1

ছোটগল্প : শর্মিলা ঘোষ

Posted in


ছোটগল্প



স্বপ্ন মানসী
শর্মিলা ঘোষ 



আজ দোকানে বসে থাকতে একটুও মন করছে না তাপুর। দীর্ঘ সাড়ে চার বছর ধরে একটা মিষ্টি স্বপ্ন দেখত আর মনের কোণে সেই স্বপ্নের জাল বুনে চলত তাপু। এটাই ছিল তাপুর সময় কাটানোর সব চেয়ে প্রিয় বিষয়। গতকাল হেমন্তের সোনাঝরা বিকেলে সেই স্বপ্ন ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল ছোট্ট একটা বাক্যে— “যে কথা বলা হয় নি, আজ আর সে কথা নাই বা বললেন”। 

সাড়ে আট বছর আগে যে দিন মিতুনকে প্রথম দেখেছিল সেই দিনটার কথা আজও চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পায় তাপু। শেষ বসন্তের এক সকালে তাপু দোকানের বাইরের রোয়াকে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল। ছ ফুট দু ইঞ্চি উচ্চতার সুঠাম চেহারার চব্বিশ বছরের পূর্ণ যুবক তাপুর গায়ের রঙ প্রায় ফর্সাই বলা যায়। দীর্ঘ দুটি চোখের মনি দুটো বাদামী। ডান চোখের সাদা অংশে একটা কালো স্পট জন্ম থেকেই আছে। তাপুর মা বলে ওটা তিল। খুব অন্তর্মুখী ছেলে হলেও চুলের স্টাইলটা অমিতাভ বচ্চনের মত রেখেছে যার ফলে মেয়েরা তাপুর বেশ ভক্ত। কিন্তু তাপুর সেই অর্থে কোন প্রমিকা নেই। ছোটবেলার বন্ধু রিমা পাশের বাড়িতে থাকে। রিমা ছাড়া আর কোন বান্ধবী তার নেই। স্কুল কলেজ কোনটাতেই মেয়েদের সাথে পড়তে হয়নি কখনো। অথচ ওর বন্ধুদের মধ্যে চারজনই প্রেম করে। তাপুর সব থেকে কাছের বন্ধু অভীক। তাপু মনের সব কথা একমাত্র অভীককেই বলে। অভীকের প্রেমিকা নীলার এক বন্ধু সুতপা তো তাপুর জন্য পাগল। কিন্তু তাপু সে রকম আগ্রহ দেখায় না। অবশ্য অভীক হাল ছাড়েনি, চেষ্টাটা চালিয়েই যাচ্ছে লাগাতার। সে তাপুকে রাজি করিয়েছে একদিন সুতপার সাথে দেখা করার জন্য। বাইরে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে খেতে সামনের বড় রাস্তার দিকে তাকিয়ে সেই সব কথাই ভাবছিল তাপু। আর তখনই চোখে পড়ল সামনের ফুটপাত দিয়ে একটি মেয়ে যেতে যেতে হঠাৎ-ই তাপুকে দেখে একটু দাঁড়াল তারপর মুচকি হেসে চলে গেল সামনের দিকে। হলুদ গাত্রবর্ণের সাথে হলুদ রঙের চুড়িদার পরা লম্বা ছিপছিপে মিষ্টি মুখের মেয়েটির চোখদুটি অসম্ভব উজ্বল। তাপুর মনটা খুশিতে ভরে গেল। কয়েকজন খদ্দের এসেছে বলে তাড়াতাড়ি সিগারেট শেষ করে তাপু দোকানে এসে বসল। চা-পাতা বিক্রি হয় দোকানে। নন্দনপুরের নাম করা চায়ের দোকান চৌধুরী টী স্টল তাপুর বাবার। কলকাতার কাছেই একটি মফঃস্বল শহর নন্দনপুর। নন্দনপুরের বাজারের কাছেই উঁচু পাঁচিল ঘেরা পাঁচ কাঠা জমির উপরে তাপুদের দোতলা বাড়ি। সামনের গেটটা বেশ বড়, সাদা রঙের এম্বাস্যাডর গাড়িটা সহজেই ঢুকতে বেরতে পারে। তাপুর বাবা রেলের বেশ বড় পোস্টে চাকুরী করতেন সম্প্রতি অবসর নিয়েছেন। তাপুর উপরে দুই দিদি। বড়দির বিয়ে হয়ে গেছে ছোড়দি একটা মাধ্যমিক স্কুলে চাকরী করে তারও বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। দোকানে বেশির ভাগ তাপুর বাবাই বসেন মাঝে সাঝে তাপু থাকে। একজন কর্মচারী আছে দোকানে। বিকেলে তাপুকে আর দোকানে বসতে হলনা। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে রাতে বাড়ী ফিরে মা আর ছোড়দির সাথে গল্প-সল্প করে রাতের খাবার খেয়ে নিজের ঘরে গিয়ে পড়তে বসেছে সে। কম্পিটিটিভ পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে এখন। সকালবেলার মেয়েটির কথা ভুলেই গেছে। পরদিন তাপুকে দোকানে যেতে হলনা ওর বাবাই গেলেন। তাপু একটু দেরি করে ঘুম থেকে উঠে বাড়ির বাইরে এল সিগারেট কেনার জন্য। সিগারেটের দোকানের উল্টো দিকে একটা টাইপ স্কুল আছে। অজান্তে তাপুর সেই দিকে চোখ চলে যায় আর তখনি আবার সেই মেয়েটিকে দেখতে পেল। মেয়েটিও তাপুর দিকে তাকিয়ে আবার সেই রকম মিষ্টি করে হাসল। হাসলে মেয়েটির চোখদুটো ভীষন উজ্বল হয়ে ওঠে। তাপু বুঝতে পারল মেয়েটি রোজ টাইপ স্কুলে টাইপ শিখতে আসে। সতের আঠের বছর বয়েস হবে মেয়েটির। কোথায় থাকে মেয়েটি? এটা তাপুকে জানতে হবে। পরদিন তাপু একটা সাইকেল নিয়ে বেশ দূরত্ব বজায় রেখে মেয়েটির পিছু নিল। কিছুটা যাবার পর বা দিকের গলিতে ঢুকে গেল মেয়েটি তারপর ব্রাহ্মনপাড়া ছাড়িয়ে ডানদিকে ঘুরে নবপল্লীর ভিতরে তিনটে বাড়ি ছেড়ে চারনম্বর বাড়িতে ঢুকল।

তাপু এখন প্রতিদিন সকালে সিগারেট কেনার ছলে টাইপ স্কুলের উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে থাকে শুধু মেয়েটিকে একবার চোখের দেখা দেখবে বলে। অভীক কিন্তু তাপুর এই পরিবর্তনটা ধরে ফেলল এবং এর কারণটাও সহজেই বুঝে গেল। একদিন অভীক তাপুর দোকানে এল। এটা ওটা বলে শেষে বলল,

- কিরে, শেষ পর্যন্ত প্রেমে পড়লি তবে!

- ধুস্‌, কি যা তা বলছিস!

- হুম্‌, আমি যা তা বলছি। আজকাল আমার কাছেও লুকাচ্ছিস! বেশ, খুব ভাল। কিন্তু একটা কথা বল তো-

- কি?

- যার দিকে তাকিয়ে থাকিস, যার জন্য সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে দাঁড়িয়ে থাকিস তার নাম জানিস?

- আমি কারো দিকে তাকাই না, তুই কি আবোল-তাবোল বকছিস বল তো? নে একটা সিগারেট খা। - এই বলে তাপু সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট অভীককে দিয়ে আর একটা নিজে নিল। অভীক সিগারেট ধরিয়ে একটা বড় টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল,

- তাহলে তুই নামটা জানতে চাস না। ঠিক আছে তবে বলব না।

- তুই ওর নাম জানিস! চিনিস না কি ওকে?

- জানতে হয় বৎস। যখন বন্ধু প্রেমে হাবুডুবু খায় তখন তার জন্য এইটুকু খোঁজ নিতেই হয়।

তাপু অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে অভীকের দিকে। অভীক বলল,

- ওর নাম মিতুন। ওদের পাশের বাড়ির মলয় আমার বন্ধু। মলয়ের কাছ থেকে নামটা জেনেছি। মিতুন বারো ক্লাস পরীক্ষা দিয়েছে। তুই চাইলে আলাপ করিয়ে দিতে পারি।

- না না এখন না। কিছুদিন বাদে।

- ও ক্কে, অ্যস ইউ উইশ।

এইভাবেই কাটছিল দিনগুলি। এরমধ্যে কিছুদিন ধরে তাপু লক্ষ্য করছে টাইপ শিখতে আসা একটি ছেলে মিতুনের সাথে আসা যাওয়া করছে। প্রতিদিন মিতুন যখন আসে সেই সময় ছেলেটি সাইকেল নিয়ে একটা লাইট পোস্ট ধরে দাঁড়িয়ে থাকে মিতুনের জন্য। মিতুন এলে এক সাথে স্কুলে যায় আবার এক সাথে ফেরে। আজকাল আর মিতুন তাপুর দিকে তাকিয়ে হাসে না। তবু তাপু রোজ দাঁড়িয়ে থাকে মিতুনকে একবার দেখার জন্য। একদিন তাপু লক্ষ্য করল ছেলেটি আর আসেনা। খোঁজ নিয়ে জানতে পারল ছেলেটি চাকরী পেয়ে গেছে। মিতুনের সাথে ছেলেটিকে আর কখনও দেখাও যায় না। কিছুদিন বাদে মিতুনও কলেজে ভর্তি হল, টাইপ স্কুলে আসা বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু তাপুর আর মিতুনকে ভালবাসার কথা বলা হল না। এই ভাবেই দু বছর কেটে গেল। তাপুও রেলে চাকরী পেল। ছোড়দির বিয়ে হয়ে গেছে, রিমারও বিয়ে হয়ে গেছে। বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। কিন্তু তাপু কি করে বিয়ে করবে! মিতুনকে সে ভালবাসে, যদিও জানেনা মিতুন তাকে ভালবাসে কিনা। একবার তো মিতুনকে জানাতেই হবে। হয়ত মিতুনও মনে মনে তাকেই কামনা করে। একদিন হঠাৎ একটা সুযোগ এসে গেল। গাজনের সময় নন্দনপুরে একটা মেলা হয়। অভীক আর নীলা সেই মেলায় তাপুকে জোর করে নিয়ে গেল। তাপু কিছুতেই যেতে চাইছিল না, কিন্তু নীলার জেদের কাছে হার মানতে হল। আর সেই মেলাতেই মিতুনের সাথে একেবারে মুখোমুখি দেখা। মিতুনের বন্ধু পিউও সাথে ছিল। তাপু মিতুন দেখে কি করবে, কি বলবে বুঝতে পারছে না, খুব নার্ভাস লাগছে তার। মিতুন কিন্তু বেশ সপ্রতিভ। তাপু কিছু বলার আগেই মিতুন বেশ জোরে বলে উঠল, 

- আরে আপনি! বেশ সাহস সঞ্চয় করে তাপু বলল,

- কেমন আছেন? অনেকদিন বাদে আপনার সাথে দেখা হল মিতুন।

- আপনি আমার নামু জানেন! তবে ওটা আমার ডাক নাম। আমি সোমাশ্রী বসু। আপনার নাম কিন্তু আমি জানিনা।

- আমি হিন্দোল চৌধুরী। সবাই অবশ্য আমাকে তাপু বলেই ডাকে। 

- বাহ্‌ , কি সুন্দর নাম আপনার! রাগসঙ্গীতের একটা রাগের নাম হিন্দোল। আমি অবশ্য আপনাকে মনে মনে অমিতাভ বলেই ডাকতাম। এই বলে মিতুন হাসতে লাগল। তাপু একটু বিব্রতবোধ করছিল।

- লজ্জা করবেন না হিন্দোলবাবু, আপনার ওই বচ্চন লুকটাই কিন্তু আপনাকে বেশ আকর্ষনীয় করত। অবশ্য এখনকার হেয়ার কাটিং ও বেশ মানিয়েছে আপনাকে। 

- ফুচকা খাবেন? চলুন আপনাদের ফুচকা খাওয়াবো।

- আজ থাক, অনেকক্ষণ এসেছি। পরে একদিন হবে। মিতুনরা চলে গেল। এবারও তাপু কিছু বলে উঠতে পারলনা। কিন্তু পরে একদিন কিছু হবে এ রকমই কিছু বলে গেল না মিতুন? তাছাড়া মিতুন একবার বলল না যে সে তাপুকে মনে মনে অমিতাভ বলে ডাকত। তাহলে মিতুনও তার কথা ভাবে। তাপুর মনটা হাওয়ায় ভেসে চলল।

- এরপর অনেকদিন তাপুর সাথে মিতুনের সরাসরি দেখা হয় নি। মাঝে মধ্যে দূর থেকে এক ঝলক দেখেছে, কিন্তু কথা হয় নি। অভীক আর নীলারও বিয়ে হয়ে গেছে। নতুন জীবন নিয়ে ওরা এখন মশগুল হয়ে আছে, তাপু ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে ওদের বিব্রত করতে চায় না। তাই অপেক্ষা করা ছাড়া তাপুর আর কোন বিকল্প নেই। অথচ তাপুর মা ছেলের বিয়ের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছেন। কিন্তু তাপু কিছুতেই সম্মতি জানাতে পারছেনা। তার ভালবাসার কথা মিতুনকে জানাতেই হবে। এই ভাবে কেটে গেল আর কয়েকটা বছর। একদিন একটা কাজে কাছরাপাড়া গেছিল। সেখান থেকে বাসে বাড়ি ফিরছিল তাপু। সামনের দিকে মহিলা আসনে মিতুন বসে আছে। তাপু মুগ্ধ হয়ে মিতুনকে দেখছিল। আরো পরিপূর্ণ হয়েছে পূর্ণ যুবতী মিতুন। বাসের জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে মিতুন। হাওয়ায় ওর সামনের ছোট ছোট চুল উড়ছে। মাঝে মাঝে হাত দিয়ে চুল সামলাচ্ছে। বাস কন্ডাক্টর টিকিটের জন্য পয়সা চাইলে তাপু দুটো টিকিট কাটলো আর কন্ডাক্টরকে দেখিয়ে দিল দ্বিতীয় টিকিটটা কার। মিতুন যখন টিকিট কাটার জন্য টাকা দিল তখন কন্ডাক্টর বলে দিল যে তার টিকিট কাটা হয়ে গেছে আর কে কেটেছে সেটাও দেখিয়ে দিল। মিতুন তাপুকে দেখে ঈশারায় বলল যে এটা কেন করলেন। তাপু মাথা নাড়ল। মিতুন হাতছানি দিয়ে তাপুকে কাছে ডাকল। তাপু সামনে এলে বলল,

- আপনি টিকিট কাটলেন কেন?

- তাতে কি হয়েছে। কেমন আছেন?

- ভালো, আপনি কেমন আছেন?

তাপু মাথা নেড়ে জানালো সে ভালো আছে। তাপুর আগের স্টপে মিতুন নামবে। তাপু ও নেমে পড়ল মিতুনের সাথে। আজ সাহস করে তাকে কথাটা বলতেই হবে। মিতুন তাপুকে নামতে দেখে বলল,

- আরে আপনি এখানে নামলেন কেন? আপনার তো পরেরটা!

- একটা কাজ আছে তাই। একটু ইতস্তত করে তাপু বলেই ফেলল,

- আপনাকে একটা কথা বলার আছে। অনেক আগেই বলতাম, কিন্তু সাহস করে বলে উঠতে পারিনি।

মিতুনের হাসি মুখটা যেন একটু ম্লান হয়ে গেল। মুখটা নিচু করল কিছুক্ষণ তারপর মুখ তুলে বড় বড় দুটি টলটলে চোখ রাখল তাপুর চোখের উপর আর তারপরই সেই কঠিন বাক্যটি বলল,

- যে কথা বলা হয়নি এতদিন, আজ আর সে কথা নাই বা বললেন। তাপুর মুখ থেকে অজান্তেই বেরিয়ে গেল,

- বলব না!

মিতুন আস্তে করে মাথা নাড়ল তারপর চলে গেল। তাপু কিছুক্ষণ স্থানুর মত দাঁড়িয়ে রইল সেখানে।

এই ঘটনার মাস ছয়েক বাদে আবার এক বসন্তের সকালে, সেদিন ছিল রবিবার, তাপুর ছুটি বলে বাবাকে বিশ্রাম দেবার জন্য দোকানে বসেছে। সেই প্রথম দিনের মত মিতুন দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল, তারপর তাপুর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে চলে গেল। হলদে রঙের লাল বর্ডার দেয়া তাঁতের শাড়ী সিঁথি ভর্তি টকটকে লাল সিঁদুরে রাজেন্দ্রানীর মত লাগছে মিতুনকে। 



1 comment:

  1. bah.. khub sundor.. sohoj saboleel bhashay lekha jhor jhore ekta misti premer golpo.. tobe prochur typo ache segulo shodhrate parle bhalo hoto..

    ReplyDelete