প্রবন্ধ : মকসুদা হালিম
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
ছোটগল্পকার রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি ও সৃষ্টির ক্রমবিকাশের স্বরূপ
মকসুদা হালিম
বাংলা সাহিত্যে সার্থক ছোট গল্পের স্রষ্টা হিসেবে রবীন্দ্রনাথকে শ্রেষ্ঠ শিল্পীর আসন দেওয়া হয়। তাঁর উপন্যাসের জনপ্রিয়তা যেমনই হোক না কেন - ছোট গল্পের ক্ষেত্রে তিনি বিশ্বের যে কোন শ্রেষ্ঠ গল্প লেখকের সমকক্ষ।
তাঁর প্রথম গল্প 'ভিখারিনী' মাত্র ষোল বছর বয়সে লেখা। এরপর লিখলেন, 'ঘাটের কথা', 'মুকুট' ইত্যাদি। এ পর্যন্ত তাঁর ছোট গল্প লেখার প্রস্তুতিপর্ব বলা চলে। এরপর ১২৯৮ বঙ্গাব্দে যখন তিনি আবার নতুন করে ছোটগল্প লিখতে লাগলেন - বাংলা সাহিত্যের ছোটগল্পের শুরু হল, তখন থেকেই।
এই সময়ে রবীন্দ্রনাথকে জমিদারী দেখাশোনার কাজে বাংলার গ্রামাঞ্চলে আসতে হয়েছিল। এটা তাঁর জীবনে এমন একটা ঘটনা - যা তাঁকে ছোটোগল্প রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছিল।
পদ্মাতীরে জমিদারী দেখাশোনা করার অবকাশে তিনি বাংলার গ্রামীণ জীবন বিপুল ভাবে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। পল্লীর জীবনযাপন, মামলা-মকদ্দমা, ত্যাগ-ভোগ, নীচতা-স্বার্থপরতা - আবার অনাবিল স্নেহ-ভালবাসা, রবীন্দ্র নাথের সঙ্গী-বিহীন নির্জন মুহূর্তগুলোতে যে ভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল - তাদের প্রত্যেকটি একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়ে এক একটি কাহিনীর উপাদান রূপে সুন্দর ভাবে রূপ লাভ করেছ। গল্পগুলি শিল্পলক্ষণ হিসেবে যেমন উৎকৃষ্ট তেমনি বাঙালী গ্রামীণ জীবনের চিত্র হিসেবেও এগুলির মূল্য অসাধারণ!
রবীন্দ্র ছোটগল্পের গঠনরীতি সম্পর্কে বলতে গেলে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, তিনিই প্রথম ছোটগল্পের গঠন বাংলায় আনেন। তাঁর এক শ্রেণীর কাহিনী - ঘটনা বিরল, চরিত্র বিরল, অনুভূতি বা আবেগ প্রধান। যেমন, ক্ষুধিত পাষাণ, পোস্ট মাস্টার – ইত্যাদি। অন্য শ্রেণী চরিত্র প্রধান। কোন বিশেষ চরিত্র বা চরিত্রের কোন অজ্ঞাতপূর্ব আভাসমাত্র, এই ধরণের গল্পগুলিকে উপভোগ্য করেছে। যেমন, ‘কাবুলিওয়ালা’ ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ ইত্যাদি। আবার দেখা যায় তাঁর এক ধরণের গল্প পরিকল্পনা প্রধান। এখানে সবকিছু বিস্ময় বা রহস্য জমা থাকে কাহিনীর শেষে। যেমন- সমস্যা পূরণ, বিচারক, ইত্যাদি। আর এক ধরণের গল্প নিতান্তই কাহিনী এবং তার সাথে কিছু সমস্যাও জড়িত থাকে। যেমন- ‘ঠাকুর দাদা’, ‘দালিয়া’ ইত্যাদি।
গল্পগুলো অত্যন্ত সহজ সরলভাবে বিবৃত হলেও রবীন্দ্র ছোটগল্পের যে বৈশিস্ট্য, পরিমিতবোধ এবং কৌতুকরস—তা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত অব্যহতগতিতে গল্পগুলির মধ্যে বিদ্যমান। তাঁর গল্পের একটি বাক্যও অকারণে বা অপ্রয়োজনে ব্যয় হয়নি। আর তাঁর কৌতুক রসও পেটে খিল ধরানো হাসি নয়, গল্পগুলি পড়তে পড়তে স্মিত হাস্যের প্রসন্নতায় মনটি পরিপূর্ণ হয়ে যায়।
এরপর আসে আঙ্গিকের প্রশ্ন। রবীন্দ্রনাথ গল্প রচনায় কতকগুলি আঙ্গিক অবলম্বন করেছেন। যেমন—
(১) কাহিনীটি তিনি বর্ণনা করেছেন।
(২) কাহিনীটি আরম্ভ করেছেন লেখক-পরে গল্পের নায়ক উত্তম পুরুষে গল্পটি বলে গেছেন। যেমন- নিশিথে।
(৩) পুরো কাহিনীটিই উত্তম পুরুষে বলা। যেমন - অধ্যাপক।
(৪) কাহিনীটি চিঠির আকারে লেখা। যেমন - স্ত্রীর পত্র।
(৫) গল্পের কিছুটা বর্ণনা, কিছুটা চিঠি, যেমন- দর্পহরণ।
(৬) কাহিনীটি নাট্যাকারে বর্ণিত। যেমন - কর্মফল।
(৭) কাহিনীটি রূপকথা বা রূপকথাচ্ছলে লেখা। যেমন - একটি আষাঢ়ে গল্প। ইত্যাদি।
রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্প গুলিকে “গল্পগুচ্ছের” চারখণ্ডে মুদ্রিত করা হয়েছে। রবীন্দ্র ছোটোগল্প সৃষ্টির ক্রমবিকাশের ধারা অনুসরণ করলে দেখা যায়- তিনি যতই অগ্রসর হয়ে গেছেন, গল্পগুলিও ততই অনাড়ম্বর রূপ পালটে ফেলে পরীক্ষানিরীক্ষা মূলক নানান কারুকার্যমণ্ডিত হয়ে ঝকঝকে রূপ নিয়েছে।
প্রথমখণ্ডের গল্পগুলি গ্রামভিত্তিক। গ্রামের সহজ-সরল মানুষের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু প্রমথনাথ বিশীর মতে ‘রবীন্দ্রনাথ গ্রামবাংলার কড়া নেড়েছেন মাত্র, ভিতরে প্রবেশ করেন নি।‘ একারণেই হয়তো প্রথমখণ্ডের গল্পগুলিতে কল্পনা, হৃদয়াবেগ ও প্রকৃতির অপ্রতুল ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। দেখা আর না দেখা জগতের মধ্যে, কল্পনা সেতুবন্ধ রচনা করে দিয়েছে। ফলে গল্পগুলি কাব্যিক মাধুর্যমণ্ডিত হয়ে প্রকাশ পেয়েছে। প্রকৃতি এখানে ব্যক্তির সাথে একাত্ম হয়ে গিয়েছে। তিনি চোখ দিয়ে বিশ্বপ্রকৃতিকে অবলোকন করেছিলেন এবং মন দিয়ে অনুভব করে জড় প্রকৃতির মধ্যেও মানবিক গুণ আবিষ্কার করেছেন। যেমন- ‘পোস্টমাস্টারের’ একাকী-নিঃসঙ্গ জীবনের আর্তি প্রকাশ পেয়েছে-বর্ষণক্লান্ত প্রকৃতির সাথে।
কিন্তু দ্বিতীয় খণ্ডের গল্প গুলির স্বরূপ ভিন্ন স্রোতে প্রবাহিত। গল্প গুলি অধিকাংশ শহর কেন্দ্রিক হওয়ায় তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা পুষ্ট হয়ে বিশ্লেষণমুখী রূপ নিয়েছে। অধিকাংশ গল্পে দেশকালের ঘটনা বিবৃত হয়েছে, মনস্তাত্তিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। দ্বিতীয় খণ্ডে হৃদয়াবেগ প্রশমিত, বিবৃতির প্রাধান্য। প্রত্যেকটি চরিত্রের কার্যাবলী- কার্যকারণ সহ ব্যাখ্যাত। এই প্রেক্ষিতে দ্বিতীয় খণ্ডের গল্পগুলিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়।
সমাজ, পরিবার, রাজনীতি, দেশ কাল সচেতন গল্পঃ
গল্প গুলিতে ঊনবিংশ শতাব্দীর জটিল সমাজ চিত্র, অত্যাধুনিক ব্যক্তিমনের বিকৃতি, রাজনীতির ক্ষেত্রে বাঙালির স্থান ইত্যাদির সাথে সাথে দেখা দিয়েছে ব্যক্তিত্বসম্পন্না নারী চরিত্রের প্রাধান্য। উদাহরণ স্বরূপ উল্লেখ করা যায়- মেঘ ও রৌদ্র, মান ভঞ্জন, বিচারক, উদ্ধার, ইত্যাদি গল্পগুলি।
এ খণ্ডে রবীন্দ্রনাথ ভাষারীতি ও বাক্য-গঠনভঙ্গি নিয়ে পরীক্ষা করেছেন। 'বিচারকের' আগে পর্যন্ত গল্পে দেশজ ভাষা, তৎসম শব্দ এবং বাক্যের মধ্যে পেলবতা রক্ষা করে আসছিলেন, কিন্তু 'বিচারক' থেকে তাঁর ভাষারীতির রূপ পালটে যায়। সমাসবদ্ধ পদের আধিক্য এবং কথ্য ভাষাতেও দীর্ঘ শ্বাসযুক্ত সাধু ভঙ্গি নিয়ে আসেন। আবার ছোটছোট বাক্যদ্বারা সাধু ভাষাতেও কথ্যভঙ্গি দেখা যায়। যেমনঃ ডিটেকটিভ। প্রকৃতি এসেছে উপমা, রূপক, প্রতীক ইত্যাদির মাধ্যমে ব্যক্তির মানসিকতাকে সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করতে।
তৃতীয় ও চতুর্থ খন্ডে পরিণতমনস্ক গল্পকার –গল্প বলার চেয়ে সেগুলো নিয়ে নানান রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়েছেন। ফলে গল্পগুলি কারুময় রূপ নিয়েছে। তাছাড়া ‘সবুজপত্রের’যুগে লিখিত এসব গল্পে নবযুগের সুস্পষ্ট ছাপ লক্ষিত হয়। নারী চরিত্র এখানে ব্যক্তি-স্বতন্ত্রে সমুজ্জ্বল! সে মাতা নয়, জায়া নয়, প্রিয়াও নয় –সে নারী ! ‘হালদার গোষ্ঠী’, ‘স্ত্রীর পত্র’ ইত্যাদি এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য। এ ছাড়া কতকগুলো গল্প, রূপক ধর্মী। যেমন, ‘গুপ্তধন’।
রবীন্দ্রনাথ এখানে ভাষারীতি, আঙ্গিক ইত্যাদি পরিবর্তন করেছেন। এবং ব্যকরণ ঘটিত কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষাও চালিয়েছেন। যেমন বাক্যগুলি ছোট হয়ে এসেছে, কাহিনী বর্ণনায় রূপকথার ভঙ্গী চলে এসেছে। এখানেই তিনি প্রথম চলিত গদ্যের ব্যবহার করেছেন। উপমা প্রয়োগে ব্যক্তিত্বের আরোপ এসেছে। ক্রিয়ার স্থান পরিবর্তনও উল্লেখযোগ্য। যেমন, ‘উঠিল রেগে’, ‘রেগে উঠিল’ নয়। (ক্রিয়াকে আগে নিয়ে আসা)। এগুলো রবীন্দ্রনাথের বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
উপমা-অলংকারে রবীন্দ্রনাথের কিছু নিজস্ব সৃষ্টি রয়েছে। যেমন, ‘অনেক বোঝাই গরুর গাড়ির মতোই রামকানাইয়ের নিরুপায় অবস্থা’। অথবা ‘এ নির্বোধ সর্বকান্ডপন্ডকারী নবদ্বীপের বাবা’ ইত্যাদি—বাংলা সাহিত্যে অনবদ্য ও অসাধারণ সংযোজন !
রবীন্দ্র ছোটগল্পের এ সব অসাধারণত্বই একে বাঙালির স্থান-কাল-ঘেরা গন্ডিকে অতিক্রম করে বিশ্বের এবং চিরকালের মানুষের অন্তরের সম্পদ করে দিয়েছে !
0 comments: