মুক্তগদ্য : বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়
Posted in মুক্তগদ্য
মুক্তগদ্য
সাঁতার
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়
চারদিকে এত অস্থিরতা, ক্লান্ত দিনলিপি । সময় নেই অথচ সময় নষ্ট করতে হয় প্রচুর । চায়ের দোকানে বসে প্রিয় বন্ধুকেও গাল দিই রোজ দুবেলা । ভাত হজম হয় না কিছুতেই । কি যে করি খুঁজে পাই না । হজম তো করতেই হবে অতএব – মুখের ব্যায়াম । ভুঁড়ি বাড়তে থাকে দিনদিন । কাজ নেই । পরিশ্রম নেই । পরচর্চা ছাড়া আর কোন সাংস্কৃতিক অভ্যেস তৈরি হয়নি এতদিন । ডাক্তারের কাছে যাই । ওষুধ নয় পরামর্শ লিখে দেন – দুবেলা হাঁটুন নিয়ম করে । হাঁটতেও পারিনা । অল্পেই হাঁফিয়ে উঠি । অথচ মুখ কি অবিশ্রান্ত ছুটে চলে । ক্লান্তিহীন তার ব্যবহার ।
মেয়ে এসে একদিন বলে – আমাকে সাঁতার শেখাবে না বাবা ?
- সাঁতার । চমকে উঠি , কোথায় শিখবি ?
- কেন? পুকুরে....
- পুকুর কই ? চারদিকে তো ইট আর কংক্রিটের পাহাড় ।
অলসতা ঝেড়ে ফেলতে পারিনা কিছুতেই । পুকুর খুঁজতে খুঁজতে ডুব দিই আড্ডায় । কথারা কিলবিল করে বুকের ভেতর । ঝড় বয় । তুফান আসে । গড়তে পারিনা বলেই ভেঙে ফেলার সাধ তীব্র হয়ে আসে ।
- আমাদের গ্রামে গিয়ে মাসখানেক থেকে এলে হয় না ? ঠাম্মার শরীর খুব খারাপ, সাঁতারও শেখা হবে আর...
- আর ?
মায়ের ক্লান্ত অভিমান আমার বুকপকেটে । পুরানো বেলপাতার মত তা শুকিয়ে গেছে এতদিনে ।
মেয়ে চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে থাকে । আমার চোখের নীচে স্মৃতি । মনখারাপ । একমাস নয় ৪/৫ দিন থেকে আসাই যায় ।
- ঠিক আছে , তাই হোক । মেয়ে সম্মতি দেয় ।
পুকুরটা অবিকল তেমনই আছে । বদলায় নি । বরং আরও প্রসারিত হয়েছে তার হৃৎপিণ্ড । আমি জলের গভীরে হাত রাখি । ঠিক এইভাবে হাত পা ছুঁড়তে হবে এই ভাবে... মেয়েকে শেখাই সাঁতারপ্রণালী । জল কেটে কেটে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে না তার সাত বছরের হাত । ভাসনের সুত্র আর প্লবতার জটিল তত্ব বোঝাই । মাথা ভারি হয়ে আসে তার । তবু জল ভালোবাসে ডুব দেয় জলের নিবিড়ে । গ্রামও বদলে গেছে আজকাল । এখানেও আতঙ্ক আর আর্তনাদ । দিনেও বোমার শব্দ হয় । চমকে উঠি ।
মেয়ে ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছে পদ্মপাতার জলজ ভয় পেরিয়ে, মেছো মাকড়শার জাল ডিঙিয়ে আতঙ্ক অস্থিরতা টপকে ।
মেয়েকে ডাকি – দূরে যাস নে, আমার হাত ধরে থাক ।
- হাত ধরে থাকলে সাঁতার শিখব কি করে ?
- ভয় করছে না তোর ?
- না তো । ভয়কে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে না পারলে সাঁতারের কোন মজাই থাকে না ।
বুকের ভেতর বাতাসের বলয় । পায়ের নীচে নিজস্ব শক্ত ভূখণ্ড । মেয়েকে দেখতে দেখতে ভাবি – কেবল বাবাই মেয়েকে হাত ধরে রাস্তা হাঁটতে শেখায় না, মেয়েও কখনও কখনও মা হয়ে ওঠে ।
0 comments: