0

সম্পাদকীয়

Posted in







সম্পাদকীয়




নিবিড় অন্তরতর বসন্ত এল প্রাণে... 

আর দু’রাত পোহালেই দোল, বসন্ত উৎসব। কোকিলের কুহুতানে, শিমুলে অশোকে পলাশে কৃষ্ণচূড়ার লালে লালে বসন্তের আবাহনে অপরূপা রক্তিম প্রকৃতি আজ জাগ্রত দ্বারে। আজ দখিন দুয়ার খোলা... নীলের দিগন্ত আজ আবীরে রঙীন... রক্তকাঞ্চনে লেগেছে তার অন্তররাগের ছোঁয়া। আজ সবার রঙে রঙ মেলাতে হবে... এমনই এক মাতাল করা বসন্ত সন্ধ্যায় ঋতবাক-এর সমস্ত সুধী বন্ধুজনকে জানাই বেশুমার বাসন্তী শুভেচ্ছা। মনে প্রাণে রঙীন থাকুন সকলে... অনন্ত কাল...আজীবন। 

দু’দিন পরে দোল, আর দু’হপ্তা আগে গেলো ‘মেয়ে দিবস’। ... মেয়ে দিবস! কেন জানিনা এই মেয়ে দিবস পালন করাটায় আমি একটা গভীর চক্রান্তের গন্ধ পাই যেন! কেবল মনে হয়, এই নিয়ে মাতামাতি করে মেয়েদের একটু ভুলিয়ে রাখার তাল এসব ষড়যন্ত্রী ছেলেগুলোর। পুরুষ দিবস একটা আছে, কিন্তু সেটা পালন করার এতো ধুম নেই তো! তবে? মেয়ে-পুরুষে মিলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পৃথিবীটাকে বাসযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করলে হয় না? প্রতি বছর নতুন নতুন প্রস্তাবনা... কিন্তু যে অঙ্গীকার অন্তরে অনুভবের আলোড়ন তোলে না, তা অর্থহীন। আমার বিশ্বাস, পারস্পরিক সম্মাননার প্রতিশ্রুতিই সম্ভবত একমাত্র সমাধান। এখনও যদি না ভাবি, তবে হয়তো সত্যিই বড়ো দেরি হয়ে যাবে।

যাক, অনেক ভারী ভারী কথা বলা গেল। এবার আসি অন্য কথায়। রাসবিহারী মোড়ের কাছে, কালীঘাট ট্রাম ডিপোর ঠিক উল্টো দিকে কে সি দাসের পাশে ‘শিলালিপি’তে ঋতবাক-এর নতুন ঠিকানার কথা ইতিমধ্যেই জেনে গেছেন অনেক বন্ধুই। সকলের অবগতির জন্য আরো জানাই, এই শিলালিপিতেই বন্ধুরা রাখতে পারবেন নিজেদের বই, পত্রিকা, কারুকৃতি, সব কিছু। উৎসাহী সাহিত্যিক, কবি, শিল্পীরা সরাসরি যোগাযোগ করুন আমাদের সঙ্গে। প্রসঙ্গত জানাই, ঋতবাক এখন থেকে ব্লগ ম্যাগাজিনটির পাশাপাশি নিয়মিত বই প্রকাশেও উদ্যোগী হবে। সেই উদ্দেশ্যেই তৈরি হয়েছে ঋতবাক প্রকাশনা। নতুন এবং সম্ভাবনাময় কবি, সাহিত্যিকদের স্বপ্নপূরণে সহায়তা করতে পারলেই এই প্রয়াস সার্থক হয়ে উঠবে। আপনাদের আশীর্বাদ ও সহযোগিতায় ঋদ্ধ হয়ে প্রকাশিতব্য লেখার উৎকর্ষ এবং বইয়ের নান্দনিকতাকে পাথেয় করে সফল হয়ে উঠুক এই প্রয়াস, এইটুকু প্রত্যাশা। 

ঋতবাক-এর ভাষা সংখ্যা, অর্থাৎ ফেব্রুয়ারী সংখ্যা ছিলো এক ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ... অসংখ্য নক্ষত্রের একত্রিত উজ্জ্বল সমাবেশে ভাস্বর। সেই ব্যতিক্রমের ধারাকে অব্যাহত রেখে এবারের সংখ্যায় জায়গা করে নিয়েছে এক ঝাঁক নবীন প্রতিশ্রুতিময় সাহিত্যিকের দল। এমনই নবীন-প্রবীনের মেলবন্ধনের মুক্তমঞ্চ হিসাবে ঋতবাক প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ হোক। 


শুভেচ্ছা নিরন্তর
সুস্মিতা বসু সিং




0 comments:

1

প্রচ্ছদ নিবন্ধ : রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ


একুশে ফেব্রুয়ারির চিন্তা, পুনশ্চ
রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য


এবারে আর গল্প নয়, সত্যি ঘটনা। পণ্ডিত গোবিন্দবল্লভ পন্ত (১৮৮৭-১৯৬১) ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা। তার জন্য তাঁকে অনেক পুলিশি অত্যাচার সইতে হয়েছিল। স্বাধীন ভারতেও রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে ডাক পড়েছিল তাঁর। নিজের সচিবকে মুখে মুখে একটি চিঠির বা আর কিছুর বয়ান বলতে বলতে তিনি সংজ্ঞা হারান। আর তা ফিরে আসেনি। প্রায় অচৈতন্য অবস্থায় তাঁর মুখ দিয়ে অস্ফুট কিছু কথা বেরিয়ে আসছিল। প্রথম প্রথম কেউই সে ভাষা বুঝতে পারেননি। ইংরিজি তো নয়ই, এমনকি পোশাকি হিন্দিও নয়। ঠাওর করে একজন বুঝলেন : সেটি গাড়োয়াল অঞ্চলের ভাষা, পন্ত-এর যেটি মাতৃভাষা।

উচ্চশিক্ষার ভাষা নিয়ে আলোচনা করতে বসে এই ঘটনাটি লিখে গেছেন গোপাল হালদার (চতুষ্কোণ,বৈশাখ ১৩৬৯, পৃষ্ঠা ১)

জন্মভূমি আর মাতৃভাষা নিয়ে যে আবেগ দেখা যায় সেটি সর্বদাই সৎ ও শুদ্ধ – যদি-না অন্য কারুর জন্মভূমি বা মাতৃভাষা নিয়ে কোনো ব্যঙ্গ বা হিংসের ভাব তার মধ্যে থাকে। প্রত্যেক মানুষের অধিকার আছে নিজের জন্মভূমি আর মাতৃভাষা নিয়ে গৌরব বোধ করার। কাউকে তাতে খাটো করা হয় না। কার জন্মভূমি কত ধনী, কার মাতৃভাষা কত সমৃদ্ধ – সে নিয়ে রেষারেষি বা টক্কর দেওয়ার মনোভাব একেবারেই অচল। কোন্‌ ভাষার কতজন লেখক নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন – সেই নিয়ে গর্ব করা,অন্যদের হেয় করাও নিজের মাতৃভাষার প্রতি প্রীতির নিদর্শন নয়। উল্টে বলা যায় : অন্য লোকের জন্মভূমি আর মাতৃভাষাকে অশ্রদ্ধা করলে নিজের জন্মভূমি আর মাতৃভাষাকেই অপমান করা হয়।

পাকিস্তান আমলে ঢাকায়, স্বাধীন ভারতের কাছাড়ে ও অন্যত্র ভাষা আন্দোলনের সূত্রে বহু তরুণের প্রাণ গিয়েছিল, মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন সব বয়সের মানুষ। রক্ত ঝরিয়ে ভাষার মান রক্ষা হয়।আর্থিক বা রাজনৈতিক দাবিদাওয়ার চেয়ে ভাষার দাবি এক তিলও কম নয়। তার কারণ : এই দাবির সঙ্গে কোনো বিশেষ শ্রেণীর বা গোষ্ঠীর স্বার্থ জড়িয়ে নেই; জড়িয়ে আছে সেই ভাষায় যাঁরা কথা বলেন তাঁদের সম্মান নিয়ে বাঁচার প্রশ্ন। ভাষা-শহিদরা তাই কোনো বিশেষ ভাষার শহিদ নন, সামগ্রিকভাবে ভাষা-শহিদ। জাতীয়তার সীমা ছাড়িয়ে গোটা বিশ্বয় যেখানে সেই ভাষার লোক আছেন তাঁদের সকলের ইজ্জত বজায় থাকে ভাষা-শহিদদের দৌলতে।

গত কয়েক দশকে মাঝে মাঝেই দেখা গেছে : কিছু লোক ভীষণ উত্তেজিত হয়ে বিলাপ করছেন এই বলে যে, পশ্চিমবঙ্গে তথা ভারতে বাঙলাভাষার অবস্থা নাকি নিদারুণ খারাপ, তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার।কেউবা আবার পুবদিকে আঙুল দেখিয়ে বলছেন : বাঙলাভাষা যদি বাঁচে তবে ঐ ওপার বাংলাদেশেই বাঁচবে।

এইসব বিলাপবিলাসীদের দেখে মায়া হয়। বিশ কোটি মানুষ যে ভাষায় কথা বলেন, দুনিয়ার সব কোণে যখন বাঙলাভাষী মানুষ ছড়িয়ে আছেন, তখন বাঙলাভাষার জিম্মাদার বলে ভারতের একটিমাত্র অঙ্গরাজ্যকে ধরা হবে কেন? ত্রিপুরা নয় কেন? সেখানে কি এইধরনের অনর্থক বিলাপ শোনা যায়? অসমে, উত্তরপ্রদেশে, বিহারে কি বাঙলার চর্চা নেই? হতেই পারে আর্থিক ও অন্যান্য কারণে ঐ সব অঞ্চলের বাঙলা স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। সেখানকার বাঙালি ছেলেমেয়েরা ইংরিজি বা হিন্দী মাধ্যমের স্কুলে পড়ছে। তাতে বাঙলাভাষার কি এমন লোকসান? তারা তো বাড়িতে বাঙলাই বলে। তারা যদি বাড়িতেই বাঙলা পড়তে শেখে, পড়ার অভ্যাস বজায় রাখে - সেই তো যথেষ্ট। ভাষা বাঁচে মুখে, সমৃদ্ধ হয় লেখায়। পাঠক থাকলে লেখকও থাকবেন। ছাপা বই বা পত্রিকা এখন আর বিকল্পহীন নয়, তার পাশাপাশি আছে ই-পত্রিকা, ই-বই। সেগুলি পড়া ও সেগুলিতে লেখার মধ্য দিয়েই সারা বিশ্বর বাঙলাভাষীরা তাঁদের মাতৃভাষার প্রতি আসল কর্তব্য পালন করবেন।

1 comments:

2

বিশেষ নিবন্ধ : সুস্মিতা বসু সিং

Posted in


বিশেষ নিবন্ধ


দেখতে নারী
সুস্মিতা বসু সিং



যারে দেখতে নারী, তার চলন বাঁকা...

হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন – নারী-ই লিখেছি, বানান ভুল নয়... না’রি লিখিনি। কেন লিখেছি, সেই প্রসঙ্গেই আসছি। তবে হ্যাঁ, একটা কথা সবার আগে জানিয়ে রাখা ভালো। আমি কিন্তু একেবারেই পুরুষবিদ্বেষী নারীবাদী নই। সঙ্গী হিসাবে পুরুষ ছাড়া জীবনধারণ করার কথা ভাবতেই পারিনা। সহজাত নারীবৃত্তি দিয়েই হয়তো পুরুষের সাহচর্য উপভোগও করি। কিন্তু একথা যেমন সত্যি, তেমনই আধুনিকমনস্ক নারী হিসাবে, ঘরে বাইরে সমানতালে নারীর স্বাধীনচেতা স্বাবলম্বী চরিত্র বৈশিষ্ট্যকেও সমধিক গুরুত্ব দিই, একথাও অনস্বীকার্য। আর যাবতীয় বিতর্কের সূচনা মনে হয় সেখান থেকেই।

নিজের কথাই বলি। আমার দিদিমা ছিলেন সেই যুগের বারো ক্লাস পাস। বাড়ির ছোটবউ, ছয় ছেলেমেয়ে, শ্বশুর-শাশুড়ী, ভাসুর ননদদের নিয়ে তাঁর ভরন্ত সংসার। অসম্ভব ভালো রান্নার হাত, সারদেশ্বরী আশ্রমিক বিদ্যালয়ের গরীব মেয়েদের জন্য নিজে হাতে ফ্রক, ব্লাউজ, সায়া বানিয়ে দেন, এই পর্যন্ত ঠিক ছিলো। কিন্তু তাই বলে লুকিয়ে লুকিয়ে কবিতা লেখা!! জানতে পেরে পুলিশ কমিশনার শ্বশুর প্রশ্রয়ের হাসি হাসলেন। বিয়ের আগে মেয়েটা যে নিজের ছোট মেয়ের সহপাঠিনী ছিলো! দেশ পত্রিকার দপ্তরীকে ডেকে পাঠিয়ে দিলেন কবিতা, ছাপার জন্য। শাশুড়ীর মুখ হলো ভার, তবুও মেনে নিলেন। কিন্তু বাড়ির ছোটবউ এরপর যা শুরু করলেন, সেটাতে আর চুপ করে থাকা দায় হলো। সেলাই জমা দেবার নাম করে বেরিয়ে, কাপড়ের মধ্যে লুকিয়ে রিভলবার, কার্তুজ, দরকারী চিঠিপত্র, জরুরী কাগজপত্র, গুরুত্বপূর্ণ দলিল, ইত্যাদি পৌঁছে দেওয়া শুরু করলেন বিপ্লবীদের কাছে। মেয়েদের একটা দল গড়লেন এই কাজ আরও বিস্তৃতভাবে করার জন্য। সক্রিয়ভাবে যোগ দিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামে। শ্বশুরমশায়ের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল, শাশুড়ি রাগে ফেটে পড়লেন। শ্বশুরমশাই ছোটবউমাকে ডেকে জানতে চাইলেন, তুমি কি করছো, তা তুমি জানো তো? দুর্দমনীয় মেয়েটার সম্মতিসূচক ঘাড়নাড়া দেখে কোমল হলো শ্বশুরের দৃষ্টি। বললেন, বেশ, তবে আমার নাতিনাতনিদের যেন অযত্ন না হয়। শাশুড়ী কথা বলাই বন্ধ করে দিলেন এক্কেবারে।

এহেন দিদিমার তৃতীয় সন্তান আমার মা। দাদু প্রথম জীবনে মিলিটারিতে ও পরবর্তীকালে পুলিশে চাকরী করতেন বলে স্থায়ীভাবে বাড়ীতে প্রায় থাকতেনই না। তাই দিদিমার একক তত্ত্বাবধানেই বড় হয়ে ওঠা। অসম্ভব কমনীয় এক বহিরাবরণের অন্তরালে অদ্ভূত ঋজু নীতিনিষ্ঠ চারিত্রিক দৃঢ়তা মাকে একদিকে যেমন স্বাতন্ত্র দিয়েছিলো, তেমনিই এই একই কারণে মায়ের দুর্গতিরও অন্ত ছিলো না। বিয়ের আগে বি এ পাস করে স্কুলে পড়ানো, দক্ষিণী থেকে গান শিখে ও পরে দিলীপ কুমার রায়, সুচিত্রা মিত্রর কাছে গানের চর্চা করে মহাজাতি সদন, রবীন্দ্রসদন, বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলন দাপিয়ে গান গেয়ে বেড়ানো মেয়ের বিয়ে হলো পঞ্চাশ জন সদস্যের এক যৌথ পরিবারে, যেখানে প্রগতির আলো প্রবেশ করতে সময় লেগেছিলো আরও প্রায় দুই দশক। সেখানে বিনা প্রতিবাদে যাবতীয় অন্যায় আবদার মুখ বুজে অন্য বউদের মতো মেনে নিতে পারতেন না বলে বেয়াড়া বউ-এর দুর্গতিও আটকানোর সাধ্য ছিলো না কারোর। সে বাড়িতে গান করা তো দূরের কথা, বাড়ির মেয়েদের গান শোনাটাই ছিলো একটা গর্হিত অপরাধ। আমার এঞ্জিনিয়র বাবা ফিলিপসের রেডিওর সঙ্গে কানেক্ট করে সারা বাড়িতে এখানে ওখানে বক্স লাগিয়ে দিয়েছিলেন। ঘড়ি মেলানোর ছুতো করে একটা ছোট্ট ট্রানজিস্টার রেডিও-ও কিনে দিয়েছিলেন মাকে। সেখানে বাড়ির বৌদের বই পড়াও ছিলো এক আশ্চর্য ঘটনা। আমার র‍্যালিস ইণ্ডিয়া-র চেয়ারম্যান ঠাকুরদার বক্তব্য ছিলো, বাড়ির বউরা সব সময় নতুন নতুন শাড়ী পরে এক গা গয়না ঝমঝমিয়ে আহ্লাদ করে ঘুরে বেড়াবে... তাদের আবার এমন বেয়াড়া শখ থাকবে কেন?

এমন ‘সুবর্ণলতা’র যুগ আমরা পেরিয়ে এসেছি নিঃসন্দেহে। আজ প্রগতিশীল বাঙালী পরিবারে মেয়েরা অনেক স্বাধীন। কিন্তু কোথায় যেন একটা ‘তবু’ কিছুতেই পিছন ছাড়ে না। আর তাই, বাড়ির পুরুষটির আয় নারীটির আয়ের চেয়ে বেশী হওয়া উচিত। আর তাই, সংসারের সামগ্রিক পরিচালনার দায়িত্ব একান্তভাবেই নারীর একার। অসম্ভব, এখন ম্যাচের খুব ক্রুশিয়াল মোমেন্ট, এখন রুটি আনতে যাওয়া যাবে না, প্লিজ রাগ কোরোনা সোনা... একটা কিছু ম্যানেজ করো, প্লিজ। ও হো... কাল বনির এগ্‌জ্যাম বুঝি? সুইটহার্ট বেটা, গো অ্যান্ড স্টাডি... মাম্‌মা কে জ্বালিও না... বস যদি দুর্ভাগ্যক্রমে একজন নারী হন, তবে তো চাকরী জীবনটাই দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। নাইটপার্টি থেকে ড্রিংক করে আমি ফিরিতে পারি, ঠিক আছে... কিন্তু তাই বলে তুমিও!! না না জানি, সামান্যই, তবু... বিশেষ করে আজ যখন আমি যাইনি তোমার সঙ্গে!! আসলে আমার কিছুই না, কে আবার কি মনে করে, তাই বলছিলাম, আর কি!! কাম অন্‌, ডারলিং...ডোন্ট বি সো মীন, মিষ্টু আমার আপন মামাতো বোন। আচ্ছা, সোম যেন তোমার কেমন বন্ধু হয়? স্কুলের বন্ধু, বলেছিলে ...না? বাড়িতে কে কে আছে? বউ কি করে... না না... জাস্ট কৌতূহল, আর খি!! আরে, তুমি রাগ করলে নাকি? রাগলে তোমাকে এমন সুন্দর লাগে না... হেঁ হেঁ... নিজেকে আর...

কি? ভুল বলছি কিছু? তাহলেই বলুন!! যারে দেখতে নারী, অনাদিকাল থেকেই তো তার চলন বাঁকা... আর সেটা সিধে হওয়ার চান্সও জাস্ট নেইই...




2 comments:

0

বিশেষ নিবন্ধ : পল্লববরন পাল

Posted in


বিশেষ নিবন্ধ


আজ বসন্ত
পল্লববরন পাল



‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত’

সুভাষদা আমাকে খুব ভালোবাসতেন, আমার কবিতাও। আমাকে নিয়ে ওনার বিখ্যাত অনেক কবিতা আছে, যেমন – ‘কলকাতার বাঁড়ুজ্জে’ – মুশকিল হলো, আমার বিরোধীদের তো একটাই কাজ – মিডিয়ার ক্যামেরার সামনে পাউডার-টাউডার মেখে বসে শুধু আমার কুৎসা করা, এছাড়া তো অন্য কাজকম্মো নেই, তাই ওরা বলে, ওটা নাকি সুভাষদার নিজের লেখা নয় – অনুবাদ - আসল কবিতাটা নাকি লিখেছিলো একজন তুরস্কের লোক – ইয়ে, কী যেন নাম, কী যেন নাম – জাজিম হিম্মত না নাজিম কী একটা – আমি অনেকবার বলেছি, এই বিরোধী ব্যাটাদের আসল পবলেম হলো, ওদের মাথার মধ্যে একটুও বেন নেই – ওই হিম্মতদা তো নাকি তুরস্কের কবি, তো বলুন তো, একজন তুরস্কের লোক জানবে কী করে যে আমরা বাঙালিরা ব্যানার্জীকে বাঁড়ুজ্জে বলি? হুঁ হুঁ, আসলে আসল হিম্মত একমাত্র আমার আছে, হ্যাঁ, আমারই আছে, তাই আমিই জানি যে হিম্মত কথাটাও আদপে বাংলা – আমাকে সুভাষদা নিজে বলেছিলেন যে, এটা ওনার নিজের লেখা আর আমাকে নিয়েই লেখা, ওসব হিম্মত-টিম্মত সব বুজরুকি – বিরোধীদের চক্কান্ত - আমি বিদেশ থেকে ডিগ্রি পাওয়ার পরে আশিব্বাদস্বরূপ সুভাষদা এটা লিখে আমাকে পাঠিয়েছিলেন। না না, ১৯৫২ সালে নয়। যাহা বাহান্ন তাহাই বিরানব্বই। যারা বলছে বাহান্ন, দুষ্টুমি করে বলছে।

যাগ্‌গে, এই আমি ঘোষণা করে দিলাম আমার পিয় সুভাষদার কথায় – আজ বসন্ত। ফুল ফুটলো কি ফুটলোনা, সে নিয়ে অযথা মাথা ঘামাবেননা। ব্যাস! আর অন্য কোনো কথা হবেনা, চোখ বন্ধ করে এবারে যান, সবাই ধেই ধেই করে নাচুন, কোমর দুলিয়ে গান করুন, আনন্দ করুন, নিজেরাই ফুল ফোটান - কারণ আজ বসন্ত। বসন্ত মানে শীত শেষ – দুঃখের দিন শেষ - পাতাঝরা শেষ - এবার পোরিবত্তন – নতুন পাতা, নতুন ফুল, নতুন আনন্দ – পোরিবত্তন মানেই আমি – আমি মানেই বসন্ত -বসন্ত মানেই উৎসব। উৎসব মানেই তেলেভাজায় বিশ্বদশ্যোন। বসন্ত মানেই সরস্বতীপুজো – ‘বিশ্বরূপা বিশালাক্ষী’ - ভালোবাসার দিন – ভালোবাসুন - ঘরে ঘরে ঢুকে মানুষকে ভালোবাসুন – বেশি বেশি ভালোবাসুন - দেখবেন, চীৎকার না করে সবাই যেন ওই ‘বিশ্বরূপা বিশালাক্ষী’, মানে বড়ো বড়ো চোখে আপনাদের বিশ্বরূপ দশ্যোন করে, অর্থাৎ আপনাদের ভালোবাসার উৎসব উপভোগ করে – বেশি পোতিরোধ বা ট্যাঁফো করলে বুঝবেন নিশ্চয়ই বিরোধী পার্টি, মানে ভালোবাসার বিরোধী আর কি - তখন ঘাড় মটকে উপভোগে বাধ্য করাবেন, বুঝলেন? বিরোধীদের কোনো চক্কান্ত আমি বরদাস্ত করবো না।বন্ধুরা, আগেও ওদের আমলে বসন্তোৎসব হতো, কিন্তু সেটা হতো রক্ত নিয়ে হোলি খেলা – ওরা রক্ত নিয়ে উৎসব করতো - মানুষের রক্তে। কিন্তু বসন্তোৎসব আসলে ভালোবাসার উৎসব, সুতরাং ভালোবাসতেই হবে সবাইকে – ইট্‌স মাই অর্ডার, লাভ ইজ মাস্ট, নো কম্পোমাইজ - বসন্তোৎসব আবার রঙেরও উৎসব, ‘রঙ যেন মোর কর্মে লাগে’ - কাজেই আপনারা সবাই রঙিন হয়ে রঙবাজী করলে আমি একটুও বকা দেবো না। যান। বেরিয়ে পড়ুন। দুগ্‌গা দুগ্‌গা। 

বসন্তোৎসব মানেই শান্তিনিকেতন। রবিদা আমার কথাতেই তো বোলপুরে এই উৎসব শুরু করেছিলেন –দোলের দিন – উনি তো বাহ্মণঠাকুর নয়, বাহ্ম ঠাকুর ছিলেন – বাহ্ম আর বাহ্মণে তফাৎ আছে, একটা মুর্ধণ্য ‘ণ’য়ের – বাহ্মরা পুজো-টুজোয় বিশ্বাসী ছিলোনা, তাই রবিদাও সরস্বতীপুজো করতেন না, কিন্তু ওই আমার মতো উৎসব খুব ভালোবাসতেন, তাই দোলের দিনটাকেই উনি বেছে নিয়েছিলেন – গান লিখেছিলেন ‘দোলে দোদুল দোলে দুলনা’ – কবিতা লিখেছিলেন ‘দোল দোল দুলুনি রাঙ্গা মাথায় চিরুনি’ – দোল নিয়ে ওনার অনেক লেখা আছে, আমাকে পড়িয়েছিলেন – আমার সবচেয়ে ভালো লাগে ঐ ‘ঝুলন’ কবিতাটা – ওটা পড়েই তো আমি সেই পোকাশ্যে গলায় কাপড় জড়িয়ে ঝুলনের একটিং করেছিলাম - ‘আমি পরাণের সাথে খেলিবো আজিকে মরণখেলা’ – না না, পরাণবাবুর সাথে আমার কোনো শত্তুতা নেই, মতপার্থক্য থাকতে পারে, উই আর ডেমোক্র্যাটিক কান্টি, আর আই বিলিভ ইন ডেমোক্র্যাসি অনলি – তো, ওই কবিতাটার মধ্যে বারকয়েক আছে – ‘দে দোল দোল, দে দোল দোল’ –ঘুরে ঘুরে আসছে ‘দে দোল দোল, দে দোল দোল’ - ওফ্‌, একদম শ্লোগানের মতো, শিরায় শিরায় যেন কাতুকুতু দেয় – অনেকটা আমার ওই ‘এপাং ওপাং ঝপাং/ পড়ে গিয়ে পটাং/ বাঁচাও বলে ঝপাং/ মুচকি হাসে এপাং’ কবিতাটার মতো – রবিদা আক্ষেপ করে একবার বলেছিলেন – ‘তোমার মতো যদি এরকম স্যাটাস্যট আমিও লিখতে পারতাম…’ বন্ধুরা, উনি এটা কবে বলেছিলেন জানেন? ওই যে, গান্ধীজীকে শরবৎ খাইয়ে অনশন ভাঙিয়ে ফেরার পথে – অতো সাল-তারিখ মনে থাকেনা আমার – মনে রাখিনা।

বাঙালি উৎসব পিয়। আমিই পোথম, যে বাঙালির এই উৎসবপিয়তাকে মর্যাদা দিয়েছি, বাঙলায় সত্যিকার উৎসবের মেজাজ পোতিষ্ঠা করেছি। কী বন্ধু, তাই তো? একটু জোরে ‘হ্যাঁ’ বলুন, সবাই শুনুক।শিল্প না হোক, শিল্প নিয়ে আমি পোত্যেক বছর উৎসব করি। সারদা থেকে টেট, ত্রিফলা থেকে ডেলো -কেলেঙ্কারির উৎসব। কামদুনি থেকে কাটোয়া – ধষ্যণ উৎসব। সিণ্ডিকেট থেকে মাটি, সাইকেল থেকে ক্লাব – সোনার বাংলা জুড়ে এখন শুধুই উৎসব। আমি জানি, সামান্য কিছু ইতিহাস বা পুরাণবাগীশ বিরোধীকণ্ঠ এখনও আমার এই বাঙলায় লুকিয়ে-চুরিয়ে ঘাপটি মেরে আছে, যারা আপনাদের বিভ্ভান্ত করার চেষ্টা করবে, অবশ্য সবাই যে খারাপ তা নয়, বলবে – এই দোল উৎসব নাকি হিন্দুদের অতি প্রাচীন উৎসব – আমার মুসলিম ভাইবোনেদের বঞ্চনা করে মিথ্যে পুরাণের দোহাই দিয়ে সাম্পদায়িক সম্পীতি নষ্ট করার চেষ্টা করবে - রাজা হিরণ্যকশিপু আর তাঁর দুষ্টু বোন হোলিকার দুষ্টুমির গপ্পো শোনাবে – হোলিকাদহন-এর সাতকাহন – বিষ্ণুভক্ত পোহ্লাদকে জব্দ করতে, আগুনে পুড়িয়ে মারতে নিজের পোষাকেই আগুন ধরে গিয়ে পুড়ে ছাই হবে হোলিকা, পরদিন সকালে সবাই যখন দেখবে হোলিকা ইজ অনলি এ বার্ন্ট ডেডবডি – নো হাড় নো মাংস, অনলি ছাই, তখন আনন্দে সবাই হইহই করে সেই ডেডবডির ছাই নিজেরাই নিজেদের মাথায়-মুখে মাখাবে – এই নাকি হোলিখেলার শুরু!যত্তোসব আজগুবি। মুখে ছাই মেখে কোনোদিন উৎসব হয়? গা পিত্তি জ্বলে যায় শুনে। বন্ধুরা, একবার গিয়ে ওই বেনলেস পুরাণবাগীশদের মাথায় আর মুখে আলকাতরা বা ছাই যাহোক একটা লাগিয়ে জিগেস করুন তো - হিরণ্যকশিপু কোথাকার রাজা ছিলেন? – মুলতানের। এবার আমি আপনাদের জিগেস করি, বলুন, মুলতান কোথায়? – পাঞ্জাবে। পাঞ্জাবে কারা থাকে? পাঞ্জাবীরা, যেমন বাঙলায় থাকে বাঙালিরা, বিহারে বিহারিরা। তো বন্ধু, পাঞ্জাবীদের ধর্মগুরু কে? বিষ্ণু নাকি গুরু নানক? একটু জোরে নানকের নামটা বলুন ভাই… পেসের ক্যামেরার মাধ্যমে ওই মিথ্যেবাদীরাও টিভিতে দেখুক, শুনুক -বিরোধীদের এই ধাপ্পাবাজিতে আপনারা যেন কেউ চমকাবেন না। পবলেম হলে সত্যিটা আমার থেকে জেনে নেবেন। না না ভাই, আমি আর সত্যের পোতীক-টোতীক হতে চাইনা, ওসব ব্যাকডেটেড, বরং মানুষ চাইছে সত্য এখন আমাকে পোতীক বানাক – মানুষের ডিম্যাণ্ড – কাজেই আমি মাথা পেতে আপনাদের সম্মান গোহণ করছি।

এই, কী বললি তুই? কী? চন্দগুপ্তর আমলে কালিদাসের লেখায় হোলির কথা আছে? কে কালিদাস? কোন পার্টির লোক? এই এই, যে বললো কথাটা, ওকে ধরো তো, ধরে নিয়ে এসো – ওই কীচন্দ গুপ্ত না কি একটা নাম বললো, পুরো নামটা বলারও সাহস নেই – ব্যাটা ওই গুপ্তরই গুপ্তচর নিশ্চয়ই, ওর পকেট-টকেট তল্লাসি করো, বোম-টোম থাকতে পারে – বন্ধুরা দেখুন, বলতে বলতে একটা পুরাণবাগীশ মিথ্যেবাদীকে ধরে ফেললাম – হুঁহ্‌, আমাকে চমকাতে এসেছে! আমাকে চেনেনা! আমি গোটা আণ্ডারওয়াল্ড কন্টোল করি, তোদের খতম করতে আমার এক মিনিট লাগবে রে শালা! স্যরি। এই, ওকে জেলে পুরে দাও, ওখানে ঘানিউৎসব করুক বাছাধন।

সে যাগ্‌গে-যাগ, বন্ধুরা, শান্ত হোন, বসে পড়ুন, ডিসিপ্লিন মেন্টেন করুন। এখন হোলি নিয়ে একটা গল্প বলবো আপনাদের – ভালোবাসার গল্প। এটা গল্প নাকি সত্যি, সেটা আপনারাই বলবেন – আগে গল্পটা শুনুন। আপনারা পুতনা রাক্ষসীর কথা জানেন - যে নিজের বুকের দুধে বিষ মিশিয়ে খাইয়েছিলো কিষ্ণকে – মারবে বলে, কিন্তু কিষ্ণ কি তাতে মরেছে? না বন্ধু, মরেনি – ওসব পাতি বিষ-টিষে কিষ্ণ কেন, আমাদের কেষ্টরও কিস্যু হয়না - তো সেই বিষ খেয়ে বাচ্চা কিষ্ণর গায়ের রঙ হয়ে গেলো কালো।সেই কারণেই কিষ্ণর আর এক নাম কালা। আমিও ছোটোবেলা খুব ফর্সা ছিলাম জানেন? আমাদের কেষ্টর মতো – ও অবশ্য ফর্সাই, তবে ওই যা এতো বিষ খায় যে ওর মাথায় একটু অক্সিজেনের ঘাটতি হয়ে গেছে আর কি। আমার বিরোধীরা আমাকে এতোবার এতো প্যাঁদান পেঁদিয়েছে, স্যরি, মানে পিটিয়ে পিটিয়ে সারা গায়ে কালসিটে ফেলে দিয়েছিলো, সেই থেকে আমারও গায়ের রঙ কালো। কিন্তু বন্ধুরা,পুতনার পার্টি যেমন পারেনি কিষ্ণকে মেরে ফেলতে, তেমনি আমার বিরোধী পার্টিও পারেনি আমাকে মেরে ফেলতে। কিষ্ণ বা আমার লাশ ফেলে দেওয়া এতো সহজ নয়। আমরা মানুষের সঙ্গে ছিলাম আছি থাকবো। আমরা অমর, চলমান অশরীরী। কিষ্ণর ছিলো নারায়ণী সেনা, চলমান অশরীরীর ছিলো ব্যাণ্ডরসেনা, আমারও আছে বান্দরসেনা। সে যাই হোক, যে কথা বলছিলাম - তো কিষ্ণ যখন একটু বড়ো হলো, ওর মনেও একটু ইন্টুবিন্টুর ইচ্ছে হলো - তো ওর মনে হলো, ও তো এতো কালো, রাধা বা তার সখিরা ওকে কি ভালোবাসবে? মায়ের কাছে গিয়ে ঘ্যানঘ্যান করতে থাকলো। বিরক্ত হয়ে ওর মা বললো – যা, রাধাকে গিয়ে বল, তার ইচ্ছেমতো রঙ যেন তোর মুখে মাখিয়ে দেয় – সেই থেকে হোলি –ইন্টুবিন্টু - রঙ মাখামাখি। সেই থেকে কিষ্ণ আর রাধা আমাদের সবচেয়ে পপুলার হিরো-হিরোইন।উত্তম-সুচিত্রা। আমার খুব ইচ্ছে ছিলো, ওনারা বেঁচে থাকলে এমপি করে দিতাম, দুজনকেই একসাথে –লোকসভায় বাঙলা একের পর এক সুপারডুপারহিট স্টোরি দিতো। বাঙলা আবার ভারতসভায় সেষ্ঠ আসন নিতো। ইস্‌! হলোনা। নো পবলেম। আমি নতুন মহানায়ক মহানায়িকা তৈরি করেছি। তাদেরকে লোকসভায় পাঠিয়েছি। উত্তম-সুচিত্রা জুটিকে আপনারা ভালোবাসেন। কিষ্ণকেও ভালোবাসেন।আমাকেও। জানি। কিষ্ণর মতো আমাকেও আপনারা শুধু ভালোই বাসেন না, পুজোও করেন, আমার ফটোতে রঙ মাখান – সেটাও আমি জানি।

বন্ধুরা, আপনাদের আর দেরি করাবোনা। ছুকছুক করছেন সবাই, বুঝতে পারছি। শুধু একটা কথা - এই দোল উৎসবে আপনারা যারা ভালোবাসতে যাচ্ছেন, রবিদার ওই ‘ঝুলন’ কবিতাটা মাথায় রেখে ভালোবাসবেন – যেখানে উনি বলছেন –

          ‘আয় রে ঝঞ্ঝা, পরানবধূর
           আবরণরাশি করিয়া দে দূর,
           করি লুন্ঠন অবগুন্ঠন-বসন খোল।
                                    দে দোল দোল।’

আমি চাইনা, রবিদার কোনো অসম্মান হোক। আমি চাই, তাঁর কথা যেন আপনারা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। তারপর ডেলোর মতো কোনো কেলো-টেলো হলে আমি দেখে নেবো। নির্ভয়ে যান বন্ধুরা।উৎসবে মেতে উঠুন। আর শেষ করার আগে আমার সেই প্রিয় সুভাষদার কবিতাটার মতো করে বলতে চাই –

  ফুল ফুটুক না ফুটুক     আজ বসন্ত
ভাত জুটুক না জুটুক      আজ বসন্ত
শিল্প আসুক না আসুক      আজ বসন্ত
কাজ মিলুক না মিলুক       আজ বসন্ত
ইজ্জত থাকুক না থাকুক       আজ বসন্ত

বসন্ত আসুক না আসুক     আজ উৎসব

                তাই
                         এপাং ওপাং ঝপাং

0 comments:

0

প্রবন্ধ : সুনন্দা চক্রবর্তী

Posted in

প্রবন্ধ


দোলের একাল সেকাল
সুনন্দা চক্রবর্তী



“ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল 
                   লাগলো যে দোল ...”

বসন্ত এসে গেছে। স্বাভাবিক ভাবেই শুরু হয়ে গেছে শিমূল পলাশের সাথে শরীর মনের রং মিলান্তি। তা সে খাবার হোক বা উৎসব, বাঙালী সব কিছুকে আপন করে নিজের মতো করে গড়েপিটে নিতে বেশ সিদ্ধহস্ত, দোলের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। দোল অবশ্য কোনও ইংরিজি বা মার্কিনী আমদানী নয়, খাঁটি মুলতানি আমদানী। নানাবিধ পুরাণ কথার মতো এও এক বীরগাথা, দর্প চূর্ণের ইতিহাস।ভগবান বিষ্ণুর উপাসক হিরণ্যকশিপু অমরত্বের অন্ধত্বে ভুলতে বসলেন স্বয়ং ইশ্বরকে।তাঁরই পুত্র প্রহ্লাদ [এ ক্ষেত্রেও বাঙালী তাকে সযত্নে ‘পেল্লাদ’ করে নিয়েছে]। তাকে ঠিক রামের মতো বীর বলা যায় কিনা জানিনা, তবে সে বেঁকে বসল বাবার এই গোঁয়ার্তুমির বিরুদ্ধে।সে বাবাভক্ত না হয়ে রয়ে গেল বিষ্ণুভক্ত। আর এই সিদ্ধান্তে তো বেজায় চটলেন অহংকারী রাজা।একের পর এক শাস্তির নিদান দিয়েও পথে আনা গেল না ছেলেকে। সব শেষে সেই প্রাচীন পন্থা, ভাইপোর বিরুদ্ধে ছলের আশ্রয় নিল দাদার প্রিয় বোন হোলিকা। একেবারে শেষ করে দেওয়ার ফন্দি এঁটে ভাইপোকে নিয়ে বসলো চিতায়, কোনও সাধনার কথা বলে, নিজে বসলো আগুন থেকে বাঁচার এক সুরক্ষাচাদর জড়িয়ে। কিন্তু রাখে হরি মারে কে! যেই না আগুন জ্বলা, অমনি চাদর খুলে হোলিকার গা থেকে সটান প্রহ্লাদের গায়ে। বাবা গো মা গো করে পুড়ে ছাই হল হোলিকা। এদিকে ভগিনীর শোকে উন্মত্ত হিরণ্যকশিপু শুরু করেছেন প্রচণ্ড ধ্বংসলীলা। এতে বিরক্ত হয়ে ভগবান বিষ্ণু স্বয়ং নেমে এলেন নৃসিংহ অবতার হয়ে।বধ হলেন হিরণ্যকশিপু। একই চিতায় জ্বলল ভাইবোনের শব।পরদিন সকালে রাজ্যের প্রজারা সেই চিতার ছাই নিয়ে মাখামাখি করল কপালে। এই মুলতানের ‘প্রহ্লাদপুরী’র হোলিকা দহনের গল্প।

কিন্তু প্রহ্লাদপুরী ছেড়ে এ কথা যত বাইরে এসেছে, পাশাপাশি এগিয়ে এসেছে ব্রজভূমির দিকে, ততই রূপ বদলেছে হোলি। রবীন্দ্রসংগীত থেকে নজরুলগীতি বা ভারতীয় প্রাদেশিক লোকগীতি সবেতেই ‘হোলি’, ‘হোরি’ মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। এবার আসা যাক ব্রজভূমির কথায়। ব্রজভূমি প্রেমিক পুরুষ কৃষ্ণের স্থান। এখানে হোলি কোনো বীরগাথা নয়, বরং অনেক বেশি করে প্রেমকথা, রাধা-কৃষ্ণের কথা। হোলি এখানে ভস্ম মাখা নয়, আবির মাখানো। ঘনশ্যামের ‘inferiority complex’ হতো শ্রীরাধিকা ও চন্দ্রাবলীদের ফর্সা রঙ দেখে। তাই চপলমতি কৃষ্ণ নতুন উপায় খুঁজল। কোনও এক বসন্তের পূর্ণিমায় অনেক রকম রং দিয়ে ভূত করে দিল সব ব্রজগোপীনিদের। কিন্তু এ কি হল! এতে রাধা যে হয়ে উঠলো আরো রমনীয়, মনগ্রাহী ও মনোলোভা। সে থেকেই বৃন্দাবনে হোলি শুরু। আজও সেখানে বসন্তে ষোলোদিন ধরে পালিত হয় এই উৎসব, আর হোলিকে কেন্দ্র করে ভারতের উত্তরে যা সবচেয়ে বেশী চর্চার দাবী রাখে, তা হল হোলির গান, রাজস্থানের ধামাল, উত্তরপ্রদেশ ছত্তিশগড়-এর প্রাদেশিক ‘ফোক’।দ্বারকাতে হোলি উদযাপনের মূল উপাদানই হল গানবাজনা। উত্তরপ্রদেশে আবার হোলির আরেক রূপ, লাঠমার। রাধারাণী মন্দির প্রাঙ্গণে জড়ো হয় কিশোর কিশোরীর দল, রাধাকৃষ্ণের সখাসখীর অনুকরণে ছেলেদের আবেশ-অভিসারের গান বা টিপ্পনী আর মেয়েদলের ছদ্মরাগে লাঠি প্রয়োগ, সব মিলেমিশে সেদিন সততই ‘প্রেমের বৃন্দাবন’। এছাড়া গোরক্ষপুরের ‘হোলি মিলন’ আদতেই মিলনোৎসব । উত্তরাখণ্ডের ‘কুমায়ুনী হোলি’ আবার রাগপ্রধান হোলি, আবিরের থেকে বেশী করে পিলু, ভীমপলাশী, সারং ‘বৈঠকি হোলি’ ও ‘খারি হোলি’র মূল উপাদান। ভোজপুরি ‘ফাগুয়া’ সমস্ত রাজনৈতিক রং ভুলিয়ে বিহারকে রাঙায় সত্যি কারের রঙে।দক্ষিণ ভারতে আবার হোলিতে পূজিত হন কামযুগল মদন ও রতি, হোলি যৌবনের উন্মাদনা, শীতের জড়তা কাটিয়ে নতুনের আবাহন, তোমার রঙে আমার হৃদয় রাঙানোর দিন। 

এবার ভারতের চৌহদ্দি ঘুরে ফিরি বাংলায়। ওই যে শুরুতে লিখেছিলাম - বাঙালী সব কিছুকে আপন করে নিজের মতো করে গড়েপিটে নিতে অভ্যস্ত, সত্যিই তো ,বাংলায় বসন্তোৎসব দেখলে কে বলবে দোলের বীজ অন্য কোথাও রোপিত হয়েছিল! শোনা যায়, কৃষ্ণপ্রেমী চৈতন্য বাংলায় নতুন করে দোল উৎসবের প্রবর্তন করেন। মহাপ্রভু মানবধর্মের সন্ন্যাসী, তাই চৈতন্য চেতনায় দোল পূর্ণিমা ‘forgive and forget’-এর দিন, একের রঙে সবার রঙিন হওয়ার দিন। পশ্চিমবঙ্গে দোল ‘দোলযাত্রা’ নামে বাংলা ক্যালেন্ডার গুলিতে লেখা হয়, তার কারণ দোল পূর্ণিমার দিন বহু অঞ্চলে পালকি করে রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ নিয়ে নগর পরিক্রমার প্রচলন আছে। বাঙালি যেখানে, সেখানে খাবারের বিশেষ পদ এবং উৎসবের গান থাকবে না, তাই কি কখনও হয়? তাই মঠ, ফুটকড়াই, মালপো, পায়েস আর বসন্তসন্ধ্যা বাঙালির দোলের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তবে দিন যায়, সময়ের সাথে সাথে উৎসব ও তার পালনের রীতিতেও বিবর্তন ঘটে। চৈতন্য যুগের দোল ও নয়ের দশকের দোল যেমন আলাদা। সে যুগে দোল বেশ খানিকটা পুজো-আর্চা কেন্দ্রিক, পুরুষ প্রধান। দিন দিন ধীরে ধীরে ভক্তিভাবের থেকে আনন্দ বসন্ত অনুভব ও তার প্রকাশ বেশী প্রাধান্য পেয়েছে। “আজি দখিন দুয়ার খোলা” নাচটা তুলতেই হবে, বাড়ির পুজোটা তো মায়ের ব্যাপার। ষোল বছরের মেয়েটা দোলের বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই ভাবতে আরম্ভ করত যখন প্রভাতফেরীতে নাচব, লালুদা নিশ্চয়ই ঘুম থেকে উঠে পড়বে, বারান্দা থেকে উঁকি দিয়ে দেখবে। সেই লালুদাও মনে মনে দুপুর বেলা শুয়ে ভাবছে, “সেদিন তো সব ছাড় , কুমকুম যখন ওদের বাড়ির রকটায় রং খেলবে, সুযোগ বুঝে আবির দিতে গিয়ে ছুঁয়ে দেখব গাল দুটো, যদি পারি খানিকটা লাল আবির সিঁথিতেও...।” ভাবতে ভাবতে দুপুর গুলো শেষ হয়ে যায়। না, দোলের দিন তার বেশী কিছু হল, লাগোয়া বাড়ির ছাদ ডিঙ্গিয়ে এক হল ওরা। ছাদের সিঁড়ির কোনায় ব্লাউজের প্রথম হুকটা খুলে খানিকটা রং...। দ্বিতীয় হুকটা আর খোলা হলনা। নিচ থেকে মা ডাকল “কুমকুম......!”

আজ সবকিছু আরেকটু খোলামেলা, সবের মতো বানিজ্যিকরণ হয়েছে দোলেরও। শহরকেন্দ্রিক জীবনে কম বাজেটের বসন্ত উৎসবের পাশাপাশি জায়গা করে নিচ্ছে ‘পূল পার্টি’, ‘রেইন ড্যান্স’ বা নিদেন পক্ষে ক্লাব পার্টি, ইটিং আউট। আগের বছর পাড়ার ছেলেদের বাঁদুরে রং আর পাঁক মাখাটা ঠিক পছন্দ করেনি সুজাত, তাই এবার সে ঠিক করেছে তার ফ্যামিলি আর দুটো বন্ধুর ফ্যামিলি নিয়ে ডায়মন্ড হারবারের এক হোটেলে যাবে। সামনে ভোট, তাই পাড়ার প্রভাতফেরীটা বেদখল করে নিয়েছে নেতার চামচাগুলো। দোলের শুভেচ্ছার নামে প্রচারটুকু সেরে নেওয়া, আর কি! এখন নুপূর যদি পাশের বাড়ির ছটুর থেকে গায়ে পড়া রং না মাখতে চায়, মাখবে না। সে আর তার ইঞ্জিনিয়ার বয়ফ্রেন্ড আগে থেকেই বুক করে রাখবে কোনও রিসোর্ট, ওখানে বিয়ারটা একটু দামী, ঠিক আছে, একদিন তো, নো ম্যাটার। কে জানে সে ছোড়দাদাদের ভাঙের লাড্ডুটা মিস করছে কিনা বা ‘শিলা মুন্নি’র সাথে বেজে বেজে উঠছে কিনা “ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল, লাগলো যে দোল...।”

0 comments:

2

প্রবন্ধ : সুতপা পাত্র

Posted in


প্রবন্ধ


নারী দিবস, ধর্ষণ ও আমাদের সমাজ
সুতপা পাত্র



সদ্য সদ্য মহা আড়ম্বরে উদযাপিত হল আন্তর্জাতিক নারী দিবস। ফেসবুকে অসংখ্য স্টেটাস পড়ল, কোথাও স্কুলে কেক কাটা হল, কোথাওবা পদযাত্রা আয়োজিত হল আমাদের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী কর্তৃক, কোথাও আবার ভাবগম্ভীর সভা আয়োজিত হল গুরুগম্ভীর বক্তৃতার মাধ্যমে। কিন্তু আসল ব্যাপারটি হল কই? অর্থাৎ যে মানসিক জাগরণ দরকার তার উত্তরণ না হলে এসব সভা-সমিতি, আয়োজন-প্রয়োজন সবই বৃথা। এখনও আমরা মেয়েরা পিরিয়ডের প্যাড কিনে আনি কাগজে মুড়ে, অসাবধানে জামার পেছনে দাগ লেগে গেলে সঙ্কুচিত হই। কিন্তু আজকের দিনে এই সংকোচটুকু আমাদের উচিত নির্দ্বিধায় বর্জন করা। নারী মুক্তি, নারী-স্বাধীনতার কথা বাতুলতা বই কিছু নয়, বিশেষত সেই দেশে, যে দেশের জনগণের স্বাধীন মত প্রকাশের মর্যাদা দেওয়া হয় না। মর্যাদা দেবার প্রশ্ন এই অর্থে এল যে মতামত আমরা দিই ঠিকই, কিন্তু তার মর্যাদা কতটুকু দেওয়া হয় গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কাঠামোর আড়ালে? প্রশ্নটা থেকেই যায়। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই আমরা গণতন্ত্রের কাষ্ঠপুতুল। অবশ্যই আমি এক্ষেত্রে সাধারন মানুষের কথা বলছি, ক্ষমতার শীর্ষে যাঁরা আছেন, তাঁদের না হয় বাদই দিলাম। নারী কী করে স্বাধীন হবে যেখানে গণতন্ত্র থেকে শুরু করে প্রশাসনতন্ত্র অবধি প্রতিটি স্তর পাঁকে পরিপূর্ণ?

ওই যখন থেকে নারী-পুরুষ সৃষ্টি হল তখন থেকেই তো ভগবান মেরে রেখেছেন নারীকে। শারীরিক‘ডিসঅ্যাডভান্টেজ’ই তো তার ওপর পুরুষের আধিপত্য বিস্তারে সাহায্য করেছে; তাকে বারবার ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে। শুধু ধর্ষণ নয়, কামনা চরিতার্থ হলে নৃশংস ভাবে মেরে ফেলাও হয় নারীরূপিনী দুর্বল শিকারকে। এরকম নারকীয় ঘটনার জাজ্বল্যমান প্রমাণ তো আছেই; সাম্প্রতিক কালের দিল্লীতে জ্যোতি সিংয়ের মৃত্যু বা পশ্চিমবঙ্গের কামদুনি হত্যা কান্ড। আমি আপাতত আমার এই লেখায় মেয়েদের ওপর ধর্ষণ কী হারে বেড়ে গেছে, ধর্ষকদের মেন্টালিটি কী, ধর্ষণের কী শাস্তি হওয়া উচিত, এসব বিষয়ে যাচ্ছিনা। আমি এটা বলতে চাইছি যে শারীরিক ভাবে না হলেও মানসিকভাবে আমরা প্রতিনিয়ত ‘ধর্ষিত’ হচ্ছি। অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে না পারা, ক্ষমতা যখন প্রশাসন ও গণতন্ত্রের রূপকে মুখে কুলুপ আঁটতে বাধ্য করে, তখন কী একটা গোটা সমাজ ধর্ষিত হয় না ? এ প্রসঙ্গে আক্কাই পদমশালীর উক্তিটি মনে পড়ে গেল, “That’s patriarchy. It doesn’t attack women alone, it attacks anyone and anything that is feminine. Even other men.”

একটা ছোট্ট ঘটনা বলি: রবিবার সন্ধে ৭টা, ধোবিঘাট ব্যারাকপুর। ব্যারাকপুরের এই ঘাট অনেক পুরনো। সম্প্রতি আগে যেখানে পাড় ছিল তার নীচের দিকে বেশ কিছুটা কর্দমাক্ত জমি শুকিয়ে ডাঙায় পরিণত হয়েছে। বর্ষাকাল নয়, তাই কাদার ভয় নেই; তার উপর নরম সবুজ ঘাসের আস্তরণ পড়ে বেশ মনোরম বসার জায়গা হয়েছে, তবে জায়গাটা বেশ উঁচু-নীচু। রবিবার, ছুটির দিন বলে লোকসমাগম কিছু বেশি ছিল, জোড়ায় জোড়ায় অনেক ছেলেমেয়ে ছিল, কেউ ঘাসের উপর বসে গল্প করছিল, কেউ বা হাত ধরে হাঁটছিল। ওই নীচু জায়গাটায় যে আলো থাকে না, একটু অন্ধকার। তবে গঙ্গার মনোরম শান্ত বাতাসে বসে থাকতে বেশ আরাম লাগে। ওখানে যে শুধু কাপলরাই বসে ছিল তা নয়, ছেলে পুলেরাও ছিল, ফ্যামিলিও ছিল একটা-দুটো। কিন্তু কোথাও যে কোনো বিশৃঙ্খলতা ছিল বা অশ্লীলতা ছিল, তাও নয়। যদি মুক্ত প্রাঙ্গণে নদীর ধারে পাশাপাশি ছেলে-মেয়ে বসে থাকা বা চুমু খাওয়া আদৌ অশ্লীলতার পর্যায়ে পড়ে! অন্তত আমার চোখে তো নয়ই। হঠাৎ দেখি তিন চার জন মহিলা পুলিশ সিভিল ড্রেসে এসে ওই কাপলদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে। দেখে মনে হয় মেয়েগুলি পুলিশের অস্থায়ী কর্মী,যাদের বয়স ২৫-২৬ বছরের মত, আজ্ঞা পালন করছে মাত্র। ওদের সাথে ছিল হেড কনস্টেবল এক মহিলা। পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী, ওদের সবাইকে ব্যারাকপুর উইমেন পুলিশ অফিসে যেতে হবে গাড়ি করে। সমস্বরে সবাই প্রতিবাদ করে বলে ওঠে তারা কী অপরাধ করেছে যে তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? কিন্তু পুলিশের বক্তব্য এখানে নাকি প্রায়ই রেড হয়, সন্ধ্যের পর আজেবাজে লোকজন আসে, মদ খায়। ভালোমন্দ একটা কিছু ঘটে গেলে কী হবে? সেদিন যাদের ধরা হয়েছিল তাদের মুখ যেটুকু দেখতে পেয়েছিলাম, তাতে এটুকু বুঝেছিলাম যে তারা প্রত্যেকে শিক্ষিত উচ্চ মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির ছেলে মেয়ে,এমনকি কেউ কেউ যে খুব ভালো চাকরি করে সেটা তাদের আত্মপ্রত্যয় দেখেই বোঝা যায়। প্রতিবাদের একটা কন্ঠ শোনা যাচ্ছিল- ‘‘সন্ধ্যের পর আজেবাজে লোকজন আসে, তো তাদের ধরে না নিয়ে গিয়ে আমাদের কেন ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? তাছাড়া এ জায়গাটা তো কোন পার্ক নয়, সন্ধ্যে অবধি থাকা যাবে না এমন কোন বিধিনিষেধও নেই….তাহলে?’’

…নাহ্ এই তাহলের কোনও পরিষ্কার উত্তর পাওয়া গেল না। এতে নেতৃস্থানীয়া মহিলা হেড কনস্টেবল বলেন- ‘‘এসব আমাকে বলে লাভ হবে না। আমার ওপর অর্ডার আছে, তোমাদের নিয়ে না গেলে আমার চাকরি যাবে।’’ কেই বা আর পুলিশের গাড়িতে উঠতে চায় বলুন? তাই প্রতিবাদের কন্ঠ ‘‘এবারের মত ছেড়ে দিন’’ বলে করুণ কন্ঠে উপনীত হলে; সান্ত্বনা দিয়ে বলা হয় তোমাদের নাম-ধাম সই করেই ছেড়ে দেওয়া হবে। তবুও কে আর গাড়ি করে পুলিশ স্টেশন যেতে চায়! তাই সবাই নারাজ হলে আইনের রক্ষকেরা স্বমূর্তি ধারন করে। পুলিশ ফোর্সের ভয় দেখান হয়। ইতিমধ্যে দুজন পুলিশ বাইকে করে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়; গাড়ির চালক অসভ্যের মত বলতে থাকে, ‘‘ওঠ, ওঠ শালা! গাড়িতে ওঠ।’’তার এমনি ব্যবহার দেখে মনে হয় এরা যেন কত বড় বড় সব খুন-ডাকাতি করেছে। সত্যি! খুন-ডাকাতি করলে তাও মানা যেত, এ তো তার থেকেও বড় অপরাধ কিনা, যুগ্মভাবে গঙ্গার ঘাটে একটু নিরিবিলিতে বিচরণ করা! ঘাটের পেছন দিকের যে পথ দিয়ে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানে রাস্তার দু-দিকে বাঁধানো বেদীতে আমরা যারা বসেছিলাম সবাই দেখেছিলাম, কিন্তু কেউ কোনও প্রতিবাদ করিনি। আর করবেই বা কে? কথায় বলে না বাঘে ছুঁলে আঠার ঘা, পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা! পরে একটি বিশ্বস্ত সূত্র থেকে জানতে পারি তাদের প্রত্যেকের নামে একটি করে পেটি কেস দেওয়া হয় এবং তাদের নিয়ে আসা হয় ব্যারাকপুর উইমেন পুলিশ অফিসে; সেখানের অফিসার-ইন-চা্র্জ সব নিয়ম-কনুন বলে জামিনের জন্য উকিলের ব্যবস্হা করে দেয় এবং প্রত্যেক কাপল ১০০০ টাকা করে দিয়ে ছাড়া পায়।

গোটা এই ঘটনাটা থেকে কী প্রমাণিত হয়? প্রশাসন দুষ্কৃতীদের না ধরে নিরপরাধ ছেলেমেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের অপরাধ কী না, তারা অন্ধকারে যুগ্মভাবে গঙ্গার ঘাটে বসেছিল! সত্যি যাতে কোনও অপরাধ না ঘটে তার জন্য দায়িত্ব তো প্রশাসনের নেওয়া উচিত। উল্টে ব-কলমে যেন দুষ্কৃতীদের এটাই বলা হচ্ছে যাদের জন্য তোমাদের কাজের অসুবিধে হয় দেখো তাদের তুলে নিয়ে গেলাম, তোমরা মনের খুশিতে অন্ধকারে মদ খাও, যা খুশি কর! তাহলে যা দেখা যাচ্ছে আজ একটা মেয়ে তার বয়-ফ্রেন্ডের সাথেই হোক বা একলাই হোক, সূর্যাস্তের পর শান্ত নিরালা জায়গায় দাঁড়িয়ে আকাশের তারা, নদীতীরের শীতল হাওয়া, কিছুই উপভোগ করতে পারবে না; এতে তাকে হয় দুষ্কৃতীরা ছিঁড়ে খাবে না হয় পুলিশ এসে তুলে নিয়ে যাবে।

এই পা আমার, শরীর আমার, তবু শুধুমাত্র নারী হওয়ার অপরাধে যথা ইচ্ছে তথা যাবার কোনও স্বাধীনতা নেই! কোনও নিরালা জায়গায় দাঁড়িয়ে প্রকৃতির সঙ্গে দু-দণ্ড আলাপ করতে পারবো না। এটা আমার নিজের চোখে দেখা একটা ঘটনা। কিন্তু এই ঘটনা কী প্রমাণ করে না নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এক্ষেত্রে ধর্ষিত হল ক্ষমতার হাতে? ধর্ষণ তো কেবল দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার নয়, ক্ষমতার প্রদর্শন, আস্ফালনও বটে। প্রশাসন যখন কামুক পুরুষের মত নিজেদের অর্থকামনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে অবিবাহিত প্রেমিক-প্রেমিকাদের যুগ্মভাবে অবস্থান করার অপরাধে আইনের অপপ্রয়োগ ঘটায়, তাতে ব্যক্তিবিশেষের যত না অপমান হয় তার থেকে বেশি অপমান হয় গোটা একটা সমাজের; প্রশাসনের ক্লীবত্ব ফুটে ওঠে মাত্র।

2 comments:

2

প্রবন্ধ : বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

Posted in


প্রবন্ধ


মানভূমের আঞ্চলিক কবিতা
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়



পুরুলিয়া জেলার আঞ্চলিক উপভাষায় লেখা কবিতা সাধারণের কাছে মানভূঁইয়া কবিতা নামেই অধিক পরিচিত। অবিভক্ত মানভূমের মধ্যে এই ধরনের কবিতার তেমন কোনও প্রচলন ছিল না। যা ছিল তা লোকগান, ঝুমুর, টুসু, ভাদু। এইসব লোকগানের মধ্যে লোকজীবনের চিত্র যেমন ছিল, ছিল দৈনন্দিন জীবনপ্রবাহের প্রভাব ও ভাবনার প্রতিশ্রুতি। ১৯৫৬ সালের ১লা নভেম্বর মানভূম ভেঙ্গে পুরুলিয়ার বঙ্গভুক্তি হলেও মানভূম শব্দটির বিলোপ ঘটেনি আমাদের জীবন চর্চা এবং লোকজীবন থেকে। সভ্যতার ক্রমাগ্রসরণে কোনও জাতি বা ভূখণ্ড তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বা ধারা নিয়ে কোনও স্থির বিন্দুতে অবস্থান করতে পারেনা। চেতনায় ও চিন্তায় আন্তর্জাতিক মেলবন্ধনের গভীর ও অভিপ্রেত প্রেরণায় নিজেকে সম্পন্ন করে নিজের অনেকখানি জলাঞ্জলি দিয়ে অন্যের অত্যাবশ্যক উপাদান আত্মীকরন করে। হার্বাট স্পেনসার সংস্কৃতি প্রসঙ্গে যা বলেছিলেন তা আরও একবার মনে করা যাক - “সংস্কৃতির মধ্যে সবসময় আহরণপ্রয়াসী পরিশীলিত জীবন সম্ভাবনা আছে, যা কোনও কালেই আত্মপরিপুষ্ট এবং আত্মসর্বস্ব নয়, বরং নিত্য বিচরণশীল ও নবায়ণের সম্ভাবনাঋদ্ধ।” কিন্তু সময় এগিয়ে গেলেও পুরুলিয়া তার অন্তরে প্রতিপালন করে চলে মানভূমের সেই বহমান ধারাটিই। গ্রাম বা শহর সর্বত্রই এই লোকজীবনের গভীরতর বার্তা। সংস্কৃতি শব্দটির মধ্যে যে সবুজতা এবং প্রাণের সমারোহ আছে, প্রত্যেকটি জাতির অভিব্যক্তির মধ্যে এই শ্যামলিমা ও স্পৃহণীয় মৌলিকতাই তাকে আগ্রাসনের হাত থেকে বাঁচায়। পুরুলিয়ার মানুষের ঋজু মেরুদণ্ড, মাটির সাথে সংলগ্ন থাকার দৃঢ়তা তাকে সাবেকী সাংস্কৃতিক ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হতে দেয়নি।



অবিভক্ত মানভূমে ঝুমুর লেখার রেওয়াজ ছিল। জেলার অধিকাংশ ঝুমুরকবি, যেমন গদাধর চৌধুরী, দীনা তাঁতি, পরেশ কামার, বরজুরাম, দ্বিজ টিমা, উদয় কামার মানভূমের ভাষাতেই তাঁদের গানের সুললিত ছন্দে মনের ভাব প্রকাশ করে গেছেন। যাঁরা আঞ্চলিক ভাষায় কবিতা লিখেছেন বা আজ যারা আঞ্চলিক ভাষায় কবিতা লিখছেন, এ বিষয়ে পূর্ববর্তী ঝুমুর কবিদের প্রভাবকে তাঁরা অস্বীকার করতে পারবেন না। যদিও কবিরা ঝুমুরের ধারা থেকে নয়, পুরুলিয়ার জল মাটি এবং নিজেদের অন্তরের আকুতি থেকেই লিখতে এসেছেন মাটির কবিতা।



ঝুমুরকবি গদাধর চৌধুরী যখন লেখেন ‘‘খালভরা হামকে সাথাছে / লদিভরায় হামকে সাথাছে / ঘরে আইসে খাছ্যে দাছ্যে মকমকাছে / কুলি কুলি কি মহিমা পাছে গো’’, বা দীনা তাঁতি যখন উচ্চারণ করেন ‘‘চাটি চুটি দিঞে মোরে / সাম করাল্য ডিপু ঘরে / লেখাইল আমার সাত পুরুষের নাম / লম্পট্যা শ্যাম ফাঁকি দিঞে চালালি আসাম’’, তা কবিতা হয়ে উঠুক বা না উঠুক, পুরুলিয়ার নিরাবরণ নিরাভরণ প্রান্তরের ছবিই উন্মুক্ত করে, যা শুধু আমাদের চোখের উপরিস্তরে নয়, অন্তরের গভীরেও দাগ রেখে দেয়।



মাটি ও মানুষের সংস্কৃতির এই ধারা থেকে পরবর্তী সময়ে আঞ্চলিক কবিতার ধারাটির উন্মেষ ঘটে। আঞ্চলিক কবিতা রূপে প্রসার ও পরিচিতি লাভ করে সাতের দশকে। এ ক্ষেত্রে পুরুলিয়ার ছত্রাক পত্রিকার সবিশেষ ভুমিকাও আছে। আমি শুধু সেই সমস্ত কবিদের কবিতা নিয়েই আলোচনা করব যাঁরা পুরুলিয়ার কবিতাকে পরিশীলিত রুপ দিয়ে কবিতাভাবনায় সমকালীন ফর্ম ও কনটেন্ট এনে সারা বাংলার মধ্যে ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা করেছেন। যদিও কখনওই মাটিকে অস্বীকার করে নয় বরং মৃত্তিকার গভীর তলদেশে শিকড় প্রসারিত করে।জেলার অগ্রনী কবিদের মধ্যে বেনু দেবী, সুবোধ বসু রায়, মোহিনীমোহন গঙ্গোপাধ্যায়, অমিয়কুমার সেনগুপ্ত এবং সুকুমার চৌধুরীর নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। মূলত এঁরাই পুরুলিয়ার ভাষায় লিখিত কবিতাকে সারা বাংলার প্রবাহের মধ্যে মিশিয়ে দিতে পেরেছেন। বুদ্ধিজীবি মহলের চর্চার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পেরেছেন।

আঞ্চলিক কবিতা যেহেতু একটি নির্দিষ্ট ভূমিখণ্ডের মানুষের কথ্যভাষায় লিখিত কবিতা, তাই খুব সঙ্গত কারণেই অন্য এলাকার মানুষের পক্ষে এই কবিতা পাঠ করা বা এর রসাস্বাদন করে আত্মস্থ করা খুব সহজ ব্যাপার নয়। ফলে এই ধরনের কবিতার সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার আগে এই ভাষারীতি ও উচ্চারণ বৈশিষ্ট্য অনুধাবন করা অত্যন্ত জরুরী। অনার্য-দ্রাবিড়–অস্ট্রিক (মুণ্ডারি, ওঁরাও, হো, সাঁওতালি) এবং আর্য গোষ্ঠীর (কুড়মালি, ভোজপুরি, মৈথিলী, হিন্দি, ওড়িয়া, সাদানি, খড়িবেলি) ভাষার আংশিক প্রভাব পড়েছে এই জেলার ভাষার মধ্যে।কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলা ভাষার পেলবতা অতিক্রম করে পুরুলিয়া বা পশ্চিম সীমান্ত বাংলার ভাষা হয়ে উঠেছে অনেক সমৃদ্ধ, শক্তিশালী ও তেজী। ‘‘বাজে বকিস না’’ এই নরম কথাটি পুরুলিয়ার ভাষায় যখন হয়ে ওঠে ‘‘আনখাই বিকলাইস না’’ বা যখন তাড়া কর কথাটি ‘‘ইঁড়কাই দ্যা’’তে পর্যবসিত হয়, তখন ভাষার শক্তিমত্ততা নিয়ে, তার তেজ ও গরিমা নিয়ে সংশয়ের কোনও অবকাশ থাকেনা। অপিনিহিতি, স্বরাঘাতের প্রাবল্যজনিত হ আগম, স্বতোনাসিক্যভবন এবং অন্তে অ উচ্চারণ এই উপভাষার মধ্যে পুরো মাত্রায় উপস্থিত।



পুরুলিয়া জেলার আঞ্চলিক কবিতার গ্রহণীয়তা ও জনপ্রিয়তা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে, প্রতিযোগিতায় আবৃত্তির জন্য নির্বাচিত হচ্ছে এই সব কবিতা। ক্যাসেটবন্দী হয়ে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে।

বেনু দেবী(১৯২১ – ১৯৯৪)ই জেলার আঞ্চলিক ভাষার কবিদের মধ্যে প্রবীনতমা। যদিও তাঁর আঞ্চলিক কবিতার বই ‘পুরহুইলার বারহমাসি’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৬ সালে। সামাজিক বৈষম্য, নারীর অবস্থান এবং মেয়েদের উপর অত্যচার, এইসব বিষয় তাঁর কবিতায় সহজেই জায়গা করে নিয়েছে। পণ ও প্রতিবাদ কবিতায় তিনি সেই প্রতিজ্ঞা প্রস্তুত মেয়েটিকে তুলে আনেন... ‘‘জমি বিচে পইসা বাপ কেনে দিবি পরকে / ল্যাখাপড়া হামায় শিখা, ঘুরাই দিব ঘরকে।’’



সত্য গুপ্ত একজন শক্তিমান কবি। তাঁর ‘সাঁজী’ যদিও পুরোপুরি ভাবে আঞ্চলিক কবিতার বই নয়, তবু তাতে বেশ কিছু আঞ্চলিক কবিতা পড়ার সুযোগ হয়। যা কবিকে চিনিয়ে দেয়।‘ঝান্ডি উঠা পরব’ কবিতায় তিনি লেখেন... ‘‘ভিখারি যদি ভিখ মাঙ্গাই রহে গেল ত শুখা ঝান্ডি ট উঠাই কি শুধু ফট তুলা হবেক?’’



কবি অরুণ চট্টোপাধ্যায় রাঢ়ের এক শক্তিমান ও বলিষ্ঠ কবি। তাঁর ‘সাঁঝবিহান’ আঞ্চলিক ভাষায় লিখিত শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে অন্যতম। কর্মসূত্রে তিনি পুরুলিয়ার সাঁওতালডিতে ছিলেন দীর্ঘদিন। পুরুলিয়ার মাটি ও মানুষের আপনজন হয়ে উঠেছিলেন। ‘ভুজুং মাঝির দেয়ালে পোস্টার’ কবিতায় তাই তিনি অনায়াসে লিখতে পারেন নিয়ত পদপিষ্ট হতে থাকা মানুষের যন্ত্রনার ছাপ... ‘‘বড় বাহার লাইগছে আইজ্ঞা দিয়ালে / লাল কালা রঙ দাইগলেন দমে / তা আইজ্ঞা উ গুলান কি বটে ... ছবি ত লয় ... লিখা বটে / ত কি লিখলেন বাবু / ই গাঁয়ের বিত্তান্ত কিছু লিখলেন ন কি / ইখেনে একটাও কুয়া নাই জোড়ের জল শুঁকাই গেইছে / একবেলা টুকচেক পান্তা খাইয়ে পাথর ভাঙ্গা মিশিনে খাইটছে ঘরের বিটি ছিলা / আমি বিনা লাঙ্গলের চাষি / ঠিকাদারের নাম কাটা মজুর / চদুর পারা ভালছি আংরাপুড়া আকাশ / মরা কাড়ার চামের পারা শুখা মাটি...’’

অধ্যাপক সুবোধ বসু রায় সম্পাদিত মানভূমী কবিতার দুটি সংকলনের মধ্যে প্রথমটি ১৯৮২ সালে প্রকাশিত হয়, পরেরটি ১৯৮৭ সালে। মানভূমী কবিতা সংকলন(১৯৮২ )-এর ‘ই সময়টয়’ কবিতায় বসন্তে পুরুলিয়ার অনুপম সৌন্দর্যের চিত্র তুলে ধরেন কবি... ‘‘মুকুলের বাসে মহ মহ কইত্তে থাকে চাইরদিক... / ই বোঙ্গাবুরুর দেশে / হলিতলি হয় আইজ্ঞা ই সময়টয় / টুকচা ঝুম্যর লাচ হয় / শারহুল ফুল গুইঞ্জে লিয়ে ডুংরি ধারে মাঝিঘরের বহু বিটিরা লাইচতে থাকে / এই রূপ ও জ্যোৎস্নায় তখন – বুকের ভিতরটা গুরগুরায়।’’



মোহিনীমোহন গঙ্গোপাধ্যায় জেলার আরেকজন শক্তিমান ও জনপ্রিয় কবি। প্রান্তিক উপভাষায় লেখা তাঁর অগণিত কবিতা পৌঁছে গেছে মানুষের ঘরে ঘরে। আকাশবাণী কলকাতা ও রাঁচি কেন্দ্রে অসংখ্য বার আমন্ত্রিত হয়ে মূল বাঙলা কবিতার সাথে পুরুলিয়ার আঞ্চলিক কবিতাও পাঠ করেছেন। ‘মাড় ভাতের লড়াই’ (১৯৮৫), ‘চাঁদে এককাঠা জমি’ (১৯৯৫), ‘মাঠ খসড়া’(১৯৯৯), তিনটি মানভূমী কাব্যগ্রন্থই পুরুলিয়ার আঞ্চলিক কবিতাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। তবু বলব, ‘মাড় ভাতের লড়াই’ একটি মাইলস্টোন। লফরা মাহাতর ‘জবানবন্দী’ কবিতায় নিজের অধিকারকে বলবৎ করার জন্য মজুরী বৃদ্ধির আন্দোলনে সামিল হয়েছিল লফরা। এই অপরাধে তার পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়। জেল থেকে ফিরে এসে সে দেখে শূন্য ঘর,স্ত্রী সন্তান অনাহারে মারা গেছে। তখন আরও প্রতিবাদী হয়ে ওঠে সে। তার কণ্ঠে ধ্বনিত হয় অধিকার অর্জনের দূর্বার শপথ... ‘‘ই মাটি সবার ই আকাশ সবার / সবার লাইগ্যে সব কিছু সমান না হল্যে / কাল্লায় কাল্লায় শোধ লিবঅ আইজ্ঞা / ই কনহ অন্যায় লয়, কনহ অন্যায় লয়।’’



গ্রাভিল হিকসের মতে – একজন প্রগতিশীল লেখক তাঁর রচনার মধ্য দিয়ে প্রলেতারীয় পাঠককে শ্রেণীসংগ্রামে তাঁর ভূমিকা ও অংশগ্রহণ সম্পর্কে অবহিত করেন, তাই যে অঙ্গীকারের মধ্যে লফরা মাহাতর জবানবন্দী কবিতার সমাপ্তি, সেই অধিকারই একদিন বাস্তব রূপ পায় ‘ইস্ট্রাইক’ কবিতায়। এই কবিতায় ডমরু বাগদি মরদের বেটা মরদ। “পুরুল্যার গাঁ গঞ্জের মড়ল গুল্যানের বড় দেমাক / দশ দিনের ইস্ট্রাইকে চুপসাই গেছে বুক / চারদিকের লে সামাল সামাল ডাক উইঠছে / দাবি দাওয়া মান্যে লিয়েছে সব – নীচু গলায় রা কাইড়ছে ইখন /... হ মরদের বেটা মরদ বটে ডমরু / বাবুদের পাঁজরা গুল্যান হিল্যাই দিলেক।’’



আশির শক্তিমান কবি সুকুমার চৌধুরী নিজস্ব প্রকরণে ও আঙ্গিকে অনন্য মাত্রা যোগ করেছেন জেলার আঞ্চলিক সাহিত্যে। ‘লাল লীল হইলদা তিন দিকে ঝাইলদা’ তাঁর জনপ্রিয় কাব্যগ্রন্থ শুধু নয়, শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থের স্বীকৃতিও পেয়েছে ‘দূরের খেয়া’, ‘নাগপুর থেকে’। মহারাষ্ট্রে স্বেচ্ছা নির্বাসিত এই কবির সাথে তাঁর জন্মভূমি পুরুলিয়ার মাটির সংযোগ যে কত নিবিড়, তা বোঝা যায় তাঁর কবিতাভাবনা অনুধাবন করলে। তাঁর কাব্যভাষা মাড় গালা ভাতের মতই ঝরঝরে নির্মল। গ্রামীণ যাত্রাপালা, লৌকিক দেবদেবী থেকে আরম্ভ করে ইঁজর পিঁজর ঝান্ডি খেল পর্যন্ত উদ্ভাসিত হয় তাঁর নির্মাণে। ভাভরার গন্ধে ম ম করে তাঁর কবিতার প্রতিটি অনুচ্ছেদ। লাম্বু সাউ, লুকা মাস্টার, ফাটা গনেশ, মাখনা, কন্ডাকটর লন্দী, মুতড়ু, সনুয়া পেড়কা, এইসব প্রান্তিক মানুষজনের আখ্যান বিম্বিত হয় তাঁর দ্যুতিময় কবিতায়... ‘‘মাথা গরম হয়ে গেল আরুনির। / ইড়কা বাছুরের পারহা / একগাড়ি বিলাতির চড়হে / খেপা ষাঁড়ের মত লাইচতে লাইচতে বল্য.../ দু নয়া ... যা শালহা ... নাই বিকব / ... ফকটেই লিয়ে যা বকাচদা তর বিজনিশের মুহে মুতি। / হাট ভরতি মায়া মরদ উয়াকেই দেখে, মুহে কাপড় দেয় / বিলাতি কুড়ায়। / ছেলাপুল্যারা হাততালি দেয় আর গেদলা বিলাতি তুলে / উয়াকেই ছুড়ে ছুড়ে মারছে।’’



গ্রামজ এক স্বাভাবিক ঘটনা তাঁর নিপুণ কলমে অসামান্য দীপ্তি পায়। আর বিলাতি ছোঁড়ার দৃশ্যটি অমরত্বের মহিমা অর্জন করে নেয় অনায়াসে।

গ্রাম্য জীবনের উপর একাগ্র ও নিবিড় হয়ে ওঠে সুকুমারের চোখ যখন ভোজনরসিক ঘাঘু ঠাকুরের কথা লেখেন তিনি। পরিচিত চিত্র ও চরিত্র কি অসামান্য মহিমায় উঠে আসে গ্রামবাংলার আকাঁড়া শব্দের নির্যাসে... ‘‘ঘাঘু ঠাকুরের মুখ চইলতেই থাকে / কনহ থকান নাই শুধু লাজাই গেলহে / মাঝে মাঝে মিটমিটাই হাসে আর / বকা খাওয়াসের ছুটু ছেলা পেন্টুল সামলাতে সামলাতে গুনহে / একশহ তিন ... একশহ চার ...’’

দেবাশিস সরখেল আঞ্চলিক ভাষাকে ছন্দের রূপ দিয়েছেন নিজস্ব ধারায়। তিনি যখন লেখেন... ‘‘তোর ক্ষেত ভইরেছে বড়হান ধানের শীসে / তুই কমতি ছিলি কিসে? যেমনি টাঁড় তেমনি মুগুর / বউটি খুব ডাগর ডুগর মাচান ভরা পুঁই / তবু কিসের দুখে ঝুইলে পড়লি তুই?’’, কবিতাটি জীবনানন্দ দাশের আট বছর আগের একদিন কবিতার কথা মনে করিয়ে দেয়।



মানভূমী কবিতার আর এক সার্থক কবি দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর ‘আঁধার বাইদ বহাল’ জনপ্রিয় কাব্যগ্রন্থগুলির অন্যতম। কবির ‘হারান্যা’ কবিতাটি বিভিন্ন মঞ্চে শোনা যায়। চাসনালার কয়লাখাদানে জল ঢুকে কত শ্রমিকের যে মৃত্যু হয়েছিল সেদিন তার কোনও পরিসংখ্যান নেই। পুত্রশোকে পিতার মর্মান্তিক কান্নায় ভরে উঠেছিল আকাশ বাতাশ। কত স্বামীহারা অনাথিনীর কান্না, মায়ের চোখের জল। অনেকেরই ঘরে ফেরা হয়নি। ছেলের মৃত্যুতে কাকা চাকরি পেলে ঘরে প্রাচুর্য আসে, অভাব দূর হয়। কিন্তু হারান্যার জন্য একবুক অপেক্ষা নিয়ে বসে থাকে তার বাবা... ‘‘আইজ শুনলি ক্যলেন আইসছে / সেই হারান্যা নদীটাই ঘুইরে আইসছে বাবু / লদীর সঙ্গে হামার বড় ছেল্যা ট নাই আইসবেক বাবু?’’

কবি অমিয়কুমার সেনগুপ্ত শুধু কবি নন, পুরুলিয়ার লৌকিক সংস্কৃতির প্রাণপুরুষও। এই জেলার কাব্য আন্দোলনে একটি উজ্জ্বল নাম। পাষাণময় যে দেশ, মানভূমের বিংশ শতাব্দীর কবিতার পাশাপাশি তিনি পুরুলিয়ার আঞ্চলিক কবিতার সংকলনও করেছেন। নতুন এক সুর সংযোজন করেছেন আঞ্চলিক কবিতায়... ‘‘এই দুনিয়া হামদের লয়, উরাই থাকুক সুকে/ কষ্ট লিয়ে চোলে যাবঅ রোইবে দাগা বুকে / অ বাবু লাও পেনাম হামার ... লখনা টুডু বলে / জীবন যাছ্যে পারল্যে বাচাও অ্যাতটুকু মাড়জলে।’’ বা ‘‘হা ভাল দিন ডুব্যে গ্যালঅ কাছাই গ্যালঅ রাত/ রাতকানা এই বুড়ার ইবার ধর নুনা ডাইনহাত।’’



কবি গোপাল কুম্ভকার সার্বিক অর্থেই একজন সাবঅল্টার্ন মানুষ। খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর কবিতায় উঠে আসে ‘দুখবুড়া আঠুড়্যা মানুষের পেটে গামছা বাইন্ধে’ দিন গুজরানোর কাহিনী... ‘‘হামরা ত শিকড় ছিঁড়া হে / হামরা চইখ থাইক্ত্যে কানা / হামদের কি রকত আছে? তেজ আছে? পুইড়্যে পুইড়্যে ন জুমড়া কাঠ হয়্যে গেলি।’’



তারাশঙ্কর দরিপার ‘কপাট খুলঅ’ কাব্যগ্রন্থে সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে স্থানীয় মানুষের কথা। কানাইলাল খাঁর ‘পরিযায়ী পাখিদের কথা’ (২০০৪) কাব্যগ্রন্থেও কয়েকটি আঞ্চলিক কবিতা রয়েছে। শঙ্কর চৌধুরীর কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরাপাতা’ (১৯৯৮), পার্থসারথী মহাপাত্রের ‘বড় মুকরুর ছা’ (১৯৯৮) সেভাবে রেখাপাত না করলেও আঞ্চলিক কবিতার ধারাটিকে পুষ্ট করেছে। জলধর কর্মকারের ‘হামরা মানভুঞা’ বটি বা মুজিবর আনসারীর ‘টাঁড় টিকর’ (২০০০) বিশেষ ভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। কবি অসিতকুমার মাজির অতি সফল ও জনপ্রিয় আঞ্চলিক কবিতার বই ‘পরব টাড়ের পাঁচালী’। কবি সনাতন মাজির ‘মানভুম কেইসন সুন্দর’। হরেন্দ্রনাথ ওঝার ‘রুখা মাটি কাব্য’-এর কবিতা আজও ভাবিয়ে তোলে। ‘অড়’ পত্রিকার সম্পাদক রমানাথ দাসের ‘ঢেউ’ এবং ‘আয় পুরুল্যা যায় পুরুল্যা’ উল্লেখযোগ্য মানভূমী বইগুলির মধ্যে অন্যতম।



মানভূমী কবিতার বিকাশ ও সৃজনে যেসব পত্রিকা সংগ্রামী ভূমিকা নিয়েছিল, তাদের মধ্যে ছত্রাক, রাঢ়ভূম, অনৃজু, সাহিত্য মন্দির এবং অড় পত্রিকার নাম উল্লেখযোগ্য। কবি ও লোক সংস্কৃতি গবেষক ডঃ সুভাষ রায় চেলিয়ামায় মানভূম লোকসংস্কৃতি পরিষদ গঠন করে জেলার আঞ্চলিক সাহিত্যকে উৎসাহিত করে চলেছেন। এই পরিষদ প্রতি বছর জেলার শিল্পীদের পুরস্কৃত সম্বর্ধিত করে।



উপরে উল্লিখিত কবিরা ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে যাঁরা এই ধরনের কবিতা লিখেছেন বা লিখে চলেছেন, তাঁদের মধ্যে মহাবীর নন্দী, হাজারী প্রসাদ রাজোয়াড়, কানাইলাল দরিপা, অনিল পাত্র, সিরাজুল হক, দুঃখহরণ মুখোপাধ্যায়, নির্মল আচার্য, তারাশঙ্কর দরিপা, চিত্তরঞ্জন সেনগুপ্ত, সৃষ্টিধর মাহাত, সুনীল মাহাত, ব্রজদুলাল চক্রবর্তী, শীলা সরকার, ছত্রমোহন মাহাত, ঝগড়ু মাহাত, নিত্যানন্দ মাহাত, সনাতন মাজি, অনিল মাহাত, অমল ত্রিবেদী, উদয়ন হাজরা, শঙ্কর চৌধুরী, প্রিয়ব্রত দাস, অশোক কুমার চৌধুরী, খগেন্দ্রনাথ মাহাত, পাগল বাউরী,কানাইলাল খান, নিত্যানন্দ রায়, বিজয় পণ্ডা, তপন ঘোষ, অসীম বন্দ্যোপাধ্যায়, চঞ্চল দুবে, ভোলানাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ভরত মাহাত, নির্মল পট্টনায়ক, চারিয়ান মাহাত, বিদ্যুৎ পরামানিক, সিদ্ধিনাথ চট্টোপাধ্যায়, প্রদীপ বাউরী, দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, অসিতকুমার মাজি, পার্থ সারথি মহাপাত্র, সুভাষ রায়, সুনীতি গাতাইত, অপর্ণা দেওঘরিয়া, বিশ্বজিৎ লায়েক, অভিমন্যু মাহাত, জলধর কর্মকার, দীনবন্ধু চট্টরাজ, রমানাথ দাস, মুজিবর আনসারী, তরুণ কুমার সরখেল, রোহিত চন্দ্র মণ্ডল, তরুণ বাউরি, সন্দীপ সরকার অরূপ শান্তিকারী এবং এই নিবন্ধকার থেকে শুরু করে এখন তো প্রায় সবাইই আঞ্চলিক কবিতা লিখছেন। ফলে এই প্রান্তিক উপভাষায় কবিতা লেখার ধারাটিও পরিপুষ্ট হচ্ছে।



১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত অখণ্ড মানভূম ভূখণ্ডে যে ভাষা আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল, তা বাংলা দেশের ভাষা আন্দোলন বা আসামের বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দলনের চেয়ে কোন অংশে কম গরিমাদীপ্ত নয়। ১৯৫৬ সালের ১লা নভেম্বর দিনটির গুরুত্ব তাই ২১শে ফেব্রুয়ারী বা ১৯শে মে-র মতই সমান তাৎপর্যপূর্ণ। মানুষের অশিক্ষার কারণে এবং প্রচারের অভাবে তা আড়ালেই থেকে গেছে। এই আন্দোলন শুধু ভারতবর্ষের এক ব্যতিক্রমী ঘটনাই নয়, এক রক্তলাঞ্ছিত অধ্যায়ের ঐতিহাসিক দলিলও একে বলা যেতে পারে। মূলত এই ভাষাধিকার অর্জনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে পুরুলিয়া জেলার মানুষের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করার প্রতিজ্ঞাকঠিন শপথ ও অঙ্গীকার। রুখা শুখা মানুষের টান টান শিরদাঁড়ায় তারই বজ্রনির্ঘোষ। শুধু ভাষার স্বাধিকার অর্জনই নয়, আঞ্চলিক কবিতার বিকাশে এবং তার গৌরবময় প্রসারে যে সমস্ত কবি, সাহিত্যিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মীগণ এগিয়ে এসেছেন এবং সারা বাংলার দরবারে পুরুলিয়ার এই উপভাষাকে গ্রহণীয় করে তুলেছেন, সাহিত্যের মূলস্রোতে তাঁদেরও অবদান কম নয়। এর ফলে মূল বাংলা ভাষাও সমৃদ্ধ হচ্ছে, গতিশীল হচ্ছে। বাবু বাঙলার কাছে আজ আর আঞ্চলিক উপভাষা উপেক্ষিত নয়। বরং প্রসারিত হচ্ছে সার্বিক বাঙলা ভাষার রূপরেখা। প্রতিদিন নতুন নতুন আকাঁড়া শব্দে ভরে যাচ্ছে বাংলার শব্দকোষ।



ঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃ



তথ্যসুত্র

১। নির্বাচিত আঞ্চলিক কবিতা (কবিতা পাক্ষিক) – সম্পাদনা – মোহিনীমোহন গঙ্গোপাধ্যায়

২। পুরুলিয়ার আঞ্চলিক কবিতা সংকলন (সঞ্চয়ন) – সম্পাদনা - অমিয়কুমার সেনগুপ্ত

৩। নির্বাচিত মানভূমী কবিতা (ক্রিয়েটিভ এ্যসোসিয়েটস) - সম্পাদনা - শ্রমিক সেন



৪। মানভূমের কবিতা সংকলন (অনৃজু) – সম্পাদনা - ডঃ সুভাষ রায়

2 comments:

0

বিশেষ রচনা : রিয়া চক্রবর্তী

Posted in


বিশেষ রচনা



নারীদিবস
রিয়া চক্রবর্তী 



নারীদিবসের উৎসবে ঝলমল করছে পাহাড় ও নদী। চুপচাপ গাছের আড়ালে ফিসফাস শব্দ, যেসব পরিযায়ী পাখিরা তাদের আস্তানা ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম দক্ষিণে, একটু উষ্ণতার জন্য। তারা একে একে ফিরছে সেই চেনা পৃথিবীর গন্ধে। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পরে রাতে ঘরে ফেরে শিশুটির মা, অবসন্ন তার শরীর। উনুনে ফুটছে ভাত আর আলু সেদ্ধ, রাতের বিছানায় জোর করে প্রেমের উষ্ণতায় ভেঙে পড়ছে শরীর। এই ভূতগ্রস্ত জীবনের অন্ধকার কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত তা - অঙ্কের কোন সংখ্যা দিয়েই বিচার করা যাবেনা। সকালে শিশুটি দুহাত মেলে দেয় মায়ের দিকে,  অস্ফুট শব্দে ডাগর চোখে মাকে দেখে আজ সে কিছুতেই যেন ছাড়বেনা, তবুও নিবিড় আলিঙ্গন থেকে ছেলেকে নামিয়ে  চলে যায় তার কাজে। রাতে ফেরার পথে পথ আটকায় চারজন পুরুষ, জোর করে বিবস্ত্রা করে তাকে লুঠ করে তার বশিষ্ট লজ্জা। পথের ধারে পরে রইলো নিথর দেহ প্রাণ ছেড়ে গেছে বিষাদলোক।

আচ্ছা, কবরের আড়ালে কফিনে গিয়ে পৌঁছোবে তো নারীদিবসের উৎসবের স্লোগান!

0 comments:

0

বিশেষ রচনা : পলাশ কুমার পাল

Posted in


বিশেষ রচনা


আমি নারী
পলাশ কুমার পাল




আমি নারী। এই জন্যই হয়তো আমার বিশেষত্ব। সাম্যতা আনার চেষ্টায় পুরুষ দিবসের না-অস্তিত্ত্বে নারীদিবস পালিত হয়। উৎসব! অনুষ্ঠানমুখর পরিবেশে কথার বেলুন সেজে ওঠে... বাতাসের অস্তিত্ত্ব ফুরালে সে বেলুন আর বেলুন নয়।

আসলে দোকানে দেখানদারি পুতুলের মতো এই 'নারী' শব্দের চমকে প্রত্যেকে স্বচ্ছ হয়ে উঠতে চায়। সেখানে নারী নিজেও বাদ যায় না। যেমন ধরুন আমি। নিজের জন্মের মুখরতা কতটা বর্ণময় বা বনেদী ছিল জানি না। তবে জন্মের পরবর্তী ক্ষেত্রে বড়ো হয়ে ওঠার মাপনীতে বয়সের বৃদ্ধির পাশাপাশি কিছু দাগ ক্রমশ সহযাত্রী হয়ে ওঠে আমার নির্বাক শিরদাঁড়ায়, যে দাগই নির্দেশ করে 'আমি নারী ওরা পুরুষ'।

আমি বিবাহের মঞ্চে চন্দনে-ফুলে সেজে বসে পড়ি সাতপাকের গভীর জলে... সুবাসিত রজনীগন্ধা ও অলংকারের মুখোশী আলাপে স্বপ্নগুলো যেন প্রজাপতি হয়ে ওঠে; যার কোনও শিরদাঁড়া নেই, নেই শিকড়! কেবল এক ফুল থেকে অন্য ফুলে উড়ে বেড়াবার বৈশিষ্ট্যগুণে নিজেদের মানিয়ে নিই। দেশ শিক্ষিত হয় বর্ণমালায়, যুক্তিতে শাণ লাগে, বিবাহিত জীবনে শৈশবের অঙ্কিত পদবী কুষ্ঠিকে জীবন কুষ্ঠি রূপে সচল রাখি; আর বলি, "এই দেখো, আমরা নারী নিজেদের পরিচিতিকে নিজের মতো করেই রেখেছি। আমরা এখন স্বাধীন পাখি!"

কিন্তু সাতপাকের পরের সময়ে? পুরুষদের শিকড় আর আমাদের না-শিকড় দুই উদ্ভিদের পার্থক্যকে বাড়িয়ে দেয়। না-শিকড় মানে জড় বলছি না! শৈশব থেকে যৌবন পর্যন্ত বেড়ে ওঠা বাগানের পরিবেশকে বিদায় জানিয়ে পাকাপাকিভাবে অন্য বাগানে বাসা বোনার মধ্যে যতটা তোমরা নতুন স্বপ্নের কথা বলো, তার থেকে বেশি ব্যর্থতা আমি বা আমাদের নারীদের দুর্বল করে। করণ শৈশব থেকে যে পরিবেশে নিজের শিকড় তৈরি হয়, তা সাতপাকের চক্রাবর্তে বিনষ্ট হয়ে যায়। নতুন সংসার, নতুন দেয়াল, নতুন মানুষজনের পরিবেশে শৈশবের মতো নতুনভাবে নিজেকে আবারও শিকড় তৈরি করতে হয়। ব্যতিক্রম হয়তো কিছুজন থাকে। তবে সময়-কাল-সভ্যতার অভিনবত্বের মাঝে নিজেরা যখন স্বাধীনতার রঙীন বেলুন ওড়াই আধুনিকতার আকাশে, ঠিক তখনই অ-বিবর্তিত এই লাটাই আর সুতো বলে দেয় ভূমির অস্তিত্ত্বের কথা।

সভ্যতা সৃষ্টির আদিমতা যে ভূমিতে জন্ম, সে বিবাহ। বিবর্তিত সভ্যতার মাঝে নারী-পুরুষের এই মিলন মানবসভ্যতার মূল বীজ। কিন্তু দুই পরিবেশের দুই মানুষের মিলিত সভ্যতা কোন পরিবেশে লালিত হবে? পুরুষতান্ত্রিক সমাজ হয়তো আদিকালে নিজেদের জন্মভূমিকে বেছে নিয়েছিল। কিন্তু শিক্ষিত আত্ম জাগরিত নারীরা? এই প্রশ্ন খুব একটা শুনিনা। আমরা নারীরা বা আমি নানা নারীবাদী প্রশ্নের বুদবুদে ফেণিত হলেও শ্যাম্পেন হয়ে রয়ে যাই বোতলে বা সভ্যতার ঠোঁট বেয়ে সভ্যতার মজ্জায়...

অনেকটা টবের গাছের মতন। আলোর সন্ধান চাই! চাই মাটিও! অথচ সজ্জিত থাকি বাড়ির ছাদে বা বারান্দায় বা উঠানে বেড়ে ওঠা পুরুষের আলংকারিক হয়ে। গাছ হয়ে না-ওঠার ব্যর্থতায় শুধু নীল আকাশ দেখা, নিজেদের জন্মভূমির আটচালাকে বিদায় জানিয়ে নতুন মাটির সন্ধানে শিকড়ের 'বিবাহ উপকথা'। নারীবাদের স্রোতে ভাসতে ভাসতে এক সমুদ্র নারী ঢেউয়ের নোনতায় সভ্যতার সমুদ্র সৈকতে ভেঙে পড়া...

আমি সেই সমুদ্র বা সামুদ্রিক ঢেউয়ের নারীদের অস্তিত্ত্ব! তোমরা পর্যটনের সুখ উপভোগ করো, শরীরে মাখো ঢেউ... স্ফূর্তিতে! আমি নারী বা আমরা নারীরা টবের সীমাবদ্ধতায় অট্টালিকার ব্যর্থতা! নারীদিবস আসে-যায় অতিথির মতো সাদা ধবধবে লালপাড় শাড়িতে। আসলে ধবধবে শুভ্রতার নারীবাদে লালপাড় হল এই ব্যর্থতার রক্তলেখা।

0 comments:

0

প্রাচীন কথা : কৃষ্ণ দেবরায়

Posted in


প্রাচীন কথা


বিন্দুতে সিন্ধু-দর্শন (অন্তিম পর্ব )
কৃষ্ণ দেবরায়



প্রত্নতাত্ত্বিক এবং নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্টে আর্যদের কোনও উপস্থিতি হরপ্পা সভ্যতায় খুঁজে পাওয়া না গেলেও হাল ছাড়লেন না হিন্দু মৌলবাদীরা। তাঁদেরই অনুগত কিছু প্রত্নতাত্বিক ভারতবর্ষকে আর্যদের আদি বাসভূমি বলে প্রচার করা শুরু করেন। ভারতে আর্যদের আদি বাসস্থান বলে তাঁরা নির্দেশ করেন সরস্বতী অববাহিকা। এস পি গুপ্তর মতানুসারে, ‘‘সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতা পূর্ণবিকশিত বৈদিক সভ্যতারই এক গুরুত্বপূর্ণ দিকের প্রতিনিধিত্ব করে।’’ তিনি আরো বলেছেন যে হরপ্পা সংস্কৃতি ছিল উভয় নদীরই দান এবং “সম্ভবত শেষোক্ত(সরস্বতী) নদীর দানই বেশি।” তিনি সিন্ধ বনাম সরস্বতী এবং ভারত বনাম পাকিস্তানের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপারটি চিন্তা করেছিলেন। তাঁর মতে সরস্বতী এবং তার শাখা নদীগুলির পাড়ে সাতশোরও বেশি হরপ্পা ক্ষেত্র পাওয়া গেছে, আর সিন্ধ নদীর এবং তার শাখানদী গুলির তীরে একশোটি ক্ষেত্রও আবিষ্কৃত হয়নি। এর থেকেই সরস্বতীর গুরুত্ব বোঝা যায়।

কিন্তু আমরা সিন্ধু এবং সরস্বতীর তুলনার সময় অন্যান্য তুল্য বিষয়গুলি কমিয়ে দেখতে পারিনা। গোড়াতেই বলা দরকার,সরস্বতী নদীকে ঘগ্‌গর বা হাকরা নদীর সঙ্গে চিহ্নিত করে দেখা হয়েছে। পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং রাজস্থানে নদীটিকে ঘগ্‌গর নামে অভিহিত করা হয় আর সীমান্তের ওপারে পাকিস্তানে তাকে ডাকা হয় হাকরা নামে। এটা পরিস্কার বোঝা দরকার যে হাকরা-ঘগ্‌গর হলো সিন্ধুর একটি শাখা নদী। উপরন্তু, হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো এবং ঢোলবিয়া সমেত হরপ্পার প্রধান ক্ষেত্রগুলির একটিও হাকরা বা ঘগ্‌গর এর তীরে অবস্থিত নয়। কেবলমাত্র কালিবঙ্গান ঘগ্‌গর এর কাছাকাছি। ঘগ্‌গর যেখানে গুরুত্বপূর্ণ নদী সেই আম্বালা কিংবা সিরসা জেলায় কোনও হরপ্পা বসতির হদিস পাওয়া যায়নি। 

মৌলবাদীরা সাম্প্রদায়িক বিবেচনায় সিন্ধুর চেয়ে সরস্বতীর দাবি প্রতিষ্ঠিত করতে চান অতিরিক্ত মাত্রায়। হরপ্পা প্রসঙ্গে তাঁরা মনে করেন যে ভারত বিভাগের পর সিন্ধু মুসলমানদের সঙ্গে সম্পৃক্ত, কেবলমাত্র সরস্বতীই হিন্দুদের সাথে রয়ে গেছে! ঋক্‌ বেদে সরস্বতীর দিকে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে, অনেক সূক্ত রচিত হয়েছে তাকে উপলক্ষ্য করে; সুতরাং তাঁরা তাঁদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্যেই এই নদীটিকে ব্যবহার করতে চান। কিন্তু লক্ষণীয় যে সরস্বতী নামে অনেক নদী আছে এবং এদের মধ্যে প্রাচীনতমটিকে হাকরা অথবা ঘগ্‌গর এর সঙ্গে চিহ্নিত করা যায়না। ঋক্‌ বেদে সরস্বতীকে বলা হয়েছে নদীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ।এটিএকটি বৃহৎ নদী। বারোমাসই যার জল থাকে, এমন নদী। হাকরা বা ঘগ্‌গর এর সাথে তার চরিত্র মেলেনা। প্রাচীনতম সরস্বতীকে আফগানিস্তানের হেলমাণ্ড এর সঙ্গে এক বলে চিহ্নিত করা হয়েছে, যা আবেস্তায় হরখাওয়াতি নামে উল্লিখিত। যাই হোক, ভাষাতাত্ত্বিক এবং স্থান-কালের আগে-পরে বিচারে দৃষ্টিকোণ থেকে ঋকবেদের সঙ্গে আবেস্তার তুলনা করলে কোনও সন্দেহই থাকেনা যে আদি বৈদিক সরস্বতী আর হরখাওয়াতি বা হেলম্যাণ্ড একই নদী। বৈদিক জনগণ যত অগ্রসর হয়েছে তারা এই সরস্বতী নামটি পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান, গাড়োয়াল, প্রয়াগ এবং রাজগীর পর্যন্ত নিয়ে গেছে। হিন্দু মৌলবাদীরা যতই চেষ্টা করুক ইতিহাস কে বিকৃত করে নিজেদের কার্য সিদ্ধি করতে, তাদের আগে এইসব প্রমাণগুলিকে খণ্ডন করতে হবে। আর সেগুলি যতদিন না হচ্ছে ততদিন দুটো কথা অবশ্যই আমাদের মেনে নিতে হবে। প্রথমটা হল যে বৈদিক সভ্যতার অনেক আগে থেকেই অবিভক্ত ভারতে এক উন্নত সভ্যতা ছিল এবং দ্বিতীয়ত, হরপ্পা সভ্যতা আর্যদের এদেশে আসার অনেক আগের সভ্যতা। ( শেষ )

0 comments:

13

প্রাচীন কথা : অমিতাভ প্রামাণিক

Posted in


প্রাচীন কথা


সূর্যোদয়ের প্রাক্কালে
অমিতাভ প্রামাণিক



এক


খাচ্ছিলো তাঁতী তাঁত বুনে।

তাই তো খায়, এতে আর নতুনত্ব কী আছে? আর এ তাঁতী তেমন অবিমৃশ্যকারীও নয় যে এঁড়ে গরু কিনতে যাবে। সুতরাং সে পথে তার কাল হয়নি। এর বাড়িতে ব্যাঙের বাসাও নেই। নিজের যে ছা, সে কোলা ব্যাঙের ছায়ের মত খায় দায় গান গায় তাইরে নাইরে না করে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ায় না।

একটা ছা নাকি? গোটা পাঁচেক। কিন্তু বাকিদের কথা থাক। সবচেয়ে বড়ো যে, যার নাম বিল, তার কথাই বলি।

নর্দাম্পটনশায়ারে শ’ আটেক মাত্র জনবসতির এক অজ গ্রামে বাড়ি। বাচ্চা বিল ইস্কুলে যায়, পড়াশুনা করে। আর পাঁচটা বাচ্চা যেমন, বিলের শেখার ইচ্ছে তাদের থেকে বেশি বই কম না। গাছপালার বিষয়ে জানতে সে উৎসুক, ভাষাশিক্ষায় চৌকস। নিজে নিজেই চেষ্টা করে ল্যাটিনের পাঠ শিখে নেয় সে। বইতে কলম্বাসের ভ্রমণকাহিনি পড়েছে, বন্ধুদের বলে সে কলম্বাসের মত দেশ বিদেশ ঘুরতে চায়, বন্ধুরা তাকে বিল্লু কলম্বাস বলে খ্যাপায়। কাকা পিটার কানাডায় যোদ্ধা, সে বিলকে শুনিয়েছে জাহাজ আর সমুদ্রের গল্প। বিলের মন সর্বদা নতুন জগৎ দেখার আশায় বুঁদ হয়ে থাকে।

বাবা এডমন্ড পেশায় তাঁতী, কিন্তু তাঁত বুনে সংসার চলে না বলে তার পাশাপাশি গ্রামের চার্চে প্যারিশ ক্লার্কগিরি করেন, যাজকদের ইউনিফর্ম কেচে দেন, আর সেখানকার স্কুলে সবচেয়ে নীচু ক্লাসে শিক্ষকতাও করেন। বিলের বয়স যখন মাত্র সাত বছর, তার সারা শরীরে এক বিচিত্র অ্যালার্জি দেখা দিলো। রোদে গেলেই চামড়ায় চাকা চাকা দাগ, চুলকে ঘা। মোটে রোদ সহ্য করতে পারে না তার চামড়া, ফলে বাড়ির বাইরে কাজকর্ম করা তার পক্ষে মুশকিল হয়ে উঠলো। বয়স চোদ্দ পুরতেই তাই তাকে ধরে পাঠিয়ে দেওয়া হলো পাশের গ্রাম প্যাডিংটনের এক মুচি ক্লার্ক নিকোলাসের কাছে। ক্লার্কও এডমন্ডের মতই জুতো সেলাইয়ের অবসরে চার্চেও কাজ করে। তার দোকানে ছিল একটা ওল্ড টেস্টামেন্টের কপি, তার কিছু অংশ আবার গ্রীক ভাষায় লেখা। ক্লার্কের কাছে চামড়ার কাজ শেখার মধ্যেই গ্রামের এক প্রতিবেশী কলেজ পড়ুয়া ছেলের কাছে গ্রীক গ্রামার বই চেয়ে নিয়ে নিজে নিজেই গ্রীক ভাষা শিখে নিলো বিল।

ক্লার্ক নিকোলাসের চামড়ার দোকানে আর এক শিক্ষানবিশ ছিল, তার নাম জন, সে আবার প্রতিবাদী ধরণের। এরা যে চার্চে যেত, চার্চ অফ ইংল্যান্ড, সে তার মতে বিশ্বাসী নয়। বিলকে ফুসলে জন নিয়ে গেল পাশের গ্রাম হ্যাকলটনে, সেখানে আরো কিছু সমমনস্কদের সহায়তায় খুলে বসলো এক কংগ্রিগেশনাল চার্চ।

বিলের বয়স যখন আঠারো, ক্লার্ক নিকোলাস মারা যায়। বিল গেলো তার পাশের গ্রাম হ্যাকলটনের মুচি টমাস ওল্ডের কাছে কাজ শিখতে। দু বছর যেতে না যেতেই বিল টমাসের শালী ডরোথিকে বিয়ে করে ফেললো, তখনো তার বয়স কুড়িও পোরেনি।

ডরোথির ডাক নাম ডলি, সে বয়সে বিলের চেয়ে ছ’ বছরের বড়, তার ওপর নিরক্ষর। কিন্তু বিল অতশত গ্রাহ্য করলো না। বিয়ের রেজিস্টারে ডরোথি সই করলো মস্ত একটা ক্রস মেরে, নামটা ঠিকঠাক সই করতেও শেখেনি সে। বছর ঘুরতেই তার পেটে বাচ্চা, জন্ম হলো মেয়ে অ্যানের। একে তো আয় নেই তেমন, তার ওপরে আবার এই সংসারের চাপ, অথৈ জলে পড়ে গেল বিল।

অ্যান অবশ্য বেশিদিন জ্বালায়নি বিলদের। এক বছর পূর্তির আগেই তার কী এক জ্বর হলো, তাতেই মারা গেলো সে। সেই জ্বর হলো বিলেরও, সেও প্রায় মারাই পড়ছিল, কিন্তু কোনোমতে সেরে উঠলো আরও ভগ্নস্বাস্থ্য হয়ে। তার মাথার সব চুল পড়ে গেল, সে আর গজালো না কোনোদিন। বিলের এই দুর্দিনে তার মা গ্রাম থেকে এলেন ছেলেকে দেখতে। ছেলের আর্থিক অবস্থা যা দেখলেন, তা তিনিও সহ্য করতে পারলেন না।

টমাস ওল্ড মারা যেতে তার জুতোর দোকান বিলের হয়ে গেলো বটে, কিন্তু ওল্ডের বিধবা বৌ আর বাচ্চাদের দেখাশুনার ভারও বিলকেই নিতে হলো। বিল তখন সবে বাইশ বছরের। ব্যবসাপত্র তার দ্বারা মোটেই হয় না। লোকজন ধারে মাল নিয়ে টাকা দেয়না, বিল তাগাদা দিয়ে আদায় করতে পারে না।

উপায় না পেয়ে সন্ধ্যেবেলা একটা স্কুল খুলে ফেললো সে। কিন্তু ছাত্র হিসাবে সে যতটা মনোযোগী, শিক্ষক হিসাবে ততটাই ব্যর্থ। সংসারের খরচ বেড়েই চললো, পাওনাদারদের উৎপাত শুরু হলো, বিল কিছুতেই দারিদ্র্য থেকে বেরোতে পারে না। পড়াশুনা অবশ্য চলতেই থাকলো ইংরাজী, ল্যাটিন, গ্রীক ভাষায়। ধর্মগ্রন্থ পড়ে, ঈশ্বরের মহিমা কত অপার তা অনুধাবন করে, তার ওপর যে কেন তাঁর করুণা বর্ষিত হয় না, তা অবশ্য বুঝতে পারে না।

ছোটবেলায় পড়া ছিল কলম্বাসের কথা। এখন সে পড়লো অ্যান্টার্কটিকায় ক্যাপ্টেন কুকের অভিযানের কাহিনি। তারও মনে জেগে উঠলো দূরদেশে ভ্রমণের ইচ্ছা।

বছর দুই পরে বিল মল্টন নামে এক ছোট্ট গ্রামের নগণ্য এক ব্যাপ্টিস্ট চার্চে যাজকগিরির কাজ পেলো। ততদিনে ক্লার্কের বিধবা আর তার ছেলেপুলে তার ঘাড় থেকে নেমে গেছে, কিন্তু নিজের সংসারের দায়িত্ব গেছে অনেক বেড়ে। ডলি এক এক করে তিন বাচ্চার জন্ম দিয়েছে – ফেলিক্স, উইলিয়াম আর পিটারের। তার দুর্দশা আর ঘুচছেই না। মল্টনেও সে ছাত্র পড়িয়ে সংসারে উপার্জন বাড়ানোর চেষ্টা করেছে, কিন্তু লাভ হয়নি। তার ছাত্ররা তাকে ছেড়ে অন্য জায়গায় পড়তে চলে যায়, ফলে তাকে আবার মুচিগিরি ধরতে হলো। বিল ভাবলো, সে প্রভু যিশুর বাণী প্রচার করবে, কিন্তু তার সহযোগীরা বলে, ধুর, তোমার দ্বারা হবে না। চার্চে জন সাটক্লিফ, জন রায়ল্যান্ড আর অ্যান্ড্রু ফুলার নামে তিনজন যজমানি করে, তারা বিলকে ভালবাসে, কিন্তু জনগণ বিলকে চায় না।

বিল পড়াশুনা নিয়ে থাকে। যে জুতোর দোকানে সে মুচিগিরি করে, সেখানে সে চামড়া কেটে কেটে পৃথিবীর ম্যাপ বানিয়ে দেওয়ালে ঝুলিয়ে কোন জায়গায় কত লোক, তাদের কী ধর্ম, কী করে তারা যাবতীয় তথ্য লিখে রাখলো। দোকানের মালিক বোঝে বিল জ্ঞানী লোক, পার্ট টাইম কাজ করলেও সে পুরো পয়সা দিয়ে দেয়, কিন্তু তাতেও বিলের চলে না তেমন। ল্যাটিন গ্রীকের পাশাপাশি সে ততদিনে হিব্রু, ফ্রেঞ্চ আর ড্যানিশ ভাষাও শিখে ফেলেছে।

বিল খবরাখবর পড়ে আর ভাবে সাধারণ মানুষের যে এত দুঃখ দুর্দশা, তা কেবল প্রভু যিশুর মাহাত্ম্য না অনুধাবন করার জন্যেই। যত বেশি বইটই পড়ে, ততই তার এই ধারণা দৃঢ় হয়। সে এর ওপরে বইও লিখে ফেললো আর অন্যান্য যাজকদের তার মতে উৎসাহিত করতে লাগলো। একত্রিশ বছর বয়সে জনা বারো যাজক মিলে একটা সোসাইটিও বানিয়ে ফেললো সে।

বিলের যখন জন্ম হয়, তার মাত্র চার বছর আগে তার স্বদেশী রবার্ট ক্লাইভ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হয়ে ভারতে বাণিজ্য করতে এসে সেখানে এক শক্তিশালী নবাব সিরাজউদ্দৌল্লার বিশাল সেনাবাহিনীকে কৌশলে যুদ্ধে পরাস্ত করে এক ব্যাপক এলাকায় শুধু বাণিজ্য নয়, প্রভুত্ব করার অধিকার পেয়ে গেছে। তার বছর সাতেক পরে বক্সারের যুদ্ধে জিতে তারা সমগ্র বাংলায় আধিপত্য কায়েম করে ফেলেছে। ক্লাইভের পরে ওয়ারেন হেস্টিংস ও তারও পরে কর্ণওয়ালিস বাংলা শাসন করছে। যুদ্ধ চলছে দক্ষিণে টিপু সুলতানের সঙ্গে, পশ্চিমে মারাঠাদের সঙ্গে। এই যুদ্ধে জয় হলে পুরো ভারতবর্ষই চলে আসবে ইংরেজদের অধীনে।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হয়ে কাজ করতে প্রচুর ইংরেজ ভারতে আসে, কিছুদিন থাকে, লুঠতরাজ ফুর্তি করে আর জাহাজ ভর্তি লুঠের মাল নিয়ে ফিরে যায় দেশে। জন টমাস নামে এক সার্জন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হয়ে কাজে এসে কিছুদিন থেকে গেছে বাংলায় আর সেখানকার চার্চে কিছু কাজ করে গেছে। জন দেখে গেছে বাংলার অবস্থা, সে আবার ফিরে গিয়ে সেখানে ধর্মের কাজ করতে চায়, যদি সঙ্গে একজন সহযোগী পাওয়া যায়, আর তাদের খরচ যদি সোসাইটি বহন করতে রাজি হয়।

করছিলো জুতো সেলাই, হঠাৎ চণ্ডীপাঠেও উৎসাহী হয়ে পড়লো বিল। সোসাইটির এক মিটিঙে জন টমাসের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হতেই বিল বলে উঠলো, সে জনের সঙ্গে ভারতে যেতে ইচ্ছুক।

কিন্তু বিলের চার্চ বিলকে ছাড়তে রাজি নয়। বিলের বাবা তো শুনেই বললেন, বিল কি পাগল হয়ে গেল? পাঁচ মাসের অন্তঃস্বত্তা ডলি তো একেবারেই গররাজি। সে পরিষ্কার বলে দিলো, আমি এর মধ্যেই নেই। সোসাইটি বললো, আমরা তোমাদের যাওয়ার ব্যাপারে রাজি, কিন্তু পয়সা চেয়ে লজ্জা দিও না, আমাদের কাছে নেই। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর চুক্তিতেও ধর্মপ্রচারকদের বাংলায় নিয়ে গিয়ে হাজির করা বে-আইনী।

তবু তাদের যাওয়া কেউ আটকাতে পারলো না।

ঝামেলা অবশ্য কম হয়নি। ডলি রাজি না হওয়ায় বিল একটু ঝুলোঝুলি করে শেষে বললো, ঠিক আছে, তাহলে আমি ফেলিক্সকে নিয়ে যাই, তুমি থাকো অন্য বাচ্চাদের নিয়ে। অন্তঃস্বত্তা বৌ আর দুটো বাচ্চাকে বাড়িতে রেখে বড় ছেলেকে নিয়ে জাহাজে উঠলো বিল জন আর ওর বৌ-বাচ্চার সঙ্গে। কিন্তু জাহাজ ভোঁ বাজতেই খবর পাওয়া গেল জন পাওনাদারদের টাকা শোধ না করে পালাচ্ছে, তাই ওদের দুই ফ্যামিলিকে নামিয়ে দিয়ে জাহাজ চলে গেল।

আর কোনো জাহাজ পাওয়া যাচ্ছে না। কাজেই ওদের যাওয়া পেছিয়ে গেল। এই অবসরে ডলি বাচ্চার জন্ম দিয়েছে ভালভাবেই। বিল তাকে বললো, দেখো ডলি, জনের বৌও তো যেতে চাইছিল না, বরের কথা ভেবেই যাচ্ছে। তুমিও প্লিজ চলো। জন বিলের বাড়ি এসে ডলিকে ভয় দেখালো, ভেবে দেখো, আমরা চলে গেলে তোমার কী করে চলবে। গিয়েই তো আর আমরা টাকা পাঠাতে পারবো না, কাজ জুটলে তবেই না। তোমাদের যদি আর কোনোদিন দেখা না হয় –

অনিচ্ছাসত্ত্বেও ডলি রাজি হয় বিলের সঙ্গে যেতে। তবে তার আগে শর্ত দেয় যে তার বোন কিটিকে সঙ্গে নিতে হবে, সে নবজাত বাচ্চার দেখভাল করবে।

পাঁচ মাস ড্যানিশ জাহাজে ভেসে সমুদ্রঝড় সহ্য করে বত্রিশ বছর বয়সে এক নভেম্বরের শীতের সন্ধ্যায় কলকাতা এসে হাজির হলো জন আর বিল। সঙ্গে ছেলেপুলে কোলে ডলি, ডলির বোন কিটি, জনের বৌ আর মেয়ে। ওরা ভাবতেই পারেনি কলকাতায় থাকতে কেমন খরচাপাতি হবে। সঙ্গে যা টাকাপয়সা এনেছিলো, দ্রুত ফুরিয়ে যেতে লাগলো। কলকাতার কাছে কিছুদিন থেকে টাকার অভাবে তাদের চলে যেতে হলো এক জলা বাদাবনে। সেখানে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ, চোর-ছ্যাঁচড়ের উৎপাত। স্থানীয় এক মহাজনের এক পরিত্যক্ত বাড়িতে স্থান হলো, সেখানে ভাড়ার ব্যাপার নেই। টমাসের এসব পোষালো না, সে বিলকে টা টা করে কেটে পড়লো নিজের ধান্দায় ফের সার্জনগিরি করতে।

ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া জোটেনা, বাড়িটাও পোড়ো আর ড্যাম্প ধরা, বিল ডলি আর ওদের বড়ছেলে ফেলিক্সের আমাশা ধরে গেল সঙ্গে সঙ্গে। ফেলিক্স তো মরেই যাচ্ছিলো। ডলির বোন কিটির অবস্থাও তথৈবচ। বিল কাজ খুঁজতে লাগলো, কিন্তু এই বিদেশ বিভুঁইতে ম্লেচ্ছ বিদেশীকে কাজ দেবে কে? বিল জনকে খবর পাঠালো, চল্লিশ মাইল পূবদিকে গেলে একটা অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার জায়গায় থাকা যায়, তুমি আমার ভাগের টাকাটা পাঠাও। জন উত্তর দিলো, সে টাকা কি আর আছে? সার্জারির যন্ত্র কিনতে খরচ হয়ে গেছে।

চোখে অন্ধকার দেখলো বিল। ডলি নিত্য গঞ্জনা দেয়, এ তুমি কোথায় এনে ফেললে!

উপায়হীন বিল স্থানীয় লোকের কাছে সাহায্য নিয়ে বাংলা শিখতে লাগলো। এখানে লোক অধিকাংশই অশিক্ষিত, এদের কাছে ধর্মকথা প্রচার করতে গেলে স্থানীয় ভাষাতেই করতে হবে, সেটা শেখা দরকার। একজন পণ্ডিতকে সামান্য পয়সা দিয়ে নিযুক্ত করলো ভাষাশিক্ষার জন্যে। কিছুদিন যেতেই লোকজন জোগাড় করে শুরু করে দিলো বাইবেলের বাংলা অনুবাদ।

কিছুদিন বাদে টমাসের দয়ায় কিছু টাকা ধার পেয়ে আবার বেরিয়ে পড়লো সংসার উঠিয়ে বৌ, শালী, তিনটে বাচ্চা আর একটা সদ্যোজাত শিশু নিয়ে। নদীর ধার দিয়ে বনের পথ দিয়ে চললো তাদের যাত্রা। নদীর ধারে রোদ পোহায় কুমির, বনের পথে বিষধর সাপ আর মানুষখেকো বাঘের আনাগোনা, রাত্রে কোথায় থাকবে তার ঠিক নেই – চলছে বিলের অন্বেষণ। শেষমেষ একটা পছন্দের জায়গা মিললো তো তাও স্থায়ী হলো না। জন টমাসের এক বন্ধু জন বিলকে এক গ্রামে নীল বানানোর কারখানায় ম্যানেজারের চাকরির খবর দিয়েছে। বিল ঠিক করলো সেখানেই আস্তানা গাড়বে। চাকরি পেলে তার থাকাটা অন্তত আইনানুগ হয়।

সেই গ্রামে পৌছাবার সঙ্গে সঙ্গেই ডলি রক্ত-আমাশায় আক্রান্ত হলো, বিলের হলো ম্যালেরিয়া। দিনরাত বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকে সে। ওদিকে ডলির বোন কিটিকে পটিয়ে নিয়েছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক ছোকরা সেনা, তার সঙ্গে সে ভেগে গেছে। পাঁচ বছরের ছেলে পিটার কয়েক দিনের মধ্যে পেটের রোগ সহ্য করতে না পেরে মারা গেলো। তার মৃতদেহ কবরস্থ করার লোকও পাওয়া গেল না, কেননা বিদেশীর মড়া ছুঁলে ভারতীয় ডোমেরও জাত যাবে।

ইংল্যান্ডের অজ পাড়াগাঁ থেকে বাংলার অজ পাড়াগাঁয়ে এসে তারা যা দেখেছে, তাতে মাথা ঠিক রাখা কঠিন। এখানে রাস্তার ধারে মানুষের মৃতদেহ পড়ে থাকে, রাস্তার কুকুরে খায়, কেউ গ্রাহ্য করে না। ভায়ে ভায়ে খুনোখুনি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। বিচারে কারো হয়ত প্রাণদণ্ড হয়েছে, খোলা মাঠে প্রকাশ্যে তার ফাঁসি হয়, সেই ফাঁসি দেখতে অনেকে আসে। ফাঁসির পরে মৃতদেহ সেই ফাঁসের দড়ি থেকে ঝুলে থাকে দিনের পর দিন, পচে দুর্গন্ধ বের হয় তা থেকে, সরিয়ে নেওয়ার কেউ নেই। কয়েকদিনের জন্যে তারা মালদা বেড়াতে গেছিলো। সেখানে প্রচুর আমগাছ। একটা আমগাছের ডালে একটা ঝুড়ি বাঁধা দেখে ডলি জানতে চেয়েছিলো, ওখানে অত উঁচুতে ঝুড়ি কেন। তাতে সে যা জানলো, তা শিউরে ওঠার মত ঘটনা। গত বছর আমের ফলন ভালো না হওয়ায় বাগানের মালিক নিজের সদ্যোজাত শিশুকে ঝুড়িতে বেঁধে গাছে টাঙিয়ে দিয়েছে। সেখানে সে রোদে পুড়ে, জল ও খাদ্যাভাবে মারা গেছে, তার মৃতদেহ পিঁপড়ে খাচ্ছে, মাথার ছোট্ট খুলি বেরিয়ে আছে ঝুড়ি থেকে। এ নাকি ভগবানকে খুশি করার জন্যে, যাতে আমের ফলন ভাল হয়। ভয়ে বিতৃষ্ণায় আঁতকে উঠেছিলো ডলি, এ রকম কিছু তার নিজের দেশে ভাবাই যায় না।

বিল অবশ্য এ দেশে এসে এর চেয়েও ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখেছে। জীবন্ত সদ্য-বিধবাকে প্রচুর পরিমাণে ভাঙ খাইয়ে ঢাকের বাজনার তালে তালে এক সময় চিতায় তুলে দেওয়া হয়। স্থানীয় লোকেরা বলে – সতী। অসুস্থ মৃত্যুপথযাত্রী মানুষকে গঙ্গার ধারে ফেলে রেখে আত্মীয়রা বাড়ি চলে গেছে, তার সেই নিঃসঙ্গ মৃত্যু কী করুণ! শেয়াল-শকুন অপেক্ষায় থাকে কখন ছিঁড়ে খাবে তাকে। কুষ্ঠরোগীকে জলে ডুবিয়ে বা আগুনে পুড়িয়ে জোর করে মেরে ফেলা হয়, নিজের ছেলে-মেয়েকে বাবা-মারাই মেরে ফেলে। ডরোথিকে সে জানায় নি এই ব্যাপার। জানলে সে তো তুলকালাম করবে। 

নিজের দেশে প্রথম সন্তান অ্যানকে হারিয়েছে ডলি। প্রবাসে ছেলে পিটারের এই অসহায় মৃত্যু। ভয়ঙ্কর দারিদ্র্য, অপরিচিত পরিবেশ, নিত্য অসুখ-বিসুখে বিধ্বস্ত, সহায়-সম্বলহীনা, লেখাপড়া না-জানা গ্রাম্য বিদেশিনী ডলি এরপর একেবারে পাগল হয়ে গেলো। তার চিকিৎসা করার মত সঙ্গতি বিলের ছিলো না। সে তখন ভাষা শিক্ষা নিয়ে ব্যস্ত। একে একে ভারতীয় ভাষা শিখছে সে – বাংলা, সংস্কৃত, মারাঠি, ওড়িয়া, হিন্দী, অসমিয়া। ডলি চুপচাপ থাকে, এমনি দেখলে কিছু বোঝা যায় না। হঠাৎ হঠাৎ রেগে গিয়ে চ্যাঁচাতে থাকে, লোকজনের মধ্যেই বিলকে গালাগালি দেয় বেশ্যাসক্ত বলে, ছুরি হাতে তেড়ে আসে।বিলের চুলের মুঠি ধরে বলে, এখুনি তোর গলা কেটে দু-ফাঁক করে দেবো। তার ধারণা বিল অন্য মেয়েদের সঙ্গে ফস্টিনস্টি করে, বাড়ির কাজের মেয়ের সঙ্গে শোয়, পতিতাপল্লী যায়। কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়ে যখন চ্যাঁচাতে থাকে, তখন তাকে ঠেকানো যায় না। জনের বৌ একদিন ওকে শান্ত করতে এসেছিল, তাকে উদ্দেশ্য করেই প্রকাশ্যে চেঁচিয়ে উঠলো, বিলের সঙ্গে লটঘট করতে তোর লজ্জা করে না! এর পর বিলের কাছে আসলে তোর মাথাও ফাটিয়ে দেবো হারামজাদি।

বাচ্চা তিনটেকে দেখার কেউ নেই, তারা বাপ-মা মরা অনাথের মত রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। ডলির মাথা খারাপের লক্ষণ খুব বেড়ে গেলে তাকে বাড়িতে একটা ঘরের মধ্যে তালাবন্ধ রেখে বিল অন্য ঘরে বসে একমনে নিজের বাংলা ব্যাকরণ শিক্ষা চালিয়ে যায় আর নীলের কারখানায় শ’খানেক কর্মীর কাজের দেখভাল করে।

এরমধ্যে জন টমাস আবার তাকে ছেড়ে চলে গেছে, এবার রামের ব্যবসা করতে। জনের পাওনাদাররাও এসে বিলকে ছেঁকে ধরে। মানসিকভাবে অসুস্থ ডলি জনাথন নামে আর এক পুত্রের জন্ম দিয়েছে ততদিনে। চারখানা বাচ্চা মুরগীর মতো এখানে ওখানে চরে, তাদের পোশাকের ছিরি নেই, কার সঙ্গে কেমনভাবে কথা বলতে হয় কিচ্ছু জানে না, পড়াশুনা তো দূরের কথা। এই অবস্থায় নীল কারখানার মালিক কারখানা বন্ধ করে দিলো। বিল সেই নীলকুঠির বাস উঠিয়ে চললো আবার ভাগ্যান্বেষণে, এবার খিদিরপুরে।

আরও ন’বছর ধরে নিজে প্রবল মানসিক অশান্তি ভোগ করে ও বিলের ওপর প্রবল মানসিক অত্যাচার চালিয়ে একান্ন বছর বয়সে ডরোথি এক পক্ষকাল জ্বরে ভুগে একদিন চিরশান্তির দেশে চলে গেলো।ততদিনে তাকে কবরস্থ করার মত স্বদেশী সঙ্গীসাথী জুটেছে বিলের। পাঠিয়েছে দেশের সোসাইটি।

দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াইতে কখনো তেমন ক্লান্ত হয়নি বিল, কিন্তু এতদিনের বিবাহিত জীবনে, বিশেষ করে বাংলায় আসার পর চোদ্দ বছর ডরোথি ছিলো যেন এক মূর্তিমতী অভিশাপ। তবুও এতদিনের সাথীকে হারিয়ে একটুর জন্যে মুহ্যমান হয়ে পড়লো বিল। কবরখানার রেজিস্টারে নিজের নাম সই করতে গিয়ে তার ওপর ঝরে পড়লো দুফোঁটা চোখের জল। হাতের তালু দিয়ে মুছে তার ওপর পুরো নাম সই করলো সে – উইলিয়াম কেরি। 

(ক্রমশ)

13 comments: