বিশেষ রচনা : সীমা ব্যানার্জী-রায়
Posted in বিশেষ রচনা
বিশেষ রচনা
কে আনকালচার্ড?
সীমা ব্যানার্জী-রায়
লুজিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পড়বার সময় মাঝে মাঝেই একা হয়ে পড়তাম নতুন পরিচিত বন্ধুদের কাছ থেকে। এইরকম একদিন কলেজ ক্যাফেটেরিয়ার কোণার সীটে বসে আছি। আয়েস করে সবে মাত্র কফির কাপটাতে প্রথম চুমুকটা দিয়েছি। শুনতে পেলাম দুই মিষ্টি নারী -কণ্ঠ। কারণ আমার কণ্ঠ সব সময় আমার কাছে হাঁড়িচাঁচা পাখীর মতন লাগে। তাই কানটা খাড়া করলাম, কারণ তাঁরা ছিলেন সত্যিকারের বাঙ্গালী। যদিও আমি বাঙ্গালী পুরোপুরি হতে পারি নি আজও-এটাই আমার সবচেয়ে দুঃখ।
প্রথমজন বেশ উত্তেজিত, কারণ তিনি বক্তা। আর দ্বিতীয় জন নিরুপায় শ্রোতা মাত্র। -'হুঁ-হাঁ'- দেওয়া ছাড়া আর বিশেষ কিছু করার ছিল না তাঁর। বুঝলাম দুজনেই কলকাতায় জন্মেছেন এবং বড় হয়েছেন। যিনি বক্তা তিনি 'ইগো'র লড়াইয়ে এক্কেবারে ক্ষত বিক্ষত! ভাগ্য আমার ভাল ছিল তাই কোণার টেবিলে ছিলাম। আমাকে তাঁরা কেউই লক্ষ্য করতে পারেন নি। যদিও আমার মধ্যে বাঙ্গালীত্ব-র অভাব বলে জানি, নয়ত সব সময় শুনতে হয় যে, আমি স্প্যানীশ বা পাঞ্জাবী-না কোন হটভট দেশ থেকে আসা এক প্রাণী। যাই হোক, দুকান খাড়া করে বসে থাকলাম।
বক্তাঃ এরা কালচারের জানেটা কি? এসেছে তো সব গ্রাম/মফস্ব্ল থেকে । জানি সবই, বাব্বাঃ। এখানে এসে একেবারে সব নায়ক-নায়িকা হয়ে গেছে। দেখলেই বোঝা যায় কিন্তু। আমি জন্মেছি কলকাতায়, পড়াশুনা করেছি কলকাতায়। থেকেছি দক্ষিণ কলকাতায়। কলকাতার হেঁজো-পেঁজো যায়গা থেকেও আসি নি। জন্মগত ভাবেই -কালচার- কি! আমি জানি। কালচারাল পরিবেশেই আমি 'বর্ন এ্যান্ড ব্রট আপ'। এরা কালচার কি তা জানবে কোত্থেকে- কি বলো?
শ্রোতাঃ- আমিও তো তাই। কলকাতায় জন্মেছি আবার কলকাতায়-ই বড় হয়েছি। নামকরা ইংরেজি স্কুলে পড়াশুনা করেছি। বনেদি বংশের মেয়েরা আমার বান্ধবী ছিল। কোনটাই আমার সাথে মিলছে না দেখে এমন ভাব করলাম যেন, কিছুই শুনছি না।
বক্তাঃ আরে সে-ই তো, সেই জন্যেই তো তোমাকে কথাগুলো বলছি। বলো তো, এরা কালচারের জানে টা কি? জন্মেছে তো সব গ্রামে অথবা মফস্ব্লে। কালচার কি তা এরা জানবে কোত্থেকে- ? কোনদিন কি স্টেজে উঠেছে?
শ্রোতাঃ স্টেজে ওঠা তো দূরের কথা-স্টেজের কাছাকাছি ই গেছে কিনা সন্দেহ। অথচ এখানে সব কালচারাল সেক্রেটারী। গা জ্বলে যায় এইসব দেখে।
চা খাওয়া আর হল না, জুড়িয়ে ঠান্ডা হয়ে গেল। আমি আবার কোন কথা মন দিয়ে শুনতে শুরু করলে যদি অন্য দিকে মন দি - এক্কেবারে শুনতে পারি না। লোকে আমাকে কালা ভেবে বসে। এইভাবে বসে বসে “ কালচার্ড -আনকালচার্ড--' শহর/ নগর, গ্রাম /মফস্বল, বাংলা/ইংলিশ এই শব্দ গুলো নিয়ে মনে মনে নাড়াচাড়া করতে করতে ফিরে এলাম ক্লাসে । ক্লাসের নোট নেওয়া তো দূরের কথা-মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগল-সেই দুই কলকাতার কালচার্ড-দের কথা। বাড়ি ফিরে এলাম। খাতাটা টেনে নিয়ে বসলাম টেবিলে। খাতার ওপরে পেনটা রেখে ভাবতে লাগলাম কে কালচার্ড?......কারা কালচার্ড? সত্যি তো কোনদিন মনেও আসে নি এই প্রশ্নগুলো?
মনে পড়লো বন্ধু প্রিয়নাথ সেনকে লেখা রবীন্দ্রনাথের এই লাইনটা- “ আমার কলকাতা ছেড়ে পালাতে ইচ্ছে করে।” মনে পড়ল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ-এর কলকাতা সম্পর্কে প্রকাশ করা নানা উপলব্ধি- “ পৃ্থিবী বাস্তবিক কী আর্শ্চয্য সুন্দরী তা কলকাতায় থাকলে ভুলে যেতে হ্য়।”
রবীন্দ্রনাথ কলকাতায় জন্মেছিলেন কিন্তু কলকাতায় থাকতে চাননি। তিনি কোথায় জীবনের অধিক সময় কাটিয়েছেন সে কথা আশা করি বাঙ্গালীদের অজানা নয়। শহরের যান্ত্রিকতা-কৃ্ত্রিমতা তাঁকে আনন্দ দিতে পারেনি একটুও। ইংরেজি পাঠশালায় তিনি পড়েননি। যদিও ইংরেজি মাধ্যমে পড়নেওয়ালাদের থেকে অনেক বেশি ইংরেজি পড়েছিলেন। তাদের থেকে অনেক বেশি নির্ভূল ও সুন্দর ইংরেজি তিনি জানতেন। একটা শিশুর শিক্ষার মাধ্যম তার মাতৃভাষাই হওয়া উচিত, একথাও তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন। তবে কি তিনি কালচার্ড ছিলেন না?
এতো গেল রবি ঠাকুরের ব্যাপার। অন্যরা সব কোথায় জন্মেছিলেন? চুপচাপ বসে ভাবতে লাগলাম। দেখি কখন এসে আমার সামনে দাঁড়িয়েছেন রাজা রামমোহন রায় এবং পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
আমার সামনে রাখা খাতাটাতে রামমোহন রায় বড় বড় করে জন্মস্থান লিখলেন -হুগলী জেলার রাধানগর গ্রাম।
বিদ্যাসাগর হেসে তাঁর হাত থেকে পেনটা নিলেন। জন্মস্থান লিখলেন -মেদিনীপুরের বীরসিংহ গ্রাম। তাকিয়ে দেখি আমার সামনে তো বিরাট ভীড়। একে একে সকলে পরস্পরের হাত থেকে পেন নিচ্ছেন আর লিখছেন।
বিদ্যাসাগরের হাত থেকে পেনটা নিয়ে মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত জন্মস্থান লিখলেন-যশোর জেলার কপোতাক্ষ নদীর তীরবর্তী সাগরদাড়ী গ্রাম। নাট্যকার দিনবন্ধু মিত্র জন্মস্থান লিখলেন-নদীয়ার চৌবেড়িয়া গ্রাম। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় জন্মস্থান লিখলেন-নদীয়ার কৃষ্ণনগর।
সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জন্মস্থান লিখলেন-নৈহাটির কাঁঠালপাড়া গ্রাম। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জন্মস্থান লিখলেন-হুগলী জেলার দেবানন্দপুর গ্রাম। তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় লিখলেন জন্মস্থান – বীরভূমের লাভপুর গ্রাম। বিভূতি ভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় কে দেখেই আমি বলে ফেললাম- “ আমরা জানি আপনি নিজেই সেই গ্রামের 'অপু'।”
কবি জীবনানন্দ দাসকে দেখে না বলে থাকতে পারলাম না - “রূপসী বাংলার ওই রূপ কি কেউ শহরের নিষ্প্রাণ পাথরে জন্মে দেখতে পায়? সব তো ইঁটের পাঁজরে বলি হয়ে যায়।”
বাংলা সাহিত্যের ধ্রুবতারা-কবি নীরদচন্দ্র চৌধুরী জন্মেছিলেন কিশোরগঞ্জ শহরে।
তখনও কিন্তু ভীড় কমেনি। খাতার কাছে এগিয়ে আসার জন্য রীতিমত ঠেলাঠেলি চলছে।
কিন্তু কে যেন চেঁচিয়ে উঠল। ঘুমটা গেল ভেঙ্গে। দেখি আমার বৌ্দি চায়ের কাপ হাতে।
-এখনও ঘুমাচ্ছিস?
-ঘুমুচ্ছি না তো, দেখছি আনকালচার্ড কে?
বৌ্দি অবাকঃ “কে আবার আনকালচার্ড?”
আমি বললামঃ “সেটাই তো আমার জিজ্ঞাসা। তুমি কি জানো?”
আমি আমার বঙ্গজননীকে যেন বললাম-
“আমার না-বলা বাণীর ঘন যামিনীর মাঝে
তোমার ভাবনা তারার মতন বাজে।
নিভৃত মনের বনের ছায়াটি ঘিরে
না-দেখা ফুলের গোপন গন্ধ ফিরে,
আমার লুকায় বেদনা অঝরা অশ্রুনীরে-
অশ্রুত বাঁশী হৃদয় গহনে বাজে।।”
0 comments: