ছোটগল্প : সাঈদা মিমি
Posted in ছোটগল্প
ছোটগল্প
তাদের একদিন ও দিনগুলি
সাঈদা মিমি
প্রথমবার ফল যা পাওয়া গেলো তা ধাক্কা দিয়ে গেলেও ভেঙে পড়েনি মধু, ভুলভাল তো হতেই পারে এরকম ভাবনা থেকে দ্বিতীয়বারের মত সব টেস্ট করা হলো, একই ফলাফল, মা হতে পারবে না সে। বায়োলজিক্যালি সন্তান ধারণে অক্ষম মধু পুরোপুরিই ডুবে গেলো হতাশায় বিষন্নতায় । সজ্ঞানেই একশটা ঘুমের বড়ি খেয়ে ফেললো, এখানে প্রকৃতির একটা বিরাট ভূমিকা ছিলো, খেলাটা পরিণতি পেলো না । স্ত্রীর ভাবান্তর চোখে পড়েছিলো অলোকের কিন্তু এরকম কিছু ঘটতে পারে সেটা আশা করেনি, সে জানতেও পারতো না যদি মাঝরাতে কাঁচের গেলাসটা শব্দ তুলে ভেঙে না পড়তো । প্রায় ন্যাতানো মধু, কতগুলি অষুধের খোসা দেখে যা বোঝার বুঝে নিয়েছিলো অলোক, এরপর আর এক মুহূর্ত দেরী নয়, তবুও শঙ্কা কাটতে সময় লেগেছিলো এগার দিন, কোমায় চলে গিয়েছিলো মধু । যখন সে ফিরলো তখন অনেক রক্তজলের চিৎকার তাকে ঘিরে ফেলেছে ।
এইসব এখন থাক, কোকাপাল মামার উঠান থেকে ঘুরে আসি । মামার হাত যে যাদুর আঙুল সেটা বুঝতে আলাদা চোখের দরকার নেই, বাসন কিংবা প্রতিমা সব নির্মাণে তাঁর খ্যাতি আশেপাশের সব গ্রামে । সারা মরশুমেই সে ব্যাস্ত, ছইবিহীন নৌকায় উথলির হাটে যায় তার পসরা, সেখান থেকে সাভারের পর্যটক বাজারে । পূজার সময়ে মামার কথা বলার অবকাশ নেই তবুও আমাকে সে বাক্য দিয়েছে, একটা ভাস্কর্য গড়ে দেবে আমার । এসব ঠিকঠাক হয়ে যেতই, গণ্ডগোল পাকালো সুনীতা; কোকাপাল মামার বড় মেয়ে, জাতধর্ম জলে ঢেলে কাজিবাড়ীর বহুরূপী সাদেক মিয়ার সাথে সে ভেগে গেলো । পুরো কুমার পাড়া থ মেরে গেছে, মা দূর্গার মূর্তি অর্ধসমাপ্ত, বুড়ি নয়ন ঠাকুমা ধাক্কাটা নিতে পারলো না, তার শ্রাদ্ধ সেরে কোকাপাল মামা সপরিবারে কোথায় যে চলে গেলো, আমরা কেউ জানতে পারলাম না ।
মধু কি করছে? শুয়ে আছে সে, ধাবমান মৃত্যুচিন্তায় কাতর । সে আসলে ভীত অন্য কারণে, যদি অলোক আরেকটা বিয়ে করে! অলোকের বংশে বাতি দেয়ার কেউ নেই, বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে সে । যদিও তার বাপ মা বেঁচে নেই এবং তার একটি দিদি রয়েছে, এই দিদিকে যমের মত ভয় পায় মধু, তার উচ্চস্বরে বলা বাক্যসমূহের অর্ধেক জুড়েই থাকে খিস্তিখেউড় । দিদি কি অলোক কে বাধ্য করবে আরেকটি বিয়ে করতে? খুবই সম্ভব, অলোকও দিদি বলতে অজ্ঞান । যদিও অলোক তার কব্জায়ত্ব, সে অলোকের দূর্বল অংশগুলি সম্পর্কে সচেতন এবং তার বাবার বিশাল পণের অংশ অলোকের ব্যাবসায় খাটছে। ঠিক সেই ক্ষণটায় অলোক ক্যাশ বাক্সের ওপর উবু হয়ে হিসেব মেলাতে ব্যাস্ত । দক্ষ কর্মকার সে, যদিও চরম অপরিণামদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলো একবার প্রথম যৌবনে, সেই কথা মনে পড়লে রাগে ক্ষোভে বুকটায় জ্বালা ধরে যায় তার ।
কোকাপাল মামা পুরোপুরিই হারিয়ে গেলো, কুমার পাড়ায় যেতে ইচ্ছে করে না আর । সুনীতা কেন এমন করলো? করম চাচা একদিন বলছে শুনলাম, কার পাপ বড় করেছিলো কোকাপাল? সেই রক্ত ভালো ছিলো না, নিজের মাইয়া হইলে এত বড় দাগা দিতো না । হ্যাঁ আমরা সবাই জানি, নীতা কোকাপাল মামার পালক মেয়ে কিন্তু কখনোই এটা বোঝার উপায় ছিলো না । সুনীতার চাওয়াগুলির মূল্য থাকতো প্রথমে, তারপর অন্য সবার চাওয়া, এমনকি তার স্কুলে যাওয়া যা কুমার পল্লীর ঘরগুলিতে কোন অর্থ বহন করে না, তারা বংশ পরম্পরায় মাটির কারিগর, বিদ্যাশিক্ষায় আগ্রহ কম । কেউ কেউ দুই তিন ক্লাস পড়েই শেষ কিন্তু সুনীতা সেভেন পাশ করে একটা বিস্ময় তৈরী করে ফেললো, তা নিয়ে কোকাপাল মামার গর্বের অন্ত ছিলো না ।
অলোক বিশ্বনাথ স্কুল পাশ দিলো তিনবারের চেষ্টায়, দিদির ইচ্ছে ছিলো সে কোন সরকারী চাকুরে হবে কিন্তু অলোকের মন লাগেনি, সে বাবার দোকানের উত্তরারিকারী হিসেবে নিজেকে ভাবতে পছন্দ করতো । তাছাড়া তার হাতখরচ উত্তরোত্তর বাড়ছে, বন্ধু বাড়ছে এবং যৌবন ধর্মের কুহেলি তাগিদ । বন্ধুমহল, সিগারেট, চোলাই এবং একসময় উপলব্ধি করার জন্যে যেখানে পা রেখেছিলো সেই বেশ্যাপাড়ায় সপ্তাহে অন্তত দুইবার যেতে হয় তাকে, শেষতক দোকানে বসতে শুরু করলো অলোক । তার জামাইবাবু যে কিনা এই প্রতিষ্ঠান আগলে রাখছিলো এতদিন, ব্যাপারটা তার মোটেই পছন্দ হলো না । দিদিকে মারধোরের ঘটনা মাঝে মধ্যে থেকে নিত্যে রূপ নিলো কিন্তু সংকটাপন্ন হওয়ার আগে সুরসিক ঈশ্বর কিস্তিমাত করে দিলেন, অলোক এবং জামাইবাবু মুখোমুখি ধরা খেলো পতিতা পল্লীতে । এই অংকটা কষে ফেলা সহজ, দিদিও জানবে না, মুখোশও খুলবে না, ব্যাবসাপাতি মিলেমিশে চলবে, মারধোর নিষেধ হাত নিশপিশ করলেও ।
দেখি একটু পিছু ফিরে চৌদ্দ বছরের মধুকে আরেকবার, মাধবী মানে মধু ভালো আছে, উড়ছে । এ কেমন নমুনা? উড়ছে মানে কি! এ ওড়াওড়ি মনস্তাত্বিক, সে প্রেমের হাওয়ায় উড়ছে । তপন সাহা আর বেলি সাহার আদরের একমাত্র কন্যা সে । বাপের ব্যাবসা জমি জিরেত মিলিয়ে কম নেই । সে যতটা পায় তার ভাই দুটি সেসবের অর্ধেকও পায় না । মেয়ে একদিন পরের ঘরে চলে যাবে, আহা বাবা মায়ের মন টনটনিয়ে ওঠে । মধু তখন দীপনের বাহুতে, স্বপ্ন নেশায়… আবার সে জহুরি নবুর বাহুলগ্না! অপরিণামদর্শী মেয়েটা বোঝার আগেই গর্ভ অনুসঙ্গ, দীপন পুরোপুরি অস্বীকার করে বসলো । এর পিছনে কারণটা ছিলো জহুরী নবু, মধুর প্রেমিকের তালিকায় থাকার অপরাধে সে ও ফাঁসলো । কাউকেই মধুর দায়িত্ব নিতে রাজি করানো গেলো না এবং গর্ভপাত অবস্ব্ম্ভাবি হয়ে পড়লো; একজন আনাড়ি দাই এবং বিবর্ণ মাধবী ।
সুনীতা একদিন হঠাৎ ফিরে এলো, তার আলগা চমকটা কোথায় হারিয়ে গেছে তা নিয়ে ফিসফাঁস হয়েছিলো যদিও প্রাক্তন ভিটায় বসে সারাজীবনের যে আহাজারি মেয়েটাকে ফালি ফালি করেছিলো তা কেউই দেখেনি । সুনীতি কিংবা তার পুরুষটি এসব আগ্রহ নিয়ে উৎসুক অনেকেই এসেছিলো, জবাব মেলেনি । আশ্রয়ও জোটেনি তার এমনকি দুই দানা খাবারও । একদিন খুব ভোরে ইছামতির পাড়ে মেয়েটাকে পেয়েছিলো কোকাপাল তার ঢিবি করে রাখা মাটির পাশে, কেউ জন্মের পরেই ফেলে গেছে, নাড়ি কাটা হয়নি- জন্মরক্তে মাখামাখি । কোকাপাল এবং আরতি সেই মৃতপ্রায় বাচ্চাটাকে কত নিবিড় পরিচর্যায় সারিয়ে তুলেছিলো, সে হিদুঁর সন্তান না মোছলমানের সেদিকে ফিরে তাকায়নি । মেয়েটা পয়া ছিলো, দশগ্রামে ছড়িয়ে পড়েছিলো কোকাপালের নাম; মেয়েটা অপয়া ছিলো, সে দশগ্রামের কাছেই কোকাপালের মুখে চুনকালি মেখে দিলো । সুনীতি ফিরে গেলো, কোথায়? কেউই সেটা জানতে পারলো না কিন্তু সাদেক মিয়াকে গ্রামেই দেখা যেতে লাগলো।সে পঞ্চায়েতকে বকশিশ দিয়ে, অনুতাপ করে-টরে ধোয়া তুলসী সাজলো।দাড়িতে-টুপিতে-মসজিদে-চিল্লায়-তাবলীগে এবং অন্ধকার আরিচা নগরবাড়ী চোরাচালানে।
অলোক ভালোবেসে ফেলেছিলো নিভারানী কে, বিষয়টা স্বাভাবিক নয়, কেন না বেশ্যাপাড়ার কাউকে হৃদয়ে জায়গা দিতে নেই । নিভারানীও সেকথা বোঝাতে চেয়েছে বারবার, অলোক বুঝতে চায়নি । সে নিভা কে ঘরেই এনে তুললো । একদিন নিভা ছিলো মাসডাইল গ্রামের পেয়াদাবাড়ির মেয়ে, প্রেমিকের হাত ধরে ঘর ছাড়া মরিয়ম । দৌলতদিয়া পতিতা পল্লীতে আসার পর অবশ্য তার নাম বদলে দেয়া হয় । এসব সে অলোক কে বলেছিলো, তবুও নিভা কে আটহাজার টাকা দিয়ে পতিতালয় থেকে ছাড়িয়ে এনেছিলো অলোক । সুপ্ত একটা স্বপ্ন যে নিভারানীর ছিলো না তা নয়, ঘরের দিশা তাকে আলোড়িত করেছিলো বৈকি, তবে সেই ঘরে যে আরেক সতর্ক সাপ বাস করে নিভা সেটা জেনেছিলো অলোকের ঘরে পা দেবার পর, জামাইবাবুটি… সে ও যে নিভার খরিদ্দার ছিলো একসময়ের।
অনুতাপ মধু কে ঘুনপোকার মত কাটছিলো । ঘরময় এক প্রতিধ্বনি উত্তরোত্তর বাড়ছিলো, আমি একটা ভ্রূণকে হত্যা করেছিলাম…. করেছিলাম… করে… এভাবে অদৃশ্য শব্দটা যত বাড়ছিলো, ততই উম্মাদের মত কান চেপে ধরছিলো মধু এবং সে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো অলোকের বুকে, স্বীকারোক্তি দিতে চেয়েছিলো, পারেনি । আর অলোক ? তার বলার মত ছিলো যা, মধুকে সে বলেছিলো, বিবাহিত জীবনের আবেগঘন কোন এক দুখী রাতে।মধুর জন্য পরবর্তী সময়ে সেটা ভালো ফল বয়ে এনেছে স্বামীকে কব্জায় রাখতে। নিভারানীর উত্থান, জামাইবাবুর চালবাজি, নয়মাসের গর্ভ…. জামাইবাবু বলেছিলো ও বাইচ্চা তোমার কেম্বায় কও? আমারও তো হইবার পারে! অলোক আতকে উঠেছিলো, নিভা স্বৈরীনি প্রথম ভাবনা ছিলো সেটাই অথচ গৃহলক্ষীর চিন্তা উত্তপ্ত মাথায় আসেনি, এলে তিনগাঁও দুরের কুটনী দাইয়ের হাতে নিভা কে তুলে দিতো না সে, বাচ্চাটাকে ফেলে আসতো না ইছামতির নির্জন মৃত্যুপাড়ে । নিভা উম্মাদের মত হামলে পড়েছিলো, আমার বাইচ্চা আমাক দেও, আমি তোমাগের কাছ থে চইলা যামু… একটা লাখি খেয়ে নেতিয়ে পড়েছিলো সে । সেই ক্রোধ প্রশমিত হয়ে অপরাধবোধ যেদিন জেগেছিলো সেদিন নিভা কে ফিরিয়ে আনার পথ ছিলো না আর । অলোক পতিতালয় ভুলেছিলো, জামাইবাবু তো ভোলেনি, একদিন নেশার ঘোরে বলে ফেলেছিলো, একলাই পাইবা সব? আমি হইতে দিলে না!...
দুই হন্তারকের নির্ঘুম রাত, দুটো অদৃশ্য শিশু শুয়ে ছিলো দুইজনের মাঝখানে । বাতাসের নির্বোধ গোঙানি ভাসছিলো এবং ঘরের ভিতর পড়ে থাকা মানুষদুটির কোন কথাই আর অবশিষ্ট ছিলো না বলার ।
0 comments: