প্রবন্ধ : ঈশানী রায়চৌধুরী
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
অনাম্নী অঙ্গনারা
ঈশানী রায়চৌধুরী
অনেকদিন আগে..যখন আমি ইস্কুলের ছাত্রী.."বেতার জগত " পত্রিকায় একটি কবিতা পড়েছিলাম | লিখেছিলেন কবিতা সিংহ | কবিতাটির নাম "নারী"| খুব ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু পংক্তি মনে আছে |
" অন্ধকার প্রাক-ইতিহাস
প্রগাঢ় অমার মধ্যে ঈশ্বরতার কোনো সংজ্ঞা নেই
স্তূপ স্তূপ ক্ষুধা আর ঘোর লালসার
উদগ্র আমার থেকে উঠে আসে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আদিম
পরিতৃপ্ত মাংসল নিদ্রার মধ্য থেকে শ্বদন্তের
কামড় বসায় ক্ষুধা
ক্ষুধার সুতীব্র দাঁত ছিঁড়ে খায় নির্বিচারে
কে কার সন্তান ?"
সত্যিই তাই | আমরা যারা সাজানো গোছানো সুখী গৃহকোণ শোভে গ্রামোফোন মার্কা সংসারে ...তা বাবা , দাদা , স্বামী ..যেই হোক.... তাদের তাঁবে থেকে দিব্যি বাড়া ভাত খাচ্ছি ...আমরা কী জানি যে সব কষ্ট সইয়ে নেওয়া যায়..শুধু পেটের জ্বালা ছাড়া ! আর তা পারা যায় না বলেই প্রিয়জনকে হারিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে মালসাভোগ চড়াই |
ধরা যাক , মঞ্জু নামের একটি মেয়ে |
“ খিদের জ্বালা সইতে পারি না ! যদি পুরুষ হতাম , হয়ত আর কোনো উপায় না থাকলে সুপারি কিলার হতাম | এখন বেশ্যা হয়েছি | এই ভালো | অন্যকে না মেরে নিজেকে রোজ একটু একটু করে মারা | অন্য ভাবে...এত আস্তে, যে চিনচিনে ব্যথাটা থাকে, ঝুঁঝিয়ে রক্ত পড়াটা টের পাই না |
আর যখন ভদ্রবাড়ির মেয়েরা আমাদের দিকে, আমাদের পেশার দিকে আঙুল তোলে, আমরা হাসি | আমাদের ঘর থেকে বেরিয়ে পুরুষেরা যখন ওদের ঘরে ওদের বিছানায় যায়, তখন ওরা নিজেদের বিছিয়ে দেয় | তাও আবার নগদ টাকা ছাড়াই | শুধু ওই ভাত কাপড়ের লোভেই তো ! নাকি গয়না, বেড়ানো...এসবও ? অবশ্য..আমরা বারোভাতারি...ওরা এক | বাঁধা বাবু ! আমরা তবু মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলতে পারি , "আজ ঘরে বাবু বসাবো না | যাও বাপু, বেশি হল্লা ক'র না |" গেরস্ত ঘরের মেয়েরা ? ইচ্ছে হোক, না হোক..বাবু চাইলে বসাতেই হবে ! আমরাই ভালো আছি...হাফ- গেরস্ত মাগী হয়ে ! স্বাধীনভাবে খাচ্ছি, দাচ্ছি...কারো দয়ার দান তো নিচ্ছি না !”
বেশ্যাবৃত্তি আসলে এমনই এক দুষ্টক্ষত , যা আমাদের আর্থসামাজিক পরিবেশের শিকার হয়ে মিশে গেছে পুরোপুরি আমাদের রক্তে | এ এক এমন পেশা, যেখানে আনকোরা অভিজ্ঞতা বা সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞতার দাম সবচেয়ে বেশি | পৃথিবীর আর কোনো পেশায় এটি হয় কি? আর পুরুষ শাসিত সমাজে মেয়েরা বেশি লেখাপড়া শিখলে চাকরি করে চেয়ারে বসে, আর পেটে বিদ্যে কম থাকলে চাকরি করে শুয়ে | বড় বড় নীতিবাগীশদের কাছে দেহদান কোনো ঘৃণ্য ব্যাপার নয়....যদি গ্রহীতাটি বিবাহিত স্বামী হয় !
বেশ্যাবৃত্তি কি অশ্লীল ? আমি তো মনে করি, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতির গঠন অনেক বেশি অশ্লীল..যা আমাদের মেয়েদের বাধ্য করে শরীর বেচে খেতে | আমরা সকলের জন্য দু’মুঠো ভাতের যোগাড় করতে পারি না..অথচ আই পি এল -এ স্পন্সরশিপ পেতে ৩৮৪ কোটি টাকা খরচ করতে পারি, কোটি কোটি টাকা খরচ করে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারি | আমরা সেভ দ্য টাইগার, বা গো গ্রীন প্রকল্পে মুক্তহাতে দান করতে পারি ; কিন্তু সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও পরিবার পিছু একটি কন্যাসন্তানকে অনাথাশ্রম থেকে দত্তক নিতে পারি না ! কিংবা, কোনো বেশ্যা যদি সুস্থভাবে বাঁচতে চায়..হয়ত আমার বাড়িতে রান্নার কাজ ক’রে..আমরা মুখ ফিরিয়ে নিই | আমরা দুপুরে কিটি পার্টি করি, পরনিন্দা পরচর্চা করি, বিউটি পার্লারে যাই...মুখ পালিশ করতে, শরীর সাজাতে | কিন্তু ওই ক্ষয়াটে মেয়েগুলো..যারা সন্ধেবেলা রং মেখে গলির মুখে ক্লান্ত চোখ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ..তাদের বাচ্চারা ...যারা দিনের বেলায় মাকে পায়..কিন্তু রাতের বেলায় থাকতে হয়..খোলা পথে বা হয়ত মায়ের ঘরের চৌকির নীচে...মুখটি বুজে...যদি..বাবু জানতে পেরে যায়..যারা বড় হলে..যদি ছেলে হয়..তবে দালাল আর মেয়ে হলে নথভাঙার পর লাইনে নেমে পড়ে..আমরা কিন্তু তাদের সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য কিছুই করি না | আমরা মুখে বলি...ওই দেখো..এন জি ও কত কাজ করছে...কিন্তু নিজেরা গা ঘামাই না | তিন নম্বরের সুধারাণীরা বংশ পরম্পরায় সুধারাণীই রয়ে যায় ! আমরাই, এই সমাজের ওপরতলার মানুষেরাই, পরোক্ষে প্রশ্রয় দিই অজ্ঞানতা, অভাব, অশিক্ষা, আর দারিদ্র্য | বাড়তেই থাকে হু হু করে... এই পতিতাবৃত্তি | মেয়েরা বিকিয়ে যায় অভাবে, অবহেলায় | তারা শরীর বেচা টাকায় ভাত জোগায় সংসারে | টাকায় পাপের ক্লেদ লেগে থাকে না | পেশায় থাকে !
পতিতাবৃত্তি এক সামাজিক ব্যাধি | মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ কিছু সংস্থা এদের নিয়ে সীমিত ক্ষমতায় কিছু কাজ করে, কিছু সুবিচার দেওয়ার, ভদ্রভাবে বেঁচে থাকার সুযোগের ব্যবস্থা করে | কিন্তু ওই পর্যন্তই | তাই আজও মেয়েরা হাটে প্রকাশ্য দিবালোকে, বা রাতের অন্ধকারে গলি ঘুঁজিতে বিক্রি হয়ে যায়, মেয়েদের রিফর্মেশন কেন্দ্রগুলি তকমা পায় নারী পাচার কেন্দ্রের, সমাজের ওপরতলার মানুষ দিনেরবেলায় নারীমুক্তি নিয়ে বুকুনি ঝেড়ে সন্ধেবেলা আলোয়ানে মুখ ঢেকে বেলফুলের মালা হাতে জড়িয়ে বেশ্যাপল্লী গিয়ে টাটকা মাল খোঁজে ! কবিরা, গল্পকাররা এদের উপজীব্য করে লেখেন, এদের নিয়ে সিনেমা হয়, এদের হয়ে মাঝে মাঝে আদালতে অধিকারের লড়াই লড়েন ব্রিফলেস উকিলেরা | ব্যস, হয়ে গেল নারী মুক্তি আর মুক্ত নারী নিয়ে আন্দোলন ! এই পতিতারা ছাড়া আর কোনো শ্রেণী একই সঙ্গে এত ঘৃণা আর নাকে কান্নার শিকার হয়েছে বলে মনে হয় না ! যা আমরা এদের দিতে পারিনি..তা হল...যৌনকর্মী হিসেবে আইনের আশ্রয় আর সামাজিক স্বীকৃতি | পেটের ভাত , বর্ণপরিচয়, পরনের কাপড়..এসব তো অনেক দূরের কথা.. এরা নিজেদের ব্যবস্থা যে নিজেরাই করে নিয়েছে...তাতেও আমরা ন্যায্য অধিকার আর ন্যুনতম সম্মান এদের দিতে পারিনি | এদের ব্রাত্য, অবহেলিত ভেবে অনুকম্পা করেছি, অস্পৃশ্য পেশা ভেবে নিজেদের নিরাপদ দূরত্বে রেখেছি | বরং এভাবে ভাবি না কেন..যে এরা স্বাধীন সত্ত্বার নিখুঁত প্রতীক, যারা পরিস্থিতির শিকার হয়ে উপায়ান্তর না পেয়ে সফল অর্থনৈতিক প্রকল্প স্বেচ্ছা - বিনিয়োগে নিজেরাই বেছে নিয়েছে...যাতে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে ! যতক্ষণ না আমরা সমাজ, অর্থনীতি, শিক্ষা ব্যবস্থায় এমন পরিবর্তন আনতে পারছি, যে এই পেশাটিকে নির্মূল করতে পারব, ততক্ষণ লজ্জার দায়ভাগ না হয় আমরা...এই সমাজের সুস্থ জীবনযাপনে অভ্যস্ত নাগরিকেরাই মাথা পেতে নিই ! ততক্ষণ এটুকুই ভাবি ,
" ভালোবেসেছিলাম একটি স্বৈরিণীকে
খরচ করে চোদ্দ সিকে |
স্বৈরিণীও ভালোবাসা দিতে পারে
হিসেবমতো উষ্ণ নিপুণ অন্ধকারে |
তাকে এখন মনে করি. ...
...কী নাম ছিল ?সঠিক এখন তো মনে নেই :
আয়ুর শেষে স্মৃতি খানিক খর্ব হবেই |
গোলাপী ? না তরঙ্গিনী ? কুসুমবালা ?
যাক গে, খোঁপায় বাঁধা ছিল বকুলমালা ,
ছিল বুঝি দু'চোখে তার কাজলটানা ;
চোদ্দ সিকেয় ছুঁয়েছিলাম পরীর ডানা ;
এখন আমি ডানার গন্ধে কৌটো ভরি |"
( পৌত্তলিক/ অরবিন্দ গুহ)
ঋতবাক সম্পাদিকার কাছে আমার অভিযোগ এই লেখাটি কে প্রবন্ধ আখ্যা দেওয়ায়। এটি একটি নির্ভেজাল সাহিত্যের চাবুক ! যেটা সপাটে আছড়ে পড়েছে আমাদের পচা-গলা সমাজের ক্ষতের ওপরে। ঈশানী কে সাবাস ! তার এই সাহসী ঋজু বক্তব্যের জন্যে। ঋতবাক সম্পাদিকাকে আন্তরিক ধন্যবাদ এই সাহসী লেখাটি প্রকাশের জন্যে !
ReplyDeleteSabash.
ReplyDelete