প্রবন্ধ : সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
মহাকাব্যের নায়ক
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
মহাকাব্য বলতে আমি এখানে ভারতবর্ষের দুই সনাতন পুরানকাব্যকেই বোঝাচ্ছি। তার বাইরে আর কোনও দেশের মহাকাব্য নিয়ে আলোচনা করার মতন জ্ঞানের পরিধি আমার নেই। এই রকম একটা বিষয় নিয়েও বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধ লেখা আমার মতন অল্পবুদ্ধি লোকের সাজে কি না, সেটাও বিবেচ্য। তবে আপাতত লোভ সংবরণ করা গেলো না। রচনার দায় অবশ্যই আমার, কিন্তু সেটা পড়ে হজম করার দায়িত্ব সহৃদয় পাঠকের। বদহজম হলে অপরাধ মার্জনীয়।
প্রথমে সহজ বিষয়টাই ধরি। আদিকবির হৃদয়নন্দন দাশরথি রামচন্দ্র যে রামায়ণের অবিসম্বাদিত নায়ক, সেটা আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। যা যা চারিত্রিক বৈশিষ্ট একজন Epical hero কে চিহ্নিত করে এবং মহাকাব্যিক নিয়ম অনুযায়ী জীবনধারা যে যে খাতে বওয়ার প্রয়োজন হয়, সেই সব শর্ত রামচন্দ্রের চরিত্র ও জীবনকাহিনী পূরণ করে। উত্তরকোশলের মতন একটি সমৃদ্ধ রাজ্যের সিংহাসনের ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকার এবং স্বভাবে ধীরোদাত্ত নায়কের সবকটি গুণের সমন্বয় রামচন্দ্রকে এক পরিপূর্ণ মহাকাব্যিক নায়কের মহিমায় প্রতিষ্ঠিত করেছে রামায়ণের কাহিনীশৃঙ্খলায়। একেবারে কৈশোরকাল থেকেই তিনি মহাবীরের পর্যায়ে উন্নীত। বিশ্বামিত্র যখন রাম-লক্ষ্মণকে তাড়কা এবং তার সহচর রাক্ষসদের দমন করার জন্য নিয়ে যান, তখন এঁরা দু’জন সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ তরুন। বয়স সম্ভবত কুড়ির কোঠাও পার হয়নি। সেই বয়সেই এই দুই বৈমাত্রেয় ভাইয়ের, বিশেষ করে রামচন্দ্রের বীরত্বের যশ আর্যাবর্তে অনেকখানি প্রসিদ্ধ। না হলে এত বীর থাকতে বিশ্বামিত্র এই দুই নবীন যুবককে এমন দুরূহ কাজের জন্য বেছে নেবেন কেন? এবং রাক্ষসবধের কাজ সুষ্ঠুরূপে সম্পন্ন করার অব্যবহিত পরেই রামচন্দ্র যা করেন, অর্থাৎ মৈথিলী জনকতনয়ার স্বয়ংবরসভায় হরধনু ভঙ্গ, তাতে তাঁর অসাধারণ বীরত্বের সংবাদ সম্ভবত আর্যাবর্তের গণ্ডী লঙ্ঘন করে দাক্ষিণাত্য অবধি ছড়িয়ে পড়ে।
রাম মহাবীর, আদর্শ পুত্র, আদর্শ রাজা, সে যুগের নিরীখে আদর্শ স্বামীও বটেন, এবং সর্বোপরি তাঁর জীবন একজন আদর্শ নায়কের প্রায় বাঁধা গতেই বহমান। বিমাতার ষড়যন্ত্রে ও পিতৃসত্য পালনের তাড়নায় রাজ্যচ্যূতি এবং বনবাস, তদুপরি রাবণের মতন একজন মহাপরাক্রম ও প্রভাবশালী রাজা কর্তৃক পত্নীহরণ রামচন্দ্রকে এমন এক বিপন্নতার মুখে ঠেলে দেয়, যা শ্রোতা-পাঠকের হৃদয়ে তাঁর জন্য অপার সহানুভূতি সৃষ্টি করতে বাধ্য। মহাকাব্যিক ভাষায় যাকে heroic isolation বলে, রামচন্দ্রের জীবন এই ধরনের পরিস্থিতিগুলিতে সেই মহিমায় ভাস্বর। সহনায়ক লক্ষ্মণকে সঙ্গে নিয়ে অতঃপর তাঁর অসাধ্যসাধনগুলি আবহমানকাল ধরে ভারতবর্ষ তথা সারা বিশ্বের আবালবৃদ্ধবনিতার মনোরঞ্জন করে এসেছে। নিঃসম্বল অবস্থা থেকে ওইরকম একটি শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী সংগঠিত করে লঙ্কার মতন সুরক্ষিত, সমৃদ্ধ দ্বীপরাষ্ট্র আক্রমণ করা এবং রাবণের বিশ্বত্রাস সামরিক শক্তিকে পরাভূত করে স্ত্রীর এবং নিজের হৃত সম্মান পুনরুদ্ধার করা কোনওভাবেই সহজসাধ্য ছিলো না। সেই প্রয়াসে বার দুয়েক তাঁকে ছলনাহত্যার আশ্রয়ও নিতে হয়েছে। কিষ্কিন্ধ্যাপতি বালী এবং লঙ্কার যুবরাজ ইন্দ্রজিৎ মেঘনাদ, যাঁরা দুজনেই অপরাজেয় যোদ্ধা হিসেবে খ্যাত ছিলেন, এই ছলনার শিকার। প্রথমজনের অপসারণ সম্পন্ন না হলে লঙ্কার বিরূদ্ধে কিষ্কিন্ধ্যার সামরিক শক্তিকে ব্যবহার করা সম্ভব হতো না। দ্বিতীয়জন সম্মুখযুদ্ধে রাম-লক্ষ্মণ দু’জনকেই রীতিমতন বেগ দিয়েছেন, এবং ইনি শেষ পর্যন্ত জীবিত থাকলে যুদ্ধের ফলাফলটাই হয়তো অন্যরকম হয়ে যেতো। তাই যে কোনও প্রকারে এই দু’জনের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া রামচন্দ্রের একান্ত প্রয়োজন ছিলো। দু’টি ক্ষেত্রেই দু’জনের দুই পরমাত্মীয়ের বিশ্বাসঘাতকতার সুযোগ সদ্ব্যবহার করেছিলেন রামচন্দ্র।
এই দু’টি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রামচন্দ্রের বীরত্বের মর্যাদা যতখানি লঙ্ঘিত হয়েছে, তার থেকে কিঞ্চিৎ বেশি বোধহয় তাঁর নায়কোচিত ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে লঙ্কাজয়ের পর অযোধ্যায় ফিরে এসে সীতাদেবীর প্রতি তাঁর ব্যবহারে। আধুনিক প্রগতিশীলরা তাঁর সেই আচরণে নারীত্বের চূড়ান্ত অবমাননা খুঁজে পেয়েছেন। প্রজাদের নির্বন্ধে স্ত্রীকে অগ্নিপরীক্ষায় প্রবৃত্ত করা এবং তাঁর চরিত্রের উপর অসতীত্বের কলঙ্কারোপ করে গর্ভবতী অবস্থায় তাঁকে নির্বাসন দান জাতীয় আচরণগুলি সত্যিই আজকের দৃষ্টিভঙ্গীতে বড় নিষ্ঠুর, বড় বেশি পৌরুষদুষ্ট মনে হয়। তবে এক যুগের সামাজিক বোধের সঠিক মূল্যায়ন যে আরেক যুগের দৃষ্টিভঙ্গীর নিরীখে করা যায় না, সে কথা তো অনস্বীকার্য। আজ পর্যন্ত যে সত্য এবং ন্যায়ের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রামরাজ্যের উদাহরণ ভারতবর্ষে দেওয়া হয়, সে রাজ্য যিনি প্রকৃতপক্ষে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাঁর পক্ষে যে প্রজাবর্গের অভিমতকে উপেক্ষা করা সম্ভব ছিলো না, বা সম্ভব হলেও উচিত ছিলো না, সে কথাও আশা করি অধুনিক পর্যালোচকদের মেনে নিতে অসুবিধা হবে না। দশ বছরের অধিক সময় লঙ্কায় রাবণের বন্দিনী থাকার পর অযোধ্যা প্রত্যাবর্তনের অব্যবহিত পরেই এমন একটা সময়ে সীতার গর্ভাধান হয়েছিলো, যে সেই গর্ভস্থ সন্তানের পিতৃত্ব নিয়েই প্রজারা সন্দিহান হয়ে উঠেছিলো; এবং সেকালের সমাজভাবনায় উত্তরাধিকার ব্যাপারটা, বিশেষত যেখানে সিংহাসনের উত্তরাধিকারের প্রশ্ন, সেটা এতখানিই বংশধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলো, যে গোটা পরিস্থিতিটাই রামচন্দ্রের জন্য রীতিমতন সমস্যাসঙ্কুল হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। সেই অবস্থান থেকে তিনি যা করেছিলেন, তা ছাড়া বোধহয় রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য তাঁর আর উপায়ান্তর ছিলো না।
তবে এই জাতীয় কিছু দ্বন্দ্ব বা উত্তরাধুনিক বিতর্কের অবকাশের বাইরে আপামর ভারতীয় জনমানসে এমন একটি আসনে প্রভু পতিতপাবন শ্রীরামচন্দ্র আসীন, যা অবতারকল্প ভগবত্তার মহিমায় চিহ্নিত। ভারতবাসী ধর্মপ্রাণ। আমাদের দেশে প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে শুরু করে মাত্র কয়েকশো বছর আগে পর্যন্ত যত মানুষের deification বা দিব্যায়ন ঘটেছে, তেমনটা পৃথিবীর আর কোনও দেশে ঘটেছে বলে আমার জানা নেই। বাল্মীকির রামায়ণকে যদি কিয়দাংশেও ঐতিহাসিক বলে মেনে নিতে হয়, তবে তার মূল উপজীব্য দাশরথি রামচন্দ্রের দিব্যায়ন, যে দিব্যায়ন পরিপূর্ণতার মাত্রা পায় তাঁর চিরকালীন একনিষ্ঠ সেবক হনুমানের ভক্তি-আনুগত্যের পরাকাষ্ঠায়।
এই এক অদ্ভূত মহাকব্যিক সম্পর্ক! ভগবানের সঙ্গে ভক্তের। একের বিপন্নতায় অন্যের আর্তি। একের প্রয়োজনে অন্যের নিঃস্বার্থ সহায়তা। রামায়ণে ভক্ত এসেছেন ভগবানের সাহায্যকল্পে। সীতাকে হারিয়ে দিশাহারা রাম-লক্ষ্মণ যখন বনে বনে ভ্রাম্যমান, সেই সময়ে হনুমানের আবির্ভাব। তাঁরই মধ্যস্থতায় কিষ্কিন্ধ্যার নির্বাসিত রাজপুত্র সুগ্রীবের সঙ্গে রামের বন্ধুত্ব, এবং তারপর লঙ্কায় বন্দিনী সীতার কাছে রামের বার্তা বহন করা থেকে আরম্ভ করে লঙ্কাজয় অবধি হনুমানের ভূমিকার কাহিনী ভারতবর্ষের মানুষের আবাল্য পাঠ্য ও শ্রব্য। রামায়ণবর্ণিত এই প্রভু-ভক্তের অনাবিল সম্পর্ক ভারতীয় সংস্কৃতিতে, ভারতবর্ষের মানুষের মনে এতটাই উজ্জ্বল, এতখানি প্রাবাদিক, যে এখনও আনুগত্যের উদাহরণ দিতে হলে রামভক্ত হনুমানের নামই উল্লেখ করা হয়।
দ্বৈপায়ন ব্যাসের কালজয়ী মহাকাব্যে কিন্তু বিষয়টা একটু অন্যরকম। প্রকৃতপক্ষে, পরিস্থিতিটা প্রায় রামায়ণের বিপরীত। এখানে ভক্তের জীবনের বিপন্ন এক সময়ে ভগবানের আবির্ভাব; এবং তারপর ভক্তের সঙ্গে ভগবানের যে সম্পর্কটি তৈরি হয়, তা ভক্তি বা আনুগত্যের চাইতে অনেক বেশি হৃদ্যতার, আত্মীয়তার । আমি অবশ্যই মহাভারতের দুই পুরুষসিংহ কৃষ্ণ ও অর্জুনের পারস্পরিক সম্পর্কের কথা বলছি। কিন্তু এই সম্পর্কের গভীরে প্রবেশ করার আগে আমাদের মূল প্রসঙ্গে, অর্থাৎ নায়ক নির্বাচনের প্রসঙ্গে, একবার ফিরে যেতে হবে। কারণ মহাভারতের কাহিনী ও তার বহমানতা রামায়ণের মতন সরলরেখ নয়, এবং দ্বৈপায়নের এই অতুলকীর্তির আভ্যন্তরীণ জটিলতার তন্তুগুলি ছাড়িয়ে কোনও একটি চরিত্রকে একক নায়ক প্রতিপন্ন করাও খুব সহজ কাজ নয়।
প্রকৃতপক্ষে, মহাভারতের আদিপর্বের নায়ক দেবব্রত ভীষ্ম। পিতৃদেব মহারাজ শান্তনুর প্রৌঢ় বয়সের প্রেম-কামনা চরিতার্থ করার জন্য যে আত্মত্যাগ তরুণ দেবব্রত করেছিলেন, তা সারা বিশ্বের মহাকাব্যিক পরম্পরায় নজিরবিহীন। তাঁর অনন্ত প্রজ্ঞা ও অসামান্য বীরত্বও প্রায় অনন্যদৃষ্টান্ত। স্বয়ং দ্বৈপায়ন ব্যাসের উদ্ধৃতি অনুযায়ী মহাভারতের ব্যাপ্তি মূলত এই ভারতবংশীয় মহামানবের সুদীর্ঘ জীবনের পরিসর। কিন্তু তবু ভীষ্ম সমগ্র মহাভারতের নায়ক নন। কারণ, যে মুহূর্ত থেকে হস্তিনাপুরের সিংহাসনকে কেন্দ্র করে ধার্তরাষ্ট্র এবং পাণ্ডবদের মধ্যে কুরুবংশীয় জ্ঞাতিশত্রুতা আরম্ভ হয়, সেই মুহূর্ত থেকে একটু একটু করে মহাকাব্যের দৃষ্টিকেন্দ্র বা focus ভীষ্মের উপর থেকে সরে যেতে থাকে। উজ্জ্বলতর হতে থাকেন পাণ্ডবরা, এবং একটা সময়ে গিয়ে মহাভারত হয়ে দাঁড়ায় মূলত পাণ্ডব ভাইদেরই জীবনসংগ্রামের কাহিনী। সে কাহিনীর নায়ক কখনও ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির, কখনও বৃকোদর ভীম এবং অবশ্যই ভারতীয় মহাকাব্যিক পরম্পরার শ্রেষ্ঠ বীর সব্যসাচী অর্জুন।
যুধিষ্ঠিরের ধৈর্য, স্থৈর্য, ন্যায়নিষ্ঠা এবং ঔচিত্যবোধ প্রায় অতিমানবিক পর্যায়ের। এমন এক সার্বজনীন ভালোবাসা, মমত্বের স্রোতও বোধহয় দুই মহাকব্যের আর কোনও চরিত্রের হৃদয় থেকে নিঃসৃত হয় না। ছোটবেলায় পিতৃহীন ভাইদের, যাঁরা কেউই তাঁর থেকে খুব বেশি ছোট নন (যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুনের জন্ম ক্রমান্বয়ে এক এক বছরের ব্যবধানে এবং নকুল-সহদেব অর্জুনের কিছু পরেই যুগ্মজাত), যুধিষ্ঠির প্রায় পিতার স্নেহেই আগলে রেখেছেন। পরম শত্রু দুর্যোধনের বিরূদ্ধেও তাঁর মুখে কোনওদিন কোনও অভিশাপ উচ্চারিত হতে শোনা যায়নি। এমনকি পাণ্ডবদের দ্বৈতবনে বাসকালীন কৌরবরা যখন তাঁদের উত্তক্ত করার জন্য সবাহিনী সপরিবার সেখানে এসে গন্ধর্বদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লেন এবং তাদের হাতে চূড়ান্ত হেনস্থা হলেন, তখনও যুধিষ্ঠিরেরই নির্দেশে ভীম অর্জুন গিয়ে গন্ধর্বদের হাত থেকে তাঁদের মুক্ত করেন। ধৃতরাষ্ট্রের জামাই জয়দ্রথের দ্রৌপদীহরণের সময়ও যুধিষ্ঠির ক্রোধান্ধ ভীমকে গান্ধারী-দুঃশলাদের কথা স্মরণ করিয়ে জয়দ্রথকে হত্যা করতে নিষেধ করেছিলেন। এই জাতীয় সমদর্শিতা বা সংবেদনশীলতা একজন ক্ষত্রিয়ের চরিত্রে দুর্লভ, কারণ প্রতিশোধস্পৃহা ছিলো সে যুগের ক্ষত্রিয় জাতির মানসিক গঠনের মূলে।
যুধিষ্ঠিরের চারিত্রিক গঠন ক্ষত্রিয়ের থেকে বেশি ব্রাহ্মণসুলভ। যুদ্ধে, অশান্তিতে তাঁর চিরকাল অনীহা। ঋষিব্রাহ্মণদের সঙ্গে আধ্যাত্মালোচনায় কালযাপন তাঁর প্রিয় ব্যসন। চিরশত্রু ধার্তরাষ্ট্রদের সম্বোধনেও তাই তিনি ‘‘অজাতশত্রু’’। যুদ্ধটাও যে তিনি একেবারে করতে জানতেন না, তা নয়। অন্তত কুরুক্ষেত্রে বারকয়েক তিনি দুর্যোধন-দুঃশাসনদের রথযুদ্ধে পর্যুদস্ত করেছেন, এবং যুদ্ধের অন্তিম পর্যায়ে শল্যের মতন মহাযোদ্ধার নিপাতও করেছেন। কিন্তু তবু, প্রখ্যাত সাহিত্যিকরা যতই তাঁকে কৃষ্ণাদ্রৌপদীর পরমদয়িত সাব্যস্ত করে মহাভারতের প্রধান নায়ক প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করুন, যুধিষ্ঠির বস্তুত তা নন। কারণ, মহাবাব্যের নায়ক হওয়ার যা প্রধান শর্ত, সেই বীরশ্রেষ্ঠত্ব তাঁর নেই।
সে বীরত্ব আছে তাঁর অনুজ ভীমসেনের। মহাভারতের জনপ্রিয়তম চরিত্রগুলির মধ্যে ভীমসেন একজন। একজন মানুষের শারীরিক সক্ষমতা কি অবিশ্বাস্য পর্যায়ে পৌঁছতে পারে, ভীম সম্ভবত তার প্রকৃষ্টতম মহাকাব্যিক নিদর্শন। তিনি মহাভারতের দ্রুততম মানুষ। দৌড়ে রথের পশ্চাদ্ধাবন করতে পারেন। তিনি সর্বাধিক শক্তিশালী পুরুষ। মল্লযুদ্ধে তাঁর সমকক্ষ সেযুগে কেউ ছিলো না। নিজের martial art কে ভীম এমন একটা অমানুষিক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন, যে হাতে অস্ত্র থাকলে তাঁর বিরূদ্ধে বাঘ-সিংহ-হাতি-গণ্ডারের মতন ভয়ংকর প্রাণীও বিশেষ প্রতিরোধ সৃষ্টি করতে পারতো না। কুরুক্ষেত্রে তিনি একা গদা হাতে অসংখ্য রণহস্তী বধ করেছিলেন। মৎস্যদেশে অজ্ঞাতবাসকালীন রাজা বিরাট ও তাঁর পরিবারের মনোরঞ্জন করার জন্য ভীম প্রাসাদপ্রাঙ্গনে বন্য পশুদের সঙ্গে একক যুদ্ধ করতেন।
আসলে ভীমের জনপ্রিয়তার প্রধান কারণই তাঁর এই দর্শনদারী gallery performance। তাঁর অতিমানবিক কীর্তিগুলি সবই এই ধরনের মনোরঞ্জক, হাততালি কুড়নো। দণ্ডপ্রদানে তিনি সিদ্ধহস্ত। হিড়িম্ব, বক, জটাসুর, কীর্মির, কীচকদের ভীম চরম শাস্তি দিয়েছেন। তাঁর ক্রোধদৃষ্টিতে কেউ একবার পড়লে তার আয়ুষ্কাল সীমিত হয়ে আসতো। তাঁর প্রতিজ্ঞায় যাদের যাদের মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হয়েছে, তারা কেউ তাঁর হাত থেকে রেহাই পায়নি। দ্যূৎসভায় দ্রৌপদীর চূড়ান্ত লাঞ্ছনার সময় নিরূপায় ভীম শুধু রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে প্রতিজ্ঞা উচ্চারণ করেছিলেন – ধৃতরাষ্ট্রের সবকটি পুত্রকে তিনি রণক্ষেত্রে এর প্রতিদান দেবেন, এবং তিনি তা দিয়েওছেন। একশোজন ধার্তরাষ্ট্রই কুরুক্ষেত্রে ভীমের হাতে নিহত হয়েছেন। দুঃশাসন ও দুর্যোধনের জন্য ছিলো বিশেষ শাস্তির প্রতিশ্রূতি, যে প্রতিশ্রূতিও ভীম অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন, এবং পালনকালে কখনও কখনও ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করেছেন।
এই নিষ্ঠুরতাই কিন্তু ভীমকে মহাকাব্যের নায়ক হতে দেয় না। বড় স্থূল আচরণগুলি তাঁর। অতিভোজন, পানাধিক্য, অতিক্রোধ, চূড়ান্ত প্রতিহিংসাপরায়নতা জাতীয় স্বভাবগুলি ভীমসেনের ভিতরকার সরল মানুষটাকে কেমন যেন মোটা দাগের একটি নৃশংস চরিত্রে রূপান্তরিত করে। ভীম, বলরামরা আসলে কৃষ্ণ বা অর্জুনের মার্জিত ক্ষাত্রশক্তির বিপরীতে দাঁড়িয়ে বড় crude, অপরিশীলিত। এঁদের সমগ্র অস্তিত্বগুলি বড় বেশি দৈহিক। শক্তিচর্চাই যেন এঁদের জীবনের মূলমন্ত্র, এবং সে শক্তিও ধনুর্বিদ্যার মতন সূক্ষ্ম সমরশিল্পে কিছুটা হলেও অপারগ। এবং সেই কারণেই এত জনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও ভীম মহাভারতের পূর্ণপ্রতিম নায়ক হয়ে উঠতে পারেন না।
যিনি পারতেন, তিনি ভীমেরই সহোদর অগ্রজ, বহু মহাভারতপ্রেমীর বেদনায় চিরভাস্বর প্রথম কৌন্তেয় ভাগ্যহত কর্ণ। জন্মলগ্নে পরিত্যক্ত সহজাত কবচকুণ্ডলধারী ভগবান সূর্যের ঔরসে কুন্তীর কন্যাবস্থার গর্ভজাত এই মহাবীরের জন্য মহাকাব্যের নায়কের মঞ্চ যেন প্রস্তুতই ছিলো। তবু যে কর্ণ নায়ক হতে পারলেন না, তার মূলে তাঁর ক্ষত্রিয় জন্ম ও সূত সংস্কারের বৈষম্য। এই বৈষম্য তাঁর চরিত্রে এমন কতগুলি জটিলতার সৃষ্টি করেছিলো, যা তাঁর ঔদার্য ও বীরত্বের বিপরীতে তাঁকে এক দাম্ভিক, আত্মসর্বস্ব, অস্থিরস্বভাব মানুষে পরিণত করে। পালকপিতা সূত অধিরথ কিন্তু তাঁর শিক্ষা-প্রশিক্ষণে কোনও ত্রুটি রাখেন নি। সময় মতন তাঁকে পাঠানো হয়েছিলো হস্তিনাপুরে দ্রোণাচার্যের অস্ত্রপাঠশালায়। কিন্তু সেখানে দুর্যোধনের সাহচর্যে তিনি প্রথম থেকেই হয়ে উঠলেন পাণ্ডবদের প্রতি অকারণে বিমুখ। তার উপর যখন অর্জুন ধনুর্বিদ্যার কৃতিত্বে বাকিদের সঙ্গে সঙ্গে তাঁকেও পিছনে ফেলে এগিয়ে গেলেন, তখন কর্ণের মন তাঁর উপর ঈর্ষায় একেবারে বিষিয়ে উঠলো। সেই বিষের নিরসন তাঁর আর কোনওদিন হলো না।
দুর্যোধন তাঁকে সব দিয়েছিলেন। বন্ধুত্ব, সম্মান, রাজত্ব, এবং সেই সঙ্গে অসূয়া। শুধুমাত্র দুর্যোধনের সন্তুষ্টিসাধনের জন্য কর্ণ নিরপরাধ পাণ্ডবদের বিরূদ্ধে তাঁর সব ক’টি ষড়যন্ত্রে অংশীদার। নিজের এবং দুর্যোধনের অহংকে তৃপ্ত করার জন্য সর্বক্ষণ তাঁর মুখে দম্ভ। এই দম্ভের কারণেই তিনি ভীষ্ম-দ্রোণাচার্যদের অপ্রিয়ভাজন। দুর্যোধনকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করতেন বলে এঁরাও কর্ণের বিরাগভাজন হয়ে উঠেছিলেন। সর্বসমক্ষে এঁদের অপমান করতেও কর্ণের বাধতো না, এবং দুর্যোধনও তাঁকে নিরন্তর প্রশ্রয় দিয়ে যেতেন। অথচ মোক্ষম প্রয়োজনের সময়ে কর্ণের যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ খুব বিরল ঘটনা ছিলো না। দ্বৈতবনে গন্ধর্বদের সঙ্গে সেই সংঘর্ষের সময় কর্ণ তাদের প্রহার সহ্য করতে না পেরে একসময়ে দুর্যোধনদের চরম বিপদের মুখে ফেলে পলায়ন করেছিলেন। বস্তুত, গোধন ব্যবস্থাপনার নাম করে দ্বৈতবনে গিয়ে নিজেদের সমৃদ্ধি প্রদর্শন করে বনবাসী নিঃসম্বল পাণ্ডবদের জ্বালাতন করার পুরো পরিকল্পনাটাই ছিলো কর্ণের মস্তিষ্কপ্রসূত। এই সংকীর্ণমনস্কতা যেন তাঁর মতন এক মহাবীরের পক্ষে একেবারেই বেমানান।
যে দুর্যোধনের জন্য কর্ণের এত সম্মান ও সমৃদ্ধি, সেই দুর্যোধনেরই সব চাইতে বড় প্রয়োজনের সময়, অর্থাৎ কুরুক্ষেত্রের সমরাঙ্গনে, শুধুমাত্র নিজের অহং-এর কারণে কর্ণ প্রথম থেকে যুদ্ধ করেননি। ভীষ্মের সঙ্গে ego clash এ জড়িয়ে পড়ে কর্ণ তাঁর সৈনাপত্যে যুদ্ধ করতেই অস্বীকার করেন, এবং তার ফলস্বরূপ কৌরববাহিনী কখনোই পূর্ণশক্তিতে যুদ্ধ করার সুযোগ পায় না। বিরাটপর্বের শেষে অর্জুনের সঙ্গে দ্বৈরথেও কর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে একাধিকবার পৃষ্ঠপ্রদর্শন করতে বাধ্য হয়েছিলেন; এবং কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধেও তিনি ভীমের মতন মধ্যমমানের ধনুর্ধরের কাছে বাণযুদ্ধে একবার হলেও পরাজিত হয়েছেন। যদিও এই ঘটনাগুলিতে কর্ণের বীরত্ব লাঘব হয়না। প্রমাণিত হয় তাঁর অস্থিরমতি, lack of concentration। তবু এই আচরণগুলি কোনওভাবেই নায়কোচিত নয়। তাই পাঠকের হৃদয়ে প্রভূত সমবেদনা উদ্রেক করা সত্ত্বেও বসুষেণ কর্ণ মহাভারতের অন্যতম প্রতিনায়ক মাত্রই থেকে যান।
তাহলে এই বিশাল মহাকাব্যের বহুতর উজ্জ্বল পুরুষের সমাবেশের মধ্যে থেকে নায়ক চয়ন করার পদ্ধতি কি? একটু বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিতে দেখলে, মহাভারতের গভীরে সন্নিবেশিত যে তিনটি মানদণ্ড বা standard খুঁজে পাওয়া যায় শ্রেষ্ঠ পুরুষের নির্ণায়ক হিসেবে, সেগুলি হলো বীরশ্রেষ্ঠত্ব, জ্ঞানীশ্রেষ্ঠত্ব ও প্রেমিকশ্রেষ্ঠত্ব। এই মানদণ্ডগুলির নিরিখে দেখলে মহাভারতের প্রথম পুরুষশ্রেষ্ঠ ভীষ্ম। তাঁর অপরিমেয় বীরত্ব ও প্রজ্ঞার কথা আমরা ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি। সে প্রসঙ্গে আর যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আমরা ফিরে যাবো যেখান থেকে আমরা মহাভারতের প্রসঙ্গ আরম্ভ করেছিলাম, সেখানে। মহাভারতের যে দুটি অসাধারণ চরিত্র আবহমানকাল ধরে ভারতবর্ষের মানুষের মনের মনিকোঠায় ভাস্বর, সেই কৃষ্ণ ও অর্জুনের প্রসঙ্গে।
বাসুদেব কৃষ্ণ! প্রেমিকশ্রেষ্ঠ, অপরাজেয় যোদ্ধা, পরমদার্শনিক যোগী, অতুলনীয় কর্মবীর! তাঁকে কেন্দ্র করে ধর্ম, সংস্কৃতি, শিল্প, সাহিত্য, স্থাপত্য এবং আরও কত যে প্রতিষ্ঠান সারা বিশ্বে গড়ে উঠেছে, আজও উঠছে, তার সংখ্যা অপরিমেয়। বিশ্বের সব সাহিত্য, সব পুরান, সব মহাকাব্য তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও সম্ভবত এমন সর্বাতিশায়ী দ্বিতীয় আরেকটি চরিত্র পাওয়া যাবে না। ভারতবর্ষের শিল্প-কলা-সংস্কৃতির কত বড় একটা অংশ যে এই এক পুরুষোত্তমের জীবন, কার্যকলাপ ও দর্শনের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, তা ভাবলেও আশ্চর্য হতে হয়। মহাভারতের পরিপ্রেক্ষিতে কৃষ্ণই একমাত্র চরিত্র যিনি এই মহাকাব্যের সুবিশাল পরিসরকেও অতিক্রম করে আরও অনেক, অনেক বড় হয়ে মানব চেতনায় ছড়িয়ে পড়েছেন; একটা গোটা দেশ ও তার সংস্কৃতির প্রাণপুরুষ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। দ্বৈপায়নের মহাকাব্যকে যদি ইতিহাস বলে স্বীকার করতে হয়, তাহলে এ কথাও স্বতঃসিদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়, যে এমন বিরাট মাপের মানুষ পৃথিবীর আর কোনও দেশে আর কোনও সময়ে জন্মান নি। কৃষ্ণ সব রকমের মানবিক গুন, ক্ষমতা, বোধ ও ব্যাপ্তির শেষ কথা। কিন্তু সে সব কিছুর উর্দ্ধে মধুসূদন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এমন এক ঐশ্বরিক মহিমায় প্রতিষ্ঠিত, যে তিনি শুধুমাত্র অবতার নন। স্বয়ং পুরানপুরুষ শ্রীবিষ্ণুর সঙ্গে তিনি একাত্ম-একাকার। এবং সেই কারণেই কৃষ্ণ মহাভারতের নায়ক নন!
নায়ককে যে বিপন্ন হতে হয়! বঞ্চিত হতে হয়! ভাগ্যবিপর্যয়ের শিকার হতে হয়! না হলে শ্রোতা-পাঠকের মনে তাঁর জন্য সমবেদনা, সহানুভূতি আসবে কোথা থেকে? একটি চরিত্রের সঙ্গে পাঠক একাত্মবোধ না করলে সেই চরিত্রের নায়কত্ব সম্পূর্ণ হয় না। কিন্তু কৃষ্ণের মতন অতিমাত্রিক চরিত্রের সঙ্গে একাত্মবোধ করার অবকাশ কোথায় সাধারণ পাঠকের?
সে অবকাশ আছে কৃষ্ণেরই পরমমিত্র অর্জুনের চরিত্রে। অদ্বিতীয় যোদ্ধা, বহু নারীর হৃদয়হরণ অদ্ভূতকর্মা অর্জুন শৈশব থেকেই নায়কের মহিমায় চিহ্নিত। পরমধার্মিক ও মহাবল দুই সন্তান যুধিষ্ঠির ও ভীমের জন্মের পর পাণ্ডু ও কুন্তী তপস্যা করেছিলেন এক মহাপরাক্রমশালী বীরশ্রেষ্ঠ ইন্দ্রপ্রতিম পুত্রের। সেই তপস্যার ফল স্বয়ং দেবরাজের ঔরসে কুন্তীর গর্ভে অর্জুনের জন্ম। তাঁর জন্মলগ্নেই দৈববাণী হয়, এই শিশু সমগ্র পৃথিবীকে আপন বীরত্বে ও মহত্বে বশবর্তী করবে। সেই দৈবঘোষের সম্পূর্ণ মর্যাদা অর্জুন রেখেছিলেন।
অথচ শতশৃঙ্গ পর্বতে অতিবাহিত শৈশবকালে অর্জুন কিন্তু যুধিষ্ঠির বা ভীমের তুলনায় নিষ্প্রভ। মায়ের সঙ্গে হস্তিনাপুরে এসে পাণ্ডবরা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বুঝতে পারেন যে তাঁরা তাঁদের জ্ঞাতি ধার্তরাষ্ট্রদের ঈর্ষা-অসূয়ায় বিপন্ন। কিন্তু সেই পরিস্থিতিতে শুধু সুযোগের অপেক্ষা ছাড়া তাঁদের আর বিশেষ কিছু করণীয় ছিলো না। এবং সে সুযোগ আসতেই সর্বাগ্রে যিনি তার সদ্ব্যবহার করেন, তিনি অর্জুন। দ্রোণাচার্যের অস্ত্রপাঠশালায় তিনি প্রথম দিন থেকে উজ্জ্বলতম ছাত্র। সংযম, মনোঃসংযোগ, অধ্যাবসায় ও বিরামহীন অভ্যাসের মাধ্যমে অর্জুন নিজের অস্ত্রক্ষমতাকে দিন দিন পরিশীলন করেছেন, এবং শেষ পর্যন্ত এমন একটি পর্যায়ে উন্নীত করেছেন, যেখানে দাঁড়িয়ে দেবাদিদেব মহাদেবকে পর্যন্ত স্বীকার করতে হয়, যে ন্যায়যুদ্ধে তিনিও অর্জুনকে পরাজিত করতে পারবেন না!
অর্জুনের অবিশ্বাস্য একক পরাক্রমে বিরাটপর্বের শেষে মৎস্যদেশের গোধন হরণ করতে গিয়ে পর্যুদস্ত হয়েছিলো ভীষ্ম-দ্রোণ-কৃপ-কর্ণ-অশ্বত্থামা-দুর্যোধন-দুঃশাসন সমন্বিত মহাশক্তিধর কৌরব বাহিনী। কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনেও অর্জুনই একমাত্র যোদ্ধা, যিনি একটিও দ্বৈরথেও একবারের জন্যও পশ্চাৎপদ হননি, এবং যে সব অত্যাশ্চর্য কৃতিত্ব তিনি সে যুদ্ধে দেখিয়েছেন, তার সঙ্গে তুলনীয় আর কোনও কীর্তি পৃথিবীর কোনও মহাকাব্যে সম্ভবত নেই।
তবু, শুধুমাত্র বীরত্বের মানদণ্ডে অর্জুনের মতন চরিত্রের পূর্ণনায়কত্ব সম্পাদন হয় না। কারণ অর্জুন শুধু বীর নন। তিনি শিল্পী, প্রেমিক, ধীর, উদাত্ত, সংযত, সংবৃতমন্ত্র, মর্যাদাঋদ্ধ, এবং সর্বোপরি, তিনি সেই ঈশ্বরপ্রতিম মানুষটির নিকটতম বন্ধু ও আত্মীয়।
আবার সেই সম্পর্ক! ভগবানের সঙ্গে ভক্তের। রামায়ণে এ সম্পর্ক একমাত্রিক। শুধুমাত্র ভক্তি-আনুগত্যের। দ্বৈপায়নের অমর কাব্যে এ সম্পর্কের বৈচিত্র বড় মধুর, বড় চিত্তগ্রাহী। পিসতুত ভাই পাণ্ডবদের সঙ্গে কৃষ্ণ-বলরামের প্রথম পরিচয় দ্রৌপদীর স্বয়ংবরসভার পর। ইতিপূর্বে কোনওদিন না দেখলেও স্বয়ংবরসভায় ছদ্মবেশে উপস্থিত পাণ্ডবদের নিজের প্রখর বুদ্ধি ও পর্যবেক্ষণ ক্ষমতায় ঠিক চিনে নিয়েছিলেন কৃষ্ণ, এবং সঙ্গোপনে তাঁদের অনুসরণ করে খুঁজে নিয়ছিলেন কুম্ভকারগৃহে তাঁদের অস্থায়ী আবাস। সেই যে হৃদয়তন্তু জুড়লো, সে বন্ধন আজীবন সযত্নে রক্ষা করে গেছেন দুই যুগপুরুষ কৃষ্ণ ও অর্জুন। বিশেষত এ ব্যাপারে কৃষ্ণের প্রয়াস লক্ষণীয়।
আসলে কৃষ্ণ বুঝতে পেরেছিলেন যে ভাইদের সঙ্গে থাকা সত্ত্বেও অর্জুন কতখানি একা! মহাবীর হওয়া সত্ত্বেও কত অসহায়! স্বয়ংবরসভায় বীর্যশুল্কে অগ্নিসম্ভবা দ্রৌপদী কৃষ্ণাকে লাভ করলেন অর্জুন। কিন্তু তাঁকে সম্পূর্ণ নিজের করে তাঁর আর কখনোই পাওয়া হলো না। সন্তুষ্ট থাকতে হলো তাঁর একপঞ্চমাংশে। বস্তুত, নারদের দেওয়া বিধান অনুযায়ী এক এক বৎসর একেক ভাইয়ের ঘরণী থাকার যে নিয়ম দ্রৌপদীর জন্য ধার্য হয়েছিলো, সেই নিয়মে তাঁকে নিজের অংকে পাওয়ার আগেই ঘটে গেলো অর্জুনের জীবনে চরম বিভ্রাট। ব্রাহ্মণের যজ্ঞকাষ্ঠ উদ্ধারের জন্য অস্ত্রাগারে প্রবেশ করে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় যুধিষ্ঠির-দ্রৌপদীকে দেখে ফেলার অপরাধে বারো বৎসর নির্বাসনের শাস্তি নেমে এলো তাঁর মাথার উপর। বিব্রত যুধিষ্ঠির, স্নেহময় যুধিষ্ঠির অনেক চেষ্টা করলেন নির্দোষ অনুজকে নিবৃত্ত করার। কিন্তু সত্যপালনের অজুহাতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন অভিমানী অর্জুন।
বড় সূক্ষ্ম, বড় নৈর্ব্যক্তিক তাঁর অভিমান। ভাগ্য ছাড়া আর কাউকে দায়ীও করার নেই পরিস্থিতির জন্য। ভবঘুরের মতন ঘুরে ঘুরেই কেটে গেলো তাঁর যৌবন। স্থিত হয়ে বসা আর হলো না কোথাও। শৈশব কেটেছিলো শতশৃঙ্গ পর্বতের অরণ্যময় পরিবেশে। সেখান থেকে মা-ভাইয়েদের হাত ধরে পিতৃরাজ্যে এসে আশ্রিতের পরবাস। তারপর যতুগৃহ থেকে বেঁচে পালিয়ে ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে ভিক্ষাবৃত্তি। অবশেষে আপন কৃতিত্বে দ্রৌপদীকে জয় করা, এবং সেই সূত্রে পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ ও যদুকুলচূড়ামনি কৃষ্ণের নৈকট্য, বন্ধুত্ব ও রাজনৈতিক সমর্থনলাভ। কিন্তু সে সাফল্যের স্বাদটুকু ঠিক করে উপভোগ করার আগেই আবার এই বিপর্যয়! কীই বা করতে পারেন অর্জুন তাঁর চিরসাথী ধনুর্বান সঙ্গী করে আবার বেরিয়ে পড়া ছাড়া?
ক্রমাগত ভ্রাম্যমান! ব্যাসের বর্ণনায় তৃতীয় পাণ্ডব। দিগ্বিজয়ী বীর চলেছেন উদ্দেশ্যহীন ঔদাসীন্যে! পথে নাগকন্যা উলূপী ও মনিপুরনৃপদুহিতা চিত্রাঙ্গদার সরস অথচ স্বল্পকালীন সান্নিধ্য। তারপর আবার পথ। বোধহয় নিজের অজান্তেই অর্জুন উপস্থিত হলেন প্রভাস তীর্থে। হয়তো তাঁর বিষন্ন অবচেতন চাইছিলো কোনও সমমনস্ক মানুষের নৈকট্য। তাই তিনি চলে এলেন সেই স্থানে, যেখান থেকে কৃষ্ণের দ্বারকাপুরী অতি নিকটে। দেখা হলো দুই বন্ধুর। কৃষ্ণ যেন তাঁর স্নেহ-ভালোবাসা-সহানুভূতির উৎসমুখ খুলে দিলেন চিরভক্ত প্রিয়সখার জন্য। অর্জুনের বিষন্নতা অপনোদন হলো। তারপর যখন তিনি মুগ্ধ হলেন অনবদ্যাঙ্গী সুভদ্রাকে দেখে, কৃষ্ণ বুঝলেন অর্জুনের বুভুক্ষু হৃদয় চাইছে কাউকে নিজের, শুধু নিজের করে পেতে। দ্রৌপদীকে পেয়েও পাননি অর্জুন। উলূপীকে তিনি চাননি। উলূপীই চেয়েছিলেন তাঁকে। চিত্রাঙ্গদাকে চেয়েছিলেন অর্জুন। পেয়েওছিলেন। কিন্তু সে প্রাপ্তি ছিলো শর্তসাপেক্ষ। চিত্রাঙ্গদাকে কোনওদিন নিজের দেশে নিয়ে যেতে পারবেন না অর্জুন। তাঁর পুত্রকে দিতে পারবেন না নিজের ভারতবংশীয় উত্তরাধিকার। তাই তাঁর প্রেমিক হৃদয় আকুল হয়ে ছিলো কাউকে সর্বাংশে পেতে, নিজেকে উজাড় করে দিতে। কৃষ্ণ সে কথা বুঝলেন, এবং অর্জুনকে পরামর্শ দিলেন সুভদ্রাকে বাহুবলে হরণ করে নিয়ে যেতে। নিজে দায়িত্ব নিলেন যাদবগোষ্ঠীকে বোঝাবার, এবং সতর্ক করে দিলেন, যদি যাদবরা শেষ অবধি না বোঝেন, তাহলে তাঁরা অর্জুনের পশ্চাদ্ধাবন করবেন, এবং তাঁদের সঙ্গে আসবেন কৃতবর্মা, সাত্যকি, বলরামের মতন ভয়ংকর যোদ্ধাদের সঙ্গে কৃষ্ণ স্বয়ং!
কৃষ্ণের এই সতর্কীকরণে অর্জুনের অসাধারণ প্রতিক্রিয়া তাঁকে মহাভারতের বাকি সব চরিত্রের থেকে আলাদা করে দেয়। একটু হেসে অর্জুন কৃষ্ণকে বলেছিলেন, ‘‘এসো। দেখা যাবে। শুধু মনে রেখো, আমি অর্জুন।’’
যাদবসেনার সাংঘাতিক পরাক্রম সে যুগে সর্বজনবিদিত ছিলো। বিশেষ করে সেই বাহিনীতে যদি কৃষ্ণ-বলরাম সামিল থাকেন, তবে তাঁদের জয় করার কথা কেউ ভাবতেই পারতো না। এবং সেইখানেই অর্জুন অর্জুন। সব ধনুর্ধরের সেরা ধনুর্ধর অদ্বিতীয় সব্যসাচী! তিনি সুভদ্রাকে নিয়ে চলে যাওয়ার পর কৃষ্ণ যখন যুক্তি দিয়েও যাদবদের সবাইকে, বিশেষত বলরামকে বোঝাতে পারছিলেন না, তখন তিনি শেষ পর্যন্ত তাঁদের নিরস্ত করেন এই বলে, যে অর্জুনের পশ্চাদ্ধাবন করা যেতেই পারে; কিন্তু যদি একাকী তাঁর কাছে পরাজিত হয়ে ফিরতে হয় রণদুর্মদ যাদববাহিনীকে, তাদের গর্ব, অভিমান, অপরাজেয়তার খ্যাতি, সব ভূলুন্ঠিত হবে। তাঁর এই কথায় কাজ হয়েছিলো। এবং তা শুধুমাত্র অন্তঃসারহীন সাবধানবাণী ছিলো না। অর্জুনকে সব থেকে ভালো কৃষ্ণই চিনতেন, এবং জানতেন যেখানে তাঁর বীরত্বের মর্যাদার প্রশ্ন, সেখানে তাঁকে পরাভূত করা অসম্ভব।
এইখানেই অর্জুনের বৈশিষ্ট। যুদ্ধক্ষেত্রে বিপক্ষে আত্মীয়-স্বজন-বন্ধুদের দেখে তিনি নির্বিন্ন হয়ে ওঠেন, কান্নায় ভেঙে পড়েন, যা যুধিষ্ঠিরের মতন মমতাময় মানুষও পড়েন না। আবার যখন সম্মানের প্রশ্ন, তখন তাঁকে জয় করা স্বয়ং ভগবানেরও অসাধ্য। ত্রিভুবনের শ্রেষ্ঠ বীর হয়েও নপুংসকের ছদ্মবেশে রাজকুমারীদের নাচগান শেখাতে তিনি এতটুকু কুন্ঠিত হন না। বরং নিজের শিল্পীসত্ত্বার সেই বিকাশের সুযোগে আনন্দিত হয়ে ওঠেন। আবার সেই অর্জুনই গাণ্ডীবের অপমানে ক্রোধে প্রজ্জ্বলিত হয়ে যুধিষ্ঠিরকেও চরম শাস্তি দিতে উদ্যত হন!
অর্জুনের চরিত্রের আরও অনেকগুলি দিক বা dimension আছে। কিন্তু অত বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ এখানে নেই। প্রয়োজনও নেই। আমাদের যা মূল উদ্দেশ্য, অর্থাৎ মহাকাব্যের নায়ক নির্ণয়ন, তা আপাতত সিদ্ধ হয়েছে। মহাভারতের জটিল ও অন্তহীন পৌরুষেয়তার বিস্তৃতির মধ্যে সম্ভবত সর্বাধিক মানবিক ও নায়কোচিত গুণসম্পন্ন চরিত্র গাণ্ডীবধন্বা তৃতীয় পাণ্ডব ঐন্দ্রেয় অর্জুন। তাই তিনি মহাভারত সূত্রধার মহাকারুণিক ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পরম মিত্র, এবং এই পৃথিবীর সমস্ত যোগ, সব দর্শনের যা সারাৎসার, স্বয়ং ভগবানের মুখনিঃসৃত অমৃতবাণী সেই ভাগবদ্গীতার তিনি এক এবং অদ্বিতীয় শ্রোতা।
This comment has been removed by the author.
ReplyDeleteBhalo laglo.orjun ke niye bhabte hobe.etokal sudhu korno ke niyei bhebechi
ReplyDeletebhalo laglo.kintu ektu songshoy o dakha dilo ei jonno j apnar bishleshon anujayi arjun er jiboner birotto r jabotio gunaboli sotteo tar nissongota vayaboho.ete kore take tragedir nayok i mone hochche .. kintu mahabharat ki tragedy te sesh hochche ? sesh obdi to sob shanto hoye shanti parbo parjonto kahini egiye jachche ...sekhane arjun o potito hochchen mrittumukhe thakchen kebol judhistir . ghotona ghotano jhuddho rajjo joy tarpor joggo shanti kamona kore saragvimukhe jatra kora sob ta jurei to judhistir . somosto attio sajon thke bichchino hoyeo mahakabyer nayoker moto tini i to abichol dharmer pothe .. tai baktik targedy ir dik thke arjun to nayok botei ..kintu judhisthir o ki kom kichu ? mahabharat tragic bhabe sesh hochcheo na .
ReplyDelete