0

সম্পাদকীয়

Posted in

 



সম্পাদকীয় 


আরেকটা পুজো এসে গেলো। দুর্গাপুজো। বাঙালির একটা বিশেষ সময়। বাইরে রোদের দিকে তাকালে মনে হয় সেটাও আগের বছরের মতো। সেই একই রকম ঝকঝকে শরতের গন্ধ-মাখা। এসবই ঠিক।  কিন্তু সবই কি ঠিক? মহামারীর আবহে এবার যখন এই উৎসব পালিত হতে চলেছে, উৎসবের মেজাজের পাশাপাশি আমাদের ঘিরে রয়েছে অজানিত এক আশঙ্কা। আসলে আমাদের বিশেষ এই বার্ষিক উদযাপন কতটা ধর্মীয় আর কতটা সামাজিক মেলামেশার উৎসব, সে নিয়ে তর্ক হতেই পারে।

এরই মধ্যে এসে পড়লো আমাদের মাসিক ব্লগ প্রকাশের সময়ও। এবারে ঋতবাকের বিশেষ উৎসব সংখ্যা। নিয়মিত বিভাগগুলির সঙ্গে থাকছে একটি উপন্যাসিকা ও একটি দীর্ঘ কবিতা।

গত সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে 'বিশেষ ক্রোড়পত্র' বিভাগ। এই বিভাগে এই সংখ্যার বিশেষ আকর্ষণ, কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। ৬ অক্টোবর ছিল কবির জন্মদিন। প্রবাদপ্রতিম এই ব্যক্তিত্বের প্রতি  ঋতবাকের শ্রদ্ধার্ঘ্য। লিখেছেন দেশ-বিদেশের সমসময়ের প্রথিতযশা লিখিয়েরা। এছাড়াও থাকছে Friedrich Engels এর কাব্যনাট্য Cola di Rienzi এর অলোকরঞ্জনকৃত বাংলা ভাষান্তর 'স্তিমিত সিংহাসন'। ক্রোড়পত্রটির সংকলন ও গ্রন্থনা-সম্পাদনা রাজা মুখোপাধ্যায়। কৃতজ্ঞতা জানবেন, সুহৃদ... 

উৎসব হোক অন্তরে, আনন্দ সর্ব্বব্যাপী

শুভেচ্ছা নিরন্তর

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - অমিতাভ পুরকায়স্থ

Posted in








কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে দুর্গোৎসবের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হচ্ছে যথাযোগ্য মর্যাদায়। আজ নবমী। পারিবারিক প্রথা মেনে মোষ বলি পর্ব মিটল নির্বিঘ্নে। মোষের রক্তে কাদা হয়ে যাওয়া মাটি গায়ে মাখামাখির আচারও শেষ হল ভক্তদের। সেই হুল্লোড় থিতিয়ে এলে নাটমন্দিরে নেমে এলেন স্বয়ং নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র। হাতে এক গোছা কাগজ। মহারাজের পেছন পেছন যুবরাজ এবং অন্যান্য রাজকুমাররাও হাজির হলেন। ঢাকের বোল বদলে গেল, বলিদানের তীব্র গতিময়তা থেকে দুলকি চালের খেমটায়। এক পণ্ডিত গোছের মানুষ উপস্থিত সকলকে সচেতন করে ঘোষণা করলেন, ‘এ বার শুরু হচ্ছে কাদা খেউড়!’ 

একটু গলা সাফ করে সুরে ভেঁজে মহারাজ ধরলেন স্বরচিত গান। আদিরসাত্মক রচনা, কিন্তু খুব সাবলীল ভাবে গেয়ে নিজের আসনে গিয়ে বসলেন তিনি। উপস্থিত শ্রোতাদের উচ্ছ্বাস ও উৎসাহ দেখলে বোঝা যায়, সবাই এই গান শোনার প্রস্তুতি নিয়েই এসেছেন। এ বার যুবরাজ এবং তার পর একে একে সব রাজকুমাররা মহারাজ ও সমবেত শ্রোতাদের সামনে পরিবেশন করলেন নিজেদের রচনা, যার মধ্যে দেওর-বৌদির অবৈধ সম্পর্ককে উপজীব্য করে আখ্যানও পরিবেশিত হল। ‘কি হ’ল ওলো ঠাকুরঝি’ খেউড়টি রচনা করে পরিবেশন করলেন যুবরাজ শিবচন্দ্র। মহারাজের আদেশে এর পর খেউড়ের আঙ্গিকে দুই রাজকুমারকে প্রশ্নোত্তরে ছড়া-কাটাকাটিও করতে হল। উপস্থিত শ্রোতারা খুব খুশি হয়ে শুনতে লাগলেন সেই গান। তারিফ করলেন স্বয়ং কৃষ্ণচন্দ্রও। এ ভাবেই সম্পন্ন হল নবমীর অনুষ্ঠান। 

আমাদের আজকের রুচিবোধে একটু খারাপ লাগলেও, আঠারো শতকের শেষ পর্যন্ত এ ভাবেই উৎসবের অঙ্গ হিসেবে পরিবেশিত হয়ে এসেছে এই গ্রামীণ বিনোদন, যার নাম ‘কাদা খেউড়’। অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত হয়ে এই গান আজ অন্ধকারে নির্বাসিত। শুধু সমাজ থেকে নয়, আমাদের স্মৃতি থেকেও। 

জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস তার ‘বাঙ্গালা ভাষার অভিধান’-এ (পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ) ‘কাদাখেঁড়ু’ শব্দটি অন্তর্ভুক্ত করেছেন। অর্থ বলেছেন, ‘স্ত্রীরজো জনিত উৎসব। স্ত্রীলোকের পুনর্ব্বিবাহের সময় কাদা মাখিয়া যে খেউড়, পাঁচালি গান হয়, তাহার নাম কাদাখেঁড়ু’। সঙ্গে দু’লাইন উদাহরণ দিয়েছেন ‘অন্নদামঙ্গল’ থেকে, সেটা তুলে দিলাম প্রসঙ্গটা বোঝাতে— “বিদ্যার হইল ঋতু সখীরা জানিল।/ বিয়া মত পুনর্ব্বিয়া সুন্দর করিল॥/ খুদমাগা কাদাখেঁড়ু নারিনু রচিতে।/ পুথি বেড়ে যায় বড় খেদ রৈল চিতে॥” উদাহরণে, উপরের দেওয়া উদ্ধৃতির শেষ দুই লাইন দিয়ে জ্ঞানেন্দ্রমোহন সরাসরি ‘অশ্লীল’ তকমা না দিলেও, ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে সর্বসমক্ষে এমন গান গাওয়া হয় না। আদিরসাত্মক ‘কাদা খেউড়’ ছাড়াও আর এক ধরনের খেউড় প্রচলিত ছিল, যার নাম ‘সাদা খেউড়’। দ্বিতীয় ধরনের খেউড় মূলত রাধাকৃষ্ণকে উপজীব্য করে রচনা হত। তবে আজ কথা ‘কাদা খেউড়’ নিয়ে, যা এক সময় ছিল শারদোৎসবে নবমী উদ্‌যাপনের অঙ্গ। 

তা হলে কি কাদা খেউড় রাজবাড়ির নিজস্ব সাংস্কৃতিক বিকৃতি? সেই সম্ভাবনা বাতিল করে কাদা খেউড়ের জনপ্রিয়তার কথা শুনিয়েছেন মহেন্দ্রনাথ দত্ত। নিজের ছোটবেলা, অর্থাৎ উনিশ শতকের শেষ অর্ধের কথা বলতে গিয়ে তিনি জানিয়েছেন, সে সময় নবমীতে পাঁঠা ও মোষ বলি দিয়ে সেই রক্ত-কাদা গায়ে মেখে এবং মোষের মুণ্ড মাথায় নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘোরা হত। মহেন্দ্রনাথ লিখছেন, “বৃদ্ধ পিতামহ তাহার সমবয়স্কিলোক, পুত্র, পৌত্র লইয়া হাতে খাতা লইয়া কাদামাটির গান করিত। সে সব অতি অশ্লীল ও অশ্রাব্য গান। বাড়ীর মেয়েদের সম্মুখেও সেই সব গাওয়া হইত এবং পাছে ভুল হয় এজন্য হাতে লেখা খাতা রেখে দিয়েছে, ইহাকে অপর কথায় খেউড় গান বলিত। তখনকার এ সবের প্রচল ছিল এবং লোকে বিশেষ আপত্তি করিত না বরং আনন্দ অনুভব করিত।’’ 

মহেন্দ্রনাথের সাক্ষ্য অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে যে নবমীর দিন খেউড় গানের সামাজিক মান্যতা ছিল। কিন্তু তার পর কী এমন হল যে এই গান একেবারে হারিয়ে গেল? খুব ছোট করে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায় না। তবে মহেন্দ্রনাথ সেই কারণগুলির একটি দিকে ইঙ্গিত করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘‘কিন্তু ইংরাজী শিক্ষা ও কেশব সেন মহাশয়ের অভ্যুদয় হইতে ধীরে ধীরে এ সব উঠিয়া যায়।’’ আসলে ইংরেজি শিক্ষা আর কেশব সেনের সঙ্গে সঙ্গে নতুন সাংস্কৃতিক বোধ ও রুচির প্রকাশ দেখল কলকাতা শহর। পুরনো বিনোদনের খোলনলচে বদলে নতুন নতুন মাধ্যমের উদয় হল। শহরের বড়লোক ও তাঁদের দেখাদেখি মধ্যবিত্তদের একটা বড় অংশ প্রগতির এই নতুন পথের যাত্রী হলেন। ‘অবক্ষয়ী’ রুচির প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাসনের সাজা পেল কাদা মাটির গান। অথচ এই গানের উৎস ও দুর্গোৎসবের সঙ্গে এর সম্পর্কের গভীরে গেলে, এক অন্য দৃষ্টিকোণের হদিশ মেলে। খুব সহজে ‘বাবু কালচারের অবক্ষয়’ বলে দেগে দেওয়ার আগে, ইতিহাসের সেই পাতা একটু উল্টে দেখা যেতে পারে। 

আমরা জানি যে ভারতে তন্ত্রের যে মূল চারটি সম্প্রদায় আছে (গৌড়ীয়, কেরলীয়, কাশ্মীরি ও বিলাসী) তার মধ্যে গৌড়ীয় সম্প্রদায় প্রাচীনতম ও প্রধান। অনেকে মনে করেন গৌড়েই তন্ত্রের উদ্ভব (গৌড়ে প্রকাশিতা বিদ্যা)। পাল বংশের সময়ও বাংলায় তন্ত্রের বেশ ভাল প্রভাব ছিল। প্রাচীন সতীপীঠগুলির অবস্থান লক্ষ করলেও দেখা যায়, বেশির ভাগই বাংলায় অবস্থিত। এই সমস্ত অঞ্চল এক সময় জঙ্গল ছিল এবং সেই বন্য ভূমির অধিবাসী ছিল ‘কিরাত’ বা ‘শবর’ নামের জনগোষ্ঠী। ‘কাদম্বরী’, ‘হরিবংশ’, ‘দশকুমারচরিত’, ‘ভবিষ্যোত্তরপুরাণ’, ‘কালিকাপুরাণ’ ইত্যাদি শাস্ত্রগ্রন্থের মতে শ্রীশ্রীচণ্ডীতে যে দেবীর উল্লেখ, তিনি কিরাত ও শবরদের উপাস্য ছিলেন। তাই চণ্ডীর আবির্ভাব এই বাংলায় বলে মনে করা হয়। 

আমরা দুই শ্রেণীর শবর জাতির কথা জানতে পারি। ‘নগ্ন শবর’ ও ‘পর্ণ শবর’। বজ্রযান বৌদ্ধধর্মে ‘পর্ণশবরী’ নামের দেবীর কথা পাই, যিনি গাছের পাতা পরিধান করেন। এই ষড়ভুজ দেবীমূর্তিগুলির মধ্যে বেশ কয়েকটি বাংলার ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে আবিষ্কৃত। পাল যুগের শিল্পকলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন পর্ণশবরীর দুটি মূর্তি উদ্ধারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নলিনীকান্ত ভট্টশালীর নাম। অন্য দিকে বলা যেতে পারে হিন্দু পূজাপার্বণের আচার-অনুষ্ঠান সংক্রান্ত অন্যতম প্রাচীন গ্রন্থ, জীমূতবাহন প্রণীত ‘কালবিবেক’-এর কথা (আনুমানিক সময় দ্বাদশ শতক)। সেখানে নবমীর কৃত্য হিসেবে শবরোৎসবের কথা বলা হয়েছে। তার সঙ্গে বিশেষ করে নির্দেশ করা হয়েছে কাদামাটির গানের কথা। সুতরাং এ কথা আমরা বলতেই পারি যে বাংলার দেবী-উপাসনার ধারাবাহিকতার উত্তরাধিকার আসলে সেই আদিম জনজাতির মাতৃকা পূজার উত্তরাধিকার। সেই উত্তরাধিকারেরই একটি নিদর্শন শবরোৎসব, যার অঙ্গ ছিল কাদা খেউড়। 

পুরাণ ও প্রচলিত লোককাহিনির পরিসরের বাইরে দুর্গাপূজার ইতিহাস ও বিবর্তনকে দেখার চেষ্টা হয়েছে নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকেও। সেই সব অনুসন্ধান দুর্গাপূজার নানা আচার ও অনুষ্ঠানের মধ্যেও চেষ্টা করে বাঙালির মতো মিশ্র জাতির হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের নানা ইঙ্গিত খুঁজে পেতে। নানা গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে ঘটে চলা ক্ষমতার টানাপড়েন যেন প্রতিফলিত হয় উৎসবের বিবর্তনের ইতিহাসে। 

গবেষকদের একটা বড় অংশ এখন মোটামুটি ভাবে একমত যে তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণের বহু আগে থেকেই দুর্গাপূজার প্রচলন ছিল। কংসনারায়ণ দেবী-আরাধনার মধ্যে একটা উৎসবের মেজাজ অবশ্যই নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু আরও বহু আগে থেকেই (হয়তো ঠিক এই রূপে নয়) প্রচলিত ছিল দুর্গার (বা চণ্ডীর) আরাধনা। তবে সেটা কখনওই জনসাধারণের মধ্যে উৎসবের আকারে ও দেবীকে বর্তমান রূপে কল্পনা করে পালিত হত না। 

নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে পূজার আচার-অনুষ্ঠানের ‘সংস্কার’কে দেখা যায় সমাজ বিবর্তন ও ক্ষমতার টানাপড়েন হিসেবেও। এক সময় জনসাধারণের উৎসব বলতে বাংলায় প্রচলিত ছিল গাজন। এক শ্রেণিহীন ভ্রাতৃত্ববোধের আহ্বান থাকে গাজনে। আমরা সবাই জানি যে চৈত্রের শুরুতে যাঁরা গাজনের সন্ন্যাস নেন, তাঁরা নিজ গোত্র ত্যাগ করে শিব গোত্রে পরিচিত হন উৎসবের উদ্‌যাপন পর্যন্ত। সাধারণ মানুষের এই ঐক্য সব সময়েই ক্ষমতাবানরা সন্দেহের চোখে দেখেন। তাই গাজনের পরিবর্তে অন্য কোনও উৎসব খাড়া করার প্রয়োজন হয়। আরও একটা কারণেও দরকার হয়ে পড়ল নতুন উৎসবের। গাজনের মূল ভাব ত্যাগের। সেখানে বিলাসিতার কোনও জায়গা নেই। এ দিকে সাধারণের মধ্যে বিলাস-ব্যসন শৌখিনতা বিস্তার হলে অর্থনীতির চাকা ঘুরতে থাকে দ্রুত। সুগম হয় অতিরিক্ত খাজনা আদায়ের পথ। 

এই প্রেক্ষাপটে চৈত্র মাসে গাজন সরিয়ে উদয় হচ্ছে নতুন জাতীয় উৎসবের। দুর্গোৎসব। যার জন্য কৃত্তিবাস বাংলা রামায়ণে যোগ করছেন অকালবোধনের অধ্যায়, যা মূল রামায়ণ এবং ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে প্রচলিত মহাকাব্যে নেই। সেই উপাখ্যানের শক্তিতেই বলীয়ান হয়ে চৈত্র থেকে উৎসবের মরসুমকে আশ্বিনে সরিয়ে আনেন মনুসংহিতার টীকাকার কুলুকভট্টের পুত্র, রাজা কংসনারায়ণ। এখানে কৃত্তিবাসের সঙ্গে রাজার সম্পর্কটা বলে নেওয়া দরকার। রাজা সভাপণ্ডিত রমেশ শাস্ত্রীর পরামর্শে দুর্গাপূজার সঙ্কল্প করেন, তখন প্রাথমিক প্রয়োজন হয় সাধারণের সঙ্গে দেবীর পরিচয় করানোর। কারণ, আগেই বলা হয়েছে, ঠিক এই রূপে দেবী সাধারণ্যে পরিচিত ছিলেন না। সেই পরিচয় করানোর কাজটির দায়িত্ব পেয়ে কংসনারায়ণের সভাকবি কৃত্তিবাস ওঝা ‘রাম পাঁচালী’ নামে রামায়ণের এক অনুবাদে শ্রীরামকে উদ্ধার করার জন্য দুর্গার অকালবোধনের উপাখ্যান রচনা করলেন। তার ভিত্তিতে বাংলায় শুরু হল উৎসব, যার রূপায়ণে সে আমলেই কংসনারায়ণ খরচ করেছিলেন কয়েক লাখ টাকা। 

নতুন উৎসবে সকল শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে না পারলে, এই পুরো প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য সফল হয় না। তাই উৎসবের মধ্যে নানা আচার-অনুষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত করা হল, যাতে সমাজের সব স্তরের মানুষ এর সঙ্গে একাত্ম হতে পারেন এবং নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী অংশগ্রহণে উৎসাহিত হন। পুজোর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শ্রেণির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য পূজার উপচার ও আচরণের মধ্যে সেই তথাকথিত দুর্বলতর শ্রেণির জন্য কিছু অনুষ্ঠান আলাদা করে সংরক্ষিত হল। যেমন বেশ্যাবাড়ির মাটি অথবা হাড়ির বাদ্যির কথা আমরা সবাই জানি। এগুলি ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না পুজো। এ ছাড়াও পুজোর নানা কাজে নানা জাতের মানুষের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হল নানা আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে। 

অনুষ্ঠানের জন্য অন্ত্যজ বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শ্রম নেওয়ায় সমস্যা ছিল না। কিন্তু ক্ষমতার কেন্দ্রের যে প্রতিনিধিরা পুজোর সংগঠন করতেন, তাঁদের অস্বস্তি শুরু হল সাংস্কৃতিক রুচির তারতম্য থেকে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে সেই রুচি ছিল সরাসরি ব্রাহ্মণ্য রুচির বিরোধী। তাই উৎসবকে সংস্কার করে অনার্য প্রভাব থেকে মুক্ত করার জন্য একটা চাপ তৈরি হল। এই চেষ্টার অন্য প্রাচীন উদাহরণ হিসেবে আমাদের সামনে আসে শ্রীচৈতন্যের সমসাময়িক (১৫০০- ১৫৭৫) স্মার্ত রঘুনন্দনের দুর্গাপূজা বিধি সংস্কারে। শবরোৎসবের অংশটিতে ব্যাপক কাটছাঁট করেন তিনি। 

তা সত্বেও শবরোৎসবের স্মৃতি জাগানো কাদা খেউড়ের মতো অনেক আচার টিকে ছিল বহু দিন। সেটাও ধীরে ধীরে লুপ্ত হয় গেল উনিশ শতকে এসে, যখন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ‘কেন্দ্রগত’ সাংস্কৃতিক রুচির পার্থক্যকে ‘অশ্লীলতা’ বলে দাগানো শুরু হল। আর অশ্লীলতা মানেই ক্ষমতাশালী শ্রেণির চোখে সম্ভাব্য সমাজবিপ্লবের বারুদ, দেখামাত্র যা নিষ্ক্রিয় করতে হয়। এই মানসিকতা থেকেই শুরু হল এক আজব ‘উইচহান্ট’, যার থেকে রেহাই পেলেন না স্বয়ং কৃত্তিবাস বা কাশীরাম দাসও। সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক পণ্ডিত জয়গোপাল তর্কালঙ্কার ১৮২০ সাল নাগাদ কৃত্তিবাসের রামায়ণ ও কাশীরাম দাসের মহাভারত অশ্লীলতামুক্ত করতে শুরু করলেন এক ধর্মযুদ্ধ। অথচ অশ্লীলতা বলতে যা বোঝানো হচ্ছিল, তা ভারতীয় শিল্পশাস্ত্রের পরম্পরার একদম বিপরীত। শরীরের বর্ণনা বা মিথুনমূর্তি কখনওই অশ্লীল মনে করেননি এ দেশের সৃষ্টিশীল কলাবন্তরা। বরং সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন কথাবার্তায় খুব স্বাভাবিক ভাবেই ঢুকে পড়ত নব্য রুচিবোধে ত্যাজ্য শব্দ ও বাক্য। এ নিয়ে প্রমথ চৌধুরী তাঁর ‘কাব্যে অশ্লীলতা—আলংকারিক মত’ নিবন্ধে বামনাচার্যকে উদ্ধৃত করে যে সংজ্ঞা দিয়েছেন, তা মনে পড়ে। সেই সংজ্ঞা যদি মেনে চলা হয় তা হলে দেখব, কাদা খেউড়ে যারা গায়ক/রচয়িতা এবং শ্রোতা হিসেবেই অংশ নিতেন, তাঁদের মনে এই গান শুনে লজ্জা, ঘৃণা, অমঙ্গল ভাবনা বা আতঙ্ক সঞ্চার হত না মোটেই। তাই মনে হয় যে বিনোদনে অংশগ্রহণকারী নয়, সমাজের উঁচু তলার মানুষের সঙ্গে রুচিভেদের জন্যই নীতিবাগীশদের রোষানলে দগ্ধ হতে হয়েছিল সাধারণ মানুষের বিনোদনকে। 

উনিশ শতকের বাংলায়, বিশেষ করে কলকাতায় এই রুচিবোধ গঠনের ব্যাপারে ব্রাহ্ম সমাজ ও ইংরেজি শিক্ষার ভূমিকার কথা আগেও বলেছি, মহেন্দ্রনাথ দত্তকে উদ্ধৃত করে। কিন্তু এই তথাকথিত রুচির উৎস খুঁজতে গেলে আমরা ঔপনিবেশিক শাসন ও সাহেবদের প্রভাবের কথা বেশি শুনতে পাই। ব্রিটিশ সমাজের অশ্লীলতা ও রুচিবোধ নিয়ে উন্নাসিকতার শুরু শিল্প বিপ্লবের পর নতুন আর্থ-সামাজিক শ্রেণি গড়ে ওঠার সময় থেকে। সাধারণ জনগণের থেকে নিজেদের আলাদা বা উঁচু প্রতিপন্ন করার চেষ্টার একটি রূপ ছিল ভাষা ও আচার-আচরণে স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠা করা। এই চেষ্টা থেকেই জন্ম নিল শরীর ও যৌনকর্ম নিয়ে আলোচনায় নিয়ন্ত্রণ। এই নীতিবাগীশ মানসিকতা গড়ে তোলার পেছনে ‘ইভানজেলিস্ট’ (Evangelist) খ্রিস্টধর্ম-প্রচারকদের ভূমিকার কথাও উল্লেখ করতে হয়। 

এই ভিক্টোরীয় নীতিবাগীশ মানসিকতাই এক দিন গেড়ে বসল বাংলায়। আর সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষের ভাষা এক কথায় হয়ে গেল অশ্লীল। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, রানি ভিক্টোরিয়ার রাজত্বের অনেক আগেই জয়গোপাল তর্কালঙ্কার রামায়ণ-মহাভারত সংস্কারের কাজ শুরু করেন। তবে সুপ্রিম কোর্টের জজ-পণ্ডিত হিসেবে তর্কালঙ্কার মহাশয়ের সঙ্গে সাহেবদের মেলামেশা ছিল। কেরি ও মার্শম্যান তাঁর কাছে সংস্কৃত শিখতেন। সংস্কৃত পণ্ডিত এবং ইংরেজ সাহেব ও মিশনারি— দুই সমাজই একযোগে এ দেশের সাধারণ মানুষের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধ ঘোষণা করল। এই সহযোগিতা শুরু অবশ্য সেই ১৮১৭ সালে ‘স্কুল বুক সোসাইটি’ স্থাপনের সময় থেকে। ইংরেজ কোম্পানির পরিচালনাধীন সোসাইটি এবং সেই সংগঠনের বেতনভুক পণ্ডিতকুল, সবাই মিলে আক্রমণের মূল লক্ষ্য করলেন বটতলার সহজলভ্য সাহিত্য থেকে শুরু করে হিন্দু পালাপার্বণের পৌরাণিক কাহিনিকে। সাধারণের কাছে যা কিছু জনপ্রিয়, তার মধ্যে বাদ গেল না কিছুই। 

এই ছুতমার্গ কোন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল, তার উদাহরণ পাই বঙ্গদর্শনের পাতায়। সেখানে লেখা হচ্ছে: ‘‘অশ্লীলতা, বঙ্গদেশীয়দিগের জাতীয় দোষ বলিলে অত্যুক্তি হয় না।’’ এর পর অশ্লীলতার নিদর্শন কোথায় পাওয়া যায়, তার উদাহরণ দিতে গিয়ে লেখক বলছেন, ‘‘যাঁহারা ইহা অত্যুক্তি বিবেচনা করিবেন তাঁহারা বাঙ্গালির রহস্য, বাঙ্গালির গালি, নিম্নশ্রেনীর বাঙ্গালি স্ত্রীলোকের কোন্দল, এবং বাঙ্গালির যাত্রা পাঁচালী মনে ভাবিয়া দেখুন। মুহূর্ত জন্য বাঙ্গালি কৃষকের কথোপকথন শ্রবণ করিয়া দেখুন— বাঙ্গালির প্রণীত যে সকল কাব্যগ্রন্থ সর্ব্বোৎকৃষ্ট বলিয়া খ্যাত তাহা পাঠ করিয়া দেখুন।’’ অর্থাৎ পুরো লৌকিক বাংলার সংস্কৃতিকে এক কথায় অশ্লীল বলে ত্যাজ্য করা হচ্ছে। 

নীলকর সাহেবদের অত্যচারে সদর্থক ভূমিকা নেওয়া পাদ্রী জেমস লং থেকে দেশীয়দের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের জন্য বিখ্যাত বেথুন সাহেব— সকলের মত ছিল: সমস্ত জনপ্রিয় এবং লৌকিক সাহিত্য ‘সুস্থ রুচির পরিপন্থী’। পরবর্তী সময়ে নীতি-নৈতিকতার এই পতাকাটাই তুলে ধরে এগিয়ে নিয়ে গেলেন কেশবচন্দ্র সেন। 

তবে শুধু রুচিভেদ নয়। এর মধ্যে রাজনীতির একটা সূক্ষ্ম চালও ছিল। উনিশ শতকের জন-বিনোদনের মধ্যে দিয়ে শাসক ও শাসকদের নিকটজনের সমালোচনা করলেই তা অশ্লীলতার দায়ে বন্ধ করে দেওয়ার প্রবণতা চোখে পড়ে, যেমন ঘটেছিল কাঁসারিপাড়ার সঙ-এর ক্ষেত্রে। আর সেই সঙ-এর মিছিল থেকেই আওয়াজ উঠেছিল ‘অশ্লীলতা শব্দ মোরা আগে শুনি নাই’। এই সরল স্বীকারোক্তি থেকেই আমরা বুঝতে পারি যে বাংলার সাধারণ মানুষের শব্দকোষে এই শব্দের কোনও অস্তিত্ব ছিল না কোনও কালেই। অশ্লীলতার অভিযোগ এসেছে সব সময় ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে এবং প্রান্তিক মানুষের নিজেদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করার অধিকারকে অবজ্ঞা করে। সে রঘুনন্দন-ই হোন বা জেমস লং! 

নবমীর দুর্গাপুজোর বলির সঙ্গে কাদা খেউড়ের সম্পর্ক খুঁজতে গিয়ে যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি আমাদের বলেছেন কৃষ্ণযজুর্বেদ অনুযায়ী “সম্বৎসরব্যাপী সত্রের পর ঋত্বিকেরা হর্ষক্রীড়া করতেন আর তাঁদের সম্মুখে দাস জাতীয় বারাঙ্গনা কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি নৃত্য ও অশ্লীল গান করত। ‘কাদামাটির গান’ আসলে সেই পরম্পরা।” প্রত্যাশিত ভাবেই তিনি বিষয়টি ব্যখ্যা করতে চেয়েছেন শাস্ত্রীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যা উচ্চবর্গীয় তথাকথিত ‘পরিশীলিত’ রুচির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাই দেশের আদি জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রভাবের কথা হয়তো তিনি বলেননি। 

খেউড়ের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন পাথুরিয়াঘাটার গোপীমোহন ঠাকুর, শোভাবাজারের নবকৃষ্ণ, রাজা গোপীমোহন দেব, জোড়াসাঁকোর সিংহ পরিবার, গরানহাটার কৃষ্ণমোহন বসাক প্রমুখ। পরবর্তী সময়ে অশ্লীলতার পৃষ্ঠপোষক বলে কাঠগড়ায় তোলা হয়েছে তাঁদের। কিন্তু এই বিচার শুরুর আগে ভাবার প্রয়োজন হয়তো ছিল যে সেই সময় কলকাতা শহর সবে গড়ে উঠছে। অন্যান্য জায়গা, মূলত গ্রাম থেকে মানুষ এসে বসতি তৈরি করছেন এখানে। তাঁরা নিয়ে আসছেন তাঁদের গ্রামের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। সেই সব গ্রামীণ সংস্কৃতির সমাহারেই গড়ে উঠছে নতুন শহর কলকাতার সাংস্কৃতিক পরিচয়। সেই গ্রামীণ সংস্কৃতির অংশ ছিল খেউড় যা কলকাতার অনুকূল পরিবেশে নিজের শিকড় ছড়িয়ে দিয়েছিল। 

এ প্রসঙ্গে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করি উত্তরবঙ্গ এবং লাগোয়া আসামের লোকগীতি-পরম্পরার জাগ-গানের প্রতি। সাধারণত মদন চতুর্দশীর পার্বণ উপলক্ষ্য করে গাওয়া হয়। শ্রী যাদবেশ্বর তর্করত্ন মনে করেছেন যে ‘কামকে জাগ্রত করার গান’ বলেই এর নাম ‘জাগ-গান’। গ্রামের মানুষের মুখে মুখে গাওয়া কৃষ্ণলীলা বিষয়ক এই লোকসঙ্গীতের একটি অংশ ‘কৃষ্ণ-ধামালী’। জাগ-গানের এই ধারার নাম ‘কৃষ্ণ-ধামালী’ কেন হল, সেই উত্তর খুঁজতে ‘দেশ’ পত্রিকায় এক নিবন্ধে যতীন্দ্র সেন লিখেছেন— “ধামালী শব্দে তরল ভাবে অশ্লীলতা দোষে দুষ্ট গান বুঝায়।... জাগ-গানের অন্তর্গত কৃষ্ণ ধামালী পালাটি রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা বিষয়ক।” 

কৃষ্ণলীলা বিষয়ে একটি জাগ-গানের উদাহরণ দেখা যাক— 

“বাপের আগে কয় কানাঞি মাওয়ের আগত কান্দে। 
রাধা মামির জোড়া শ্রীফল আমার খাবার নাদে।। 
ডাঙর হ’ বোল ছাওয়াল কানাঞি ডাঙর হ’ বোল তুই। 
খাবার পাইলে সনতরা কিনিয়া আনিম মুই।।” 

উত্তরবঙ্গ ও সন্নিহিত আসামের রাজবংশী সমাজের এই গান । কিন্তু তার সংজ্ঞা নির্ধারণে ‘অশ্লীল’ বিশেষণটির ব্যবহার করতেই হয়েছে ‘দেশ’ পত্রিকার পাতায়। কাদা খেউড়ের ক্ষেত্রেও একই জিনিস লক্ষ করা যায়। গ্রাম্য বা আদিবাসী সমাজের এই স্বাভাবিক প্রকাশভঙ্গিকে বদলে দিতে চেয়েছে ক্ষমতার সংস্কৃতি। তাই জাগ-গানের আয়োজন হয় লোকবসতি থেকে একটু দূরে। সেই সুযোগ আছে বলেই কোনও কোনও অঞ্চলে এখনও বেঁচে আছে জাগ-গান। কাদা খেউড় কলকাতাকেন্দ্রিক হয়ে পড়ায় সেই সুযোগ হয়তো ছিল না। তা ছাড়াও সমালোচনা ও নিন্দার ঝাপটাও অনেক বেশি পড়েছে তার উপর। সব মিলিয়ে উনিশ শতক পেরোনোর আগেও পঞ্চত্ব প্রাপ্তি হয় এই বিনোদনের। 

আমরা প্রায় দেড় শতক বা তারও আগের একটা সময় নিয়ে আলোচনা করছি। এই সময়ের মধ্যে নাগরিক রুচির বদল বয়ে গেছে যে খাতে, সেখান থেকে উজান যাওয়ার চিন্তাটাই পাগলামি। তবু আজ এই পুরনো কাসুন্দি আবার ঘাঁটতে বসেছি, কারণ এর মধ্যে আছে ইতিহাসের এক শিক্ষা। ঠিক যে ভাবে এক সময় শবরোৎসবের সংস্কৃতি ছেঁটে ফেলা হয় সাংস্কৃতিক দূষণের নামে, সে ভাবেই রুচি ও নৈতিকতার দোহাই দিয়ে বারংবার সমাজের ক্ষমতাশালী গোষ্ঠী নিজেদের অনুমোদিত সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে বাকি সমাজের উপর। আর সেই চেষ্টা ফলবতী হলে দেখা যাচ্ছে, নিজেদের সাংস্কৃতিক শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে বহু সংখ্যক প্রান্তিক মানুষ আর হারিয়ে যাচ্ছে তাঁদের নিজস্ব ঐতিহ্যের সঙ্গে সব রকম যোগাযোগ। অবস্থাটা এমন পর্যায়ে চলে যায় যে সম্পূর্ণ একটি কাদা খেউড় পদ খুঁজে পাওয়া আজ খুব কঠিন। খেউড় সম্পর্কেও শুধু উল্লেখ পাওয়া যায় আখড়াই ও হাফ-আখড়াই গানের ক্রমবিবর্তনের একটি ধাপ হিসেবে। অথচ মহেন্দ্রনাথ দত্তের বক্তব্য অনুযায়ী তেমন হওয়ার নয়। কাদা খেউড় গানের খাতা থাকা উচিত ছিল পুরনো কলকাতার বহু পরিবারে। এই বিষয় নিয়ে কাজ করতে গবেষকরা এগিয়ে এলে আমরা আমাদের সামাজিক ইতিহাসের একটি কম-আলোচিত দিক সম্পর্কে আরও জানতে পারব। 

0 comments:

0

প্রবন্ধ - অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in




 



প্রামাণ্য যুক্তি না থাকলে তর্কে বিপক্ষকে সহজে দাবিয়ে দেবার অভিনব পন্থা হল তাকে কোনো অবাঞ্ছিত গোষ্ঠীভুক্ত বলে দাগিয়ে দেওয়া। গত তিন-চার দশক ধরে বিজ্ঞানেও এই ধরণের একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যা কিছু অতিমাত্রিক প্রাকৃতিক ঘটনা সবই সাম্প্রতিক কালে বহু প্রচারিত বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য বলে প্রচার করা হচ্ছে। এতে অনুসন্ধান ও গবেষণার পরিশ্রম কমে, বিজ্ঞান মার খায়। 

পৃথিবীতে প্রায় প্রতিনিয়তই কোথাও না কোথাও কোনো না কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে চলেছে, সে সমুদ্রতলে হোক বা পৃথিবীপৃষ্ঠে। ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত, ভূমিক্ষয়, সুনামি, ঝড়, তাপপ্রবাহ এসব আবহমানকাল ধরে কম-বেশি হয়ে চলেছে। দুর্যোগ যখন প্রাণি ও মানবসম্পদকে আঘাত করে, মনুষ্য-ব্যবহৃত ভূসম্পদের ব্যপক ক্ষতি করে তখন তা বিপর্যয়ের পর্যায়ে চলে যায়। জনমানবহীন জায়গায় ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত, ধস-এর মত দুর্যোগ হলেও বিপর্যয়ের কারণ হয় না, আবার ১৯৯৯-এ ফাইলিন ঘুর্ণিঝড়, ২০০৪-এর ভারত মহাসাগরে সুনামি, ২০০৫-এ কাশ্মীর ভূমিকম্প, ২০০৮-এ চিনে ভূকম্প, ২০০৯-এ আয়লা ঘুর্ণিঝড় এবং সাম্প্রতিক আমপান বহু প্রাণ ও প্রাকৃতিক সম্পদ নষ্ট করেছে এবং তার জন্যে প্রচুর আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। একসময় এইসব বিপর্যয়কে দেবতার রোষ বলে দাগিয়ে দেওয়ার চল ছিল, আধুনিক কালে বলা হয় প্রকৃতির রোষ আর কিছু বিজ্ঞানী বলেন মানুষের জন্যে পৃথিবী গরম হয়ে যাচ্ছে বলে। এই তিনটেই বিশ্বাসজাত। সাম্প্রতিক ঘুর্ণিঝড় আমপান বিপর্যয়কে এই তিন কারণেই অভিযুক্ত করেছেন বিভিন্ন মানসিকতার লোক। 

ঘুর্ণিঝড় কেন হয়

একটা নির্দিষ্ট সীমারেখার মধ্যে পৃথিবীর ঘুর্ণনের পথে যে-কোনো তরল পদার্থের ঘুর্ণায়মান অবস্থাকে সাইক্লোন বলে। উত্তর গোলার্ধে এই ঘুর্ণন ঘড়ির কাঁটা ঘোরার দিকে আর দক্ষিণ গোলার্ধে বিপরীত দিকে। প্রতিটা সাইক্লোনের কেন্দ্রে একটা ঘুর্ণি হাওয়া তৈরি করে বলে এর নাম ঘুর্ণিঝড়। ক্রান্তীয় থেকে মেরুপ্রদেশে যে কোনো জায়গায় ছোট থেকে বড় নানা মাত্রার ঘুর্ণিঝড় হতে পারে কিন্তু এর প্রস্তুতিতে চাই গরম বাতাস। সূর্যের বিকিরণ রশ্মি সরাসরি সমুদ্রের জল গরম করে। ক্রান্তীয় অঞ্চলে সূর্যের তাপ সর্বাধিক হওয়ায় কর্কটক্রান্তি ও মকরক্রান্তি রেখাদ্বয়ের অন্তর্বর্তী অঞ্চলে অর্থাৎ ২৩.৫ ডিগ্রি উত্তর এবং ২৩.৫ ডিগ্রি দক্ষিণ অক্ষরেখার মধ্যে ঘুর্ণিঝড় তৈরি হয়। তবে সমুদ্রপৃষ্ঠের জলের তাপমাত্রা ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলেই জল গরম হয় এবং গরম বাতাস অপেক্ষাকৃত হালকা বলে ওপরের দিকে উঠে গিয়ে নিম্নচাপ তৈরি করে। ভেতরের দিকে চাপ থাকে সবচেয়ে কম, বাইরের চাপ বেশি। এইবার বাইরের থেকে বায়ু নিম্নচাপের কেন্দ্রের দিকে ছুটে আসে কিন্তু কেন্দ্রে কিছুতেই পৌঁছতে পারে না। মাঝখানের বেশ কিছুটা জায়গাকে ঘিরে তৈরি হয় ঘুর্ণিপাক, পাগলের মত হাওয়া ঘুরপাক খেতে খেতে তোলে ঘুর্ণিঝড়। একেবারে কেন্দ্রে ঘুর্ণিঝড়ের চোখ। বাতাস আবার সোজা চলতে পারে না, কাঁকড়ার মত পাশের দিকে সরতে থাকে, তাই আস্তে আস্তে চলে আসে ডাঙার দিকে। অনেক সময় ঘুর্ণিঝড়ের প্রবল বেগ ডাঙায় আসার আগেই তার তেজ কমে যায়। ক্রান্তীয় বা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলাকায় হয় বলে ভারত মহাসাগর, জাপান, অষ্ট্রেলিয়া, ফিলিপাইন, পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ, মেক্সিকো উপসাগর ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ঘুর্ণিঝড় প্রবণ। প্রতিবছরই একাধিক ঝড়ের মুখোমুখি হতে হয় এসব দেশে সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকার মানুষদের। 

সূর্যের অবস্থানের সাথে এই ঝড় তৈরি হবার সম্পর্ক আছে বলে উত্তর গোলার্ধে আগস্ট থেকে নভেম্বর আর দক্ষিণ গোলার্ধে জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসে এই ঝড় হয়। কিন্তু উত্তরায়ণ ও দক্ষিণায়নের জন্যে ক্রান্তীয় অঞ্চলে ভারত মহাসাগর আর প্রশান্ত মহাসাগরে মে-জুন ও সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে সাইক্লোন হয়। ভারতে সাইক্লোন তৈরি হয় উত্তর ভারত মহাসাগরে। বঙ্গোপসাগর ও আরবসাগরে বছরের দুটো ভিন্ন সময়ে ঘুর্ণিঝড় হয়। বঙ্গোপসাগরে মে-জুন ও সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর এবং আরবসাগরে এপ্রিল-জুন ও সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর মাসে। বঙ্গোপসাগরে ঝড়ের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত বেশি, গড়ে ছ’টা প্রতি বছরে, আরবসাগরে গড়ে দেড়। 

ভারতে ঘুর্ণিঝড়

ভারতে (বর্তমান বাংলাদেশ সমেত) ১৫৮৪ সাল থেকে রেকর্ডে দেখা গেছে অন্তত আঠারোটা বেশ বড় ধরনের ঘুর্ণিঝড় হয়ে গেছে যার ফলে প্রতিটিতে কমপক্ষে দশ হাজার মানবসম্পদ নষ্ট হয়েছে। বাংলা খাড়িতে ১৭৩৭ সালে তিন লক্ষ এবং ১৯৭০ সালে বাংলাদেশে সাড়ে পাঁচ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। গত আড়াইশো বছরে ভারতে বড় ধরনের সাইক্লোনে প্রায় বারো লক্ষেরও বেশি মানুষের প্রাণ নষ্ট হয়েছে। ভয়াবহ ঘুর্ণিঝড়ে যেসব বছরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা হোল [স্থান, মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা] – ১৫৮৪ (বাকেরগঞ্জ, বরিশাল, ২ লক্ষ), ১৬৯৯ (সুন্দরবন, ৫০ হাজার), ১৭৩৭ (হুগলি নদী, ৩.৫ লক্ষ), ১৭৬৭ (বরিশাল, ৩০ হাজার), ১৭৮৯ (করিঙ্গা, ২০ হাজার), ১৮২২ (বরিশাল, ৫০ হাজার), ১৮৩১ (বরিশাল, ২২ হাজার), ১৮৩৯ (করিঙ্গা, ৩ লক্ষ), ১৮৬৪ (কলকাতা, ৬০ হাজার), ১৮৭৬ (বাকেরগঞ্জ, ২ লক্ষ), ১৮৮২ (মুম্বাই, ১ লক্ষ), ১৮৯৭ (চট্টগ্রাম, ১.৭৫ লক্ষ), ১৯১২ (বাংলাদেশ, ৪০ হাজার), ১৯১৯ (বাংলাদেশ, ৪০ হাজার), ১৯৪২ (কলকাতা, ৪০ হাজার; বাংলাদেশ, ৬১ হাজার), ১৯৭০ (ভোলা, বাংলাদেশ, ৫.৫ লক্ষ), ১৯৭৭ (দেবী তালুক, ২০ হাজার), ১৯৯১ (বাংলাদেশ, ১.৪ লক্ষ)। [সূত্রঃ Encyclopedia of hurricanes, Typhoons and Cyclones (1999) by David Longshore; Deadliest Tropical Cyclones in History, www.wunderground.com]। উনিশ শতকে মৃত্যুর সংখ্যা আনুমানিক আট লক্ষেরও বেশি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি এবং তার যথাযথ ব্যবহার করে ১৯৯৯ সালে ওডিসায় ফাইলিন, ২০০৯ সালে আয়লা ও এ বছর আমপানের আগে সতর্কতামূলকভাবে দুর্যোগ সম্ভাব্য এলাকা থেকে মানুষ সরিয়ে ফেলার জন্যে ব্যাপক মানবসম্পদহানি রোখা সম্ভব হয়েছে যদিও চাষ-আবাদ, নদীর বাঁধ ও সম্পত্তিহানি হয়েছে প্রভূত।

আমপান

সাইক্লোনের নামকরণ করা হয় সারা পৃথিবী জুড়ে। সাধারণত এলাকা-ভিত্তিক নামের ব্যাঙ্ক করা হয় এবং সেখান থেকে নাম বাছা হয়। এবারের আমপান ঘুর্ণিঝড়ের নাম নেওয়া হয়েছে থাইল্যান্ডের প্রস্তাবিত নামের তালিকা থেকে। আমপান মানে আকাশ। বিশাখাপত্তনম থেকে ২০০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে এবং শ্রীলঙ্কার ৩০০ কিলোমিটার পূর্বে ১৩ই মে ২০২০ তারিখে উত্তর ভারত মহাসাগরে জলের তাপমাত্রা অত্যন্ত গরম হয়ে যাওয়ায় একটা নিম্নচাপ তৈরি হয় ও উত্তরপূর্ব দিকে সরতে থাকে এবং ক্রমে শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে। নিম্নচাপ আরও গভীর হয় এবং ঘুর্ণিঝড় প্রবল আকার নিয়ে কলকাতার দিকে এগিয়ে আসে। ১৮ই মে এই ঝড়ের সর্বোচ্চ গতিবেগ হয় ঘন্টায় ২৬০ কিলোমিটার। তারপর উপকূলের দিকে এগিয়ে এলে বাতাসের গতিবেগ কমতে থাকে এবং ২০শে মে ১৫৫ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা গতিবেগে দুপুর আড়াইটেয় পশ্চিমবাংলার উপকূলে আছড়ে পড়ে। বিজ্ঞানীদের মতে বঙ্গোপসাগর এলাকায় ১৫৮২ সালের পর রেকর্ড অনুসারে ১৭৩৭, ১৮৩৩, ১৯৯৯ এর পর আমপান চতুর্থ সুপার সাইক্লোন। কলকাতা, হাওড়া, হুগলি, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা এবং পূর্ব মেদিনীপুর সমেত বিস্তীর্ণ এলাকা ঝড়ে আক্রান্ত। এছাড়াও ওডিসা ও বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়ে। কোভিড-১৯ এর জন্যে সামাজিক দূরত্বের সতর্কতা মেনেও প্রচুর উপকুলবাসী লোকেদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে মৃত্যুর হার অনেক কম। পশ্চিমবঙ্গে ৯৮ জন মানুষের মৃত্যুর খবর নথিভুক্ত হয়েছে। তবে কলকাতা সহ জেলাগুলোতে প্রচুর বাড়িঘর ভেঙে, গাছ উপড়ে, ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে বাঁধ ভেঙে জল ঢুকে চাষআবাদের ফসল ও জমি সব ব্যাপক নষ্ট করে দিয়েছে। দু লক্ষ একর জমির ধান নষ্ট হয়েছে। 

বিশ্বাস বনাম বিজ্ঞান 

উত্তর ভারত মহাসাগরে ঘুর্ণিঝড় বাৎসরিক প্রাকৃতিক ঘটনা। কখনও ঝড়ের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়ে। বিপর্যয়ের আবার অন্য কারণও আছে, যেমন প্রকৃতি ও পরিবেশের তোয়াক্কা না করে যেখানে সেখানে মানুষের বসবাস যার পেছনে রাজনৈতিক প্রভাব বেশি আর তার সাথে যুক্ত হয় আর্থ-সামাজিক দিক। সুন্দরবন অঞ্চলে মানুষের বসবাস প্রাকৃতিক নিয়মবিরুদ্ধ এবং তাই বারবার বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হয়। সুন্দরী গাছ ও বাঁধ জলপ্লাবনের মাত্রা কমাতে পারে কিন্তু নির্মূল করা যাবে না। এছাড়াও ভূগাঠণিক দিক দিয়ে এলাকার অনেকটাই অধোগমনে ক্ষয়ের মুখে যার জন্যে সমুদ্রের জলের মাত্রা আপেক্ষিক বৃদ্ধি পাওয়ায় নোনা জল ঢুকে আসছে। ক্ষতিগ্রস্তরা বেশিরভাগই গরীব মানুষ। দেবতা বা প্রকৃতির রোষ এখানে কাজ করে না, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও মানবিকতার অভাবই প্রধান দায়ী। সেভাবেই, বিশ্ব উষ্ণায়ন, এল-নিনো এগুলো সবই বাস্তব, আন্তর্হিমবাহ যুগে, যখন পৃথিবীর তাপমাত্রা গত বারো হাজার বছর ধরে ক্রমাগত বেড়েই চলেছে, এবং মাঝেমাঝে হঠাৎ বেশি গরম বা ঠাণ্ডা হয়ে যায়, এগুলোকে অস্বীকার করা যায় না। আট হাজার বছর আগে পৃথিবী খুব গরম হয়ে গেছিল আবার সাত শো বছর আগে ছিল ক্ষুদ্র বরফ যুগ। পৃথিবী স্বাভাবিক নিয়মেই গরম হয়ে যাচ্ছে, এর জন্যে মানুষের অবদান যৎসামান্য। যদি ধরেই নেওয়া যায় গত একশো বছরে জ্বালানি ব্যবহারের জন্যে পৃথিবী গরম হয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়িয়ে দিয়েছে, যেমন এক্ষেত্রে ঘুর্ণিঝড়, তাহলে তার আগের দুর্যোগ ও বিপর্যয়ের কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। বিজ্ঞান বিশ্বাসের থেকে বিশ্লেষণে আস্থা রাখে তাই অনুসন্ধান ও গবেষণা চলতে থাকে। 

(লেখক ভূবিজ্ঞানী এবং জিএস আই-এর প্রাক্তন অধিকর্তা)

0 comments:

0

প্রবন্ধ - সঞ্চারী গোস্বামী

Posted in


উফ, ইন্টারনেটটা আজ যা জ্বালাচ্ছে না!

এই বাক্যবন্ধটি কমবেশি আমরা সবাই ব্যবহার করি কোনো না কোনো সময়ে। এই অতিমারী আক্রান্ত এক সময়ে দাঁড়িয়ে যখন অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছি বা করছি, ব্যাঙ্কে লাইন না দিয়ে অনলাইন ট্রান্স্যাকশনে অভ্যস্ত হবার চেষ্টা করছি, ঝট করে দেখে নিচ্ছি প্রতিদিনের কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা, যোগ দিচ্ছি কোনো ওয়েবিনারে, আতঙ্ক থেকে মুখ ফেরাতে ফেসবুক লাইভে অনুষ্ঠান শুনছি বা করছি, তখন মাঝেমাঝেই যে এই কথা বলতে হবে, তাতে আর আশ্চর্য কী! শরীর থাকলে যেমন রোগ হবে, তেমনি যন্ত্র ব্যবহার করলে তার যন্ত্রণাও যে অবশ্যম্ভাবী!

কিন্তু ভাবুন তো, কমবেশি অসুবিধা সত্ত্বেও সারা পৃথিবীটা এখন কেমন হাতের মুঠোয়! সুদূর ইউরোপ বা আমেরিকার কোনো শহরে বসে কত সহজে আপনি এশিয়ার একটি শহরে যোগাযোগ করতে পারেন! হঠাৎ অর্থের প্রয়োজনে মুহূর্তের মধ্যে পেয়ে যেতে পারেন। কলকাতা থেকে ব্যাঙ্গালোর দুরন্ত এক্সপ্রেসে অক্টোবরের পাঁচ তারিখে টিকিট পাওয়া যাবে কিনা বা মুম্বই থেকে মিউনিখ হয়ে ত্রিয়েস্তে যাওয়ার ফ্লাইট আছে কিনা দেখে নিতে আপনার মাত্র কয়েক মিনিট সময় লাগবে।

এত সুবিধা স্বত্ত্বেও অস্বীকার করার উপায় নেই, অন্তত আমার দেশের মোটামুটি ৪৬% মানুষ এখনো ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না, বা বলা ভালো করতে পারেন না। সারা বিশ্বের দিকে যদি তাকাই তাহলেও গড়ে ৪৭% মানুষ এখনো এই পরিষেবার আওতার বাইরে। এই বাইরে থাকাটা খানিকটা মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থানের কারণে আর খানিকটা কোনো একটি জায়গার ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে। এ ছাড়াও অবশ্য প্রচ্ছন্ন কিছু কারণ থেকে যায়। তবুও আমরা যদি এই পরিষেবার বিষয়টিকে সময়ের সঙ্গে দেখি তাহলে দেখব বিশ্বজুড়ে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ২০০৫ সালে ছিল ১৬%। ২০১০এ তা হয়েছে ৩০%, ২০১৭তে ৪৮% ও ২০১৯ এ ৫৩.৬%। ইন্টারনেট ছেড়ে যদি কেবল যোগাযোগ ব্যবস্থার কথা ভাবি তাহলে এই মুহূর্তে মোটামুটিভাবে বিশ্বের ৬১% মানুষের নিজের মোবাইল ফোন আছে এবং স্মার্টফোনের বিচারে সেটা ৪৫% এর কাছাকাছি। নেই-এর অঙ্কে বলতে গেলে ৩৯% এর নিজের মোবাইল নেই এবং স্মার্টফোন ৫৫% মানুষের ছোঁয়ার বাইরে।

কিন্তু সময়ের নিরিখে বিচার করলেই আমরা দেখতে পাব এই যোগাযোগ ব্যবস্থায় আসলে কোন ফাঁকে এক বিপ্লব হয়ে গেছে। আমি যখন স্মার্টফোন ব্যবহার করি সত্যি কি ভেবে দেখি ঠিক কোন মুহূর্তে আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের সেই দৈত্য এসব কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলল? আমাদের স্বভাবই এমন যে আমরা প্রযুক্তি ব্যবহার করি, কিন্তু বিজ্ঞানকে স্বীকার করি না। দেশের এক বিরাট সংখ্যক মানুষ এখনো বিজ্ঞানের বদলে অবিজ্ঞানে ভরসা করেন, রোগমুক্তির জন্য দেবস্থানে মানত করেন, ওঝার কাছে যান, কিন্তু ডাক্তারের কাছে যান না। অবশ্য তার জন্য তাদের অন্যায় দেখার আগে ভাবা দরকার আমরা সঠিক কথা সঠিক ভাবে মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছি কিনা। অন্তত আমরা যারা বিজ্ঞানে ভরসা রাখি এ দায়িত্ব তাদেরও।

আজ থেকে ১৫০ বছর আগের কথা। এক আইরিশ বিজ্ঞানী আলোর গতিবিধি নিয়ে কিছু গবেষণা করছিলেন। কিন্তু ওই বিজ্ঞানে যা হয়েছে বারবার, অর্থাৎ accident। যদিও বলাই বাহুল্য, এখানে এই শব্দের মানে দুর্ঘটনা নয়। আলো নিয়ে গবেষণা করতে করতে তিনি বুঝলেন বাতাসে কেবল ধূলিকণা নয়, জীবাণুও থাকে। কেবল বুঝলেন না... প্রমাণ করলেন। মাস্ক বা রেস্পিরেটরের ব্যবহার তখন খানিকটা জানা। জন টিন্ড্যাল বললেন যে সুতির কাপড়ের আচ্ছাদনের মধ্যে কটন উলের একটা ফিল্টার লাগিয়ে দিলে এই জীবাণুকে শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে আমাদের শরীরের ভেতরে যাওয়া থেকে আটকানো যাবে, যার ফলে আমাদের রোগ-ব্যাধি আটকানো খানিকটা সম্ভব হতে পারে। একবার ভাবুন তো আজকের দিনে দাঁড়িয়ে। করোনা অতিমারী থেকে বাঁচার জন্য আমরা কী ব্যবহার করছি আসলে? আজ থেকে ১৫০ বছর আগে যার কথা শুরু করেছিলেন ওই আইরিশ বিজ্ঞানী – জন টিন্ড্যাল।

ভাবছেন, হচ্ছিল যোগাযোগ ব্যবস্থা আর ইন্টারনেটের কথা, আবার কেন এই মাস্কের কথা! বেশ তো একটু বিস্মরণের পথে যাওয়া হচ্ছিল, আবার কেন? আসলে বলা এইজন্য যে, ভদ্রলোক ওই বিশেষ আচ্ছাদনের কথা না বললে, বাতাসে ভাসমান জীবাণুর কথা সেদিন না বললে আজ আমি জ্যান্ত অবস্থায় এই বিষয়ে লিখতাম কিনা, আপনি পড়তেন কিনা আর প্রকাশক ছাপতেন কিনা এ বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে।


যাই হোক, আসল কথায় যাই, অর্থাৎ কিনা যোগাযোগের কথায়। টিন্ড্যাল আরেকটি গবেষণা করেছিলেন এর কিছু আগে, সম্ভবত ১৮৫৪ সালে। আলো বিষয়েই। খুবই সহজ পরীক্ষা। যে কোনো সময় আপনি সহজেই এটা করে ফেলতে পারবেন। দরকার হচ্ছে একটি লেসার টর্চ, একটি স্বচ্ছ প্লাস্টিকের বোতল, খানিকটা জল যেটা বোতলে ভরা হবে আর একটি বোতলে ফুটো করার জন্য কোনো যন্ত্র, আপনার যেটা নিতে ইচ্ছে করে, সেটা। ও হ্যাঁ, আরেকটা জিনিসও নেবেন – জলভর্তি বোতলের নিচে রাখার একটি কানা উঁচু বাটি। এটা যে খুব প্রয়োজন তা নয়, তবে না নিলে ফুটো বোতল থেকে জল পড়ে কী হবে বুঝতেই পারছেন। এবার আসি পরীক্ষার কথায়। বোতলে জল নিয়ে তার একপাশ থেকে আলো ফেললে আলো জলের মধ্যে দিয়ে গিয়ে অন্যপাশে দেওয়ালে গিয়ে পড়বে স্বাভাবিক ভাবেই। নিচে ছবিতে লাল তীর দিয়ে (চিত্র ২ অ) যেমন দেখানো হয়েছে আর কি! এইবার মনে করুন আপনি বোতলের একট দেওয়ালে একটি ফুটো করলেন। জল তো বোতল থেকে যেভাবে বাঁকা পথে বেরোনোর কথা তেমন বেরোবে (চিত্র ২ আ); আপনি বোতলের তলায় কানা উঁচু বাটি রেখেছেন, তাই মেঝেয় পড়বে না, কিন্তু আলো? আমার-আপনার স্বাভাবিক বোধ বলছে আলো আগে যেমন বেরোচ্ছিল, তেমন বেরিয়ে দেওয়ালে পড়বে।

কিন্তু ঘটনা হল, আলো তেমন পথে যাবে না। টর্চ একটু নাড়ালে চাড়ালে মাঝে মাঝে যাবে, কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই আপনি দেখবেন আলো ওই জলের ধারার পদাঙ্ক অনুসরণ করছে। যদিও টিন্ড্যাল যখন এই পরীক্ষা করেন, তখন তিনি লেসার টর্চ পাননি, সাধারণ একমুখী আলো ব্যবহার করেই পরীক্ষাটি করেন। এই ঘটনাটি আলোর যে বিশেষ ধর্মের জন্য হয়, তার কথা আমরা ছোটবেলায় বিজ্ঞান বইতে পড়ি, তার নাম প্রতিসরণ। দুটো বিভিন্ন ঘনত্বের মাধ্যম ধরা যাক, এখানে যেমন বোতলের ভেতর জল আর বাইরে হাওয়া।

ঘন মাধ্যমে আলো আস্তে চলে, অনেকটা ভিড় স্টেশনে যেভাবে আপনাকে যেতে হয় আর কি! আর লঘু মাধ্যমে আলো জোরে চলতে পারে, ফাঁকা রাস্তায় আপনি যেমন চলতে পারেন, ঠিক সেরকম। এবার ভিড়ের মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে হঠাৎ ফাঁকা রাস্তা পেলে আপনি যেমন ভড়কে যান, আলোরও তেমনি হয়, আর এর ফলে আলো বেশ মজার কিছু কাণ্ড ঘটায়। তার মধ্যে একটি হল টোট্যাল ইন্টারন্যাল রিফ্লেক্সন। এতে আলো এতই ভড়কে যায় যে ভাবে, এত ফাঁকা মানে নিশ্চয়ই সামনে গোলমাল। অতএব সে সুড়সুড় করে যে মাধ্যম দিয়ে যাচ্ছিল সেখানে ফিরে আসে। এই পরীক্ষাতেও আসলে তাই হয়েছিল। এতে একটা ভারি মজার জিনিস দেখা গেল। জলের ধারাটাকে আপনি যদি পাইপ ভাবেন, তাহলে আলো কেমন অবলীলায় সেই পাইপ বেয়ে চলে গেল। পরীক্ষা হলেও সেই মুহূর্তে পরীক্ষাটির গুরুত্ব বোঝা যায়নি। আপাতত আমিও বোঝাব না, আরো কিছুদূর হেঁটে নাহয় এ পথে ফেরত আসা যাবে আবার।

এই পরীক্ষা যখন হল, তার কাছাকাছি সময়ে আরও একটা যুগান্তকারী আবিষ্কার হয়েছে। ১৮৭৬ সাল। আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল আবিষ্কার করেছেন টেলিফোন। একটা মাইকের মত জিনিসের সামনে কথা বললে একটা তারের মধ্যে দিয়ে সেই কথা বেশ খানিকটা দূরেও পাঠানো যায়, এটা দেখা গেছে। নিচের ছবিটি (চিত্র ৩) প্রথমবার আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল-এর টেলিফোন ব্যবহারের ছবি। এর ঠিক চার বছরের মাথায় ১৮৮০ সালে এই ভদ্রলোকই আরেকটি যন্ত্র তৈরি করেন। তার নাম ফটোফোন। টেলিফোনের থেকে একটু আলাদা এটি। কিন্তু উদ্দেশ্য সেই যোগাযোগ। ১৮৭৬ এর পর থেকেই এই যন্ত্রে আলোর ব্যবহার নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিলেন গ্রাহাম বেল, কারণ শব্দের তুলনায় আলো দ্রুতগামী। অনেক দূরে কিছু তথ্য পাঠাতে আলোর জুড়ি মেলা ভার।



এই যন্ত্রেও ওই চিত্র ৩ এর মতই একটি কথা বলার জায়গা ও নল ছিল। নল দিয়ে শব্দ গিয়ে নলের অন্য প্রান্ত্রে রাখা একটা আয়নাকে ধাক্কা মারত। আয়নাটা কোনো সাধারণ আয়না নয়, কানের পর্দার মত স্থিতিস্থাপক কোনো পদার্থ দিয়ে তৈরি। কানের পর্দায় শব্দ ধাক্কা মারলে যেভাবে সেই পর্দা কাঁপে, আমাদের বা গ্রাহাম বেলের আয়নাটিও সেইরকম। তাতে আয়নার ওপর যে আলো পড়ত তা বিভিন্ন তীব্রতায় বিভিন্ন দূরত্বে যেত। এই আলোকে ধরে প্রথম যখন তাকে আবার শব্দে পরিণত করা হয়েছিল। তার জন্য ব্যবহার হয়েছিল ভূষাকালি। তবে জানেন কি যে ভদ্রলোক যন্ত্রের মান উন্নত করার জন্য কী কাণ্ড করেছিলেন? নিজের মধুচন্দ্রিমার সময়েও চিন্তাভাবনা, বিজ্ঞানের পেপার পড়া চালিয়েছেন। সেলেনিয়ামের রোধ (resistance) যে আলোর ওপর নির্ভর করে কমে বাড়ে, এই মধুচন্দ্রিমার সময়েই তাঁর এটা গোচরে আসে – একটি পেপার পড়ে। পরের ফটোফোন যন্ত্রে সেলেনিয়াম ফটোডিটেক্টর ব্যবহার করে আলোকে তড়িৎ-এ রূপান্তরিত করা হয়, শেষে আবার শব্দে। তবে দুঃখের বিষয়, এ যন্ত্র টেলিফোনের মত ভালো কাজ করছিল না। গ্রাহাম বেল যদিও উচ্ছ্বসিত হয়ে তাঁর বাবাকে চিঠিতে লিখেছেলেন যে তাঁর বাবা এবার ঠাকুর্দা হয়েছেন, লিখেছিলেন, তিনি এখন সূর্যের হাসি-গান-কাশি সবই শুনতে পাবেন। কিন্তু নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকা তার রীতিমত সমালোচনা শুরু করে। তাদের মনে হয়েছিল, সাধারণ মানুষের জন্য এই সূর্যের আলো ব্যবহার করে কথা বলার আইডিয়াটি কিম্ভূত ও বাড়াবাড়ি ধরণের।

কিন্তু বিজ্ঞানে সমকাল কোনো কাজের গুরুত্ব বুঝতে ভুল করেছে, এ ঘটনা নতুন নয়। এখানেও তাই হয়েছিল। আজকের দিনে আমরা সবাই প্রায় অপ্টিক্যাল ফাইবার বা ফাইবার অপ্টিক কেব্‌ল-এর কথা জানি। শব্দ, ছবি, তথ্য, সবকিছু আমরা এখন আলো ব্যবহার করেই পাঠাই। যা একসময় বাজে কথা বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, তার ওপর নির্ভর করেই আজকের দিনে আমাদের সারা পৃথিবীটা চলছে।

গ্রাহাম বেল-এর সময় পর্যন্ত আলোকে কোনো নল দিয়ে পাঠানো যায়নি। নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর আপত্তি একেবারে অযৌক্তিক বলা যায় না। গ্রাহাম বেল সূর্যের আলো ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন, যার অনেক অসুবিধে। সব জায়গার আয়না দিয়ে আলো ধরা অসুবিধে। সর্বোপরি মেঘলা দিনে তো মহা সমস্যা। বিজ্ঞানীরা কিন্তু চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

এর অনেক দিন পর ১৯৩০ সালে জার্মানির এক ডাক্তারি ছাত্রের মনে হল, আচ্ছা শরীরের ভেতর কোনো যন্ত্র গোলমাল করলে শরীরে তার প্রভাব দিয়ে বোঝা যায় হয়ত, কিন্তু সত্যি সত্যি একেবারে শরীরের ভেতরের ছবি বাইরে আনতে পারলে কেমন হয়! প্রথমেই তো আর মানুষের শরীরে পরীক্ষা করা যায় না, তাই প্রথম কাঁচের নল দিয়ে তিনি ছবি পাঠালেন একটা বাল্বের। এই কাজে তিনি ব্যবহার করলেন অনেকগুলো কাঁচের অতি সূক্ষ্ম নল। এই কাঁচের নল ব্যবহার করে আলো পাঠানোর বিষয়টা অবশ্য জানা ছিল ততদিনে।

কিন্তু সেই কাঁচের নলের বান্ডিল ব্যবহার করে ছবি, যা কিনা আসলে একটা তথ্য, পাঠানোর আইডিয়াটা একেবারেই এঁর। অবশ্য বাবারও বাবা থাকে। তাই এই আইডিয়ার পেছনে যে ভাবনা কাজ করেছিল, তা হল স্টেথোস্কোপের মধ্য দিয়ে শব্দ আসার ভাবনা। শরীরের ভেতরের যে শব্দ সহজে শোনা যায় না, তা শোনার জন্য ব্যবহার হত স্টেথোস্কোপ। ঠিক একইভাবে শরীরের যে অংশ দেখা যায় না, তা দেখার জন্য আলো ব্যবহার করে আসলে স্টেথোস্কোপের মত একটি যন্ত্র তৈরি করতে চেয়েছিলেন তিনি। এই ডাক্তারি ছাত্রের তৈরি জিনিসটাই কিন্তু প্রথম ফাইবার অপ্টিক কেব্‌ল। সেই যন্ত্র ব্যবহার করে বাল্বের ছবি পাঠানো গেছিল, যদিও ছবি খুব একটা ভালো ছিল না। এর পেটেন্ট ক্লেম করতে গিয়ে ব্যর্থ হন তিনি, কারণ ততদিনে হ্যান্সেল নামে এক আমেরিকান বিজ্ঞানী কাঁচের পাইপ দিয়ে ছবি পাঠানো যায় বলে তার পেটেন্ট নিয়ে বসে আছেন। যদিও ছবি পাঠানোর কৃতিত্ব সম্পূর্ণ ওই ছাত্রেরই ছিল। ছবিটা কীকরে আরেকটু ভালো করা যায় তার জন্য আরেকটু গবেষণা করতে চাইলেন ভদ্রলোক। কিন্তু পারলেন না। কারণ তিনি তখন জার্মানির বাসিন্দা, জাতিতে ইহুদি এবং সময়টা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিছু আগে। এই ডাক্তারবাবুর নাম হেনরিক ল্যাম। এই প্রযুক্তি আমরা যে যন্ত্রে ব্যবহার করি, এখনও, তা হল এন্ডোস্কোপ।

হেনরিক ল্যামের ছবির মান খারাপ ছিল। কিন্তু ওইসময় যে কাঁচের ফাইবার ব্যবহার হত, তাতে ওর চেয়ে বেশি ভালো ছবি পাবার সম্ভাবনা ছিল না। এ বিষয়টা বোঝা গেল পরে। কোনো তথ্য পাঠানোর সময় সবসময়ই কিছু না কিছু অংশ বাদ পড়তে থাকে। ঠিক যেমন, আপনি অনেকখানি রাস্তা হাঁটতে গেলে আস্তে আস্তে আপনার শক্তিক্ষয় হয়, এও তেমনি। ১৯৬৪ সালে দুই বিজ্ঞানী কাও এবং হক্যাম দেখালেন, প্রতি কিলোমিটারে একটা নির্দিষ্ট মানের চেয়ে বেশি তথ্য হারিয়ে যেতে থাকলে, অপ্টিক্যাল ফাইবার দিয়ে ঠিকমত তথ্য পাঠানোর আশা করা যাবে না। সেইসঙ্গে তাঁরা এও বললেন, কাঁচের নল যে কাঁচ দিয়ে তৈরি হচ্ছে তাকে হতে হবে যতটা সম্ভব শুদ্ধ; তবেই এই তথ্য পাঠানোয় সাফল্য আসতে পারে। এর মাত্র ছয় বছরের মধ্যে কর্নিং গ্লাস ওয়ার্কস নামে একটি আমেরিকান কম্পানি এমন অপ্টিক্যাল ফাইবার তৈরি করে যার মধ্যে দিয়ে তথ্য পাঠালে তথ্য হারানোর ভয় খুব কম থাকে। এরাই পরে ক্রমশ ভালো থেকে আরো ভালো অপ্টিক্যাল ফাইবার তৈরি করে। টেলিকমিউনিকেশনের আজকের যে উন্নতি তার পুরোটাই এই অপ্টিক্যাল ফাইবারের জন্য, কারণ অন্য কোনোভাবেই এত বিপুল তথ্য আমরা এক জায়গা থেকে এত সহজে অন্য জায়গায় পাঠাতে পারিনা। প্রথমেই যে ইন্টারনেটের কথা বললাম, তার স্পীড আসে অপ্টিক্যাল ফাইবারের জন্য। ফেসবুকের ক্যালিফোর্নিয়ার হেডকোয়ার্টারে এত সহজে আলোর গতিতে পৌঁছতে গেলে সমুদ্রের তলায় বিছোনো অপ্টিক্যাল ফাইবার-ই ভরসা যে!

এতক্ষণ হেঁটে মনে হয় না আর টিন্ড্যালের আলো বেঁকে যাওয়ার পরীক্ষার গুরুত্ব বোঝাতে হবে পাঠককে। কারণ পাঠক এতক্ষণে নিজেই তা বুঝে নিয়েছেন। আমরা বরং ফিরে দেখব অন্য একজনকে। হেনরিক ল্যাম। রাষ্ট্রব্যবস্থা অসহযোগিতা না করলে এই মানুষটি কাজ চালিয়ে যেতে পারতেন এবং হয়তো আরো আগেই আমরা তথ্য পাঠানোর পথে এগিয়ে যেতাম আরও। ঠিক যেভাবে গ্যালিলিওকে গৃহবন্দী করা হয়েছিল, ডারউইনের তত্ত্ব স্বীকার করতে চায়নি চার্চ, ঠিক যেভাবে নাৎসি জার্মানি থেকে হারিয়ে গেছেন বহু ইহুদি বিজ্ঞানী, সেই একই ধারায় বিজ্ঞানকে অস্বীকার করা হচ্ছে আজও। কিশোরী গ্রেটা থনবার্গও যখন বুঝতে পারে পরিবেশকে কীভাবে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি আমরা, রাষ্ট্রনেতারা তাকে নিয়ে মজা করেন। রাষ্ট্রশক্তি বিজ্ঞানকে আজও অস্বীকার করতে চায়, কারণ বিজ্ঞান বা বিজ্ঞানী, বিক্রি না হয়ে যাওয়া একজন মানুষ সত্য বলেন সবসময়, নতিস্বীকার না করে। ‘হীরক রাজার দেশে’-র সেই গবেষককে মনে আছে তো? প্রতিটি বিজ্ঞানীরই বোধহয় আজ আরেকবার রাষ্ট্রশক্তিকে মনে করিয়ে দেবার সময় এসেছে – “আমি একা, আমি একক, আমি একমেবাদ্বিতীয়ম গবেষক!”

0 comments:

1

প্রবন্ধ - শিবাংশু দে

Posted in


বাবার অটোগ্র্যাফ খাতায় আচার্য সুনীতিকুমার লিখে দিয়েছিলেন তুলসীদাসের একটা দোঁহা|

‘‘যদ্যপি জগ দারুণ‚ দুখ নানা‚
সব তেঁ কঠিন জাতি অপমানা।।’’

প্রায় চুয়াত্তর বছর আগের কথা| লাটসাহেবের বাড়িতে তখনও ইউনিয়ন জ্যাক উড়তো| তাঁরা ভেবেছিলেন একদিন আমরা 'জাতি-অপমানা' জয় করবো| ব্যস‚ ইউনিয়ন জ্যাকটা নামিয়ে দেওয়ার অপেক্ষা| জ্ঞান হবার সময় থেকে লেখাটি দেখেছি| জাতি-অপমানা যে কী ব্যাপার সেটা জানতে খুঁজেছি পুথিপত্র। হাত ধরেছি কবি’র| মানুষটির মননে জাতি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক মাত্রার তোলপাড়। একটা ভিন্ন মাত্রা| তাঁর সিদ্ধির সব কিছুতে দেশি মানুষের উপরে জেগে থাকে আন্তর্জাতিক মানব| গান্ধিজির মতো মানুষও বুঝে উঠতে পারেননি কবির স্বভাবের এই দিকটি| 'Religion of Man' লিখে এদেশে ওদেশে সব মূঢ় জাতীয়তাবাদীর নিন্দার ভাগী হয়েছিলেন| 'জাতীয়তা'র শিকল ভেঙে ফেলেছিলেন তিনি। তবু 'জাতি অপমানা'র বেদনা তাঁকে আজীবন তাড়িয়ে বেড়িয়েছে| জালিয়াঁওয়ালাবাগ ও তাঁর প্রতিক্রিয়া তো সবাই জানে|

অপ্রবাসী, অঋণী দ্বীপবাসীরা কবে থেকে যেন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেলো। কবে থেকেই অলক্ষ্মীকে ভয় না পাওয়া প্রবাসীর লক্ষ্মীলাভ দস্তুর হয়ে দাঁড়ালো। সেটাই পুণ্য। 'স্বদেশ' মানে যদি নস্টালজিয়া, 'বিদেশ' কি একটা মূঢ় প্রত্যয়? প্রবাসী মেঘের জলে সোনার ধান। তবু কেন 'প্রবাসী' মানে অমর্যাদার কালো টিপ? 'প্রবাসী' হওয়া 'অপরাধ' নয়| এদেশে, ওদেশে, কোনও দেশেই। তার মর্যাদার কোনও লাইসেন্স লাগেনা চিরন্তন দেশে ও কালে। নিষ্প্রয়োজন| কোনটা যে 'দেশ', সেটাই তো সবসময় বুঝে ওঠা যায়না| চামড়ার রং নিয়ে পক্ষপাত তো এদেশেও রয়েছে পুরো মাত্রায়| রয়েছে জন্মগত জাতি নিয়ে কটাক্ষ| সে তো ব্যক্তি আমি পারিবারিক ভাবে দেখতে গেলে নিজের দেশেই 'প্রবাসী' চার পুরুষ| আমার যে বিপুল পরিমাণ আত্মীয়-বন্ধু ছড়িয়ে আছেন য়ুরোপ বা আমেরিকায়‚ তাঁদের সঙ্গে যখনই সাক্ষাৎ হয়‚ জানতে চাই 'জাতি অপমানা' কেমন লাগে? নবীন প্রজন্মের মানুষেরা হয়তো ততটা স্পর্শকাতর ন'ন| কিন্তু চল্লিশ পেরোনো আত্মীয়রা নিজেদের অস্বস্তি ঢাকেন না| একই স্তরের‚ হয়তো উচ্চ স্তরেরও যোগ্যতা‚ কুশলতা নিয়েও শুনেছি শাদা চামড়াদের থেকে অনেক অধস্তন থাকার বেদনা সইতে হয়| আমার এক ভাই‚ সে এম আই টি ও হার্ভার্ডে উচ্চ শিক্ষিত| দীর্ঘদিন বস্টনে থাকে| সেদিন বললো কোথাও লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল| হঠাৎ দু-চারজন শাদা চামড়া, যাদের লোকে রেডনেক বলে তাচ্ছিল্য করে, স্রেফ ধাক্কা দিয়ে তাকে লাইন থেকে বার করে নিজেরা দাঁড়িয়ে পড়লো সেখানে| বললো‚ পিছনে গিয়ে দাঁড়াও| আমি বলি‚ কী করলি তখন? সে বললো‚ কী আর করবো? পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম| বলি‚ কেউ কিছু বললো না? না দাদা‚ কেউ কিছু বলেনা| আজ আবার এক বন্ধুর সঙ্গে শাদা চামড়া একজন মানুষের অকারণ রূঢ় ব্যবহারের খবর পেলুম। তিনি দীর্ঘদিন মার্কিন দেশে আছেন। স্বাভাবিকভাবেই সেই দেশ তাঁকে দিয়েওছে বহুকিছু। কিন্তু মনেও করিয়ে দেয় তিনি তাঁদের লোক ন'ন। আমার এক ভায়রাভাই আরো লক্ষ মানুষের মতো 'মূলধন' জমিয়ে ফিরে আসতে চেয়েছিল| কারণ তখনও তার গায়ের চামড়াটা একটু মিহি থেকে গিয়েছিল| কিন্তু এখন সে আরো লক্ষ মানুষের মতো সব পেয়েছির দেশের অংশ হয়ে গিয়েছে| এগুলো হয়তো নিতান্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা| অন্যরকম উদাহরণও হয়তো রয়েছে ভূরি ভূরি| উপার্জনের মাত্রা‚ যাপনের স্থিরতা‚ সাহেবি অনুশাসনের স্বাচ্ছন্দ্য‚ এককালের 'সচেতন' ভারতীয়দের জাতি-অপমানা ভুলিয়ে দেয়| নিজস্ব সান্ত্বনার স্পেস তৈরি করে নেয়। সেদেশে একটা সরকার পাল্টায়| কিছুদিন উদ্বেগে থাকে| আবার মানিয়ে নেয়| ভারতীয়দের মতো 'মানিয়ে' নেবার ক্ষমতা শুধু চিনদেশের মানুষদেরই থাকে| বিহারিরা মরে বম্বেতে, ঝাড়খণ্ডিরা মরে কর্ণাটকে, ছত্তিসগড়িরা মরে গুজরাতে। খেটে খাওয়া মানুষগুলো মরে যায় অবিচারে, অকৃতজ্ঞতায়। শুধু জেগে থাকে জাতি অপমানা। বাড়তে বাড়তে আকাশ ছোঁয়। পুরোনো সভ্যতার পুণ্য|

মানুষের রক্তে জাতিহিংসা রয়েছে| কেউ তাকে লালনপালন করে আনন্দ পায়| কেউ লুকিয়ে রাখে| কিন্তু বিষ থেকেই যায়| কী এদেশে‚ কী ওদেশে| আমাদের দেশেও তো রেডনেকের দল ক্রমশ বেড়ে উঠছে। দিন দুনি, রাত চৌগুণি। অবশ্যই আশা করিনি যে অচ্ছেদিন আসছে। 'বাঙালি জাগো' বলে যেকোনও সময় কল্কি অবতার ধুপ করে স্টেজে এসে নামবেন। তবে এই ক’দিনের মধ্যে অবস্থাটা যে এতটা খারাপ হবে, তাও ভাবিনি। লিস্ট মিলিয়ে লিখতে গেলে ফুরোবে না। উত্তরভারতের যে রুক্ষপ্রকৃতির 'হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান' জাতীয় মডেল আমরা বাল্যকাল থেকে দেখেছি নিজ বাসভূমে, তার বিষ যে এত দ্রুত সুবেহ বাংলাকেও গ্রাস করে নেবে, ভাবতে পারিনি। অথচ ঘটনাটি সেরকমই। গেল গেল রব তুলে অনশন ধর্নায় বসার উপক্রমকে অবশ্যই সমর্থন করিনা। কিন্তু বিষয়টি ভাবাচ্ছে। সতর্ক হওয়া জরুরি। বাঙালিরা এ জাতীয় অধমর্ণ অস্তিত্বের সংকট থেকে উদ্ধার হতে না পারলে ভবিষ্যৎ কেমন হবে তা নিয়ে বিশেষ সংশয়ের অবকাশ থাকেনা।

সারা বিশ্বে প্রতিটি মানুষগোষ্ঠীর দুরকম পরিচয় থাকে। একটি তার ঐতিহাসিক পরিচয়। কালখণ্ডের উদ্বর্তনের পথ ধরে, নথিবদ্ধ ধারাপাঠের পরিপ্রেক্ষিতে নিজস্ব অবস্থানকে চিনে নেওয়া। আর অন্যটি তার পরিচিত প্রতিবিম্বভিত্তিক কল্পনা। কোনটাই সর্বৈব সত্য বা মিথ্যা নয়। দুই ধরণের পরিচয়ের ভিতরই কিছু সারবস্তু থাকে। ঐতিহাসিক বস্তুস্থিতি ছাড়াও প্রতিটি জাতির একেকটা স্বীকৃত প্রতিবিম্ব থাকে। বাঙালিরও আছে। এই প্রতিবিম্ব সৃষ্টির পিছনে নানা ধারণা ও অভিজ্ঞতা কাজ করে। যে ভৌগোলিক অবস্থানে আজকের বাঙালিদের বাস, মহাভারতের যুগে তাদের অন্ত্যেবাসী মনে করা হতো। সেকালের অঙ্গদেশ, অর্থাৎ আজকের ভাগলপুর, তার পূর্বের অংশকে হস্তিনাপুরের মানুষ অসভ্য ও অনার্যদেশ মনে করতো। সেখানে আর্যদের নামে মাত্র বসবাস ছিলো। সে জন্যই পরম চতুর দুর্যোধন দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভায় কর্ণকে অঙ্গদেশের রাজা হিসেবে ঘোষণা করলেন। বাংলায় যাকে বলে, উড়ো খই গোবিন্দায় নমো। কর্ণ কখনও ভুলেও তাঁর 'রাজ্য' দেখতে আসেননি। বাঙালির এই অবহেলিত অবস্থানটি তার ঐতিহাসিক 'ভাবমূর্তি'র অঙ্গ। বিকৃত, প্রতিবিম্বিত লোকশ্রুতির ফসল।। উত্তরাপথের আর্যজাতি 'বাঙালি'দের সম্বন্ধে পুরাণ যুগ থেকেই হীন ধারণা পোষণ করে এসেছে।

বলীরাজার পুত্রদের নিয়ে অঙ্গ, বঙ্গ বা কলিঙ্গের যে লোককথা, তা কিন্তু আর্যেতর মানুষদেরই উপাখ্যান। এই এলাকায় যে রাজ্যগুলো ছিলো, যেমন বঙ্গ, সুহ্ম থেকে প্রাগজ্যোতিষপুর, সেখানকার মানুষদের সম্বন্ধে আর্যাবর্তের দর্পিত অধিবাসীরা বেশ নিচু ধারণাই পোষণ করতো। তার রেশ আজও আছে। কারণ আর্য সভ্যতার সীমানা ছিলো মগধরাজ্যের সমৃদ্ধতম রাজপাট। যার সামনে কোসল থেকে গান্ধার, সবাই নিষ্প্রভ।

বাঙালির আদিতম জাতিগত অস্তিত্ত্ব গড়ে ওঠে তার সমুদ্রবাণিজ্যের সঙ্গে যোগাযোগকে কেন্দ্র করে। কাশ্মীরের রাজকবি কল্হনের লেখায় একটা উল্লেখ পাই, সমতটের মানুষদের। যাদের সম্বন্ধে বলা হয়েছে তারা সম্পূর্ণ অন্য ধরনের মানুষ এবং দেবভাষা সংস্কৃত জানেনা। তার বদলে তারা পাখির ভাষায় কথা বলে। এ সময়ে ন্যায় ও তর্কশাস্ত্রের প্রতি বাঙালির আগ্রহ বেশ প্রচারিত ছিলো। যাঁরা প্রমথনাথ বিশীর 'নিকৃষ্ট গল্প' পাঠ করেছেন (জানিনা কজন এমন আছেন এখানে), তাঁদের মনে পড়বে কাশ্মীরের বা অবন্তীপুরের পটভূমিকায় 'ধনেপাতা' নামক সেই বিখ্যাত গল্পটি। মুঘল যুগে জাহাঙ্গির বাদশা বলেছিলেন, 'হুনরে চিন, হুজ্জতে বঙ্গাল'। অর্থাৎ চিন দেশের মানুষের স্কিল অনন্য আর বাঙালি অতুলনীয় হুজ্জত বাধাবার কলায়। সবাই স্বীকার করবেন জাহাঙ্গির যতই আনারকলি-নূরজাহান করুন না কেন, ক্রান্তদর্শী পুরুষ ছিলেন। একদিকে ন্যায় ও স্মৃতিশাস্ত্রের যুগান্তকারী চর্চা, আবার তার সঙ্গেই নিমাই পণ্ডিতের ভাসিয়ে দেওয়া প্রেমধর্ম। দিগ্বিজয়ী সমুদ্রযাত্রী বীরের দল, মঙ্গলকাব্যের লোকায়ত দুর্ধর্ষ যোদ্ধারা, অপরপক্ষে ভীত সন্ত্রস্ত তৈলচিক্কন বাবু কালচারের প্রতিনিধিরা। আবার কী শরণ নিতে হবে সেই, 'মেলাবেন, তিনি মেলাবেন' মন্ত্রের।

পশ্চিমে পরাক্রান্ত মগধ, দক্ষিণে সমান পরাক্রান্ত ওড্র, উৎকল ও কলিঙ্গদেশ উত্তরে অরণ্যবিকীর্ণ অঙ্গদেশ ও পূর্বে পর্বতারণ্যানীর সমারোহে অগম্য উপজাতি সভ্যতা, এই নিয়ে বাঙালির যে সভ্যতা গড়ে ওঠে তার মধ্যে আর্য, দ্রাবিড়, মোঙ্গল ও অস্ট্রিক, সবারই কিছু কিছু রক্তবীজ এসে পড়ে। বাঙালি সে অর্থে ভারতবর্ষের প্রথম প্রকৃত pot boiled জাতি।

আমাদের এইসব স্ববিরোধী ঐতিহাসিক অবস্থান থেকেই দেশবিদেশে মানুষের মনে বাঙালির ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে। এই গৌরচন্দ্রিকা একটু আন্দাজ পাওয়া যেতে পারে। 'বাঙালি'রা কীভাবে তাদের সন্তানসন্ততিদের আত্মপরিচয় সম্বন্ধে ওয়কিফহাল করবে। বাঙালিরা তাদের কোন পরিচয়ের সঙ্গে নিজেদের চিহ্নিত করে অথবা কেন করে, সেটাই বৃহৎ প্রশ্ন। যেমন বলা হয়, 'as much Bengali as rasogolla'। শ্লেষার্থে গড়ে ওঠা এ জাতীয় ধারণাবলী থেকে নিজেদের বার করে আনতে প্রচুর উদ্যম প্রয়োজন। অভিজ্ঞতা বলে, বাঙালিদের সে উদ্যম আছে বলে মনে হয়না। তাদের ভাবনার বাইনারি জগতে লাল-সবুজ দাদাদিদি, ইস্ট-মোহন, বাঙাল-ঘটি, চিংড়ি-ইলিশের দ্বন্দ্ব ইত্যাদি যে গুরুত্ব দিয়ে বিচার করা হয়, সেই শ্রমের ভগ্নাংশও আত্মপরিচয় গড়ে তোলার কাজে ব্যয় করা হয়না। ১৯৪৭এর দেশভাগের পর বাঙালির জাতি পরিচয় এই মুহূর্তে আবার তুমুল চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বাঙালিকে গোবলয়ের অংশ করে তুলতে সর্বশক্তি দিয়ে মাঠে নেমেছে বণিক আর মাফিয়ার দল। পরিকল্পনা মাফিক আক্রমণের মাধ্যমে তারা কাজটা অনেকটা এগিয়েও নিয়েছে। 'হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তান' নামক উত্তর ভারতীয় জাতিসত্ত্বার বিকৃত, গলিত শবদেহটি বাঙালির স্কন্ধলগ্ন করে দেবার জন্য কোমর বেঁধে নেমে গেছে শাসক গোষ্ঠী। মনে হয় অচিরকালেই আমাদের উত্তরসূরিরা গোপনে নিজেদের মধ্যে 'হামরাও বঙ্গালি হচ্ছি' বলে পরিচয় বিনিময় করবে। বাহাত্তর বছর আগে করে যাওয়া সুনীতিকুমারের আশংকা, বাস্তব হবার পথে অনেকটা অগ্রসর হয়ে গেছে।

জর্জ ফ্লয়েড অথবা জেকব ব্লেক নামক অনন্ত পাশার চৌরসে পাওয়া যাচ্ছে রহু চণ্ডালের হাড়। জর্জের দেশটা না হয় ইতিহাসহীন। শুধু বর্তমানের জোরে চলে। চলে যায়। সত্য-মিথ্যার বিচার আলাদা আমাদের থেকে। পরিপ্রেক্ষিতগুলি একেবারে আলাদা। কিন্তু প্রথম তারা নিজের জমিতে অনুভব করছে রক্ত, কান্না, আগুনের প্রলয়ংকর বিপর্যয়। আইনের সমাজ ছত্রখান হয়ে যাচ্ছে বেআইনি লুটপাট, অরাজকতায়। সর্বশক্তিমান রাজাকে ভূমিগত বাংকারের ব্যবস্থা দেখে আসতে হচ্ছে। যেমন অন্য একজনকে শেষ পর্যন্ত দেখা গিয়েছিলো বার্লিনের পাতালে। খুব বেশিদিন আগের কথা তো নয়। মানুষকে অস্বীকার করে, মানবিকতা থেকে ইস্তফা দিয়ে কোনও দিন কেউ টিকে থাকে না। কিন্তু এদেশে তো আড়াই-তিন হাজার বছরের নথিবদ্ধ ইতিহাস। ইতিহাসের শিক্ষা পৃথিবীতে আমাদের মতো আর কারো কাছে নেই। বার বার মুখ থুবড়ে পড়া। বার বার লাফিয়ে উঠে হাঁটতে থাকা। ঐ খেটে খাওয়া মানুষগুলির মতো। তাদের এই জীবনী শক্তি কোথা থেকে আস! তাদের সঙ্গে হিমালয়প্রমাণ অবিচার। কীটপতঙ্গের মতো মৃত্যু। তবু তারা কোথাও আগুন জ্বালিয়ে দেয়নি। অন্যের সম্পত্তি লুটপাট করেনি। মৃত্যু তাদের ধ্বংস করতে পারে না। তারা জানে শরীরের মৃত্যু হবেই। জন ল্যাংয়ের 'ওয়ান্ডারিংস ইন ইন্ডিয়া' বইয়ে সেই আফঘানিস্তান যুদ্ধ জিতে ফিরে আসা ছ-ফুট দু ইঞ্চি লম্বা অওধের দুর্ধর্ষ সিপাহি মৌন সিংয়ের গল্প দেখেছি আমরা। তার যখন মনে হলো, মারা যাবে, তখন পিছু ফিরে দেখা নয়। তার সেনাপতি লেফটেন্যান্ট সাহেব জন ল্যাংকে বলছেন, 'They always fancy they are going to die, if there is anything the matter with them.' মরতে রাজি, কিন্তু জাতি-অপমানা সইতে পারবে না। বাঙালির কি মনে থাকে তাদের জাতি পরিচয় কী? তার সম্মান আর অপমানের বোধ? গরিমা আর গৌরব? অস্তিত্ব রক্ষার ন্যূনতম সম্বল কিছু আদর্শ, কিছু প্রস্তুতি?

বাঙালিরা কি বুঝতে পারছে না, তাদের উত্তরসূরিরা মরে যাবে, পুড়ে যাবে, কাল সমুদ্রের তীর ধরে ধরে গাঁথা থাকবে তাদের সমাধি পাথর।

কখনও মনে হয় তুলসীদাস বা সুনীতিকুমার কোনও এক অলীক দেশের মানুষ, যাঁদের জন্য শুধু রাখা থাকে আমাদের ব্যর্থ নমস্কার|

1 comments:

0

প্রবন্ধ - সোমব্রত সরকার

Posted in





















দুই 

প্রথম কৈবর্ত শব্দটির প্রয়োগ দেখি আমরা তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে। কৈবর্ত শব্দটির প্রাচীনতম রূপ হল কেবর্ত। এর ধাতুগত অর্থ হল, কে(জেলে) বর্ততে ইতি কেবর্ত। মৎস্যজীবী সম্প্রদায়কে আবার ধীবরও বলা হয়। ধীবর সংস্কৃত শব্দ। বাংলায় জেলে বা জালিয়া। পুরাণ সহ বিভিন্ন প্রাচীন গ্রন্থগুলোতে ধীবর শব্দের অর্থ মৎস্যঘাতী। রাঢ় অঞ্চলে মৎস্যজীবীরা সব ধীবর বলেই পরিচিত। বৈদিক যুগে আবার জলকে অবলম্বন করে যাদের জীবিকা তাদের বলা হত কেবট্। এই কেবটরা নয়টি গোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিল তখন। সকলেই মাছের ব্যবসা করত। এরা সব ধৈবর, দাস, বৈন্দ, শৌসকলা, কৈবর্ত ও পর্ণক জাতি ক্ষত্রিয়দের সমকক্ষ ছিল। বিষ্ণুপুরাণে কৈবর্তদের অব্রাহ্মণ বলা হয়েছে। মনুস্মৃতিতে নিষাদ পিতার ঔরসে অয়োগব মাতার গর্ভজাত সন্তানের নামকরণ করেছে মার্গব বা দাস হিসেবে। আবার কৈবর্তও বলা হয়েছে। জীবিকা বলা হয়েছে নৌকা চালনা। বিষ্ণুপুরাণে বলা হয়েছে, এই কৈবর্তরা আর্যপূর্ব কৌম্ বা গোষ্ঠী। মনুও এই মত পোষণ করেছেন। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে ধীবর ও কৈবর্তদের দেখানো রয়েছে অসংশূদ্র হিসেবে। এরা সকলেই মৎস্যজীবী। আবার বৃহদ্ধর্মপুরাণে ধীবররা মধ্যম সংকর পর্যায়ের বলে গোষ্ঠীভুক্ত রয়েছে। তবে এটা ধর নেওয়া যেতে পারে, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের ভেতর ধীবর-কৈবর্তদের উদ্ভব নিয়ে যে ব্যাখ্যা রয়েছে, সেই ব্যাখ্যাকে মান্য করেই কৈবর্ত ও মাহিষ্যদের আসন এক এবং অভিন্ন হয়ে ওঠে। পূর্ববঙ্গের হালিক দাস এবং পরাশর দাশ, হুগলি-বাঁকুড়া-মেদিনীপুরের চাষি-কৈবর্তরা এখন নিজেদের মাহিষ্য বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন। আবার ত্রিপুরা, শ্রীহট্ট, ময়মনসিংহ, ঢাকার মৎস্যজীবীরা কৈবর্ত হিসেবে পরিচিত। এই সব উদাহরণ থেকে এটা স্পষ্ট, কালক্রমে কৈবর্তদের মধ্যে দু’টি বিভাজন হয়। মৎস্যজীবীরা কৈবর্ত আর কৃষিজীবীরা মাহিষ্য। বৌদ্ধ জাতকের গল্পেও কৈবর্তরা হল মৎস্যজীবী। মহাভারতের অনুশাসন পর্বে রয়েছে, তাম্রলিপ্তের রাজা ময়ূরধ্বজ ও শিরধ্বজ ছিলেন কৈবর্ত রাজা। এবং এঁরা জালিক কৈবর্ত। আবার রাজা শান্তনুও জালিয়া সর্দারের কন্যা সত্যবতীকে (মৎস্যগন্ধা) বিবাহ করেছিলেন। হরিবংশে দেখি শ্রীকৃষ্ণের আত্মীয়া শ্রুতদেবীর সঙ্গে কৈবর্ত রাজার বিবাহ হয়। 

কৈবর্তদের প্রথম ঐতিহাসিক উল্লেখ পাওয়া যায় পাল রাজাদের সময়। দিব্য, রুদোক ও ভীম — এই তিন কৈবর্ত রাজা বরেন্দ্রভূমিতে রাজত্ব করার ফলে রাজ্যে ও সমাজে যে কৈবর্ত জাতির প্রতিপত্তি বাড়ে সে কথা বল্লালচরিতে রয়েছে। একাদশ-দ্বাদশ শতকে কৈবর্তরা বাংলাদেশে কেবট্ট নামে পরিচিত ছিল। তাঁরা সে সময় কেউ কেউ পণ্ডিতও ছিলেন। তার প্রমাণ হিসেবে ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’ কাব্যগ্রন্থে কেবট্ট কবির পদ রয়েছে। পপীপ রচিত গঙ্গাসাগরের পদটি মধুর এবং যথেষ্ট সুন্দরও বটে। বল্লালচরিতে বলা রয়েছে, বল্লাল সেন কৈবর্তদের শ্রেণি বিভাজন করে তাদের মালাকার, কুম্ভকার ও কর্মকারে উন্নীত করে গেছেন। আর কৈবর্তদের মধ্যে সেই বৃত্তি পরিবর্তনকারী হালিক সম্প্রদায়ই মাহিষ্যতে উত্তীর্ণ হয়েছে সে সময়ই। বাংলার পদাতিক সৈন্যদের পাইক বলা হত। এই পাইক বাহিনীতেও কৈবর্তরা ছিল। মহাভারতের শান্তিপর্বেও দেখি সৈন্যদলে প্রান্তবাসী ভীল, বাগদী, কৈবর্তদের অংশগ্রহণ। 

বর্তমানে কলকাতার জেলিয়া কৈবর্তদের পূর্বেকার বাসভূমি ছিল হুগলি জেলার আরামবাগ মহকুমার খানাকুল-কৃষ্ণনগর, খানাকুল বন্দর, মেদিনীপুরের ঘাটাল মহকুমার মেদিনীপুর শহর এবং বাঁকুড়া। ১৯৩৭ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য দেবপ্রসাদ সর্বাধিকারী ‘খানাকুল-কৃষ্ণনগর’ সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে। তিনি বলেছিলেন: 

একসময় বর্তমান খানাকুলের কৃষ্ণনগর গ্রাম নদীগর্ভে ছিল। উক্ত নদী রামগড় থেকে উৎপন্ন হয়ে রূপনারায়ণে মিশেছিল। এই নদীর তীরে ঘণ্টেশ্বর শিব। নদীটি কোনও কোনও স্থানে রত্নাকর আর শাখারঙা নামে পরিচিত ছিল। বর্তমানে নদীটি মজে গিয়ে কানা নামে টিঁকে আছে। 

0 comments:

0

প্রবন্ধ - রিমি মুৎসুদ্দি

Posted in


-না, আমি একটু ঘুরে আসি। আশেপাশের হোটেলগুলোও একটু দেখে আসি।

সাংবাদিক যুবকটি হোটেল থেকে বেরোতে উদ্যত হলে হোটেলের ম্যানেজার বলে ওঠেন -আরে স্যার, অন্যকোথাও যাবেন কেন? এই হোটেলের থেকে কম রেটে আপনি পুরো বস্তারে কোথাও পাবেন না। লছমী, পানি পিলাও স্যারকো।

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আদিবাসী মেয়েটা ম্যানেজারের ঘরের এককোণে রাখা মাটির কুঁজো থেকে গড়িয়ে একগ্লাস জল সাংবাদিকটির সামনে এগিয়ে দেয়।

হোটেলের বিল অফিস মিটিয়ে দিলেও ঘরের নোনাধরা দেওয়াল আর বাথরুমে জিরো পাওয়ারের থেকেও কম আলোর হলুদ বাল্বটা চোখের সামনে ভেসে ওঠায় সাংবাদিক ছেলেটি এই হোটেলে থাকতে চাইছে না। জলটুকু খেয়েই সে বেরিয়ে যেতে গেলে ম্যানেজার আবার বলে ওঠে -স্যার, এই রুমের সাথে আপনি ওই লছমীকে ফ্রি পাবেন। আপনি যখন বলবেন, যতক্ষণ বলবেন আপনাকে সার্ভিস দিয়ে যাবে।

কথাটা শুনে চমকে উঠলেও সাংবাদিক অভিজ্ঞতায় এইরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি সে আগেও হয়েছে। লছমী নামে আদিবাসী যুবতীটির কালো চোখে কী ভীষণ কাঠিন্য, নির্লিপ্তি! তবু এখনও যেন বনভূমির সরলতা লেগে রয়েছে ওই মুখে। বস্তারের জঙ্গলে বসবাসকারী বেশিরভাগ আদিবাসী যুবতী, কিশোরীর গল্পটা খানিকটা একইরকম। সালওয়া জুড়ুম বন্ধ হলেও যখন তখন হয় পুলিশ, নয় মাওবাদীদের অত্যাচারে ওদের অনেকেরই ঘরবাড়ি পুড়ে গেছে। অনেকের পরিবারের পুরুষ সদস্য মারা গেছে। টাটা কোম্পানি বক্সাইটের জন্য যে যে অংশগুলো লিজ নিয়েছে, জঙ্গলের সেই অংশগুলোয় ওরা ঢুকতে পারে না। তাই ওদের গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য যে বনভূমির ওপর এতদিন ধরে ওরা নির্ভর করত, তা এখন রাষ্ট্র ও বহুজাতিকের মালিকানা হওয়াতে ওরা ঘরছাড়া, ভূমিহীন, অরণ্যহীন।

Feminisation of Poverty- সারা পৃথিবীতে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দারিদ্রের ভার (Burden of Poverty) নারীদের ওপরই বর্তায়। UNIFEM-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী, ‘the burden of poverty is borne by women, especially in developing countries.’ এর কারণ হিসাবে জেণ্ডার বায়াসকেই দায়ী করেছে WHO থেকে UNESCO। ইউনাইটেড নেশন ডেভলপমেন্ট প্রোগ্রাম (UNDP)-এর জেণ্ডার রিলেটেড হিউম্যান ডেভলপমেন্ট ইন্ডেক্স ও হিউম্যান ডেভলপমেন্ট ইন্ডেক্স- এই দুই উন্নয়ন সূচক অনুসারে সারা বিশ্বে, বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের লাইফ এক্সপেক্ট্যান্সি ও মরটালিটি রেট অনেক কম।

মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষক, অধ্যাপক ডায়না পিয়ার্স সারা বিশ্বের ৩৭টি উন্নয়নশীল দেশের ওপর গবেষণা করে দেখেছেন, দারিদ্র্যের দায়ভার ও বোঝা বেশিরভাগ দেশে ও সামাজিক পরিকাঠামোতে মহিলারাই ভোগ করেন।

অপুষ্টি ও স্বাস্থ্য-পরিষেবার অভাব, নূন্যতম জীবনধারণের অধিকার থেকে বঞ্চিতের পরিসংখ্যানে আমাদের দেশে মহিলাদের সংখ্যা অনেক বেশী- অর্থনীতিবিদ উমা কাপিলা তাঁর বই India’s Economic Development Since 1947-এ পরিসংখ্যান দিয়ে বুঝিয়েছেন। উমা কাপিলার গবেষণা অনুযায়ী ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে মহিলাদের সমস্যা সেই অঞ্চলের ভৌগোলিক ও আর্থসামাজিক কারণগুলোর উপর নির্ভরশীল। এবং অবশ্যই জেন্ডার বায়াসের যে মানসিকতা শুধু ভারত নয়, সারা পৃথিবীর মানুষের হাড়ে মজ্জায় ঢুকে রয়েছে, সেগুলোও অন্যতম কারণ।

ভারতবর্ষের আরো একটা গ্রামের চিত্র দিই। রাজস্থানের প্রত্যন্ত কয়েকটা গ্রাম। যেখানে নিম্নবর্ণ উচ্চবর্ণের ভেদাভেদ একেবারে দিনের আলোর মতোই দৃশ্যমান। মেয়েরা জলের খোঁজে দূরদূরান্তে যায়। তবু কাছাকাছি, উচ্চবর্ণের জলাশয়ের ধারেকাছেও যেতে পারে না। বেশিরভাগ দিনই শূন্য কলসি হাতে ফিরে আসে। দূরের একটামাত্র কুয়োতে অর্ধেক সময় জল থাকে না। আবার বাড়িতে জলের অভাব হলে বাড়ির পুরুষদের কাছেও মারধোর খায়। এটা সম্প্রতি ন্যাশনাল উইমেন কমিশনের রিপোর্টে উল্লেখিত ঘটনা।

হরিয়ানা, পাঞ্জাবের বেশ কয়েকটা অঞ্চলে কন্যা ভ্রুণ হত্যা এমন পর্যায় উঠেছে যে ছেলেরা বিয়ে করা বা বংশরক্ষার জন্য মেয়ে পাচ্ছে না। তাই বাংলা, বিহার, ওড়িশা থেকে খুব গরীব ঘরের মেয়েরা এইসব অঞ্চলে পাচার হয়ে যায়। রীতিমতো পয়সা দিয়ে কিনে বিয়ে করে নেয় পাত্রটি। এরপর বয়স্ক থেকে কনিষ্ঠ পরিবারের সব পুরুষ সদস্যদেরই সেবাদাসী ও যৌনদাসীতে রূপান্তরিত হয় সেই মেয়েটি। আদিবাসী মেয়েদের অবস্থা আরো করুণ।

যাই হোক, দারিদ্র্যের সংজ্ঞা বা তথ্যের কপচানি না দিয়ে সাধারণ জীবনের আশেপাশে তাকালেই বোঝা যায়, মেয়েরা কীভাবে পরিবারের অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানে নিজেদের সবটুকু নিংড়ে দিচ্ছেন। গৃহস্থ বাড়িতে কাজ করতে আসা অথবা কারখানায় দৈনন্দিন আয়ের ভিত্তিতে কাজ করা মহিলারা তাঁদের আয়ের সবটুকু পরিবারের জন্য তুলে দেন। নিজেদের শরীর, স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা ও কিছুটা পরিবার ও সমাজের উদাসীনতায় সেইসব মহিলারাই সঠিক পুষ্টি ও চিকিৎসার অভাবে বিভিন্ন রোগের শিকার।

এইসব আলোচনা করতে করতে রূপকথার গল্পের শেষটা মনে আসে, প্রশ্ন জাগে। রাজপুত্র এসে কেন উদ্ধার করবে বন্দিনী রাজকন্যাকে? সোনার কাঠি রূপোর কাঠি ছোঁয়ালেও জেগে যে তাকে থাকতেই হবে। নিজের বিরুদ্ধে হওয়া অত্যাচারের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করে আরো অনেক বন্দীমুক্তি তাকেই ঘটাতে হবে। তবেই তো সে রাজকন্যা। কুঁচবরণ কন্যা তার মেঘবরণ চুল - রাজকন্যার এই প্রোটোটাইপটাও কিন্তু চাপিয়ে দেওয়া।

যেদিন জাতধর্ম, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা নির্বিশেষে সব নারীদের বেঁচে থাকার অধিকার নিয়ে, কাগজে কলমে নয়, বাস্তব কর্মসূচীতে রূপায়িত হবে উন্নয়নের পরিকল্পনা, সেদিনই বোধহয় উওম্যানহুড অথবা ‘বিশ্বমানবতা দিবস’ পালন সার্থক হবে।

0 comments:

2

বিশেষ ক্রোড়পত্র - অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত

Posted in






সূচী 

আমার অলোকরঞ্জনদা - নাসের হোসেন 

অনন্য ভাষাশিল্পী অলোকরঞ্জন - জয় গোস্বামী 

অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত-র কবিতা : ‘কোটি বছর আমার বাড়ির বয়স’ - হিন্দোল ভট্টাচার্য 

একুশে আশ্বিন - অরুণ দে 

অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত’র ভাষা - হান্‌স্‌ হার্ডার 

কোনও এক বই সম্পাদকের অলোকদা - শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় 

স্তিমিত সিংহাসন – অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত(অনুবাদ) 

নাট্যকোলাজ, অন্যধারার নাটক – সুনীল দাশ







আমার অলোকরঞ্জনদা 
নাসের হোসেন 


তাঁর সঙ্গে যখনি ফোনে কথা হয়, প্রথমেই তাঁর জিজ্ঞাস্য 
থাকে, তাঁর অতুলনীয় স্নেহার্দ্র কণ্ঠস্বরে : 
'নাসের,তুমি একটা ভালো সংবাদ শোনাও।' 
আমি তৎপর হই,চেষ্টা করি কোনো একটা ভালো 
সংবাদ শোনাবার, এবং প্রত্যেকবারই যে- কথাটা প্রথমেই 
বলে থাকি তাঁকে : 'অলোকরঞ্জনদা এখন এই যে 
ফোনে আপনার স্নেহার্দ্র কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম 
এর থেকে বড়ো সুসংবাদ এই মুহূর্তে আমার কাছে 
সমগ্র পৃথিবীতেই নেই।' তিনি তারপর সেই 
একই স্নেহার্দ্রতায় আচ্ছন্ন করে জিজ্ঞাসা করেন : 
'আচ্ছা আচ্ছা,তা তো বটেই, তা তো বটেই, 
আচ্ছা নাসের, আর- একটা সুসংবাদ দাও এবার।' 
তারপর, এবং এইভাবে, চলতে থাকে আমার সুসংবাদ 
সংগ্রহের পালা।এবং তা চলতেই থাকে। 



[নাসের হোসেন : জন্ম ১৯৫৭। আশির দশকের উল্লেখযোগ্য বাঙালি কবি। একাধিক কবিতা – গ্রন্থের লেখক।] 






কোনও এক বই সম্পাদকের অলোকদা 
শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় 


সম্প্রতি হঠাৎ একদিন চিন্তা করতে গিয়ে উপলব্ধি করলাম, বই-সম্পাদকের পেশায় আমার সাতচল্লিশ বছর কেটে গেল। পাশাপাশি কিছু মাস্টারি করেছি, খুবই সামান্য কিছু অকিঞ্চিৎকর লেখালিখি, বক্তৃতা দিয়েছি নানা বিষয়ে, ব্যস। বই-সম্পাদকের পেশায় কর্তব্য-করণীয় ঠিক কি, সে বিষয়ে বই পড়ুয়াদের বা বইউদাসীন ‘সাংস্কৃতিক ‘আড্ডাবীরদের’ ধারণা অতিক্ষীণ, নেই বললেই চলে। খুবই কম সংখ্যক কিছু লেখক যাঁরা এই অদ্ভুত পেশাটির সমঝদার, তাঁদের সঙ্গে কাজ করার দুর্লভ সুযোগ যখন পেয়েছি, তার আনন্দ স্বর্গসুখ বোধ হয়েছে – সেই স্বর্গ যা মানুষের কল্পনার পরম আস্বাদ। 

পনেরো বছর এই পেশায় কাজ শিখে কিছুটা দক্ষতা আয়ত্ত করে প্রথম যখন স্বাধীনভাবে ঘনিষ্ঠ কায়েকজন বন্ধুর সঙ্গে একত্রে একটা মনোমত প্রকাশনা সংস্থা তৈরি করার সুযোগ হল, তখনই অলোকরঞ্জনের শরণার্থী হই। তাঁর দাক্ষিণ্যে ও প্রশ্রয়ে তাঁর পাঁচটি বই প্রকাশ করার সৌভাগ্য হয়। আরও একটি বইয়ে আমার সম্পাদকীয় আগ্রহে তিনি অমূল্য সহযোগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে আমায় কৃতার্থ করেন। এই সম্পাদকীয় সাহচর্যেই তাঁর সঙ্গে আমার অসমবয়সী বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তিনি নিজে তাঁর ‘দুই বন্ধু’ নামে দীর্ঘ কবিতায় আমায় এই ‘বন্ধু’ স্বীকৃতি না দিলে এই দাবী করবার স্পর্ধা আমার হত না। 

যে বন্ধুতাকে মন্থন করে তাঁর ওই অসামান্য বন্ধুতার কবিতা, সে-বন্ধুতা কথার কারিগরিতে খাড়া করে তুলবার সাধ্য আমার নেই। বরং কবির সঙ্গে নিতান্তই একজন বই-সম্পাদকের সখ্যবৃত্তির একটা কাহিনি নথিবদ্ধ করে রাখতে চাই। অলোকদার কাছে যাতায়াতের শুরু হয়েছিল জর্মন সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে প্রশ্ন বা সংশয় নিরসনের তাড়নায়, কখনও বা জর্মন থেকে কোনোকিছু চট করে নিখাদ অনুবাদ করিয়ে নেবার তাগিদে। 

স্বাধীন প্রকাশনায় এসে থীমা থেকে সরাসরি তিনটি যে অনুবাদগ্রন্থ প্রকাশ করি, তার মধ্যে গ্যুন্টার গ্রাস- এর কবিতা ও কোলরিজ-এর রাইম অভ দি এনশেন্ট ম্যারিনার থেকে বুড়ো নাবিকের উপকথা হয়তো প্রত্যাশিতই ছিল। অপ্রত্যাশিত ছিল ভিলহেল্‌ম্‌ বুশ-এর মাক্স ও মোরিৎস এবং আরও চিত্রকথা। অলোকদাই প্রথম পরিচিত করালেন আমাদের মাক্স ও মোরিৎস নামে এই দুই খুদে ডানপিটের সঙ্গে। কৌতুকী ছড়ার পরম্পরায় সুকুমার রায় ও খাপছাড়া-র রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে লিউইস ক্যারল, এডওয়ার্ড লিয়র ও অগ্‌ডেন ন্যাল মিলিয়ে বাঙালি পাঠকের যে রসাস্বাদন তাতে অন্য এক মাত্রা এল অলোকরঞ্জনের অনুবাদে, ভিলহেল্‌ম্‌ বুশ-এর সংযোজনে। পরে সবিস্ময়ে আবিষ্কার করেছি হিটলার ও আনতোনিও গ্রামশি দুজনেই ছিলেন মাক্স ও মোরিৎস-এর ভক্ত! সাহিত্যে, চিত্রকলা ও সঙ্গীতে অলোকরঞ্জনের সমান টান লক্ষ করেই তাঁর প্রতিটি বইকেই বিশেষভাবে চিত্রমণ্ডিত করার লক্ষ্য ছিল আমাদের। গ্রাস ও বুশ-এর নিজস্ব চিত্রকলা তো সহজেই বই-এর অঙ্গ হয়ে গেল। কোলরিজ-এর অলংকরণে শিল্পী বন্ধু রবিন মণ্ডল আমার সহায় হলেন; শর্ত ছিল, মূল কবিতাটি তাঁকে পড়ে শোনাতে হবে, ব্যাখ্যাসহ! আমার পাঠ ও অলোকরঞ্জনের ভাষান্তরণ থেকে সৃষ্টি হল রবিনবাবুর চিত্রসম্পদ। 

এই বইগুলির নির্মাণকালেই অলোকদার মনে ওই যৌথ শিল্পকল্পনার হদিশ পাচ্ছিলাম। সেই সূত্রেই, অলোকদার তুলনারহিত বয়ানে তাঁর একটি লেখার সূত্রপাত – লেখার নাম ‘শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়–কে লেখা একটি চিঠি’- ‘সেই যে পড়ন্ত দুপুরে উৎফুল্ল উদাসীনতা নিয়ে আমাকে নির্দেশ দিলেন স্বরচিত কবিতার মধ্যে কোথায় কোথায় মিশ্র মাধ্যমের আদল ধরা পড়েছে সেই মর্মে একটি নিবন্ধ লিখতে হবে, তারপর থেকেই আপনার হদিশ নেই আর।’ এই খোলা চিঠিটিকে কেন্দ্রে রেখেই তৈরি হয় আরেকটি বই সমবায়ী শিল্পের গরজে, যার ভূমিকায় অলোকরঞ্জন লেখেন : ‘কবিতাকে আজ আর একচোরা হয়ে ভাবের ঘরে চুরি করা মানায় না। তাকে থেকে থেকেই চিত্রকলা, সঙ্গীত বা ফিল্মের কাছ থেকে আঁজলা ভরে রসদ নিতে হয়। অন্যদিকে, মিশ্র শিল্পের গূঢ় যন্ত্রণায়, সৃষ্টির নানামুখী প্রকাশচর্যারও কি এখন কবিতার কাছে শরণার্থী হওয়ার কথা নয়?’ এই বইটিতে মিশ্র-শিল্পের সেই সূত্রটি বই-সম্পাদকের ভূমিকায় আমি বিস্তৃত করে নিয়েছিলাম পাণ্ডুলিপি, চিত্রণের দুর্লভ অনুষঙ্গের গবেষণাজারিত চয়নে। অলোকরঞ্জনের ভাষা সেই দৃশ্যকল্পের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়ে যে অন্য ভাষা সৃষ্টি করেছিল, তারই যেন অবশ্যম্ভাবী উত্তরবয়ন তাঁর পরের বই – ২০০০-এর পর ২০০৩ – যুদ্ধের ছায়ায়, নিজেই যাকে বর্ণনা করেন ‘কোলাজ’ বলে; কবিতা, সমকালের ভয়ংকর ইতিহাস, চিত্রকলা – চলচ্চিত্রকলার অমোঘ অনুষঙ্গের অনিবার্য ক্রমান্বয়তায় সভ্যতার সংকটের এই সমতাময় উচ্চারণ বাংলা সাহিত্যে এক পরিপূর্ণ অন্য ভাষার জন্ম দিয়েছিল। লজ্জা আমাদের, পাঠকেরা লক্ষ করলেন না, তাঁর অনন্যসাধারণ সেই ভাষাবৈভব যার বিবেকী অভিঘাতও যেন অধরা থেকে গেল বাঙালি সাহিত্যপাঠকের উদাসীনতায়। দুই মহাযুদ্ধকালীন জর্মন চিত্রকরদের ছবি; পিকাসোর ‘গ্যোর্নিকা’র প্রস্তুতিতে আঁকা ছবি; কলকাতার শিল্পী তপন ভট্টাচার্যের ছবি; অলোকরঞ্জনের মৌলিক ও অনুবাদিত কবিতা; গাদামার ও ইঙে বাখমান–এর সঙ্গে তাঁর কথোপকথন; এ কালীন অন্তহীন যুদ্ধে মৃতের হিসেব, ধ্বংসের নির্মম তথ্যাবলি; ঘৃণার আঁচে দেশচ্যুত শরণার্থীদের সঙ্গে কথোপকথন হয়ে উঠেছে সমকালের এক চেতনাগভীর মহাকাব্য, যার রূপ হতে পারে কেবল ‘কোলাজ’ই। সেই কোলাজের গভীরে অন্তঃশীলতা অলোকরঞ্জনের একান্তই নিজস্ব মিশ্রকাব্য। 

বই-সম্পাদকের দুঃখ, এ বই তেমন বিক্রি হয়নি। সতেরো বছরেও শেষ হয়নি প্রথম সংস্করণ। যেমন হয়নি, আগের বইটিও। সমবায়ী শিল্পকে অলোকরঞ্জন নিতান্ত একটা শৌখিন শিল্পসাধ বিবেচনা করেননি, বরং সভ্যতার সংকটে সভ্যতার রক্ষাকবচ বলেই তাকে মেনেছিলেন। যুদ্ধের ছায়ায় বইটির সূচনায় তিনি লিখেছিলেন, ‘কীভাবে কেন ঠাণ্ডা ইতিহাসের একটা বই পড়ছি, এমন সময় শমীক এলেন। শমীকের সঙ্গে দেখা হলেই এক একটি প্রকল্পের বোধন হয়। সেদিনও ঠিক হল, যুদ্ধ নিয়ে, অর্থাৎ যুদ্ধ ব্যাপারটার বিরুদ্ধে একটি কোলাজ তৈরি করতে হবে।’ যুদ্ধের ছায়ায় আমাদের নিজ অবস্থানে মিশ্র শিল্পের ভাষাতেই কেবল আমরা পেতে পারি মুক্তদৃষ্টি জীবনের অধিকারটুকু। সেটা বুঝতে তাঁর সমভাষী কবিতাপাঠকেরা নারাজ বলেই কি কবি তাঁর বড়ই নিঃসঙ্গ স্বেছানির্বাসন বেছে নিয়েছেন? তাঁকে সুখী দেখিনি হির্শবার্গ-এ। সেখানেও তাঁকে তাড়া করে ফেরে তাঁরই নিজের কবিতার ছত্র : 

কিন্তু আমি হঠাৎ ঈশ্বরিত 
হয়ে-ওঠার দুঃসাহসে তরান্বিত একখানি ত্রিপদী 
লিখতে গিয়ে দেখেছি আজ হয়নি কোথাও 
যুদ্ধের বিরতি– 
সাদীর ছিল যোজনব্যাপী গুলবাগিচা, আমার তকদির : 
বিবদমান বন্ধুদের গুলিগালাজ, জম্মু ও কাশ্মীর। 


[শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় : জন্ম ১৯৪০। আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন নাট্য ও চলচ্চিত্র সমালোচক এবং তাঁর নিজের ভাষায় ‘বই – সম্পাদক’। অসংখ্য সম্পাদিত বইয়ের মধ্যে ‘আনতোনিও গ্রামশি নির্বাচিত রচনাসমগ্র’ তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।] 





অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত-র কবিতা : ‘কোটি বছর আমার বাড়ির বয়স’ 
হিন্দোল ভট্টাচার্য 


বাংলা কবিতা রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে বিশ্বে ভ্রমণ শুরু করেছিল। বিশ্ব সেই প্রথম প্রত্যক্ষ করেছিল, অনুবাদের মাধ্যমেই, বাংলা কবিতার ভুবন কেমন মায়াবী দার্শনিক সংলাপ হয়ে উঠতে পারে কবিতার সামগ্রিকতা বজায় রেখেই। কিন্তু সেই কাব্য কতটা আধুনিক, সে বিষয়ে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। এই সন্দেহ প্রকাশের কারণ হিসেবে আমরা যদি ভাবি অনুবাদের দেওয়াল, তাহলে, তা যেমন সত্য, তেমন এ কথাও বলতে হবে হয়ত রবীন্দ্রনাথ আধুনিকতার থেকে একটু দূরেই ছিলেন। যদিও এ অনেক তর্কের বিষয়, কারণ রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গ উঠলেই, আধুনিকতার সংজ্ঞাকে অনেকেই প্রশ্ন করতে শুরু করে দেন। অবশ্যই এ কথা স্বীকার্য যে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক ছিলেন না, ছিলেন সনাতন, ছিলেন চিরকালীন। তিনি যে আধুনিক ছিলেন না, তা আমাদের কাছে বরং স্বস্তির বিষয়। কিন্তু চার এবং পাঁচের দশকের বাংলা কবিতা আধুনিকতার সঙ্গে সখ্যতা তৈরি করল শুধু নয়, আধুনিকতাকে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে শুরুও করে দিল। তার রক্তমাংসের প্রমাণ হল জীবনানন্দের, সুধীন্দ্রনাথের, বিষ্ণু দে, সমর সেন, অরুণ মিত্র, অমিয় চক্রবর্তী এবং সর্বোপরি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা। এক আশ্চর্য বিষয় হল এই, যে, প্রায় রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশিই জীবনানন্দ লিখে গেলেন আধুনিকতার যন্ত্রণার কবিতা। বোদলেয়রের অশুভ ও অমঙ্গলবোধের দুনিয়াই না, বা কাফকা- দস্তয়ভস্কির দুনিয়াই না, তাঁর কবিতায় একসঙ্গে মিশে গেল দালির সুররিয়ালিজম, ইয়েটসের একাকীত্ব, মৃত্যুচেতনা এবং এডগার অ্যালান পো-এর যন্ত্রণাদগ্ধ সৌন্দর্যচেতনা। পো যে অন্ধকার এবং মরমীয়া চেতনার সন্ধিক্ষণের রঙ লিখে গেছেন, তা জীবনানন্দের কবিতায় হানা দিল যেমন হানা দিয়েছিল বোদলেয়ারে। এলিয়টের পো সংক্রান্ত ভাবনাগুলি এখানে স্মরণ করার মতো। একদিকে জীবনানন্দের যুগ, অন্যদিকে সুধীন্দ্রনাথের ধ্রুপদ, একদিকে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতাদর্শ, অন্যদিকে সারা বিশ্ব জুড়েই বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বেড়ে ওঠা অস্তিত্ববাদের প্রেক্ষাপটে লেখা হতে শুরু করল আমাদের পাঁচ-এর দশকের কবিতা। দেখতে পেলাম সুনীল, প্রণবেন্দুর হাত ধরে একদিকে এল ব্যক্তিগত চৈতন্য এবং বিষাদের এক বিশ্ববীক্ষা। দেখলাম বিনয়ের হাত ধরে ধ্বনিত হল আধুনিক রোমান্টিকতার এবং শাশ্বতের প্রতি অন্বেষণের এক নতুন অধ্যায়। এলেন শক্তি ও উৎপলকুমার বসু। বাংলা কবিতার মানচিত্র-ই যেন বদলে গেল। শক্তি যেমন নিয়ে এলেন প্রকৃতির সঙ্গে আধুনিক ব্যক্তি মানুষের চিরবাউলের সম্পর্ককে, তেমন-ই উৎপল বাংলা কবিতায় হাজির করলেন সমগ্র বিশ্বকেই, সমগ্র সময়প্রবাহকেই। এক নতুন চৈতন্যের সঙ্গে উৎপলের দেখা হতে লাগল। সেই সঙ্গেই তিনজন কবি, শঙ্খ, আলোক সরকার এবং অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত একমুঠো ধুলোর মধ্যে বিশ্বকে এবং বিশ্বে একমুঠো ধুলোকে প্রত্যক্ষ করতে লাগলেন। এই শেষ তিনজনের সম্পর্কে হয়ত আলাদা আলাদা করে ভাবনা বিনিময় করাই ভালো। কিন্তু এই লেখাটির ক্ষেত্রে কথা বলা যাক অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত সম্পর্কে, যাঁর কাছে ভাষাই হল দেশ ও বিশ্ব, যিনি অনবরত এই বিশ্বকে খুঁজে চলেছেন কখনও নিজের দেশের বিভিন্ন ভাষার কবিতার মধ্যে তো কখনও বিশ্বের কবিতার ভুবনের মধ্যে। অনবরত নিজেকে যে কবি ভাঙেন, তাঁকে ধারাবাহিক পড়তে হয়, তাঁর অভিযাত্রার বাঁকগুলিকে ধরতে গিয়ে। কবি অলোকরঞ্জনের কবিতার যে অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল যৌবন বাউলের ঈশ্বরের সঙ্গে মৃত্তিকার কথোপকথনের মধ্যে, সেই সংলাপ তাঁকে করে তুলেছিল বাংলার শিকড়ের সহযাত্রী। সেই প্রথম কাব্যগ্রন্থের মধ্যে দিয়ে যখন আমরা যাই প্রকাশের পাঁচ দশক পরে, তখন বুঝতে পারি, কী নিপুণ অন্তর্ঘাত ঘটে গেল বাংলা কবিতায়। অথচ কী সুন্দর সেই অন্তর্ঘাত! যৌবন বাউল কাব্যগ্রন্থটি আমার কাছে অন্তত, কবির কৃশ বেদনার সাধনা। যে সাধনার কথা তিনি তাঁর কবিতায় বলছেন- “ একটি কিশোর মাঠের কিনারে, একটি অতীত/ বুকে করে আছে, এখুনি তো পায়ে/ ঠেলে দিতে পারে, ও তবু কেন যে সেদিনের শীত/ বুকে ধরে আছে/ ও কি মনে করে অরূপরতন/ গড়বে শীতের কৃশ বেদনার সাধনার বলে? 

এখানে এই কবিতাটিতে এসে আমি থমকে যাই বারেবার। কী ভাবছেন কবি এখানে? আমি তো অন্য একটা ভাবনা ভাবছি। ভাবছি একজন কাফকা বা একজন র্যাঁিবো কি পারবেন তাঁদের কৃশ বেদনার সাধনায় রিলকে বা রবীন্দ্রনাথা বা গ্যয়টে যে অরূপরতনকে পেয়েছিলেন তাকে স্পর্শ করতে? বিষাদের এই যে শীতার্ত হিম বেদনার কুয়াশার ভিতরে আমাদের আধুনিকতা ডুবে গেল অস্তিত্ববাদে, সেখানে কি অলোকরঞ্জনের যৌবন বাউল পারল লালনের ভাবনার শীর্ষকে ছুঁতে? তা কি আদৌ সম্ভব? এখানেই কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত আলাদা হয়ে গেলেন তাঁর সমসাময়িক কবিদের চেয়ে। তাঁর কবিতা শুধু অনুভূতিমালার প্রসারণ হয়েই রইল না, মেধার সঙ্গে, ভাবনার সন্দর্ভের সঙ্গে মিশে গেল অভিজ্ঞতার বোধ। মানসিকতাতেই তিনি অন্য একরকম ঘরানার জন্ম দিলেন। তিনি আধুনিকতাকেও প্রশ্ন করলেন, যখন আধুনিকতা তার ডালপালা বিস্তার করছে সারা বিশ্বেই। এ পর্যায়ের অনেক কবিতাতেই তাঁর এই ঔপনিষদিক অন্ধকার প্রত্যক্ষ করি আমি, যেখানে তিনি গভীর বিশ্বাসে সেই আলোর সন্ধান করছেন, অপেক্ষা করছেন তার জন্য। যৌবনবাউলের দর্শনের একটি টুকরো অংশ হয়ত এখানে পড়ি আমি- 

দ্বিতীয় ভুবন রচনার অধিকার 
দিয়েছ আমার হাতে— 
এই ভেবে আমি যত খেয়া পারাপার 
করেছি গভীর রাতে, 
প্রতিবার তরী কান্নায় শুরু হয় 
কান্নায় ডোবে জলে, 
হাসিমুখে তবু কেন হে বিশ্বময় 
তোমার তরণী চলে? 
(অপূর্ণ) 

কিন্তু এই কবিতাগুলির দর্শনের সঙ্গে যে ব্যক্তিত্ব তিনি অর্জন ও প্রতিষ্ঠিত করলেন বাংলা কবিতায় তা এক স্বতন্ত্র কাব্যভাষা নিয়ে তো এলই, সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে এল এক ভিন্ন দার্শনিক যাপন। তিনি যেন দান্তের ইনফের্নোর মধ্যে দিয়ে হাঁটছেন রবীন্দ্রগান গাইতে গাইতে। তিনি জানেন ‘হে পূর্ণ তব চরণের কাছে/ যাহা কিছু ছিল আছে আছে আছে’, কিন্তু তিনি এও জানেন, তাঁকে এক অন্ধের মতো অন্ধকারের মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতে হবে। তিনি জানেন যে এ জন্মে তিনি সুগতর কেউ না। তিনি জানেন, তিনি বহুবছর ধরে হাঁটছেন এই অন্ধকারে। হাজার শুধু না, সহস্র সহস্র, লক্ষ লক্ষ বছর ধরে তাঁর এই হেঁটে আসা, তাঁর এই থাকা। আর তিনি যে বাড়িতে থাকেন, সেই বাড়িটাও বহুবছরের। যেন আবহমান অবচেতনার অংশ হয়ে তিনি কথা বলে উঠছেন, যে আবহমানতার শুরু কোথায় তিনি জানেন না। 

কবে প্রথম কার কাছে এই মাটি 
কিনেছিলাম, তার আগে এই মাটি 
কার ছিল, আর কাদের-কাদের ছিল? 
ভগবানের স্বত্বাধিকার প্রথম কবে গেল? 
কোটি বছর আমার বাড়ির বয়স। 
(আমার বাড়ির বয়স) 

কোন কবিতা কী কারণে লেখা হয়, আর সেই কবিতা কতবছর পরে কীভাবে আবিষ্কৃত হয়, তা নিয়ন্ত্রণ করতে কবি পারেন না হয়ত। কারণ কবিতা হল সেই আবহমানতার প্রতিনিধি, যার মধ্যে দিয়ে শুধু কবি নন, প্রকাশিত হয় অনেক গূঢ় ভাবনা। যে ভাবনাগুলি হয়ত সচেতন ভাবে কবি ভাবেন না। কিন্তু অবচেতনে কবি সেই ভাবনার ধারক হয়ে ওঠেন। এই কথা বলার উদ্দেশ্য হল, কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত এভাবেই আধুনিকতার সঙ্গে আবহমানতার বিবাহ সম্পন্ন করেন তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থেই। আবহমানতা, সূর্যের মতোই এমন এক অদৃশ্য ভর,যার কাছে এলে আধুনিকতাও তার দিক পরিবর্তন করে। কিছুটা তো নিজেকেও বদলায়। অস্তিত্ববাদ অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তর কবিতার কাছে এসে নিজেকেও খানিকটা পরিবর্তন করে। ঠিক সেই বিষয়টিই ঘটে অলোকরঞ্জনের শিল্পিত স্বভাবে, যখন তিনি আধুনিকতাকেও যেমন তার অন্ধকার শুদ্ধ গ্রহণ করেন, তেমন তিনি আধুনিকতাকেও ফিরিয়ে দেন আবহমানতার কিছু অংশ। যেন একজন বিষ গলাধঃকরণ করে ফিরিয়ে দিচ্ছেন সামান্য অমৃত। 

যেমন বলা যায় যৌবন বাউল কাব্যগ্রন্থের মৌলকণ্ঠ নামক কবিতাটি। 

মৌল কণ্ঠ কেঁদে উঠল পথের অন্ধকারে; 
দরজা খুলে কেঁদে উঠলাম : ‘মাগো 
তুমি আমার ঘরের বাইরে থেকে 
ডেকে উঠলে? তুমি আমায় ঘরের বাইরে নিয়ে যাবে 
তুলসীতলায়?’ 
--ঘুমন্ত মা-র মুখে দেখলাম শান্ত স্বপ্ন-প্রদীপ। 

মৌল কণ্ঠ কেঁদে উঠল পথের অন্ধকারে; 
দরজা ভেঙে কেঁদে উঠলাম : ‘অরুণিমা, অরুণিমা, 
তুমি আমার শয্যা ছেড়ে ঘরের বাইরে থেকে 
ডেকে উঠলে? তুমি আমায় ঘরের বাইরে নিয়ে যাবে 
প্রথম কুঁড়ির স্বর্গীয় সেই প্রতিশ্রুতির স্মৃতির বাগানে?’ 
অরুণিমার মুখে দেখলাম শান্ত স্বপ্ন-প্রদীপ। 
মৌল কণ্ঠ কেঁদে উঠল ঘরের অন্ধকারে।। 

‘সুন্দর ও কার্ল মার্ক্স’ প্রবন্ধে অলোকরঞ্জন লিখছেন- ‘ আজ যখন লুকাচ প্রমুখ নন্দন্তাত্বিকদের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়ার পরেও মার্ক্সীয় সমালোচনা, বিশেষত বাংলা দেশে, প্রগতির নামে একটি কূপমাণ্ডুক্যের অভিসন্ধিচর্চায় অবসিত হয়েছে, তখন একবার অন্তত মুমুক্ষু মার্ক্সের প্রাথমিক ও মানবিক অভিপ্রায়ের সেই ব্যাপ্তির কথা মনে রাখা ভালো যিনি সুন্দরের প্রয়োজনকেই ত্বরান্বিত করতে চেয়েছিলেন, প্রয়োজনের সুন্দরকে নয়’। দেখা যাচ্ছে, এই ভাবনায় উপনীত হওয়ার আগেই অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত অন্ধকারের সঙ্গে এক গভীর দার্শনিক নান্দনিক অভিযাত্রায় মেতেছেন। কারণ তিনি জানেন যে নশ্বর ব্যথা এবং যন্ত্রণার বিশ্বে আমাদের যাপন করতে হয়, তা নরকের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। কিন্তু ঈশ্বর এর মধ্যেই রয়েছে। ঈশ্বরের জন্য বা সুন্দরের জন্য, সত্যের জন্য, সে সত্য এক না বহু, তা নিয়ে সংশয় আমাদের থাকলেও, তার জন্য আমাদের যেতে হবেই, রাধা যেমন কণ্টকজর্জরিত পায়ে ছুটে গিয়েছিলেন অভিসারের নিয়তিনির্দিষ্ট পথে। এই অভিযাত্রার শেষ নেই কোনও কিন্তু অভিযাত্রার শেষে সেই সুন্দর যে রয়েছে, তার জন্য কবির মননে এবং মেধায় রয়েছে গভীর বিশ্বাস। রাত্রির মন্দির শীর্ষক কবিতাটি এক্ষেত্রে তাঁর সেই সময়কার ভাবনার প্রাণভোমরা বলতেই পারি আমরা। কারণ যে পটভূমিকা অন্ধকার বলে কবি শুরু করেন তাঁর প্রথম অভিযাত্রার শিলালিপিলিখন, সেই অন্ধকারের স্বরূপটি কী, আর তা কতটা সুন্দর, সে সম্পর্কে কবির কৌতূহল থাকাটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু এক্ষেত্রে কৌতূহল তাঁকে নিয়ে গেছে এমন এক জায়গায়, যেখান থেকে হয়ত আর ফিরে আসা যায় না। 

কার ভয় কর? স্থির খদ্যোতের সবুজ তর্জণী 
রাত্রির মন্দিরে জ্বলছে। অন্ধকার নিভছে। একদিন 
যারা ছিল, যারা নেই, তারা এই মন্দিরে সবাই; 
কেউ দেবদারু, কেউ তমাল, কারো বা রুগ্নদেহ 
নশ্বরতাশেষে দিব্য চন্দনের সুস্থতরু হয়ে 
দাঁড়িয়ে রয়েছে। সব সেরে গেছে, সকলের ব্যাধি 
আরোগ্য হয়েছে; এই রাত্রির মন্দিরে তুমি ছাড়া 
কেউ তো অসুস্থ নেই ওরে অন্ধ মরণবিলাসী, 
ঈশ্বর তোমার বুকে তুমি বুঝি তাকিয়ে দেখবে না? 

(রাত্রির মন্দির) 

এই মহৎ চিরায়ত কবিতাটির সামনে এসে সমস্ত নশ্বর অস্তিত্ববাদ যেন হোঁচট খায়। যেন অজস্ব প্রশ্নের মুখোমুখি হয়। যেন নিজের কাছেই নিজে আশ্বস্ত হয়। যেন আজীবন বয়ে নিয়ে যাওয়া নিরাশ্রয় একাকীত্ব শেষে একফোঁটা কান্নার জন্য জায়গা খুঁজে পায়। 

চিত্রকল্পের সন্ধানে নামক প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন- “ জর্জিয় কবিয়ালেরা অতিকথনে বিশ্বাস করতেন। তার ফলে তাঁদের কবিতা পরবর্তীদের কাছে অসত্যপ্রতিম বলে মনে হয়েছিল। হিউম বিরক্তিভরে বলে উঠেছিলেন রোমান্টিক কবিদের গোঙানি অসহ্য, এখন চাই অনার্দ্র কবিতা। ধ্রুপদী কবিতার সপক্ষে ইমেজবাদী কবিরা বাক্যময় কবিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেন, কবিতায় প্রত্যাশিত হল বাঙ্ময় বিভূতি। প্রশ্ন জাগে, বাংলা কবিতা কেন আজও এই প্রত্যাশা যথাযথ জাগ্রত হল না?’ প্রতীক যেখানে বিষয় ও বিষয়ীর মধ্যে সমান্তর সম্পর্ক নির্দেশ করে, চিত্রকল্পের সন্ধান সেক্ষেত্রে বিষয় বিষয়ীর অন্তর্বয়ন। এই অন্তর্বয়নের রূপ ও অরূপ অলোকরঞ্জনের প্রথম তিনটি কাব্যগ্রন্থে এক ভিন্ন ভাষায় রূপব পরিগ্রহ করেছে বলা যায়। যৌবন বাউলের আধুনিকতা ও আবহমানতার অন্তর্বয়নের পাশাপাশি আমরা এখানে সন্ধান করতে পারি নিষিদ্ধ কোজাগরী ও রক্তাক্ত ঝরোখাতে। স্মরণ করতে পারি নিষিদ্ধ কোজাগরী গ্রন্থের পথের মন্ত্র কবিতাটিকে- 


আমরা 
পান্থশালার বারান্দায় 
বসব না। 
সূর্য 
অরুণ বরুণ নিয়ে যখন 
দিনান্ত। 
চন্দ্র 
কিরণমালা নিয়ে যখন 
নিভন্ত। 

আমরা 
পান্থশালার বারান্দায় 
বসব না। 

আমুরা 
দ্বিতীয় চুম্বনের আশায় 
থাকব না। 

খুলল 
মেঘের দুয়ার 
ঐ আমাদের সিংহাসন। 

নামল 
বোশেখি ঝড়, বৃষ্টি ভেজায় 
সিংহাসন; 

আমরা 
দ্বিতীয় চুম্বনের আশায় 
থাকব না। 

নিষিদ্ধ কোজাগরী কাব্যগ্রন্থটিতে যেন মিতকথনের বিস্তার এক অনবদ্য অন্তর্বয়নের রূপ পায়। যৌবন বাউলে তবু অন্ধকার অস্তিত্ববাদের প্রেক্ষাপট ছিল, তা যেন এখানে নেই। এখানে কি কবি আরও গভীর অন্ধকারে গেছেন? না কি সেই আলোর কাছাকাছি পৌঁছেছেন, যার কাছাকাছি গেলে মানুষ অনেক শান্ত হয়ে যায়, অনেক কম তুলির আঁচড়ে এঁকে ফেলে মহাকাব্যিক ক্যানভাস। অলোকরঞ্জনের কবিতার এই আরেক বৈশিষ্ট্য। এক মহাকাব্যিক ক্যানভাস থেকে যায় তাঁর সৃষ্টিগুলির মধ্যে। যেন তিনি আঁকছেন একটি ছোট্ট ফুলদানী। কিন্তু তার প্রেক্ষাপটে আছে হয়ত সুদূর দিগন্ত বা যুদ্ধক্ষয়ী, রক্তক্ষয়ী বর্তমান। কিন্তু সেই ফুলদানীতে আঁকা আছে শান্ত এক পৃথিবীর সংসার। তবু এই শান্ত পৃথিবীর সংসার যেন ব্যাহত হচ্ছে ক্রমশ। তিনি নিজেকে আটকাচ্ছেন বারবার। কিন্তু যে অরূপরতনের সন্ধান একবার পেয়েছে, সে চরম অন্ধকারের মধ্যেও আলোর লীলা দেখতে পায়। ফলে, নিষিদ্ধ কোজাগরীতে আমরা এক অনবদ্য অলোকরঞ্জনীয় ভাষাপ্রবাহে দেখতে পাই তাঁর কবিতা অনেক বেশি রহস্যময় হয়ে গেল। আধুনিকতা কি অনেক বেশি সুললিত আচ্ছাদনে মুড়ে ফেললেন কবি? কিন্তু সুললিত এই আচ্ছাদনের ভিতরে আধুনিকতার নগ্নতা দেখতে পেলাম আরও বেশি করে। 

আত্মনিহত দুটি মৃতদেহ 
রাঢ়ভগবতীপুরে 
দুপুরবেলায় পৌঁছিয়ে গেল 
নদীর উজান ঘুরে। 
একটি পুরুষ, তার চোখে তবু আক্রোশ, রুক্ষতা 
অন্যটি নারী, তার চোখেমুখে অটুট স্বর্ণলতা।। 

(নারীশ্বরী) 

মনে রাখতে হবে এই কবিতাগুলি প্রকৃতপক্ষে সামাজিক রাজনৈতিক ভাবে আমাদের এক সন্ধিক্ষণের সময়। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তর কবিতার অভিযাত্রাকে আমরা যদি দুই ভাবে ভাগ করি, তবে তার একভাবে পড়বে এই প্রথম তিনটি কাব্যগ্রন্থ। আরেক ভাব শুরু হয় গিলোটিনে আলপনা থেকে। তার কারণও রাজনৈতিক। কিন্তু রাজনৈতিক সন্দর্ভের যে আকাশ লুকোচুরি খেলছিল এতক্ষণ ধরে, রক্তাক্ত ঝরোখায় এসে সেই সন্দর্ভ যেন নিজের অন্তরের ভিতরে থাকা দ্বন্দ্বগুলি নিয়ে হাজির হল নিশ্চিন্তে। যেন, দ্বন্দ্বই প্রধান বিষয়। আধুনিকতার বহিরঙ্গ কিন্তু তখন প্রবেশ করে গেছে তাঁর ভাবনায়। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রখর আন্তর্জাতিকতা। একপাশে রয়েছে নিজস্ব শিকড়ের পুরাণের রক্তমাংস। এর আগে আমরা বিশ্বকবিতায় ইয়েটস এবং বাংলা কবিতায় জীবনানন্দের মধ্যে এই প্রবণতা লক্ষ্য করেছি। পেয়েছি সাতটি তারার তিমির-এর মতো কাব্যগ্রন্থ। অলোকরঞ্জনের রক্তাক্ত ঝরোখা, সাতটি তারার তিমিরের সঙ্গে গল্পগাছা করতে পারে। ‘ওসব ছলনা রেখে কবি/ উচ্চারণ কর, যথা ইস্পাতের দৃপ্ত জাহ্নবী/ ধরে জ্যোৎস্না, কিংবা খর সূর্যের অমিত স্বেচ্ছাচার/ শুধু জেন একমাত্র মানদণ্ড নয় প্রতিচ্ছবি/ নিদারুণ গহবরগুলিকে ঢাকে অরণ্যঅটবী/ মূমুর্ষুকে যে বলে অপ্রিয়্ সত্য, সে অতি নচ্ছার’। এমন এক আধুনিক মহাকাব্য বাংলা ভাষার আধুনিকতম সময়ে যে লেখা হয়েছে, তা আমাদের বড়ই ভাগ্যের বিষয়। কারণ এই কাব্যগ্রন্থটি তার মহাকাব্যিক বিস্তার নিয়ে ফিরে এসো চাকার আলোর ঔজ্জ্বল্যে চাপা পড়েই আছে, হয়ত বর্তমানেও ততটা জনপ্রিয় নয়। কিন্তু এই কাব্যগ্রন্থটিকে বাংলা কবিতার এক মাইলস্টোন বললেও মনে হয় কম বলা হল। 

ধানক্ষেতে এসেছিল বেড়াতে দু-জন 
ধানক্ষেতে শিশু রেখে পালাচ্ছে দু-জন; 

‘এবার স্টেশনে চল’, বলল একজন। 
‘এবার স্টেশনে চল’, বলল একজন। 

‘সাঁকো বেয়ে নীচে এস’, এ ওকে বলল। 
‘সাঁকো বেয়ে নীচে এস’, এ ওকে বলল। 

আর নেমে এসে দেখে সুন্দর কাঁথায় 
রক্তমাখা শিশু নিয়ে ধানী নৌকো যায়। 

সুন্দর কাঁথায় ধানী নৌকো যাচ্ছে রক্তমাখা শিশু নিয়ে। এই আপাত সুন্দর অথচ ভয়ংকর দৃশ্যের মধ্যে যেন প্রতফলিত হল নীরব এক হিংসা। তার পর থেকে ক্রমশ যে হিংসার দিকে সারা পৃথিবী চলেছে, হিংসা যে আরও বেশি সাম্রাজ্যবাদী, সূক্ষ্ম, ঠাণ্ডা এবং নীরব, চকিত হয়ে উঠেছে, তা আর অবিদিত নেই। অবিদিত নেই এ কথাও যে, সাত-এর দশকে এক রাতে হত্যা করা হয়েছিল তিনশো তরুণকে। হত্যা করা হয়েছিল নতুন পৃথিবীর স্বপ্নকে। এই অন্ধকারকে প্রত্যক্ষ করে লিখে রাখাও তো এক কবির-ই কাজ। তিনি তো কেবলমাত্র সেই মহাজাগতিক দর্শনের প্রতিনিধি নন। তিনি যেমন একহাতে সত্যের সঙ্গে শাশ্বতের, আবহমানের সঙ্গে আধুনিকতার বিবাহ দেন, তেমন-ই তাঁর রক্তপাত হয়, তাঁর সময়ের হিংসায়। তিনি নিজের চোখে দেখতে থাকেন ইতিহাস কীভাবে নিজের মর্মান্তিক ইতিহাস লিখে চলেছে। বিশেষ করে কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত যেমন দেখেছেন কমিউনিস্ট আন্দোলন, যেমন প্রত্যক্ষ করেছেন কমিউনিস্ট আন্দোলনের স্বর্ণযুগ, তেমন তাঁর চোখের সামনেই দেখেছেন নকশাল আন্দোলনের উদ্ভব, তাদের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ এবং নৃশংস ভাবে তাদের যে হত্যা করা হয়েছিল সেই সব ইতিহাস। আবার তাঁর সামনেই হয়েছে জরুরি অবস্থা, হয়েছে বিশ্বায়ন, হয়েছে সোভিয়েতের পতন, ভুবনায়নের বিষাক্ত সাম্রাজ্যবাদ তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। ফলে রাজনীতি-লোকনীতির সংজ্ঞাগুলির যে ক্রম আধুনিকীকরণ ও ক্রম উত্তর-আধুনিকীকরণ হল, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে মানুষের অস্তিত্ববাদ, সুররিয়ালিজম, দাদাইজমের সঙ্গে যে পরিবর্তন হতে হতে মানুষ আরও বেশি নিঃসঙ্গতায় চলে গেল, আরও ভোগ এবং আরও সংযমহীন এক সংকর প্রজাতির সমাজকে দেখলেন। অবক্ষয় বা অন্ধকার যে কত বিচিত্র সজ্জায় নিজেকে হাজির করতে পারে, তা তাঁর কাছে অনুপস্থিত থাকল না। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় ২০০৭ সালে এই বাংলায় নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর কাণ্ডের পর তাঁর গোলাপ এখন রাজনৈতিক কাব্যগ্রন্থের কথা। শুরু করেছিলাম আধুনিকতা দিয়ে। কিন্তু আধুনিকতা তো নিজের নিয়মেই আর থাকল না। অলোকরঞ্জনের ভাবনার জগতে পাশাপাশি যেমন ছিল সুরদাস, কবীর, দাদূ সহ ভারতের মরমীয়া কবিতার জগত, তেমন ছিল ইউরোপীয় কবিতার উত্থ্বানের সম্পূর্ণ জগত। যেমন ছিল ইউরোপীয় ধ্রুপদী কবিতার আবহমানতার সম্পূর্ণ মানচিত্র, তেমন ভাবেই ছিল মার্ক্সীয় এবং উত্তর-মার্ক্সীয় ইউরোপীয় সাহিত্যজগত, প্রাচ্য নাটক, কাব্য চিত্রকলা এবং সঙ্গীতের জগত। তিনি প্রকৃতপক্ষেই বিশ্বনাগরিক। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে যাচ্ছে কয়েকদিন আগে এই অধমের নেওয়া অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত=র একট সাক্ষাৎকার, যেখানে তিনি বলেছেন- 

( বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে আপনার প্রত্যক্ষ সহবাস। বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের এবং বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে বিশ্বসাহিত্যের যোগাযোগ কি একটু ক্ষীণ হয়ে আসছে না? অল্পকয়েকজন ছাড়া কাজ সেভাবে হচ্ছে না বলেই মনে হয়। 

অলোকরঞ্জন: তুমি একটা কথা ভাবো। প্রুস্তের লেখা বাংলায় অনুবাদ করতে পারবে না। দম বেরিয়ে যাবে। তেমনি কমলকুমার মজুমদারের লেখা তুমি অনুবাদ করতে পারবে না। ইংরাজিতেও খুব অসুবিধে হবে। আমাদের একটা অনুবাদের আকাদেমি নেই সেই অর্থে। তবে বিশ্বের কবিতার বাংলায় অনুবাদ করে তার একটা প্রতিমান দেখানো। এবং সেগুলো যে একেবারে নিরর্থক নিরীক্ষা হয়েছে তা কিন্তু নয়। এই জায়গাতে আমাদের একটা অভাব রয়েছে। একটা গ্যাপ। মাঝখানে একটা ভাসাভাসা বিরতির কাজ চলছে যেটা খুব ক্ষতিকারক বলে মনে হয়। এই জায়গায় সরকারের একটা ভূমিকা আছে বলে মনে করি। দিল্লির সরকারের। সাহিত্য অকাদেমিকে তো সরকার বলে দেবে না। সাহিত্য অকাদেমি থেকেও অনুবাদের কাজ হয়েছে। কিন্তু আরও বেশি হওয়ার প্রয়োজনীয়তা ছিল। ন্যাশনাল বুক ট্রাস্টে আরও যে কাজগুলো হওয়া উচিত ছিল ততটা এগোয়নি। গুন্টার আইশ বা গুন্টার গ্রাসের মতো কবি বাংলায় নেই। কিন্তু এটা ঠিকই যে একই আদর্শে প্রাণিত হয়ে যারা লিখছেন, আলাদা করে বলা যাবে না অঙ্গীকারের কবি, হাতের কর গুনে বলাটা খুব মুশকিল হবে, দ্বিতীয়ত এটা তো ঠিকই যখন কোনও গদ্য লেখা হবে, যে গদ্যটা আজকে কেউ লিখছেন তা তিনি দশ পনেরো বছর আগেও লিখতে পারতেন না। সময় তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নিচ্ছে। কবিতার ক্ষেত্রেও এটি সমান সত্য। বিশ্বে বাংলার ভুবন এবং বাংলায় বিশ্বের ভুবন যত বিস্তৃত হবে, ততই মঙ্গল। 

শুধু বাংলা বা ভারত নয়, আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতে এই হারিয়ে যাওয়ার এক ভিন্ন ভাষ্য দেখি আপনার নব্বই পরবর্তী কবিতায়… 

অলোকরঞ্জন: আমি বলছি জীবনানন্দ যখন ইয়েটসের হাত ধরে এগিয়ে যান, বা মালার্মে যখন ডেলামেয়ারের হাত ধরে এগিয়ে যান, তার কথা। সমস্ত পৃথিবীর সমস্ত কবিদের মধ্যে একধরনের স্বগোত্রিতা থাকে। কিন্তু এটাও ঠিক যে দেশে যদি তার শিকড়টা না থাকে, এমন যদি হয় অধমর্ণ হয়ে শিকড় থেকে আমি লিখে যাচ্ছি তাহলে সেটা খুব আপত্তির ব্যাপার হবে। তুমি যে কবিতাটার কথা প্রথমেই উল্লেখ করলে, তার কী কোনও পূর্বসূরি কবিতা তুমি পেয়েছ? আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও পেয়েছ কী? পাওনি। কবিদের সমস্ত জায়গায় একটা সমান্তরাল এবং আদিগন্ত রাখীবন্ধনের ব্যাপার আছে। সেই জায়গাতে আমাকে শনাক্ত করার কাজটা কিন্তু তোমাদেরই করতে হবে। 

(ফোনের মধ্যেই শোনা যাচ্ছিল চারপাশের কিছু গলার আওয়াজ) 

এই যে শোনা যাচ্ছে তোমাদের আশেপাশে গলার আওয়াজ, একটু অসহিষ্ণু, এই চিৎকারটা আমি আমার কবিতার মধ্যে অন্তর্গত করে নিতে চাই, এবং একটু বলতেও পারো যে এখানে একটা আত্মদেবায়নের অভাব আছে। আমার মধ্যে একটা খুব ভয়ংকর অনপরিমেয় অতৃপ্তির অস্বস্তি আছে, আর সেটা না থাকলে আমি লিখব কী করে? 

মনে পড়ছে একবার কথা হয়েছিল আপনার সঙ্গে সরল এবং তরল কবিতা নিয়ে। একই ছন্দে সরল এবং গভীর কবিতা যেমন হয়, তেমন আবার তরল ও লঘু কবিতাও। কিন্তু অনেকেই দেখি তার জন্য ছন্দকে দোষারোপ করে। আবার ছন্দকে বর্জনও করে। আবার অনেকের ধারণা ছন্দের দিন ফুরিয়েছে। আপনার কী মনে হয় এ প্রসঙ্গে? 

অলোকরঞ্জন: একটা জায়গায় ছন্দ থাকবেই। রবার্ট ফ্রস্ট বলতেন না, যে যেমন জাল না টেনে ব্যাডমিন্টন বা টেনিস খেলা সম্ভব নয় তেমন সরবৃত্ত বা তানপ্রধান বা মাত্রাবৃত্ত তাতে সরাসরি না লিখলেও যে কবিতার মধ্যে ছন্দ নেই সেইরকম কোনও কবিতাকে আমি কিছুতেই অভিনন্দিত করতে পারব না। এটা তুমি লক্ষ্য করবে যে অরুণ মিত্রের পরে গদ্যছন্দটা অনেকটাই এসেছে। তার মাঝামাঝি, তার পাশাপাশি, তার আড়াআড়ি তাঁর কোণাকুণি যদি ছন্দ থেকে যায় তাহলে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না বলে আমি মনে করি। আমি জানি অনেকেই বিশ্বাস করেন না এটা। কোন ঠাকুর? অবন ঠাকুর ছবি লেখে। এটাও তো একটা ছন্দ। এটাকে তো স্ক্যান করা যায়। যে গদ্যকে আমি স্ক্যান করতে না পারি সেই গদ্যকে কবিতার রাজকিরিট পরানোর আগে মাথা নত করে ভাবব যে তাহলে কি এতকাল আমি ভুল ভেবেছি? 

(কিছুক্ষণ চুপ) 

দ্যাখো, কবিতা একটা হাতের কাজ। সুভাষদা যেটা ভাবত। কিন্তু সেই সুভাষদার কবিতা – ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত’ সেখানেও কিন্তু স্বরবৃত্ত ছন্দ এসে যাচ্ছে। সুভাষদা এগুলোকেই এমন ভাবে এক একটা কবিতায় ব্যবহার করছেন যে সেইগুলো মিছিলের মন্ত্র হয়ে উঠছে। সেইগুলো, আমরা যাকে মেমোরেল স্পিচ বলি, স্মৃতিধার্য বাগ্মীতা, তার চূড়ান্ত উদাহরণ হয়ে উঠছে। এটাও কিন্তু এক ধরনের হাতের কাজ। উনি কবিতাগুলোকে সেইভাবে দাঁড় করিয়েছেন। অন্যদিকে দেখো, কাগজ ভাঁজ করার খেলা, অরিগ্যামি যেটাকে বলে। অনেক কবিরা সেটা খেলেন। এটা খুব স্বগত খেলা। তুমি তাকে দিঘির মধ্যে ভাসিয়ে দিতেও পা্রো একটা নৌকোর মতন। আবার তুমি তাকে পরমুহূর্তে ঘুড়ি করে আকাশে উড়িয়ে দিতে পারো। এটাও একটা হাতের কাজ হচ্ছে। এই হাতের কাজ করতে করতে কিন্তু দেখা যাচ্ছে প্রায় চোদ্দ পনেরো শতক থেকে অরিগ্যামি চলছে। এখন যারা অরিগ্যামির কাজ সারা জগত ধরে করছেন। হাতের কাজ। সেখানে একটা অদ্ভুত ধরনের সময়ের পর্ব বিভাগ আছে। কতক্ষণের মধ্যে সেটাকে করে মাটি থেকে আকাশের দিকে উড়াল দিয়ে দেওয়া যায়। এটাও একটা হাতের কাজ। এই হাতের কাজটা যদি না থাকে, বিশেষ করে আজকের ডিজিটাল যুগে, তাহলে তো আমার বাঁচার এবং বাঁচাবার কোনও মানদণ্ড থাকবে না। 

আরেকটা কথা আমি তোমাকে বলি। সেটা খুব জরুরী। মনে রেখো। ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের একটা সূত্র ছিল যে পৃথিবীর সব যুগেই এমার্জেন্সি ছিল। পৃথিবীর সব যুগে। কিছুটা এমার্জেন্সি কবির নিজের বাঁচার মধ্যে থাকে। যেমন ধর বিনয় মজুমদার। এখন বিনয় মজুমদারকেও পয়ারের দিকে একটু ঝুঁকতে হয়েছে। শক্তিকেও ঝুঁকতে হয়েছে একটু স্বরবৃত্তের দিকে। তার মানে আবার একদম শাক্তপদাবলীর মতো এমনও নয়। সেভাবে হবেও না। এখন ধরো ইন্দিরা গান্ধীর এমার্জেন্সির সময় লোকে ভয়ে ভয়ে লিখছে।এখন হয়ত সেই ভয়টা কেটে গেছে। কিন্তু এমার্জেন্সি সম্পর্কে একটা চেতনা না থাকলে এটা একটা আত্মপ্রসাদের ক্ষীণ অনুবাদ হবে। কবিতা কবিতা হয়ে উঠবে না। 

এমার্জেন্সি সত্ত্বেও কবিতার এই কাজটি কিন্তু চলছে… 

অলোকরঞ্জন: এখনও নিশ্চয় একটা এমার্জেন্সি চলছে। এখন বিশ্ব জুড়েই একটা এমার্জেন্সি চলছে। বার্মাতে দেখছি সাংবাদিকদের মুখ চেপে ধরা হচ্ছে। তবে আমি শুধু সরকারি প্রশাসনের দিক থেকে বলছি না। এমন একটা জায়গা তো এসেছে যেখানে মানুষ প্রশ্ন করতে শিখেছে। প্রশ্ন করছে। আর কলকাতায় যত কবিতার পত্রিকা এমন কি পৃথিবীতে কোথাও আছে? নেই তো! তুমি যদি সেগুলো পড়ো তাহলে দেখতে পাবে, কেউ কেউ করছেন ওই হাতের কাজ সুভাষদার ধরনের। আর কেউ করছেন ওই অরিগ্যামির খেলা। তার মধ্যে দিয়ে ওই কবিতার কাজটা কিন্তু চলছে। এটা আমি বলব। কবিকে আমি দেখব না। আমি দেখব কবিতা থেকে কবিতায় বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যেটা চলছে সেটা কিন্তু বাংলা ভাষার মতো ভারতীয় সবকটা ভাষায় চলছে বলে আমার মনে হয় না। এখন দেখো এমন বিবর্তন মারাত্মক ধরনের কিছুটা মারাঠি কবিতায় গেছে। কিন্তু দিলীপ চিত্রের মৃত্যুর পর সেদিকে আর এগোয়নি। কবিতার এই যে বিচিত্র পথসঞ্চার, আমি সেইদিকে খুব আশা রাখি। আর এইখানে একজন তরুণ কবি, রাজাধিরাজের মতো কলকাতার পথে পথে হেঁটে চলেছেন।) 

অলোকরঞ্জনের এই কথাগুলির মধ্যে থেকেই স্পষ্ট, তিনি কীভাবে গিলোটিনে আলপনার সময় থেকে নিজেকে বদলে প্রায় একটি কুঠারের মতো করে তুললেন। কারণ এ কথা সত্য, হয়ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময় থেকেই সত্য, যে আমরা বসবাস করছি একটি নিয়ত জায়মান এমার্জেন্সির মধ্যে। একজন জায়মান কবি বা শিল্পীর মতোই তিনি নিজেকে তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তিগুলির নিরাপদজনক পরিসরে আটকে রাখলেন না। দার্শনিক অন্ধকারের পাশাপাশি তাঁর রচিত আলোর কথা বলতে শুরু করল সময়ের মধ্যে থাকা অসুখ। যখন সময় নিজেই সেই অসুখের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করতে শুরু করল, তখন তিনিও সেই প্রতিরোধের সাক্ষী হিসেবে থাকলেন। একজন প্রকৃত কবি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চলেও গতানুগতিকতার স্রোতে গা ভাসিয়ে দেন না। বরং তিনি স্রোতটিকে লক্ষ্য করেন। সমগ্র ইতিহাসবোধের আবহমানতায় দেখেন তাঁর সমসময়কে। অর্থাৎ আজ যে ইতিহাস তৈরি হচ্ছে, তা বহুবছরের ইতিহাসযানের প্রেক্ষিতে তিনি দেখতে থাকেন। গিলোটিনে আলপনা এমন একধরনের কবিতা, যেখানে আধুনিক একজন ব্যক্তির মধ্যে দিয়েও আবহমান মানুষের যন্ত্রণাবোধের জায়গাটির কথা তিনি লিখে যাচ্ছেন। তাঁর কাব্যজীবনের সেই প্রথম পর্যায়ের যৌবন বাউলের বাউল এখানে যে রয়েছে, তা বলা বাহুল্য। কিন্তু সেই বাউল এখন শুধুই একতারাতে রাত্রির মন্দিরের অপূর্ব অন্ধকারের সঙ্গে যাপন করতে পারে না। যে আঁধার আলোর অধিক যেমন তিনি প্রত্যক্ষ করেন, তেমন প্রত্যক্ষ করেন যে আলো আঁধারের চেয়েও অন্ধকার, তাকে। 

ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল অস্থাবর পোকামাকড় 
সাঁওতালডির আলোকমালায় অতীন্দ্রিয় ছল 
কেউ বলেছে এবারে খুব ফসল হবে না-ই বা হলো ফসল 
ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ুক দুর্ভিক্ষের অকূল চরাচর 
আমি তবু এই শরীরের খড় 
সংকলিত সত্তা আমার একাগ্র পবিত্র করে রাখি 
‘আমাকে ভোগ করবে তুমি’- বলে জ্বালাই শেষদুটি জোনাকি! 

( জ্বর) 

ভয়ংকর এই বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়েও কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের ভিতরের বিশ্বাস কিন্তু ভাঙেনি। এইটাই আধুনিকতার সামনে এক বিরাট বড় দেওয়াল হয়ে রইল। মঙ্গলের প্রতি বিশ্বাসের জায়গা থেকেও অলোকরঞ্জন সুন্দরের গা থেকে যে রক্ত পড়ছে, যে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডে ঘাসের উপর পড়ে থাকছে মাংসের টুকরো, বাতাসে মিশে যাচ্ছে পারমাণবিক ভস্ম, তা প্রত্যক্ষ করছেন। তিনি দেখছেন একটা অ্যাপোক্যালিপ্টাস পৃথিবীর দিকে আমরা সকলেই এখন এগিয়ে চলেছি। এই প্রত্যক্ষ করাটাকে তিনি লিখে রাখছেন। একজন বিশ্বনাগরিকের মতোই তিনি দেখছেন যে ধ্বংসস্তূপের কোনও কাঁটাতার নেই, দেশ নেই। যে ভাষা তাঁর দেশ বলে তিনি গর্ববোধ করেন, সেই ভাষাও ক্রমশ বিপন্নতায় ডুবে যাচ্ছে। গত কুড়ি বছরের কবিতা অলোকরঞ্জনের এই ক্রমশ বিপন্নতাকে ধরার কবিতা, তাঁর কষ্টযাপনের কবিতা, তাঁর অসহায় ভাবে এক অসুস্থ পৃথিবীকে প্রতি মুহূর্তে আরও অসুস্থ হয়ে চলতে দেখার কবিতা। কারণ এই বিপন্নতা তো শুধু একটি বিশেষ এলাকার নয়, সমগ্র বিশ্বের। এই বিপন্নতার মধ্যে যেমন মিশে আছে ক্রমবর্ধমান পারমাণবিক সন্ত্রাসের পৃথিবী, তেমন আছে বিশ্বায়িত অর্থনীতির ফাঁদ, যেমন রয়েছে মৌলবাদের রাজনীতির পৃথিবী, হিংসায় ক্রমশ উন্মাদ পৃথিবী, তেমন রয়েছে একটা নীতিহীন পৃথিবী। পরিবেশ বিপন্ন, মানবতা বিপন্ন, সুন্দর বিপন্ন। এই গভীর রাজনৈতিক অবস্থা কীভাবে তাঁর কবিতা থেকে আলাদা থাকবে? তাই, আমার মনে হয় গত কুড়ি বছরের অলোকরঞ্জনের প্রতিটি শব্দ রাজনৈতিক, যদিও তাঁর অন্তর্বয়ানে রয়ে যায় সেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব, যাঁর সঙ্গে কথোপকথন সেই যৌবন বাউল লেখার সময় থেকেই শুরু করেছিলেন তিনি। ভালো হত, খুব ভালো হত, যদি কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত একটি সুন্দর পৃথিবীতে চলে যেতে পারতেন। আমরা দুর্ভাগা, কারণ তিনি এখন বিয়াত্রিচেকে খোঁজেন না, খুঁজতে পারেন না, তিনি এখনও হেঁটে চলেছেন ইনফের্নোর আগুনের মধ্য দিয়ে। বরং দান্তের চেয়েও তাঁর যাত্রাপথটি একটু আলাদাই হয়েছে। পুরগেতোরিওর থেকে তিনি শিকড় সন্ধানে এসেছেন ইনফের্নোর মধ্যে। এই ইনফের্নোও তো তাঁকে পেরিয়ে যেতে হবে। কিন্তু তাঁর আশ্রয় কখনওই তাঁকে ছেড়ে যাননি। সেই আশ্রয়ের সঙ্গে তাঁর যাপন-ই তাঁকে করে রেখেছে এক শান্ত পর্যটক। তিনি অভিনিবেশ সহকারে পর্যবেক্ষণ করতে পারেন সুন্দরের খুঁটিনাটি, যার গায়ে লেগে আছে বোমার টুকরোর বিষাদ। আর তার হাত ধরেছে তার নিজস্ব ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ভাষাবিশ্ব। যা সম্পর্কে তাঁর এক প্রবন্ধ থেকে আভাস পাওয়া যায়-‘ ভাষা এবং শব্দ এক নয়। ভাষার মধ্যে ধ্বনি আছে, অনেকখানি জায়গা জুড়ে। তা নাহলে অর্থহীন বৈদিক স্তোভধ্বনি ঐ মর্যাদা পেত না, ব্রজবুলির মতো আবেগনিয়ন্ত্রিত, ব্যাকরণবিস্মৃত ভাষা পেতাম না আমরা। আধুনিক কবিতায় শব্দই সমগ্র ভাষাকে কোণার্ককিন্নরীর চিবুকে ক্ষোদিত করে তুলে ধরেছে। অনন্ত শূন্যের দিকে মালার্মে শাদা কাগজ মেলে রেখেছিলেন, ভাষার ভাষা পরম শব্দকে অভ্যররথনা করে নেবেন বলে। বাঙ্ঘলা কবিতায় এই মুহূর্তের শব্দৈষণা বিশ্লেষণ করলে দেখবো মালার্মের নিরঞ্জন সেই শব্দসন্ধানে এসে মিলেছে জীবনানন্দের শব্দব্যক্তিত্ব”। 

অলোকরঞ্জনের কবিতা, সেই ব্যক্তিত্বকেই ধারণ করে চলেছে। শূধু তিনি এক বিষাদের মন নিয়ে চেয়ে দেখছেন কীভাবে এই পৃথিবী আত্মঘাতী হয়ে উঠল! কীভাবে আধুনিকতা নিজেই নিজের আয়না ভেঙে ফেলল। কীভাবে প্রকৃতির ভিতর জন্ম নিল প্রকৃতিকে ধ্বংস করার কীট। যে সুললিত অন্ধকারের সাধনায় তিনি রাত্রির মন্দিরে ঈশ্বরকে অন্তরে নিয়ে উপাসনায় বসেছিলেন, সেখানে তিনি আজও বসে আছেন। কিন্তু তিনি জানেন, সব অন্ধকার এক অন্ধকার নয়। এখন অন্ধকার বড় অচেনা। বড় হিংস্র। বড় বেশি ধ্বংসাত্মক। 

অলোকরঞ্জনের কবিতা এক নিঃস্বার্থ আরুণির মতো এই ধ্বংসের স্রোতের বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তিনি জানেন, একার পক্ষে হয়ত এই স্রোত আটকানো সম্ভব নয়। কিন্তু তিনি এও জানেন, একমাত্র সুন্দর দিয়েই এই অসুন্দরকে প্রতিরোধ করা সম্ভব। 


[লেখক পরিচিতি - জন্ম ১৯৭৮। পেশায় বিজ্ঞাপনকর্মী৷ সমসময়ের একজন উল্লেখযোগ্য কবি, গদ্যকার, অনুবাদক।] 







একুশে আশ্বিন 
অরুণ দে 



কলকাতার জাতক সে। পিতামহের প্রয়াণের পর তাকে চলে যেতে হল গ্রামের পরিবেশে। যাবার সময় তার কোনও কষ্ট হয়নি। বেশ কয়েক বছর পর পারিবারিক বিপর্যয়ে আবার তাকে ফিরতে হল কলকাতার কাছেই। আসার সময় তার মন কেমন করছিল বন্ধুদের জন্য। স্টেশন প্ল্যাটফর্মের সেই গাছটার জন্য, যার কাছে সন্ধেটা তারা কাটিয়ে দিত দিনের পর দিন। তার মন-কেমনের মধ্যে বাসা বেঁধে নিল অনিশ্চয়তা। সে জানত না ঘর যে ছাড়ায়, হাত সে বাড়ায়। একে একে সে অনেক কিছু পেল। অনেকই। তাকে ঘিরে থাকে কত স্নেহ, ভালোবাসা। শুভ ইচ্ছা। এমন করেই একদিন সে পেয়ে গিয়েছিল একুশে আশ্বিন। তারপর সেই একুশে আশ্বিন একটু একটু করে ডালপালা মেলে বিশাল মহীরুহ হয়ে তাকে বুকের মধ্যে টেনে নিল। চোখ বুজলে এখন সে দেখতে পায় ঝলমলে আকাশ। শুনতে পায় আকাশ জুড়ে বাজছে এক আনন্দগান। 



[অরুণ দে : জন্ম ১৯৫৪। সাহিত্য অকাদেমির প্রাক্তন গ্রন্থাগারিক। ছড়াকার। রম্য রচনা লেখক।] 





অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত’র ভাষা 
হান্‌স্‌ হার্ডার 


সম্প্রতি প্রকাশিত “বাস্তুহারার পাহাড়তলি” কবিতা সংকলনে মার্টিন হাইডেগার (Martin Heidegger) – এর নামে একটা কবিতাতে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত বিংশ শতাব্দীর এই অস্তিত্ববাদী জার্মান চিন্তকের সঙ্গে তাঁর একটা নিবিড় যোগাযোগ-সূত্র স্থাপন করেছিলেন। 

কবিদের সর্বাগ্রণী দার্শনিক তুমি, তুমিই তো শিখিয়েছ, ‘মানুষের অস্তিত্বের আবাসন ভাষা’। 

ভাষাই যেন আমাদের বাড়ি - হাইডেগার-এর এই মন্ত্রটি অলোকরঞ্জন-এর খুব প্রিয় একটি উদ্ধৃতি, এবং এমন হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক : ভাষাকে নিয়ে ভাষার মধ্যে থাকা, প্রতি মুহূর্তেই সেই ভাষাকে ভালোবাসা, বিদ্রূপ, আরও কত রকমের খেলা করার প্রবণতা অলোকরঞ্জন-এর কবি আর ব্যক্তিচরিত্রের এক অবিছেদ্য লক্ষণ। 

সেই মার্টিন হাইডেগার একথাও বলেছিলেন যে, গ্রীক আর জার্মান ছাড়া অন্য কোনও ভাষায় দর্শনশাস্ত্র নেই; আর এটাও জানা কথা যে হাইডেগার হিটলার এর আমলের প্রথম পর্যায়ে হিটলারপন্থী ফ্যাসিবাদীদের পক্ষে ছিলেন; ফ্রাইবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে কর্মরত থাকাকালীন ইহুদি অধ্যাপকদের পদচ্যুত করার ব্যাপারে ক্ষেত্র-বিশেষে তাঁর ভূমিকা ছিল যাকে বলা যায় সক্রিয়। ভাষার সীমানা যিনি অতটা অনির্বচনীয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন, সেই দার্শনিক যে সঙ্কীর্ণ জাত্যাভিমানে আক্রান্ত হয়েছিলেন, সেটা ঘটনা - সঙ্কীর্ণতা যেন ব্যাপ্তিকে নিজের সীমানায় আটকে রেখেছিল। 

হাইডেগার-এর ভাষা-প্রেমে প্রভাবিত হয়েও অলোকরঞ্জন হাইডেগার-এর একদেশদর্শিতা (বা দ্বিদেশদর্শিতা)-র ঠিক উলটো দিকে অবস্থান করেন। তাঁর কবিতায় তিনিও বাংলা ভাষার সীমান্তরেখাগুলো নিয়ে অনেক রকম নিরীক্ষা করতেই থাকেন। কিন্তু অলোকরঞ্জন-এর মতো একজন তুলনামূলক সাহিত্যতাত্বিক – সহজলভ্য ব্যাপ্তি যাঁর ক্ষেত্রে সর্বদা কার্যকর – কথায় আর তাত্বিক লেখায় যেমন, কবিতায়ও তেমনই। 

এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা জিগ্যেস করতে পারি যে ভাষা যদি মানুষের একটা আবাসন হয়, তাহলে অলোকরঞ্জন-এর কবিতা কিরকম বাসস্থান? ব্যাতিক্রমী নিশ্চয়ই - এই গৃহে দশটি দরজা, সাতটি তলা, ত্রিবেণী আর মালকোঠা সুনির্দিষ্ট জায়গায় অবস্থান করে না; বসার ঘর বা শয়নকক্ষের মধ্যেকার দেওয়ালগুলো নেই। আমি মনে করি এটা একটা কল্পগৃহ, যেখানে দেওয়ালগুলো সুবিধামতো তৈরি করা যায়। সার্বজনীন আর ব্যাক্তিগত স্তরগুলো আলাদা না থেকে অনেক সময় মিশে যায়। সেই বাড়ির খোলা ছাদের ওপর ভাষার সঙ্গে, ভাষার মাধ্যমে এক খেলা চলতে থাকে। 

কিন্তু কবিতার ওস্তাদের কবিতার বর্ণনা কবিতার ভাষায় করাটা আসলে হাস্যকর একটা চেষ্টা। কবিতা নিয়ে ভাষা, ভাষা নিয়ে অলোকরঞ্জন, আর মাঝে মাঝে তাঁর কবিতা আমারও মুখের ভাষা। যেমন বৃষ্টির সময় ছাদের নিচে আমার পড়ার ঘরে বসে থাকলে জলের ফোঁটা যখন টপটপ করে ছাদের ওপর পড়তে থাকে, তখন অলোকরঞ্জন-এর ‘প্লাবনের রাজগৃহে’ মনে পরে। তাঁর পঁয়ত্রিশ বছর আগেকার কবিতায় প্লাবন যতই প্রলয়ধর্মী হোক না কেন, সেই রাজগৃহ যেন হয়ে যায় আমার আপন বাসস্থান, মিশে যায় দিগন্ত বিস্তৃত আকাশের সঙ্গে। পৃথিবী টলমল করছে করুক, আমি আপন গৃহে সুরক্ষিত। এভাবে একটা বাংলা কবিতা জার্মান এক চিলেকোঠাকে রাজগৃহে পরিণত করতে থাকে। 

গ্রীক-জার্মান বা বাংলা সংস্কৃতির সীমানাগুলো না মেনে তাঁর আরও অনেক কবিতা চারদিকে ভেসে যাক আর আমাদের পরিণতি ঘটাক, এটাই তাঁর অষ্টআশিতম জন্মদিনে আমার কামনা। 


[হানস হার্ড।র : জন্ম ১৯৬৬। হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইনস্টিটিউট ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ’ – এর অধ্যক্ষ। একাধিক বই-এর লেখক এবং বাংলা ছাড়াও অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় পারদর্শী।] 




অনন্য ভাষাশিল্পী অলোকরঞ্জন 
জয় গোস্বামী 


সহজাত কবিত্বপ্রতিভার নক্ষত্রদীপ্তি নিয়ে অলোকরঞ্জন আবির্ভূত হন বাংলা কবিতার আকাশে। তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘যৌবন বাউল’ প্রকাশমাত্র কাব্য পাঠকরা বিমোহিত হয়ে যান এই কবির অসামান্য প্রকরণ-দক্ষতা ও কবি হৃদয়ের মাধুর্যস্পর্শে। সেই প্রথম কাব্য-পুস্তক থেকে আজ পর্যন্ত কখনও এই কবির অবিরল অগ্রসরমানতার পথে কোনও বাধার পাথর এসে দাঁড়াতে পারেনি। আজ পর্যন্ত তিনটি কবিতা-সমগ্র বেরিয়েছে অলোকরঞ্জনের। আরও তিনখণ্ড সমগ্র এক্ষুনি বেরোতে পারে তাঁর কবিতার পরিমাণ এতই অধিক। 

আশির দশকে একটি অধুনালুপ্ত লিটল ম্যাগাজিন অলোকরঞ্জনের মাতৃদেবী নীহারিকা দাশগুপ্তের একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে অলোকরঞ্জনকে বিষয় হিসাবে কেন্দ্রে রেখে। অলোকরঞ্জনের মা সেই সাক্ষাৎকারে একটি কথা বলেছিলেন, যেকথা আমার আজও মনে আছে। সেই কথা থেকে জানা যায় অলোকরঞ্জন যখন মাত্র ছয় বছরের শিশু, তখন তিনি মুখে মুখে দুটি কবিতার লাইন তৈরি করে তাঁর মাকে বলেন। সেই লাইনদুটি হল, ‘হরিণগুলো চরে বেড়ায় বনে বনে/তারা কথা বলে মনে মনে’। ছয় বছরের শিশু একথা ভাবতে পারল কিভাবে যে, নীরব হরিণেরা মনে মনে কথা বলে চলেছে? এই হল অলোকরঞ্জনের কবিত্বের প্রথম প্রকাশ। এই দুটি লাইন থেকেই বোঝা যায় ভবিষ্যতে এক বড় কবির উন্মেষ ঘটতে চলেছে। 

আজ অলোকরঞ্জন এক আন্তর্জাতিক কবি ও চিন্তকরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তাঁর একের পর এক কাব্যগ্রন্থে আমরা যেমন দেখতে পাই ভারতবর্ষের চিরকালীন রূপ – তেমনই সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে দেশ হারানো, ভিটেমাটি হারানো যেসকল শরণার্থী ও উদ্বাস্তুরা রয়েছেন, তাঁদের নিয়ে কবির একান্ত উদ্বেগ ও চঞ্চলতা। 

অলোকরঞ্জনের কবিতায় আমাদের এই বঙ্গদেশ যেমন ধরা পড়ে, তেমনই প্রকাশ পায় সারা পৃথিবীর বিপন্ন মানুষের কথা। অলোকরঞ্জন শুধু বাঙালির কবি নন, তিনি তাঁর কবিতায় ধারণ করেন সমস্ত বিশ্বের দুর্দশাগ্রস্ত জনসাধারণের জন্য এক আকুল সমবেদনা। এখনও পর্যন্ত প্রকাশিত তাঁর শেষতম কাব্যগ্রন্থ ‘পাহাড়তলির বাস্তুহারা’–র মধ্যেও সেই চিত্র জাজ্জ্বল্যমান। 

তবে অলোকরঞ্জন শুধু কবিতাই লিখেছেন সারা জীবন ধরে, তাই নয়; তাঁর প্রবন্ধের বইগুলিও গদ্যরচনার একেবারে স্বতন্ত্র একটি ভাষা ও দৃষ্টিকোণকে বাঙালি পাঠকের সকাশে নিয়ে এসেছে। কে ভুলতে পারে অলোকরঞ্জনের প্রবন্ধ-গ্রন্থ ‘শিল্পিত স্বভাব’- এর কথা? কার মনে পড়বে না ‘স্থির বিষয়ের দিকে’ নামক তাঁর অতুলনীয় গদ্য গ্রন্থটিকে? এখন তাঁর কবিতার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর গদ্যসংগ্রহ কলেজ স্ট্রিট থেকে কিনে নিয়ে যান পাঠকরা। তাঁরা পড়েন এবং আবিষ্ট হন। তাঁর গদ্যসংগ্রহের অন্তত আরও দুটি খণ্ড প্রস্তুত করা যায় এই মুহূর্তেই, সেকথা তাঁর পাঠকমাত্রেই বুঝতে পারেন। অলোকরঞ্জনের মৌখিক বাংলা ভাষাও এক অলৌকিক ঔজ্জ্বল্য বিকিরণ করে। এবং সর্বদা সেই ভাষাজ্যোতি বিচ্ছ্যুরিত হয় তাঁর মুখের সামান্য–সাধারণ কথা থেকেও। 

আমি অনেক সময় অলোকরঞ্জনকে ভাষণ প্রদান করতে শুনেছি। এমন আশ্চর্য সেই ভাষণের প্রতিটি বাক্যগঠন এবং এত অপূর্ব সেই ভাষণকে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার শৈলী, এত নিখুঁত সেইসব ভাষণকে তার নিজস্ব গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার যুক্তি-পরম্পরা, যে সকল শ্রোতাই সেসব ভাষণে মুগ্ধ না হয়ে পারেন না। 

সেই কারণে প্রত্যেক বছর দু’মাসের জন্য যখন তিনি জার্মানি থেকে কলকাতায় এসে বাস করেন, তখন প্রায় প্রত্যেকদিন তাঁকে এক বা একাধিক সভায় গিয়ে ভাষণ পেশ করতে হয়। অনুরাগীদের হৃদয় তিনি এমনভাবেই জয় করে চলেছেন পঞ্চাশ বছরেরও অধিক সময় ধরে। 

অলোকরঞ্জন সাতাশি বছর বয়স পূর্ণ করলেন সদ্যই। এত দীর্ঘকাল ধরে লিখে চলার ক্ষেত্রে, ভাষণ দেওয়ার ক্ষেত্রে, ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় ভাষার ইন্দ্রজাল রচনার ক্ষেত্রে তিনি আজও এক অদ্বিতীয় সিদ্ধপুরুষ। নিজে পঞ্চাশ দশকের কবি হয়েও নবীন প্রজন্মের কবিতা লেখকরা তাঁর স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়নি। আশি দশকের কবি নাসের হোসেন যেমন তাঁর স্নেহধন্য, তেমনই এই একবিংশ শতকের প্রথম দশকে সদ্য লিখতে আসা কবি ও সম্পাদক জিৎ মুখোপাধ্যায়ও তাঁর স্নেহাশ্রয় লাভ করেছে। নিজের বিষয়ে এটুকু বলতে চাই, এই কবির স্নেহস্পর্শ আমিও পেয়েছি। এবং সেই স্নেহ অলোকরঞ্জনের হৃদয়ের কত গভীর থেকে উৎসারিত হয়েছে, তার একটি দৃষ্টান্ত দিয়ে আমার এই সংক্ষিপ্ত প্রণাম নিবেদন আমি সম্পূর্ণ করতে চাই। 

সকলেই জানেন, অলোকরঞ্জনের স্থায়ী বাসস্থান জার্মান দেশে। ইতিমধ্যে তিনি বিদেশে থাকাকালীন আমাকে একবার চাকরি ছাড়তে হল। সে খবর প্রবাসে বসেও অলোকরঞ্জনের কাছে কিভাবে পৌঁছল, সেকথা আমি জানি না। কিন্তু অলোকরঞ্জন, একদিন রাত সাড়ে দশটায় আমার স্ত্রী কাবেরির ফোনে ফোন করে কথা বলতে চাইলেন। 

কি বললেন তিনি আমাকে? এমন একটি কথা বললেন, আমি সারা জীবন মনে রাখব। অলোকদা বললেন, তোমার যদি কোথাও দরকার হয়, তাহলে আমাকে অবশ্যই জানিও। জানবে আমি সর্বক্ষণ আছি তোমার পাশে। কোনও প্রয়োজনের কথা আমাকে জানাতে বিন্দুমাত্র সংকোচ কোরো না। 

এতবড় কথা কে বলতে পারে? যাঁর হৃদয় দিগন্ত-প্রসারিত, তেমন মানুষের কাছেই এমন কথা শুনতে পাওয়া যায়। অলোকদা বুঝতে পারেননি, কিন্তু ফোন ধরা অবস্থায় আমার চোখ দিয়ে জল ঝরছিল। ফোন যখন কাবেরিকে ফেরৎ দিতে গেলাম, তখন কাবেরি বলল, একি! তোমার চোখে জল কেন? 

কাবেরিকে বললাম আমার এই অশ্রু সংবরণ করতে না পারার কাহিনী। আজ পাঠকদেরও জানালাম। 

অলোকরঞ্জন শতায়ু হন, ঈশ্বরের কাছে এই প্রার্থনাই করি। 



[জয় গোস্বামী : জন্ম ১৯৫৪। এই প্রজন্মের একজন অতি গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি কবি। অসংখ্য জনপ্রিয় কবিতার জনক।] 





স্তিমিত সিংহাসন 
ফ্রীডরিশ এঙ্গেলস 


একটি ক্রান্তিসঞ্চারী কাব্যনাট্য। তথ্যগ্রন্থি ও জার্মান থেকে অনুবাদ অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত 



প্রস্তাবনা 

গত শতাব্দীর সাতের দশকে কলকাতায় বইমেলা শুরু। প্রথম কয়েক বছর মেলার শেষ দু’দিন বইবাজার হতো। সেইরকম এক বইবাজারে হাতড়াতে হাতড়াতে হঠাৎ পেলাম ‘কার্ল মার্ক্সের প্রেমের কবিতা’। ভারি অবাক হয়েছিলাম। একইরকম অবাক হলাম যখন শুনলাম ফ্রীডরিশ এঙ্গেলসের লেখা নাটকের কথা। বন্ধু রাজা মুখোপাধ্যায়ের কল্যাণে ‘স্তিমিত সিংহাসন’ হাতে পেয়ে তো আরেক চমক। মূল জার্মান থেকে অনুবাদ করেছেন আমাদের প্রিয় অগ্রজ কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। 

‘ফ্রীডরি ওসভাল্ড’ ছদ্মনামে প্রথম জীবনে নাকি লিরিকধর্মী কবিতা লিখতেন এঙ্গেলস – ভাবা যায়? আনুমানিক ১৮৪১ সাল নাগাদ এই কাব্যনাটকটি লেখেন। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ফ্যাসিবাদের চূড়ান্ত ব্যর্থতা ও পতন পরিণতির কাহিনী বলেছেন। বুর্জোয়া অভিজাতশ্রেণী অথবা স্বৈরতন্ত্র, সে যতই জনপ্রিয় হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত এরা কেউই যে সমাজের পক্ষে মঙ্গলজনক নয় – বরং ক্ষমতা দূষণের ফলে সমাজের কী ভয়ঙ্কর ক্ষতিসাধন করে –এই সতর্ক বার্তা এঙ্গেলসের এই কাব্যনাটকের মাধ্যমে এই সময়ের প্রাসঙ্গিকতায় আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে – পাঠকমাত্রই তা উপলব্ধি করবেন বলেই আমার বিশ্বাস। 

কবি পল্লববরন পাল 
২০ অক্টোবর, ২০২০, কলকাতা 



প্রথম অঙ্ক। প্রথম দৃশ্য 

পটভূমি রোম। 

দৃশ্যাভাস : নগরদুর্গ 

(কোলোনা ও অন্যান্য অভিজাত নাগরিকদের প্রবেশ।। 

ঈষৎ পরেই বাতিস্তার নেতৃত্বে এগিয়ে আসে জনতা)। 



অভিজাতবৃন্দ ॥ কোলোনা, পালানো যাক, ভিড়ের চাপে মারা পড়বার দশা। ক্ষিপ্ত জনতার উগ্ৰায়ণ থেকে সরে পড়া যাক। 

কোলোনা ॥ পালানো? যেটার কাঁধে পা রেখেছি একাধিকবার 

সেই আবর্জনতার থেকে বুঝি পালাবে কোলোনা ? 

পালাতে হয় তো ধাও কাপুরুষ। আমিই সামলাব ঐ ক্রোধ। 

অভিজাতবৃন্দ ॥ দেখছ না কীরকম ফেঁপে-ফুলে রাস্তা জুড়ে যায়। 

শুনছো না ওদের দাপ? সঙ্গে চলে এসো 

(জনতা, বাতিস্তা তার চুড়োয়। ভিতরে ঢুকে পড়ে) 

বাতিস্তা ॥ ব্যাপারটা তাহলে ঠিক কী দাঁড়াচ্ছে? শহুরে বাবুরা। 

আমাদের ছেড়ে যাবে এত কেন ত্বরা? | 

অথচ থাকতেও চাও সেটা বেশ বুঝেছি আমরা। 

কোলোনা ॥ (অভিজাতবৃন্দকে) বেশ তো সইছো তোমরা 

নিজেদের নিয়ে এ মস্করা? 

বাতিস্তা ॥ চেয়ে দেখো সাধারণ মানুষের আর্তিময় মুখ 

থাকো আমাদের দেশ, এই শুধু প্রার্থনা আমাদের। 

কোলোনা ও অন্যান্য। 

অভিজাতবৃন্দ ॥ ভেগে যা নির্বোধ যতো, এ তল্লাট থেকে। 

বাতিস্তা ॥ আমরা তো তোমাদের সেবাদাস হতে দিব্বি রাজি। 

কোলোনা ॥ (অভিজাতবৃন্দকে) ছুরি বিচ্ছুরিত করো- 

বাতিস্তা ॥ শিশুর সোহাগে তোমাদের খুব করব যতন 

বিদ্রোহে আর যাব না রইব সন্তর্পণ 

বাকস্বাধীনতার দিয়ে দেব বলি বি-লক্ষণ। 

ভার্যা ও শিশু দেব তোমাদের উৎসর্জন। 

বাড়িঘরদোর লুটে-পুটে করো রমণ-বমন 

আমাদের নিয়ে চাও যদি করো অবলুণ্ঠন 

চাপ দাও, হানো, পরাও-না বেড়ি শেকলভূষণ 

পাপ তাপ যতো করেছি দহন মোচন 

শুধু কাছে থাকো, শুধু করি এই নিবিড় ভজন 

কোলোনা ॥ ধীমানগণ, কী মনে হয়! 

অভিজাতবৃন্দ ॥ পালাক, নির্বোধ যতো - এ তল্লাট থেকে – 

কোলোনা ॥ পালাও, নির্বোধ পামর যতো 

স্বরধ্বনি এই চেনো না আর। 

বজ্রে বিঁধেছিল চমৎকার। 

তোদের, আর এই পায়ের লাথি 

তোদের শিরোদেশে – হা বজ্জাতি - 

আপন প্রভুকেই বেবাক ভুলে গেলি পরিষ্কার! 

জনতা ॥ নিপাত যাও! 

কোলোনা ॥ (অভিজাতবৃন্দকে) নিষ্কোশিত করো অসি অন্তর আত্মরক্ষায় 

জনতা ॥ চুলোয় যাও! আজ মুক্তি আমাদের! 

বাতিস্তা ॥ মিনতি, আমাদের সঙ্গে রয়ে যাও। 

অভিজাতবৃন্দ ॥ রোষ থেকে প্রস্থান, ফেরা তারপর 

যেই না ঘটবে প্রতিস্পৃহাপ্রহর 

কোলোনা ॥ অগত্যা এই নরমপন্থা 

দুরন্ত হোক, বিদায়, জনতা আসবে যখন আমাদের শাহী। 

কাঁপবে তোমরা ত্রাহি ত্রাহি ত্রাহি 

জনতা ॥ নিপাত যাও! 

(কোলোনা এবং অভিজাতবৃন্দের প্রস্থান। জনগোষ্ঠী নিজেকে দুটি কোরাসদলে বিভক্ত করে নেয়। দ্বিতীয়টি প্রথম দলের চেয়ে জোরালো)। 

বাতিস্তা ॥ দেখো : সজ্জন মহাশয়গণ। 

কাঁপেন কেমন, অবরোধে রন, ভূস্বামী, ভূপ, কাউন্ট-ব্যারন রণভঙ্গুর কী উদাহরণ। 

যদি দশজন খুদে বদমাস দেয় পিটটান, সেই অবকাশে। স্বয়ং নরক-শয়তান আসে আমাদের ঠিক অন্তরদেশে? তাতে আমাদের লাভ কী বলুন, 

রুষ্ট রহেন যদি ট্রিবিউন? 

প্রথম কোরাস ॥ জয় ট্রিবিউন, জনতামুক্তিদাতা 

তাঁকে হেলা করে কার ঘাড়ে কটা মাথা! 

দ্বিতীয় কোরাস ॥ যাক সে-ও রসাতলে। 

বাতিস্তা ॥ সে বেশ মন্দ সে বড়োই সজ্জন। 

বনেদীশোণিত মহিষেরা যেরকম। 

বলে তোমাদের উদ্দেশে সুবচন। লোকের কথায় দেয় না মেলে শ্রবণ কুশাসক যায়, স্বৈরাচারীরা আসে, 

আখেরে এই তো ঘটমান ইতিহাস। 

প্রথম কোরাস ॥ মিথ্যাপবাদ ছড়িয়ো না আর, থামো। 

দ্বিতীয় কোরাস। না হে না, চালিয়ে যাও। 

বাতিস্তা ॥ সে বেশ মন্দ সে বড়োই সজ্জন। 

বনেদীশোণিত মহিষেরা যেরকম। 

প্রথম দল ॥ মুক্তিদাতার মানহানি থেকে থামো। 

জয় রিয়েন্‌ৎসি ট্রিবিউন। বাঁদরামো 

ছাড়ো দূর হও, মারো এ বদনামীকে – 

দ্বিতীয় দল ॥ স্বেচ্ছাচারীরা রসাতলে যাক। রিয়েন্‌ৎসি যমালয়ে। 

ট্রিবিউন হোক খুন। 

বাতিস্তা, তুমি আমাদের আশ্রয়। 

বাতিস্তা ॥ বলে তোমাদের উদ্দেশে সুবচন। 

লোকের কথায় দেয় না মেলে শ্রবণ – কুশাসক যায়, স্বৈরাচারীরা আসে, আখেরে এটাই ঘটছে ঐ ইতিহাসে। (দ্বিধাময় পরিবেশ। জয়ধ্বজ শোভাযাত্রার সংগীত দূর থেকেশোনা যায়। সেই সঙ্গে গোলগুলির শব্দ। সবাই থমকে দাঁড়িয়ে)। 

দুই কোরাসদল ॥ (একসঙ্গে) ঐ এল, চলো তার মুখোমুখি দাঁড়াই। 

প্রথম কোরাসদল ॥ মুক্তিদাতার জয়। 

দ্বিতীয় কোরাসদল ॥ যতোই দাঁড়াক শক্তির গৌরবে 

আমাদের প্রতিশোধের শিকার হবে। 

যেমনটা আরো পাঁচজন তারা কবেই... 

দুই কোরাসদল ॥ (একসঙ্গে) চলো যাই তার মুখোমুখি মোকাবিলায়! 

(সমবেত প্রস্থান)। 





প্রথম অঙ্ক। দ্বিতীয় দৃশ্য 

(কোলোনার প্রাসাদ, কামিলার ঘর)। 

কামিলা ॥ এ কি রলরোল পথে-পথে! 

এ কি ভিড়, না বিড়ম্বনা 

এই দুর্মর দাপাদাপি। এ যে রক্তনিশানলহর! 

শুনি প্রাসাদসোপান বেয়ে। আসে বন্য জনধ্বনি। 

ওরা আমার পিতার নামে দেয় ধিক্কার রীতিমতো 

বাবা, তুমি এই ক্রোধবিকৃত 

গণশক্তির সামনে যেয়ো না। 

শিরোদেশ ঘিরে বাঁচাবে তোমায় 

জননী মেরীর করুণ চাহনি। 

প্রদোষপ্রতিম অকথ্য ভয় 

ঘিরেছে আমায়, কী হবে তোমার! 

বাঁচাও আমাকে দুর্বহ এই জ্বালা থেকে পড়ি তোমার দু'পায়ে 



সকল সেবক কাপুরুষতায় আমাকে একলা রেখে পালিয়েছে। 

আমি এ প্রাসাদে ভয়পাংশুল। 

একাকী দাঁড়িয়ে আছি একঠায়! 

হায় ভগবান! ও বুঝি আমার 

দয়িত এসেছে— ভাষার অতীত - 

এল বলে, রাখি নিজেকে কোথায় – 

দোর দুরুদুরু আমার দয়িত! 

(মন্ট্রিয়ালের প্রবেশ) 

কামিলা ॥ একি এ দৈবের লীলা, কেন তুমি এই ঝুঁকি নিলে? 

মন্ট্রিায়াল ॥ (নতজানু) কামিলা! কামিলা! 

কামিলা ॥ বাবা যে-দুয়ার বন্ধ করে দিয়েছেন ঠেলে ফেলে 

কেন তুমি এলে! 

তুমি তার বধ্য প্রাণী এইখানে, 

তার ছুরি থেকে 

ভেবেছ কি বাঁচাবে নিজেকে? 

মন্ট্রিয়াল ॥ সুতনুকা, সেই সেতুপারাপার 

ভুললে কী করে শপথ, 

সন্ধ্যাতারা দ্যোতনার। 

সম্মুখে সেই অক্ষিলহরী! 

কামিলা ॥ পথ ছাড়ো! হায় বিধাতা, আমার 

হৃদয়ের দ্বারে একি হাহাকার! 

মন্ট্রিয়াল ॥ প্রিয়তমা দেখো বন্য আগুন 

রক্তাভ, মুখে প্রতিচ্ছুরিত। 

তোমার দরদী অচেনা এখন। 

যে তোমার বুকে আশ্রয় নিত? 

কামিলা ॥ তাকাব না, নেই সেই অধিকার আর 

তাহলেই হবে প্রত্যয় সংহার 

হা এই হৃদয়, বিচুর্ণ তার দশা। 

কখনো হব না, তোমার দৃক-পরশ। 

মন্ট্রিয়াল ॥ দেখছো না পায়ে বিনতি রেখেছি এই, 

দুর্গত দিনমণি, ফেরাবে যখন ও হৃদয়, ও আকাশ। 

আমাকে ফিরিয়ে দেবে ঠিক তক্ষুনি। 

কামিলা ॥ এ হৃদয় একাকার, 

অচেনার মতো রইতে পারিনে আর, 

প্রেমিক আমাকে জয় করে নিল আবার, 

আমি চিরদিন তোমার। 

দু’জনে ॥ জয় প্রত্যয়, জয় সংরাগ জয়। 

থাকুন না ঘিরে ষড়যন্ত্রের গতি 

আকাশ ধূসর, তাতে কিবা আসে যায়, 

একজন হয় অন্যজনের যদি। 

এমন কি গোটা এই দুনিয়াটা যদি 

আমাদের নিয়ে অকথা-কুকথা বলে 

আমরা যখন দু’জনকে ঘিরে থাকি 

আমাদের তারা তলাবেনা ঘোলাজলে। 

কামিলা ॥ দয়িত আমার, পথে-পথে এত লোক। 

মেতেছে কীসের টানে? 

দয়িত আমার, আমার জনক 

— বলে দাও— কোন্‌খানে? 

মন্ট্রিয়াল ॥ হও ভয়হীন, তাঁর কিছু ঘটবে না! 

অভিজাত বন্ধুদের সঙ্গে তিনি। 

শলা আঁটছেন কী করে পালানো যায়, 

ট্রিবিউন হানে, গণসংকীর্তন। 

তঁকে ঘিরে খুব। 

তিনি বিদ্যুৎগতি, 

সতীর্থজন ঠাহর করার আগেই 

এসে দাঁড়ালেন নগরতোলা মুখে। 

পরিকর নিয়ে তিনি এক্ষুনি এসে 

নিরাপত্তায় তোমাকে নিয়ে যাবেন। 

হেরো, দলবল উতরোল উল্লাসে, 

মন্দ্র বিষাণ, নিশান ওড়ে আকাশে, 

তিনি নিজে তার স্মিতকেশ নিয়ে আসেন। 

তোমার সকাশে— এইবারে আমি যাই! 

কামিলা ॥ পালাও পালাও সেই ভালো দরদিয়া, 

দুরুদুরু কেন কাঁপাবে তোমার হৃদয়, 

তোমাতেই আমি সঁপেছি আমার হিয়া 

বাসনা আমার তোমাতেই এসে জিরোয়। 

মন্ট্রিয়াল ॥ শুভ প্রস্থান! বিদায়! সুকল্যাণী! 

সাক্ষী থাকুন ঠাকুর-দেবতা যতো, 

একবার ফিরে আসবই, তোমাকেও 

রাজ্ঞী, বাড়িতে নিয়ে যাব রীতিমতো। 

আমারে ঘিরেছে মহাকল্পনা যতো 

নিজেরে করেছি অর্পণ তারি মোহে, 

তুমি বসে রোম-রাণীর সিংহাসনে 

করেছি তোমাকে নিজ হাতে উথিত। 

কামিলা ॥ আমি তো তোমার রমণী নিঃসহায়, 

এই ভেবে তবু পুলক জেগেছে চিতে 

আত্মা শরীর যদি সঁপে দিতে পারি। 

সেই তো আমার ভাগ্য এ ধরণীতে দু’জনে 

জয় প্রত্যয় জয় সংরাগ জয়। 




প্রথম অঙ্ক। তৃতীয় দৃশ্য। 

(জনতা মঞ্চের দিকে বাহিত হয়ে পটভূমিতে নিজেকে বিন্যস্ত করে নেয়। সামনে ক্ষুব্ধ কোরাসদল নিয়ে বাতিস্তা। জয়যাত্রার দৃশ্য)। 

গণকোরাস ॥ জয় রিয়েন্‌ৎসি, পিতৃভূমির পিতা। 

জয় ট্রিবিউন! জনতাকে দিলে মুক্তি! 

(মিছিল গড়ে উঠতে থাকে) 

বাতিস্তা ॥ এল পরদেশী ফৌজ সঙ্গে নিয়ে। 

হতে চায় গণজনক! বাঁদরামি এ 

আপন দেশের মানুষকে যে-বা ডরায়। 

তার কৌতুক নিছক ক্ষণস্থায়ী। 

গণকোরাস ॥ জয় ট্রিবিউন! জনতাকে দিলে মুক্তি! 

জয় রিয়েন্‌ৎসি! পিতৃভূমির পিতা। 

বাতিস্তা ॥ মজা গড়াবে না আজ বেশি দূর। 

ভাঙন ঘনালে হবেন চতুর! 

ক্ষুব্ধ কোরাসদল ॥ পরদেশী ফৌজ, নিপাত যাও 

ট্রিবিউন যাও নিপাত যাও। 

জননীপীড়ক তোকে শাপ দিই 

দেবলাঞ্ছক, কলঙ্কমতি! 

ভিনদেশী দল সাথে নিয়ে ধাও উধাও হও। 

গণকোরাস ॥ জয় ট্রিবিউন জয় 

জাতির জনক হোক পরমায়ুময়! 

বাতিস্তা ॥ দেখো কী রকম উৎফুল্ল সে তাকায় 

মজাখানা তার উৎরেছে ভেবে ডগমগ 

অহংকারে পড়ে না মাটিতে 

এ এক আজব রগড়; 

ফাঁসিকাঠে দেবে ঝুলিয়ে সে আমাদের – 

তবু জেনে রেখো 

জনতার ঘটে বুদ্ধি ঘনালে শেষে 

ও গর্ব যাবে ভেসে! 

গণকোরাস ॥ জয় ট্রিবিউন জয় 

জাতির জনক হোক পরমায়ুময়! 

(রিয়েন্‌ৎসি মঞ্চবেদীর উপর) 

রিয়েন্‌ৎসি ॥ আবার তোমাদের নিকটে চলে আসি, 

মহান্ রোমবাসী! আবার চোখে দেখি। 

শুদ্ধিময় যতো নগর রাজধানী। 

মঞ্চ শাশ্বত! ধন্য মানি এই অভিবাদনে আমি 

কৃতজ্ঞতা আমি ফিরিয়ে দিতে জানি। 

ঈশ্বরের নামে – 

চক্ষু মুখে রেখে- 

আমার পণ 

মুক্তি তোমাদের আমার জীবনের সাধনধন। 

মুক্ত সে মহান্ প্রাচীন রোম তার 

চূর্ণশেষ থেকে পুনর্জন্মের লভুক সম্ভার 

রোমের দ্যুতি যতোদিন না ফিরে আসে 

ঘেন্না ততোদিন আমার অবকাশে আমার অভিলাষে 

ধ্রুপদী সেই শোভা জগজ্জনতার 

সামনে উজ্জ্বল হোক পুনর্বার! 

ফিনিক্স যেরকম দীপ্যমান 

ভস্ম থেকে জাগে, 

জাগুক সেই মতো রোমের প্রাণ, 

প্রাচীন যুগ যেন আবার জেগে ওঠে অনশ্বরতায় 

বিশ্ব তাকে দেখে চম্‌কে যেন যায়। 

(গণকোরাস আগের মতোই স্তুতিময়) 

(পর্দা নামে) 





দ্বিতীয় অঙ্ক। প্রথম দৃশ্য। 

(রোমের দক্ষিণে পালেস্তিনা শহর। কোলোনার কক্ষ। দৃশ্যের সূচনায়, থেকে-থেকে দূর থেকে গোলাবর্ষণের শব্দ। কোলোনা, কামিলা)। 

কামিলা ॥ দোহাই বাবা জানাও সব ভিতরকার খবর, 

তোমার যতো বন্ধুজন শঙ্কাহত মুখ। পালায় কেন? 

শত্রুপক্ষের 

ঘনানো অবরোধের অধীর বারুদ বাড়ে আরো — 

আমরা বুঝি বিজিত আজ? সত্যি করে বলো। 

কোলোনা ॥ কামিলা শোন উতলা হোস কেন? 

নামমাতাল ওর্সিনি চায় আমার জায়গা নিতে 

নির্বাচিত নেতাকেই সে মানতে চায় না আর 

আমার কাছে দাঁড়িয়ে চায় আমরা মতো করবে হুকুম জারি 

আমিও কেন আমার দাবি ছাড়ি- 

তার ফলে এক ফারাক বাড়ে, মিটিয়ে নেওয়া যাবে না 

বুঝি আর।। 

ওর্সিনির ছেলেটি এসে মিনতি করে : ‘জনকবন্ধুরা, 

বিভেদ ভোলো, এবং বিশেষত 

বৈরী-ঘেরা এই মুহূর্তে সংহতিই জরুরি আমাদের। 

ঘটাব আমি মৈত্রী তোমাদের। 

কোলোনা, তোমার সুকন্যা সুন্দরী। 

দয়িতা আমার আমার ভার্যা হোক 

এ-এক অটুট পবিত্র বন্ধনী 

জাতকদের গড়া — এক করে দিক আবার তোমাদের, 

তাহলে আর পরস্পরের মধ্যে কোনো লড়াই বাধবে না। 



ওর্সিনি এই শুনে বলল : ‘আমি নারাজ নই, কিন্তু তুমি, কোলোনা, তুমি পিছিয়ে যেন যাচ্ছ মনে হয় – 

তাহা আমি নাচার কাল সদলবলে আমি, 

ট্রিবিউনের সকাশে গিয়ে মিটিয়ে নেব বিসংবাদ যতো! 

আমি দেখব কী করে তুমি টিকিয়ে রাখো তোমার 

নিজের ঘাঁটি। 

– বলে খালাস। এবার আমার কথা। 

কামিলা, তুই সূর্য ডুববার 

আগেই যেন ওর্সিনির সন্তানের বধূ 

হতে পারিস, তৈরি হয়ে নে, 

আমিও তাকে জানাই সম্মতি! 

কামিলা ॥ হা ঈশ্বর, কী করব এখন! 

কোলোনা ॥ মনে হচ্ছে ব্যাপারটাতে তেমন যেন তৃপ্ত নোস তুই 

আমিই কি খুব তুষ্ট, ভাবছিস! 

মহত্তর অলঙ্কারে সাজাব তোকে, ছিল এ-অভিলাষ 

খুদে কাউন্ট ওর্সিনির চেয়েও। 

যোগ্যতার রাজকুমার ভালোবাসায় তোর 

সত্যি যদি নিতে পারত ঝুঁকি, 

সেটাই হত আনন্দের – কিন্তু সেটা ঘটেনি, সুতরাং 

এ ছাড়া আর উপায় দেখছি না। 

কামিলা ॥ তবে তো সবি ধার্য হয়ে আছে, 

উৎসর্গের শিকার আমি একা, 

তোমরা পাবে শান্তি, সেই ধাঁচে 

শান্তি আমার চূর্ণ একাকার। 

ব্যাপারটা এই রকম দাঁড়াচ্ছে 

যে লোকটাকে ঘেন্নার চেয়েও 

ঘেন্না করি তাকেই বরসাজে 

দেখব আর দেব আমার দেহ। 

দোহাই পিতা, হয়ো না গররাজি 

তোমার জন্যে আমি 

জীবন দিতে রাজি 

ওর্সিনির ছেলেকে আমি কোনো শর্তেই মানব না স্বামিন্‌! 

কোলানা ॥ তোর কি আর বুদ্ধি নেই ঘটে? 

আমার রীতিনীতির। 

করিস্ বিকৃতি? 

এত সাহস! পাপিষ্ঠা! আমার আদেশ নে তুলে তোর মাথায়। 

কালিমা ॥ খবরদারি মন যা চায় করতে পারো জারি 

আমি আমার প্রতিজ্ঞার কাছে 

(আমার মনোনীত আমায় যাচে) 

বাগ্‌দত্তা নারী। 

কোলোনা ॥ স্বপ্নে ভেবেছিস আমি মন্ট্রিয়ালের হাতে তোকে 

দেব সঁপে? তাকে 

পাবার দুরাশা আজো মন থেকে দিসনি সরিয়ে? 

আমার জামাতা হবে মন্ট্রিয়াল! ভেবে যদি থাকিস তো ভুল! নারীঘাতী দস্যুকে কখনো 

চায়নি কোলোনা-কুল। 

কামিলা ॥ আমার প্রতিজ্ঞা। 

হয় যদি মিথ্যা 

তার আগেই আমাকে মৃত্তিকা 

অন্ধকারে লুপ্ত করে নিক। দয়িত আমাদের 

ছিন্ন করে এমন শক্তি কার 

দুঃখে যার প্রত্যয়ের ঘের। 

দেখবে সে ঠিক হাসির ঝিলিক অরুণরক্তিমায়! 

কোলোনা ॥ দেখেও দেখবি না তুই আমাদের জরুরি এ দশা? 

লৌহ পিণ্ডগুলি 

সমস্ত প্রাচীর উপড়ে ফেলে 

শত্রুদল আমাদের ঘিরে ধরে আরো, 

দেখেও দেখবি না তুই আমাদের নিয়তি প্রগাঢ়, 

যখন চুড়োর পরে চুড়ো 

শিখরশীর্ষের শেষে শিখরশীর্ষেরা গুঁড়ো-গুঁড়ো 

ঝড়ের সুযোগ নিয়ে অমিত্র সহসা ঢুকে পড়ে, 

কে তোকে বাঁচাবে বল্ শক্তির লাঞ্ছনা থেকে ওরে, 

বুনো সৈনিকের থাবা ছিঁড়ে-ছিঁড়ে নেবে তোকে নিষ্ঠুর নখরে। 

কামিলা ॥ মন্ট্রিয়াল — আমার প্রেমিক – সে-ই বাঁচাবে আমাকে, আসবেই। 

সে না এলে হাতে এই ছুরি আছে- 

বাঁচাবে আমাকে সব কলঙ্কের হাত থেকে। 

কোলোনা ॥ ওরা কি মন্ট্রিয়ালের লোক নয় যারা 

ট্ৰিব্যুনের কাছে গিয়েছিল? 

যারা আমাদের এই ঘোর বিপদের মধ্যে ঠেলে দিল 

চোখ থেকে অহরহ বিরতির শান্তি কেড়ে নিল — 

তুই সেই মন্ট্রিয়াল ছাড়া। 

নিবি না কারুক্কে মনে, এ কেমন অবাধ্য বেয়াড়া! 

কামিলা ॥ আমি তার কাছে রব চিরপ্রত্যয়িনী! 

কোলোনা ॥ তার মানে ভালো-মন্দ ভেদ ভুলেছিস। 

কামিলা ॥ যে কথা দিয়েছি আমি তার কাছে ঋণী। 

কোলোনা ॥ অলক্ষ্মী, এখান থেকে এখুনি চলে যা 

এই দর্প চূর্ণ করা সে দারুণ সোজা। 

কামিলা ॥ আমাকে শপথ ছেড়ে যেতে বলো নাকি। 

কোলোনা ॥ জেনে রাখ্‌, এই দিন যাবার আগেই — 

কামিলা ॥ নিছক ছলনা হবে আমার কথা কি? 

কোলোনা ॥ অচিরে বানাব তোকে শমিত জোনাকি। 

কামিলা ॥ এ অঙ্গার – কোলোনা। 

নির্বাপিত হতে নেই বাকি।। 

কামিলা ॥ এই ভালোবাসা – 

কোলোনা || দেবে নিজেকে বিলিয়ে।। 



কামিলা ॥ বিশ্বস্ততা এই— তার সঙ্গে যোঝা 

কোলোনা ॥ আমার পক্ষে তা ছেলেখেলা। 

কামিলা ॥ তেমনি আমার কাছে অসম্ভব আমার বিশ্বাস ভেঙে খেলা। 

কোলোনা ॥ যদি তার ফলে তোকে প্রাণ দিতে হয়। 

কামিলা ॥ জানি প্রাণ যাবে তাই এত নিঃসংশয়। 

ঘটে যা ঘটুক আমি বিশ্বাসের কাছে 

শাশ্বতী রয়েছি এই নিশ্চয়তা আছে। 

তার জন্যে মেনে নেব সব বিপর্যয়। 

কোলোনা ॥ জানি তোর প্রাণ যাবে, নেই পরিত্রাণ। 

কামিলা ॥ যায় যদি যাক যায় যদি যাক প্রাণ। 

কোলোনা ॥ সাঙ্গ করে দিবি তোর বিশ্বাসের পালা। 

কামিলা ॥ চিরদিন রবে এই প্রতীতি উজালা। 

কোলোনা ॥ আমার অনুজ্ঞা সে-ই অলঙঘ্য বিষয়। 

কামিলা ॥ আমার বিশ্বাস সে-ও লঙঘনীয় নয়। 

(গৃহভৃত্যের প্রবেশ) 

ভৃত্য ॥ প্রভু এক আগন্তুক এসেছেন। 

কী যেন জরুরি-কিছু কথা বলবেনই। 

নাম শুধু আপনাকেই জানাবেন তিনি। 

কোলোনা ॥ তাকে আসতে দাও। 

(ভৃত্যের প্রস্থান। মন্ট্রিয়াল টুপি আর ওভারকোট নিয়ে প্রবেশ করে। 

টুপিটাকে খুলে ওভারকোটটাকে পিছনে একপাশে সরিয়ে রাখে) 

কমিলা ॥ হা ঈশ্বর! দয়িত আমার! 

কোলোনা ॥ মন্ট্রিয়াল! কোত্থেকে পেলে এ ভবনে ঢোকার সাহস! 

তোমার সৈন্যরা আজ আমাদের বেষ্টন করেছে, 

আমাদের শত্রুদের সঙ্গৎ দিয়েছ বেশ জানি 

আমার কন্যাকে দিলে আরেক রাস্তায় হাতছানি 

কী চাও এখানে? 

মন্ট্রিয়াল ॥ কেন এত ধৈর্যহীন, অধমের বক্তব্য শুনুন। 

মনে পড়ে কীরকম অপমান করেছিলেন আমি যখন 

কামিলার করভিক্ষা করেছিলাম? 

এখন আমার এই প্রতিশোধ, যা মানায় বীরপুরুষেরে, 

যা তোমায় চারদিক থেকে ঘিরে আছে সৈন্যেরা আমার, 

তাদের বর্ষিত অগ্নি কাঁপায় তোদের এ নগরী। 

একবার তাকাই যদি বন্য গণজনতার তোড়ে ঠিক ভেসে যাবি তোরা, 

অবিশ্যি বাঁচাতে পারি যদি চাও, পালেস্ত্রিনা-র 

পতন হবে না তবে, তোমাদের নিয়ে যাব আমি 

প্রাচীন রোমের সেই দ্যুতিময় গরিমা সমীপে! 

কোলোনা ॥ তার মানে ট্রিবিউনকেই অস্বীকার, 

বিশ্বাসহনন। সেটা কোনো বীরোচিত কাজ নয় - 

এ ব্যাপারে আমার সামান্যতম মদৎ পাবে না। 

মন্ট্রিয়াল ॥ এখানে বিশ্বাসভঙ্গ কোথায়? 

আমি তো নেই, আমার ভাইয়েরা 

ট্ৰিব্যুনের অভিমুখে সেনানী পাঠিয়ে দিয়েছিল। 

তাদের এ কর্ম আমি সমর্থন করিনি কখনো! 

সেটা করব না আমি শর্ত এই : 

আমাকে দাও যা আমি অনায়াসে জিনে নিতে পারি! 

কোলোনা ॥ কোন্‌ শর্ত? 

মন্ট্রিয়াল ॥ রোমের সমস্ত জুড়ে হাজারো মানুষ যারা আমার। 

নির্দেশ শুনবে বলে আজ উৎকর্ণ হয়ে আছে। 

আমার জমিন নেই, তবু আমি ইতালি দেশের 

সবচেয়ে শক্তিশালী আজ। 

এসেছি তোমার কাছে, এই দাবি, রোমের প্রধান মঞ্চে 

যবে উদ্দীপিত যাব, তোমার কন্যাকে 

সিংহাসনে নীত করে নিয়ে যাব ভার্যা-ভূমিকায়! 

(কোলোনা-র দুশ্চিন্তিত পদচারণা) 

কামিলা ॥ বাবা আমি তোমাকে কি আগেই বলিনি 

আমার দয়িত এসে আমাদের বাঁচাবেই বাঁচাবে? 

আমি কি জানিনি, ও যে আমার দুর্দিনে 

অংশ নেবে আমার দুরূহ ভাবনায়? 

মন্ট্রিয়াল ॥ আমিই বা কী করে বলো তোমার দুর্দিনে 

ছেড়ে যাই তোমাকে ও তোমার পিতাকে! 

কোলোনা ॥ তবে তাই হোক। আমি ওর্সিনিকে ছেড়ে দিই, 

স্পর্ধা তার আমাকেই ঈর্ষা করে ভাব! 

ঘরবাড়ি নিয়ে সে ডুবুক; আমি উঠবই উঠব! 

পুত্র, নাও আমার কন্যাকে! হোক সে তোমারই হোক! 

রোমের মঞ্চটি তুমি তুলে আনো ভবনে তোমার। 



কামিলা, এবার অপগত হোক 

ক্রোধ কর্কশ ঘৃণা 

আকাঙ্ক্ষা তোর সুতৃপ্ত হোক - 

এখনো কি তুই চোখ মেলে তাকাবি না? 

কামিলা ॥ এভাবেই যতো যন্ত্রণা সন্ত্রাস 

থেকে কীরকম সংরাগ সঙ্কাশ। 

আমার হৃদয়ে স্ফুরিত এ অধিবাস 

অবিশ্বাস্য ভাগ্যের ইতিহাস! 

মন্ট্রিয়াল ॥ এতদিন ধরে ধিকিধিকি হায়। 

প্রত্যাশাহীন নির্ভরসায় 

ঘটে গেছে ক্ষতি, সেই অধ্যায় 

স্মরণ করতে কার মন চায়? 

কামিলা ॥ একি আনন্দস্পন্দিত দিন। 

মন্ট্রিয়াল ॥ একি উপহার বিস্ময়লীন! 

কামিলা ॥ দুঃখদিনের মহার্ঘ দান! 

কোলোনা ॥ পরস্পরের এ সম্প্রদান : 

হোক তোমাদের জীবন মহান্‌! 



(তিনজন সমবেত) 

হোক অপগত নিয়তির দিন 

প্রতিশ্রুতির আলোয় 

মহা-আগামীর দীপ্তি নবীন 

জানুক দৃঙ্খলয়! 

দীর্ঘদিনের এই সংগ্রাম। 

সন্তাপলাঞ্ছিত : 

শুদ্ধ প্রণয়বহ্নি জ্বলুক 

শাশ্বত শিখায়িত! 





দ্বিতীয় অঙ্ক। দ্বিতীয় দৃশ্য 

(রিয়েন্‌ৎসির বাড়ির একটি ঘরে। তার হাতে একটি কাগজ) 

রিয়েন্‌ৎসি ॥ ধিক্‌, বিশ্বাসঘাতী! জনতাকে আমার রাস্তা 

থেকে ভিন্‌পথে নিয়ে গিয়ে এই খল প্রতারণা 

বাহু থেকে স্বেদ বিদায়ী যেমন ঠিক সেই মতো 

ধিক্‌, বিশ্বাসঘাতকসমিতি! জনতা আমাকে 

মানলে তবেই ভবিষ্য হবে সমৃদ্ধ খুব; 

আমার জনতা, কতো না সয়েছি তাদের জন্যে, 

অভিশাপ, কারাযাতনা, নির্বাসনের জ্বলুনি, 

স্বেচ্ছাচারীর মাঝখানে গিয়ে তাদেরই জন্যে 

‘এইবারে থামো’, আমি — এই আমি — ব’লে কি উঠিনি? 



আমার জনতা, যতো হোক শাপমন্যি ঘনানো 

খারাপ সময়, কাপুরুষতাও, তুমি রবে ঠিক, তোমার হবেই দুর্দমনীয় পুনরুত্থানও, 

দৃপ্ত বিজয়ী তোমরা অনমনীয় নাগরিক! 



জানো না কি কতো পীড়ন কতোই 

যন্ত্রণা আমি তোদের জন্য 

বহন করেছি, আর সেই কথা 

তোদের এখন জানা বুঝি নেই? 

দীর্ঘ দীর্ঘ বছর কেমন 

কাঁটার ভিতরে অটুট পা রেখে হাঁটলাম, 

কোনো অভিনন্দন কখনো পাইনি তোমাদের থেকে! 

চেয়েছি রোমকে মুক্ত করব 

বিবাদের সেই বিজিত শিকার : 

নতুন রাঙাব প্রাচীন গর্ব 

অর্থহীন কি এ অঙ্গীকার? 

দেখাও প্রাচীন রোম নিজস্ব 

গরিমায় নিজ মূর্তি 

তুমি তো সমাধি রাত্রে পরমতৃপ্ত 

দেখেছি, এবার উত্তিষ্ঠত 





দ্বিতীয় অঙ্ক। তৃতীয় দৃশ্য 

(কোলোনার প্রাসাদ। নৈশভোজের বর্ণাঢ্য আয়োজন। 

মন্ট্রিয়াল, বাতিস্তা, অতিথিদের কোরাসদল) 

মন্ট্রিয়াল ॥ আসুন, শুরু হোক আকাঙ্খার 

ট্রফি, এ রজনী অন্ধকার! সময় নিয়ে এই দুর্ভাবনা 

পাত্রে যতোক্ষণ সুরা-বাহার! 

কক্ষ ঘুরে-ঘুরে ধ্বনিত হোক সুর। 

যতোক্ষণে ভোর রঙোৎসার! 

কোলোনা ॥ আসুন, হাতে-হাতে সুরা-আধার। 

স্বর্ণাসব এই পান করুক 

পাত্র ভরে আছে প্রান্ত ছুঁয়ে 

হৃদয়ে এনে দেবে তেজি আগুন! 

কক্ষ ঘুরে-ঘুরে ধ্বনিত হোক সুর 

যতোক্ষণ খোলে ভোরের দ্বার! 

বাতিস্তা ॥ আহা, এ যেন গান, কে গায় গান! 

মন্ট্রিয়াল ॥ ওরে কিশোর, দে তো ঈষৎ সুর। 

অনুমতি করুন, একটি প্রোভোশাল-গানের ধুয়ো 

আমার উপভাষার ঢঙে আপনাদের গেয়ে শোনাই 

মহান ত্রুবাদুর রচিত এই গান। 



(একটু পরেই একটু প্রণয়গীতি শোনা যায়) 



বাতিস্তা ॥ আসুন নারীদের স্বাস্থ্য পান করি! 

কোরাস ॥ বাঁচুন রমণীরা পরমায়ুষ্মতী! সুরার ঝলকানি 

তাঁদের মোহ যেন সরিয়ে নেয় না হে, 

বাঁচুন রমণীরা আয়ুর ঈশ্বরী! 

মন্ট্রিয়াল ॥ ওহে সেবক ঢালো এখানে মদ আরো 

যীশুর নামে সেই পাহাড়ি-মদ জানো? 

তাহলে আনো তার সারাৎসার 

এখানে পান হবে, পানের গানও 

কোরাস ॥ বাঁচুন রমণীরা পরমায়ুষ্মতী! সুরার ঝলকানি 

তাঁদের মোহ যেন সরিয়ে নেয় না হে, 

বাঁচুক রমণীরা আয়ুর ঈশ্বরী! 

(নগরতোরণ থেকে জুপিটার মন্দিরের ঘণ্টা বেজে ওঠে) 

বাতিস্তা ॥ হঠাৎ কী ব্যাপার। ঘণ্টা বাজে কেন? 

মন্ট্রিয়াল ॥ কিছু না, ধুত্তোর, মিথ্যে পাতো কান। 

জমুক ধুমধাম খুশির কলতান। 

বাতিস্তা ॥ মান্যবর, এই মদ্য আপনার এবং যতো 

মানীর উদ্দেশে এবার পান করি বশংবদ 

অচিরে ভবদীয় প্রচেষ্টায় 

ট্ৰিব্যুন-প্রভু যেন অক্কা পায় 

ধ্বনিত হোক আজ আমার এই ধ্বনি কক্ষময়। 

মন্ট্রিয়াল জয়-দিগ্বিজয়! 

কোরাস ॥ ধ্বনিত হোক আজ বৈতালিক যতো কক্ষময় 

যাঁর এই ভোজসভা সেই 

মন্ট্রিয়াল জয় বিজয় জয় জয় দিগ্বিজয়! 

(বাইরে সন্ন্যাসীদের স্তোত্রগান) 

প্রভু দাও ওদের অনন্ত স্থৈর্য 

পড়ুক ওদের ঘিরে 

চিরন্তনের রশ্মি! 

মন্ট্রিয়াল ॥ বন্ধুগণ! থমকে গেলেন কেন? 

সন্ত ওরা, ইনিয়ে-বিনিয়ে মরে মৃত্যু আর গোরস্থান নিয়ে, 

আমাদের ঘিরে তবু জীবন রয়েছে ঝলমলিয়ে - 

(সন্ন্যাসীদের স্তোত্রগান। মাঝে-মাঝেই ‘ক্রোধের এই দিন’ 

‘শোকের এই দিন’ ইত্যাদি অংশ শোনা যাচ্ছে) 

ধন্যবাদ বন্ধুগণ 

সমবেত আনন্দের বানে 

নিমজ্জিত করে দিন সন্ন্যাসীদের আর্তনাদ 

শাশ্বত নগরী রোম দীর্ঘজীবী হোক 

কোরাস ॥ শাশ্বত নগরী রোম দীর্ঘজীবী হোক 

পান করা যাক। 

(বাইরে সন্ন্যাসীদের স্তোত্র চলতে থাকে। ‘প্রভু তুমি পুণ্যময়/ 

লুপ্ত করে দিয়ো না আমাকে/ ঐ দিনে’ ইত্যাদি অংশ শোনা যায়) 

মন্ট্রিয়াল ॥ ট্রিবিউনের ধ্বংস হোক উপলক্ষ্য এই পানীয়ের। 

বিশ্বাসঘাতী সে, ও যে জনতার ঘাম 

খরচ করেছে তার প্রাকারের স্বার্থের শোভায়! 

ঘনাবে প্রতিশোধে প্রহর সে জানবার আগেই 

ঘটুক পতন তার! 

কোরাস ॥ সিংহাসন থেকে তবে যাক খসে যাক ট্রিবিউন 

বিশ্বাসভঙ্গের মাইনে অর্জন করুক। 

(দরোজায় তিনবার করাঘাত। সবাই শঙ্কিত) 

মন্ট্রিয়াল ॥ ঢুকে পড়বি যদি পড়্‌, অবাঞ্ছিত অতিথির দল 

(রাজবেশে ট্রিবিউনের প্রবেশ। সশস্ত্র পরিকরবর্গ পিছনেই) 

রিয়েন্‌ৎসি ॥ বাহবা, বাহবা মন্ট্রিয়াল, 

নগরমন্দিরে ঘণ্টা, পুরোহিতদল এসে স্তোত্রগানে মেশায় তোমার 

ভাইদের হত্যার খবর, আর উৎসব তখনই, 

তাহলে সবাই শোনো, শোনো ওই তীব্র সমাচার! 

কোরাস ॥ এখন বিচারকের বিবমিষা শুরু হল ব’লে। 

রিয়েন্‌ৎসি ॥ তোমাদের ঘনাল প্রহর 

ও নির্ধারিত বিশ্বাসহত্যার জন্যে মাইনে পাবে কে কতো মোহর। (মন্ট্রিয়াল আর বাতিস্তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হল। পর্দা নেমে আসে) 





তৃতীয় অঙ্ক। প্রথম দৃশ্য 

(নিনা রুদ্ধশ্বাসে ঢুকে পড়ে) 



নিনা ॥ মাতা মেরী, বাঁচাও আমাকে, 

ত্রাণ করো স্বর্গের জনক, 

উত্তেজিত জলোর্মি কেমন 

পথে পথে হন্যে হয়ে ধায় 

গরগর গর্জন-তর্জন। 

হরবোলারা নাম ধরে হাঁকে 

এদিকে এগিয়ে আসতে চায়, 

আমাদেরই প্রাসাদের দিকে 

পথ করে নিয়েছে ওরা দেখো! 

বন্য এক আক্রোশের বশে 

আমাদের হানে ঘূণ্য দশা। 

ঘটাবেই বিষম সংহার 

পাকে পাকে ফেনিল জনতা 

আমাদের দিকে ধেয়ে আসে! 



মাতা মেরী পারমিতাময়ী 

করো ত্রাণ করো আমাদের। 

ছায়াঘন ডানার বিথারে 

আবৃত করুন আমাদের 

যতো দেবদূত শঙ্কাহত। 

এ মিনতি, ওই কুঁড়েঘরে 

নামো আমাদের ত্রাণ করো 

জনতার অন্ধ ক্রোধ থেকে 



ক্রমেই সমীপে ছুটে আসে 

জনতার ঘূর্ণীস্রোত ঐ 

উঠে যায়, উঠে ঘুরে যায়, 

চতুৰ্ধারে অসি ঝল্‌কায় 

একরাশ বর্শার ফলক 

ঝলে ওঠে রশ্মির আভায়। 



ক্রমেই ঘনায় শক্তিশালী 

মৃত্যুবাহু আমাদের ঘিরে, 

মেরীমাতা! ভুবনদেবতা! 

বাঁচাও এ গ্লানির তিমিরে। 

(রিয়েন্‌ৎসির প্রবেশ) 

রিয়েন্‌ৎসি ॥ যা হবার তাই হল, আগে কিন্তু এমন ভাবিনি! 

জনতা উদ্যত আজ বিপক্ষে আমার, 

মন্ট্রিয়ালের আর বাতিস্তার মৃত্যুর সংবাদে 

প্রতিস্পৃহাতুর! 

নিনা ॥ হারিয়েন্‌ৎসি, মহার্ঘ্য-আমার! 

আমাদের চতুৰ্ধারে ঘনাল আঁধার। 

রক্ষা করো তোমাকে-আমাকে। 

রিয়েন্‌ৎসি ॥ শান্ত হও, রমণী আমার! 

এখনো সংকট ততো ব্যাপ্ত নয়; 

আমার তারুণ্যশক্তি অটুট এখনো 

দৃপ্তধী, দাঁড়াব আমি জনতার ঐ 

অগ্নিবর্ষী প্রবৃত্তির মুখোমুখি গিয়ে 

অহংকারের স্পন্দে, দ্বিধা করব না! 



এখনো আমার চোখ অশনি-অসিত 

নির্মল ললাটে কোনো ভাজ পড়েনি তো 

আমার ভাষার শক্তি তীক্ষ আর দ্রুতগ এ অসি – 

আমি অশঙ্কিত! আসে তো আসুক ঝড়— 

আমি ঠিকই আছি, 

বসিয়েছি নিজেকেই রাজসিংহাসনে, 

এবং আসীন আজো, যদি কেউ বাদ সাধে। 

আমি তার উষ্মা খুব প্রশমিত করে দিতে জানি! 

নিনা ॥ এখনি চলো পালিয়ে যাই, তোমাকে অনুরোধ, 

তবেই শুধু পরিত্রাণ ওদের ক্রোধ থেকে 

এবার শুধু একটিবার, রিয়েন্‌ৎসি আমার 

মিনতি শোনো, পালিয়ে যাই চলো নিরুদ্বেগে। 

রিয়েন্‌ৎসি ॥ কাপুরুষের মতো আমি পালাব কখনো? কখনো না। 

নিনা ॥ এখনো আছে সময় চলো পালিয়ে যাই, শোনো। 

রিয়েন্‌ৎসি ॥ মৃত্যু যদি আমাকে এসে ভয় দেখায় তবু 

সুদৃঢ় আমি দাঁড়াব তার বিরোধীপক্ষেই! 

নিনা ॥ চলে এসো মূর্খ মূঢ় জনতা কখনো 

এত বড়ো উৎসর্জনের যোগ্য নয়। 

রিয়েন্‌ৎসি ॥ যদি-বা নিয়তি নামে আমার উপরে 

আমার মরণ যেন জগতের কানে 

শোনায় : রোমের অনন্য পরমতা 

ধ্রুব লক্ষ্য ছিল রিয়েন্‌ৎসির ধ্যানজ্ঞানে 

নিনা ॥ তাহলে যাবে না তুমি, স্বামিন্‌ আমার 

আমিও তোমাকে ছেড়ে যাব না, সংসারে 

যেমন সৌভাগ্য দিনে পাশে দাঁড়িয়েছি 

সঙ্গ দেব দুর্ভাগ্যের করাল আঁধারে। 

রিয়েন্‌ৎসি ॥ ঘরণী আমার এসো হৃদয়ে আমার 

যদি জীবনের লক্ষ্য অকৃতার্থ থাকে 

উদ্যমের পুরস্কার স্বর্গীয় আনন্দ 

তোমার ভালোবাসায় ছুঁয়েছে আমাকে! 

নিনা ॥ আমার মহার্ঘ্য, দৃঢ় শক্তিশালী তুমি। 

সকলের মাঝখানে আশ্চর্য অপার, 

তোমার বাহুর ঘেরে বুঝেছি এখন 

কী-এক সৌভাগ্য কাঁপে সত্তায় আমার। 

দ্বৈত ॥ আমরা দু'জনে দৃষ্টির উদ্ভাসে 

পরস্পরের স্পন্দে ওতপ্রাতো 

যথার্থ ভালোবাসায় অনুসৃত 

এড়াব সকল নিয়তির দুর্দশা! 

বাহিরে যখন মৃত্যুর সন্ত্রাস 

অসি-ছুরিকার আগুনের খুব ভয় 

আমাদের ওই সংহতি দৃঢ় করে 

প্রতিটি সুদিন, প্রতিটি দুঃসময়। 





তৃতীয় অঙ্ক। দ্বিতীয় দৃশ্য 

(নগরতোরণের মুখোমুখি, কামিলা, খোলা তার চুল, হাতে ছুরিকা) 



কামিলা ॥ তাহলে তাকে আসতে হল ঠিকই 

দীর্ঘায়ত প্রতীক্ষার ধন 

প্রতিশোধের প্রহর ঝিকিমিকি 

করেছি যাকে হৃদয় নিবেদন! 

প্রতিশোধের প্রহর ধিকিধিকি! 

নিহত প্রেম সেদিন হায় তোমার 

রক্ত যেমন অঝোরে ঝরেছিল, 

সেইভাবে আজ ঝরবে তার শোণিত 

এবং আমিই কারয়িত্রী, সেটা 

আপন হাতে করব চিহ্নিত 

নিহত আজ আমার প্রেমিক, জানি 

জ্বলুক তবে ঘৃণা আমার খুব, 

স্বেচ্ছাচারীর রক্ত পিপাসায় 

আমার ওই শুষ্ক তরবারি 

রক্তঘামে উঠুক আজ নেয়ে 

ভার্যা নই, করাল নারী আমি 

ওটাই হোক, আমার পরিচয় 

এবার আমি লৌহ ছুরিকায় 

ছিন্ন করে দেবই তার শিরা 

বিশ্বাসের ঘাতক যে আমায় 

প্রেমকে কেড়ে ঘা দিল আমাকেই! 

পালাক যতো মেদুর মমতার 

নারীত্বের কোমল সংস্কার 

এবার শুধু শাস্তি, এইবার 

প্রতিশোধের আস্পৃহা আমার! 



হয় যদি তোক আমার খুব পাপ 

উত্তেজিত জনতা রীতিমতো 

মেতে রয়েছে, 

করব তাকেই রূপায়িত আগুনে একাকার 

এই তো আজ আকাঙ্ক্ষা আমার! 

সিংহাসন থেকে রিয়েন্‌ৎসির 

পতন হোক, সমাধি আছে স্থির 

তোমার জন্যে, তুমি আমার প্রেমিক 

কেড়ে নিয়েছ, মুক্তি নেই তোমার! 

(সমবেত জনতার উদ্দেশে) 

প্রতিশোধ চাই, প্রতিশোধ! 

স্বৈররাজ শেষ হয়ে যাক, 

তার কর্ম শুধে দিতে হও 

বুরুজের চৌদিকে চড়াও 

মুঠোয় পেয়ে ছেড়ে দিয়ে না তাকে 

সজ্জিত ভবন থেকে ছিড়ে 

এইখানে আনো রুধিরাক্ত 

শেষ তার হোক শোচনায়! 

কোরাস ॥ প্রতিশোধ চাই প্রতিশোধ! 

কামিলা ॥ ঝরুক তার পাপবোঝাই মাথায় 

শাপ-শাপান্ত, মৃত্যু এখন তবে — 

স্বাধীনতা সে হরণ করেছিল 

এবার তাকে হিসেব দিতে হবে। 



শঙ্কাহত বিশ্বাসঘাতক 

আছড়ে মরুক সবার পদতলে 

তার কুকাজের অন্ত নেই কোনো 

রাঙা রক্ত বহাক তার ফলে। 

কোরাস ॥ প্রতিশোধ চাই প্রতিশোধ! 

(রিয়েন্‌ৎসির প্রবেশ, পিছনে নিনা)। 

রিয়েন্‌ৎসি ॥ রোমের সুভদ্র নাগরকিবৃন্দ, আপনারা কেন 

এভাবে সশস্ত্র হয়ে এসেছেন 

দুর্গের তোরণমুখে? 

আমি তো আপনাদেরই নির্বাচিত, 

আমাকে বিশ্বাস নেই আর? 

এই রাজপ্রতীক তো আপনারা 

সবাই আমাকে দিয়েছেন! 

কী অন্যায় করেছি, বলুন। 

আমার কর্মের বৃত্ত পূর্ণায়ত করার সময় 

দিন আমাকে; রোমের প্রাচীন কীর্তি পুনরুদ্ধারের ভার; 

আপনারা যেন স্বরচিত আইনের অধিকারে 

তামাম দুনিয়াটার মালিক হতে পারেন, তাই 

আমি চাই। তবে কেন শোনেন অলীক অপবাদ, 

আমার কাজেরই মূল্যে আমার বিচার করবেন। 

কামিলা ॥ কান দিয়ো না মিথ্যাবাদীর ভাষায়। 

লক্ষ্য যেন ছলকিয়ে না দেয়। 

স্বাধীনতার গরজে প্রতিশোধ 

নিতেই হবে স্বাধীনতার দায়ে 

(জনতা রিয়েৎসর দিকে এগিয়ে যায়) 

নিনা ॥ ঈশ্বর! ঈশ্বর! 

রিয়েন্‌ৎসি ॥ শয়তানেরা, দূর হয়ে যাও চোখের সামনে থেকে! 

নিনা ॥ আমার চোখের জল তোমাদের স্পর্শ করছে না! 

কামিলা ॥ এই তো বিজয়! প্রতিশোধের নেশায় 

আগুন উঠল হিলহিলিয়ে জ্ব’লে। 

কোরাস ॥ স্বাধীন সত্তা হরণ করেছিলে 

এবারে তাই প্রতিশোধের পালা 

নিনা ॥ যাকে ভাঙিয়ে সুদিন তোমাদের 

তোমরা আজ ঝরাবে লোহ তার? 

চাও যদি তো আমার রক্ত নাও 

আমারি হোক শুদ্ধি-অনুতাপ! 

কামিলা ॥ এখন শুধুই প্রতিহিংসা, দয়া 

নিজেকে ক’রে নিয়েছে প্রত্যাহার! 

নিনা ॥ একবার দেখো আমার দারুণ দশা। 

ভাবো কী করেনি তোমাদের জন্যে সে! 

কামিলা ॥ রোমের মানুষ, কী করে ভুলবে বলো। 

কতো যন্ত্রণা তোমাদের দিয়েছে সে! 

কোরাস ॥ যতো যন্ত্রণা আমাদের দিয়েছে সে। 

সমস্ত কিছু মনে আছে আমাদের! 

নিনা ॥ করুণা! করুণা! 

কামিলা ॥ প্রতিশোধ! খুন! 

নিনা ॥ ঐ শিরোদেশ ক্ষুন্ন কোরোনা। 

কামিলা ॥ স্বৈরী ছিনিয়ে নিয়েছে মুক্তি 

নিজের রক্তে শোধ করে দিক। 

কোরাস ॥ মুক্তি ছিনিয়ে নিয়েছে স্বৈরী 

প্রতিশোধ নিতে আমরা তৈরি! 

নিনা ॥ উন্মাদ এই আগুনের দাহ। 

শুভবুদ্ধিকে এখনো বাঁচাও! 

কামিলা ॥ জনতার ক্রোধ জুলন্ত অঙ্গার 

তারি দাহে হবে জীবন সাঙ্গ তার। 

নিনা ॥ করুণা! করুণা! 

কামিলা ॥ প্রতিশোধ! খুন! 

নিনা ॥ মমতা! মমতা! 

কামিলা ॥ শুনো না এ-কথা। 

কোরাস ॥ বিশ্বাসঘাতী, প্রতিশোধে রাজি নোস? 

কী করে এড়াবি আমাদের আক্রোশ? 

(সমাপ্তি) 







নাট্যকোলাজ, অন্য ধারার নাটক 
সুনীল দাশ 


গত শতাব্দীর আটের দশক সংবর্ত গ্রুপ থিয়েটারের কাছে ছিল নাট্য কোলাজের দশকের সূচনা। আলোকরঞ্জনদা - কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, সেদিনের কলকাতা তথা বাংলা থিয়েটারের বহতা ধারায় নতুন এক নাট্য প্রযোজনা ঘারানার গোড়াপত্তন করেছিলেন 'নাট্যকোলাজ'। 

গদ্য ও পদ্য সংলাপ উচ্চারণ, আবৃত্তি, অভিনয়, একক, দ্বৈত এবং সমবেত কণ্ঠে গান ও বাদ্য সংগীত, আলোক চিত্রের স্থির ও চলচিত্রের ব্যঞ্জনা বা বিভাবিত দেহছন্দের সুষমা, নৃত্য নির্মাণ, ভাষ্য এবং কোরাস বলয়ের আবর্তন - আঠা দিয়ে কেটে কেটে ছবি জোড়ার মতো এক শিল্পায়িত মঞ্চ সঞ্চালন - নাট্য অভিঘাতে - হল নাট্যকোলাজ-অলোক রঞ্জন দাশগুপ্তের রচনা 'আলো, আরো আলো' নাট্য প্রযোজনায়, যার উদবোধন জাতীয় গ্রন্থাগারে। য়োহান হ্বোলফ্‌গাঙ ফন গ্যোয়েটের লেখা 'ফাউস্ট' নাটকের আদ্যপ্রান্ত জার্মান থেকে বাংলায় ভাষান্তর নয়, 'আলো আরো আলো' ফাউস্টের নির্বাচিত অংশের অনুসৃজন। 

১৯৮২তে একটি নয়, দুটি নাট্যকোলাজ সংবর্ত গ্রুপ থিয়েটারের প্রযোজনার জন্য লিখেছিলেন অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। প্রথমটি তিন চরিত্র- ফাউস্ট, গ্রেটশেন বা মার্গারেট এবং মেফিস্টোফিলিস-কে নিয়ে 'আলো আরো আলো'। দ্বিতীয় নাট্যকোলাজটির নাম 'গ্যোয়েটের জীবনশিল্প'। প্রথমটিতে শান্তনু গঙ্গোপাধ্যায়, সুদেষ্ণা রায় আর অনিমেষ গঙ্গোপাধ্যায় অভিনয় করলেন এবং দ্বিতীয়টিতে সৌমেন ভট্টাচার্যের সঙ্গে সংবর্ত গ্রুপ থিয়েটারের অন্যান্য অভিনয় শিল্পীরা। দুটি নাট্যকোলাজ প্রযোজনাতেই আবহ সঙ্গীত রচনা করেছিলেন সেই সময়কার কলকাতা গ্যোয়েটে ইন্‌স্‌টিটিউট ম্যাক্স ম্যূলার ভবনের ডিরেক্টর হান্‌স্‌ য়্যুর্গেন নাগেল। 

শ্রীযুক্ত নাগেল আমার সামনে দ্রুপদী জার্মান সঙ্গীতের অনন্ত ভুবনের প্রবেশ দ্বার খুলে দিয়েছিলেন সেই দশক জুড়ে একের পর এক প্রতিভাদীপ্ত জার্মান কবি, নাটককার ও বিপ্লবীদের জীবন ও শিল্প নিয়ে নাট্য কোলাজের সুরের ভুবন গড়ে তুলতে। বেটোফেন, মোৎসার্ট; হ্বাগনার শুলৎস্‌, হেন্ডেল, প্রমুখ সুর সাধক থেকে শুরু করে একালের যশস্বী জার্মান সঙ্গীতবিদ্‌ অবধি সঙ্গীত ঐশ্বর্যের নিরন্তর নির্যাস অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের প্রতিটি নাট্যকোলাজ পাণ্ডুলিপির অনিবার্য অন্তরং হয়ে উঠেছিল। প্রচলিত থিয়েটার স্টেজে নয়, আলো আলো আরো আলো'র উদ্বোধনী অভিনয় জাগীয় গ্রন্থাগারের মতো 'গোয়েটের জীবন শিল্প এর প্রথম অভিনয় হয়েছিল কলকাতার শেক্সপিয়র সরণীর অরবিন্ধ ভবনে শ্রোতা দরসসশক পরিপুর্ন সমাবেশ। ১৯৮২ এর ২৩ আগস্ট ছিল নাট্যকোলাজ ' আলো আর আলো সুচনা অভিনয়। এর এগারো দিন পড়ে, বারো দিনের মাথায় ৪ সেপ্টেমব্র ১৯৮২ তে প্রযোজনা শুরু হলো গ্যোয়েটের জীবন ও রচনা নিয়ে ভিন্ন ধারার নাট্য নিবেদন' গ্যোয়েটের জীবনশিল্প। 

ওই সময় প্রতি বছর নিয়ম করে প্রায় জার্মানির হির্শবার্গ থেকে বেশ কিছুদিন সময় হাতে নিয়ে অলোকদা সস্ত্রীক আসতেন কলকাতায়। তখন মাঝে মধ্যে কলকাতার ম্যাক্স ম্যূলার ভবনের ৮ নম্বর প্রমথেশ বড়ুয়া সরণীর তিন তলার অডিটোরিয়ামে সংবর্ত গ্রুপ থিয়েটারের নাট্যকোলাজের মহড়ায় অলোকরঞ্জনদার পাশে আমাদের নিরন্তর প্রেরণাদাত্রীর ভুমিকায় উপস্থিত থকতেন ট্রুড বার্টা বৌদি। ট্রুড বার্টা বৌদির ভূমিকা নিছক নিস্ক্রিয় নীরব দর্শক শ্রোতার ছিল না, নাট্য কোলাজগুলোর জার্মান চরিত্রদের রূপারোপের পোশাক বিন্যাশ থেকে শুরু করে দৃশ্য রচনায় নানান সরঞ্জামের ড্রয়িং, পেপার কাটিং, ফোটোগ্রাফ, টুপি, ছড়ি ইত্যাদি হরেক রকমের টুকিটাকি দিয়ে পাশ্চাত্য পরিমনণ্ডল গড়তে ট্রুড বার্টা বৌদির আগ্রহ ছিল আমাদের ভরসা। 

পরের বছর, ১৯৮৩-এর সেপ্টেম্বরে প্রথম দিনেই এম.এম.বি. মঞ্চে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের পাণ্ডুলিপি থেকে নিবেদির হল কেবল মাত্র কবিতা দিয়ে বোনা নাট্যকোলাজ- হাইনরিশ হাইনের কবিতার দৃশ্যময় মঞ্চায়ন - 'প্রেমে পরনা সে'। এই নাট্য কোলাজে নৃত্যরূপকে পরিপূর্ণ প্রয়োগ না করে আবৃত্তির ছন্দময়তার সঙ্গে সংগতি রেখে অভিনয় শিল্পীর সেই ছন্দ বিজ্ঞানকে বাঙ্ময় করে তোলা লক্ষ্য হয়ে উঠেছিল এর খণ্ড খণ্ড দৃশ্য বিভায়। ‘দাঁড়িয়ে ছিলাম মাস্তুলে দিয়ে ভর। এবং প্রতিটি প্রহর গুণ ছিলাম'-এর কবির জীবনরেখার চলন এগিয়ে শুভাশিস ভট্টাচার্যের কোরিওগ্রাফি হয়ে উঠেছিল 'প্রেমে পরবাসে' প্রযোজনার অন্যতম সম্পদ। 



একই বছরে অর্থাৎ ১৯৮৩-তে দ্বিতীয় যে পাণ্ডুলিপিটি সংবর্ত গ্রুপ থিয়েটার পেয়েছিল অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের কাছ থেকে সেটি কোনো নাট্যকোলাজ নয়। সেটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জার্মান নাটকের পূর্ণাংগ অনুবাদ। ফ্রীডরিশ এঙ্গেল্‌স (১৮২০-১৮৯৫)-এর লেখা একমাত্র নাটক - একটি কাব্য নাটক 'কোলা দি রিয়েনৎসি (১৮৪১)। কার্ল মার্ক্স (১৮১৮-১৮৮৩)-এর সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব নিবিড় হওয়ার আগে একুশ বছর বয়সে এই নাট্য সৃজনের নিদর্শন রাখেন। বহুকাল নাটকটির খসড়া সাহিত্যানুরাগীদের দৃষ্টির আড়লে ছিল। ১৯৭৪-এ কাব্যনাটকাটির খসড়া পুনরুদ্ধার হওয়ার এক দশকের মধ্যেই ত্রিভাষী কবি (বাংলা, জার্মান, ইংরেজি) সেটির ভাষান্তর করেন বাংলায় এবং অন্যত্র মঞ্চায়িত হওয়ার আগেই সংবর্ত নাট্যগোষ্ঠী কলকাতার মঞ্চে 'রিয়েনৎসি’র অভিনয় করে। প্রথম অভিনয় ২৬ নভেম্বর ১৯৮৩, ম্যাক্স ম্যূলার ভবন মঞ্চে। 

এই নাটকাভিনয়ে সংবর্তের পূর্ববর্তী নাট্য কোলাজের অভিনয় শিল্পীদের সঙ্গে ক্রমে যোগ দিলেন চিত্রলেখা বসু উইলিয়ামস, সুদর্শন রায়, সৈকত সেনগুপ্ত, বিমল দাশ প্রমুখ। বাংলা ভাষান্তরে নাটকটি 'স্তিমিত সিংহাসন' নামে পুস্তিকাকারে প্রকাশিত হয়েছে পয়লা মাঘ, ১৪০৬ সালে। 

জনতার থেকে ক্ষমতার শীর্ষে উঠে আসা রিয়েনৎসি রোমে জনতার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বৈরাচারি হয়ে ওঠার পর জনতারই প্রবল আক্রোশে নিহত হয়। বাংলা অনুবাদের ভূমিকায় লেখা হয়েছে, 'অপেরার জন্য নির্ণীত হলেও প্রথাধার্য গীতিনাট্যের কাঠামোয় না সাজিয়ে বিষয়বস্তুটি বৈপ্লবিকভাবে বিন্যস্ত করতে চেয়েছিলেন এঙ্গেলস। এবং এই রূপকল্পটির নাম কাব্যনাট্য। তাঁর কাব্যনাট্যের অনেকখানি জায়গা জুড়ে কবিতার অন্ত্যমিল/অন্ত্যমিল/ পর্বন্যাস প্রভৃতি সরঞ্জাম ব্যবহৃত হয়েছে। চূড়ান্ত বিপর্যয়ের মুহূর্ত আঁকতে গিয়ে এই উপরকরণগুলিও তিনি সরাসরি বিসর্জন দিয়েছেন।’ তার আগে অনুস্রষ্টার বিশ্লেষণ, '…ঐ নাটক অন্তত শিল্পের বিচারে, চিরায়ত নাট্যদর্শ লঙ্ঘন করেছে। দ্বিতীয় অঙ্কে দ্বিতীয় দৃশ্যে ভোজনসভার মত্ততার পাশাপাশি সন্ন্যাসীদের উচ্চারিত লাতিন মন্ত্রে ধ্রুপদী পরিবেশের ঘণীভবন স্পষ্টই চোখে পড়ে। কিন্তু এঙ্গেলস সেই ট্রাজিক সম্ভাবনাকে কোনো একাগ্র পরিণতি দিতে চাইনি, শেক্সপিয়র হাতছানি দেওয়া সত্ত্বেও শেক্সপীরিয়তা বর্জন করেছেন। 

আমাদের গ্রুপ থিয়েটারের অভিনয়ে বিভিন্ন চরিত্রে একক অভিনয়ের পাশপাশি সংলাপ উচ্চারণে কোরাসের ভূমিকা ক্রমশঃ অধিক থেকে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। সম্মিলিত অভিনয়কে শ্রুতিমোহন ও ছন্দবিতানে বিচ্ছুরিত করে তোলার শিল্পপ্রীতি ক্রমিক সংবর্তের অনুশীলনে আরো শানিত হয়ে উঠেছে। 'রিয়েনৎসি' প্রযোজনাতেও 'অভিজাতবৃন্দ', 'জনতা' প্রথম কোরাস'; দ্বিতীয় কোরাস’, ‘দুই কোরাস দল’, ‘গণ কোরাস’, ‘কোরাস’ প্রমুখ বিভিন্ন জোটে সমবেশ কন্ঠের ঐকতান অভিনয়ের ঐশ্বর্য হয়ে উঠেছে। 'রিসেনৎসি’ কাব্যনাটকটি শেষ হয়েছে এইভাবে- 


কোরাস ।। 

মুক্তি ছিনিয়ে নিয়েছে স্বৈরী 
প্রতিশোধ নিতে আমরা তৈরি! 

নিনা ।। 

উন্মাদ এই আগুনের দাহ 
শুভ বুদ্ধিকে এখনো বাঁচাও! 

কামিলা।। 

জনতার ক্রোধ জ্বলন্ত অঙ্গার 
তারই দাহে হবে জীবন সাঙ্গ তার। 

নিনা।। 

করুণা করুণা! 

কামিলা।। 

প্রতিশোধ! খুন! 

নিনা।। 

মমতা! মমতা! 

কামিলা।। 

শুনো না এ কথা। 

কোরাজ।। 

বিশ্বাসঘাতী, প্রতিশোধে রাজি নোস্‌? 
কী করে এড়াবি আমাদের আক্রোশ? 

(সমাপ্তি) 

গত আটের দশকের গোড়া থেকে সংবার্ত গ্রুপ থিয়েটারে অভিনয় অনুশীলনের জন্যে ক্রমাগত এসে যোগ দিচ্ছে তরুণ ও তরুণতররা, তাদের কণ্ঠর খজুতা ও প্রগাঢ় উচ্চারণের সমলয়ে ছন্দবোধ জাগিয়ে তোলা আমাদের প্রধান লক্ষ্য। রাজা মুখোপাধ্যায়, সঞ্জয় ঘোষ, সোমনাথ রায়, বিদ্যাভূষণ শর্মা, অমিতাভ বসু প্রমুখ এক ঝাঁক নাটক নিবেদিত প্রাণের উদ্দীপনা সংবর্তকে প্রচলিত মহড়া ঘরানা ছেড়ে নিরীক্ষা নিমগ্নতায় ব্রতী করেছে। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের নাট্য পাণ্ডুলিপির মতই তা স্বাতন্ত্রে সমুজ্জ্বল। 

ওই আটের দশকের ১৯৮৪-এর বছরটা ছিল সংবর্ত গ্রুপ থিয়েটাররের অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের নাট্য পাণ্ডুলিপি নিয়ে মহড়া ও মঞ্চায়নের সবচেয়ে বেশি কাজের বছর। ১৯৮৪-তে একটা বা দুটো নয়, তিনটি নাট্য পাণ্ডুলিপি সংবর্তের জন্যে আমাকে দিয়েছিলেন আলোকদা। ‘নিয়তি ও দেবযান’, ‘নিয়তি ও বিপ্লব’ এবং ‘ড্রাগন বধের পালা’। প্রথম দুটি নাট্যকোলাজ এবং তৃতীয় পূর্ণাঙ্গ নাটকের ভাষান্তর। 

কবি হ্যোল্ডারলীনের জীবন ও রচনা নিয়ে এই কোলাজ কবি জীবনের দিব্য ট্রাজিডির নাট্যরূপ। কবি (১৭৭০-১৮৪৩) অস্তিত্বের মাধ্যমে মানুষের জীবনের চূড়ান্ত বোধ অর্জন করতে চেয়েছিলেন। কবির এই অর্জনের দাবী ছিল এতই তীব্র যে তিনি ঈশ্বর বা প্রেমিকার সঙ্গেও শেষ পর্যন্ত রক্ষা করতে পারেননি। 

হান্‌স্‌ য়্যুর্গেন নাগেল সংযোজিত আবহে 'নিয়তি ও দেবযান’ প্রযোজনায় স্লাইড নির্বাচন ও সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন বৌদি - ট্রুড বার্টা দাশগুপ্ত। আলোর দায়িত্বে ছিলেন জয় সেন। এই প্রযোজনায় দুর্গা শঙ্কর ঘোষ এবং অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের নির্মাণ একটি ফিল্মভাষ্য সংযুক্ত হয়েছিল 'আপন স্বদেশ’। ‘নিয়তি ও দেবযান’ নাট্যকোলাজে সংবর্ত গ্রুপ থিয়েটারে নতুন যে সব নাট্য শিল্পীদের আমরা পেয়েছিলাম তাঁদের মধ্যে ছিলেন সুলগ্না মুখোপাধ্যায়, চন্দ্রমল্লী সেনগুপ্ত, লিপিকা ভট্টাচার্য, দেবকল্পা দাশ, বিজয় দত্ত, শুভাশিস পাল, ধীমানকিশোর ঘোষ, প্রদীপ মুখোপাধ্যায়, মলয় নন্দী, পবিত্র নন্দী, শুভাশিসরঞ্জন দাশ প্রমুখ। সংবর্তের যাবতীয় মঞ্চ প্রযোজনার নেপথ্য কাজে প্রদীপ কর, সোমেন ঘোষ, কুমকুম দাশেদের সহযোগিতা তো থাকেই। 

আগস্ট মাসের পয়লা তারিখেই ম্যাক্স ম্যূলার ভবন মঞ্চে প্রথম অভিনয় 'নিয়তি ও দেবযান' নাট্যকোলাজের। এর ২৯ দিন পড়ে, ৩০ আগস্ট ১৯৪৮-তে এম এম বি অডিটোরিয়ামে প্রযোজিত হয়েছিল নাট্যকোলাজ ‘নিয়তি ও বিপ্লব'। গেয়র্গ বুশনার-এর জীবন ও রচনা নিয়ে 'নিয়তি ও বিপ্লব' নাট্যময় কোলাজটি লিখেছিলেন অলোকদা তাঁর অন্যধারার কলমে। মাত্র তেইশ বছরের জীবনে গেয়র্গ বুশনার (১৮১৩-১৮৩৭) 'দান্তনের মৃত্যু', 'লিয়ঁ ওলেনা এবং হ্বয়েৎসেক-এর মতো তিনটি আসামান্য নাটকের রচয়িতা। মাতৃভূমি হেসেন। লাইপৎসিগের যে যুদ্ধে হেরে যান নেপোলিয়ন গেয়র্গ বুশনারের বাবা ছিলেন সেই যুদ্ধের সেনাবাহিনীর ডাক্তার। গেয়র্গ ফরাসী শাসনাধীন স্ট্রার্সবুর্গের বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছিলেন ডাক্তারি পড়তে। বিপ্লবের প্রতি তার আকর্ষণ অল্প বয়স থেকেই। ‘হেসিয়ান মেসেঞ্জার’ ইস্তাহার লেখেন তিনি ১৮৩৪-এ। বলা হয় ওই ইস্তেহার কাল মার্ক্সের কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর এক আদিম সংস্করণ। 

সংবর্ত গ্রুপ থিয়টারের গেয়র্গ বুশনারের চরিত্রাভিনয় দিয়ে শুরু শুভাশিস মুখোপাধ্যায়ের। এসেছেন আরও অনেকেই - শান্তনু লাহিড়ী, শুভ কুমার বসু, গৌতম চট্টোপাধ্যায়, আনন্দ গঙ্গোপাধ্যায়, আনন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়, ঊর্মিলেন্দু মুখোপাধ্যায়, শম্ভু চক্রবর্তী, রাজা মজুমদার, ঈশিতা মিত্র, বাণী পাল, পদ্মিনী লাহিড়ীরাও। কিছু সময়ের মধ্যেই সংবর্তের অভিনয় ধারায় সংযুক্ত হয়েছেনে। 'নিয়তি ও বিপ্লব’-এর উদ্বোধনী অভিনয়ের পাঁচ দিন পরে ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৮৪ সংবর্তে নতুন নাটক 'ড্রাগন বধের পালা' অভিনীত হল প্রথম সন্ধ্যায়। দুই জার্মানির লোকপ্রিয় কবিয়াল হ্বোল্‌ভ্‌ বীয়ারমানের নাটক 'ড্রা ড্রা' থেকে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের ভাষান্তর 'ড্রাগন বধের পালা'। 

দীর্ঘ পালা জুড়ে মোট একুশটি চরিত্র। এর আগে একসঙ্গে এত চরিত্র নিয়ে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা আমাদের গ্রুপ থিয়েটারের ছিল না। পালার প্রতিটি অঙ্ক সূচনায় গান বা ছড়া। এই প্রযোজনায় সংবর্তের সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছিলেন ভারতীয় থিয়েটারের দুই শীর্ষচূড় নাট্য-পুরুষ। আলোকসম্পাতে তাপস সেন আর মঞ্চ পরিকল্পনায় খালেদ চৌধুরী। এর পাশে হলো আরও সমুজ্জ্বল সংযোজন। দৃশ্য মুখে মঞ্চে ব্যালাড আবৃত্তির জন্য আমাদের যথসময়ে আবৃত্তি উপহার দিতে থকলেন কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। 



নগরী জুড়ে ড্রাগন ছিল শুয়ে 

দীর্ঘ কাল সে এক পরমাদ 

ভয়ংকর জন্তুটারে দেখে 

ঘুচলো আমার গান গাওয়ার সাধ 



সংলাপের দীপ্ত দোলায় শ্লেষের সন্দীপন তো পরতে পরতে - 

হংসী।। এ আবার কেরে এখানে হল হাজির? 

গাধা।। পুচ্ছটি কাটা গিয়েছে মার্জারীর 

(হাস্যরোল) 

বেড়াল।। আমি কিবা একা সটান বাজারে গিয়ে 

যুদ্ধের পোজ-এ অযথা রই দাঁড়িয়ে… 

সবাই।। আর তারপর? 

বেড়াল।। আমাকে দেখেই দৌড় দিল ড্রাগন 

প্রাসাদের দিকে ভয় পেয়ে বাছাধন 

ফলে আমি কিনা যুদ্ধের শেষ অংশটা মিস করি 

[অন্যান্য সবার তীব্র হাস্য] 

শুয়োর।। গা গতর থেকে কিছু কি খুইয়েছিস? 

কুকুর।। মনে পড়ে যেন আর কিছু ছিল তোর এই কলেবরে! 

বেড়াল।। বাসি যত সব রসিকতা লজ্ঝড়ে। 

[অস্ফূট স্বরে] ডাইনিটা কিনা আমাকে পাকড়ে 

ছুরি বার করে 

লেজটাকে দিল ছারখার করে 

ভিড়ের মধ্যে করল রে প্রস্থান। 

গাধা।। কী আর করবি সকলেরই কিছু রয়েছে ক্ষতস্থান। 

[হাস্যরোল] 

পরের বছর অলোকদা সংবর্তকে দিলেন আর একটি নাট্যকোলাজ 'মৃত্যুমদির হ্বান্‌সি হ্রদের তীরে’। মহাকবি গ্যোয়েটে যাঁর প্রতিভাকে ঈর্ষা করতেন সেই কবি, নাট্যকার ও কাহিনী লেখক ক্লাইস্টের জীবন ও রচনা নিয়ে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের নাট্যকোলাজ 'মৃত্যু মদির হ্বান্‌সি হ্রদের তীরে’। ১৯৮৫-এর ২৩ আগস্ট প্রথম অভিনয় হয়েছিল এই নাট্যকোলাজের কলকাতার এম.এম.বি অডিটোরিয়ামে। 

প্রযোজনাটি দিল্লিতে নিবেদিন হওয়ার পর The States Man পত্রিকার নাট্য সমালোচক লিখেছিলেন 'The ambience is sombre, the best slow is keeping with inherent ‘pessimism’ of the grey manuscript of k’eist of concept that the beauty of the human soul, its simplicity and purity have been lost due to submission to string-pulling fate which may be overcome by death? 

১৯৮৫-তে অলোকদার তিনটি ভিন্ন গোত্রের নাট্যলেখ মঞ্চায়ন করে সংবর্ত। এর পরের বছর – ১৯৮৬-র ৯ আগস্ট আর একটি অপ্রতিম নাট্যকোলাজ, যার সৃষ্টি ওই প্রচল পরিহারী নাট্য ধারার 'অতন্দ্র গোলাপ’ মঞ্চস্থ করেছিল। কবি রাইনার মারিয়ারিলকের জীবন ও সৃষ্টি নিয়ে নাট্যকোলাজ অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের। 

‘অতন্দ্র গোলাপ’-এ কবি রিলকের প্রেমিকা লু সালোমে আন্দ্রেয়ার চরিত্রে অভিনয়ে এলেন স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়। শুরুর থেকেই অরুণ মিত্র, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শঙ্খ ঘোষ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, রাণাঘাট থেকে আসা তরুণ কবি, জয় গোস্বামীর পাশাপাশি কবি পত্নী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায় সংবর্ত গ্রুপ থিয়েটারের আশেষ প্রেরণা উদ্দীপক দর্শক ছিলেন। এই নাট্যকোলাজ প্রযোজনা থেকে তিনি হয়ে উঠলেন নিয়মিত অভিনয় শিল্পী। আরও কিছু নতুন নাট্যকর্মী মুনমুন দত্ত, দেবাশিস ভট্টাচার্য, সন্দীপ পাল, দেবপ্রসাদ রায় চৌধুরী, অনিরুদ্ধ পুততুণ্ড, মধুলীনা সরকার প্রমুখ সংবর্তের অভিনয় ধারার সঙ্গে একাত্ম হয়েছিলেন। 

পরের বছর ১৯৮৭-তে আমরা নাট্যকোলাজ নির্মাণ করলাম আটের দশকে লেখা অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের শেষ নাট্যকোলাজটির পাণ্ডুলিপি থেকে। গেরহার্ড হাউপ্টমানের জীবন ও সৃষ্টি ধারা সংকলিত নাট্যকোলাজ 'পান্থশালায় জন্ম নিল পথিক’। ১৫ মে-র সন্ধ্যায় উদ্বোধনী অভিনয় হলো। 

আরও একটি বড় মাপের কাজ সংবর্ত গ্রুপ থিয়েটারের নাঠ্য প্রযোজনার বাংলা অনুবাদ নাটকের ইতিহাসে সংযোজন করেছে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত - গ্যোয়েটের এপিক কাব্য নাটক রাইনিকে ফুক্স-এর ভাষান্তরে। এম.এম.বি-এর সহযোগিতায় এই প্রযোজনায় আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন প্রবীণ জার্মান নাট্য নির্দেশক হ্বোল্‌ফরাম মেরিং যৌথ নির্দেশনায় থাকলেন সংবর্ত গ্রুপ থিয়েটারের নির্দেশক অভিনেতার সঙ্গে। দিল্লিতে ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামার প্রথম ভারত রঙ্গোৎসবে আমন্ত্রিত হয়ে ‘শেয়াল পণ্ডিত’-এর প্রযোজনা আলাদা মাত্রা পেয়েছিল। ‘যৌবন বাউল’ (১৯৫৯) থেকে ‘মরমী করাত’ (১৯৯০) অলোকরঞ্জনী কবিতা পরিক্রমায় সংবর্তের কবি প্রণতির কোলাজটি স্মৃতি ধার্য হয়ে আছে। 



[সুনীল দাশ : জন্ম ১৯৪৩। ছোট গল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার – নির্দেশক এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক। আশির দশকে তারই নির্দেশনায় অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত রচিত একাধিক নাট্য – কোলাজ মঞ্চস্থ হয়।] 

2 comments: