটস ফরস্টার দুই খণ্ডে যথার্থ ইংরেজী-বাংলা এবং বাংলা-ইংরেজি অভিধান প্রণয়ন করেন । বাংলায় লেখা প্রথম বাংলা অভিধান রচনা ও প্রকাশ করেছিলেন রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ ১৮১৭ সালে । তারপর থেকে অন্তত শ’দুয়েক ছোটবড় অভিধান প্রকাশিত হয়েছে । সেসব অভিধানে আছে প্রচলিত-অপ্রচলিত এবং বাংলা-অবাংলা শব্দ, শব্দের এক বা একাধিক অর্থ, আর শব্দগুলোর পদ পরিচয় । কোনো কোনো অভিধানে শব্দগুলো কীভাবে প্রয়োগ করা হয় অথবা প্রয়োগ করতে হয় তার দৃষ্টান্তও দেওয়া আছে । অনেক অভিধানে দেওয়া আছে এসব শব্দ কীভাবে পূর্ববর্তী লেখকরা ব্যবহার করেছেন । শুধুমাত্র তৎসম শব্দের অভিধান, ব্যুৎপত্তির অভিধান, আঞ্চলিক ভাষার অভিধান, বাংলা ভাষায় বিদেশি শব্দের অভিধান, স্ল্যাং-এর অভিধান, অপরাধজগতে প্রচলিত শব্দের অভিধান ইত্যাদি বিচিত্র ধরনের অভিধান প্রকাশিত হলেও বাংলা ভাষায় ‘অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি’র মতো অভিধান আজও রচিত হয়নি, যাতে বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত তাবৎ শব্দ আছে । কীভাবে শব্দগুলোর অর্থ এবং বানান ধীরে ধীরে বদলে যায়, কোনো বাংলা অভিধানেই তা দেওয়া নেই । 

বাংলা ভাষায় প্রথম ব্যাকরণ রচনা করন রামমোহন রায় ( ১৭৭৪- ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দ) । পুস্তকটি ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দে ‘কলিকাতা স্কুল বুক সোসাইটি’ প্রকাশ করে । রামমোহন রায় তাঁর পুস্তকে খোদ ভাষাটিকে প্রায় সার্বজনীনভাবে ‘গৌড়ীয় ভাষা’ বলে উল্লেখ করেছেন । সেন-রাজত্বের আমলে ব্রাহ্মণ্যবাদ প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই বর্ণহিন্দুর দৃষ্টিতে প্রাকৃতের মধ্য দিয়ে উদ্ভুত স্থানীয় ভাষা ঘৃণার্থে শুধুমাত্র ‘ভাষা’ বলেই অভিহিত হয়েছে (অষ্টাদশ পুরাণানি রামস্য চারতানি চ ভাষায়াং মানবঃ শ্রুত্বা রৌরবং নরকং ব্রজেৎ) । রামমোহন রায় নিজের পুস্তকে কয়েকবার বিক্ষিপ্তভাবে ভাষাটিকে ‘বঙ্গভাষা’ বলে উল্লেখ করেছেন কিন্তু বাঙলা ভাষা বলে তাকে সম্বোধন করেননি । হ্যালহেড সাহেবের বাঙলা ভাষার ব্যাকরণ লেখা হয়েছিল রোমান হরফে ।

সুবল মিত্রের ‘সরল বাঙ্গালা বাংলা অভিধান’ প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯০৬ সালে । এবং জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের ‘বাঙ্গালা ভাষার অভিধান’ প্রকাশিত হয় ১৯১৭ সালে । হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ অভিধানটির কাজ শুরু করেছিলেন ‘অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি’ প্রকাশিত হওয়ার প্রায় দু’দশক আগে । কিন্তু তাঁর সেই অভিধানের শেষ খণ্ডটি প্রকাশিত হয় ১৯৪৬ সালে । জ্ঞানেন্দ্রমোহন ও হরিচরণ – উভয়েই শব্দগুলোর সম্ভাব্য ব্যুৎপত্তি ও যতদূর সম্ভব অর্থান্তর দিয়েছিলেন । কিন্তু তাঁদের প্রভূত পরিশ্রম এবং আন্তরিক নিষ্ঠা সত্ত্বেও সেই অভিধানে অনেক অপূর্ণতা থেকে গেছে । জ্ঞানেন্দ্রমোহনের ‘বাঙ্গালা ভাষার অভিধান’-এ শব্দের সংখ্যা প্রায় এক লাখ পনেরো হাজার । জ্ঞানেন্দ্রমোহনের অভিধান প্রকাশিত হবার পর প্রায় একশো বছর পার হয়ে গেছে এবং হরিচরণের অভিধান প্রকাশিত হয়েছে আশি বছর আগে । ইতিমধ্যে হাজার হাজার নতুন শব্দ, বিশেষ করে যৌগিক শব্দ তৈরি হয়েছে । ব্যাকরণ সিদ্ধ নয়, এমন হাজার হাজার যৌগিক শব্দও তৈরি হয়েছে । তাছাড়া বিচিত্র ব্যবহারের মাধ্যমে শব্দের অর্থান্তরও বৃদ্ধি পেয়েছে । হারিয়ে যাওয়া হাজার হাজার শব্দও আবিষ্কৃত হয়েছে অজানা ভাণ্ডার থেকে । গত একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে নিরন্তর গবেষণা করে পণ্ডিতেরা মধ্যযুগের বিপুল কাব্যসাহিত্য এবং আঠারো শতকের ক্রমবিকাশশীল বাংলা গদ্যের প্রচুর উপাদান আবিষ্কার করেছেন । গত এক শতাব্দীতে বাংলা শব্দসংখ্যা বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে ।

১৯৪৭ সালে দেশভাগ এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে অভ্যুদয়ও বাংলা ভাষার ওপর বিপুল প্রভাব বিস্তার করেছে । কলকাতাকেন্দ্রিক প্রামাণ্য ভাষায় বহু পুর্ববঙ্গীয় শব্দ গৃহীত হয়েছে । শব্দের অভিধানও বদলেছে । জ্ঞানেন্দ্রমোহন এবং হরিচরণ যে-ভাষার অভিধান রচনা করেছিলেন, সেই বাংলা ভাষা আর এখনকার বাংলা ভাষা ঠিক এক নয় । হরিচরণ তাঁর শব্দকোষে সংস্কৃত ভাষার প্রতি যে-গুরুত্ব দিয়েছিলেন, বাংলা ভাষার চর্চায় তার প্রাসঙ্গিকতাও এখন অনেকটাই হারিয়ে গেছে । বাংলা বিবর্তনের ধারায় কয়েকটি তরঙ্গ লক্ষ্য করা যায় । যেমন চর্যাপদ এবং শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ভাষা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, তা সংস্কৃতানুগ নয় । ফলে সংস্কৃত থেকে সে ভাষা অনেক দূরে সরে গিয়েছিলো । অথচ ষোড়শ শতাব্দীতে যে বিশাল বৈষ্ণব সাহিত্য রচিত হয়, তা সংস্কৃত ও সংস্কৃত থেকে আগত শব্দে ভরা । মুঘল আমলের রাজভাষা হলেও, ফারসির প্রভাব বাংলা ভাষায় পড়েছিলো সীমিত পরিমাণে । তার প্রধান কারণ জনপ্রিয় বৈষ্ণব সাহিত্য এবং বৈষ্ণব ধর্ম বাংলা ভাষাকে ফারসির হামলা থেকে দূরে সরিয়ে রাখে ।



এরপর বাংলা ভাষাকে আঘাত করে আঠারো শতকের দ্বিতীয় ভাগে শাসনকর্তা বদলে যাওয়ায় । ১৭৭০-এর দশকেই মুসলমান-শাসকদের সরকারি ভাষা ফারসিকে দূর করার একটা বিকল্প হিসেবে ইংরেজরা বাংলা ভাষাকে পৃষ্ঠপোষণা দিতে আরম্ভ করেছিলো । তাছাড়া সরকারি কাজকর্ম ক্রমবর্ধমান মাত্রায় কাগজভিত্তিক হওয়ায় নতুন নতুন শব্দ আমদানি করার এবং সংস্কৃত ভাষাভিত্তিক পরিভাষা সৃষ্টি করার প্রয়োজনও দেখা দিয়েছিলো । এভাবে উন্মেষশীল বাংলা ভাষা আরও একবার সংস্কৃত ভাষার দিকে ঝুঁকে পড়লো । ইংরেজ আমলে কলকাতায় রাজধানী স্থাপিত হওয়ায় প্রামাণ্য বাংলা ভাষাটিও ধীরে ধীরে মহীরুহে পরিণত হলো তারই বৈশিষ্ট্য নিয়ে, যদিও সে ভাষার উপকরণ এসেছিলো বঙ্গদেশের অন্য অঞ্চল থেকেও ।



রবীন্দ্রনাথ এসে ভাব প্রকাশের প্রয়োজনে নতুন শব্দ ব্যবহার করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে পুর্ববর্তী লেখকদের ব্যবহৃত শব্দগুলোর সঙ্গে লেজ জুড়ে দিয়ে হাজার হাজার সমাসবদ্ধ নতুন শব্দ গঠন করেছেন । এছাড়াও প্রমথ চৌধুরীর উৎসাহে প্রামাণ্য কথ্যভাষাকে লেখ্যভাষার আসনে বসিয়েছেন । সেইসঙ্গে মুখের ভাষাকেও লিখিত ভাষার দিকে খানিকটা টেনে এনে বাংলা ভাষাকে সহজ সুন্দর ও সাবলীল করে তুলেছেন । রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় শেষ দু’দশকে নজরুল ইসলামও একটা নতুন শব্দভাণ্ডারের দ্বার খুলে দিলেন – আরবি–ফারসির । আরও একটা নতুন শব্দভাণ্ডারের দ্বার খুলে দিলেন জসীমউদ্দীন । 



বাঙলা ভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী - ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর :

বিদ্যাসাগর বাঙলা ভাষার ‘প্রথম যথার্থ শিল্পী’ অর্থাৎ শুধু লেখক নন, প্রচারক নন, শিক্ষাগুরু নন; সেসবের সীমা অতিক্রম করে, বিদ্যাসাগর সাহিত্যশিল্পী । এই পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যাসাগরের পূর্ববর্তী প্রধান দু-চারজনের দানের কথা স্মরণ করা দরকার । প্রধানত স্মরণীয় – উইলিয়াম কেরি, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, রামমোহন রায়, ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্যারীচাঁদ মিত্র, অক্ষয়কুমার দত্ত প্রভৃতির দান । সেই সঙ্গে বাঙলা সংবাদপত্রের দানও মনে রাখতে হবে । উইলিয়াম কেরির ‘কথোপকথন’ (১৮০১ খ্রীঃ) অসামান্য বস্তু । বিভিন্ন শ্রেণির ও বিভিন্ন স্তরের বাঙালীর শিষ্ট আলাপ থেকে মেয়েলি কোঁদল পর্যন্ত নানা রীতির কথিত বাঙলার নিদর্শন এতে পাওয়া যায় । মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারকেই কেউ কেউ প্রথম গদ্যশিল্পী বলে গণ্য করেন । মৃত্যুঞ্জয়ের লেখায় স্বভাবতই বিষয়বৈচিত্র্য এবং ভাষার বৈচিত্র আছে । ‘প্রবোধচন্দ্রিকা’য় (রচিত ১৮১৩, প্রকাশিত ১৮৩৩) আমরা অন্তত তিন রকম গদ্যরীতির নমুনা পাই । একদিকে সংস্কৃতানুরাগী সাধুভাষা, মাঝখানে সরল সচ্ছন্দ সাধুভাষা এবং অন্যদিকে প্রায় কথ্য ভাষা – যা কেরির ‘কথোপকথনে’র কথা মনে করিয়ে দেয় । মৃত্যুঞ্জয়ের শিল্পকৌশল স্বীকার্য । কিন্তু অনেক কারণেই তাঁর শিল্পবোধ খণ্ডিত এবং শিল্পরীতিতেও ব্যাহত । তিনি নানারূপ ভাষার পরীক্ষা করেছেন অথচ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেননি । বিষয়ের দিক থেকে বৈচিত্র্য থাকলেও রীতিস্থিরত্ব নেই । বিচার-যুক্তিতেও তিনি কুযুক্তিপরায়ণ, অশালীন, কটুক্তিবিলাসী । রামমোহন রায়ের বাংলা গদ্য সম্বন্ধে ‘সংবাদ প্রভাকর’-এ (১৮৫৪ সালে) বলা হয়েছে – “রামমোহন জলের ন্যায় সহজ ভাষা লিখিতেন । তাহাতে কোনো বিচার ও বিবাদ ঘটিত বিষয় লেখায় মনের অভিপ্রায় ও ভাব সকল অতি সহজে স্পষ্টরূপে প্রকাশ পাইত; এজন্য পাঠকেরা অনায়াসেই হৃদয়ঙ্গম করিতেন, কিন্তু সে লেখায় শব্দের বিশেষ পারিপাট্য ও তাদৃশ মিষ্টতা ছিল না ।”



রামমোহন রায়ের আমলের পণ্ডিতদের মধ্যে মৃত্যুঞ্জয় ছিলেন গদ্যগুরু । নানা ধরণের লিপিকৌশল দেখাতে ওস্তাদ ছিলেন । রামমোহন রায় আয়ত্ব করেছিলেন বাঙলা ভাষার মূল রূপটিকে । তিনি বিচার ও আলোচনার গদ্যই তৈরি করতে চেয়েছিলেন । কিন্তু রামমোহন শিল্পী নন – বিচারকুশল তার্কিক । গদ্যসাহিত্য সৃষ্টি তাঁর কল্পনায়ও ছিল না । রামমোহনের বিচারপদ্ধতিও সংস্কৃত শাস্ত্রবিচারের ঐতিহ্যানুযায়ী মধ্যযুগের স্কুলম্যান-এর পদ্ধতি । কারণ, পণ্ডিতের ঐতিহ্যপদ্ধতির তখনো সমাজে প্রতিষ্ঠা ছিল । রামমোহন প্রথম থেকেই (বেদান্তগ্রন্থের অনুবাদ, ১৮১৫) বাঙলা বাক্যের মূল প্রকৃতি ধরতে পেরেছিলেন । বাঙলা গদ্যভাষার ‘অন্বয়’ – কর্তা, কর্ম, ক্রিয়া প্রভৃতির বাক্যমধ্যে চমৎকার প্রমাণ । রামমোহন বক্তব্যকে সরল করার জন্যই লিখতেন – শব্দ বা বাক্যের খেলা দেখাবার ইচ্ছায় নয় । তার্কিক রামমোহন বিপক্ষের বিরুদ্ধে কটূক্তি প্রয়োগ করেননি এবং অপরের কটূক্তিকে যুক্তির দ্বারা নিরসন করেছেন । ‘প্রবর্তক-নিবর্তক সংবাদ’-এ স্ত্রীজাতির গুণাবলীর সমর্থনে শুধু অদ্ভুত উদার দৃষ্টির পরিচয় দেননি, সে লেখাতে রীতিমত আন্তরিকতার স্পর্শও আছে । বিদ্যাসাগরের গদ্যরচনায় এসব গুণের (রসবোধের সঙ্গে) সমাবেশ ঘটেছে । তাতেই বিদ্যাসাগর গদ্যশিল্পী ।



রামমোহন রায়ের সময়কার ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় (নববাবুবিলাস) কিন্তু গদ্যসাহিত্য রচনা করেছিলেন । সে দিক থেকে টেকচাঁদ ঠাকুরের (প্যারিচাঁদ মিত্র) ‘আলালের ঘরের দুলাল’-এর গুরুত্বই সর্বাধিক । লেখাটি চমৎকার । একথা ভোলা উচিৎ নয় যে, বাঙলা গদ্য গড়তে এঁরাই সর্বাপেক্ষা বেশি সাহায্য করেছেন । ‘তত্ত্ববধিনী পত্রিকা’-র বাঙলা গদ্যও উল্লখেযোগ্য । স্বয়ং বিদ্যাসাগর ছিলেন সে পত্রিকার সঙ্গে জড়িত । যদিও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজনারায়ন বসু ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় বাঙলা গদ্যে আরও সজীবতা সঞ্চার করছিলেন তবুও অক্ষয়কুমার দত্ত ছিলেন ‘তত্ত্ববধিনী’র সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য লেখক । ‘বাহ্যবস্তুর সঙ্গে মানববস্তুর সম্বন্ধবিচার’ (১৮৫২-৫৩) ও ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ (১৮৭০-১৮৮৩) বস্তুনিষ্ঠ আলোচনায়, লিপিকুশলতায় বাঙলা ভাষার চিরকালের সম্পদ । কিন্তু অক্ষয়কুমার দত্তের ভাষায় সরসতা কম । তা বিশুদ্ধ যুক্তিবাদের ভাষা এবং অনেকটা বিশুষ্ক যুক্তিবাদের ভাষা । এখানেই বিদ্যাসাগরের গদ্যরচনার সার্থকতা । তাঁর যুক্তিবাদী লেখা কিন্তু সরস এবং প্রয়োজনমত রসাভিষিক্ত যা বুদ্ধিকে জীইয়ে তোলে, প্রাণকে সজীব করে । বিদ্যাসাগরের হাতে বাঙলা গদ্য তাই আত্ম-আবিষ্কার করলো । বাংলা গদ্যের ক্রমবিকাশ ও ক্রমপ্রতিষ্ঠার ধারায় কাউকে ‘জনক’ বলতে হলে বিদ্যাসাগরকেই বলা চলে । বিদ্যাসাগর বাংলা লেখায় সর্বপ্রথম কমা, সেমিকোলন প্রভৃত ভেদচিহ্নগুলি প্রচলিত করেন ।



ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের বাংলা সাহিত্যকে বলা হয় বঙ্কিম যুগ । আর বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধকে বলা হয় রবীন্দ্র যুগ । রবীন্দ্র যুগ হলো বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণযুগ । বাংলা কথা সাহিত্যের আসর তখন জমজমাট । রবীন্দ্রনাথ তখন ‘চোখের বালি’, ‘গোরা’, ‘শেষের কবিতা’, ‘চতুরঙ্গ’, ‘যোগাযোগ’ আর ‘গল্পগুচ্ছের’ বিচিত্র ধরনের গল্পের ঐশ্বর্য্য নিয়ে বিরাজ করছেন । সঙ্গে আছেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়, প্রমথ চৌধুরীর মতো উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কগণ । এছাড়াও ‘ভারতী’, ‘মানসী’, ‘সবুজপত্র’, ‘বিচিত্রা’, ‘কল্লোল’, ‘কালিকলম’, ‘শনিবারের চিঠি’র নবীন প্রবীণ কথাশিল্পীগণ ।



বাংলা পরিভাষা এখনো মুখের ভাষা হয়ে উঠলো না :

বিশিষ্ঠার্থবোধক শব্দ যা বিশেষ প্রসঙ্গে বিশেষ অর্থ গ্রহণ করে কিংবা বিশেষ বস্তু, বস্তুধর্ম, প্রক্রিয়া ইত্যাদি বোঝায় তা হলো পরিভাষা । যেমন – বিশেষ্য, যৌগ, রাগ (সঙ্গীতের), দ্বিবীজপত্রী ইত্যাদি । অনেক শব্দ সাধারণভাবে এক বা একাধিক অর্থে ব্যবহৃত হয় । আবার পারিভাষিক ব্যবহার পেয়ে যেতে পারে বিশিষ্ট অর্থে । একই শব্দের এই দুই জাতীয় অর্থের মধ্যে সাদৃশ্য থাকতেই পারে । কিন্তু তারা কখনোই এক নয় । যেমন ‘আলাপ’ শব্দটির কয়েকটি মানে আছে কিন্তু উচ্চাঙ্গ সংগীতে ‘আলাপ’ বিশেষ অর্থবহ পারিভাষিক শব্দ । আহ্নিক, সন্ধ্যাহ্নিক, সন্ধ্যা ইত্যাদি শব্দের আলাদা মানে থাকলেও উপাসনা প্রসঙ্গে তাদের বিশিষ্ট, স্বতন্ত্র ও স্বীকৃত মানে আছে । তেমনই রোধ, ক্ষমতা, শক্তি, কার্য ইত্যাদি শব্দের আলাদা মানে থাকলেও পদার্থবিজ্ঞানে তাদের বিশিষ্ট মানে আছে । পারিভাষিক শব্দের প্রতিশব্দ হয় না ।

জ্ঞানচর্চার সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন শব্দ ভাষায় আসে । সেইসাথে আসে পরিভাষা । লোকসভা, বিধানসভা, বিচ্ছিন্নতাবাদ ইত্যাদির যে মানে আমরা ব্যবহার করে থাকি তা আগে ছিলো না । কিছু লোক মিলে সভা করলেই তা লোকসভা হবে না । লোকসভা আর জনসভা শব্দে সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস বোঝায় । লোকসভা পারিভাষিক শব্দ । জনসভা পারিভাষিক শব্দ নয় । গ্রামের লোকে সভা করে কাউকে একঘরে করার বিধান দিলেও সে সভা কোনোমতেই বিধানসভা হতে পারে না । এতকাল ছিলো যিনি বিধান দেন তিনিই বিধায়ক । বিধায়ক শব্দের মানে একই থাকলেও আজ তার একটি নতুন মান হয়েছে – বিধান সভার সদস্য । কিছুকাল আগেও যাকে বলা হতো ‘স্বতন্ত্র’ তাকে এখন পারিভাষিক অর্থে বলা হয় ‘নির্দলীয়’ । ‘স্বতন্ত্র’ নামে একটি রাজনৈতিক দল এসে যাওয়ায় ‘নির্দলীয়’শব্দটি ব্যবহৃত হতে লাগলো ।



বাংলা ভাষায় পরিভাষা নেই – এই অভিমত আংশিক সত্য । যে দেশে যে বিদ্যার চর্চা হয়েছে, যে জিনিস আছে তার প্রকৃতি, পরিবেশ, সামাজিক আচা-আচরণে, ধর্মে, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতে, সে দেশের ভাষায় তার জন্য সাধারণ অথবা পারিভাষিক শব্দ অবশ্যই পাওয়া যায় । বাংলা শব্দ সম্ভারের মধ্যেও আমাদের নিজস্ব ধ্যান-ধারণাকে ধরে রাখা যাবে । উদাহরণ স্বরূপ আমাদের সঙ্গীত বিষয়ক কিছু পরিভাষা যেমন তান, লয়,পকড়,আলাপ ঝালা, তেহাই –এসব সহজেই প্রকাশ করা যায় । অন্যদিকে নায়িকা, গুরু – এসব শব্দের সহজে ইংরেজি করা যায় না । কিংবা ছাঁদনাতলা, শুভদৃষ্টি, গায়েহলুদ । গায়ে হলুদ মাখলেই তো গায়েহলুদ হয় না । আবার বিছানায় ফুল ছড়িয়ে রেখে ঘুমোলেই ফুলশয্যা হয় না । এসবই হলো পরিভাষা । ছাঁদনাতলা, গায়েহলুদ ইত্যাদি আমাদের দেশের সংস্কৃতিতে আছে বলেই তার জুতসই বাংলা শব্দও আছে । আগে ছিলো না, পরে হয়েছে, এমন জিনিসের জন্যও দরকারি শব্দ আমাদের শব্দভাণ্ডারে এসে ঢুকেছে । তাদের আর বিদেশি বলে চেনার উপায় নেই । মুসলমান শাসনের আমলে প্রচুর শব্দ এসেছে । যেমন - মোকদমা, উকিল, সমন, জেরা, খারিজ ইত্যাদি । মুসলমান ওস্তাদেরাও ভারতীয় সংগীতে অনেক জিনিস যোগ করেছেন । সেইসাথে অনেক শব্দও এসে ঢুকেছে আমাদের শব্দভাণ্ডারে । যেমন - বন্দিশ, সেতার, মিরজাব, জমজমা ইত্যাদি শব্দ ।



আমাদের বাংলা শব্দের উৎস সংস্কৃত, আরবি, ফরাসি, পোর্তুগিজ, ইংরেজি । এটাও ঠিক যে বিদেশ থেকে আমদানি করা ভাবনা, জিনিসপত্র, বিদ্যা, জীবনযাপনের পদ্ধতি – এসব নিয়ে বলতে বা লিখতে গেলে আমাদের ভাষায় বেশ অসুবিধা হয় । তাদের কিছু শব্দকে হয়তো অনুবাদ করে নিতে পেরেছি, অনেকগুলোই পারিনি । আমরা যতই স্বদেশী, দেশীয় বলে থাকি না কেন, আমাদের এখনকার জীবনযাত্রার প্রণালী, স্কুল ও কলেজে যা লেখাপড়া করি তার সবটাই বিদেশি । এদেশে পাকাবাড়ি ছিলো না । তাই কেবলমাত্র পাকা বাড়ির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এমন শব্দ আমাদের ভাষাতেও ছিলো না । অথচ কাচা বাড়িতে লাগে কিংবা কাঁচা-পাকা দু’রকম বাড়ির জন্যই দরকার এমন শব্দ আমাদের শব্দভাণ্ডারে আছে । যেমন - ছাদ, সিঁড়ি, চাল, মুনি, থাম, বেড়া ইত্যাদি । যেসব শব্দ পাওয়া যায় না তা হলো – শিক (ফার্সি), সিমেন্ট, লিন্টেন, জানালা (পোর্তুগিজ), সিলিং, রেলিং ইত্যাদি । পাই না ঘরের মধ্যেকার টেবিল, সোফা, ডিভান, ড্রয়ার, আলমারি, পাইপ, বসিন, সিংক, কমোড ইত্যাদি । আমাদের পরনের প্যান্ট, শার্ট, ব্লাউজ, শায়া, জুতো, মোজা সোয়েটার –এসবই বিদেশি শব্দ । রান্নাঘরের কাপ, প্লেট, ডিশ, সসপ্যান, ফ্রিজ, কুকা, গ্যাসলাইটার ইত্যাদি ব্যবহৃত শব্দই বিদেশি । বিদেশি শব্দগুলো স্বরূপে বা ঈষৎ পরিবর্তিত হয়ে মিশে গেছে আমাদের ভাষায় । 



বাংলা সাহিত্যসেবী, বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে পরিভাষা নিয়ে ভাবনাচেষ্টা কম হয়নি । আবার বিদেশী শব্দের ভাষান্তর ঘটেছে কোনো কোনো অজ্ঞাত ব্যক্তি দ্বারা । যেমন – ঘড়ির কাঁটা । আমাদের দেশে কাঁটাওয়ালা ঘড়ি আগে ছিলো না । ইংরেজিতে ঘড়ির কাঁটাকে বলা হয় ‘হ্যান্ড’ । কিন্তু কবে কোন অজ্ঞাত ব্যক্তি এর নামকরণ করলেন ‘কাঁটা’ । ‘ফায়ার ইঞ্জিন’কে কোনো এক অনামা অজানা ব্যক্তি করে গেছেন ‘দমকল’ । দমকল একটি স্বাভাবিক পরিভাষার উদাহরণ । ‘হসপিটাল’ এর পরিবর্তিত রূপ হয়েছে ‘হাসপাতাল’ । অনেকেই জীবীকার দায়ে ‘ব্রেক’-কে বলেন ‘বেরেক’, ‘প্লাগ’কে বলেন ‘পেলাগ’ । এরাই আবার টাইম, সাইজ, পিস ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করে থাকেন । এছাড়াও অনেক পরিভাষার উদাহরণ দেওয়া যায় যা আমাদের বাংলাতেই আছে । যেমন – প্রাণ-কে পরাণ, শাঁখ-কে শঙ্খ, কান্দী-কে কাঁদি, বম্ব-কে বোমা, ব্রাশ–কে বুরুশ ইত্যাদি । অন্যদিকে শিক্ষিত বাঙালির চিন্তাভাবনা ইংরেজি ও বাংলা মিশিয়ে তৈরি হয় । যেমন – ‘ট্রেন অ্যাক্সিডেন্টের পর বহু ডেডবডির পরিচয় পাওয়া যায়নি’ । বাংলা পরিভাষিক শব্দের অনেক কিছুরই ইংরেজি অনুষঙ্গ নেই – তাদের অনুবাদও অসম্ভব । যেমন – ত্রিভঙ্গ, রস, পটুয়া ইত্যাদি ।



পরিভাষা প্রণয়ন বলতে আমরা সেই ঘটনাটা বুঝবো যেখানে শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, কলা, প্রশাসন প্রভৃতি ক্ষেত্রে যে ইংরেজি ও অন্য বিদেশী শব্দ আছে তার বাংলা করা, কিংবা বাংলায় গ্রহণীয় রূপ দেওয়া । বহু প্রাতঃস্মরণীয় মানুষ এ কাজ করেছেন কিন্তু সমস্যা মেটেনি । ইদানিং সমস্যা আরও বেড়েছে । বাংলা ভাষায় যে ভাবে পরিভাষা প্রণয়ন করা হচ্ছে বা হয়েছে তাতে মনে হয়, যাঁরা এগুলো করেন তাঁদের প্রধান বিবেচ্য হয় কোনো রকমে একটা শব্দ দাঁড় করানো । নইলে ‘মৃত্যুকালীন উক্তি’র পরিভাষা ‘মূমূর্ষশ্রাবিতক’, ‘এস্টিমেট’-এর পরিভাষা প্রাক্‌কলন’, ‘ওয়ারেন্ট’-র ‘প্রগ্রহণ পত্র’, ‘ব্যালট পেপার’-এর ‘মতপত্রী’ ইত্যাদি শব্দ বাঙালির মুখের ভাষায় না এলে পরিভাষার ভবিষ্যৎ নেই । এই সব পরিভাষা যাঁরা করেছেন, তাঁরা সকলেই বিশিষ্ট ব্যক্তি । তাঁদের বিদ্যাবত্তা, পাণ্ডিত্য নিয়ে কোনো সংশয় নেই । তবুও এসব এখনো পর্যন্ত বাঙালির মুখের ভাষা হয়ে উঠতে পারলো না । 



বাংলাভাষার অস্তিত্ব আজ বিপন্ন :

ভাষার স্বভাব নদীর মতোই পরিবর্তনশীল । নদীর এই পরিবর্তনশীল স্বভাবের কারণেই তার বুকে জমে চোরাবালি এবং ব্যহত হয় তার স্বাভাবিক স্রোত । তেমনটাই হয়ে থাকে ভাষার ক্ষেত্রেও । ভাষাব্যবহারকারী সমাজ যদি তার ভাষা নদীর বুকের তলার চোরাবালি প্রতিনিয়ত সরিয়ে না দেয়, তাকে যদি স্বাভাবিক স্রোতস্বিনী করে তুলতে না পারেন, তাহলে এই আধুনিক ভাষাসংঘাতের যুগে সেই সমাজের ভাষা আর টেঁকে না । বদলে যায় । গত একশ বছরে পৃথিবীতে অনেক মানুষ তাদের মাতৃভাষাকে বদলে নিয়েছে । বাংলাভাষাও এই চক্রের বাইরে থাকতে পারে না । যতো ভাষাপ্রেমই থাকুক না কেন এবং বাংলা গানে যত যাদুই থাকুক না কেন এ ভাষা যদি ঘরে-বাইরে সর্বত্র আমাদের মুখ্যভাষা না হয়ে উঠতে পারে, আমরা যদি সেভাবে তাকে গড়ে তুলতে না পারি তাহলে আজ যে ক্ষয়কে মনে হচ্ছে অতি ক্ষুদ্র তা কিছুকালে মধ্যেই সুবিপুল ধসে রূপান্তরিত হবে । পৃথিবীতে গত একশ বছরে অনেক দেশের ভাষাই হারিয়ে গেছে । দেখা গেছে সে-সব হতভাগ্য দেশে সমৃদ্ধ ভাষা ও নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এসে সে-দেশের মাতৃভাষাকেই উপড়ে ফেলে দিয়েছে । যে-দেশে উপনিবেশ দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে সেখানকার মাতৃভাষার মহীরুহ উপড়ে গিয়ে খিচুড়িভাষার বুনোজঙ্গলের উদ্ভব হয়েছে । যেমন ঘটেছে হাইতি, ফ্রেঞ্চ, গায়না, জামাইকা ইত্যাদি দেশে । আমাদের দেশেও ভাষা প্রবল গতিতে খিচুড়ি হচ্ছে । আজকালকার লেখা গল্প উপন্যাস পড়লে দেখা যায় তাতে বাংলার সাথে বেশ কিছু ইংরেজি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে । আচার্য সুনীতিকুমার ১৯৪১ সালের এক বক্তৃতায় বলেছিলেন - ‘বাঙলায় প্রায় ৮/৯ শত ইংরেজি শব্দ ইতিমধ্যেই পুর্ণরূপে গৃহীত হয়ে বাঙলা বনে গিয়েছে ।’



চল্লিশ দশকের পর বাংলা ভাষায় ইংরেজি শব্দের অনুপ্রবেশ যে বিপুল হারে বেড়েছে তা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত । একটু খুঁটিয়ে দেখলে দেখা যাবে, এখন যে-কোনো ইংরেজি শব্দ এমনকি ইংরেজি বাক্যগঠনপ্রণালীও বাংলায় অবলীলাক্রমে ব্যবহৃত হচ্ছে । এই খিচুড়ি ঘটাটাই হচ্ছে ভাষাবদলের প্রথম ধাপ । কলকাতার উপভাষা হচ্ছে আমাদের নানা প্রান্তের নানা উপভাষার মধ্যে সকলের জানা বাওয়ারি উপভাষা । এ ভাষায় আমরা বই পড়ি, খবর পড়ি, গান গাই । কলকাতার উপভাষাকে সরিয়ে রাখলে বাংলার প্রান্তিক ভাষাভাষীদের পক্ষে পরস্পরের ভাষা বোঝার উপায় থাকবে না । এই ভাষা যদি পর্যাপ্ত ইংরেজি গিলে খিচুড়ি হয়ে অবশিষ্ট বাঙালির কাছে দুর্বোধ্য হয়ে পড়ে তাহলে আমরা আবার এক নতুন বিপদের সন্মুখীন হবো । আমাদের দেশে ভাষার ক্রম-অবলুপ্তির একটি অন্য ধরনও লক্ষ করা গেছে । পশ্চিমবঙ্গে সাঁওতালি মাতৃভাষা এখন প্রায় ১৮ লক্ষ মানুষের এবং নেপালি মাতৃভাষা প্রায় ৭ লক্ষের । এদের মধ্যে নেপালি ভাষাগোষ্ঠীর মানুষেরা তাঁদের মাতৃভাষা পড়ছেন । অন্যদিকে সাঁওতালি ভাষাগোষ্ঠীর মানুষেরা তাদের মাতৃভাষা পড়ছেন না যে তার প্রমাণ পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের পরিসংখ্যান থেকেই জানা যায় । নেপালি ভাষার পরীক্ষার্থীর সংখ্যা সাঁওতালি ভাষার পরীক্ষার্থীদের থেকে অনেকগুণ বেশি । মাতৃভাষার প্রতি আকর্ষণ ও প্রীতি মানুষমাত্রেই সহজাত ও স্বাভাবিক । কিন্তু ভাষার প্রতিদানের ক্ষমতার উপর তার ব্যবহারের ব্যাপ্তি নির্ভর করে । জীবিকাক্ষেত্রে সাঁওতালি জ্ঞানের কোনো মূল্য নেই । সাঁওতালি শিখে কেউ চাকরি পাবে না । উচশিক্ষাক্ষেত্রে সাঁওতালদের আধুনিক বিদ্যাচর্চায় এ ভাষার স্থান এখনো দৃঢ়ভাবে গড়ে তোলা যায়নি । বিশ্বভারতীর একটি ডিপ্লোমা কোর্সের বাইরে এদেশে সাঁওতালি শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই । শিক্ষক নেই । শিক্ষক গড়ে তোলার, বই লেখার সংগঠনও নেই । অন্যদিকে নেপালিও ছোটো গোষ্ঠীর ভাষা । কিন্তু বহির্জীবনে তার ব্যবহার ক্ষেত্র গড়ে উঠেছে । সম্প্রতি নেপালি একাদেমি হয়েছে । তাদের দৈনিক পত্রিকা, টাইপরাইটার ইত্যাদি আছে । দার্জিলিংয়ের চাকরি পেতে হলে নেপালি জানতে হয় । অথচ নিরক্ষর সাঁওতাল ছেলেটিকেও বর্ধমানে বাংলা রাজমহলে মৈথিলি শিখতে হয় । অর্থাৎ কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ভাষাই শিখতে হচ্ছে তাকে । এতেই প্রমাণিত হয় যে কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ভাষাই আজকের দিনে স্বাভাবিকভাবে ক্রম প্রসারতা লাভ করে ।



বাংলাভাষার সংসার থেকেই চুরি গেছে মালদার খোট্টা উপভাষা ও জলপাইগুড়ির প্রায়-বঙ্গীভূত সাদরি উপভাষা । আজকাল দেশে নবাগত এই ভাষাসাম্প্রদায়িকতার কারণ হিন্দির ঊর্ধ্বচাপ । ভারতে একমাত্র আমাদের অর্থাৎ বাঙালিদেরই এই সমস্ত উৎপাত তুচ্ছ করার শক্তি ছিলো । কিন্তু আমরা বাঙালিরা আমাদের ভাষার প্রতি যে ব্যবহার করছি তারও কোনো তুলনা নেই । এখন বাংলাভাষা ভুলতে চাওয়াই হচ্ছে বাঙালির প্রাত্যহিক বাসনা । এখন তিনিই উপহাসাস্পদ যিনি নিজ সন্তানকে বঙ্গভাষার স্কুলে পাঠান । বাংলায় চিঠি লেখেন । সভায় বাংলা বলেন । ইংরেজি মাধ্যমে না-পড়ানো আর ইংরেজি না-পড়ানো এক নয় । রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘ইংরেজি আমাদের পক্ষে কাজের ভাষা, কিন্তু ভাবের ভাষা নহে । ভাবের ভাষা কাজের ভাষা থেকেও বেশি প্রয়োজন । কারণ আমাদের দেহ সাড়ে তিন হাতের মধ্যে বদ্ধ,কিন্তু তাই বলিয়া ঠিক সাড়ে তিন হাত পরিমাণ গৃহ নির্মাণ করিলে চলে না । স্বাধীন চলাফেরার জন্য অনেকখানি স্থান রাখা আবশ্যক ।’ সেই স্বাধীনতা যেহেতু আমরা শিক্ষায় রাখিনি সেজন্য ‘তেমন মুঠা করিয়া কিছু ধরিতে পারিতেছি না, তেমন আদ্যোপান্ত কিছু গড়িতে পারিতেছি না, তেমন জোরের সহিত কিছু দাঁড় করাইতে পারিতেছি না ।’ মাতৃভাষাকে শিক্ষার বাহন করে তোলার প্রচেষ্টা আমরা শুরু করেছি প্রায় একশ বছর আগে থেকে । কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ বিষয়ে শুরু হয়েছিলো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভারতীয় উপাচার্য গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিয়ে । আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকাকালীন মাতৃভাষাকে শিক্ষার বাহন করার উদ্যোগ নিলেন ১৯২১ সালে । আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যু হলো তাঁর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবার আগেই । ভারতবর্ষে আধুনিক ভাষা ও সাহিত্য শিক্ষার মডেল কি হওয়া উচিত আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তাঁর আমলে বাংলা এম এ-র পাঠক্রমে তার এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন । সেই নিয়মানুসারে যে বাংলায় পড়বে তাকে অন্য দুটি ভারতীয় ভাষাও শিখতে হবে । অন্য ভাষাভাষীদের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম । আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর পিতার অসমাপ্ত কাজ নতুন করে শুরু করলেন পুত্র শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় । রবীন্দ্রনাথের কলমও কিন্তু থেমে থাকেনি । তিনি অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন এই বিষয়ে । অবশেষে ১৯৩৫ সালে সরকারী অনুমোদন পাওয়া গেল । ছাত্রছাত্রীরা মাতৃভাষার মাধ্যমে পরীক্ষা দিলেন ১৯৪০ সাল থেকে । রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর এক বছর আগে ।



সরকারী কাজকর্মে বাংলাভাষার প্রচলন বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ভূমিকা যথেষ্ট রয়েছে । ঠিক হলো যে ১৯৬৫ সাল থেকেই পশ্চিমবঙ্গে সব কাজ বঙ্গভাষায় হবে । অথচ ১৯৬৫ সালের আগেই ১৯৬৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের ১৯ নম্বর অ্যাক্টে বলা হলো যে, বাংলার সুবিধা প্রত্যাহার করা হচ্ছে না । কিন্তু ইংরেজি থাকবে । কলেজ, আদালত, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, সরকার - কোথাও আমরা বাংলাভাষাকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছি না । শুধুমাত্র সাহিত্যের জোরেই বাংলাভাষা আজ তার অন্তিম লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে ।



১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষে ইংরেজ সাম্রাজ্যের অবসান হলো । দেশ বিভাগের সময় বঙ্গভূমি বিভক্ত হয়ে মধ্য উত্তর আর পূর্ব এলাকা নিয়ে পাকিস্তানের কাঠামোতে পূর্ব বাংলা গঠিত হলো । ঢাকাকেন্দ্রিক বাংলা সাহিত্য গড়ে উঠতে শুরু করলো নতুনভাবে । তবে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষার স্বাভাবিক অগ্রগতি রোধ করা ছাড়াও এই বলিষ্ঠ ভাষাকে বিকৃত করার প্রচেষ্টা করলো । হিন্দুয়ানির হাত থেকে বাংলা ভাষা রক্ষা করার অজুহাতে শাসক কর্তৃপক্ষ রাতারাতি উর্দু ও ফরাসী শব্দের আমদানি করার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠলো । নববর্ষের উৎসব, রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী ইত্যাদিকে বিদেশী সংস্কৃতি বলে আখ্যায়িত করলো । শুরু হলো প্রতিরোধের সংগ্রাম । ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্যে ছাত্রদের রক্তে ঢাকা রাজপথ রক্তাক্ত হলো । শুরু হলো দুর্বার আন্দোলন । চুয়ান্নোর সাধারণ নির্বাচন, বাষট্টির ছাত্র আন্দোলন ব্যাপক ভাবে আছড়ে পড়লো পূর্ব বাংলার মাটিতে । ছেষট্টির ছয়দফা আন্দোলন হলো । ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান হলো । একাত্তরের স্বাধিকার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন পূর্ব বঙ্গের বাঙালিরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে । একাত্তরের ষোলোই ডিসেম্বর বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে জন্ম হলো বাংলাদেশের । বিশ্বের মধ্যে একমাত্র রাষ্ট্র যার রাষ্ট্রভাষা হলো বাংলা ।



সূত্র – ১ ) বাংলাদেশের বাঙালি জাতির আত্মপরিচয় – এম আর আখতার মুকুল । ২) বাঙ্গালী – মহম্মদ আমীর হোসেন এবং অন্যান্য কিছু গ্রন্থ (পুঁথি, দেশ পত্রিকা ইত্যাদি)

0 comments: