ছোটগল্প : তাপসকিরণ রায়
Posted in ছোটগল্প
ছোটগল্প
বৃন্দাবন-বাসিনী
তাপসকিরণ রায়
বৃন্দাবনের নন্দীকুঠির এক আধ-অন্ধকার কুটিরে আজ বিশ বছর কাটিয়ে দিল সবিতা। বয়স তার আশির কাছাকাছি।
-কি গো, একটু ফেন ভাত দেও দিকিনি, সৌদামিনী লাঠি ভর দিয়ে আসতে আসতে কথাগুলি বলল। এই বৃদ্ধা আশি বছর পার করেছে জীবনের। দেখলে মনে হবে যেন না-মরে কোন মত টিঁকে আছে। সবিতার পাশের কুটিতে সে থাকে। ঠাকুরের প্রসাদ ভোগ না পেলে নিজে রেঁধে বেড়ে খেতে খুব কষ্ট হয়।
মাটির হাঁড়িতে সামান্য ফেন ভাত বসায় সবিতা। মাঝে মধ্যে তা থেকে সৌদামিনীকে ভাগ দিতে হয়। তার মানে আধ পেটা খাওয়া। শুরুতে এখানে আসার পর থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা একেবারে খারাপ ছিল না। নন্দী-কুঠি থেকে আর্থিক সহায়তা কিছু পেত। এ ছাড়া আজ এখানে ভাণ্ডারা, কাল পূজার ভোগ, পরশু প্রসাদ বিতরণ এসব মিলিয়ে দিনগুলি খেয়ে পরে কেটে যেত। আর তা ছাড়া শুরুতে শরীরও কিছুটা সাথ দিয়ে ছিল। মন্দিরের কাজ, পূজাপার্বণে সহায়তা করা, নিয়মিত ভজন কীর্তন নিয়ে ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে নিজেকে ভুলে থাকতে পারত।
কত আর ভুলে থাকা যায় ! স্বামী, সবিতা আর তার এক মাত্র ছেলে, সরলকে ফেলে রেখে স্বর্গবাসী হয়ে গেলেন। সরল তখন ন বছরের। তারপর থেকে সবিতাকে সংসারের হাল সামলাতে হয়ে ছিল। ঘরের পুরানো সেলাই মেশিন কাজে লেগে ছিল, ঘরের কাজের ফাঁকে ঠোঙা বানিয়ে দোকানে দিয়ে আসা এ সবই সবিতাকে করতে হয়েছে। কোন মতে দুটো পেট চলেছে, কিন্তু সরলের লেখা পড়া ? তাকে সরকারী স্কুলে পাঠিয়েছে, শত কাজের মাঝে দু বেলা ছেলেকে পড়িয়েছে। সরলকে বলতে গেলে ঘরের কোন কাজ সে করতে দেয় নি। এত দারিদ্রের মাঝেও মা ও ছেলের মাঝে ছিল এক মধুর সম্পর্ক।
-দেও না গো একটু ফেন ভাত--তোমার প্রসাদ দাও ! সৌদামিনী হাসির চেষ্টা করে। নড়বড়ে ফোকলা দাঁত বেরিয়ে আসে মুখের বাইরে--সেটা হাসি, না কান্না তা বোঝার উপায় নেই ! আসলে সে তো মরে বেঁচে থাকার হাসি !
ভাবনার জাল ছিঁড়ে বর্তমানে ফিরে আসে সবিতা - আজ বেশী নাই, আসো যা আছে তাই খেয়ে নিই। এমনি প্রায়ই হয়। আজকাল কোথাও থেকে কিছু না জুটলে ওরা দুটিতে ফেন ভাল নিয়ে খেয়ে নেয়। বুড়ি শরীর নিয়ে এর চেয়ে বেশী আর কিছু করার থাকে না। ভাণ্ডারা বল, প্রসাদ বল, কেউ তো আর আগের মত ঘরে বয়ে এনে দেয় না--তাও আশপাশে হলে কথা, দু পা গিয়ে খেয়ে আসা যায়, সাথে করে নিয়ে আসাও যায়। আজকাল সব সাহায্য বন্ধ প্রায়।
সবিতা ছেলেকে কোন মত মেট্রিক পাশ করাল, এক চট কলে ছেলে কেরানীর কাজ পেল। ছেলে মার সম্পর্ক তখনও খুব ভালো ছিল।
একটা বছর ঘুরতে না ঘুরতে ছেলে তার এক মেয়ের ফাঁদে পড়ল। রাত দিন সেই চট কলের মেয়েটা সরলের পেছনে লেগে থাকত। সে সময় থেকেই ছেলে আর মার মধ্যে মনমালিন্যর শুরু। ওই মেয়েটার পেছনেই ঘুর ঘুর করত সরল। অনেক রাতে ঘরে ফিরত। এমন কি রাতে একটু আধটু নেশাও করত।
-কি রে বাবা ! তুই নেশা করিস ? সবিতা ছেলের মাথায় হাত রেখে বলে ছিল।
-বেশ করি, আমি নেশা করি--তোমার কি ? নেশাগ্রস্ত সরল বলে উঠেছিল।
মা ছেলের কথায় দুঃখ পেয়েছিল। তবু ছেলের পিঠে হাত রেখে ছিল। সরল সে হাত ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে ছিল। সবিতা তার হাত আবারও সস্নেহে রেখেছিল ছেলের পিঠে, বলেছিল, দেখ সরল, মেয়েটা যদি ভালো হয় ওকে তুই বিয়ে করে নে !
বেশ কিছু সময় সরল চুপ করে ছিল, তারপর হঠাৎ সে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠে ছিল, বলেছিল, জানো মা, ঊর্মি, ভালো মেয়ে নয়, আমি জানি। ও আমার পয়সাকেই চেনে, ওর সঙ্গে অনেকের ভাব ! সে দিন নেশার ঘোরে কিনা কে জানে সরল অনেক কেঁদে ছিল।
সবিতা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ছিল, আদর করে বলে ছিল, তবে কেন ওর পিছনে ঘুরছিস, বাবা ?
-চাই তো ছাড়তে, কিন্তু...সে দিন আর কিছু বলেনি সরল।
ছেলের ভাবনায় সবিতার ঘুম আসত না রাতে।
-কাল যাবে গো, কেশব মন্দিরে দরিদ্র সেবা আছে, সৌদামিনী ফেনের বাটিতে চুমুক দিতে দিতে বলে উঠলো।
সবিতা বলে, তুমি যাবে কি করে ?
শরীর কাঁপিয়ে ফোকলা দাঁতে বলে উঠে সৌদামিনী, দেখি যদি পারি, লাঠিতে ভর দিয়ে পারব না ?
-চল চেষ্টা করি - না খেলে যে বাঁচব না - দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে আসে সবিতার।
এ দিকে সরল একদিন ওই উটকো মেয়েটাকে নিয়ে ঘরে ঢুকল। সেই ঊর্মি, পরনে লাল টকটকে শাড়ী, কপালে সিঁদুরের গোল বড় টিপ। সঙ্গে আরও দু তিনটে ছেলে। তার মধ্যে একজন বলে উঠলো, সরল আজ ঊর্মিকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছে, মাসিমা, ওই শ্যামা মার মন্দিরে গিয়ে...
কিছু করার ছিল না। আশপাশের ঘরের লোকজন এসে ভিড় করলো। মেয়েছেলেরা উলু দিয়ে বরণ করে বউ ঘরে তুলল। ঊর্মি ভক্তি গদগদ হয়ে সবিতাকে প্রণাম করল।
দু তিন মাস ভালো ছিল। তারপর খেমটা নাচ শুরু হল। ঊর্মি সবিতাকে যাচ্ছেতাই বলা শুরু করে দিল। শুরুতে সরলের আড়ালে, পরে সরলের সামনেই। সরল শুরুতে ঊর্মিকে বাধা দিতে চেষ্টা করত, তাও কিছু দিন পরে বন্ধ হয়ে গেল। সবিতা ছেলেকে নালিশ জানত। ছেলে মাথা নিচু করে থাকত। ঊর্মিকে কিছু বলার সাহস তার ছিল কোথায় ?
কেশব মন্দিরে চলেছে সৌদামিনী ও সবিতা। দুজনের হাতেই লাঠি। কাঁধে ছেঁড়া মলিন ঝোলা। নিজেকে বোয়ে নিয়ে যাওয়াই ওদের কাছে অসহনীয় হয়ে উঠছে। পেটের দায়ে কোন মত চলতে হচ্ছে। ওরা বহুদিন আগেই জানতে পেরেছে, পেটই মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু ! বেঁচে থাকার কত যে মূল্য চুকাতে হয় তা তারা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। এখন তো শরীর ধারণ করাই বড় কথা ! ওই তো দলে দলে কৃষ্ণ ভক্তরা চলেছে। পরিচিত জনেরা কথা বলছে, কুশল বিনিময় হচ্ছে। ওরা সবাই প্রসাদ পেতেই যাচ্ছে। এমনি প্রসাদ বৃন্দাবনে প্রায়ই পাওয়া যায়। দরিদ্র নারায়ণ ভোজন। রাধাকৃষ্ণের লীলাভূমি এই বৃন্দাবন। হাজারও সেবায়েত দাসীরা এখানে থাকে। বেশীর ভাগই এরা বয়স্কা, বৃদ্ধা। আর বেশীর ভাগই এরা বিতাড়িতা, নিজের পরিবারের ছেলে বউরা ঘরে স্থান দেয়নি। আপনজনরাই এদের দাগা দিয়েছে !
আর ভাবতে পারছে না সবিতা, সে সব কথা ভাবলে নিজেকে আরও আরও দুর্বল বলে মনে হয়।
-এই বুড়ি ! ঘরের সব কাজকর্ম তো পড়ে আছে, এখানে বসে কি ভাবছিস ? ঊর্মি মুখ ঝামটা দিয়ে ওঠে।
সবিতা প্রতিবাদ করলেও কেউ শোনার নেই। এ যে তার পূর্বজন্মের পাপের ফল ! সামনেই ছেলে বসে ছিল, ছেলেকে দেখিয়ে বলে উঠেছিল সবিতা, দেখ তোর বউ আমার সঙ্গে কি ব্যবহার করছে...
-তুমি একটু ঠিকঠাক ভাবে চল না কেন মা - সরল বলেছিল।
-চলবে কি ? ছেলের লায় পেলে - ঊর্মি মুখ ঝামটা দিয়ে উঠেছিল।
-দেখ, সরল, তোর বউ কি বলে ? ছেলের দিকে করুণ ভাবে তাকিয়ে সবিতা বলে ওঠে।
-আবার কথা বল কেন তুমি ? যা বলছে শোন না - তুমিও কম যাও না দেখছি, মার প্রতি ছেলের এমনি ধরণের বিধান ছিল ! সবিতা দেখেছে, বউ ছেলের কানের কাছে সব সময় গুজগুজ ফুসফুস করেই চলত।
এরপরেও মুখ কামড়ি মেরে ঘরের সব কাজ করে গেছে। ঘরে একলা লুকিয়ে কান্না করা ছাড়া সবিতার আর কিছু করার ছিল না। তাও ঊর্মি দেখে ফেললে চীৎকার করে উঠত, বুড়ি তোর কান্না ছাড়া কি আর কাজ নেই ?
আর পারছিল না সবিতা। সে রাতেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাবে ঠিক করেছিল। শেষকালে ঘর থেকে পালাবার সময় ছেলের কাছে ধরা পড়ে গিয়ে ছিল। ঊর্মি ছুটে এসে বলে উঠেছিল, ঘর ছেড়ে যাচ্ছ ? যাও, যাও...
-যাই না যাই, আমি বুঝব, আমার ছেলে বুঝবে, তুমি বলার কে ? যাবার আগে বোধহয় অভিমান ঠেলে উঠেছিল সবিতার।
ঊর্মি চীৎকার করে উঠে ছিল, যা, যা, এখনই যা না - দেখব কত দিন ঘরের বাইরে থাকতে পারিস!
বাইরের দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল সবিতা, ঊর্মি তাকে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে দিল দরজার বাইরে। ছেলে তার বোবার মত চুপ করে সব দেখছিল। এর পর আর কিছু বলার নেই। ছেলের দিকে একবার মুখ তুলে তাকিয়ে হন হন করে হাঁটতে শুরু করে ছিল রাস্তা ধরে।
এর মধ্যেই সবিতা জেনে নিয়ে ছিল যে ওদের মত অসহায়দের স্থান হল বৃন্দাবন। ট্রেনে উঠে পড়তে হবে, বিনা টিকিতেও চলবে। আর হাওড়া স্টেশন দেখা হয়ে গিয়ে ছিল সৌদামিনীর সঙ্গে। একই পথের পথিক ছিল ওরা। সতীর্থ। আর কোন কথা নেই, কোন দিকে তাকানো নেই - ওরা এসে ওঠে ছিল এই বৃন্দাবনে।
হঠাৎ সম্বিৎ ফিরল সবিতার, অনেক সময় ধরে গাছ তলায় বসে আছে ওরা। গাছতলার ছায়া পেয়ে সৌদামিনী ঘুমিয়ে পড়েছে হবে।
সবিতা চীৎকার করে ডেকে উঠলো, আর না, এবার ওঠো তো, চল, কৈ ?
সৌদামিনীর রা নেই কোন। সবিতা ধাক্কা দিল সৌদামিনীকে কিন্তু এ কি ওর মাথাটা একদিকে এমন ভাবে ঢলে পড়ল কেন ! বারবার ডাকার পরও কোন সাড়া নেই। আশপাশের লোক জমা হয়ে গেল। বোঝা গেল সৌদামিনী আর বেঁচে নেই। বোবা হয়ে গেল সবিতা। বুক ঠেলে কোথা থেকে যেন কান্না উথলে উঠছিল ! শেষমেশ নন্দি-কুঠির লোকেরা এসে সৌদামিনীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যবস্থা করলো। সমস্ত সময়টা শ্মশানের এক কোণে বসে ছিল সবিতা, চোখের সামনে তার বিশ বছরের এক সাথে থাকা সাথীকে পুড়ে নিঃশেষ হতে দেখল !
রাতে ঘুম আসছিল না সবিতার, বুকের ভেতর কিসের একটা ব্যথা চিনচিন করে উঠছিল। বৃন্দাবনে আসার পর ছেলেকে দু তিনটে চিঠি লিখে ছিল সবিতা। অনেক অপেক্ষা করে ছিল কিছু না হোক অন্তত ছেলে তার দু লাইন উত্তর দেবে, লিখবে, ভুল করেছি মা - তোমাকে এসে আমি নিয়ে যাব। বৃথা। এ অপেক্ষার শেষ নেই - এ যে অনন্ত অপেক্ষা। হঠাৎ বুকের ব্যথাটা প্রচণ্ড বেড়ে গেল, সবিতা বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে লাগলো।
এরপর একটা দিন, একটা রাত কেটে গেল। সবিতা ঘরের দরজা খোলে নি বলে আশপাশের লোকজনের মধ্যে জানাজানি হয়ে গেল। শেষে ঘরের নড়বড়ে দরজা ভাঙ্গা হল। সবাই দেখল, সবিতা ঘুমিয়ে আছে। সে যে ছিল শান্তির ঘুম। চির শান্তির ঘুম।
0 comments: