প্রচ্ছদ নিবন্ধ
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা সাহিত্যের
তিন বন্দ্যোপাধ্যায় : জীবন ও সাহিত্য
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়
নিবন্ধটির শিরোনামের যাথার্থ্য সম্পর্কে পাঠকের প্রশ্ন থাকতে পারে, কেননা এই নিবন্ধে যে তিনজনের জীবন ও সাহিত্যভাবনার সূত্রগুলি বুঝতে চেয়েছি, তাদের সকলেরই প্রতিষ্ঠা স্বাধীনতার অনেক আগেই। বলা ভালো এই তিন বন্দ্যোপাধ্যায় – বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর ও মাণিক ১৯৩০ পরবর্তী বাংলা কথা সাহিত্যের অগ্রপুরুষ। তবু এমন শিরোনামের কারণ স্বাধীনতা পরবর্তী প্রজন্মের বাংলা কথা-সাহিত্যের কাছে আসা, তাদের পাঠাভ্যাসের নির্মাণ এদের সাহিত্য ঘিরেই। রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ ১৯৪১এ, শরৎচন্দ্রও চলে গেছেন স্বাধীনতার নয় বৎসর আগেই। ততদিনে প্রবল আবির্ভাব হয়েছে বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের।
কর্মজীবনের প্রায় সবটাই স্কুলশিক্ষকতা করা বিভূতিভূষণ তাঁর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তি ‘পথের পাচালি’ লিখলেন ১৯২৯এ। তার দু বছর পরে তারাশঙ্কর তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘চৈতালী ঘুর্ণি’ লিখলেন ১৯৩১এ কারান্তরালে বসে, আর প্রায় একই সময়ে, ১৯২৮এ মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম গল্প ‘অতসী মামী’ আলোড়ন তুলেছে বাংলা সাহিত্য অনুরাগী মহলে। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রের পর বাংলা সাহিত্যে যথার্থ উপন্যাস পাওয়া গেলো বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালি’ তে। স্বাধীনতা-উত্তর প্রথম প্রজন্মের আমরা কথাসাহিত্য পাঠ শুরু করলাম এদের দিয়েই।
বিভূতিভূষণের জন্ম হালিশহরের মুরারিপুকুর গ্রামে তাঁর মাতুলালয়ে ১৮৯৪এর ১২ই সেপ্টেম্বর। পিতা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতা মৃণালিনী দেবী। বনগ্রাম হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলকাতার রিপন কলেজ (এখন সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) থেকে স্নাতক হন। ১৯১৮য় ২৪ বছর বয়সে বিবাহ হয় শ্রীমতী গৌরী দেবীর সঙ্গে। মাত্র একবছর পরে গৌরী দেবীর অকাল বিয়োগ হয়। গৌরীর অকাল বিয়োগ তাঁর মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছিল। তারপর দীর্ঘ চব্বিশ বছর বিপত্নিক জীবন যাপনের পর সাতচল্লিশ বছর বয়সে পুনর্বিবাহ করেন শ্রীমতী রমাকে। তার শেষজীবনের নিবাস শাল-পিয়ালের জঙ্গল ঘেরা ঘাটশিলার বাসভবনটি উৎসর্গ করেছিলেন প্রথমা পত্নীকে ‘গৌরীকুঞ্জ’ নামকরণ করে। নিজের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা আরণ্যকও উৎসর্গ করেছিলেন গৌরী দেবীর স্মৃতিতে।
বিভূতিভূষণের সাহিত্যজীবন মাত্র একুশ বছরের। ১৯২১শে প্রবাসী পত্রিকায় ‘উপেক্ষিতা’নামে একটি গল্প প্রকাশের মধ্য দিয়ে তাঁর সাহিত্যজীবনের সূচনা। ১৯২৫এ শুরু করেন তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি ‘পথের পাচালি’র রচনা, তখন তিনি ভাগলপুরে কর্মরত। শেষ রচনা, উপন্যাস ‘দম্পতি’ তাঁর মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয় ১৯৫২তে। একুশ বছরের নাতিদীর্ঘ সাহিত্যজীবনে বিভূতিভূষণের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখা ৫৪টি যার মধ্যে ১০টি উপন্যাস, ২৫টি গল্পসংকলন, ও ৬টি কিশোরপাঠ্য রচনা। এছাড়াও ভ্রমণ কাহিনী, দিনলিপি ও অন্য রচনার সংখ্যা ১৩টি। অপু-কাহিনী ‘পথের পাঁচালি’ বিভূতিভূষণের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি, সংশয় নেই। এর পরেই রাখতে হবে তাঁর অনন্য সৃষ্টি ‘আরণ্যক’ (১৯৪৫)কে। প্রকৃতি প্রেমি বিভূতিভূষণ অরণ্যক লেখার পরিকল্পনা করেছিলেন ভাগলপুরে কর্মরত থাকাকালীন। ‘স্মৃতির রেখা’ দিনলিপিতে ১৯২৮এর ১২ই ফেব্রুয়ারি লিখেছিলেন – “এই জঙ্গলের জীবন নিয়ে একটা কিছু লিখবো - একটা কঠিন শৌর্যপূর্ণ, গতিশীল, ব্রাত্য জীবনের ছবি। এই বন, নির্জনতা, ঘোড়ায় চড়া, পথ হারানো অন্ধকার - এই নির্জনে জঙ্গলের মধ্যে খুপরি বেঁধে থাকা। মাঝে মাঝে, যেমন আজ গভীর বনের নির্জনতা ভেদ করে যে শুড়ি পথটা ভিটে-টোলার বাথানের দিকে চলে গিয়েছে দেখা গেল, ঐ রকম শুড়ি পথ এক বাথান থেকে আর এক বাথানে যাচ্চে - পথ হারানো, রাত্রের অন্ধকারে জঙ্গলের মধ্যে ঘোড়া করে ঘোরা, এদেশের লোকের দারিদ্র, সরলতা, এই virile, active life, এই সন্ধ্যায় অন্ধকারে ভরা গভীর বন ঝাউবনের ছবি এই সব।...”
আরণ্যক উপন্যাসটির বিরাট একটি অংশ জুড়ে আছে প্রকৃতি। তাঁর অন্যান্য উপন্যাস থেকে এর স্বাতন্ত্র্য একাধিক। অন্য উপন্যাসগুলোতে প্রায় বাংলার শান্ত মধুর প্রাকৃতির রূপই স্থান পেয়েছে। ‘আরণ্যক’ পূর্ণিয়া ভাগলপুরের এক গভীর অরণ্য প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছে এক অপরিচিত অরণ্য সমাজের খণ্ড খণ্ড জীবন চিত্র, বাস্তব ও কল্পনার মিশ্রণে সে জীবন শুধু অপূর্বই নয়, রহস্যময়ও বটে। প্রকৃতির সঙ্গে মানব মনের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক বিধৃত হয়েছে ‘আরণ্যক’ উপন্যাসে।
‘পথের পাঁচালি’, অপরাজিত, আরণ্যক ছাড়া বিভূতিভূষণের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য রচনা হ’ল – ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ (১৯৪০), ‘অভিযাত্রিক’ (ভ্রমণ/১৯৪০) ‘অনুবর্তন’ (১৯৪২), ‘দৃষ্টি প্রদীপ’ (১৯৪২), দেবযান’(১৯৫১), ‘কেদার রাজা’(১৯৪৫), ‘চাঁদের পাহাড়’ (কিশোর উপন্যাস / ১৯৪৮), ‘ইছামতী’(১৯৫০), ও ‘অশনি সংকেত’।
গত শতকের ত্রিশের দশকে ‘কল্লোল’ ও ‘কালিকম’ গোষ্ঠী বাংলা সাহিত্যে নতুনতর ভাবনার সূত্রপাত করেছিল। তারাশঙ্কর, মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র প্রমুখের সাহিত্যভাবনার প্রস্তুতি । বিভূতিভূষণ সযত্নে কল্লোল, কালিকলমের ভুমিকা থেকে দূরে থাকলেন। তিনি রসদ সংগ্রহ করলেন তারা-ভরা আকাশ, দিগন্ত-বিস্তৃত সবুজ, মেঘ, জ্যোৎস্না অন্ধকারের রহস্য আর অরণ্যের আহ্বান থেকে। মানুষকে তিনি দেখেন তার জটিলতাহীন এক অসহায় মূর্তিতে। যৌবনের চাঞ্চল্য,উচ্চাশার সংঘাত, সমাজবন্ধনের জটিলতা তিনি পাশে সরিয়ে রেখে মানুষের রূপমূর্তিটি ধরতে চেয়েছেন। এইজন্য একদিকে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সুনিবিড় আত্মীয়তা, প্রকৃতির কোলে মানুষের চির অসহায় বন্ধন; অপরদিকে মানুষের জীবনযাত্রার করুণ ও বেদনাময় জগতের ছবি আশ্চর্য নিপুনতায় এঁকেছেন বিভূতিভূষণ। পল্লীবাংলার অনাড়ম্বর জীবন ও গ্রাম্য প্রকৃতির স্নেহনিবিড় স্পর্শ তাঁর সাহিত্য সৃজনে। সাহিত্য ও জীবনের নিবিড় নৈকট্য বিভূতিভূষণে।
গ্রামীণ বাংলার জীবন-ছবি তারাশঙ্করেও আছে। বিভূতিভূষণ যখন ভাগলপুরে পথের পাঁচালি লিখছেন, তারাশঙ্কর তখন জাতীয় কংগ্রেসে গান্ধীবাদে বিশ্বাসী অসহযোগ আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। অসহযোগ আন্দোলনে ধৃত তারাশঙ্কর তাঁর ‘চৈতালী ঘূর্ণী’ লিখলেন কারান্তরালে বসে।
স্বল্পায়ু বিভতিভূষণ চলে যান ১৯৫০এ (১লা নভেম্বর)। আরও স্বল্পায়ু মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ও চলে যান ৪৮ বছর বয়সে। তারাশঙ্কর ছিলেন আরও বেশ কিছুদিন – মধ্য একাত্তর পর্যন্ত। সুতরাং, স্বাধীনতা-উত্তর কালে আমাদের সমাজের অনেক ভাঙ্গা-গড়া প্রত্যক্ষ করেছেন, দেখেছেন বাংলা ভাষা ভিত্তিক এক নতুন রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্খা ও প্রস্তুতিও।
রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদ প্রার্থী হয়ে তারাশঙ্কর গিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে। কবির সঙ্গে তাঁর আলাপের কিছু অংশ এইরকম –
রবীন্দ্রনাথ প্রশ্ন শুরু করলেন “কি করো?
বললাম – করার মত কিছুতেই মন লাগেনি। চাকরীতেও না, বিষয় কাজেও না ; কিছুদিন দেশের কাজ করেছি। কিছুদিন দেশ সেবা করেছি।
অর্থাৎ জেল খেটেছো?
হ্যাঁ
ও পাক থেকে ছাড়ান পেয়েছো?
জানি না, তবে এখন ভাবি পেয়েছি।
সেইটে সত্য হোক। তা হ’লে তোমার হবে। তুমি দেখেছো অনেক। এত দেখলে কি করে?
কিছুদিন সমাজ সেবার কাজ করেছি। আর কিছুদিন বিষয়-কর্ম করেছি। সামান্য জমিদারী আছে। ঐ দুই উপলক্ষে গাঁয়ে গাঁয়ে অনেক ঘুরেছি, লোকের সঙ্গে অনেক মিশেছি, কারবারও করেছি।
সেটা সত্য হয়েছে তোমার। তুমি গাঁয়ের কথা লিখেছ, খুব ঠিক লিখেছ। তোমার মত গাঁয়ের মানুষের কথা আগে আমি পড়িনি। ...তুমি দেখেছ। আমি তো দেখার সুযোগ পাইনি। তোমরা আমাকে দেখতে দাওনি। আমাদের তো পতিত করে রেখেছিলে তোমরা। ...দেখবে – দু চোখ ভরে দেখবে। দূরে দাঁড়িয়ে নয়। কাছে গিয়ে পাশে বসে তাদের একজন হয়ে যাবে। সে শক্তি ও শিক্ষা তোমার আছে”। ...[‘আমার সাহিত্য জীবন’ গ্রন্থ থেকে]।
কথোপকথনের এই ক’টি পংক্তিতেই আমরা বুঝতে পারি কথাশিল্পী তারাশঙ্করের সাহিত্যভাবনার মূল সূত্রগুলি। তাঁর ‘রাইকমল’ গল্পটি পড়ে রবীন্দ্রনাথ তাকে লিখেছিলেন - “গল্প লিখতে বসে যারা গল্প না লেখার ভাণ করে, তুমি যে তাদের দলে নাম লেখাওনি, এতেই আমি খুশি হয়েছি”।
জন্ম ১৮৯৮এর ২৩শে জুলাই বীরভুম জেলার লাভপুর গ্রামে। পিতা হরিদাশ বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতা প্রভাবতী দেবী। ১৯১৬তে লাভপুর থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাশ করে সাউথ সুবার্বন কলেজে (এখন যার নাম আশুতোষ কলেজ) ইন্টারমিডিয়েট পড়া শুরু করেন। কিন্তু বৃটিশ বিরোধী অসহযোগ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। রাজনৈতিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ার কারণে কলেজ শিক্ষা অসম্পূর্ণ থেকে যায় তারাশঙ্করের। ১৯২৯তে গান্ধীজির আহবানে অসহযোগ আন্দোলনে সক্রীয়ভাবে অংশগ্রণ করেন এবং গান্ধীবাদে বিশ্বাসী হয়ে কংগ্রেসের নিষ্ঠাবান কর্মী হয়ে ওঠেন। আইন অমান্য আন্দোলনে অংশ নিয়ে ১৯৩০এ কারারুদ্ধ হন কয়েক মাস। কারান্তরালে থাকাকালীন লেখেন তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘চৈতালী ঘূর্ণি’। কারাগারে থাকাকালীনই তখনকার কংগ্রেসী রাজনীতি সম্পর্কে তাঁর মোহভঙ্গ ঘটে। তাঁর নিজের কথায় “তখন জেলখানায় রাজনীতি-সর্বস্ব মানুষের চেহারা দেখে ভবিষৎ ভাবনায় শঙ্কিত হয়েছি; চিত্ত ভারাক্রান্ত হয়ে তখন রাজনীতির দিকে চিত্ত সম্পূর্ণ রূপে বিমুখ হয়েছে”। এই সময় থেকেই তারাশঙ্কর নিজেকে সম্পূর্ণ নিয়োজিত করলেন সাহিত্য কর্মে, মানবজীবনের বিশাল রূপ কথাসাহিত্যে ফুটিয়ে তোলাই তাঁর ব্রত হ’ল। মুমূর্ষু সামন্ততান্ত্রিক ব্যক্তি, জীবন ও সমাজ অপরূপ করুণা ও মমতায় চিত্রিত তাঁর কালজয়ী উপন্যাস ও গল্পগুলিতে। সামাজিক পরিবর্তনের বিভিন্ন চিত্র তাঁর অনেক গল্প ও উপন্যাসের বিষয়। যেখানে আছে গ্রাম জীবনের ভাঙ্গন ও উদীয়মান নগরজীবনের দ্বন্দ্ব।
বীরভুম অঞ্চলের অতি সাধারণ ও নিম্নবর্গের মানুষজন – বেদিয়া, বাজিকর, সাঁওতাল, আউল-বাউল, বৈষ্ণব, বাগদি, বাউড়ি, ডোম, গ্রাম্য কবিয়াল, তান্ত্রিক, প্রভৃতিদের দেখেছিলেন ঘনিষ্ঠভাবে। তাদের জীবনচিত্র এঁকেছেন ‘রাইকমল’, ‘কবি’, ‘ধাত্রীদেবতা’, ‘পঞ্চগ্রাম’, ‘গণদেবতা’, ‘হাসুলি বাঁকের উপকথা’, প্রভৃতি উপন্যাসে।
বিপুল তাঁর সাহিত্য সৃষ্টি। লিখেছেন ৬৫টি উপন্যাস, ৫৩টি গল্প সংকলন, ১২টি নাটক, ৪টি প্রবন্ধ সংগ্রহ, ৪টি আত্মজীবনী এবং ২টি ভ্রমণ কাহিনী। তারাশঙ্করের কালজয়ী লেখাগুলির কয়েকটি মাত্র – চৈতালী ঘুর্ণী (১৯৩১), নীলকন্ঠ (১৯৩৩), রাইকমল (১৯৩৪), জলসাঘর (১৯৩৭), আগুন (১৯৩৭), রসকলি (১৯৩৮), ধাত্রীদেবতা (১৯৩৯), কালিন্দী (১৯৪০), গণদেবতা (১৯৪২), কবি (১৯৪৪), পঞ্চগ্রাম (১৯৪৪), হারানো সুর (১৯৪৬), ডাকহরকরা (১৯৪৬), অভিযান (১০৪৬), হাসুলিবাঁকের উপকথা(১৯৫১), আরোগ্য নিকেতন (১৯৫৩), পঞ্চপুত্তলী (১৯৫৬), সপ্তপদী (১৯৫৭), ডাকহরকরা (১৯৫৮), রাধা (১৯৫৮)।
ধর্মশাস্ত্রের অবাধ অনুশীলন ও ইংরাজি শিক্ষার প্রভাবে তারাশঙ্করের মানস গঠিত হয়েছিল। ক্ষয়িষ্ণু জমিদার পরিবারের সন্তান হওয়ার সুবাদে তাঁর সামাজিক অভিজ্ঞতা, ভারতবোধ, অর্থনৈতিক সম্পর্কের জটিলতা, জমিদারতন্ত্রের অবক্ষয়, ও সমাজের নানান ভাঙা-গড়ার ছবি তাঁর উপন্যাস গল্পে।
স্বাধীনতা-উত্তর পর্বে ১৯৭১এ প্রয়াণ পর্যন্ত নিশ্চিতভাবেই তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রধান মুখ।
মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর উপন্যাস, গল্পে সমাজ বাস্তবতার ছবি লিখলেন এক নতুনতর আঙ্গিকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়কালে পৃথিবী জুড়ে মানবিকতা ও মূল্যবোধের চরম সংকট সময়ে বাংলা কথা সাহিত্যে নতুনতর ধারার সূচনা হয়েছিল যাঁদের লেখনিতে মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদেরই একজন।
জন্ম এখনকার ঝাড়খণ্ড রাজ্যের দুমকা শহরে। পৈত্রিক নিবাস ঢাকার বিক্রমপুরে। পিতা হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতা নীরদাসুন্দরী। পিতার ঢাকার সেটলমেন্ট বিভাগে কর্মের সুবাদে বাংলা ও বিহারের নানা স্থানে বদলি হতে হতো আর সেই সূত্রে মানিকের শৈশব, কৈশোর ও ছাত্রজীবন কেটেছে বাংলা ও বিহারের নানান স্থানে। কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউশনে স্কুল শিক্ষা শুরু করে কয়েক বছর টাঙ্গাইলে স্কুলে ভর্তি হন, সেখান থেকে আবার কাঁথির মডেল স্কুল হয়ে শেষ পর্যন্ত মেদিনীপুর জিলা স্কুল থেকে মেট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। কলেজ শিক্ষা সম্পূর্ণ না করে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন পুরোপুরি সাহিত্যসেবায়।
সাহিত্যজীবনের প্রথম পর্বে মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় ফ্রয়েডীয় দর্শনে প্রভাবিত হয়েছিলেন প্রথম পর্বের লেখাগুলিতে তার ছায়াপাত ঘটেছে। বাংলা ভাষাও সাহিত্যের প্রাজ্ঞ অধ্যাপক ভবতোষ দত্ত মন্তব্য করেছেন “ফ্রয়েডীয় মনস্তত্বকে তিনিই যথার্থ জীবনবোধের সঙ্গে যুক্ত করিয়া বাঙালি দরিদ্র, মধ্যবিত্ত এবং ধনী সমাজের নানা পরিপ্রেক্ষায় রূপদান করিয়াছেন। এই কারণে মাণিকের উপন্যাস বাস্তবধর্মী হইলেও সাময়িকতা দ্বারা খণ্ডিত নয়”। (ভারতকোষ – ৫ম খণ্ড)। পরবর্তী পর্যায়ে তিনি গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলে মার্কসবাদী জীবনদর্শনে।
শ্রমজীবি নীচুতলার মানুষ ও মধ্যবিত্ত মানুষের জীবন সংগ্রাম ছিল মার্ক্সীয় তত্ত্বে গভীরভাবে প্রভাবিত এই কথাসাহিত্যিকের লেখার বিষয়বস্তু। মাত্র ৪৮বছরের জীবনকাল ছিল মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। এই স্বল্পায়ু জীবনেই রচনা করেছেন বিয়াল্লিশটি উপন্যাস ও দুই শতাধিক ছোট গল্প। তাঁর উপন্যাস ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’, ‘দিবারাত্রির কাব্য’, ‘পদ্মানদীর মাঝি’, ‘প্রাগৈতিহাসিক’, ‘স্বাধীনতার স্বাদ’, ‘ছোট বকুলপুরের যাত্রী’(গল্প), প্রভৃতি বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। এবং একটি প্রবন্ধ সংকলন, একটি নাটক আর মৃত্যুর অনেক পরে প্রকাশিত হয় তাঁর একটি কাব্য সংকলন ‘মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা’। মানব জীবনযন্ত্রণার গভীরতর অনুভব আর নিচুতলার মানুষের মধ্যে জীবনের সত্য-প্রতীতির অন্বেষণ তাঁর সাহিত্য পরিক্রমায়। রাজনৈতিক সচেতনতা যে শিল্পের উৎকর্ষ হ্রাস পায় না, মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ও গল্পগুলি তারই নিদর্শন।
মাণিকের কবি পরিচয় আমরা জেনেছি তাঁর মৃত্যুর অনেক পরে। অথচ, কবি মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বয়স ঔপন্যাসিক মাণিক বন্দ্যোপাধায়ের মতই। জীবদ্দশায় কিছু কবিতা বিক্ষিপ্তভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। বহু কবিতাই আবদ্ধ ছিল তার রেখে যাওয়া দুটি খাতায়। একটি ১৯২৪ থেকে ১৯২৯ পর্যন্ত সময়কালে রচিত, আর একটি খাতায় ১৯৪৩ থেকে ১৯৫৩ পর্যন্ত সময়কালে রচিত কবিতা। মৃত্যুর ১৪বছর পরে সেই দুটি খাতা উদ্ধার করে ৬৪টি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয় তাঁর কাব্য সংকলন ‘মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা’। মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখে গিয়েছেন, “আমার বিজ্ঞানপ্রীতি, জাত-বৈজ্ঞানিকের কেন-ধর্মী জীবন জিজ্ঞাসা, ছাত্রবয়সেই লেখকের দায়িত্বকে অবিশ্বাস্য গুরুত্ব দিয়ে ছিনিমিনি লেখা থেকে বিরত থাকা প্রভৃতি কতগুলি লক্ষণে ছিল সুস্পষ্ট নির্দেশ যে সাধ করলে আমি কবি হতেও পারি; কিন্তু ঔপন্যাসিক হওয়াটাই আমার পক্ষে হবে উচিত ও স্বাভাবিক |”
মার্কসবাদী জীবনদর্শনে বিশ্বাসী মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় পার্টির সাংস্কৃতিক ফ্রন্টের সাংগঠনিক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন, যুক্ত হন ‘ফ্যাসি বিরোধী লেখক সঙ্ঘ’ ও প্রগতি লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘে’র সঙ্গে। ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য পদ গ্রহণ করেন ১৯৪৪এ। দারিদ্র ও অনটন ছিল তাঁর নিত্য সঙ্গী, যা ১৯৫০এর দশকে চরম আকার নেয়। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ আর্থিক সাহায্যের আবেদনে সাড়া দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় মাসিক ১০০টাকার পেনশন ভাতার ব্যবস্থা করেন ও চিকিৎসার জন্য এককালীন ১২০০টাকা মঞ্জুর করেন। ১৯৫৬র ৩রা ডিসেম্বর কলকাতার নীলরতন সরকার হাসপাতালে জীবনাবসান হয় রবীন্দ্রোত্তর কালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাশিল্পী মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাত্র ৪৮ বছর বয়সে।
স্বাধীনতা-উত্তর কালে বাংলাসাহিত্যের বিপুল বৈচিত্রে অনেক কালজয়ী উপন্যাসে বাঙালির সমাজ-জীবনের অনেক ওঠা-নামা, ভাঙ্গা-গড়ার ছবি লিখেছেন বনফুল, বিমল কর, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, সতীনাথ ভাদুড়ী, সমরেশ বসু, প্রমুখ। তথাপি ১৯৫০এর দশকের শেষ পর্যন্ত বিভূতিভূষণ-তারাশঙ্কর-মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় এই ত্রয়ীর কাজই ছিল বাংলাসাহিত্যের প্রধান মুখ হয়ে ওঠা।
[তথ্যসূত্র : ভারতকোষ (৫ম খণ্ড), ‘আমার সাহিত্যজীবন’ – তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘বিংশ শতাব্দীর বাংলা উপন্যাসে বাস্তব’ – সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় (বাংলা আকাডেমি পত্রিকা-১১), ‘ইতিকথা ও পরের কথা : মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাস্তববাদী শৈলী’ – মালিনী ভট্টাচার্য, বাংলা আকাডেমি পত্রিকা ১৩ ও কালোত্তীর্ণ শিল্পী তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মোহম্মদ আসাদ – দৈনিক সংগ্রাম, ঢাকা]
2 comments: