1

সম্পাদকীয়

Posted in


সম্পাদকীয়



পূর্ণ করে আপনাকে সে দেবে,
রসের ভারে তাই সে অবনত...

আজ ২১শে জুলাই, ২০১৬। প্রকাশিত হলো ঋতবাক ২য় বর্ষ, ২৪তম সংখ্যা। পূর্ণ হলো দ্বিতীয় বর্ষ অতিক্রমণ। এই দুই বৎসরের যাত্রাপথ যে পুরোটাই মসৃণ ছিল, তা নয়। উপল বন্ধুর পথে বার বার হোঁচট খেতে খেতে এগিয়ে চলা। বার বার ভুল, আবার ভুলের মধ্যে দিয়েই ঠিকটাকে চিনে নেওয়া। অনেক বন্ধু এসেছেন, সাথে চলেছেন। আবার ত্যাগও করেছেন অনেকেই। তবু চলা থামেনি। আজ সঙ্গে পেয়েছি এমন সব বিশিষ্ট বিদ্বদ্জনদের, সহযাত্রী বন্ধুদের, যে তাঁদের আন্তরিকতার পূর্ণ মর্যাদা দিতে সামনে এগিয়ে চলা ছাড়া আর কোনও পথ খোলা নেই। কৃতজ্ঞতা জানবেন সকলে। 

আগেও বহুবার বলেছি, আবারও বলছি, ঋতবাক ওয়েব ম্যাগাজিন নিয়ে অনেক স্বপ্ন, সে স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার দায়ও আমাদের-ই। বিগত কুড়ি বছরের ওয়েব ম্যাগাজিনের অগ্রগতির ইতিহাস আমাকে আশান্বিত করে। প্রাকৃতিক এবং সমাজতাত্ত্বিক কারণেই মানব সভ্যতা রক্ষার প্রয়োজনে একদিন অবশ্যম্ভাবীভাবেই প্রিন্টেড ম্যাগাজিনের তুলনায় ওয়েব ম্যাগাজিনগুলির প্রয়োজনীয়তা ও জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাবে। সে ভবিষ্যৎ বিশেষ দূরে নয়। আর সেদিন যাঁরা ইতিহাসের এই বিবর্তনের মূল্যায়ন করবেন, অনিবার্য ভাবেই ঋতবাক-এর নাম তাঁদের উল্লেখ করতেই হবে, আমি নিশ্চিত।

শ্রাবণের এই দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যা অনিবার্যভাবেই উৎসর্গীকৃত হলো সেই সে মহামানবটিকে স্মরণ করে, যাঁকে বাদ দিলে আজও বাঙালী অস্তিত্বসঙ্কটে বিব্রত বোধ করে। মৃত্যুতেও যেন তিনি বিজয়ী বীর... আসলে ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের বাইশে শ্রাবণ, দুপুর বারোটা দশ – সেদিন সেখানে পড়ে রয়ে গিয়েছিল তো শুধু সেই নশ্বর আধারটুকুই... বাকি সমস্তটাই কী আজ এই নিদারুণ অস্থিরতার সঙ্কট মুহূর্তেও প্রবল প্রাণপ্রাচুর্যে সর্বব্যাপী অস্তিমানতা নিয়ে বিরাজিত নয়? আজও তো তিনি বাঙালীর বিপন্নতার শেষ আশ্রয়। যুগ বদলেছে, বদলেছে প্রজন্ম, আর তার সাথে দৃষ্টিভঙ্গী এবং গ্রহণীয়তাও। অন্যভাবে আছেন, তবু আছেন – উত্তর আধুনিক কবির ভাষায় ‘ভিতর বাহিরে, অন্তরে অন্তরে...’ তাঁর আসন কোনও দিনই শূন্য হয়নি, যে পূর্ণ করতে হবে! 

এদিকে ঋতবাক সাহিত্যপত্রের যুগপৎ অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গ সজ্জার পরিবর্তনের ধারা অব্যাহত। এখন থেকে ব্লগের লেখা ফেসবুক, ট্যুইটর, গুগল প্লাস বা যেখানে খুশি শেয়ার করা যাবে সরাসরি লিঙ্কে ক্লিক করেই। মুদ্রণ সংখ্যার লেখা নির্বাচন পর্ব প্রায় শেষের পথে। গল্প প্রতিযোগিতায় অভূতপূর্ব সাড়া। ঋতবাক পাবলিকেশনেও বন্ধুদের বই ছাপার কাজ চলছে জোরকদমে। সবচেয়ে বড় খবর, ব্লগের উপদেষ্টামণ্ডলীকে সমৃদ্ধ করলেন স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ সুদিন চট্টোপাধ্যায় ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরাজী বিভাগীয় প্রধান চিন্ময় গুহ। ঋতবাক ঋদ্ধ হলো। 

আরও খবর, ঋতবাকের সর্বকালীন ইতিহাসে সম্ভবত জনপ্রিয়তম ধারাবাহিক ‘আমার বারুদবেলা’র প্রথম পর্ব শেষ হলো এই দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যাতেই। লেখক স্বপন দেবের কাছে অনুরোধ – দ্বিতীয় পর্বের ডালি নিয়ে ফিরে আসুন খুব শিগগিরি (জনান্তিকে জানিয়ে রাখি, লেখক চলেছেন সুদূর বিদেশে পৌত্র সন্দর্শনে – এ বড়ো অপ্রতিরোধ্য অমোঘ টান)। এই সংখ্যা থেকেই শুরু হলো রাজর্ষি পি দাসের ধারাবাহিক উপন্যাস ‘ফেরা’। 

ঋতবাকের নিয়মিত বিভাগগুলিও যথারীতি ভরে উঠেছে অজস্র ভালো লেখায়। এমনই নিরন্তর সহযোগিতা ও দীর্ঘ সহযাত্রার কামনায় সম্পৃক্ত হয়ে ঋতবাকের যাত্রাপথ উত্তরোত্তর মসৃণ হোক, এই প্রত্যাশাই রাখি।



শুভেচ্ছা নিরন্তর

সুস্মিতা বসু সিং

1 comments:

7

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - হিমাদ্রি মুখোপাধ্যায়

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ


বাইশে শ্রাবণ­­­
হিমাদ্রি মুখোপাধ্যায়



দিনানুদিনের আলপথ দিয়ে হেঁটে চলি আমরা। সে পথ কখনও সরল, কখনও বক্র---পথের শেষ কোথায়, তা কেউ জানি না, জানার প্রয়োজনও হয়তো নেই। তবে অবিশ্রাম এই পথ চলার মাঝে কোনও কোনও দিন আসে আমাদের, যাকে বলা যায় "তুমি কিছু দিয়ে যাও মোর প্রাণে/গোপনে", অথবা যার দিকে আর্ত দুচোখ মেলে আমরা বলে থাকি---"বড়ো বেদনার মতো বেজেছ তুমি হে"...এরকম-ই এক দিনের নাম হয়তো বাইশে শ্রাবণ। পথিক আমরা, এমনি এক বরিষণ মুখরিত শ্রাবণ দিনে আমাদের পান্থজনের সখা চলে গিয়েছিলেন।

১৯৬১ সাল। রবীন্দ্র-জন্মশতবর্ষ। সত্যজিৎ রায় নির্মাণ করলেন কালোত্তীর্ণ এক তথ্যচিত্র। রবীন্দ্রনাথ। ছবির শুরুতেই ফ্রেমে ধরা পড়লো, কলকাতার রাজপথে লক্ষ মানুষ চলেছে এক দীর্ঘ শবযাত্রায়। অন্তরাল থেকে গমগম করে উঠলো সত্যজিতের ধীরোদাত্ত কণ্ঠস্বর--"অন দ্য সেভেন্থ অফ অগাস্ট, নাইনটিন হান্ড্রেড এন্ড ফর্টিওয়ান, ইন দ্য সিটি অব ক্যালকাটা, এ ম্যান ডায়েড"---উনিশশো একচল্লিশ সালের সাতই আগস্ট, কলকাতা শহরে একটি মানুষ মারা যান। একটি মানুষ মাত্র, একবারও তিনি উচ্চারণ করেন না তার নাম, কেননা তিনি জানেন মানুষের মৃত্যু হয়, রবিঠাকুরের মৃত্যু হয় না কোনওদিন। শবযাত্রার অন্তরাল থেকে তখনও অবিশ্রাম তিনি বলে চলেছেন ইংরেজিতে---তাঁর নশ্বর শরীর ভষ্মীভূত হবে সত্য, কিন্তু যে উত্তরাধিকার তিনি রেখে গেলেন তাঁর গদ্যে, কবিতায়, নাটকে, গানে, ছবিতে-- কোনও অগ্নি কোনওদিন তাকে দগ্ধ করতে সমর্থ হবে না।

১৩৪৮ বঙ্গাব্দের বাইশে শ্রাবণ, দুপুর বারোটা দশ। দাবানলের মতো খবর ছড়িয়ে পড়লো দেশের প্রতিটি প্রান্তে--রবি অস্তমিত। অবিশ্বাস্য, অসম্ভব কোনও সংবাদ যেন। বিরামবিহীন বৃষ্টি, তার-ই মধ্যে উদভ্রান্ত কলকাতা শহর সেদিন নেমে এলো রাস্তায়। পাগলের মতো নজরুল ছুটছেন বেতার কেন্দ্রে, বিশাল মই আর ফটো তোলার সরঞ্জাম নিয়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র চলেছেন নিমতলার দিকে। লোকারণ্য রাজপথ, তিনি এগুতে পারছেন না, তবু পৌঁছতে তো তাঁকে হবেই--তিনি ছাড়া কে দিতে পারে মহত্তম এই সৎকারের ধারাবিবরণী! সম্প্রচার করতে করতেই নজরুল লিখে চলেছেন একের পর এক এলিজি। আকাশবাণী থেকে দেশের প্রতিটি কোণায় কোণায় রেডিওতে ছড়িয়ে পড়ছে তাঁর শোকার্ত, বিহ্বল, মন্দ্রকণ্ঠ---"ভারতভাগ্য জ্বলিছে শ্মশানে, তব দেহ নয় হায়,/আজ বাংলার লক্ষ্মীশ্রীর সিঁদুর মুছিয়া যায়...

অভূতপূর্ব সেই মহাযাত্রার বিবরণ আজও হয়তো সংরক্ষিত আছে আকাশবাণীর আর্কাইভে, সংরক্ষিত আছে প্রত্যক্ষদর্শী কিছু অতিপ্রবীণ মানুষের স্মৃতিতে আর বঙ্গসাহিত্যের কিছু অবিস্মরণীয় লেখকের রচনায়। মৈত্রেয়ী দেবী, সন্তোষ কুমার ঘোষ আর বুদ্ধদেব বসুর লেখায় লিপিবদ্ধ আছে সেদিনের কিছু খণ্ড মুহূর্ত। তেমনি এক উদ্ভাসিত মুহূর্তের সাক্ষী হতে পারি আমরা সত্যেন আর স্বাতীর সঙ্গে বুদ্ধদেবের তিথিডোর উপন্যাসে---

"আসছে … আসছে …’ গুঞ্জন রব উঠলো ভিড়ের মধ্যে।

স্বাতী মনে-মনে ভাবছিলো লম্বা গম্ভীর আনত আচ্ছন্ন স্তব্ধ মন্থর মিছিল, কিন্তু মাত্রই কয়েকজন যেন অত্যন্ত তাড়াহুড়ো করে নিয়ে এলো কাঁধে করে – নিয়ে গেলো উত্তর থেকে দক্ষিণে – পিছনে এলোমেলো লোক – বিদ্যুতের ঝিলিক দিলো লম্বা শাদা চুল আর মস্ত শাদা শান্ত তন্ময় কপাল। ঐটুকু দেখলো স্বাতী, আর দেখতে পেলো না।

সত্যেন দেখলো, স্বাতী দাঁড়িয়ে আছে শক্ত সোজা হয়ে, হাত মুঠ করে, ঠোঁটে ঠোঁট চাপা, দেখলো তার কন্ঠের কাঁপুনি, ঠোঁটের কাঁপুনি, গালের ঘন রঙ, দেখলো তার তরল কালো উজ্জ্বল চোখ দুটি আরো উজ্জ্বল হলো, ঝকখকে দুটি আয়না হয়ে উঠলো, তারপর ভাঙলো আয়না, আবার তরল হলো, উপচালো, মাথা নিচু হলো।

আর তা-ই দেখে সত্যেনের নতুন করে গলা আটকালো, চোখ ঝাপসালো, আর সেজন্য লজ্জা করলো নিজের কাছেই। এ মৃত্যু তো কান্না চায়না, এই দুঃখ মহান, মহামূল্য দুঃখ, আশি বছরের পরম পরিশ্রমের এই সবশেষের রত্ন – এ কি চোখের জলে বাজে খরচ করবার?"

মহার্ঘ বেদনার এই সম্পন্ন উত্তরাধিকার, যা হয়ে ওঠার কথা ছিলো আমাদের মতো উত্তরসাধকদের কাছে এক বহুমূল্য দীক্ষা, আজ তাঁর মৃত্যুর পঁচাত্তর বছর পরে, তার পরিণাম দেখে বড়ো শঙ্কা জাগে। অনুভব করি বড়ো মর্মান্তিক ঋতকথন ছিল বিষ্ণু দের সেই মর্মান্তিক কবিতা--

"কালবৈশাখীর তীব্র অতৃপ্ত প্রতিভা 
বাদলের প্রবল প্লাবন--
সবই শুধু বৎসরান্তে একদিনে নির্গত নি:শেষ? 
অপঠিত, নির্মনন, 
নেই আর কোনো আবেদন!!"...
তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ 
আর বাইশে শ্রাবণ?"

আজ বড়ো দরিদ্র হয়ে পড়েছি আমরা, উত্তরাধিকারহীন, আত্মপরিচয়হীন, "আপন সত্তার থেকে পলাতক", "নিত্য রুচিক্ষয়ে ক্ষয়ে অসুন্দর"। আমাদের এই "গড্ডল ধুলার অন্যায়ে কুৎসিতে" "সেই সাবিত্রীর ক্ষিপ্র কর বিভা" প্রতিদিন আজ ম্রিয়মান। অথচ, এমন হওয়ার কিন্তু কোনও কথা ছিল না। ব্যাস-বাল্মীকি-কালিদাসের সম্পন্ন উত্তরাধিকার আছে আমাদের, আজ থেকে পঁচাত্তর বছর আগেও তিনি বেঁচে ছিলেন শারীরিক ভাবে, সেই তিনি যিনি আমাদের পরম সৌভাগ্যবশত এই হতশ্রী দেশে জন্মগ্রহণ করে একটি দেশকে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন শীলিত রুচি, অনম্য আভিজাত্য আর গরিমাময় এক সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক অহংকার। অথচ, দুর্ভাগ্য এই যে তাঁকে আমরা আত্মস্থ করতে পারলাম না। চৈত্রের শালবনের নিভৃতিতে আমার তাঁকে খুঁজলাম না। যিনি আমাদের প্রতিষ্ঠা হতে পারতেন, তাঁকে নিয়ে আমরা প্রতিষ্ঠান বানালাম। তাঁর আলো আর আকাশ, যা হতে পারতো আমাদের পরিত্রাণ ও মুক্তি, তার বদলে আমরা তাঁর মূর্তি বানালাম, উৎসব করলাম, কিন্তু আমাদের অন্তরে পরিগ্রহণ করলাম না। জীবন যে আসলে কীভাবে যাপন করতে হয়, সব পৃথুলতাকে অতিক্রম করে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে কীভাবে পুণ্য করতে, হয়, ধন্য করতে হয়, আলোকশিখা করে তুলতে হয় দেবালয়ের--জীবনের সেই মহার্ঘ পাঠটি-ই তাঁর কাছ থেকে গ্রহণ করা হলো না আমাদের।

আজও বাইশে শ্রাবণ আসে, এবারেও আসবে, যেমন আসে প্রতিবার। হয়তো শ্রাবণের ঘনকৃষ্ণ মেঘ সেদিন পুঞ্জিত হয়ে থাকবে আকাশে। সেদিন যেন আমরা স্মরণে রাখতে পারি তাঁর গান--"এই শ্রাবণের বুকের ভিতর আগুন আছে"; আমরা যেন ভুলে না যাই মেঘ নয়, বৃষ্টিও নয়, মেঘের ভিতরে নিহিত সেই জ্বলদর্চি শিখাটির নাম আসলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেদিন নতজানু হয়ে আমরা যেন প্রার্থনা করতে পারি---

"তোমার আকাশ দাও কবি, 
দাও দীর্ঘ আশি বছরের 
আমাদের ক্ষীয়মান মানসে ছড়াও 
সূর্যোদয় সূর্যাস্তের আশি বছরের আলো…” 

প্রার্থনা করি, বাইশে শ্রাবণোত্তর আমাদের দিনগুলি জ্যোতির্ময় হোক, প্রার্থনা করি, গানে গানে আমাদের সব বন্ধন ঘুচে যাক্।


7 comments:

1

প্রবন্ধ - শিবাংশু দে

Posted in


প্রবন্ধ


আমি যে গান গাই, জানিনে সে...
শিবাংশু দে



বাইশে শ্রাবণের দিন তিনি প্রয়াত হয়েছিলেন। রোগতপ্ত শরীরের মায়া কাটিয়ে মিশে গিয়েছিলেন ধরিত্রীর অনুপুঙ্খ আশ্রয়ের মধ্যে। কিন্তু মানুষ এখনও কাঁদছে। কেন? কে জানে? সে ব্যাসদেবও নেই, নেই নহুষ রাজাও। শুধু অন্তহীন বিস্ময়পর্বে গ্রস্ত হয়ে আছে সহস্র ভক্তজন। এইদিনে তাঁকে স্মরণ মানে বাইশে শ্রাবণের কিছু ছাপমারা গান। " জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে", " আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু", "অশ্রুনদীর সুদূর পারে", "আমার যেদিন ভেসে গেছে"। মাসটাও শ্রাবণ, তাই বর্ষার জলে অশ্রুর অনুষঙ্গ। এক বাইশে শ্রাবণের অনুষ্ঠানে গেয়েছিলুম প্রিয় গান, "কিছু বলবো বলে এসেছিলেম।" গুণে গুণে আটজন প্রশ্ন করেছিলেন এই গানটি 'বাইশে শ্রাবণে'র 'মাহাত্ম্য'কে সঠিক ধারণ করতে পারে কি না? কবি'কে শোকের আধারে বেঁধে রাখতে উৎসুক শ্রোতা বোধ হয় সংখ্যায় অধিক। প্রেমের প্রশ্রয়ে জাগিয়ে রাখার জন্য মনস্ক, সচেতন শ্রোতারা কী আর প্রস্তুত হবেন? কোনওদিন? জানিনা। অধুনা প্রজন্ম থেকে রবীন্দ্রনাথ ক্রমশঃ দূরে চলে যাচ্ছেন।

