0

ছোটগল্প : মমতা দাস (ভট্টাচার্য)

Posted in




ছোটগল্প



পথের মা 
মমতা দাস (ভট্টাচার্য)




আমি আগে গড়িয়াহাট -এ গেলে প্রায়-ই একজন বুড়ো ভদ্রমহিলা এসে ধুপ কাঠি কেনার অনুরোধ করতেন। সুশ্রী চেহারা, মোটামুটি পরিস্কার পোশাক-আসাক। হাতে এক গোছা ধুপ কাঠি, কাঁধে একটা শান্তিনিকেতনী ঝোলা, তাতেও আরো কিছু ধুপকাঠির প্যাকেট রাখা আছে। বয়স হয়েছে, সামান্য কুঁজো হয়েছেন বয়সের ভারে, কাঁধে বেশি ভার বইতে পারেন না মনে হয়, তাই অল্প কয়েক প্যাকেট-ই রাখা থাকে ব্যাগে। আমি প্রতিবার-ই কয়েকটা প্যাকেট কিনতাম। ওনার অনুরোধ ফেলতে পারতামনা। মায়ের বয়সী একজন এভাবে জিনিস বিক্রি করছেন, নিশ্চয়-ই প্রয়োজনে। যে বয়সে মানুষ ঘরে বসে আরাম করতে ভালো বাসে, সেই বয়সে বাধ্য না হলে কেউ এভাবে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে জিনিস বেচে না। আমার খুব কৌতূহল হত ওনার কথা জানার, কিন্তু যদি কিছু মনে করেন ভেবে কিছু জিগ্গেস করে উঠতে পারতাম না। দু-একটা সাধারণ কথা-বার্তা বলে-ই কিনে নিয়ে চলে আসতাম।

সেবার খুব শীত পড়েছে। আমি বহু বছর দেরাদুন-এ কাটিয়েছি, কলকাতার ঠান্ডা গায়েই লাগে না, সেই শীতে আমার-ও যেন একটু একটু কাঁপন ধরে যাচ্ছে। গড়িয়াহাট গেছি একটু জরুরী কেনাকাটার জন্য, তাড়াতাড়ি করে কাজ সারছি, যাতে বাজারটা কোনরকমে সেরে, বাড়ির বন্ধ-ঘরের উষ্ণতায় ফিরতে পারি। হঠাৎ পাশ থেকে কে যেন বলে উঠলো।...." কি গো মেয়ে আজ আমাকে যে দেখতেই পাচ্ছনা! ধুপকাঠি নেবে না? "...তাকিয়ে দেখি উনি। মাথায় ঘোমটা, গায়ে একটা পাতলা মুগা চাদর, ঠান্ডায় যেন কাঁপছেন একটু একটু! 
আমি বললাম।..."মাসিমা, আপনি এই ঠান্ডাতেও বেরিয়েছেন?".... করুণ হাসির সঙ্গে জবাব এলো...."কি করব মা, ওনার অসুখ, ওষুধ-পথ্য , কিছু টাকা যে খুব দরকার।".......আমি বলতে গেলাম।...." তবু".....মনে হলো উনি বেশ কাঁপছেন, বললাম ....."চলুন মাসিমা , একটু চা খাই। এই ঠান্ডায় ভালো লাগবে"........উনি দেখি ইতস্তত করছেন, .....বললাম...... " আমি কিন্তু চা খাবই এখন, আমি তো আপনার মেয়ে, আমার সঙ্গে চা খেতে কি আপত্তি আছে আপনার"?........লজ্জা পেয়ে গেলেন,......" আরে না না , ভাবছিলাম"......."এত ভাবেনা , এই ঠান্ডায় চা নাখেলে জমে যাব এবার। চলুন,চলুন"...একরকম জোর করেই ওঁকে নিয়ে একটা সাধারণ রেস্তোরায় ঢুকে বসলাম। চা আর একটু খাবার অর্ডার দিয়ে বললাম..."এবার আপনার কথা বলুন মাসিমা। কে কে আছে আপনার, তারা কোথায় থাকে , আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে"...উত্তর না দিয়ে চুপ করে বসে রইলেন নিজের হাতের দিকে চেয়ে। ভাবলাম 'হয়ত কেউ নেই, মনটা খারাপ হয়ে গেল বোধ হয়'...বললাম আপনার ইচ্ছা না হলে বলবেন না। আমি কি করব সে খবর নিয়ে? আমি তো গল্প করার জন্য এমনি জিগ্গেস করছি।"...থতমত খেয়ে বললেন, " না না তাতে কি হয়েছে? তোমার সঙ্গে কতদিনের আলাপ, আদর করে মাসিমা ডাক, চা খাওয়াতে এনেছ, এটুকু তো জানতে চাইতেই পার, আমি ভাবছিলাম কি বলব? এ কি বলার মত কথা? তবে তোমাকে বলা যায়।".

তারপর যা শুনলাম, যেমন আশ্চর্যের তেমনি দু:খের। মাসিমার তিন ছেলে, এক মেয়ে। সবার অবস্থা ভালো, বড় চাকরি করে। অর্থের অভাব নেই। ছেলেরা একজন ডাক্তার, একজন ব্যারিস্টার, একজন ইঞ্জিনীয়ার। মেয়ে স্কুল -এর প্রিন্সিপাল, তার স্বামী কলেজের প্রফেসর, মেশোমশাই নিজেও স্কুল-এ পড়াতেন , তখন মাইনে তেমন কিছু ছিলনা, তার উপর ছেলে-মেয়ের পড়ার যাতে অসুবিধা না হয় ভেবে ওদের পিছনে অনেক খরচ করেছেন, ওরা লেখা-পড়ায় সবাই ভালোছিলো , মাস্টার রাখতে হয় নি, তবু চার জনের পড়ার তো একটা খরচ আছেই সেসব করে, ছোট্ট একটা বাড়ি করতে পেরেছেন মাত্র, টাকা জমাতে পারেন নি, পেনশন-ও নেই তাই... আমি শুনতে শুনতে স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছিলাম, গরম চায়ে চুমুক দিয়ে, গলাটা ঝেড়ে, সঙ্কোচের সঙ্গে জিগ্গেস করলাম, " ওরা কিছু বলে না আপনি এভাবে ধুপকাঠি বিক্রি করেন? হেসে উঠলেন, "ওদের সময় কোথায় আমাদের নিয়ে ভাবে?" "মানে, ওরা......." " না না দেখেনা, ".....শক্ত গলায় বলেন। " ওরা কোথায় থাকে"?......আমি আরো সঙ্কুচিত,......."তাদের সব প্রাসাদ, বাড়ি-গাড়ি, বৃদ্ধ মা-বাবাকে সেখানে রাখার জায়গা হয়না"........আমি বলি....."টাকা-পয়সা",কথা শেষ হয় না, মাসিমা হেসে ওঠেন,....."ওদের নিজেদের-ই অভাব ঘোচে না, সারা বছর নাই নাই, মা রে, যার যত আছে, তার তত অভাব"........একটু থেমে যোগ করেন, ......"আমরা দুটো বুড়ো -বুড়ি, কি-ই বা খরচ, তাও মাথার উপর ছাদ আছে, ওই আমার রোজগারে হয়ে যায়"........." আর মেশোমশাই?".......আমি বলি, ......."উনি অসুস্থ, বয়স হয়েছে। আগে ঘরে বসে, ছাত্র পড়িয়ে যা পেতেন , আমাদের স্বচ্ছন্দে চলে যেত দুটো প্রাণীর। নাম করা মাস্টার ছিলেন উনি, ছাত্রের অভাব হয় নি কখনো। ওর অসুখের পর থেকেই একটু মুশকিল হয়েছে। আমি তো জলে পড়ে গেছিলাম একেবারে , শেষে ওনার পুরনো ছাত্রী, পাড়ার একজন বউ, এই ব্যবস্থা করে দিল, তাই বেঁচেছি। ভিক্ষে করতে হচ্ছে না। "......কথা শেষ করে , মুখটা ঘুরিয়ে নেন ...."চোখে যেন কি একটা পড়ল, "....বলে রুমাল চাপা দিলেন চোখে।

আমি জানি কি পড়েছে চোখে, অপদার্থ সন্তানের মা হওয়ার লজ্জা, দু:খ, হতাশা সব চারদিক থেকে ঢুকে পড়েছে মাসিমার চোখে, সম্মানিত মাস্টারের স্ত্রী, পথে পথে ধুপকাঠি বেচে বেড়াচ্ছেন গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য, এ কি আমদের দেশের, দশের লজ্জা নয়? কেন সমাজ কোনো দায়িত্ব নেবে না? যে সন্তানদের জন্য ওনারা কত ত্যাগ, কত কষ্ট স্বীকার করেছেন, কেন বাধ্য করা যাবে না সেই সন্তানদের, এদেরকে দেখার জন্য? এত আমার, আপনার সকলের লজ্জা, এই লজ্জা আমরা রাখব কোথায়? 

মাসিমার দিকে আমি তাকাতে পারছিলাম না, মাথা নীচু করে বসে রইলাম। মার সামনে সফল তিন চার সন্তানের জননী হাপুস নয়নে কেঁদে চলেছেন 'পথের মা'-এর মত। আর সমাজের বিভিন্ন বড় বড় পেশায় যুক্ত অমানুষ ছেলে-মেয়েদের কথা ভাবছেন বোধ হয়........ হায় রে সন্তান, হায়রে সমাজ !!

0 comments: