প্রবন্ধ : ইন্দ্রাণী ঘোষ
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
নারী স্বাধীনতা - এক খোঁজ
ইন্দ্রাণী ঘোষ
বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ সময়, কল কারখানার শ্রমিক যুদ্ধে গেল, মেশিন চলে না। হাল ধরলেন বিরাঙ্গনারা । সেই শুরু আর্থিক প্রয়োজনে বাইরে বেরনো । ছেলে ভুলানো ছড়া, ঘুম পাড়ানী গান, হেঁশেলের বাইরে এসে কল কারখানার জগতে পদার্পণ । অনেকে বলেন সেই আমাদের মেয়েদের ত্রিশঙ্কু দশা শুরু। তবে ভাবার বিষয় হল ভাল হল না, মন্দ হল ?
স্বাধীনতা আসলে কি? “ স্বাধীনতা কি খায় না মাখে?, স্বাধীনতা কি কেষ্ট না রাধে?” এই কথা বুঝতে ও যুঝতে পেরিয়ে গেল কত দশক ।
ষাটের এবং সত্তর এর দশকে নারী স্বাধীনতার প্রথম বিকাশ। এই আন্দোলনের কিছু বিশেষ দিক ছিল। প্রথমত, স্লোগান দেয়া হল ‘ব্যাক্তিগতই রাজনৈতিক’-অর্থাৎ মেয়েদের ভয়াবহ সামাজিক অবস্থার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মিটিং মিছিল করা। শুধুমাত্র সরকারের উত্থান পতন নয়,পরিবারতন্ত্রের ভিতরে শাসক পুরুষ ও শাসিত মহিলাদের সম্পর্কের খতিয়ানও বটে। মেয়েদের বিবাহিত জীবনের কর্তব্য ও সন্তানধারণ সম্পর্কে তাঁদের মতামত । আরও পরে গর্ভনিরোধক বড়ির আবিষ্কার তাদের হাতে সন্তান ধারণ সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের ভিত্তি মজবুত করে দিল। সন্তান ধারণ একজন নারী করবে বা করবে না, এ বিষয়ে তাঁর মতামত প্রথম গুরুত্ব পাওয়ার অবকাশ পেল।
দ্বিতীয়ত, হল ‘প্র ওমান লাইন’ অর্থাৎ এই ধারণা যে মহিলাদের ভয়াবহ অবস্থার জন্য তারা নিজেরা দায়ী নয়। পুরুষ শাসিত সমাজ যে ভাবে নারীকে দেখতে চায় সে ভাবেই সে নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে। মেকআপ না নেওয়া যেমন ফেমিমিনিস্ট আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক ছিল । তাঁরা মনে করতেন, পুরুষের চোখে সুন্দর হয়ে তারা নিজেদের শোষণের পথ নিজেরাই প্রশস্ত করছেন । অতএব মেক আপ বর্জন করা হোক। অবশ্য এখন এ ধারণা বদলেছে, মেয়েরা সাজেন অনেক সময় নিজের চোখে সুন্দর লাগতে, নিজের নান্দনিক বোধ চরিতার্থ করতে। এটাও অনেকক্ষেত্রে ঠিক যে মেক আপ পরিহিতা মহিলারা কর্মক্ষেত্রে অনেক সময়তেই বেশি উন্নতি করেন ।
কেন তা বলার দরকার নেই, সব পাঠক এখানে প্রাপ্তবয়স্ক। মিনি স্কার্ট, স্কিন টাইট ফিগার হাগিং টপ বা চোলি কাট ব্লাউজ অনেকেই পড়ে থাকেন, তাঁরা মনে করেন ফ্যাশন জীবনের অঙ্গ তিনি এবং তাঁরা যদি নিজেকে সেই পোশাকে ‘ক্যারি’ করতে পারেন, তবে করবেন নাই বা কেন ? আর শরীর দেখতে পেলেই পুরুষ নেকড়ের দলের ঝাঁপিয়ে পড়ার অধিকার আছে, তাতো নয়।
তৃতীয়ত ফেমিনিসট বা নারী স্বাধীনতা আন্দোলনকারীরা বললেন,
মহিলাদের পরস্পরের মধ্যে এক বন্ধনের কথা, যা জৈবিক বন্ধনের অনেক উপরে। মেয়েরা নিজেদের মধ্যে এক বন্ধন সৃষ্টি করবেন এবং বজায় রাখবেন যা নারী পুরুষ বন্ধনের চেয়ে আলাদা । নারী স্বাধীনতা আন্দোলনের আরও দুটি দাবী ছিল, যা দুনিয়া অবাক চোখে দেখেছিল । এক, মহিলাদের ভোটের অধিকার ও অপরটি ছিল নারী পুরুষ নির্বিশেষে একই পারিশ্রমিক পাবার অধিকার। এখন অবশ্য এ অবস্থা বদলেছে । বর্তমানে দেখি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের মর্যাদা পাওয়ার লড়াই । এ আন্দোলনও অনেক দূর এগিয়েছে । মানুষ মানুষের মর্যাদা পাবে, যে কোন আন্দোলনেরই এটাই শেষ কথা; তা সে মানুষ নারী হোক বা ট্রান্স জেন্ডার বা তৃতীয় লিঙ্গই হোক ।
গর্ভপাতের অধিকার নিয়েও নারীবাদীরা আন্দোলন করেছেন। গর্ভপাতের অধিকার শুধুমাত্র উচ্চবিত্ত নয়, নিম্নবিত্তেরও থাকা উচিত এ বিষয় দাবি উঠেছে। তবে খ্রিস্টান ধর্মে গর্ভপাতকে অধর্ম মনে করা হয় এখনও । এখন অবশ্য গর্ভধারণ ও অযাচিত গর্ভের সম্ভবনা কে মহিলারা নিজেরাই শেষ করতে পারেন । নারী মুক্তি আন্দোলনের এ এক বিশাল জয় ।
এরপর আসা যায় ‘কন্সেপচুয়াল আর্ট’ এর প্রসঙ্গে এখানে বলা হয় যে রান্নাঘরের সামগ্রীর দিয়েও মেয়েরা তাদের নান্দনিক তৃষ্ণা মেটাতে পারেন । আমেরিকাতে যখন নারীবাদী আন্দোলন চলছে তখন অন্তরজালের যুগ নয়, অথচ দেখি সেই কবে থেকে মেদিনীপুরের মেয়ে বউরা হয়ত বা নিজেদের অজান্তে নিজেদের নান্দনিক তৃষ্ণা মেটাতে অতি সুক্ষ কাজের গয়না বড়ি তৈরি করছেন। ও দিকে পশ্চিমী মেয়েরা বলছে - কনন্সেপচুয়াল আর্টের কথা । কি অদ্ভুত যোগাযোগ, দৈব যোগাযোগই বোধহয় হবে ।
ঘর সামলানর চেয়ে বড় কাজ মেয়েদের আর কিছু ছিল না এক সময়, কিন্তু যে মুহূর্তে তাঁরা সংসারের গণ্ডীর বাইরে এসে পা রাখলেন সেই তখনি শুরু হল সামঞ্জস্য বজায় রাখার সমস্যা । তা এই সামঞ্জস্য বজায় রাখার খেলাটি বেশ কঠিন । একটা দড়ির উপর দিয়ে হাঁটছে মহিলারা, একটু এদিক ওদিক হলেই পতন অনিবার্য । হচ্ছেও তাই সংসার ভাঙছে, পরের প্রজন্ম কষ্ট পাচ্ছে আবার সম্পর্কের নতুন সংজ্ঞাও তৈরি হচ্ছে ।
সম্পর্কের কথা বলতে গেলে শাশুড়িমাতা ও পুত্রবধূর সম্পর্কের কথা এসেই যায়। পুত্রবধূ কেরিয়ার করবেন, শাশুড়ি মা ঘর সামলাবেন - এ বড় অস্বস্তির কথা যেন । পুত্রবধু কে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে, তার চাকরীতে যাওয়ার কি দরকার? ‘সখের চাকরি - ও যেতে হবে না’। তা চাকরি যে শুধু সখ মেটানর জন্যই নয়, এ যে অস্তিত্বের খোঁজ, তা বোঝেন না তাঁরা । অর্থনৈতিক স্বাধীনতা একটি মেয়ের সমাজে দাঁড়ানোর জায়গা বদলে দেয় । চাকরী করা বা না করা সবটাই একটি মেয়ের ব্যাক্তিগত সিদ্ধান্ত, তাতে যে অন্য কারুর কথা বলাটা অনুচিত, এ কথা ভারতীয় শ্বশ্রূমাতার হৃদয়ঙ্গম হয় নি এখনও, অনেক ক্ষেত্রে । তার কারণ, মননের অভাব। (উদারমনা শাশুড়ি মা এমন ভাবেন না) । নিজে করতে পারেন নি, অন্য মেয়েটি বা কেন করবে? তার চেয়ে “চল নিয়ম মতে”।
তাসের দেশের বাঁধ কিন্তু এখন ভাঙছে । প্রথম দেখি সত্যজিত রায়ের মহানগর ছবিতে, যেখানে শাশুড়ি মা ভাত বেড়ে দিচ্ছেন ছেলে বউমা দুজনকেই অফিস যাওয়ার আগে । এ ছবি জন মানসে হৈ চই ফেলে দিয়েছিল বলেই শুনেছি । আবার হালফিলের ছবি অপর্ণা সেন নির্দেশিত ‘পারমিতার একদিন” এ দেখি বউমা শাশুড়ির এক সখীত্বের সম্পর্ক, যা বজায় থাকে বউমার বিবাহ বিচ্ছেদ এবং দ্বিতীয় বিবাহের পরেও। এই হল নারীত্ব বন্ধনের নতুন সংজ্ঞা । ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবি আবহমানে দেখি পুত্রবধূ চোস্ত ইংরেজিতে শাশুড়ি মায়ের বিরুদ্ধে কথা বলেন এবং সেটা মেনে নেয়ার দরাজ দিল দেখান শাশুড়ি মা আভিজাত্যের সঙ্গে । সম্পর্ক যে শুধু ক্ষমতা প্রদর্শন নয়, সম্পর্ক দুটি প্রাণের হয় তা সে দুজন পুরুষই হন বা নারী হন এ কথা যেদিন সকলে বুঝবেন, সেদিন লিঙ্গ বৈষম্য, নারী নির্যাতণ, কন্যা ভ্রুণ হত্যার বীভৎসতা মুছে যাবে। এক নতুন পৃথিবী হবে যেখানে একমাত্র মন্ত্র হবে ভালবাসার মন্ত্র । রাজস্থান, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশের মানুষও মেয়েদের সম্মান দেবে । “সে দিন আর কত দূরে” ?
স্বচ্ছ ধারণা ও পরিশীলিত ভাষায় একটা সুন্দর প্রবন্ধ পাঠের আনন্দই আলাদা। ইন্দ্রাণীকে আমার শুভেচ্ছা জানাই।
ReplyDeleteপত্রিকাটি সার্বিক ভাবে সুন্দর !
ReplyDelete