আমাদের সন্তানদের প্রজন্মে কবি'র গান সম্ভবতঃ তাৎপর্য হারিয়েছে। কারণ আমাদের প্রজন্ম তাঁর গান অনন্ত, অনর্গল শুধু 'শুনে' গেছি। প্রস্তুতিহীন আলস্যে ধরে রাখতে পারিনি। নিজেদের অক্ষমতায় পরবর্তী প্রজন্মের কাছে এই অমূল্য উত্তরাধিকারটির মর্যাদা ধূসর করে ফেলেছি। দিনের পর দিন। তবু আমাদের প্রজন্মের একজন হিসেবে আমি জানি, আমার মতো আরও অনেক অনেক শ্রোতার, বা বলা ভালো উত্তরাধিকারীর কাছে, রবীন্দ্রসঙ্গীত এখনও জীবনের চতুর্থ মাত্রা। সুরে, শব্দে, কাব্যে, চেতনায় বা সংক্ষেপে বলতে গেলে, পাতি বেঁচে থাকায়। তাই আমি এখন সময় পেলেই অধিকারীজনদের সঙ্গে রবীন্দ্রসঙ্গীতের বর্তমান আর ভবিষ্যৎ নিয়ে বিনিময় করি। কলকাতা বা শান্তিনিকেতনকে উৎস আকর মেনে নিয়ে এখানে এলেই বিষয়টি নিয়ে শিকড় থেকে পল্লবের খোঁজ করি। সময়ের উদ্বর্তনে মননের মধু নিয়ে সৃজনবধূরা স্বতস্ফূর্ত উঠে আসে। বিভিন্ন ঘরানার রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভিন্নতর অভিঘাত সমূহ আজকের শ্রোতার কাছে সে জন্যই বিস্ময়ের বিপন্ন স্রোত। অন্তত মনোযোগী শ্রোতার জন্য তো বটেই। প্রজন্মের ব্যবধানে গায়নের ধরণে ও শোনায় স্বতোৎসার অভ্যেস পাল্টায়। সে অভ্যেসেই শ্রোতারা ঠিক করে দেন, কীভাবে কবির গান গাইতে হবে। বিশ্বায়িত বাজারের পণ্য হিসেবে রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্থানটি কোথায় নির্দিষ্ট হবে? বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় বিবর্তিত গায়ন পদ্ধতি নিয়ে নানা কথা ওঠে। শুনতে পাই, সাহানাদেবীর গানের থেকে কাননদেবীর গানের পেশকারি অধিক উজ্জ্বল। আমিও এ বিষয়ে একমত। অথচ আমরা সচেতনভাবেই সাহানাদেবীর একান্ত অনুরাগী শ্রোতা। এমন কি কবি নিজেই যখন বলতেন, সাহানাদেবীর গলায় তাঁর গান পূর্ণ মর্যাদা পায়। কিন্তু রাইচাঁদ বড়াল বা পঙ্কজকুমার, কাননদেবীর গানের মধ্যে কোন অতিরিক্ত রসায়নটি যোজনা করতেন, যাতে তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীত অধিকাংশ শ্রোতার ভালো লাগতো? ওস্তাদের মার'টা কোথায়? কঠোর অনুসন্ধান করেও কিন্তু এই সব পরিবেশনার মধ্যে কোনও আপোস করার অভিপ্রেত পাইনি। অর্থাৎ কোনও ডায়লিউশন নেই। তাঁদের নিষ্ঠা, সচেতন শ্রোতার কাছে এখনও প্রাসঙ্গিক। ঠাকুরবাড়ির কুলুঙ্গি আর শান্তিনিকেতনের উপাসনাগৃহের বাইরে যে সংখ্যাগুরু শ্রোতার দল, তাঁদের জন্য পঙ্কজকুমার, সঙ্গে কুন্দনলাল যে রসটি পরিবেশন করতে পারতেন, দাবি অনুযায়ী অনেক বেশি উৎসমুখী, 'শুদ্ধ' ঘরানার শিল্পীরা সেটা পারতেন না। অথচ ইন্দিরাদেবী দেবব্রতকে আলাদা করে পথনির্দেশ দিতেন, একক গাইতে উৎসাহিত করতেন। এর সঙ্গেই শান্তিনিকেতনের ধারায় অন্যমাত্রার স্ফূর্ত গায়ন নিয়ে এসেছিলেন সুচিত্রা। ছয় থেকে আট দশকে একসঙ্গে এতজন সিদ্ধ শিল্পী রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনের মান'কে যে পর্যায়ে তুলে দিয়েছিলেন, সেটা ধরে রাখার চ্যালেঞ্জটি পরবর্তী শতকের শূন্য ও প্রথম দশকের গায়কদের নাগালের বাইরে চলে গেলো। একেবারে শীর্ষস্থানে থাকা পরিবেশকরাও 'গলাটা ভালো' জাতীয় মন্তব্যের সীমায় বাঁধা রয়ে গেলেন। তখন থেকেই সনিষ্ঠ, অনুরাগী শ্রোতাদের জন্য কবি'র হাতে পেনসিল ছাড়া বিশেষ কিছু বাঁচলো না। 

আসলে কিছু বিদগ্ধ মানুষ, হয়তো সদুদ্দেশ্যেই, কবির গানের 'পবিত্রতা' নিয়ে বড্ডো বেশি স্পর্শকাতর ছিলেন। তাঁরা নিজেদের সমর্থনে কবি'র নানা উক্তি'র স্বপ্রণোদিত ব্যাখ্যাও প্রস্তুত করতেন। এই জাতীয় জটিলতার উৎস ছিলো দীর্ঘ জীবনের নানা স্তরে করা কবি'র বহু স্ববিরোধী মন্তব্য। অনেকটা গীতা বা কুরাণের নানা স্ববিরোধী ঊদ্ধৃতি যেমন কায়েমিস্বার্থের মানুষেরা নিজেদের সুবিধেমতন ব্যবহার করেন, সেভাবেই। নিজের গান, বা বৃহদার্থে 'গান' সম্বন্ধে কবির ধারণা সারা জীবনে পাল্টে গেছে বারবার। নিজের বিষয়ে তিনি বলেছিলেন যে তাঁর 'গ্রেটেস্ট ভাইস' হলো 'ইনকনসিস্টেন্সি' আর তাঁর 'গ্রেটেস্ট ভার্চু'ও হলো ঐ 'ইনকনসিস্টেন্সি'। এই জায়গাটিতে আমাদের মতো ইতর মানুষেরা কবি'র সঙ্গে একাত্ম বোধ করতে শুরু করি। নিজের সম্বন্ধে তাঁর এই মূল্যায়ণ যে কত যথার্থ ছিলো তার প্রমাণ পেয়েছি বহুবার। যেমন ১৯১২ সালে 'জীবনস্মৃতি'র একটি অধ্যায় তিনি শুরু করেছিলেন এইভাবে, ''বাক্য যেখানে শেষ হইয়াছে সেইখানেই গানের প্রারম্ভ।'' তিনি লিখেছিলেন, ''সুর কেন কথার দাস হইবে'' অথবা ''...গীতকলার নিজেরই একটি বিশেষ প্রকৃতি ও বিশেষ কাজ আছে। গানে যখন কথা থাকে তখন কথার উচিত হয়না সেই সুযোগে গান'কে ছাড়াইয়া যাওয়া, সেখানে সে গানেরই বাহনমাত্র। গান নিজের ঐশ্বর্যেই বড়ো, বাক্যের দাসত্ব সে কেন করিতে যাইবে।'' এখানে 'গান' বলতে তিনি সুর'কেই সমার্থবোধ করছেন। সেই গ্রন্থেরই আরেক স্থানে তিনি একটি বিশেষ স্মৃতির উল্লেখ করে বলছেন, ''... সুর যে জায়গায় কথাটা উড়াইয়া লইয়া গেল, কথা আপনি সেখানে পায়ে হাঁটিয়া গিয়া পৌঁছিতে পারিত না।'' কিন্তু দিলীপকুমারের সঙ্গে তাঁর যখনই প্রাসঙ্গিক আলাপ হয়েছে তিনি আমাদের কালোয়াতি গানে সুরের ইম্প্রোভাইজেশন, যা'কে দিলীপকুমার নাম দিয়েছিলেন 'সুরবিহার', বিষয়ে নিজের দ্বিধা প্রকট করেছেন। ১৯১২ সালে তাঁর এ বিষয়ে ধারণা ১৯৩৮ সালে পাল্টে গেলো। তখন তিনি বলছেন (এ বিষয়ে) ''মত বদলিয়েছি। কতবার বদলিয়েছি তার ঠিক নেই।'' তিনি আরও জানাচ্ছেন, হিন্দুস্তানি কালোয়াতি গানের তিনি কদরদান, তার রস তিনি পূর্ণতঃ উপভোগ করেন। কিন্তু 'খাঁচার পাখি'র মতো শুধু বুলি আউড়ে গেলে কিন্তু সঙ্গীতে মুক্তি নেই। তিনি চাইছেন নতুন সৃষ্টি ও গণ্ডি ভেঙে নতুন জীবনের পথ। এই ধারণাটি তিনি গ্রহণ করেছেন আবহমান কালের বাংলা পদাবলীসঙ্গীত থেকে। যে শৈলিতে পদাবলী, গীতকলাকে সঙ্গিনী করে শিল্পকে জাগিয়ে তুলেছিলো। সুর যখন কথার সঙ্গিনী হয়ে উঠবে, তখনই এই যুগলবন্দি থেকেই সার্থক হয়ে উঠবে সঙ্গীত। এই বর্ণনাটি কিন্তু যথার্থ উপমা সহকারে তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন 'জীবনস্মৃতি'তে বহুকাল আগেই, ''.... আমাদের দেশে স্ত্রী যেমন স্বামীর অধীনতা স্বীকার করিয়াই স্বামীর উপর কর্তৃত্ব করিতে পারে, এ দেশে গানও তেমনি বাক্যের অনুবর্তন করিবার ভার লইয়া বাক্যকে ছাড়াইয়া যায়।'' ১৯৩৭ সালে তিনি ধূর্জটিপ্রসাদকে লিখেছিলেন , ''... কথাও সুরকে বেগ দেয়, সুরও কথাকে বেগ দেয়, উভয়ের মধ্যে আদানপ্রদানের স্বাভাবিক সম্বন্ধ আছে।'' ১৯২১ সালে বলেছিলেন, ''... সংগীতের মধ্যে বাণীর মিলন সাধনই এখন আমার প্রধান সাধনা হয়ে উঠেছে'' (আমাদের সংগীত)। এই সময়েই তিনি আরও লিখেছিলেন, ''...বাংলাদেশে কাব্যের সহযোগে সংগীতের যে বিকাশ হচ্ছে, সে এক অপরূপ জিনিস হয়ে উঠবে। তাতে রাগরাগিণীর বিশুদ্ধতা থাকবে না, যেমন কীর্তনে তা নেই; অর্থাৎ গানের জাত রক্ষা হবে না, নিয়মের স্খলন হতে থাকবে, কেননা তাকে বাণীর দাবি মেনে চলতে হবে। কিন্তু এমনতরো পরিণয়ে পরস্পরের মন জোগাবার জন্য উভয় পক্ষেরই নিজের জিদ কিছু কিছু না ছাড়লে মিলন সুন্দর হয় না।'' তারপর ১৯২৬ সালে তিনি দিলীপকুমারকে আবার লিখেছিলেন, ''...কীর্তনে বাঙালির গানে সঙ্গীত ও কাব্যের যে অর্ধনারীশ্বর মূর্তি, বাঙালির অন্য সাধারণ গানেও তাই।'' 

দিলীপকুমারের সঙ্গে তাঁর এই বার্তালাপ থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে রবীন্দ্রসঙ্গীতের মূল কাঠামোটি বিষয়ে কবির অবস্থান কী রকম। দিলীপকুমার চেয়েছিলেন তাঁর গানের ব্যক্তিত্বস্বরূপটি নির্মাণ করবেন গায়ক বা 'রূপকার', আমাদের কালোয়াতি গানের মতো। কিন্তু কবি জানতেন সেই ব্যক্তিত্ব ইতোমধ্যেই নির্মিত হয়ে গেছে সুরকারের সৃজিত কাঠামোতে। গায়ক বা রূপকার সেই প্রচ্ছন্ন ব্যক্তিত্বকে প্রাণ দেবেন তাঁর স্বরে, পরিবেশনায়, কিন্তু সুরকারকে অতিক্রম করে যাবার অধিকার তাঁর থাকবে না। 

'' ... যে মানুষ গান বাঁধিবে আর যে মানুষ গান গাহিবে দুজনেই যদি সৃষ্টিকর্তা হয় তবে তো রসের গঙ্গাযমুনাসংগম। যে গান গাওয়া হইতেছে সেটা যে কেবল আবৃত্তি নয়, তাহা যে তখন-তখনি জীবন-উৎস হইতে তাজা উঠিতেছে, এটা অনুভব করিলে শ্রোতার আনন্দ অক্লান্ত অম্লান হইয়া থাকে। কিন্তু মুশকিল এই যে, সৃষ্টি করিবার ক্ষমতা জগতে বিরল। যাদের শক্তি আছে তারা গান বাঁধে, আর যাদের শিক্ষা আছে তারা গান গায়–সাধারণত এরা দুই জাতের মানুষ। দৈবাৎ ইহাদের জোড় মেলে, কিন্তু প্রায় মেলে না। ফলে দাঁড়ায় এই যে, কলাকৌশলের কলা অংশটা থাকে গানকর্তার ভাগে, আর ওস্তাদের ভাগে পড়ে কৌশল অংশটা। কৌশল জিনিসটা খাদ হিসাবেই চলে, সোনা হিসাবে নয়। কিন্তু ওস্তাদের হাতে খাদের মিশল বাড়িতেই থাকে। কেননা, ওস্তাদ মানুষটাই মাঝারি, এবং মাঝারির প্রভুত্বই জগতে সব চেয়ে বড়ো দুর্ঘটনা। এইজন্যে ভারতের বৈঠকী সংগীত কালক্রমে সুরসভা ছাড়িয়া অসুরের কুস্তির আখড়ায় নামিয়াছে। সেখানে তান-মান-লয়ের তাণ্ডবটাই প্রবল হইয়া ওঠে, আসল গানটা ঝাপ্সা হইয়া থাকে।'' (সংগীতের মুক্তি) 

এ বিষয়ে আমার মনে হয় তাঁর অভিপ্রেত অনেকটা পাশ্চাত্যের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ধরনের সঙ্গে মেলে। সেখানেও স্বরলিপির নির্দিষ্ট বাঁধনকে আপোসহীনভাবে স্বীকার করে নিয়েও বিভিন্ন শিল্পীর পরিবেশনে নিজস্বতার সিলমোহর লক্ষ্য করা যায়। তবে এই মিলটা শুধু সুরের ক্ষেত্রেই প্রযুক্ত হতে পারে, সুর ও বাণীর মালা গাঁথার সাফল্য এক্ষেত্রে অর্জিত হয়না। নিজের সৃষ্টির অবয়বকে এইভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করার সাধ ও সাধ্য, শুধু বাংলায় কেন সারা ভারতবর্ষে কোথাও চোখে পড়েনি। বাংলাতে অন্য যেসব প্রধান কম্পোজার ছিলেন, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, দ্বিজেন্দ্রলাল বা নজরুল কেউই নিজস্ব সৃষ্টির পরিবেশন পদ্ধতি বিষয়ে এ জাতীয় স্পষ্ট ও নির্দিষ্ট নীতিনির্দেশ রেখে যাননি। তাই তাঁদের গান পরিবেশনের ক্ষেত্রে পরবর্তীকালে দিলীপকুমারের অভীপ্সাই বলবতী হয়েছে, যেটা আমাদের আবহমান কালের গীতকৌশল। যদিও এই মুহূর্তের প্রজন্মে বহু নবীন শিল্পীদের গান শুনে মনে হয় দিলীপকুমারই জিতে যাচ্ছেন। বহুক্ষেত্রে গায়কই গানের ভাগ্য নির্ধারণ করছেন। এটা চিরকালীন ভারতীয় প্রবণতা। কিন্তু এই প্রশ্নটিতে রবীন্দ্রনাথ নিতান্ত ব্যতিক্রম। তাঁর অনুশাসনের ভুবনটি য়ুরোপীয় ছাঁচের। গানকে কোনও মূল্যেই "সুরসভা ছাড়িয়া অসুরের কুস্তির আখড়ায়" পরিণত করার বিরুদ্ধে তাঁর জেহাদ। দ্বন্দ্বটি এইখানেই জন্ম নেয়। তাঁর শিল্পের ব্যাখ্যায় গভীরতার যে শর্ত কবি আরোপ করেছিলেন, শুধু আজকে নয়, চিরকালই অনেক পারফর্মারই তা সঠিক অনুধাবন করতে পারেননি। স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতার ভেদরেখাটি ঘুচিয়ে দিতে তাঁদের উদ্যমের অভাব নেই। শিল্পীর ইনকনসিস্টেন্সির উৎস থাকে সৃজনশীলতার দোলাচলে। কিন্তু টাইরানি'র জন্ম মূর্খতা থেকে আসে। ওটা তাৎক্ষণিকের বিকার। অথচ সঙ্গতভাবেই তাঁর শিক্ষায় আমরা অনন্ত আশাবাদী হয়ে থাকতে চাই। কালের ধর্মে কবির গানের পরিবেশনে পরিবর্তন নিশ্চয় আসবে। কিন্তু সংযমই সমস্ত শাশ্বত শিল্পের প্রধান শর্ত, কবির গানের ক্ষেত্রেও তার কোনও ব্যতিক্রম হবেনা। প্রকৃত শিল্পীরা স্বধর্মে সংযত হয়ে থাকবেন, এটাই একমাত্র অভিপ্রায়।

আমরা ইতর মানুষ। শাস্ত্রবাক্যের অচল উপলব্ধির থেকে অনুভূতির সতত দোলাচলে অস্থির প্রেমের প্রলাপে অধিক আস্থা রাখি। গুরু যখন বলছেন, ইনকনসিস্টেন্সিই একযোগে প্রধানতম পুণ্য ও পাপ, আমাদের জন্য তার থেকে বড়ো দিক নির্দেশ আর কী হতে পারে?

এবার বাইশে শ্রাবণে সব মার্কামারা গান নির্বাসনে পাঠিয়ে সারাদিন শুধু গাইবো, "নীল দিগন্তে, ঐ ফুলের আগুন লাগলো।" ফাগুনহাওয়া, শাওনপশলা, ফুলের আগুন, চিতার ফুলকি, সবাই মিলে একটা আকাশ হয়ে উঠবে। কবি'র ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠা প্রায় অদৃশ্য হাসিটি আমি দেখতে পাবো। নিমতলা নয়, আমার জন্য তিনি সতত অপেক্ষা করেন ছাতিমতলায়। পঁচিশ, বাইশ সব একাকার করে দেন দমকা হাওয়ায়। শুধু সমুখের পথ দিয়ে তাঁর পলাতকা ছায়া আমার গানের বন্ধন মেনে নেয়। 

নিতেই হবে....





1 comments:

6

প্রবন্ধ - আইভি চট্টোপাধ্যায়

Posted in


প্রবন্ধ


উপনিষদ : ব্যবহারিক জীবনে প্রাসঙ্গিকতা 
আইভি চট্টোপাধ্যায়



“মধুবাতা ঋতায়তে। মধু ক্ষরন্তি সিন্ধব:। মাধ্বীর্ন: সন্তু ওষধি:।
মধু নক্তমুতোষসো। মধুমত্‍ পার্থিবং রজ:। মধু দ্যৌরস্তু ন: পিতা। 
মধুমান্নো বনস্পতির্মধুমানস্তু সূর্য:। মাধ্বীর্গাবো ভবন্তু ন: ॥“ (বৃহদারণ্যক ৬॥৩॥৬॥)

বাতাসে মধু বয়, নদীর জলে মধুর ক্ষরণ। ওষধিরা মধুময় হোক। দিবা ও উষা মধুময় হোক। পৃথিবীর ধূলি মধু। আমাদের পিতা দ্যৌ মধুময়। বনস্পতি, সূর্য, গাভীরা সব মধুময় হোক। 

উপনিষদপাঠের সঙ্গে আমার সম্পর্কের সূত্র এই স্তোত্র। প্রথম যেদিন এই কথাগুলো পড়লাম, আমার ভেতর জুড়ে এক আনন্দের প্রকাশ। চমৎকার এক অনুভূতি। এই যে আমি, আমার চারপাশ, আকাশ বাতাস আলো প্রকৃতি.. সমগ্র বিশ্বব্যাপী এক আনন্দের প্রকাশ এই স্তোত্রে।

উপনিষদের প্রতি আগ্রহের সেই শুরু। ক্রমে আসক্তি। এমন আনন্দরসে পরিপ্লাবিত সাহিত্য খুব বেশি তো নেই। কৌতূহলে আমি উপনিষদ রচনাকাল ও সেই সময়ের ইতিহাস নিয়েও আগ্রহী হয়ে পড়ি। 

সাধারণ দর্শন যেভাবে লিখিত, উপনিষদের দর্শন সেভাবে গড়ে ওঠে নি। সাধারণ দার্শনিকের অনুসন্ধানমার্গ অনেকটাই বিচারমার্গ। মনের যে অংশ চিন্তা করে, কেবল সেই অংশকেই অবলম্বন করে সত্যের অনুসন্ধান। উপনিষদের ঋষি কিন্তু খানিক দার্শনিক, খানিক কবি। কেবলই বিচারমার্গে তিনি সমাধান খোঁজেন নি। 

উপনিষদের ভাবধারাকে সুসংবদ্ধভাবে সাজানোর উদ্দেশ্যে বাদরায়ণ ব্রহ্মসূত্র রচনা করেছিলেন। সেকালে বিশেষ শাস্ত্রকে সূত্রের আকারে রচনা করার একটা প্রবণতা ছিল। সূত্রের উদ্দেশ্য ছিল, শাস্ত্রের বিস্তারিত ভাবটিকে সংক্ষিপ্ত আকার দেওয়া। আর আজকের পৃথিবীতে তো গভীর ভাবনার ব্যক্তিগত সময় পর্যন্ত নেই। অজস্র কথা, নিরন্তর কথা। শব্দ ব্যবহারে অমিতব্যয়, চূড়ান্ত অসংযম। অন্যের কথা, গভীর কোনও কথা শোনার সময় নেই। অসংখ্য গণমাধ্যমে নিরন্তর ক্যাপস্যুলড জ্ঞানের চাষ। তিরিশ সেকেন্ডের এক একটি মনোহারী বিজ্ঞাপনে জীবনদর্শনের ক্যাপস্যুলড বাণী। শাস্ত্রপাঠের সময় বা আগ্রহ কই? তাই সেকালের নিরিখে শাস্ত্রগুলোর সংক্ষিপ্ত-করণের ভাবনাটা বেশ বুঝি। 

কিন্তু এই সংক্ষিপ্ত-করণের কারণে বহু শাস্ত্রবাক্য আজ দুর্বোধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ বহু সূত্র এমন আকার নিয়েছে যে, মূল বক্তব্য উদ্ধার করাই দুষ্কর। ব্রহ্মসূত্রের ক্ষেত্রে এই বিভ্রাট ঘটেছিল সবচেয়ে বেশি। 

পরবর্তীযুগের গবেষকরা প্রমাণ করেছেন, মূল উপনিষদের দর্শনের ব্যাখ্যা এবং অর্থ বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন মনীষী বিভিন্ন ভাবে করেছেন। যেমন শঙ্কর, রামানুজ, মধ্বাচার্য, বল্লভাচার্য, নিম্বার্ক, বলদেব বিদ্যাভূষণ। এঁদের ব্যাখ্যাগুলো এমনই পরষ্পরবিরোধী এবং স্বতন্ত্র যে প্রত্যেকটিকে এক একটি স্বতন্ত্র দার্শনিক তত্ত্ব হিসেবে স্থাপন করা যায়। 

এই যুক্তি থেকেই শঙ্করের ভাষ্য ‘অদ্বৈতবাদ’ নামে পরিচিত। রামানুজের ভাষ্যের পরিচিতি ‘বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ’ নামে, মধ্বাচার্যের ভাষ্য ‘দ্বৈতবাদ’, নিম্বার্কের ভাষ্য ‘দ্বৈতাদ্বৈতবাদ’, বল্লভাচার্যের ভাষ্য ‘বিশুদ্ধাদ্বৈতবাদ’ এবং বলদেবের ভাষ্যের পরিচিতি ‘অচিন্ত্যভেদাভেদ’ নামে। প্রতিটিই ভাষ্য ‘বেদান্ত দর্শন’ হিসেবে খ্যাত, কারণ এই সব ‘বাদ’-ই ব্রহ্মসূত্র বা বেদান্তসূত্রের ব্যাখ্যা করে। 

‘উপনিষদ’ শব্দটি সহজ, কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে ‘উপনিষদ’-এর সহজ সরল স্বাভাবিক অর্থ আজ অনেকটাই হারিয়ে গেছে। যুগে যুগে মনীষীরা একটি গূঢ় অর্থ খোঁজার চেষ্টা করে উপনিষদকে অনর্থক এক জটিল দর্শনে পরিণত করেছেন। ‘উপনিষদ’ শব্দটি যে বেদান্তের সমার্থবোধক শব্দ, তাও আমরা ভুলতে বসেছি। 

আমার মনে হয়, ‘উপনিষদ’-এর অর্থের ব্যাখ্যা করা উচিত সময়ের কথা মাথায় রেখে। যে সময় উপনিষদ রচিত হয়, সে কালের ভাবধারার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। তা যদি হয়, তাহলে জন্ম-মৃত্যুর বন্ধন বা পরজন্মবাদ সম্পর্কিত ব্যাখ্যাগুলো নিরর্থক হয়ে দাঁড়ায়। কারণ প্রাচীন উপনিষদের জন্ম যে যুগে, তখন জন্মান্তরবাদ প্রতিষ্ঠিত হয় নি। সে যুগে আজকের মতো দার্শনিক জ্ঞানের কোনও ব্যবহারিক উদ্দেশ্যও ছিল না। জানার জন্যে জানা, ব্রহ্মকে জানা-ই একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল। 

বর্তমানে আমরা যতগুলো উপনিষদ দেখতে পাই, প্রাচীনকালে তা ছিল না। বেদের সঙ্গে যুক্ত অবস্থায় মাত্র সাতটি উপনিষদের নাম পাওয়া যায়। ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্যে শঙ্কর ষোলোটি উপনিষদের বার্তা উদ্ধৃত করেছিলেন। মোঘল সম্রাট শাহজাহানের পুত্র দারাশিকো পঞ্চাশটি উপনিষদের অনুবাদ করেছিলেন। 

মুক্তিক উপনিষদে একশ’ আটটি উপনিষদের উল্লেখ আছে। বাসুদেব লক্ষণ শাস্ত্রীর সঙ্কলনে উপনিষদের সংখ্যা একশ’ কুড়ি। এইভাবে উপনিষদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। গবেষকরা এত গোলমেলে হিসেবের মধ্যে না গিয়ে উপনিষদগুলোকে মূল তিন শ্রেণীতে ভাগ করেছেন। 

- ব্রহ্মবাদী বা সর্বেশ্বরবাদী
- যোগবাদী ও সন্ন্যাসবাদী
- ভক্তিবাদী বা পৌরাণিক দেবতাপন্থী 

এইখানে ভারতীয় দার্শনিক চিন্তাধারার স্তর সম্বন্ধে কয়েকটি কথা প্রাসঙ্গিক। ভারতীয় ধর্ম বা দর্শনের ইতিহাসে চারটি স্তর। 

এক, বৈদিক স্তর। ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের প্রাধান্য। আবার অনেক দেবতা থেকে একেশ্বরবাদ এবং সর্বেশ্বরবাদ অভিমুখী চিন্তার শুরুও এ সময় থেকেই। 

দুই, পরাবিদ্যা বা ব্রহ্মবিদ্যার স্তর। এ সময় মানুষ ব্রহ্ম সম্বন্ধে জানতে উত্‍সুক হয়েছে। ব্রাহ্মণের শেষ অংশে বিশুদ্ধ দার্শনিক চিন্তা ধর্মের স্থান নিয়েছে এই স্তরেই। 

তিন, ষড়দর্শন বা মুক্তিমার্গের স্তর। এ সময় থেকেই মানুষ মনে করতে শুরু করেছে যে জ্ঞানমার্গই মুক্তির পথ। জৈন এবং বৌদ্ধ ধর্মদর্শনের সময়কাল এই। 

চার, পৌরাণিক ভক্তিমার্গের স্তর। একেশ্বরবাদের প্রতিষ্ঠা এ সময়। ঈশ্বরে ভক্তিই মুক্তির উপায়, এমন ভাবনার শুরু। 

ধর্মগ্রন্থ হিসেবেই বেদের উত্‍পত্তি। বেদের দুটি মূল অংশ – ‘সংহিতা’ ও ‘ব্রাহ্মণ’। সংহিতায় বিভিন্ন দেবতার উদ্দেশে রচিত ‘সুক্ত’ বা স্তোত্র। ব্রাহ্মণের আলোচ্য বিষয় হলো যজ্ঞবিধি। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, আনুষ্ঠানিক ব্যাপারস্যাপার নিয়ে ব্রাহ্মণের জন্ম হলেও তার বিষয়বস্তু ক্রমে মানবিক মনন-বিষয়ক ব্যাপারে পরিণতি পেয়েছে। বেদের যে অংশটি তখনকার দিনে অরণ্যে গিয়ে পড়তে হতো, তার নাম ‘আরণ্যক’। গৃহস্থ আশ্রমের শেষে মানুষ বানপ্রস্থে থাকাকালীন যে যাগযজ্ঞ করবে, তার বিধি। 

এর ঠিক পর থেকেই দেখা যায়, একটি চিন্তার কাল শুরু হয়েছে। বিশুদ্ধ দার্শনিক চিন্তার কাল। এ সময়ে কোনও যাগযজ্ঞের কথাই নেই। এই সময়টিই ‘উপনিষদ’-এর কাল। 

বেদের ‘সংহিতা’ ও ব্রাহ্মণের ‘উপনিষদ’ অংশে এ সময় বারোটি উপনিষদের উল্লেখ পাওয়া যায় : 

ইশাবাস্য, ঐতরেয়, কৌষীতকি, তৈত্তিরীয়, ছান্দোগ্য, বৃহদারণ্যক, কেন, কঠ, শ্বেতাশ্বতর, প্রশ্ন, মুণ্ডক, মাণ্ডুক্য।

এই প্রতিটি প্রাচীনতম উপনিষদের মূল কথা – পরাবিদ্যা। পরমব্রহ্ম বিষয়ে জ্ঞান। ব্রহ্মবাদ। 

ইশাবাস্য হলো একমাত্র উপনিষদ, যেটি বেদের সংহিতা-র অংশ। ঐতরেয় ঋগবেদের ঐতরেয় আরণ্যকের সঙ্গে যুক্ত। কৌষীতকি ঋগবেদের শাঙ্খায়ন আরণ্যকের শেষ অংশ। তৈত্তিরীয় কৃষ্ণযজুর্বেদের অংশ, বৃহদারণ্যক শুক্লযজুর্বেদের শতপথ ব্রাহ্মণের অংশ। ছান্দোগ্য সামবেদের ছান্দোগ্য ব্রাহ্মণের অংশ। 

কেন উপনিষদ সামবেদের জৈমিনীয় ব্রাহ্মণের অংশ। 

কেন ছাড়া প্রাচীন এই ছয়টি উপনিষদ গদ্যে রচিত। কেন আংশিক পদ্যে লেখা। আবার মাণ্ডুক্য ছাড়া বাকি কঠ, শ্বেতাশ্বতর, প্রশ্ন, মুণ্ডক সব উপনিষদই পদ্যে রচিত। 

পরাবিদ্যা এবং ব্রহ্মবাদ ছাড়া উপনিষদের মূল ভাবটি হলো এক সর্বব্যাপী উপলব্ধির ভাব। এক নৈতিক আদর্শ যা স্বার্থ ও পরার্থের সামঞ্জস্য বিধানে সহায়ক। মানুষ নিজেকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে।

তাই স্বভাবত মানুষ স্বার্থপর। উপনিষদ এই সমস্যার সমাধান দিয়েছে নতুন পথে। স্বার্থপর মানুষও কিন্তু নিজ নিজ প্রিয়জনের জন্যে সর্বস্ব দিয়ে দিতে পারে। সন্তানের জন্যে স্নেহে, বন্ধুর জন্যে কিংবা ভালোবাসার মানুষটির জন্যে স্বার্থপর মানুষ পরার্থপর হয়ে উঠছে, এমন হামেশাই হয়। 

তাহলে ক্ষেত্রবিশেষে মানুষ যদি স্বার্থত্যাগ করতে পারে, সন্তানের স্বার্থ যদি মায়ের স্বার্থের সঙ্গে এক হয়ে যেতে পারে, তাহলে অন্যক্ষেত্রে হয়ে উঠতে পারে না কেন? মানুষের হৃদয়বৃত্তি যদি প্রসারিত হয়, স্নেহ প্রীতি ও ভালোবাসার আঙিনা যদি একটু বিস্তৃত হয়, ‘সব মানুষই আমার নিজের’ -এমন বোধ তৈরী হয়, তবে স্বার্থত্যাগ সম্ভব।

পরাবিদ্যা এবং ব্রহ্মবাদ এক ব্রহ্মের কথা বলে। ব্রহ্ম এক, তিনি সব কিছুতে জড়িয়ে আছেন। 

ছান্দোগ্য উপনিষদে ব্রহ্মের প্রতিশব্দ হলো ভূমা। প্রতিশব্দ হিসেবে বিভিন্ন উপনিষদে আরেকটি শব্দ বারবার পাওয়া যায়। আত্মন। এই আত্মন ব্যক্তিবিশেষের আত্মা নন। ব্রহ্ম বা ভূমা বা আত্মন সবার ভেতরে বিদ্যমান। এই ব্রহ্মকে জানতে চাওয়া আর বুঝতে চাওয়াই মানবজীবনের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত। উপনিষদের দর্শন তাই বলে। 

এক পরমসত্তা। বিশ্বের মূলে যে বিশেষ তত্ত্ব, যা থেকে বিভিন্ন প্রাণ ও অপ্রাণের জন্ম, জীবনধারণ এবং শেষে বিলীন হওয়া। সেই পরমসত্তা আর কিছু না, ব্রহ্ম বা ভূমা বা আত্মন। রূপ রস গন্ধ স্পর্শ শব্দের এই জগত পরমসত্তার স্বাভাবিক প্রকাশ। 

এই পরমসত্তাকে উপলব্ধি করার জন্যে মনন চাই, বুদ্ধিবৃত্তির সঙ্গে সঙ্গে হৃদয়বৃত্তিও চাই। যদি ব্রহ্মই বিশ্বের সবকিছুর মধ্যে বিদ্যমান, তাঁর সম্পর্কে সম্পর্কিত হয়ে প্রতিটি জীব তাহলে আত্মীয়। 

উপনিষদের এই মূলমন্ত্র। এই মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে গাইতে পারা যায়..

কী আনন্দ, কী আনন্দ, কি আনন্দ
দিবারাত্রি নাচে মুক্তি, নাচে বন্ধ...

নিজেকে বহুর মধ্যে মিলিয়ে নিয়ে সামগ্রিক দৃষ্টি দিয়ে বিশ্বের দিকে চোখ মেলে চাইলে যে আনন্দ, সেই হলো ব্রহ্মের আনন্দ। ভূমানন্দ।

ব্রহ্ম সমস্ত প্রাণীতে, উদ্ভিদে, সচেতন অচেতন প্রতিটিই বস্তুতে বিরাজমান। উপনিষদের তত্ত্ব এই।

এই দর্শন আত্মস্থ করলে তাই সবাই নিজের, সবাই আপন। স্বার্থ আর পরার্থের দ্বন্দ্ব থাকে না। কিন্তু আজকের মানুষের জীবনে এই উপনিষদ-পাঠের গুরুত্ব কোথায়। কিভাবেই বা রক্ষা হয় এই ভারত-সংস্কৃতি। আজকের ব্যবহারিক জীবনে এই প্রাচীন সাহিত্যের স্থান ঠিক কোথায়। 

আমার মনে হয়েছে যে, উপনিষদের লক্ষ্য ইন্দ্রিয়-নিয়ন্ত্রণ। সার্থক জীবনযাপনের জন্য উপনিষদ-পাঠ আবশ্যক। উপনিষদের সঙ্গে সন্ন্যাসবাদের মূল পার্থক্য হলো, কৃচ্ছ্রসাধন ও ইন্দ্রিয়-নিরোধের পথে না গিয়েও দেহ-মনের ওপর সম্পূর্ণ আধিপত্য বিস্তার। সমাজ-কল্যাণে মানুষের মন ব্যবহার হওয়া। সন্ন্যাসী হয়ে জীবন থেকে পলায়ন নয়। উপনিষদ বলে, মানুষের জীবনে যেমন ত্যাগের স্থান আছে, তেমনই ভোগেরও স্থান। এই দুইয়ের সামঞ্জস্যেই জীবনের সার্থকতা। 

উপনিষদের মূল কথা – সত্যম শিবম সুন্দরম। 

গোলযোগ বাধছে মানুষের স্বভাব নিয়ে। সব ধর্মেই বলা হচ্ছে, পাপকে ঘৃণা করো, পাপীকে নয়। দয়া করো। মজার কথাটা এই যে, ধর্মমতের অনুরাগীরা সহিষ্ণুতার চর্চায় পাপীর স্বাধীনতা নিয়েও নরমপন্থী। এক্ষেত্রে উপায় একটিই। পাপীর নিজের অন্তরের পথে যাত্রা। মানবমুক্তি। মানুষের সবচেয়ে বড় জিনিস তার স্বাধীনতা। চিন্তার স্বাধীনতা, বাক-স্বাধীনতা, সৃষ্টির স্বাধীনতা, ব্যাখ্যা করার স্বাধীনতা। রাসেল, রবীন্দ্রনাথ, রাধাকৃষ্ণন কিংবা বুদ্ধ চৈতন্যদেব রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ কেউই পপুলার ধর্মকে আশ্রয় করেন নি। ধর্ম কোনও আচার অনুষ্ঠান নয়, ধর্ম এক নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী। 

এই সহজ কথাটা আমরা ভুলে থাকি। উপনিষদ-চর্চা আমাদের সেই নীতিজ্ঞানে সহায়ক। 

ব্যবহারিক জীবনে উপনিষদের প্রাসঙ্গিকতা কোথায়? কতটা? কেবল সুন্দর স্বাস্থ্য, বিদ্যা বা বুদ্ধি নিয়ে একজন ‘মানুষ’ হয় না। মানুষ গড়ে ওঠে সমাজের অঙ্গ হিসেবে। সমগ্র সমাজের কল্যাণের সঙ্গে নিজের স্বার্থের সামঞ্জস্য রেখে যে চলতে পারে, তার নীতিজ্ঞান হয়েছে বলা যায়। উপনিষদের যুগে এই নৈতিক শিক্ষাকে বিশেষ স্থান দেওয়া হতো। 

এই প্রসঙ্গে বৃহদারণ্যক উপনিষদের একটি গল্প বলি।(বৃহদারণ্যক॥৫॥২॥৩॥)

আদিকালে ঋষি প্রজাপতির আশ্রমে তিন শ্রেণীর শিক্ষার্থী দীর্ঘকাল ধরে বিদ্যাচর্চা করছিলেন। দেবতা, দানব, মানব। শিক্ষাশেষে সমাবর্তন। এই সময় গুরুর কাছে শেষ উপদেশ প্রার্থনার রীতি। প্রথমে 

দেবতাদের দল। গুরু তাদের উপদেশ দিলেন, ‘দ’। তারপর মানব শিষ্যদেরও একই উপদেশ দিলেন, ‘দ’। সবার শেষে দানবদের পাল। গুরু একই উপদেশ দিলেন, ‘দ’। 

দেবতা উপদেশ নিলেন এইভাবে, ‘দ’ অর্থাৎ ‘দাম্যত’। আত্মদমন করো। কামনা দমন করে শান্ত হও।

মানুষ সে উপদেশ নিলেন, ‘দ’ অর্থে ‘দত্ত’। দান করো। 

দানব উপদেশ নিল ‘দ’ অর্থাৎ ‘দয়ধ্বম’। দয়া করো। দয়ালু হও। 

দেবতা অসীম ক্ষমতার আধার। সে ক্ষমতার অপব্যবহার হলে সমাজের অমঙ্গল। তাই তাদের আত্মদমন করার উপদেশ। মানুষ স্বভাবত লোভী ও ভোগী। তাই দান-এর উপদেশ। যা পাও তা একা ভোগ কোরো না। দানব অসুররা হিংসাপরায়ণ। এই প্রবৃত্তিকে প্রশ্রয় দিলে সমাজে অন্যের উত্পীড়নের আশঙ্কা। তাই তাদের জন্যে দয়া-র উপদেশ। 

আজ সভ্যতার অনেকখানি পথ পেরিয়ে এসে আমরা জানি, একজন মানুষের মধ্যেই দেব-দানব-মানবের সহাবস্থান। প্রতিটি মানুষের মধ্যে দেব-দানব-মানব তিন বৃত্তির খেলা। তাই আজও মানুষের বিশেষ নৈতিক গুণের গুরুত্ব অপরিসীম।

এই প্রসঙ্গে একটা স্বীকারোক্তি আছে আমার। 

বৃহদারণ্যকের গল্পটা পড়ার ইচ্ছে হয়েছিল এক পাশ্চাত্য কবির কবিতা পড়ে। টি এস এলিয়ট। 

এলিয়টের ‘দ্য ওয়েস্টল্যান্ড’ কাব্যে অনেক উদ্ধৃতি। পশ্চিমি পাঠকের কাছে বৃহদারণ্যক উপনিষদ থেকে উদ্ধৃতি। আদি মন্ত্রগুলোকে অক্ষুণ্ণ রেখে এই উদ্ধৃতি। 

এলিয়টের এই বৈশিষ্ট্য আমায় খুব অবাক করে। অনায়াসে তিনি উচ্চারণ করেন, ‘দয়ধ্বম, দত্ত, দাম্যত’। উপনিষদের এই মন্ত্র.. ‘দয়ধ্বম, দত্ত, দাম্যত’। সর্বকালীন যার আবেদন। অনায়াস সাবলীলতায় এলিয়ট পাঠকের মনে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। 

সমারসেট মম-এর গল্প ‘রেজারস এজ’ কঠ-উপনিষদের ‘ক্ষুরস্য ধারা’-র অনুবাদ। ম্যাক্সমুলার ভারতীয় ধর্মশাস্ত্র ও দর্শনের প্রতি গভীর পক্ষপাত দেখিয়েছেন। ম্যাক্সমুলারের ‘সেক্রেড বুকস অফ দ্য ইস্ট’-এ উপনিষদের অনুবাদও আছে। মার্কিন সাহিত্যিক রাল্ফ ওয়াল্ডো ইমারশনের একটি কবিতার নাম ‘ব্রহ্ম’, একটি প্রবন্ধের নাম ‘ওভার সোল’। এই সাহিত্যিক যে উপনিষদের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন, বেশ বোঝা যায়। 

আমাদের ভারতীয় সংস্কৃতির অনেক কথাই পশ্চিমের লেখক-কবির কলমে পড়ছি আগে, তারপর খোঁজ করছি। ব্যবহারিক জীবনে যে উপনিষদকে জায়গা দিই নি, তার প্রমাণে এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর কি হতে পারে ?

ছান্দোগ্য উপনিষদের তৃতীয় অধ্যায়ের ষোড়শ ও সপ্তদশ খণ্ডে একটি চমত্কার বর্ণনা আছে। 

মানুষের সমগ্র জীবনকে এখানে একটি যজ্ঞরূপে কল্পনা করা হয়েছে। বৈদিক যুগে সব যজ্ঞের সেরা ছিল ‘সোমযাগ’। সোমযাগে পাঁচদিন ধরে অনুষ্ঠান হতো। প্রথম দিনে ‘দীক্ষা’। সেদিন সংযমের দিন। পান ও আহার নিষেধ। পরের তিনদিন ধরে ‘উপসৎ’। পান আহার আমোদ প্রমোদের ঢালাও আয়োজন। পঞ্চমদিনে মূল অনুষ্ঠান ‘সবন’। সোমলতা ছেঁচে রস বার করা, দিনে তিন বার, সকাল দুপুর ও সন্ধ্যায়। সেইসঙ্গে স্তোত্রগান আর শাস্ত্রপাঠ। এই ক্রিয়াটির নাম ‘স্তুতশস্ত্র’। যজ্ঞশেষে যজ্ঞপাত্রগুলোকে জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। এই প্রক্রিয়ার নাম ‘অবভৃথ’। সব শেষে যজ্ঞে যোগদান করা সব ঋত্বিককে ‘দক্ষিণা’ দেওয়ার রীতি। 

এই পাঁচটি ক্রিয়া, ‘দীক্ষা’- ‘উপসত্‍’- ‘স্তুতশস্ত্র’- ‘অবভৃথ’- ‘দক্ষিণা’, মানুষের জীবনের কর্মের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে ছান্দোগ্য উপনিষদে। 

সংযমী মানুষের সংযত আচরণের তুলনা হলো দীক্ষা। সাধারণ মানুষের সাধারণ যাপনের তুলনা উপসত্‍। জীবনধারণের শর্ত মিটিয়েও মানুষ হাসে, খেলা করে, প্রীতিপ্রকাশ করে। এর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে স্তুতশস্ত্র-এর। তারপর জীবন শেষ হলে অবভৃথ, মৃত্তিকা-পাত্র জলে ভাসিয়ে দেবার মতো করেই জীবনের লীলা শেষ। 
বাকি রইল দক্ষিণা-র কথা। মানুষের জীবন-যজ্ঞের দক্ষিণা দিতে হয় সারা জীবন ধরে। কি সেই দক্ষিণা ? তপস্যা, দান, আর্জব (প্রার্থনা), অহিংসা, সত্যভাষণ। 

‘অথ যত্তপো দানমার্জবমহিংসা সত্যবচনমিতি 
তা অস্য দক্ষিণা: ॥‘ (ছান্দোগ্য॥৩॥ ১৭॥ 8)

এইখানেই উপনিষদের শিক্ষার সার্থকতা। যে মহৎ গুণগুলো মানুষের জীবনকে সার্থক করে, সমাজের কল্যাণ-সাধন করে, সেগুলোকে মানুষের অবশ্যপালনীয় কর্তব্য হিসেবে পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে উপনিষদে। 

প্রাচীন ভারতীয় জীবনদর্শন এ কথাই বারবার বলেছে। আমরা সমগ্র বিশ্বজগৎ ও সমগ্র মানবজাতিকে হৃদয়ে ধারণ করেছি। মানবচৈতন্যলোক ও মানবমঙ্গল আমাদের মন্ত্র। ভারত-সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ দান – অহিংসা আর সত্যভাষণ। মহাত্মা গান্ধীর জীবনে আমরা দেখি, উপনিষদের এই বার্তাই তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র। 

উপনিষদের দর্শন ইন্দ্রিয়-নিয়ন্ত্রণের শিক্ষা দেয়, ইন্দ্রিয়-দমন নয়। সংযম এবং নীতি-জ্ঞান সেই চেতনা তৈরী করে যাতে মানুষ সংসারে থেকেই মুক্তির আনন্দ পেতে পারে। 

এই প্রসঙ্গে গীতা ও উপনিষদের দর্শনের একটি তুলনামূলক আলোচনা করা যেতে পারে। গীতা শিক্ষা দেয়, কর্মফলের আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে, কর্মফল সম্পর্কে উদাসীন থেকে কর্তব্যকর্ম সম্পাদন। যিনি সকল কামনা ত্যাগ করেন তিনি স্থিতপ্রজ্ঞ। যিনি সুখ-দু:খ ভয়-ক্রোধে সমান উদাসীন তিনি স্থিতধী। 

কর্মফল ত্যাগই প্রকৃত যোগ। নিজের কাজটুকু করো, ফলের আশা কোরো না।

উপনিষদের আদর্শের সঙ্গে এইখানে গীতার আদর্শের তফাৎ। উপনিষদ বলে, হৃদয়বৃত্তিকে বাদ দিয়ে মানুষ হয় না। উপনিষদ বলে, সুখভোগের ইচ্ছে একটি স্বাভাবিক ইচ্ছে। দয়া করো, দান করো, আত্মদমন করো। কিন্তু মা সন্তানের প্রিয় হোক, সন্তান মায়ের প্রিয় হোক, মানুষ মানুষকে ভালোবাসুক, বিশ্ববাসী বিশ্ববাসীকে ভালোবাসুক। ব্রহ্মের স্বরূপ, ব্রহ্মের সর্বব্যাপী-রূপ অনুভব করে প্রতিটি মানুষ একে অন্যের সঙ্গে আত্মীয়তা অনুভব করুক।

ইসলাম ধর্মে পাঁচটি অবশ্যকর্তব্য ঈশ্বরনির্ভর জীবনযাপনের রীতি আছে। প্রার্থনা, উপবাস, দান, তীর্থযাত্রা, ঈশ্বরবিশ্বাস। সন্ত সুফীরা নিরন্তর বলেন, ‘আমি ঈশ্বরের বন্ধু’। উপাসনা, পূজা, ইত্যাদি সুফীদের কাছে নিরর্থক। সুফীরা বিশ্বাস করেন, ঈশ্বর জলে-স্থলে-পাখির গানে-সমুদ্রের তরঙ্গে বিরাজ করেন। ধর্মের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত মানবপ্রেমই ঈশ্বরপ্রেম। 

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘অদ্বৈতবাদ ধর্মের এবং চিন্তার শেষ কথা’। অদ্বৈতবাদের মূল কথা হলো সর্বজনীন সর্বকালীন মানব। 

ঘুরেফিরে তাহলে সেই এক জায়গায় এসে দাঁড়াল। যুগে যুগে ছন্দে গানে নৃত্যে চিত্রকলায় স্থাপত্যে জীবনের এই মূল সুর। মানুষের চলমান জীবনের তরঙ্গের সুর। গঙ্গা যমুনা সরস্বতী থেকে হিমালয় নীলগিরি, সর্বত্রই সে তরঙ্গ। মানুষের সংস্কৃতি সভ্যতা ধর্ম সবই সেই তরঙ্গ। সর্বাত্মক সে রূপ। 

দেহমন-বিশিষ্ট মানুষ পণ্যের বাজারে ধর্ম সংগ্রহের পথে শ্রেয়কে চিনে নিতে পারে যেন, তাই উপনিষদচর্চা। পুজো করবার আবেগটা বড় হয়ে উঠলে পুজোর মূল ভাবনাটা হারিয়ে যায়। বড় হয়ে ওঠে পুজোর সামগ্রী আর বহুবিধ আয়োজনের অনুষ্ঠান। সত্যের সঙ্গে, জ্ঞানের সঙ্গে, মধুর রসের সঙ্গে সম্পর্ক হারিয়ে যায়। 

আমরা এই সামঞ্জস্যবোধের দর্শনটাই হারিয়ে ফেলছি না তো? সেই সামঞ্জস্য যাকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘শান্তমশিবমদ্বৈতম। জগতের মধ্যে সামঞ্জস্য তিনি শান্তম, সমাজের মধ্যে সামঞ্জস্য তিনি শিবম, আত্মার মধ্যে সামঞ্জস্য তিনি অদ্বৈতম’। এই সামঞ্জস্যবোধ উপনিষদের শিক্ষা। 

মানুষ নিজের চেয়ে বেশি কাউকে ভালোবাসে না। নিজের সুখ, সুবিধে, স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে ব্যস্ত মানুষের সর্বদাই অন্যের স্বার্থের সঙ্গে সংঘর্ষ। এই স্বার্থ ও পরার্থের লড়াইয়ের মীমাংসার জন্যেই উপনিষদ।

নীতিজ্ঞান না হলে জ্ঞান শুধুমাত্র পাণ্ডিত্যে আবদ্ধ থাকে। এই নীতিজ্ঞান দার্শনিকজ্ঞান ছাড়া সম্ভব নয়। যা অনবদ্য কর্ম, তাইই কর্তব্যকর্ম। 

‘যান্যনবদ্যানি কর্মাণি 
তানি সেবিতব্যানি। নো ইতরাণি ॥‘ (তৈত্তিরীয়১॥১১॥২) 

‘অনবদ্য’ কর্ম প্রসঙ্গে উপনিষদের ব্যাখ্যা হলো, যা সামগ্রিকভাবে কল্যাণকর তা-ই অনবদ্য। যা অনবদ্য নয়, তাকে ‘বর্জন’ করার কথা। এইই উপনিষদের বার্তা। সমস্ত সমাজের মানুষের সঙ্গে ভাগ করে জীবনভোগ, কেবলমাত্র অনবদ্য কর্ম সম্পাদনে আনন্দ খুঁজে নেওয়া। উপনিষদের নৈতিক আদর্শ এই। আজকের মানুষের জীবনে এর চেয়ে প্রাসঙ্গিক বার্তা আর কি-ই বা হতে পারে !

আজ সমাজে মূল্যবোধ-লুপ্ত মানুষের সংখ্যাই বেশি। এই মানুষরা বিবেকবর্জিত, যে কোনও কাজ করতে পারে। সন্ত্রাসবাদ থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদ.. মানুষের গতি অব্যাহত। আজকের মানুষের জীবনযাত্রায় অহমিকা, অহঙ্কারসর্বস্বতা। সবচেয়ে বড় কথা, জ্ঞানী মানুষ সমাজে মুখ খোলেন না। 

অজ্ঞানী বাগাড়ম্বরসর্বস্ব মানুষ নিরন্তর নানা বিষয়ে বক্তব্য জানিয়ে চলেছে। অজস্র কথা, নিরন্তর কথা, সর্ব বিষয়ে শেষকথা বলার হিড়িক। এখানেই শেষ নয়।

সমাজে, শিল্পে, সাহিত্যে, নাটকে, চিত্রকলাতে রক্তের গন্ধ, হিংসার প্রচার। ধনতন্ত্রবাদী সমাজের সবচেয়ে বড় অসুখ – অসমবন্টন, অসম আচরণ, বর্ণবৈষম্য, বিশ্বাসহীনতা। এখানে ঈশ্বরকে ব্যবহার করা হয় ঈশ্বরহীন পথে। ধ্বংসের আর হিংসার হাতিয়ার হিসেবে। 

আজকের সমাজে তাই উপনিষদ শিক্ষার প্রযোজন খুব। রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছেন, ‘মানুষের অভিব্যক্তির গতি অন্তরের দিকে’।

পৃথিবীতে সব সময়ই কিছু চিন্তাশীল, সংবেদনশীল, মানবপ্রেমিক মানুষ পাওয়া গেছে। তাঁদের বার্তা আজ আমাদের পাথেয় হোক। আদিম মানুষ ছিল বর্বর, পশুর মতো, ভৌতিক জীবনের সীমায় তার মন আর কর্ম আবদ্ধ ছিল। প্রাচীনযুগেই কিন্তু মনীষীরা সেই আদিম মানুষকে মুক্তির পথ দেখিয়েছিলেন। 

আজকের দিনে সে পথের বার্তা সমান প্রাসঙ্গিক। 

চলাটাই মানুষের কাজ। নিজেকে অতিক্রম করে এগিয়ে চলা মানুষের ধর্ম। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, উপনিষদের কথাটিই, ‘এই আরোর দিকে, এই ছাড়িয়ে যাবার দিকে মানুষের শ্রী, তার ঐশ্বর্য, তার মহত্ব’।

অন্তরের দিকে তীর্থযাত্রা আরম্ভ হোক। ‘মানুষ’-এর জয় হোক। এই প্রার্থনা। 



তথ্যসূত্র : 

*বিভিন্ন উপনিষদ 
*উপনিষদের দর্শন –হিরণ্ময় বন্দোপাধ্যায়
*বিবেকানন্দ বেদান্ত ও হিন্দুধর্ম –হোসেনুর রহমান
*ধর্ম সংকট –হোসেনুর রহমান 
*রবীন্দ্র রচনাবলী 
*ভারতীয় সাধনার ধারা –গোপীনাথ কবিরাজ
*দ্য ওয়েস্টল্যান্ড: হোয়াট দ্য থান্ডার সেইড –টি এস এলিয়ট
*দ্য সিস্টেম অফ বেদান্ত – ডয়সেন



6 comments:

0

প্রবন্ধ - অরূপ জ্যোতি ভট্টাচার্য

Posted in

প্রবন্ধ

প্রেমের প্রশিক্ষণ
অরূপ জ্যোতি ভট্টাচার্য


সাউথ সিটি মল। মেদ চিকন খোলা পিঠে ব্যাকলেস চোলির মেয়েটি। হাতে সিগারেট। সামনের সিটে বয়ফ্রেন্ড। কাউকেই চিনিনা। তবু মনের মধ্যে ঈর্ষা খেলে গেলো । মনকে সান্তনা দিলুম - ওরা ভাই-বোন। যদি স্কুল পাঠক্রমে প্রেম করা শেখাতো। আজ তাহলে আমিও গার্লফ্রেন্ড নিয়ে আসতুম। রোজ কত কি ঘটে যাহা তাহা, এমন কেন সত্যি হয়না আহা! না এটা অলীক কল্পনা নয়। এটাও বাস্তব। লিনাক্স ডেটিং কম্পানির সি ই ও আমাই এন্ডারসন বলছেন - ফ্ল্যার্ট কেমন করে করতে হয় সেটাই শেখানো হয়। কেমন করে কমুনিকেটে করতে হয়। এতে দুজনে কাছে আসে। প্রেমে পরে। প্রেম গভীর হয়। এটাই আজকের বাস্তব যে প্রেম কেমন করে করতে হয়, সেটাও শেখানো হয়। 

ফিরে যাই কালিদাসের যুগে। শকুন্তলার নিতম্বের ভারে কাদায় পায়ের ছাপ গোড়ালির দিকে গভীর। স্তনের আকর্ষণে শরীর সামনের দিকে ঝুকে রয়েছে। আর আধুনিক সুনীল বাবুর নায়িকা পুরোনো প্রেমিকের সাথে মিলিত হয় বরকে না জানিয়ে। বরের বন্ধুর দুর্নিবার আকর্ষণে ধরা দেয় মাঝেমাঝে। সদ্য অষ্টাদশী কন্যাকে আড়াল করে রাখে। কাকুর আপিলের নেশায় মেয়ে না ধরা পরে। প্রেম কাউকে শিখিয়ে দিতে হয় না। প্রকৃতির নিয়মে আত্মসমর্পণ। আবার অমিত রায়কে মুছে ফেলে শোভনলালের কাছে ধরা দেয় লাবণ্য। পার্বতীকে খুঁজে পাওয়া যায় চন্দ্রমুখীর তাচ্ছিল্যে। কোথাও প্লেটোনিক প্রেম ধরা দেয় লিবিডোর হাতছানিতে। শেষ হয় অর্গ্যাজমে। না সেখানেও শেষ নয়। একসাথে পথ চলা। এরই নাম প্রেম। পূর্বরাগ। রতি। সঙ্গম। বা শুধুই দর্শন বা শ্রবণ। 

কিন্তু আজকের বাস্তবতা অন্য রকম। টেকনোলজি নির্ভর যুগে ফেসবুক বা হোয়াটস্যাপ থেকে বেরিয়ে মানুষ ছুটে চলেছে কর্মব্যস্ত জীবনের মায়াজালে। জাসবিনা আলুওয়ালিয়ার কথায় - কেরিয়ার গড়তে গিয়ে অনেক ছেলে মেয়েই ভুলে যাচ্ছে প্রেমের আনন্দ। তাই প্রেমে পড়তেই ভুলে যাচ্ছে মানুষ। ম্যাচমেকিং শুধু নয়, রীতিমতো শেখানো হয় কেমন করে প্রেম করতে হয়। আজকের ম্যাচমেকিং কম্পানিতে শেখানো হচ্ছে প্রেমেপড়া থেকে ডেটিং চ্যাটিং সমস্ত কৌশল। আর এই কৌশল শেখাতে প্রায় ৩৫০০০ টাকার প্যাকেজ। প্রেম করানোর প্রশিক্ষক নন্দিনী চক্রবর্তী বলছেন যে, বর্তমানে এই শিক্ষা এক নতুন বিনিয়োগের মাধ্যম। 

প্রেমের প্রশিক্ষণ নিয়ে এক মহিলা ডক্টর পেয়েছেন চারজন প্রেমিক। যেখান থেকে তিনি পছন্দ করবেন জীবন সঙ্গী। নাইনা হিরানান্দানি জানাচ্ছেন, তাঁর কম্পানি ১৮ টি দেশে ৩৬৫৭ টি ডেটিং অর্গানায়িস করেছে। তাই আর জেলাসি নয়। চলার ছন্দে শাড়ির ফাঁক দিয়ে উঁকি দেওয়া কোমরের হিল্লোল বা নাভির সাহসী প্রকাশ - যা মনে নেশা জাগায়, তাতে আত্মপ্রকাশের দিন এসে গেছে। না কোনও ভয় নয়। সঠিক ভাবে প্রেম করার দিন এসে গেছে। নিজেকে প্রকাশ করার সময় এসে গেছে। শুধু প্রয়োজন একটু প্রশিক্ষণ। একটু সঠিক ভাবে কথা বলার অভ্যাস। প্রেম করা নতুন ভাবে শিখে আবার প্রেম করা যাক। 

তথ্য সূত্র : টাইমস অফ ইন্ডিয়া










0 comments:

0

বিশেষ রচনা - রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য

Posted in


বিশেষ রচনা


কুসংস্কার বিরোধিতা: ছোটোদের গল্পে
রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য 



কলেজ স্ট্রীট পাড়ার এক প্রকাশক ২০০১-এ একটি বই বার করেন: বিশ শতকের কুসংস্কার-বিরোধী গল্প। সেই প্রকাশকই ২০০৩–এ বার করলেন ছোটদের কুসংস্কার-বিরোধী গল্প। ভাবতে ভালো লাগে, দু-খণ্ডে প্রকাশিত এই বইটি দু বছর অন্তর পুনর্মুদ্রণ হয়েছে, ২০১০-এ একটি পরিমার্জিত সংস্করণও বেরিয়েছে। চমৎকার কাজ; ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর থেকে একেবারে হালের শ্রেয়া রক্ষিত অবধি অনেকের গল্প এতে আছে।

সম্পাদকের পছন্দমতো গল্প বাছা হয়েছে, কিন্তু তার বাইরেও কিছু গল্প থাকে যেগুলি এই বইতে জায়গা পাওয়ার যোগ্য। তেমন একটি গল্প ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য-র ‘তাবিজ-মহিমা’। অমিয়কুমার চক্রবর্তী-সম্পাদিত একটি বইতে এটি আছে।

যেসব বিষয় নিয়ে বড়দের গল্প লেখা হয় তার প্রায় সবই ছোটোদের গল্পর বিষয় হতে পারে। তাই কুসংস্কার-বিরোধী গল্প বড়-ছোটো সবার জন্যেই লেখা হয়েছে। কিন্তু গল্পর চরিত্র ও ঘটনা ঠিক করার সময়ে একটু তফাতও হয়। ছোটোদের গল্পে চরিত্ররা, বা তাদের অন্তত কেউ কেউ, বয়সে ছোটো হলে কমবয়সী পাঠক-পাঠিকার সঙ্গে ভাবের সংযোগ আরও সহজে ঘটে। আর গল্পর ঘটনা যদি তাদের অভিজ্ঞতার জগতের হয়, তবে মূল কথাটি কিশোর পাঠকদের কাছে সহজেই পৌঁছয়। সব পাঠকের অভিজ্ঞতার জগৎ এক নয়। তবে স্কুল আর পরীক্ষা—এই দুটি ব্যাপার কিশোর পাঠকের অভিজ্ঞতায় থাকে। এইরকমই একটি বিষয় নিয়ে লেখা হয়েছিল ‘তাবিজ-মহিমা’।

গল্পটা সংক্ষেপে এই: সামনে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা কিন্তু সোমেশের কিছুই পড়া হয় নি। তার বন্ধু সিদ্ধেশ্বর খবর দিল: শিবপুরের হরিপদ জ্যোতিষালঙ্কার মন্ত্রপূত তাবিজ দিয়ে পরীক্ষা পাশের ব্যবস্থা করে দেন। সেই মতো দু জনেই জ্যোতিষালঙ্কারের কাছে গেল। জ্যোতিষী ঘরে ছিলেন না; ছিল তার খুকি বোনঝি। তাকে এক পয়সা ঘুষ দিয়ে জ্যোতিষীর দেখা মিলল। দু টাকা ফি আর পাঁচসিকে দাম দিয়ে তারা তাবিজ নিয়ে এল। জ্যোতিষালঙ্কার বলে দিলেন: ‘যি দিন পাশের সংবাদ বাইর হইবো সি দিনই এই তাবিজ খুইলা গঙ্গাজলে নিক্ষেপ করবেন—ভুল হয় না যিনি!’ শুধু ওই দুজনই নয়, সোমেশের আরো দশ-বারোজন বন্ধুও শিবপুরে গিয়ে সেই ‘তেজস্কর তাবিজ’ নিয়ে এল।

পরীক্ষার ফল বেরতে দেখা গেল: সিদ্ধেশ্বর, রমেশ আর হরেন ভালোভাবে পাশ করেছে, কিন্তু সোমেশ, ভুঁদো, ভোঁতা—একেবারে ফেল। সবাই মিলে তখন ছুটল শিবপুরে। সব শুনে জ্যোতিষীমশায় বললেন: ‘আমার তাবিজ ঠিকই আছে, কিন্তু মহামায়ার উপর তো আর মানুষের আত নাই, তেনি যদি পছন্দ করেন ফ্যালের আত কেডা বাচাইবো? তাবিজের ভিতর ঢুইকা তেনি হগ্‌গল বদলাইয়া দিবেন। কই, কেডা ফ্যাল্‌ হইছেন? আপনে? দেহি আপনের তাবিজ, খোলেন তো?’

সোমেশের তাবিজ খুলে ভেঙে ফেলা হলো। ভেতর থেকে ফুলের সঙ্গে বেরল পাকানো এক টুকরো কাগজ। তাতে লেখা: তুমি ফ্যাল হইবা। জ্যোতিষী সগর্বে বললেন: ‘আর কেডা কেডা ফ্যাল হইছেন? খোলেন তাবিজ।’ ভুঁদো আর ভোঁতার তাবিজ খুলে দেখা গেল: কাগজে একই কথা লেখা আছে।

এই অবধি গল্পর প্রথম পর্ব। ঘটনার গতি একমুখে চলেছে। এরপর শুরু হয় দ্বিতীয় পর্ব: 
"সোমেশের দলের মুখ চূন হইয়া গেল। জ্যোতিষালঙ্কার মহাশয় ঠোঁট দুটি শুয়োরের মত সরু করিয়া টিপিয়া টিপিয়া হাসি চাপিতে লাগিলেন; ভাবখানা–এবার কেমন জব্দ!

"হঠাৎ সিদ্ধেশ্বরের মাথায় কী খেয়াল চাপিল, সে কহিল—দেখি আমারটায় কী লেখা! আমি তো পাশ হয়েছি! জ্যোতিষালঙ্কার হাঁ হাঁ করিয়া উঠিলেন—কন্‌ কিঈ, পাশ করছেন তবু গঙ্গাজলে বিসর্জন দেন নাই! মহাপাতক করছেন—অখনই ছুইটা যান, মা গঙ্গার কাছে ক্ষমা চাইয়া তাবিজ ফেইলা দিয়া আসেন। ছি ছিছি! কিন্তু সিদ্দেশ্বর ততক্ষণে তাবিজ খুলিয়া ফেলিয়াছে। সকলে অবাক হইয়া দেখিল তার ভিতরেও পাকানো কাগজ এবং তাতেও গোটা গোটা অক্ষরে লেখা—তুমি ফ্যাল হইবা।

"যারা পাশ করেছিল তাদেরও তাবিজ খুলে দেখা গেল: প্রত্যেকটির মধ্যেই লেখা—তুমি ফ্যাল হইবা, তুমি ফ্যাল হইবা, তুমি ফ্যাল হইবা।"

গল্পটি এইখানেই শেষ হতে পারত, কিন্তু পাঠকের মন তাতে ভরত না। জ্যোতিষীকে কোনও শিক্ষা দেওয়া গেল কিনা সেটা জানার কৌতূহল তো থাকবেই। এই ব্যাপারটিতে ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য একটু যেন হতাশই করেন। সোমেশ ও তার বন্ধুরা যখন জ্যোতিষীর অন্য এক মক্কেলকে নিয়ে পড়েছে, সেই ফাঁকে জ্যোতিষীমশাই পা টিপে টিপে বাড়ির ভেতরে চলে গেছেন। ঝাড়া দুই ঘন্টা চিৎকার, চেঁচামেচি, ইত্যাদির পর ‘বোধহয় বাড়ির লোকদের মায়া হইল। উপরের বারান্দা হইতে সেদিনকার সেই খুকি দেখা দিল, কহিল—বাবুরা প্যাচাল পাড়বেন না! মাউসার প্যাটে ভঙ্কর ব্যাদনা হইছে, আইজ আর তেনি লামায় যাইবো না।‘

ক্ষিতীনবাবু কিন্তু জ্যোতিষের ছলনাকে শুধু পরীক্ষার্থীদের মধ্যেই আটকে রাখেন নি। জ্যোতিষীর লক্ষ্য ছিল আরও এক ধরণের লোক। তারা হলেন: বেকার। বাড়ির সাইনবোর্ডে বড় বড় অক্ষরে লেখা ছিল: উমেদারগণের মহা সুসময়

চাকুরির বাজারে নিষ্ফলভাবে ঘুরিয়া না বেড়াইয়া
এইখানে আসুন, জ্যোতিষালঙ্কারের
মন্ত্রপূত তাবিজে আপনার অবশ্য
চাকুরি লাভ ঘটিবে।

দ্বিতীয়দিন যখন সোমেশরা ঐ জ্যোতিষীর বাড়ি গেল, তখন তিনি বৈঠকখানাতেই ছিলেন, ‘তাঁর সামনে ছিল একটি অত্যন্ত গোবেচারা গোছের লোক। তারই হাতে তাবিজ বাঁধিতে বাঁধিতে তিনি বলিতেছেন—এই তাবিজে আপনের চাকরি না হইয়া পারে না, কিন্তু চাকরি পাইয়াই কইলাম তাবিজ গঙ্গাজলে নিক্ষেপ করতে ভুলবেন না। বোচ্ছেন নি!’ জ্যোতিষীর জোচ্চুরি ফাঁস হওয়ার পর সোমেশরা সেই গোবেচারা লোকটিকে কোনও কথা বলার ফুরসত না দিয়ে তার তাবিজটাও খুলে ফেলল। দেখা গেল, তার মধ্যে লেখা—তোমার চাকরি কস্মিনকালেও হইব না। সোমেশ বলল, ‘ওঃ, এই জন্যে আপনাকেও চাকরি পাওয়া মাত্র গঙ্গাজলে তাবিজ নিক্ষেপ করবার আদেশ দেওয়া হয়েছে।

পরীক্ষার্থীর পাশাপাশি কর্মপ্রার্থীকে এনে ক্ষিতীনবাবু একটি দারুণ কাজ করেছেন; জ্যোতিষীর কাজ শুধু ছাত্রদের ঠকানো—এই বার্তাটিও একই গল্পর ভেতর দিয়ে চমৎকার পৌঁছে দেওয়া হয়। জ্যোতিষীর কায়দাটি এক—চাকরি হলে ভালো, না-হলেও ক্ষতি নেই। মহামায়ার মায়া কে বুঝবে? তিনি যদি কাউকে চাকরি দিতে বা পরীক্ষায় পাশ করাতে না চান, তার ওপর তো আর জ্যোতিষীর ‘আত নাই’।

গল্পটা ঠিক কোন্‌ সালে লেখা তা জানা নেই! তবে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার কথা যখন আছে তখন নিশ্চয়ই ১৯৫২-র আগের কথা। নববিন্দু বৃত্ত-র বদলে নাইন-পয়েন্টস্‌ সার্কল্‌ থেকে অনুমান হয়: গল্পর ঘটনাকাল ১৯৩০ বা ’৪০ এর দশকও হতে পারে। তখনও পরীক্ষায় পাশ ফেল আর চাকরি পাওয়া না-পাওয়ার দুর্ভাবনা ও অনিশ্চয়তা ভালোমতোই ছিল—এখনকার মতোই। আর এই অনিশ্চয়তার সুযোগে ছোটো-বড়ো-মাঝারি নানা মাপের জ্যোতিষী দিব্যি করে খেত—এখনো যেমন করে খায়। ক্ষিতীনবাবু নিশ্চয়ই জ্যোতিষীদের মুখোশ খোলার উদ্দেশ্য নিয়েই গল্পটি ফেঁদেছিলেন। কিন্তু শুধু উদ্দেশ্য দিয়েই তো গল্পর ভালোমন্দ বিচার হয় না। গল্পটিকেও তো ভালো গল্প হতে হবে। 

এ ব্যাপারে ক্ষিতীনবাবু শতকরা একশ পাঁচ ভাগ সফল। প্রথম হলো চরিত্রসৃষ্টি। খড়ম পরে ‘এক ঝলক বিশুদ্ধ নস্যের গন্ধ’র ‘পিছুপিছু জ্যোতিষালঙ্কার মহাশয়ও ঢুকিলেন।’ তার পরের অংশটিও অ-সাধারণ:
"জ্যোতিষীমহাশয় যে নেহাত হাতুড়ে জ্যোতিষী নন, তা তাঁর প্রথম কথা হইতেই বুঝা গেল—বাবুরা বুঝি এবার মেট্রিক দিবেন? সোমেশ ও সিদ্ধেশ্বর মুগ্ধ হইয়া গেল; লোকটি পণ্ডিত, আবার কেমন ভদ্র। এখনও তো তারা কলেজে উঠে নাই, তবু কেমন ‘বাবু’ ‘আপনি’ বলিয়া কথা বলিতেছেন। বাঃ, বেশ তো!"

সাধুভাষায় বিবরণের সঙ্গে পূর্ববঙ্গীয় ভাষার সংলাপ মেশানো—শুধু সংলাপে নয়, তাবিজের ভিতরকার ভবিষ্যদ্‌বাণীতেও—গল্পটিকে আরও সুখপাঠ্য করে তুলেছে। সবচেয়ে ওস্তাদি মার জ্যোতিষীর বোনঝি। তাকে এক পয়সা ঘুষ দিয়ে সোমেশ আর সিদ্ধেশ্বর প্রথম দিন জ্যোতিষীর দেখা পেয়েছিল। সে-ই আবার দেখা দেয় গল্পর শেষে। বারান্দা থেকে ঝুঁকে পড়ে, মেশোমশায়ের জবানিতে শেষ সংলাপ দিয়ে গল্পটি সে-ই শেষ করে। 



কৃতজ্ঞতা স্বীকার:
পার্থসারথি মিত্র, শ্যামল চট্টোপাধ্যায়, সিদ্ধার্থ দত্ত, সৌম্যেন পাল


তথ্যসূত্র:

অমিয়কুমার চক্রবর্তী সম্পা। হালকা হাসির গল্প। অভ্যুদয় প্রকাশ মন্দির, ১৯৫৬
সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পা। ছোটোদের-কুসংস্কার-বিরোধী গল্প। খণ্ড ১ ও ২। র‍্যাডিক্যাল ইম্প্রেশন, ২০১০।
সৌমিত্র বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পা। বিশ শতকের কুসংস্কার-বিরোধী গল্প। র‍্যাডিক্যাল ইম্প্রেশন, ২০১২।

0 comments:

48

ব্যক্তিগত গদ্য - রাজা ভট্টাচার্য

Posted in


ব্যক্তিগত গদ্য


চলাচল
রাজা ভট্টাচার্য


আমার জীবনের সবচেয়ে সুখের দিন হলো - চাকরিতে জয়েন করার দিনটা। এস.এস.সি. পাশ করে গেছি, ফাইনাল লিস্টে নাম আছে - স্বচক্ষে দেখে এসেছি। সুতরাং আগের ছোট্ট চাকরিটা সদর্পে ছেড়ে এসেছি। বিয়ে করলাম সম্পূর্ণ বেকার অবস্থায়। এদিকে চিঠি আর আসে না। বৌ নিজের চাকরিতে জয়েন করে গেল, আমি বসে আছি বাড়িতে। সাধু ভাষায় যাকে বলে -"মরমে মরে আছি"! হেনকালে এক শনিবার দেবদূত - অর্থাৎ পিওন এসে সেই বহু-আকাঙ্ক্ষিত চিঠিটি দিয়ে গেল। কোনোক্রমে রোববারটা পার করে সোমবার রওনা দিলাম। তার আগে অবশ্য এক আত্মীয়র কাছ থেকে জেনে নিতে হলো - জে.এম.এভিনিউ কোথায়।

বহু কষ্টে, এক পুলিশ ভদ্রলোকের সাহায্যে খুঁজে পেলাম সেই স্কুল। এটা স্কুল! চেহারা আর আশপাশ দেখে চোখ কপালে উঠে গেল। একটা প্রকাণ্ড ভাঙাচোরা প্রাসাদ; দেখলে মনে হয় - এক্ষুনি ভেঙে পড়বে হুড়মুড়িয়ে। তারই বারবাড়িতে, বারান্দা আর অন্ধকার তিন-চারটে ঘর নিয়ে স্কুল বসে। ছাত্রদের সংখ্যা দেখলে কান্না পায়। আমার বিরাট মফস্বলী স্কুলে পড়ত বারো-শো ছেলে। এখানে কোনোদিন একশো ছেলে চলে এলে সবার জায়গা হবে না। অবিশ্যি সে দুর্দৈব কখনও ঘটে না, এই যা। ছেলেদের চেহারাও তেমনি - অধিকাংশ ছেলেই অসম্ভব গরিব, খেতে পায় না ভাল করে। বাইরের চেহারা আরও খারাপ। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে রং-মাখা স্বল্পবেশী মেয়েরা, এক কাপ চা খেতে যাওয়ারও সাহস হয় না আমার। টিপিক্যাল মধ্যবিত্ত মফস্বলী মন সংকুচিত হয়ে থাকে ভয়ে আর লজ্জায় - এই বুঝি আমায় কেউ দেখে ফেলল এই ‘খারাপ’ পাড়ায় - আর ভুল বুঝল। চাকরির দ্বিতীয় দিনেই দালালের খপ্পরে পড়ে গেলাম আমি - একা ফিরছিলাম - হাত ধরে টানাটানি করতে লাগল তাদেরই একজন -"চলিয়ে বাবু - ক্যায়সি লেড়কি চাহিয়ে - নেপাল কি লেড়কি-ভি মিলেগি বাবু"! আমি ভয়ে আর ঘেন্নায় কেঁচো হয়ে গেলাম। বাড়ি ফিরে কেঁদে ফেললাম ভীত শিশুর মতন। মা আর গিন্নি মিলে সান্ত্বনা দিতে লাগল আমায় - আর আমি ভাবতে লাগলাম - আমায় কী সম্ভাব্য ‘খদ্দেরের’ মতন দেখতে ?

কিছুদিনের মধ্যেই অবশ্য যাথারীতি কেটে গেল এসব মেকী আত্মগ্লানি। দ্রুত বুঝতে পারছিলাম - রাস্তায় যে মেয়েদের আমি দেখতে পাচ্ছি - তাদের অধিকাংশই অসম্ভব গরিব। আর তাদেরই ছেলেপুলেরা পড়ে আমার কাছে। আবার - কী আশ্চর্য - দর্জিপাড়া বা বাগবাজারের গৃহস্থবাড়ির ছেলেরাও দিব্যি তাদের পাশে বসেই পড়ে, একসাথেই খেলে, টিফিন খায়। ক্রমে ভাব হয়ে গেল বাচ্চাগুলোর সঙ্গেও। বুঝতে শিখলাম এদের। হ্যাঁ, এরা আলাদা - আর তাইই তো হওয়ার কথা! এরা তো আমার বা আমাদের মতন করে বড় হয় নি! অকাতরে মুখ-খারাপ করে বাচ্চাগুলো ; জানেই না - এটা খারাপ কিছু। ক্লাস ফাইভের ছোট্ট ছেলেও অম্লান কণ্ঠে বলে -"ওর কথা বিশ্বাস করবেন না স্যার, ও খুব হারামি আছে! " অনেকেই সকালে স্কুলে আসে না-খেয়ে ; পথে কিনে নেয় চিপস্ বা অমন কিছু। টিফিনে বাড়ি থেকে মা বা অন্য কেউ এসে দিয়ে যায় খাবার - ভাত বা রুটি। কেউ-বা গেটের ফাঁক দিয়ে হাত বাড়িয়ে কেনে ঝালমুড়ি, নইলে দারোয়ান বীরেনদার দাদার দোকান থেকে কচুরি। কারো বা পয়সা নেই, খাবারও আসে নি। কাঁদে সিঁড়িতে বসে। কোনও শিক্ষকের চোখে পড়ে গেলে খুব ধমক দিয়ে তার হাতে গুঁজে দেওয়া হয় পয়সা। চোখ মুছে লজ্জিত মুখে কচুরি কিনতে যায় সে ধীর পায়ে। ক্লাসে এসে ঢুলতে থাকে অনেকেই। জেরা করলে জানা যায় - রাত্তিরটা সে কাটায় ক্লাবে ; ঘরে থাকার জায়গা নেই। কেন নেই - তা বোঝার জন্য জিজ্ঞেসবাদ করতে হয় না। ভাল লেগে গেল স্কুলটাকে, আর এই অসহায় বাচ্চাগুলোকে। রাস্তায় দাঁড়ানো মেয়েগুলোও চিনে ফেলল নতুন মাস্টারকে - তাদেরও চোখের ভাষা এল নম্র হয়ে।

মাস-খানেক পরে একদিন হেড মাস্টারমশাই ডেকে পাঠিয়ে বললেন -"রাজা, সামনেই তো রবীন্দ্রজয়ন্তী। শুনলাম তুমি গান-টান গাও। তা এবার তাহলে ক’টা রবীন্দ্রসঙ্গীত তুলে দাও না বাচ্চাদের! গাইবে সব - যে ক’জন পারে।" এইসব অকাজে আমার অনন্ত উৎসাহ। কোমর বেঁধে নেমে পড়লাম ওমনি। আলমারি থেকে বেরলো ভাঙা হারমনিয়াম - বহুকাল তাতে হাত দেয় নি কেউ। আর আমাদের ভাঙা স্কুলবাড়িতে বহুদিন পর - বেজে উঠল সুর। বাচ্চাদের চোখ কপালে উঠে গেল। রাজাবাবু-স্যার (হ্যাঁ, এইটিই এই স্কুলের সরকারি আবাহন-বিধি) কী না পারেন, মায় হারমোনিয়াম বাজালে সুর বেরোয় - ভাবা যায়!! টিপে দেখা হলো সাদা-কালো রিড। তারপর গান বাছাই, লিখে নেওয়া, এবং রিহার্সাল শুরু।

প্রথমেই ধাক্কা লেগে গেল এদের গলা শুনে। সুর নেই যে কারোর গলায়! সুর আমার আজন্মের সংস্কার, এর মধ্যেই বড় হয়েছি। বেসুর বড় কষ্ট দেয় তাই। আর এরা গান বলতে বোঝে কুমার শানু আর বাবা সায়গল - তখন এদের গানই বাজত প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে। ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে’ শুনে এরা তাই তাকিয়ে থাকে হাঁ করে। শব্দ, সুর - সবই ওদের অচেনা ঠেকে। সব্বাই মিলে গান গাওয়ার ব্যাপারটা অন্য স্যারদেরও খুব একটা পছন্দ হয় নি। একজন তো সরাসরি বলেই দিলেন -"ওরে বাবা, সব কিছু কি আর সবার জন্য? " তা নয় অবশ্য, জানি সে কথা। এও জানি, ওদের মধ্যে যে-কজনের গলায় অল্পস্বল্প সুর আছে, তাদের আলাদা করে নিলেই গানগুলো একটু শোনার যুগ্যি হতো। কিন্তু যেই গানের রিহার্সাল শুরু হয় - অমনি ওদের পাকাটে মুখ আর চোরা চাউনি বদলে যায় যে! যেন আলো জ্বলে ওঠে অন্ধকার ঘরে, ওদের মুখগুলো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মাথা নেড়ে, বেঞ্চি থাবড়ে ওরা গাইতে থাকে -"মম চিত্তে নিতি নৃত্যে" - আর অমনি আমার আর ওদের ভাল, মন্দ, জন্ম, মৃত্যু - সব নেচে ওঠে তালে তালে - বুড়ো নোনাধরা দেওয়াল নেচে ওঠে - তা তা থৈ থৈ। আদ্যিকালের বাড়ির কড়ি-বরগা নড়ে ওঠে ওদের কচি গলার আধো-বেসুরো চিৎকারে -"কী আনন্দ, কী আনন্দ, কী আনন্দ!" কেমন করে বলি -"না রে, তোর গলায় সুর নেই, আর গাইতে হবে না। তুই বাদ!" কল্পনাই করতে পারি না - উৎসাহে জ্বলজ্বলে মুখটার কি দশা হবে এই কথাটা শুনলে। অসম্ভব। বরং আমার বেসুর সইবে, ওই মুখটা নয়। কাজেই চলতে লাগল আমাদের বিচিত্র মহড়া, জানলায় উঁকি মারতে লাগল অচেনা কৌতূহলী মুখ।

অবশেষে এল পঁচিশে বৈশাখ। সেই তিনটে দিনের একটা - যেদিন আমরা বাংলায় তারিখ বলি। হৈ হৈ করে হয়ে গেল অনুষ্ঠান। এরা অনেকেই পুজোর সাজ বানায়, রোজগারের একটা প্রধান উপায় সেটা। কাজেই ইশকুলের সাজগোজের ঘটা দেখে তাক লেগে গেল সবার। বিচিত্র পোষাকের গার্জিয়ানরা ভিতু ভিতু মুখে দেখতে এল অনুষ্ঠান, আর ছেলের গান বা আবৃত্তি শুনে গদগদ মুখে ফিরে গেল সগর্বে। ছেলেরাও খুশ, আম্মো তর। শুধু পরের দিন থেকেই ক্লাস শুরু হয়ে গেল পুরোদমে - এই যা এক দুঃখ। 

মাস-খানেক পরে একটা কর্মশালা শুরু হলো ওরিয়েন্টাল সেমিনারি স্কুলে। আমি আবার কিচ্ছু চিনি না কলকাতার পথঘাট। পুরনো মাস্টারমশাইদের জিজ্ঞেস করে চলে তো গেলাম। ফেরার পথে চিত্তির কাণ্ড ঘটল। বেরিয়েই এক ছাত্রের সঙ্গে দেখা। পেন্নাম করে, দু-এক কথার পর শুধলো - কোথায় যাব আমি। শোভাবাজার মেট্রো স্টেশনে যাবো শুনে বলল -"তাইলে আবার বিডন স্ট্রিট ধরতে যাবেন কেন স্যার? এই গলিটা দিয়ে সোজা চলে যান, বড় রাস্তায় উঠে যাবেন একবারে।" তা বেশ। ভাল করে বুঝে নিয়ে, ওর মাথায় একটু হাত বুলিয়ে ঢুকে পড়লাম সেই গলিতেই। বড্ড সরু গলি, দু’পাশে মাথা তুলে রয়েছে আদ্যিকালের সব বাড়ি। দিনেমানেই যেন অন্ধকার। তা হোক, একবার বড়রাস্তায় উঠে গেলেই নিশ্চিন্ত।

মিনিট পাঁচেক হাঁটার পরেই বুঝলাম - কিছু একটা গোলমাল করেছি। রাস্তা এখানে একটু চওড়া হয়েছে। দু-পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই রং-মাখা মিনি-স্কার্ট পরা মেয়েরা ; অকারণ হাসিতে ঢলে পড়ছে একে অপরের গায়ে। টলমল পায়ে দিনের বেলায় হেঁটে যাচ্ছে মাতাল, দালালের দল ভিড় জমিয়েছে মদের দোকানে - ডাক দিচ্ছে আমায় গলা ছেড়ে। কেউ কেউ সেই প্রথম দিনের মতন উঠে আসছে কাছে, হাঁটছে পাশে পাশে, মৃদু গলায় দর বলছে ঘন্টা-পিছু। হঠাৎ ফিরে এল সেই দ্বিতীয় দিনের স্মৃতি ; আমার সর্বাঙ্গ কাঠ হয়ে গেল, মাথা নীচু করে, কোনওদিকে না তাকিয়ে অন্ধের মতন হেঁটে চললাম আমি। আমার অবস্থা বুঝে খিলখিল করে হাসতে লাগল পথে-দাঁড়ান মেয়েরা। 

এমন সময় হঠাৎ কানে এল সুর। না, সিনেমায় দেখা সেই বাইজির মুজরার সুর নয়। সেই ভয়ানক অবস্থাতেও আমার চিনতে ভুল হলো না - কোনও একটা বাড়ি থেকে ভেসে আসছে আমার খুব চেনা একটা গান -"প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে..."! সুর-টুর হচ্ছে না মোটেই, কিন্তু খুব উৎসাহের সাথে, ফুর্তি করে গাইছে কয়েকটা বাচ্চা-গলা। ইচ্ছের বিরুদ্ধেই গতি কমে এল আমার। আর তক্ষুনি, সেই বাড়ির জানলা থেকে ভেসে এল চিল-চিৎকার -"ও স্যার, ও রাজাবাবু-স্যার! " আর সেই ডাকের পিছন পিছন, সামনে দাঁড়ান মেয়েদের ছত্রভঙ্গ করে ছুটে এল একদল বাচ্চা! আমাদেরই ইশকুলের ছেলে সব। অন্য পোষাকে এখন কেমন অন্যরকম দেখাচ্ছে তাদের, কিন্তু হাসি-ভরা মুখ আর চকচকে চোখ দেখলেই বোঝা যায় - যেমন অবাক, তেমনি খুশি হয়েছে তারা। পলকে ঘিরে ফেলে তারা প্রশ্ন করে চলল প্রাণভরে - এখানে কেন, কোত্থেকে ফিরছি ইত্যাদি। যখন বললাম - বড় রাস্তায় যেতে গিয়ে পথ গুলিয়ে গেছে - তখন তাদের খুশি দেখে কে! এহে, স্যার কিচ্ছু চেনেন না - এ এক ভারি মজার কথা। আমি জিজ্ঞেস করলাম -"তা তোরা এই বিকেলবেলায় মাঠে না গিয়ে ঘরে বসে গান গাইছিলি যে ?" সমবেত উত্তর এল -"আমরা তো স্যার রাত্তিরে খেলি, আলো জ্বললে। তাই এখন সবাই মিলে..."

উত্তেজিত গলায় আমার সঙ্গে গল্প করতে করতে চলল ওরা - পথ চিনিয়ে দিতে। দু’ পা হেঁটেই একজন বলল -"স্যার, ওই ‘আরও বেদনা, আরও বেদনা’ জায়গাটায় সুর ভুল হচ্ছিল, তাই না? " এই রে, অতটা তো তখন বোঝার অবস্থা ছিল না আমার। কিন্তু সে কথা তো আর স্বীকার করা যায় না ; কাজেই বললাম -"তাই বুঝি ? কই, গা দেখি আর একবার।" 

বলতে যা দেরি, গলা খুলে সব ক’টা মিলে চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় তুলে গান ধরল ফের -"আরও বেদনা, আরও বেদনা, প্রভু দাও মোরে আরও চেতনা...."

বুড়ো কলকাতার নিষিদ্ধ রাস্তায় হাঁটছিলাম আমরা; মফস্বল থেকে আসা এক শিক্ষক, আর জনাকয় শিশু-কিশোর। প্রায়ান্ধকার গলির বাতাস কেঁপে কেঁপে উঠছিল সুরের টানে টানে -"আরও আলো, আরও আলো, এই নয়নে প্রভু ঢালো..."

আমার আর ভয় করছিল না। সামনে তাকিয়ে দেখি - আমাদের অদ্ভূত দলটার সামনে সামনে হেঁটে চলেছেন এক লম্বা-পানা বুড়ো মানুষ। বদ্ধ গলিতেও সুরের হাওয়ায় হাওয়ায় উড়ছে তাঁর পাকা দাড়ি আর পরণের জোব্বা। কোনও জোড়াসাঁকো, কোনও শান্তিনিকেতন যাকে বাঁধতে পারে নি কোনও মতেই - তিনি এখন হাঁটছেন আমাদের আগে আগে। বরাবরের মতন আজও, নিশ্চিন্তে তাঁকে অনুসরণ করে হাঁটতে লাগলাম আমি। দূরে দেখা যাচ্ছিল বড়োরাস্তা। 

আর বাচ্চাগুলো তখন গাইছিল সমস্বরে - ভুলভাল সুরে - "আমারে বাঁধবি তোরা, সেই বাঁধন কী তোদের আছে?"


48 comments:

3

ব্যক্তিগত গদ্য - গৌতম দত্ত

Posted in





ব্যক্তিগত গদ্য

অনুভবে রবীন্দ্রনাথ 
গৌতম দত্ত



“দেখেছি তোমার নামে সবার প্রথমে
শ্রাবণে ধানের শিসে দুধটুকু জমে,
তোমারি তো নামে
বৈশাখে আখের খেতে যত মধু নামে |
তবুও হাজার হাতে হাওয়া দেয় ডাক,
কোথায় মাটির স্বপ্নে শিলীভূত পঁচিশে বৈশাখ |
কোথায় আকাশে বাজে সোনার সরোদ
পঁচিশে বৈশাখী ভোর গলে হয় গিনিসোনা-রোদ |

তুমি তো বনস্পতি তোমার পায়েতে থরে থরে
অজস্র শব্দের রং কৃষ্ণচূড়ার মতো ঝরে
তুমি এক অবাক মৌচাক
কথাগুলি চারপাশে ঘোরে যেন গুনগুন সুর এক ঝাঁক |

তোমার ছন্দের নদী জমা হতো যদি
পৃথিবীতে হতো মহাসমুদ্র-বলয়,
ঝুরঝুরে গানের মাটি জ’মে জ’মে হ’ত
আর-এক নতুন হিমালয়!

আকাশে বরুণে দূর স্ফটিক ফেনায়
ছড়ানো তোমার প্রিয়নাম,
তোমার পায়ের পাতা সবখানে পাতা----
কোনখানে রাখব প্রণাম!” ---- প্রণমি - কবি দিনেশ দাস

‘শ্রাবণে ধানের শিসে দুধটুকু জমে’ – এ-কথাটা যদি সত্যিই অনুভবযোগ্য মনে হয়, তাহলে সেই অনুভব-এর মতন আমাদের বাঙালী জীবনে মিশে আছেন রবীন্দ্রনাথ।

আমি বা আমরা যারা অন্তত বাঙালী এবং রবীন্দ্রনাথকে পড়েছি (কতখানি নিতে পেরেছি জানি না) তারা যে এই বিশ্বপৃথিবীতে কত ভাগ্যবান, সে কথা বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। আমি যদি আজ এই ভারতের অন্য প্রদেশে জন্মাতাম আর আমার মাতৃভাষা হতো অন্য কিছু তাহলে কি পারতাম এমন অনুভবে রবীন্দ্রনাথকে আত্মস্থ করতে ? 

মনে পড়ে আজও, যেদিন আমি এই ছবিটা প্রথম দেখলাম আর ভাঙা ভাঙা উচ্চারণে পড়লাম ছবির তলার লেখাগুলো :-


এক মুগ্ধতায় যে নিশ্চয় ভরে গেছিলাম তা আজ এই বয়সে এসে অনুমান করতে একটুও কষ্ট হয় না। অনেক পরে জেনেছিলাম যে, এই ছবিগুলো কার আঁকা? ঠাকুরবাড়ির আর এক উজ্জ্বল সন্তান অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর মশাই-এর।

আমার জন্ম কলকাতার প্রাচীন সিমলে পাড়ায়। দু-পা হাঁটলেই গৌরমোহন মুখার্জী স্ট্রীট। এক সরু গলির এক পুরোনো বাড়ি! আজ সেখানে ঝকঝকে স্বামী বিবেকানন্দ ইন্সটিটিউট। কত বার যে উঁকি মেরেছি বাবার হাত ধরে ও বাড়ির দরজায়, কিন্তু ঢোকার উপায় ছিল না অজস্র ভাড়াটিয়াদের বসবাসের মধ্যে। এখন নতুন বাড়িতে ঢুকে সব যেন অচেনা লাগে। মনে হয় ওই গলিটা যেন আজ পাল্টে গেছে।

আমাদের বাড়ি থেকে সেন্ট্রাল এভিনিউ পেরিয়ে মুখোমুখি একটা রাস্তা, এঁকেবেকে আমায় পৌঁছে দিত আমার মামার বাড়ি নতুন-বাজারের সামনে। তার থেকে একটু বাঁ-দিকে একটা গলির মধ্যে ছিল আমার মামার বাড়ি। আর সেই গলিটার থেকে চিৎপুরের ট্রাম লাইন ধরে কিছুটা দক্ষিণে গেলেই আমার জন্মস্থান ‘লোহিয়া মাতৃ-সেবাসদন’। তার থেকে আরও একটু ফুটপাথ ধরে এগোলেই চার মাথার একটা মোড়। গনেশটকির মোড়। (গনেশটকি’জ বলে একটা সিনেমা হল ছিল সে সময়। হলটা হয়ত এখনো আছে।) আর ওই মোড় পেরিয়ে দু-চার পা গেলেই আর এক বিখ্যাত বাড়ি – ‘জোড়াসাঁকো’র ঠাকুরবাড়ি’। 

প্রথম গেছিলাম বাবার হাত ধরে। একটু অবাক হয়ে ছিলাম প্রথমে। ঠাকুরবাড়িতে কোনও ঠাকুর না দেখতে পেয়ে। এ কথাটা বললাম এই জন্যে যে, আমাদের ওই অঞ্চলে তখন অনেকই ঠাকুরবাড়ি আর সেসব ঠাকুরবাড়িতে ঠাকুরই থাকত। হয় রাধা-কৃষ্ণ কিংবা কালী অথবা অন্য আরও কত দেব-দেবী।

তবে যখন বাড়িটায় ঢুকে ওই দাড়িওয়ালা মানুষটির ছবি দেখেছিলাম আর বাবা বলেছিলেন যে এই বাড়িতেই জন্মেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তখন আর আশ্চর্য হইনি, কারণ তার আগেই আমি ওই দাড়িওয়ালা বুড়োটাকে বেশ চিনে গেছি। আর মুখস্থও হয়ে গেছে :

“অঞ্জনা-নদী-তীরে চন্দনীগাঁয়ে
পোড়ো মন্দিরখানা গঞ্জের বাঁয়ে
জীর্ণ ফাটল ধরা—— এক কোণে তারি
অন্ধ নিয়েছে বাসা কুঞ্জবিহারী।
আত্মীয় কেহ নাই নিকট কী দূর,
আছে এক লেজ-কাটা ভক্ত কুকুর।
আর আছে একতারা, বক্ষেতে ধরে
গুন্‌গুন্‌ গান গায় গুঞ্জন-স্বরে।
গঞ্জের জমিদার সঞ্জয় সেন
দু-মুঠো অন্ন তারে দুই বেলা দেন। 
........................,”

খুব সম্ভবতঃ আমি তখন দ্বিতীয় শ্রেণী।

এই আমার ছোট্ট বেলার রবিঠাকুর। পঁচিশে বৈশাখের দিন হলেই বাবা এনে দিতেন রজনীগন্ধার গোড়ে মালা আর একখানা সাদা পদ্মফুল। আগের দিন থেকেই ছবি সাজিয়ে রেখে দিতাম সেই ছোটো থেকেই। এখন ছবিখানা আর পাড়া হয় না, দেয়াল থেকে। ওখানেই মালা পরেন তিনি। আর আমাদের বাঙালী জীবনে এই দিনটা এখন এক ঊৎসবে পরিণত হয়ে গেছে। বাইশে শ্রাবণ এখনও অত গুরুত্ব পায় নি যদিও।

রবীন্দ্রনাথের জন্ম হয়েছিল এই জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতেই বাঙলা ক্যালেন্ডারের ২৫শে বৈশাখে। বাঙলা সন ১২৬৮। আর বিলিতি মতে ৭ই মে, ১৮৬১। তখন কেমন ছিল আমাদের এই প্রাচীন কলকাতা : 

“শহরে শ্যাকরাগাড়ি ছুটছে তখন ছড়্‌ছড়্‌ করে ধুলো উড়িয়ে, দড়ির চাবুক পড়ছে হাড়-বের করা ঘোড়ার পিঠে। না ছিল ট্রাম, না ছিল বাস, না ছিল মোটরগাড়ি। তখন কাজের এত বেশি হাঁসফাঁসানি ছিল না, রয়ে বসে দিন চলত। বাবুরা আপিসে যেতেন কষে তামাক টেনে নিয়ে পান চিবতে চিবতে, কেউ বা পালকি চড়ে কেউ বা ভাগের গাড়িতে। যাঁরা ছিলেন টাকাওয়ালা তাঁদের গাড়ি ছিল তকমা-আঁকা, চামড়ার আধঘোমটাওয়ালা, কোচবাক্সে কোচমান বসত মাথায় পাগড়ি হেলিয়ে, দুই দুই সইস থাকত পিছনে, কোমরে চামর বাঁধা, হেঁইয়ো শব্দে চমক লাগিয়ে দিত পায়ে-চলতি মানুষকে। মেয়েদের বাইরে যাওয়া-আসা ছিল দরজাবন্ধ পালকির হাঁপ ধরানো অন্ধকারে, গাড়ি চড়তে ছিল ভারি লজ্জা। রোদবৃষ্টিতে মাথায় ছাতা উঠত না। কোনো মেয়ের গায়ে সেমিজ, পায়ে জুতো, দেখলে সেটাকে বলত মেমসাহেবি; তার মানে, লজ্জাশরমের মাথা খাওয়া। কোনো মেয়ে যদি হঠাৎ পড়ত পরপুরুষের সামনে, ফস্‌ করে তার ঘোমটা নামত নাকের ডগা পেরিয়ে, জিভ কেটে চট্‌ করে দাঁড়াত সে পিঠ ফিরিয়ে। ঘরে যেমন তাদের দরজা বন্ধ, তেমনি বাইরে বেরবার পালকিতেও; বড়োমানুষের ঝি-বউদের পালকির উপরে আরও একটা ঢাকা চাপা থাকত মোটা ঘেটাটোপের, দেখতে হতো যেন চলতি গোরস্থান। পাশে পাশে চলত পিতলে-বাঁধানো লাঠি হাতে দারোয়ানজি। ওদের কাজ ছিল দেউড়িতে বসে বাড়ি আগলানো, দাড়ি চোমরানো, ব্যাঙ্কে টাকা আর কুটুমবাড়িতে মেয়েদের পৌঁছিয়ে দেওয়া, আর পার্বণের দিনে গিন্নিকে বন্ধ পালকি-সুদ্ধ গঙ্গায় ডুবিয়ে আনা। দরজায় ফেরিওয়ালা আসত বাক্স সাজিয়ে,......”

একথা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের। ‘ছেলেবেলা’য়।

“মাস্টারমশায় মিটমিটে আলোয় পড়াতেন প্যারী সরকারের ফার্‌স্ট্‌বুক। প্রথমে উঠত হাই, তার পর আসত ঘুম, তার পর চলত চোখ-রগড়ানি।...”

আমরাও প্রথম ইংরেজি শিখতে পড়েছি এই প্যারী চরণ সরকারের “ফার্‌স্ট্‌বুক”। এখন শিশুদের আর লাগে না। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় হল, বইখানা এখনও বাজারে পাওয়া যায়। 

একথা বলার মানে হলো যে রবীন্দ্রনাথ জন্মেছিলেন আমার জন্মেরও ৯৫ বছর আগে। কিন্তু আমি বা আমার সম-সাময়িক মানুষেরা কিছুটা হলেও পেয়েছি আমাদের প্রাচীন কলকাতার সেই ব্যবহারিক ধারাবাহিকতাগুলো। তখন তো আমাদের পাড়ার চারপাশে এত ‘মডার্ন ডে স্কুল’ গজিয়ে ওঠেনি আর আমরাও স্যুট-প্যান্ট-টাই পরে স্কুলেও যাই নি। তাই হয়তো জীবনের মাধুর্য্য ছিল অনেক বেশী। সময় বহে যেত মন্দাক্রান্তায়!

“তখন জলের কল বসে নি। বেহারা কাঁখে করে কলসি ভরে মাঘ-ফাগুনের গঙ্গার জল তুলে আনত। একতলার অন্ধকার ঘরে সারি সারি ভরা থাকত বড়োবড়ো জালায় সারা বছরের খাবার জল। নীচের তলায় সেই-সব স্যাঁৎসেতে এঁধো কুটুরিতে গা ঢাকা দিয়ে যারা বাসা করেছিল কে না জানে তাদের মস্ত হাঁ, চোখ দুটো বুকে, কান দুটো কুলোর মতন, পা দুটো উলটো দিকে। সেই ভূতুড়ে ছায়ার সামনে দিয়ে যখন বাড়ি ভিতরের বাগানে যেতুম, তোলপাড় করত বুকের ভিতরটা,পায়ে লাগাত তাড়া। তখন রাস্তার ধারে ধারে বাঁধানো নালা দিয়ে জোয়ারের সময় গঙ্গার জল আসত। ঠাকুরদার আমল থেকে সেই নালার জল বরাদ্দ ছিল আমাদের পুকুরে। যখন কপাট টেনে দেওয়া হতো ঝরঝর কলকল করে ঝরনার মতো জল ফেনিয়ে পড়ত। মাছগুলো উলটো দিকে সাঁতার কাটবার কসরত দেখাতে চাইত। দক্ষিণের বারান্দার রেলিঙ ধরে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতুম। শেষকালে এল সেই পুকুরের কাল ঘনিয়ে, পড়ল তার মধ্যে গাড়ি-গাড়ি রাবিশ। পুকুরটা বুজে যেতেই পাড়াগাঁয়ের সবুজ-ছায়া-পড়া আয়নাটা যেন গেল সরে। সেই বাদামগাছটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু অমন পা ফাঁক করে দাঁড়াবার সুবিধে থাকতেও সেই ব্রহ্মদত্যির ঠিকানা আর পাওয়া যায় না।

ভিতরে বাইরে আলো বেড়ে গেছে।”

কবেই কবি বুঝেছিলেন এই “ভিতরে বাইরে আলো বেড়ে গেছে।” তখন থেকেই দেখতে পাচ্ছি সেই পুকুরগুলো গাড়ি-গাড়ি রাবিশ ফেলে বোজানোর চক্রান্ত শুরু হয়ে গেছে। ভাবুন, আজ থেকে প্রায় একশো চল্লিশ বা দেড়শো বছর আগে! আর শুধু আলোই বাড়েনি আজ, বারান্দা আর রেলিঙ উধাও হয়ে গেছে শহর থেকে, ভূতেরা আজ আর থাকবার জায়গা পায় না সুউচ্চ বহুতলের কোনও ফাঁকা ঘরে। অলস দুপুরে শোনা যায় না আর পায়রার বক্‌বকম্‌ সেই টানা বারান্দাগুলোর কার্নিশ থেকে।

রবীন্দ্রনাথের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ তখনকার দিনে বেশ ধনী মানুষই ছিলেন। কিন্তু বাড়িতে বাহুল্য ছিলই না কোনও। বালক রবির কথা শুনুন :

“জানিয়ে রাখি আমাদের চাল ছিল গরিবের মতো। গাড়িঘোড়ার বালাই ছিল না বললেই হয়। বাইরে কোণের দিকে তেঁতুল গাছের তলায় ছিল চালাঘরে একটা পালকিগাড়ি আর একটা বুড়ো ঘোড়া। পরনের কাপড় ছিল নেহাত সাদাসিধে। অনেক সময় লেগেছিল পায়ে মোজা উঠতে। যখন ব্রজেশ্বরের ফর্দ এড়িয়ে জলপানে বরাদ্দ হলো পাঁউরুটি আর কলাপাতা-মোড়া মাখন, মনে হলো আকাশ যেন হাতে নাগাল পাওয়া গেল। সাবেক কালের বড়োমানুষির ভগ্নদশা সহজেই মেনে নেবার তালিম চলছিল।

“আমাদের এই মাদুর-পাতা আসরে যে চাকরটি ছিল সর্দার তার নাম ব্রজেশ্বর। চুলে গোঁফে লোকটা কাঁচাপাকা, মুখের উপর টানপড়া শুকনো চামড়া, গম্ভীর মেজাজ, কড়া গলা, চিবিয়ে চিবিয়ে কথা। তার পূর্ব মনিব ছিলেন লক্ষ্মীমন্ত, নামডাকওয়ালা। সেখান থেকে তাকে নাবতে হয়েছে আমাদের মতো হেলায়-মানুষ ছেলেদের খবরদারির কাজে। শুনেছি গ্রামের পাঠশালায় সে গুরুগিরি করেছে। এই গুরুমশায়ি ভাষা আর চাল ছিল তার শেষ পর্যন্ত। বাবুরা ‘বসে আছেন’ না বলে সে বলত ‘অপেক্ষা করে আছেন’। শুনে মনিবরা হাসাহাসি করতেন। যেমন ছিল তার গুমোর তেমনি ছিল তার শুচিবাই। স্নানের সময় সে পুকুরে নেমে উপরকার তেলভাষা জল দুই হাত দিয়ে পাঁচ-সাতবার ঠেলে দিয়ে একেবারে ঝুপ করে দিত ডুব। স্নানের পর পুকুর থেকে উঠে বাগানের রাস্তা দিয়ে ব্রজেশ্বর এমন ভঙ্গীতে হাত বাঁকিয়ে চলত যেন কোনোমতে বিধাতার এই নোংরা পৃথিবীটাকে পাশ কাটিয়ে চলতে পারলেই তার জাত বাঁচে। চালচলনে কোনটা ঠিক, কোনটা ঠিক নয়, এ নিয়ে খুব ঝোঁক দিয়ে সে কথা কইত। এ দিকে তার ঘাড়টা ছিল কিছু বাঁকা, তাতে তার কথার মান বাড়ত। কিন্তু ওরই মধ্যে একটা খুঁত ছিল গুরুগিরিতে। ভিতরে ভিতরে তার আহারের লোভটা ছিল খুব চাপা। আমাদের পাতে আগে থাকতে ঠিকমতো ভাগে খাবার সাজিয়ে রাখা তার নিয়ম ছিল না। আমরা খেতে বসলে একটি একটি করে লুচি আলগোছে দুলিয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করত, ‘আর দেব কি?’ কোন উত্তর তার মনের মতো সেটা বোঝা যেত তার গলার সুরে। আমি প্রায়ই বলতুম, ‘চাই নে’ -তার পরে আর সে পীড়াপীড়ি করত না। দুধের বাটিটার ‘পরেও তার অসামাল রকমের টান ছিল, আমার মোটে ছিল না। শেলফওয়ালা একটা আলমারি ছিল তার ঘরে। তার মধ্যে একটা বড়ো পিতলের বাটিতে থাকত দুধ, আর কাঠের বারকোশে লুচি তরকারি। বিড়ালের লোভ জালের বাইরে বাতাস শুঁকেশুঁকে বেড়াত।

“এমনি করে অল্প খাওয়া আমার ছেলেবেলা থেকেই দিব্যি সয়ে গিয়েছিল। সেই কম খাওয়াতে আমাকে কাহিল করেছিল এমন কথা বলবার জো নেই। যে ছেলেরা খেতে কসুর করত না তাদের চেয়ে আমার গায়ের জোর বেশি বই কম ছিল না। শরীর এত বিশ্রী রকমের ভালো ছিল যে, ইস্কুল পালাবার ঝোঁক যখন হয়রান করে দিত তখনও শরীরে কোনোরকম জুলুমের জোরেও ব্যামো ঘটাতে পারতুম না। জুতো জলে ভিজিয়ে বেড়ালুম সারাদিন, সর্দি হলো না। কার্তিক মাসে খোলা ছাদে শুয়েছি, চুল জামা গেছে ভিজে, গলার মধ্যে একটু খুসখুসানি কাশিরও সাড়া পাওয়া যায় নি। আর পেট-কামড়ানি বলে ভিতরে ভিতরে বদহজমের যে একটা তাগিদ পাওয়া যায় সেটা বুঝতে পাই নি পেটে, কেবল দরকারমতো মুখে জানিয়েছি মায়ের কাছে। শুনে মা মনে মনে হাসতেন, একটুও ভাবনা করতেন বলে মনে হয় নি। তবু চাকরকে ডেকে বলে দিতেন, ‘আচ্ছা যা, মাস্টারকে জানিয়ে দে, আজ আর পড়াতে হবে না’। আমাদের সেকেলে মা মনে করতেন, ছেলে মাঝে মাঝে পড়া কামাই করলে এতই কি লোকসান। এখনকার মায়ের হাতে পড়লে মাস্টারের কাছে তো ফিরে যেতেই হতো, তার উপরে খেতে হতো কানমলা। হয়তো বা মুচকি হেসে গিলিয়ে দিতেন ক্যাস্টর অয়েল। চিরকালের জন্যে আরাম হতো ব্যামোটা। দৈবাৎ কখনো আমার জ্বর হয়েছে; তাকে চক্ষেও দেখি নি। ডাক্তার একটু গায়ে হাত দিয়েই প্রথম দিনের ব্যবস্থা করতেন ক্যাস্টর অয়েল আর উপোস। জল খেতে পেতুম অল্প একটু, সেও গরম জল। তার সঙ্গে এলাচদানা চলতে পারত। তিন দিনের দিনই মৌরলা মাছের ঝোল আর গলা ভাত উপোসের পরে ছিল অমৃত।

“জ্বরে ভোগা কাকে বলে মনে পড়ে না। ম্যালেরিয়া বলে শব্দটা শোনাই ছিল না। ওয়াক-ধরানো ওষুধের রাজা ছিল ঐ তেলটা, কিন্তু মনে পড়ে না কুইনীন। গায়ে ফোড়াকাটা ছুরির আঁচড় পড়ে নি কোনোদিন। হাম বা জলবসন্ত কাকে বলে আজ পর্যন্ত জানি নে। শরীরটা ছিল একগুঁয়ে রকমের ভালো। মায়েরা যদি ছেলেদের শরীর এতটা নীরুগী রাখতে চান যাতে মাস্টারের হাত এড়াতে না পারে তা হলে ব্রজেশ্বরের মতো চাকর খুঁজে বের করবেন। খাবার-খরচার সঙ্গে সঙ্গেই সে বাঁচাবে ডাক্তার-খরচা; বিশেষ করে এই কলের জাঁতার ময়দা আর এই ভেজাল দেওয়া ঘি-তেলের দিনে।”

‘জলপানে বরাদ্দ হলো পাঁউরুটি আর কলাপাতা-মোড়া মাখন’। আমাদেরও ছোটোবেলায় এই কলাপাতা-মোড়া মাখন যার রঙ ছিল সাদা, তা পাঁউরুটি দিয়েই খেয়েছি কতোদিন। সেই পুরনো কলকাতার অনেক কিছুরই স্বাদ আমরা নিতে পেরেছিলাম। কিন্তু এত আলো বেড়ে গিয়ে সেসব স্বর্ণালী দিনগুলো আস্তে আস্তে হারিয়েই গেল, কলকাতার নাগরিক জীবন থেকে।

এত লাইনের পর লাইন উদ্ধৃতি দিয়ে হয়ত একটু বোঝানোর চেষ্টা করছি যে, তখনকার দিনে অত বড়লোক ঘরেও চলতো “simple living and high thinking”। আমাদের জমানাতেও আমরা এই ভাবেই মানুষ হয়েছি। এটা এই কারণে বলছি যে, আমাদের সাধারণ স্কুল বা কলেজেও অনেক বড়লোক ছেলে-মেয়েরাও পড়াশোনা করতো। কিন্তু আমাদের মেলামেশায় তা কোনও দিন বাধা হয়ে ওঠেনি। 

আমাদের ছেলেবেলায়ও দেখেছি আমাদের বাড়িতে চাকর বা রান্নার ঠাকুর থাকতে। আর আমাদেরও ছোটোবেলায় জ্বর হলেই উপোষ ছিল একেবারে বাধা। কতখানি ডিসিপ্লিন তখন মেনে চলতে হতো তা আমরাও অনুভব করেছি। 

“আহারে আমাদের শৌখিনতার গন্ধও ছিল না। কাপড়চোপড় এতই যৎসামান্য ছিল যে এখনকার ছেলের চক্ষে তাহার তালিকা ধরিলে সম্মানহানির আশঙ্কা আছে। বয়স দশের কোঠা পার হইবার পূর্বে কোনোদিন কোনো কারণেই মোজা পরি নাই। শীতের দিনে একটা সাদা জামার উপরে আর-একটা সাদা জামাই যথেষ্ট ছিল। ইহাতে কোনোদিন অদৃষ্টকে দোষ দিই নাই। কেবল, আমাদের বাড়ির দরজি নেয়ামত খলিফা অবহেলা করিয়া আমাদের জামায় পকেট-যোজনা অনাবশ্যক মনে করিলে দুঃখ বোধ করিতাম-- কারণ, এমন বালক কোনো অকিঞ্চনের ঘরেও জন্মগ্রহণ করে নাই, পকেটে রাখিবার মতো স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি যাহার কিছুমাত্র নাই; বিধাতার কৃপায় শিশুর ঐশ্বর্য সম্বন্ধে ধনী ও নির্ধনের ঘরে বেশি কিছু তারতম্য দেখা যায় না।” 

আজকের আমাদের এই অণু-সংসারে কি ভাবতেও পারি এমন কথা ? ছোটো থেকে আমরাও আদর পেয়েছি প্রচুর। কিন্তু তার সাথে সাথে ছিল এক নীরব নিয়মানুবর্তিতা, সব যৌথ সংসারেই। সে সবের পাট বালাই আর খুঁজে পাওয়া দায়! রবীন্দ্রনাথ তো কবেই লিখে গেছেন :

“আমাদের চেয়ে যাঁহারা বড়ো তাঁহাদের গতিবিধি, বেশভূষা, আহারবিহার, আরাম-আমোদ, আলাপ-আলোচনা, সমস্তই আমাদের কাছ হইতে বহুদূরে ছিল। তাহার আভাস পাইতাম, কিন্তু নাগাল পাইতাম না। এখনকার কালে ছেলেরা গুরুজনদিগকে লঘু করিয়া লইয়াছে; কোথাও তাহাদের কোনো বাধা নাই এবং না চাহিতেই তাহারা সমস্ত পায়। আমরা এত সহজে কিছুই পাই না। কত তুচ্ছ সামগ্রীও আমাদের পক্ষে দুর্লভ ছিল; বড়ো হইলে কোনো-এক সময়ে পাওয়া যাইবে, এই আশায় তাহাদিগকে দূর ভবিষ্যতের-জিম্মায় সমর্পণ করিয়া বসিয়া ছিলাম। তাহার ফল হইয়াছিল এই যে, তখন সামান্য যাহাকিছু পাইতাম তাহার সমস্ত রসটুকু পুরা আদায় করিয়া লইতাম, তাহার খোসা হইতে আঁঠি পর্যন্ত কিছুই ফেলা যাইত না। এখনকার সম্পন্ন ঘরের ছেলেদের দেখি, তাহারা সহজেই সব জিনিস পায় বলিয়া তাহার বারো-আনাকেই আধখানা কামড় দিয়া বিসর্জন করে-- তাহাদের পৃথিবীর অধিকাংশই তাহাদের কাছে অপব্যয়েই নষ্ট হয়।”

একেই কি বলে পরিবর্তন? আমরা বলি বটে যে, কলকাতার অবক্ষয় শুরু হয়েছে দূরদর্শন আর মোবাইল ফোনের হাত ধরে! কিন্তু সেটা সত্যি কি না, তা আমাদের ভেবে দেখার সময় এসেছে। কতদিন আগেই তো রবীন্দ্রনাথ অনুভব করেছিলেন এই সত্য। তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, কলকাতার ব্যবহারিক পরিবর্তন শুরু হয়ে গেছে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রায় গোড়া থেকেই। চোরাস্রোতের মতন সে পরিবর্তন আমাদের মতন সাধারণের চোখে ধরা না দিলেও, বিশ্বকবির দূরদৃষ্টি’র চোখ তা এড়ায় নি। 

আমাদের ছোটোবেলায় দেখা সবকিছুই, রবীন্দ্রনাথও দেখেছিলেন এই ভাবে :

“চৈৎ-বৈশাখ মাসে রাস্তায় ফেরিওয়ালা হেঁকে যেত ‘বরীফ’। হাঁড়িতে বরফ-দেওয়া নোনতা জলে ছোটো ছোটো টিনের চোঙে থাকত যাকে বলা হোত কুলফির বরফ, এখন যাকে বলে অইস কিংবা আইসক্রীম। রাস্তার দিকের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেই ডাকে মন কী রকম করত তা মনই জানে। আর-একটা হাঁক ছিল ‘বেলফুল’। বসন্তকালের সেই মালীদের ফুলের ঝুড়ির খবর আজ নেই, কেন জানি নে। তখন বাড়িতে মেয়েদের খোঁপা থেকে বেলফুলের গোড়ে মালার গন্ধ ছড়িয়ে যেত বাতাসে। গা ধুতে যাবার আগে ঘরের সামনে বসে সমুখে হাত-আয়না রেখে মেয়েরা চুল বাঁধত। বিনুনি-করা চুলের দড়ি দিয়ে খোঁপা তৈরি হতো নানা কারিগরিতে। তাদের পরনে ছিল ফরাসডাঙার কালাপেড়ে শাড়ি, পাক দিয়ে কুঁচকিয়ে তোলা। নাপতিনি আসত, ঝামা দিয়ে পা ঘসে আলতা পরাত। মেয়েমহলে তারাই লাগত খবর-চালাচালির কাজে।”

এ সব কিছুই আমার চোখে এখনও ভাসছে। ‘মালাই-বরফ’, ‘বেলফুল’ কিংবা ‘মাটি-ইই’-র ডাক শুনতে শুনতে কেটেছে আমাদের সেই ছোট্ট গলিখানা। বিকেল হলেই আমাদের বাড়ীর ছোটো টানা বারান্দায় মা-ঠাকুমাদের দেখেছি বিনুনি করে খোঁপা বাঁধতে। গ্রীষ্মকালে এই চুল বাঁধার পর গা-ধুয়ে মা-ঠাকুমা যখন কাচা শাড়ি পরতেন, তখন মা-ঠাকুমাদের গায়ে যেন লেগে থাকতো বিকেলের গন্ধ। নাপতিনি হয়তো রোজ আসতোনা, কিন্তু হপ্তায় একদিন মা-ঠাকুমাদের পায় এক-রকমের লাল তুলো দিয়ে আলতা পরানোর ছবি এখনও মনে আছে আমার।

আজ এই লেখা লিখতে লিখতে মনে হচ্ছে আমি কত ভাগ্যবান! বিশ্বকবির চোখে দেখা সে-দিনের কলকাতার স্মৃতি আমি একটু হলেও চোখে দেখেছি। আজ তা স্বপ্ন! 

“আগেকার কালটা ছিল যেন রাজপুত্তুর। মাঝে-মাঝে পালপার্বণে যখন মর্জি হতো আপন এলেকায় করত দান-খয়রাত। এখনকার কাল সদাগরের পুত্তুর, হরেক রকমের ঝকঝকে মাল সাজিয়ে বসেছে সদর রাস্তার চৌমাথায়। বড়ো রাস্তা থেকে খদ্দের আসে, ছোটো রাস্তা থেকেও।”

(ঊপরের সব উদ্ধৃতি)--ছেলেবেলা – রবীন্দ্রনাথ।

সত্যি! বড্ড বেড়ে গেছে খদ্দের!

অবক্ষয় যে তাঁর কাল থেকেই একটু একটু করে শুরু হয়েছে তা বুঝেছিলেন তিনি। অনেকে হয়ত বেশ তেড়েফুঁড়ে বলবেন, - সে আবার কি? অবক্ষয় বলছেন কেন? বলুন প্রগতি—। সত্যি কি তাই? আমি জানি না। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন :

“এখনকার নিয়ম হচ্ছে প্রথমে হারমোনিয়মে সুর লাগিয়ে সা রে গা মা সাধানো, তার পরে হালকা গোছের হিন্দি গান ধরিয়ে দেওয়া। তখন আমাদের পড়াশুনোর যিনি তদারক করতেন তিনি বুঝেছিলেন, ছেলেমানুষি ছেলেদের মনের আপন জিনিস,আর ঐ হালকা বাংলা ভাষা হিন্দি বুলির চেয়ে মনের মধ্যে সহজে জায়গা করে নেয়। তা ছাড়া, এ ছন্দের দিশি তাল বাঁয়া-তবলার বোলের তোয়াক্কা রাখে না। আপনা-আপনি নাড়িতে নাচতে থাকে। শিশুদের মন-ভোলানো প্রথম সাহিত্য শেখানো মায়ের মুখের ছড়া দিয়ে, শিশুদের মন-ভোলানো গান শেখানোর শুরু সেই ছড়ায়—এইটে আমাদের উপর দিয়ে পরখ করানো হয়েছিল।

তখন হারমোনিয়ম আসে নি এ দেশের গানের জাত মারতে, কাঁধের উপর তম্বুরা তুলে গান অভ্যেস করেছি। কল-টেপা সুরের গোলামি করি নি।

তখনকার কালের শৌখিন গিন্নিরা রঙ সাফ করবার সরঞ্জাম কৌটোতে করে কিনে আনেন বিলিতি দোকান থেকে, তখন তাঁরা মলম বানাতেন নিজের হাতে। তাতে ছিল বাদাম-বাটা, সর, কমলালেবুর খোসা, আরও কত কী-- যদি জানতুম আর মনে থাকত তবে বেগম-বিলাস নাম দিয়ে ব্যাবসা করলে সন্দেশের দোকানের চেয়ে কম আয় হতো না।

“তখনকার কালের সঙ্গে এখনকার কালের তফাত ঘটেছে এ কথা স্পষ্ট বুঝতে পারি যখন দেখতে পাই আজকাল বাড়ির ছাদে না আছে মানুষের আনাগোনা, না আছে ভূতপ্রেতের। পূর্বেই জানিয়েছি, অত্যন্ত বেশি লেখাপড়ার আবহাওয়ায় টিঁকতেনা পেরে ব্রহ্মদৈত্য দিয়েছে দৌড়। ছাদের কার্নিসে তার আরামে পা রাখবার গুজব উঠে গিয়ে সেখানে এঁঠো আমের আঁঠি নিয়ে কাকেদের চলেছে ছেঁড়াছেঁড়ি। এ দিকে মানুষের বসতি আটক পড়েছে নীচের তলার চারকোনা দেয়ালের প্যাক্‌বাক্সে।”

এর মধ্যেই বড় হয়ে উঠছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বাংলা ভাষাকে একটা জায়গা দিতে, কি না করেছেন। আর আজ আমরা চাইছি, আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলাকে যত দ্রুত ভুলে যেতে পারি। আজকালকার জগতে টিঁকে থাকতে হলে ‘সাহেব’ হতেই হবে। তাই চতুর্দিকে তারই আয়োজন চলছে। কিন্তু এই ভাবে চলতে পারে কি একটা গোটা জাতি? অবশ্য এই কথা আমি এখনই বা বলি কেন! এই সমস্যা রবীন্দ্রনাথের সময়েও যে ছিল তার প্রমাণ পাই :

“আমাদের বাল্যকালেও দেশের সাহিত্যসমাজ ও দেশের শিক্ষিত সমাজের মাঝখানকার ব্যবধানরেখা অনেকটা স্পষ্ট ছিল। তখনো ইংরেজি রচনা ও ইংরেজি বক্তৃতায় খ্যাতি লাভ করিবার আকাঙ্খা ছাত্রদের মনে সকলের চেয়ে প্রবল ছিল। এমন-কি, যাঁহারা বাংলা সাহিত্যের প্রতি কৃপাদৃষ্টিপাত করিতেন, তাঁহারা ইংরেজি মাচার উপরে চড়িয়া তবে সেটুকু প্রশ্রয় বিতরণ করিতে পারিতেন। সেইজন্য তখনকার দিনে মধুসূদনকে মধুসূদন, হেমচন্দ্রকে হেমচন্দ্র, বঙ্কিমকে বঙ্কিম জানিয়া আমাদের তৃপ্তি ছিল না-- তখন কেহ বা বাংলার মিল্টন, কেহ বা বাংলার বায়রন, কেহ বা বাংলার স্কট বলিয়া পরিচিত ছিলেন-- এমন-কি, বাংলার অভিনেতাকে সম্মানিত করিতে হইলে তাঁহাকে বাংলার গ্যারিক বলিলে আমাদের আশ মিটিত, অথচ গ্যারিকের সহিত কাহারো সাদৃশ্য নির্ণয় আমাদের পক্ষে সম্ভবপর ছিল না, কারণ গ্যারিক যখন নটলীলা সংবরণ করিয়াছিলেন তখন আমাদের দেশের নাট্যাভিনয় যাত্রার দলের মধ্যে জন্মান্তর যাপন করিতেছিল।

“......একদিন গেছে যখন আমাদের শিক্ষিত লোকেরা ইংরেজি পুঁথির প্রত্যেক কথাই বেদবাক্য বলিয়া জ্ঞান করিত। ইংরেজিগ্রস্ততা এতদূর পর্যন্ত সাংঘাতিক হইয়া উঠিয়াছিল যে, ইংরেজি বিধি বিধানের সহিত কোনোপ্রকারে মিলাইতে না পারিয়া জামাইষষ্ঠী ফিরাইয়া দিয়াছে এবং আমোদ করিয়া বান্ধবের গায়ে আবির-লেপনকে চরিত্রের একটা চিরস্থায়ী কলঙ্ক বলিয়া গণ্য করিয়াছে-- এতবড়ো শিক্ষিত-মূর্খতার প্রমাণ আমরা পাইয়াছি।”

বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ এক অভ্যর্থনা সভায় ছাত্রদের সম্ভাষণ করছেন কবি এই বলে :

“পূর্বে এমন দিন ছিল যখন ইংরেজি পাঠশালা হইতে আমাদের একেবারে ছুটি ছিল না। বাড়ি আসিতাম, সেখানেও পাঠশালা পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিয়া আসিত। বন্ধুকেও সম্ভাষণ করিতাম ইংরেজিতে, পিতাকেও পত্র লিখিতাম ইংরেজিতে, প্রাণের কথা বলিতাম ইংরেজি কাব্যে, দেশের লোককে সভায় আহ্বান করিতাম ইংরেজি বক্তৃতায়। আজ যখন সেই পাঠশালা হইতে, একেবারে না হউক, ক্ষণে ক্ষণে ছুটি পাইয়া থাকি তখন সেই ছুটির সময়টাতে আনন্দ করিব কোথায়? মাতার অন্তঃপুরে নহে কি? দিনের পড়া তো শেষ হইল, তার পরে ক্রিকেট খেলাতেও নাহয় রণজিৎ হইয়া উঠিলাম। তার পরে? তার পরে গৃহবাতায়ন হইতে মাতার স্বহস্ত জ্বালিত সন্ধ্যাদীপটি কি চোখে পড়িবে না? যদি পড়ে, তবে কি অবজ্ঞা করিয়া বলিব ‘ওটা মাটির প্রদীপ’? ঐ মাটির প্রদীপের পশ্চাতে কি মাতার গৌরব নাই? যদি মাটির প্রদীপই হয় তো সে দোষ কার? মাতার কক্ষে সোনার প্রদীপ গড়িয়া দিতে কে বাধা দিয়াছে? যেমনই হউক না কেন, মাটিই হউক আর সোনাই হউক, যখন আনন্দের দিন আসিবে তখন ঐখানেই আমাদের উৎসব, আর যখন দুঃখের অন্ধকার ঘনাইয়া আসে তখন রাজপথে দাঁড়াইয়া চোখের জল ফেলা যায় না-- তখন ঐ গৃহ ছাড়া আর গতি নাই।”

একে কি বলবো আমরা ? ভবিষ্যতের রূপরেখা তিনি লিখে গেছেন তাঁর অজস্র বক্তৃতা, বাণী আর লেখার মধ্যে। তিনি জানতেন যে রাজনীতি কোথায় যেতে পারে। আর তাই এই ‘বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ’-এর বক্তৃতার এক জায়গায় তিনি বলছেন :

“আমরা যাহাকে পলিটিক্‌স্‌ বলি তাহার মধ্যেও এই ভাবটা দেখিতে পাই। প্রথমে যাহা সানুনয় প্রসাদভিক্ষা ছিল দ্বিতীয় অবস্থাতে তাহার ঝুলি খসে নাই, কিন্তু তাহার বুলি অন্যরকম হইয়া গেছে—ভিক্ষুকতা যতদূর পর্যন্ত উদ্ধত স্পর্ধার আকার ধারণ করিতে পারে তাহা করিয়াছে।” --আত্মশক্তি - ছাত্রদের প্রতি সম্ভাষণ।

আর এই রকম প্রজ্ঞার একজনকে পেয়েও আমরা কি করেছি? জীবিতকালেই ব্যঙ্গ করেছি তাঁকে নিয়ে। সমালোচনায় ভরিয়ে দিয়েছি অজস্র পাতা। অসম্মান করেছি কত বার! আজ সে-সব স্বীকার করা হচ্ছে! সত্য বড় নিষ্ঠুর! আরও কষ্ট হয়, ব্যথা পাই যখন আমার এই বয়সে এসে দেখতে হয়, বিশ্বকবি আর তাঁর বৌঠান কাদম্বরী দেবী-কে নিয়ে রগরগে লেখাযুক্ত বই আজকের বই-পাড়ার বেস্টসেলার! সত্য সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ!

“১৯৩৪-৩৫ সালে তরুণ মার্ক্সবাদীদের মধ্যে দেখছি রবীন্দ্রসাহিত্যকে এক নিঃশ্বাসে ফিউডাল বাবুর্জোয়া বলে ধূলিসাৎ করবার চেষ্টা—আরও বাকচাতুর্য্যের সাহায্যে যার জের আজও টেনে চলেছেন নিরুক্ত গোষ্ঠি। রাজনীতির দিক থেকে তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে ছিলাম এতে পীড়িত হতাম খুবই। ক্রমাগতই মনে হতো এদের মুখের বড়াই সত্ত্বেও এরা নিশ্চয়ই লুকিয়ে লুকিয়ে রবীন্দ্রনাথের গান ভালবাসে। আজ যে তারা রবীন্দ্রসাহিত্যের ঐতিহ্যকে শ্রদ্ধা করতে পেরেছে এ আমারই ব্যক্তিগত জয়লাভ। কবিগুরুর শবদেহের পরে অজস্র ফুলের মালার ভীড়ের মধ্যে সংগোপনে অথচ পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে তখনকার দিনে রবে-আইনি কম্যুনিষ্ট পার্টির দেওয়া একখানা মালা লক্ষ্য করা গিয়েছিল। সে মালাটির ব্যঞ্জনা ছিল আমার কাছে গভীর। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে মার্ক্সবাদ যে শৈশবকাল উত্তীর্ণ হয়েছে তারই সাক্ষ্য ছিল সেটী।”–– রবীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকার –চিন্মোহন সেহানবীশ– ৪৬ নং একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন প্রসঙ্গে।

“...... একথাও মনে রাখা দরকার যে সেদিন কমরেড ভবানী সেনের মত বড়ো মাপের নেতা ঐ বিতর্কে ভ্রান্ত মতের প্রবক্তা হওয়া সত্ত্বেও সেদিনও ঐ মত কমিউনিস্ট শিবিরে সর্ববাদীসম্মত হয়নি, আর অচিরে তিনি নিজেও সে-মত বর্জন করেছিলেন পুরোপুরি।......” – আমরা ও ওরা–চিন্মোহন সেহানবীশ– ৪৬ নং একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন প্রসঙ্গে।

অর্থাৎ পরবর্তী কালে সংশোধিত হলেও রবীন্দ্রনাথ ও আখ্যাত হয়েছিলেন ‘বুর্জোয়া’ বলে। জীবিতকালেই কবি বারংবার আক্রান্ত হয়েছেন বিচিত্র সব সমালোচনায়! এই প্রসঙ্গে আমি শ্রী তিতাশ চৌধুরী’র একটি ওয়েব-প্রকাশিত “রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ”– নামক প্রবন্ধ থেকে আরো কিছু উদাহরণ দেবার চেষ্টা করছি।

“ ‘সোনার তরী’ কবিতা এবং কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের সেই সময় কবিকে কিরূপ সহ্য করতে হয়েছিল তা জানা যায় প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের একটি লেখা থেকে। এই একটি কবিতা নিয়ে বাংলা সাময়িক সাহিত্যে যে পরিমাণ অমৃত ও গরল মথিত হয়ে উঠেছিল, তা বোধ হয় রবীন্দ্রনাথের কোনো একটি রচনা সম্বদ্ধে কী পূর্বে কী পরে কখনো হয়নি। আসলে কবিতা উপলক্ষমাত্র, কবিই আক্রমণের লক্ষ্য। তার কারণ, রবীন্দ্রনাথের বহুমুখী প্রতিভার বৈশিষ্ট্য দেশের শিক্ষিত সমাজের বড়ো একটা অংশ স্বীকার করে নিচ্ছিল বলেই, আরেক দলের সেটাকে হেয় প্রমাণ করবার একান্ত প্রয়োজন হয়েছিল।”

বাঙলা ভাষার আর এক বিখ্যাত সাহিত্যিক এবং বিখ্যাত নাট্যকার ডি. এল রায় অর্থাৎ দ্বিজেন্দ্রলাল রায় রবীন্দ্রনাথের ইংল্যান্ড যাওয়াকে কেন্দ্র করে ‘আনন্দ-বিদায়’ শীর্ষক একটি ব্যঙ্গ-নাটক রচনা করেছিলেন এবং তাতে তিনি কি রূপ বিষোদ্গার করেছিলেন তা বোঝা যায় “একাধারে কবি, অধিকারী ঋষি কিবা ত্যাগ কিবা দান, পরিষদ জল ছিটায়ে দিলেই (কবিবর) স্বর্গে উঠিয়া যান”, ইত্যাদি বলে। এছাড়াও তিনি রবীন্দ্রনাথের ‘বিজয়িনী’ ও ‘উব্বর্শী’র বিরুদ্ধেও অশ্লীলতার অভিযোগ খাড়া করেছিলেন। সাহিত্য পত্রিকার ১৩১৩ সালের জৈষ্ঠ্য সংখ্যার রবীন্দ্রনাথের কাব্য নাট্য ‘চিত্রাঙ্গদা’র বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ এনে তিনি একে দগ্ধ করারও পরামর্শ দিয়েছিলেন।

তদানীন্তন ‘হিতবাদী’ পত্রিকার তরুণ সম্পাদক কালী প্রসন্ন কাব্য বিশারদ। রবীন্দ্রনাথের ‘কড়ি ও কোমল’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পরই কালী প্রসন্ন ‘রবিরাহু’ ছদ্মনামে একটি প্যারডি রচনা করেন এইভাবে – “ইহা কড়িও নহে কোমলও নহে পুরো মুরে ‘মিঠেকড়া’...” শুধু তাই নয়, তিনি রবিঠাকুরকে ‘পায়রা কবি’ বলেও ব্যঙ্গ করেন। যেমন: 

উড়িস নে রে পায়রা কবি
খোপের ভিতর থাক ঢাকা।
তোর বকবকম আর ফোঁসফোঁসানি
তাও কবিত্বের ভাবমাথা।
তাও ছাপালি গ্রন্থ হলো,
নগদ মূল্য এক টাকা।

সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে-বাইরে’ সবচেয়ে বিতর্কিত উপন্যাস। ‘সবুজপত্রে’ মাসিক কিস্তিতে প্রকাশিত হবার সময়ই ঝড় উঠতে শুরু হয় বিমলার আচরণ নিয়ে। বিশেষত সন্দীপের মুখে সীতা ও রাবণের বিরোধের প্রসঙ্গ ঝড় তুলেছিল। কবি বঙ্কিম মিত্র ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাস সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে পদ্যে এক অভিযোগ খাড়া করেন। ১৩২৬ সালের ‘অর্চনা’ পত্রিকার ফাল্গুন সংখ্যার বঙ্কিম মিত্র লিখেন দীর্ঘ একপদ্য। এর দু’একটি স্তবক এরকম:

এ মহাপাতকে হিন্দু। তব পুণ্য গেহ
করিওনা কলঙ্কিত; আর্যরক্ত দেহ
ধরে যদি একবিন্দু একটি শিরায়
যদি শুদ্ধ শুচিতার একটি রেখায়
শুভ্র থাকে ও চিত্তের এক তিলস্থান,
এ-কলুষ হতে দূর করো অবস্থান:...
কিন্তু যেই লেখনীর লজ্জা লেশহীন
বর্বর যথেচ্ছাচার সেই অমলিন
শুদ্ধ শুচি সতীত্বের তেজে জ্যোতির্ময়
সীতা চিত্ত কল্পিয়াছে পাপিষ্ঠ আশায়
তার হাতে আর্যনারী ‘বিমলার’ প্রায়
যথেচ্ছাচারিণী হবে কি আশ্চর্য তায়? ...ইত্যাদি।

এ সম্পর্কে চিত্রাদেব লেখেন (অনালোচিত রবীন্দ্র প্রসঙ্গ) : ‘জীবনে বহুবার তিনি (রবীন্দ্রনাথ) সমালোচনার কাঠগড়ায় আসামীরূপে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্কিম মিত্রের কবিতা তাঁর মনে একটি মাত্র তিক্ত স্মৃতি বয়ে নিয়ে এসেছিল’। ১৩১১ শ্রাবণের ‘ভারতী’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের একটি গান প্রকাশিত হয়। এর চার পংক্তি উদ্বৃত করে ১৩১১’র ভাদ্রের সাহিত্য পত্রিকার মাসিক সাহিত্য সমালোচনা’ বিভাগে বলা হয় যে, ‘গানটি সম্পূর্ণ অর্থহীন’। তারপর মন্তব্য করা হয় :

‘রবীন্দ্রবাবু অনেক লিখিয়াছেন, অনেক ছাপিয়াছেন, অনেক গাহিয়াছেন- এখনও যে তিনি যা-তা ছাপাইবার লোভ সংবরণ করিতে পারেন না, ইহা আমাদের বিচিত্র বলিয়া বোধ হয়। নাবালক কবি সুলভ কবিত্ব-কৃতি লব্ধ প্রতিষ্ঠা কবির পক্ষে নিতান্ত অশোভন- সে দৃষ্টান্ত সাহিত্যের পক্ষে নিতান্ত অপকারী, রবীন্দ্রবাবুর ন্যায় প্রতিভাশালী লেখকই যদি তাহা না বুঝিতে পারে, তাহা হইলে আমরা নাচার।’...

শুধু তাই নয়, শ্রী অরবিন্দ, যদুনাথ, প্রমুখ রবীন্দ্রবিবোধী দলে যোগ দিয়েছিলেন। বিপিনচন্দ্র পালের মতন প্রখ্যাত জাতিয়তাবাদী নেতা প্রকাশ্যে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন-রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে। বলতেই হয়, রবীন্দ্রনাথের ভাগ্যে তার দেশের কাছ থেকে জুটেছে অবিরত অপমান, অবিশ্রান্ত নিন্দা, অকারণ কটুক্তি এবং প্রায় ক্ষেত্রেই তার প্রীতিভাজন গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এতে সোৎসাহে ইন্ধন জুগিয়েছেন। অবশ্যি এ ক্ষেত্রে বিদেশীরাও কম যাননি। ইয়েটস এবরা পাউন্ড প্রমুখ জীবনবাদী শিল্পীরাও এক সময় রবীন্দ্র বিরোধিতায় নেমেছিলেন। (বিশেষ করে ইংরেজ কবি ইয়েটস) ইয়েটস (১৮৬৫-১৯৩৯) গীতাঞ্জলির একটি চমৎকার ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন। নিতান্ত এক ভারতীয় কবির ‘মুরব্বী’ ভাব প্রকাশের ইচ্ছায়। সেই ভারতীয় কবি যখন নোবেল পুরস্কার পেয়ে গেলেন, তখন তাঁর উপর মুরব্বী খানা ফলানোর সুযোগ ফসকে গেল। শুধু তাই নয়, তিনি নোবেল পুরস্কার পেলেন আরও দশ বছর পর। কাজেই খুব স্বাভাবিক কারণেই এক অসহ্য ঈর্ষার জ্বালায় তিনি রবীন্দ্রবিরোধী শিবিরে ঢুকে পড়েছিলেন।

ঐতিহাসিক নলিনীকান্ত ভট্টশালীর ‘ঢাকায় রবীন্দ্রনাথ’ স্মৃতিকথা পাঠে জানা যায় যে, ‘মেয়েলি কবিতার লেখক বলিয়া রবীন্দ্রনাথের কবিতা তখন বিশেষ সমাদর লাভ করিত না’। তিনি লিখেছেন, ‘দলে মিলিয়া আমিও রবীন্দ্রনিন্দুক সম্প্রদায়েরই একজন হইয়া দাঁড়াইয়াছিলাম। আমরা অনেকেই তখন রবীন্দ্র কাব্যের প্রায় কিছুই পাঠ করি নাই; তথাপি রবীন্দ্র কাব্যের নিন্দা করা তখন এক শ্রেণীর লোকের ফ্যাশন হইয়া দাঁড়াইয়াছিল’। (শনিবারের চিঠি, আশ্বিন, ১৩৪৮)

এর মধ্যেই কবি আপনমনে সৃষ্টি করে চলেছেন কবিতা, গান, গীতিকাব্য, নৃত্যনাট্য, ছোটোগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রহসন, হাস্যকৌতুক, ইত্যাদি। এছাড়া বিভিন্ন প্রবন্ধ তো আছেই। ঠাণ্ডা মাথায় ভাবলে বিস্মিত হওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। একদিকে নানান পারিবারিক বিপর্যয়ে বিপর্যস্ত কবি আর অন্যদিকে চলেছে নিত্য সৃষ্টির অঙ্কুর। স্ত্রী, সন্তান বিয়োগেও তিনি অবিচল। এমন একজন মানুষকে কি বলা যায় বলুন তো? স্বপ্নের বিশ্বভারতী গড়ে উঠছে তারই মধ্যে। প্রাচীন আশ্রম-ধারণাকে কেন্দ্র করে ডেকে ডেকে নিয়ে আসছেন বিভিন্ন রকম গুণী মানুষজনকে। তাঁদের নিয়ে চলছে এক নতুন বিশ্ববিদ্যালয় তৈরীর কাজকর্ম। নিঃশব্দে, নীরবে। এই ভাবেই আমার রবীন্দ্রনাথ বোঝার শুরু।

এই আমার অনুভবের রবীন্দ্রনাথ। ‘আমার সাধের সাধনা, মম শূন্য গগনবিহারী।

তোমার কাব্যের বীজ            পাথরে পড়িয়া যদি
ফুলে-ফলে না হয় সফল
পড়িতে পথের ‘পরে         পথিক দলিয়া যায়
খেয়ে যায় খঁটে-খাওয়া পাখী।
হাজার আগাছা সাথে              মহামূল্য কোন চারা
দূর করে ফেলে দেয় কেহ—
সে দোষ তাদের যারা                দাঁড়ায়ে মাটির ’পরে
মাটিরেই দিতে চায় ফাঁকি।
দুবেলা তাদের সাথে                 দু’মূঠো অন্নের লাগি’
আমাদের অশ্লীল সংগ্রাম,
কদর্য কলহে মাতি                    অন্ধকারে হাতাহাতি,
দীর্ঘ দেহ ছিন্ন বহির্বাস।
তোমার কায়ারে তাই                    ছায়া ভেবে হেসে ওঠে,
তোমার সুধারে বলি সুরা ;
জ্বরের বিকার ঘোরে               তোমারে চিনিতে নারি
গালি দেই করি উপহাস।

                                                            ...... রবীন্দ্রনাথ – সরোজ দত্ত 

আর ক’দিন পরেই বিশ্বকবির মৃত্যুদিন। ২২শে শ্রাবণ। আসুন, স্মরণে-মননে যদি একটুও শ্রদ্ধা জানাতে পারি তাঁর প্রতি। তাহলে হয়তো আমরা একটু সার্থক হবো তাঁর চিন্তাধারায়!

শেষ করছি কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের কবিতা ‘২২শে শ্রাবণ ১৩৪৮’ দিয়ে :

“মেঘ চাপা পূর্ণিমা, / আর সারি সারিমুখঢাকারুদ্যমান আলোয় / শহরের নিষ্প্রদীপ রাত শ্রাবণ-সমাচ্ছন্ন। / আলো নিবল, / রাত কাটল, / পূর্ণিমা ছাড়ল, / কিন্তু প্রভাতের কপালে / আজ আর সূর্য উঠল না। / এমন দিনেই, / এমনি শ্রাবণঘন গহন মোহে,-- / কাননভূমি যখন কূজনহীন, / সকল ঘরে যখন দুয়ার দেওয়া,-- / একেলা পথিক গোপন তার চরণ ফেলে / নিশার মত নীরবে পথ চলে। / শহরে তা অশোভন, / শহরে তা অসম্ভব। / পথিকের বাঁধা পথ আরও বেঁধে দেওয়া হয়েছে-- / কলুটোলা স্ট্রীট, কলেজ স্ট্রীট, / কর্ণওয়ালিস স্ট্রীট হয়ে / পথিক যাবে। / তারই একটা মোড়ে-- / সহস্র নিরুপায়ের ভিড়ে দাঁড়িয়ে ভিজছি। / দূর হতে কানে আসছে-- / বিপুল পরাজয়ের তুমুল জয়ধ্বনি! / সহসা দেখা গেল-- / মরণের কুসুম কেতন জয়রথ! / মনে হলো-- / কি বিচিত্র শোভা তোমার-- / কি বিচিত্র সাজ! ............”


























3 comments: