7

সম্পাদকীয়

Posted in

সম্পাদকীয়


সবেমাত্র চলে গেলো বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজো। কত জাঁকজমক, কত আড়ম্বর। প্রসঙ্গক্রমে হঠাৎই মনে পড়ে গেলো জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির দুর্গাপুজোর কথা। ভাবতে অবাক লাগে, তত্ত্ববোধিনী সভা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দশ বছর পরেও ঠাকুরবাড়িতে দুর্গাপুজো হতো। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ এই সময়টা ইচ্ছে করেই কাটাতেন প্রবাসে। তবে দ্বারকানাথ অত্যন্ত দরাজ হস্তে প্রচুর খরচ করতেন। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির মা দুর্গাকে খাঁটি সোনার গয়না দিয়ে সাজানো হতো এবং সালংকারা সেই প্রতিমাকেই বিসর্জন দেওয়া হতো গঙ্গায়। ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিকথায় পাওয়া যায় সে কথা, ‘...ভাসানের সময়েও সে গহনা খুলিয়া লওয়া হইত না—সম্ভবত ভাসানের নৌকার দাঁড়ি মাঝি বা অন্য কর্মচারীরা তাহা খুলিয়া লইত, কিন্তু প্রতিমার গা-সাজানো গহনা আবার ঘুরিয়া ফিরিয়া বাড়িতে উঠিত না।’ আবার এই বাড়ির কনিষ্ঠ পুত্রটিই ১৯৩৫ সালের ২৯ আগস্ট একটি ব্যক্তিগত চিঠিতে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে লিখলেন, ‘এখানকার বন্যাপীড়িতদের সাহায্যার্থে অর্থসংগ্রহ-চেষ্টায় ছিলুম। ব্যক্তিগতভাবে আমারও দুঃসময়। কিছু দিতে পারছিলুম না বলে মন নিতান্ত ক্ষুব্ধ ছিল। এমন সময় দেশ ও আনন্দবাজারের দুই সম্পাদক পূজার সংখ্যার দুটি কবিতার জন্যে এক শ টাকা বায়না দিয়ে যান, সেই টাকাটা বন্যার তহবিলে গিয়েছে। আগেকার মতো অনায়াসে লেখবার ক্ষমতা এখন নেই। সেইজন্যে ‘বিস্ময়’ কবিতাটি দিয়ে ওদের ঋণশোধ করব বলে স্থির করেছি। ক্লান্ত কলম নতুন লেখায় প্রবৃত্ত হতে অসম্মত।’ ... বাহ রে বাঙালি!

কথায় কথা বাড়ে। রবীন্দ্রনাথকে মনে পড়লে নোবেলের কথা আসবেই। আর নোবেলের কথা এসেই গেলে এই মুহূর্তে অভিজিতের কথা এড়িয়ে যাই কি করে? হ্যাঁ, অভিজিৎ বিনায়ক ব্যানার্জী; সাউথ পয়েন্ট, প্রেসিডেন্সি, জে এন ইউ, ভি সি ঘেরাও, ১০ দিন তিহার জেলে কাটানো, শেষে ‘চ্যানেল করে’ নোবেল বাগানো। মাঝে পরকীয়া, বিপথু সন্তানের আত্মহনন, বিবাহবিচ্ছেদ...

দাঁড়ান, দাঁড়ান... সমস্যাটা ঠিক কোথায়? নোবেল পাওয়ায়, নাকি সাফল্য অর্জন করায়?  এই নোংরামীর পিছনের আসল উৎসটা কি? উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রাজনৈতিক অপপ্রচার, নাকি আদিম ঈর্ষা? আমরা খেয়ালই করি না, এই মারাঠি মায়ের কৃতী সন্তানটি কিন্তু মাতৃভাষায় বলতে অনুরোধ করা হলে নির্দ্বিধায়, না মারাঠি নয়, বাংলায় বলে ওঠেন! কি আশ্চর্য!

একটু বিস্তারিতই বলি। গণতান্ত্রিক(?) প্রক্রিয়ার নির্বাচন করে যে রাষ্ট্র প্রধানকে আমরা গণপ্রতিনিধি হিসাবে শাসন যন্ত্রের শীর্ষে বসাচ্ছি, একদিন সেইই  ঠিক করে দিচ্ছে আমরা কী খাবো, কী পরবো, কী পড়বো, এমনকি কী চিন্তা করবো, কোন রাস্তায় চিন্তা করবো। জাস্ট নেওয়া যাচ্ছে না আর! আর ওই আদিম ঈর্ষার কথা বলছিলাম না, ওটা মনে হয় ঠিক বলছিলাম না। কেননা, আদিম ঈর্ষার প্রেক্ষাপটে সক্রিয় ছিলো স্বচ্ছ জান্তব প্রতিদ্বন্দ্বিতা; এখনকার মতো হীনমন্যতা নয়! - আমি পাচ্ছি না, তুমি কেন পাবে!- মানবিকতার কি চরম দীনতা!

এমনিতেই হেমন্ত বিষণ্ণতার ঋতু। আরও বিষণ্ণতা ওঁৎ পাতে আনাচে কানাচে... অথচ

কথা ছিলো রক্ত-প্লাবনের পর মুক্ত হবে শস্যক্ষেত...
কথা ছিলো, কথা ছিলো আঙুর ছোঁবো না কোনোদিন...
কথা ছিলো, চিল-ডাকা নদীর কিনারে একদিন ফিরে যাবো...
একদিন সুবিনয় এসে জড়িয়ে ধ’রে বোলবে: উদ্ধার পেয়েছি...
– রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ

সুস্থ থাকুন, সৃজনে থাকুন
শুভেচ্ছা নিরন্তর

7 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - অমিতাভ পুরকায়স্থ

Posted in

দুর্গোৎসবের ব্যতিক্রমী প্রতিমা: অভয়া দুর্গা
অমিতাভ পুরকায়স্থ

যুগের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু বছর বছর দুর্গাপূজা নিয়ে উৎসাহ কমেনি। শ্রদ্ধাশীল বিশ্বাসী মানুষের কাছে এই আরাধনা হারায়নি তার প্রাসঙ্গিকতা। এই প্রসঙ্গে শ্রীঅরবিন্দ বলেছেন: ‘‘তোমার শ্রদ্ধা, তোমার আন্তরিকতা, তোমার সমর্পণ যত পূর্ণতর হয়ে উঠবে, মায়ের করুণা ও অভয় ততই তোমাকে ঘিরে রাখবে।’’ 

আমরা সাধারণত যে দশভুজা মহিষাসুরমর্দিনী রূপে দেবী দুর্গার আবাহন করি, তার থেকে একেবারে ভিন্ন রূপের দেবীপ্রতিমা দেখা যায় শহর কলকাতা ও বাংলার নানা প্রান্তে। সেই সব দুর্গাপ্রতিমাকে সাধারণত ‘অভয়া দুর্গা’ বলা হয়। অস্ত্র ত্যাগ করে তিনি শান্ত দ্বিভুজা মূর্তিতে মর্তবাসীকে অভয় প্রদান করছেন। 

ছোটবেলা থেকেই আমার মনে একটা প্রশ্ন ছিল। মা অসুরের সঙ্গে মরণপণ সংগ্রাম করছেন, অথচ তাঁর ছেলেমেয়েরা এমন নির্লিপ্ত ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে কী করে? একটু অদ্ভুত লাগত। তাই সেই সত্তর বা আশির দশকে বিশেষ করে দক্ষিণ কলকাতার যে সব সর্বজনীন মণ্ডপে আলোর ভেল্কিতে যুদ্ধে কার্তিক বা গণেশের অংশ নেওয়া দেখানো হত, সেগুলি মনে হত অনেক বাস্তবসম্মত। অন্য দিকে বাকি মণ্ডপগুলিতে দশভুজা মহিষাসুরমর্দিনীর সঙ্গে তাঁর পুত্র-কন্যার এই পারিবারিক প্রতিমা কল্পনার মধ্যে একটা গোঁজামিল আছে বলে ভাবতাম। 

তার পর কলকাতার পুরনো পারিবারিক পুজোগুলো দেখতে শুরু করার পর খেয়াল করলাম, আরও এক ধরনের প্রতিমায় দুর্গাপূজা হয়, যেখানে এই পারিবারিক অ্যালবামের ছবিটা ঠিকঠাক ফিট করে। কোনও গোঁজামিল নেই। অভয়া দুর্গা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার আগে অভয়া রীতির আর এক ধরনের দুর্গাপ্রতিমা নিয়ে একটু বলে নেওয়া যাক। এই ধরনের প্রতিমাকে বলে ‘শিব-দুর্গা’ মূর্তি। 

সাধারণত বেনে বাড়ির দুর্গাপূজায় এই মূর্তি দেখা যায়। ষাঁড়ের উপর শিব বসে রয়েছেন। তাঁর বাঁ কোলে দ্বিভুজা অভয়দাত্রী দুর্গা। লক্ষ্মী সরস্বতী গণেশ কার্তিক— সব নিজেদের জায়গায় বিরাজমান। যেন এই মাত্র কোনও স্টুডিওতে পোজ দিয়ে ছবি তুললেন সপরিবার মহাদেব। 

এমন মূর্তির কারণ খুঁজতে গিয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা সূত্র দিয়েছিলেন বিডন স্ট্রিটের বিখ্যাত ‘ভোলানাথ ধাম’-এর শ্রী অজয় দত্ত। তিনি বলেছিলেন, তাঁরা ধনপতি সওদাগরের বংশধর। চুলচেরা ঐতিহাসিক বিচারে না গিয়েও মঙ্গলকাব্যের গল্প থেকেই আমার জানতে পারি যে বণিক পরিবারগুলি সাধারণত ছিলেন শিবভক্ত। দেবীরা নিজেদের পূজা সমাজে প্রচলন করার জন্য তাঁদের নির্দেশ দেন। কিন্তু গোড়ায় সেই আদেশ তাঁরা পালন করতে চাননি। পরে বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে যখন দেবীপূজা চালু হল, তখনও এমন মূর্তি তাঁরা কল্পনা করলেন, যেখানে শিবের জন্য নির্দিষ্ট হল উঁচু স্থান। শিব-দুর্গা প্রতিমাতেও শিবের মূর্তি বড় করে গড়া হয়, যাঁর কোলে বসানো হয় দুর্গাকে। 

শিব-দুর্গা প্রতিমার সঙ্গে কার্তিক গণেশ লক্ষ্মী সরস্বতী ছাড়াও জয়া-বিজয়ার মূর্তি দেখা যায়। কোথাও জয়া-বিজয়ার আলাদা মূর্তি না গড়ে মূর্তির পেছনে যে চালা থাকে, সেখানেই সুন্দর করে এঁকে দেওয়া হয়। প্রতিমার এই রূপদানে এক সম্পূর্ণ পারিবারিক ছবি ফুটে ওঠে। ঠিক যে ভাবে বছর শেষে পরিবার আর বন্ধুবান্ধব নিয়ে এক জমজমাট মিলনোৎসবে গমগম করে শতাব্দীপ্রাচীন ঠাকুর দালানগুলি! 

বনেদি এই বাড়িগুলির অধিবাসীরা মূলত বণিক সম্প্রদায়ের মানুষ। নিজেদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য তাঁরা বজায় রেখে চলেছেন পারিবারিক দুর্গোৎসবের মাধ্যমে। দুর্গাপ্রতিমার এই ভিন্ন রূপের সঙ্গে তাঁদের বাড়ির পুজোর ব্যবহৃত উপচার ও বিভিন্ন প্রথা-পদ্ধতি বার বার সে কথা মনে করিয়ে দেয়। এই সব বাড়িতে পুজোর সময় কিছু বিশেষ আচার অনুষ্ঠান লক্ষ করা যায়। যেমন অষ্টমী/নবমীর দিন ধুনো পোড়ানো। মহিলারা এক সঙ্গে বা এক-এক করে ঠাকুরের সামনে বসেন। তাঁদের দুই হাতে এবং মাথায় নতুন গামছা দিয়ে বিড়ে বানিয়ে তার উপর নতুন মালসা বসানো হয়। তার পর সেই মালসায় পোড়ানো হওয়ার ধুনো। সন্তান ও পরিবারের মঙ্গলকামনায় এই অনুষ্ঠান পালন করেন বাড়ির মহিলারা। আবার বিসর্জনের দিন ঠাকুর বরণ হয়ে যাওয়ার পর উঠোনে প্রতিমা নামিয়ে তার চারদিকে মহিলারা ঘুরে ঘুরে অঞ্জলি দেন। এই প্রথাকে বলা হয় ‘বেড়া অঞ্জলি’। এ ছাড়াও বণিক বাড়ির প্রথা হিসাবে পুজোর দিনগুলিতে নাকে বড় বড় নথ ও পায়ে মল পরে থাকা অবশ্য কর্তব্য মনে করেন এই সব বাড়ির মহিলারা। 

কলকাতার বেশ কয়েকটি পুরনো বাড়ির পুজোয় এই শিব-দুর্গা মূর্তি দেখা যায়। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু বাড়ি হল বড়বাজারের বৈষ্ণবদাস মল্লিকের বাড়ি, বৌবাজারে গোবিন্দলাল দত্তের বাড়ি (বেলু বাড়ি), ঠনঠনিয়া (দ্বারিকা) দত্ত বাড়ি, দুর্গাচরণ লাহার বাড়ি, বিডন স্ট্রিটের ভোলানাথ ধাম, ঝামাপুকুর চন্দ্র বাড়ি, কাশীপুরের বংশীধর দত্তের বাড়ি, বেনিয়াটোলা দত্ত বাড়ি, বড়াল বাড়ি ইত্যাদি। 


কলকাতার আরও কয়েকটি বণিক বাড়িতে আর এক ধরনের অভয়া দুর্গাপ্রতিমা পুজো হয় এই শারদোৎসবের সময়। সূর্য সেন স্ট্রিট দিয়ে পশ্চিম দিকে যাওয়ার সময় ডান দিকে বৈঠকখানা রোডে কাগজ আর প্রিন্টিং-এর দোকানগুলির মধ্যে নজর এড়াবে না গত শতকের একেবারে প্রথম দিকে তৈরি একটি সাদা রঙের বাড়ি। বাইরের বারান্দার নীচে ব্র্যাকেট আর উপরে নকশাদার গ্রিল— দুই-ই ঢালাই লোহার তৈরি। এই বাড়িতেই পুজো হয়ে এসেছে অভয়া দুর্গার। যশোরের বাসিন্দা সুবর্ণ বণিক নীলমণি সেন কলকাতায় এসে প্রথম জাকারিয়া স্ট্রিট অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। সেখানেই শুরু হয় দুর্গোৎসব। তিন খিলান বিশিষ্ট ঠাকুরদালান-সহ বৈঠকখানা রোডের এই বাড়ি তৈরি করেন নীলমণির পৌত্র কানাইলাল সেন। এক সময় ঠাকুরদালানের গায়ে সুন্দর কারুকাজ ছিল, যার একটা আভাস এখনও পাওয়া যায়। ১৯১৩ সাল থেকে পারিবারিক ঐতিহ্য মেনে এখানে দুর্গা ‘অভয়া’ রূপে পূজিতা হয়ে আসছেন। এই মূর্তিতে অসুর নেই, রক্তপাত নেই। দ্বিভুজা দেবীর এক হাতে অভয় মুদ্রা, অন্য হাতে বরদা মুদ্রা। পায়ের কাছে বসে আছে সিংহ, ঠিক যেন পোষা বেড়াল। দেবীর সঙ্গে লক্ষ্মী সরস্বতী কার্তিক গণেশ নিজেদের প্রথাগত স্থানে প্রতিষ্ঠিত। ষষ্ঠীর দিন বোধন হয়ে পুজো শুরু হয়। পুজোর ক’দিন প্রতিমা দর্শনের জন্য বাইরের দর্শনার্থীদের ঢুকতে দেওয়া হয় বাড়িতে। 

আরও খানিকটা পশ্চিম দিকে এগিয়ে গেলে পটলডাঙায় ধর বাড়িতে আর এক ধরনের অভয়া দুর্গাপ্রতিমা দেখতে পাওয়া যায়। সাধারণত এই বাড়িটিকে মদনমোহন ধরের ঠাকুরবাড়ি বলা হয়। পারিবারিক সূত্র থেকে জানা যায় যে ১৮৪৪ সালে কানাই ধর লেনের বাড়িতে শুরু হয় সুবর্ণবণিক গোষ্ঠীভুক্ত এই পরিবারের পুজো। ১৮৮৪ সালে পরিবারের সদস্য মদনমোহন ধর পটুয়াটোলা লেনের এই বাড়িতে পুজো শুরু করেন। ঠাকুরদালানটি একটু অদ্ভুত দেখতে। পুজো হয় তিনটি দরজা যুক্ত একটি ঘরে, যার সামনে চওড়া বারান্দার তিনটি কারুকার্যখচিত ঢালাই লোহার থাম, সাবেক খিলানবিশিষ্ট দালানরীতির স্থাপত্যের একটা আভাস দেয়। এখানেও দেবী অভয়া মূর্তিতে পূজিতা হন। অসুর ও রক্তপাতবর্জিত শান্ত অভয়দাত্রী প্রতিমা। দেবীর পায়ের কাছে দুটি ছোট ছোট সিংহ থাকে। লক্ষ্মী সরস্বতী কার্তিক গণেশ ছাড়াও সঙ্গে জয়া-বিজয়ার উপস্থিতিও নজরে পড়ে। 

একই ধরনের অভয়া মূর্তি দেখতে পাওয়া যায় আর একটি বাড়িতে। সেই পরিবারেরও কৌলিক পরিচয় সুবর্ণবণিক এবং পদবি ‘ধর’। হ্যাঁ, কলুটোলার বিখ্যাত ধর বাড়ি। এখানেও লক্ষ্মী সরস্বতী কার্তিক গণেশ আর জয়া-বিজয়ার সঙ্গে দেবীর পায়ের কাছে দুটি ছোট ছোট সিংহ থাকে। চন্দননগরের সর্ষেপাড়ার কৃষ্ণচন্দ্র ধর নিজের বাড়িতে অভয়া দুর্গাপুজো শুরু করেন উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। কৃষ্ণচন্দ্রের পুত্র পূর্ণচন্দ্র ধর ছিলেন জার্ডিন অ্যান্ড স্কিনার কোম্পানির ক্যাশিয়ার। তিনি কলুটোলার দেবেন্দ্র মল্লিক স্ট্রিটে নতুন ঠাকুরদালান সমেত বাড়ি করে পুজোটি নিয়ে আসেন। এই বাড়িতে ‘হরিভক্তি প্রদায়িনী সভা’র কলুটোলা অঞ্চলের কার্যালয় স্থাপিত হয় এবং সেই সংগঠনের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ১৮৮২ সালে শ্রীরামকৃষ্ণ এই বাড়িতে আসেন। ঠাকুরদালানের যে জায়গাটিতে তিনি বসেছিলেন, সেখানে এখন যজ্ঞকুণ্ড তৈরি করা হয়েছে। 

১৯৪৬ সালের দাঙ্গার সময় বাড়ির সমস্ত দামি আসবাব লুঠ হয়ে যায়। প্রাণ নিয়ে পরিবারের লোকেরা পালাতে সক্ষম হয়েছিলেন স্থানীয় এক মুসলমান পুলিশ অফিসারের সহযোগিতায়। কিন্তু বাড়ি ছাড়ার সময়েই সেই লুঠের দৃশ্য দেখে মানসিক ভারসাম্য হারান বাড়ির এক বয়স্ক সদস্যা। তার পর প্রায় চার বছর বাড়িছাড়া ছিল পরিবারটি। অনেক কষ্ট করে তাঁরা শেষে ফিরে পান তাঁদের ভদ্রাসন। কয়েক বছর ঘটে নিয়মরক্ষার পর আবার ঠাকুদালান উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে আনন্দময়ীর আগমনে। বর্তমানে কলুটোলার এই বাড়ি দুই শরিকের মধ্যে ভাগ হয়েছে। বাড়িতে দুটি তিন খিলানের ঠাকুর দালান। প্রতি বছর ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দুই পক্ষ আয়োজন করেন অভয়া মূর্তিতে দুর্গাপূজার।

শহরের সব অভয়া দুর্গাপূজার গল্পে কিন্তু এমন ‘হ্যাপি এন্ডিং’ নেই। বরং আছে বিষাদমাখা ঘটনার ছোঁয়া। যেমন দাঁ বাড়ির গল্প। আনুমানিক ১৭৩৪ সালে বাঁকুড়ার কোতুলপুর থেকে দয়ারাম দাঁ কলকাতার দর্জিপাড়ায় এসে বসতি স্থাপন করেন। গন্ধবণিক কৌলিক পরিচয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যে বড়বাজারে শুরু করেন মশলার কারবার। ধীরে ধীরে ব্যবসা বাড়তে থাকে। পুত্র রামনারায়ণের সময় সেই বিত্ত-সম্পত্তি আরও বিস্তার লাভ করে। খুব কম বয়সে আদরের মেয়ে দুর্গারাণীর বিয়ে দিয়েছিলেন রামনারায়ণ দাঁ। খুব জাঁকজমক করে। বিয়ের পর ধুলোপায়ের দিন বাপের বাড়ি ফিরল দুর্গা। সেখানেই আক্রান্ত হল কলেরায়, আর রাত না পোহাতেই দাঁ বাড়ির সব উৎসবের আলো যেন নিভে গেল। 

মেয়ের কথা ভুলতে পারেন না রামনারায়ণ। সব সময় তাঁর মনে হত, দুই বেণীতে লাল ফিতে লাগিয়ে বাড়িময় ঘুরে বেড়াচ্ছে ছোট মেয়েটি। এই স্মৃতিকে স্থায়ী করতে ১৭৬০ সালে বাড়িতে অভয়া দুর্গার পুজো প্রচলন করেন রামনারায়ণ দাঁ। কমলাসনে বসে যেন সেই বারো বছরের মেয়েটি। মাথায় দুই বেণী আর তাতে লাল ফিতে। পুজোয় শোকার্ত রামনারায়ণ হয়তো প্রার্থনা করেছিলেন, ‘হর পাপং হর ক্লেশং হর শোকং হরাশুভম্। হর রোগং হর ক্ষোভং হর দেবি হরপ্রিয়ে।’ আর এ ভাবেই প্রতি বছর বাপের বাড়িতে ফিরে আসার প্রথা চালু করে কি দুর্গারাণী সেই প্রার্থনায় সাড়া দিয়েছিলেন? আমরা জানি না। তবে এটুকু জানি যে সেই প্রথা আজও চলে আসছে। 

১৯৩০-এর দশকে সেন্ট্রাল এভিনিউ তৈরি হওয়ার সময় ভাঙা পড়ে দর্জিপাড়ায় মূল দাঁ বাড়িটি। বর্তমান জয় মিত্র স্ট্রিটের বাঁ দিকের প্রথম কয়েকটা বাড়িতে থাকেন ওই পরিবারের কয়েক শরিক। বাকিরা ছড়িয়ে পড়েন শহরের বিভিন্ন দিকে। জানতাম যে দর্জিপাড়ায় পুজো হয় এই অভিনব প্রতিমার। শুনে খুঁজতে গেলাম, কিন্তু কেউ বলতে পারলেন না। গলির মাথায় দাঁড়িয়ে আলোচনা করছি পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে, এমন সময় উপযাচক হয়ে এক প্রৌঢ় এগিয়ে এলেন। সমস্যা শুনলেন, আর সটান আমাদের নিয়ে গেলেন দাঁ বাড়িতে। কথা বলিয়ে দিলেন তাঁদের সঙ্গে। সেখান থেকেই জানলাম যে এ বারের পালা পড়েছে ঠনঠনিয়ার এক শরিকের। 

পৌঁছতে প্রায় সন্ধে হয়ে গেল। মানুষজনকে জিজ্ঞেস করে করে উপস্থিত হলাম ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির কাছে। কিন্তু সেই বাড়ি আর কিছুতেই খুঁজে পাই না। শেষে পাড়ার দুর্গাপুজোর প্যান্ডেলেই খোঁজ করলাম। এক ভদ্রলোক নিজে সঙ্গে করে পৌঁছে দিলেন। নিজেরা কিছুতেই খুঁজে বার করতে পারতাম না এই বাড়ি। খুব বেশি হলে আড়াই ফুট চওড়া গলিতে, দুটি বাড়ির পর এই বাড়ির দরজা। দরজার সামনে দ্বারঘট আর কলাগাছ বলে দিচ্ছে যে বাড়িতে শুভ অনুষ্ঠান হচ্ছে। 

চক মেলানো সাবেক বাড়ির মতো ঠাকুরদালানের বিলাসিতাও আজ সামর্থ্যের বাইরে এই পরিবারটির। কিন্তু ঐতিহ্য আর শ্রদ্ধা দিয়ে সেই অভাব পূরণ করার চেষ্টায় তাঁরা সফল। একটা ঘর খালি করে পুজোর আয়োজন। পরিচয় হল গৃহকর্তার সঙ্গে। বললেন, এই ছোট জায়গায় সকলের সহায়তায় পুজো ভাল ভাবেই সম্পন্ন হয়েছে। অন্য শরিকদের মধ্যে কেউ কেউ শহরের বাইরে, আবার কেউ নানা সমস্যায় এই আয়োজন করে উঠতে পারেন না। তাই সেই দায়িত্ব স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিয়েছেন সঞ্জীব দাঁ ও তার পরিবার। পর পর কয়েক বছর ধরে এই পরিবারটিই আয়োজন করছেন তাঁদের পারিবারিক অভয়া দুর্গা পুজোর। 

কলকাতার বাইরেও অভয়া মূর্তির খোঁজ পেয়েছি বর্ধমান আর হুগলি জেলার সীমান্তে বৈঁচি গ্রামে। আদি সপ্তগ্রাম তখন বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্যের মূল কেন্দ্র। বৈঁচির বিনোদবিহারী দাঁ ছিলেন গন্ধবণিক। আদি সপ্তগ্রাম থেকে পণ্য কিনে এনে মেমারির গঞ্জে বিক্রি করতেন তিনি। ব্যবসায় কিছু সুনাম হওয়ার পর মেমারিতে দোকানের পাশেই অস্থায়ী ঘর বানিয়ে থাকতেন। এক রাতে বিনোদবিহারী স্বপ্ন দেখলেন, তিনি শ্রীমন্ত সওদাগরের মতো সপ্তডিঙা ভাসিয়ে চলেছেন বাণিজ্যে। নৌকা সমুদ্রে পড়ার পর দেখলেন, সাগরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বিশাল দেবীমূর্তি। এ মূর্তি দুর্গার, তবু যেন ঠিক দুর্গা নয়। পাশে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ রয়েছেন। কিন্তু দেবীর পদতলে অসুর নেই, নেই সিংহ, কোনও অস্ত্রও। বাঁ হাতে একটি শিশুকে ধরে যেন তাকে অভয় দান করছেন দেবী। ডান হাতে বরদা মুদ্রা। দেবী আদেশ দিলেন, ‘‘তুই আমাকে এই রূপেই পুজো কর।’’ নিজের সঙ্গতির অভাবের কথা মাকে জানাতেই আবার আদেশ এল, ‘‘অধিক উপচারের দরকার নেই। কলাগাছের থোড় দিয়ে নৈবেদ্য সাজিয়ে পূজা করলেই আমি সন্তুষ্ট হব। এর থেকে বেশি কিছু দরকার নেই।’’ সেই স্বপ্নাদেশ মেনেই বিনোদবিহারী আরম্ভ করলেন দেবীর অভয়ামূর্তির পুজো। ক্রমে বিত্তশালী হয়ে ওঠেন তিনি। পুজোর আড়ম্বরও বাড়ে। কিন্তু সেই থোড়ের নৈবেদ্য বরাবর বজায় রইল ঐতিহ্য ও পরম্পরার নিদর্শন হিসাবে। 

ব্রিটিশদের কাছ থেকে ‘মহারাজা’ খেতাব পাওয়া দুর্গাচরণ লাহার মতো দু-একটি ব্যতিক্রম বাদে এই সব বাড়ির পূর্বপুরুষেরা সকলেই ছিলেন সাধারণ মানুষ, যারা নিজেদের কৌলিক বৃত্তি পালন করে শহরের বুকে স্থাপন করেছিলেন নিজেদের ভদ্রাসন। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে গিয়েও তাঁদের উত্তরসূরিরা এখনও বজায় রেখেছেন নিজেদের ঐতিহ্যশালী পুজো। ঠনঠনিয়া দত্তবাড়ির মতো কিছু বাড়িতে এখনও পুজোর জাঁকজমক যথেষ্ট। আবার দাঁ বাড়ির মতো কোথাও কোথাও সেই জৌলুস এখন অতীত। কিন্তু নিজেদের ব্যতিক্রমী দুর্গাপ্রতিমার পুজো প্রতি বারের মতো এ বারও তাঁরা নিষ্ঠার সঙ্গে সম্পন্ন করেছেন। 

দনুজদলনী দুর্গা যে বাঙালির ঘরের মেয়ে হয়ে উঠলেন, সেই রূপান্তরটা বোঝার একটা সূত্র হয়তো এই সব পুরনো পারিবারিক পুজোর ইতিহাস ও প্রতিমার বিশ্লেষণ করে পাওয়া যেতে পারে। সেই দায়িত্ব তো সনিষ্ঠ গবেষকের। আমরা সাধারণ মানুষ শুধু এটুকুই বুঝি যে উত্তর ভারতীয় বিভিন্ন সঙ্গীত-পরম্পরার মতো দুর্গাপ্রতিমার কল্পনাও বাংলার শস্যশ্যামল কাদামাটিজলে পড়ে তার পাথুরে কাঠিন্য হারিয়ে হয়ে উঠেছিল বাড়ির শান্ত স্নিগ্ধ মেয়েটি, বছরের মধ্যে চারটি দিন যাকে কাছে পাওয়ার জন্য আমরা সারা বছর অপেক্ষা করে থাকি।
বৈঠকখানা নীলমণি সেন বাড়ি

বড় বাজার বৈষ্ণবদাস মল্লিক বাড়ি

বেনিয়াটোলা দত্ত বাড়ি

ভোলানাথ ধাম শিবদুর্গা

বৌবাজার গোবিন্দলাল দত্ত বাড়ি

কলুটোলা ধর বাড়ি - ১

কলুটোলা ধর বাড়ি - ২

দাঁ বাড়ি 

ঝামাপুকুর চন্দ্র বাড়ি

পটুয়াটোলা ধর বাড়ি

0 comments:

0

প্রবন্ধ - মনোজ কর

Posted in

ছাত্র রাজনীতি – প্রেক্ষাপট এবং প্রাসঙ্গিকতা
মনোজ কর


বিগত কয়েকবছর ধরে যে প্রশ্নটি শিক্ষিত সাধারণ মানুষ এবং বুদ্ধিজীবিদের বারবার বিড়ম্বিত করে চলেছে সেটা হলো - ‘ছাত্রদের কি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা উচিত?’ আক্ষরিক অর্থে এই প্রশ্নটি অবশ্যই বিতর্কিত। যেহেতু সমাজের সবকিছুই এবং আমাদের প্রতিদিনের জীবন রাজনীতির দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত সুতরাং ছাত্ররা যারা এই সমাজেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং অদূর ভবিষ্যতে বুদ্ধিজীবি হয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবার অধিকাপ্রাপ্ত হবে তারা কি করে রাজনীতির বাইরে অধিষ্ঠান করতে পারে ? তর্কের খাতিরে যদি মেনে নিই অভিভাবকদের নির্দেশে ছাত্ররা রাজনীতির বাইরে থাকতে চায় তবুও বাস্তবে রাজনীতির আঁচ কি বাঁচিয়ে চলা সম্ভব? 

আমার মনে হয় এই প্রশ্নটিকে আক্ষরিক অর্থে নেওয়া ঠিক হবে না। আমি অনেকের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি আসল প্রশ্নটি হলো – ‘যে রাজনীতির অনুশীলন বা রাজনীতির নামে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ধারা শিক্ষাঙ্গনে গত কয়েকদশক ধরে বয়ে চলছে সেই স্রোতে গা ভাসানো ছাত্রদের পক্ষে সমীচিন কি না?’ তথাকথিত ক্ষমতালিপ্সু রাজনৈতিক নেতারা যারা কেবলমাত্র আখের গোছানোর জন্য বা সমাজের সর্বস্তরে নিজেদের কর্তৃত্ব জারি করার জন্য রাজনীতির নামে ছাত্রদের বিপথে চালনা করছেন তারা সর্বক্ষেত্রে নিজেদের স্বার্থগন্ধী উদ্দেশ্য সাধনের জন্য নানাবিধ ক্রিয়াকলাপকে সুস্থ রাজনীতির অনুশীলনের সাথে গুলিয়ে দিচ্ছেন। ফলতঃ অরাজকতা এবং রাজনীতি আজকের দিনে সমার্থক হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষ, অধিকাংশ বুদ্ধিজীবি সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে চাইছেন। মদ, গাঁজা, ড্রাগের নেশা ছাড়ানোর মতো বাবা মায়েরা ছেলে মেয়েদের স্কুল কলেজে রাজনীতি করার নেশার থেকে বাঁচাতে চাইছেন। প্রয়োজনে ছেলে মেয়েদের অন্য শহরে এমনকি বিদেশেও পাঠিয়ে দিতে চাইছেন। ছেলেধরার খপ্পরের মতো স্কুল কলেজে রাজনৈতিক নেতাদের খপ্পর থেকে ছেলে মেয়েদের বাঁচানো ক্রমশঃ কঠিন হয়ে উঠেছে। 

সুতরাং প্রশ্নটি যে প্রাসঙ্গিক তা সন্দেহাতীত। কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর বা এই সমস্যার সমাধান খুঁজতে গেলে বলা যেতে পারে এই সমস্যার কোনো সমাধান এই সময়ের প্রেক্ষিতে আছে কিনা তা দেখবার জন্য ছাত্র রাজনীতির ইতিহাসের দিকে একবার চোখ ফেরানো যাক। একটা কথা মনে রাখা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় যে ছাত্র আন্দোলন বা রাজনীতি কোনো বিচ্ছিন্ন আন্দোলন বা রাজনীতি নয়, সমাজের বৃহত্তর রাজনীতি এবং আন্দোলনেরই অংশ। শুধুমাত্র চরিত্রগত এবং গতিপ্রকৃতির দিক থেকে এটি ভিন্ন। ছাত্র রাজনীতিতে যুক্তির চেয়ে আবেগের আধিক্য বেশী। ছাত্র রাজনীতি বা আন্দোলন স্বচ্ছ, স্বার্থহীন, সৎ, নির্ভীক এবং অপরিণামদর্শী। ছাত্র আন্দোলন এবং ছাত্র রাজনীতি বহুক্ষেত্রেই বৃহত্তর রাজনৈতিক নেতৃত্বের দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং সমস্যার মূল সেখানেই নিহিত। 

ভারতবর্ষে ছাত্র রাজনীতির ইতিহাস প্রায় ১৫০ বছরের বেশী পুরোনো। 

১৮৪৮ সালে দাদাভাই নৌরজী ‘স্টুডেন্টস লিটারারি অ্যান্ড সাইন্টিফিক সোসাইটি’ বলে একটি সংগঠনের পত্তন করেন। এটির প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল ছাত্রদের মধ্যে সাহিত্য, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনার অভ্যাস এবং প্ল্যাটফর্ম তৈরী করা। এই প্ল্যাটফর্মেই ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার যাথার্থ্য নিয়ে ছাত্রদের মধ্যে আলোচনা শুরু হয় এবং সেই আলোচনা ছাত্র আন্দোলনের রূপ পায় লাহোরের কিং এডওয়ার্ড কলেজে ব্রিটিশ এবং ভারতীয় ছাত্রদের ভিন্ন শিক্ষাপদ্ধতির প্রতিবাদে ছাত্র ধর্মঘটের মধ্য দিয়ে। এই ধর্মঘট সাফল্য পায় এবং এই আন্দোলনকেই অনেকে ভারতের প্রথম ছাত্র আন্দোলন বলে অভিহিত করেন। 

১৯০৫ সালে যখন লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা করে তখন তার বিরুদ্ধে ব্যাপক ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিল মূল আন্দোলনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে। 

১৯০৭ সালে সুরাট অধিবেশনে যখন কংগ্রেস বিভক্ত হলো তখন বাল গঙ্গাধর তিলকের সমর্থনে ছাত্ররা বিপুল সংখ্যায় এগিয়ে এসেছিলেন। পরবর্তী কালে ১৯১৯ সালে রাঊলাট অ্যাক্ট এবং জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের বিরোধিতায় হাজার হাজার ছাত্র অংশগ্রহণ করেন। 

১৯২০ সালে লালা লাজপত রায়ের সভাপতিত্বে নাগপুরে অনুষ্ঠিত হয় সারা ভারত ছাত্র অধিবেশন। অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয় এই সমাবেশ থেকেই। মূলস্রোত রাজনীতিতে ছাত্রদের যুক্ত করার সচেষ্ট প্রয়াস এই সময় থেকেই শুরু হয়। এই প্রচেষ্টাকে সমর্থন করেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস। ১৯২২ সালে নো ট্যাক্স আন্দোলনে এবং ১৯৩০ এ আইন অমান্য এবং ডান্ডি অভিযানে ছাত্ররা সংগঠিত ভাবে অংগশগ্রহণ করেন। এরপর থেকে অস্পৃশ্যতা, জাতপাত, বয়স্কশিক্ষা, স্বচ্ছতা অভিযান ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে প্রচার এবং গণসচেতনতায় দলে দলে ছাত্ররা যোগদান করেন। 

১৯৩৬ সালের ১২ই আগস্ট সর্বভারতীয় ছাত্র ফেডারেশন গঠিত হয় জাতীয় কংগ্রেসের উদ্যোগে। মহম্মদ আলি জিন্না এবং জহরলাল নেহেরু ছাত্রদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় এবং ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানান ১৯শে আগস্ট । তারপরই স্কুল কলেজ ছেড়ে শত শত ছাত্র স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদান করেন। পরবর্তীকালে ১৯৪০ সালে জাতীয় কংগ্রেস এবং সর্বভারতীয় ছাত্র ফেডারেশনের অধিবেশন একই সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয় চেন্নাইতে। এইসময় থেকেই রাশিয়ায় প্রবর্তিত স্টালিন কন্সটিটিঊশন সমর্থন করার প্রসঙ্গে সর্বভারতীয় ছাত্র ফেডারেশনে দ্বিমত সৃষ্টি হয় এবং অবশেষে ১৯৪৫ সালে সর্বভারতীয় ছাত্র ফেডারেশনের নেতৃত্ব সম্পূর্ণভাবে কম্যুনিস্ট সমর্থকদের হাতে চলে যায় । 

স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে ছাত্রদের একটা বড় অংশ হিংসাত্মক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন এবং অনেকেই জেলে যান বা ফাঁসিতে অথবা পুলিশের গুলিতে মারা যান। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী ছাত্র আন্দোলনগুলির চরিত্র লক্ষ্য করলে বোঝা যায় যে এগুলি মূলতঃ স্বাধীনতা আন্দোলনের তথা মূলস্রোত রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। সুতরাং এই আন্দোলনগুলি মূলতঃ জাতীয় স্তরে এবং সর্বভারতীয় নেতৃত্বের দ্বারাই পরিচালিত হত। 

স্বাধীনতোত্তর কালে ছাত্র আন্দোলনগুলির চরিত্র পরিবর্তিত হয়। স্থানীয় এবং রাজ্যভিত্তিক স্তরে বিচ্ছিন্নভাবে আন্দোলনগুলি সংগঠিত হতে থাকে । স্বল্পমেয়াদী ইস্যুভিত্তিক এই আন্দোলনগুলি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাময়িক সাফল্য পেলেও বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই সাফল্যের মুখ দেখেনি। 

স্বাধীনতার পর জাতীয় কংগ্রেস দল ক্ষমতায় আসে৷ তারপর এক সময় ছাত্র সংসদ নির্বাচন চালু হয়৷ ছাত্র ইউনিয়নের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যে দলগুলি অংশ নেয়, তাদের প্রায় সকলেই প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের ছাত্রশাখা৷ এনএসইউআই, এবিভিপি, এমএসএফ,এআইএসএফ, এসএফআই, সিপি, টিএমসিপি ইত্যাদি —ছাত্রশাখাগুলি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অনুগামী৷ ফলে ছাত্র সংসদের নির্বাচনগুলি দেশের মূল রাজনৈতিক দলগুলির মতই কেবলমাত্র ক্ষমতাদখলের লক্ষেই চালিত হতে থাকে। ছাত্র সংসদের নির্বাচনেও হিংসার আবহাওয়া তৈরী হতে থাকে। 

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে যে ছাত্র আন্দোলনগুলির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যাতে পারে তার মধ্যে ১৯৬৯ -৭১ এ নকশাল আন্দোলন একটি বিশেষ মাত্রা পেয়েছিল কিন্তু ভ্রান্ত রণকৌশল এবং অপরিণত নেতৃত্বের কারণে এই আন্দোলন কেবল ব্যর্থ হয়নি বিগত পঞ্চাশ বছরে এই আন্দোলন আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। সে প্রসঙ্গে আসছি এই প্রবন্ধের শেষের দিকে। 

এছাড়া যে আন্দোলনগুলিতে ছাত্রদের বিশেষ ভূমিকা ছিল সেগুলি হলো,

১৯৭০ এ চিপকো আন্দোলন। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাজের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা এবং জঙ্গল কেটে ফেলার বিরুদ্ধে ১৯৭০ সালে উত্তরাখণ্ডের গোপেশ্বরে চণ্ডীপ্রসাদ ভাটের নেতৃত্বে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে ওঠে। সংগঠনটির নাম ছিল দাশৌলি গ্রাম স্বরাজ সঙ্ঘ। এই আন্দোলন শুরু হয় যখন বনদপ্তর সাইমন কোং কে গাছ কাটার ইজারা দেয় এবং স্থানীয় বাসিন্দারা তার প্রতিবাদ জানালে বাইরে থেকে শ্রমিক নিয়ে আসা হয়। সঙ্ঘের সদস্যরা গাছ জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন ঘন্টার পর ঘন্টা। অনেক মহিলা এবং ছাত্র এই আন্দোলনে অংশ নেন। পরে এই আন্দোলন বৃহত্তর বনসম্পদ রক্ষা আন্দোলনের চেহারা নেয়। এই আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে ৪৪ দিন (২৫।৫।৭৪ থেকে ৮।৭।৭৪) ব্যাপী এক দীর্ঘ ৭০০ কিমি পদযাত্রায় হাজার হাজার ছাত্র সামিল হন।

১৯৭৪ সালে নবনির্মাণ আন্দোলন। ১৯৭৩এর ডিসেম্বরে আমেদাবাদের এক কারিগরি কলেজে এই আন্দোলন শুরু হয় ২০% হোস্টেল ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদে। এই আন্দোলন অচিরেই দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের চেহারা নেয়। ৩।১।৭৪এ এক ধর্মঘটে ছাত্র এবং পুলিশের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয় গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয়ে। তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী চমনভাই প্যাটেলের পদত্যাগের দাবিতে ২৫শে জানুয়ারি রাজ্যব্যাপী বন্ধের ডাক দেয় ছাত্ররা। ৪০টি শহরে কার্ফু জারি হয়। অবশেষে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী চমনভাই প্যাটেলকে পদত্যাগ করতে বলেন।

১৯৭৯ থেকে ৮৫ সালে আসামে অনুপ্রবেশকারী হঠানোর দাবিতে তুমুল ছাত্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন নামে একটি ছাত্র সংগঠন এই আন্দোলনের শুরু করে। ব্যাপক জনসমর্থনের ভিত্তিতে এই আন্দোলন এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে পরবর্তী নির্বাচনে এই আন্দোলনের ছাত্র নেতৃত্ব এবং প্রাপ্তবয়স্ক সক্রিয় সমর্থকেরা ক্ষমতা দখল করে ‘ আসাম গণ পরিষদ’ সরকার প্রতিষ্ঠা করে।

১৯৯০ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ভি পি সিং ওবিসিদের জন্য মন্ডল কমিশন প্রস্তাবিত ২৭% সংরক্ষণ চালু করতে চাইলে সেন্ট স্টিফেন্স কলেজ এবং দিল্লি স্কুল অব ইকোনোমিক্স এর ছাত্রদের নেতৃত্বে হাজার হাজার ছাত্র সংগঠিত হন এবং দেশজুড়ে অর্থনৈতিক ভিত্তিতে সংরক্ষণের দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়। মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ তখনকার মত স্থগিত রাখা হয়। 

২০১৩ সালে শ্রীলঙ্কাতে তামিলদের ওপর অত্যাচারের প্রতিবাদে এবং ইউনাইটেড নেশান্সের ‘রেসলিউশন ফর ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইনভেস্টিগেশন অফ ওয়ার ক্রাইমকে’ সমর্থন না করার দাবিতে ‘স্টুডেন্ট ফেডারেশন ফর তামিল ইলম’ আন্দোলনের ডাক দেয়। ১১।৩।২০১৩ তে লয়লা কলেজে অনশনরত ছাত্রদের এবং রাজভবনের সামনে জমায়েত হওয়া ৫০০র বেশী ছাত্রকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে । 

২০১৪ সালে কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্রী নিগ্রহের বিচারের দাবিতে ছাত্র অবস্থানে পুলিশি নিগ্রহের প্রতিবাদে এবং উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে ছাত্রছাত্রী এবং প্রাক্তনীরা এক বিশাল আন্দোলনে সামিল হোন। ‘হোক কলরব’ নামে এই ছাত্র আন্দোলন আংশিক সাফল্য পায়। উপাচার্য অবশেষে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এই আন্দোলনে সোসাল মিডিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নানারকম সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে এই আন্দোলন এক বিশেষ চেহারা পেয়েছিল। 

২০১৬ সালের জানুয়ারিতে দলিত পিএইচ ডি গবেষক রোহিত ভেমুলার আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধান এবং বিচারের দাবিতে এক বিশাল ছাত্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। এক এবিভিপি নেতাকে আক্রমণের শাস্তি হিসেবে পাঁচজন দলিত ছাত্রকে হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেল থেকে বিতাড়িত করা হয় এবং ক্যাম্পাসে প্রবেশের ব্যাপারে তাদের ওপর নানা বিধিনিষেধ চালু করা হয়। এই পাঁচজনের একজন রোহিত ভেমুলাকে ১৭ই জানুয়ারি হোস্টেলে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। এই ঘটনার প্রতিবাদে এবং বিচারের দাবিতে এই আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল। শেষ অবধি কেউ শাস্তি পায়নি। 

২০১৭ সালের জানুয়ারিতে তামিলনাড়ু এবং পণ্ডিচেরিতে প্রায় কুড়ি লক্ষ ছাত্র ‘জাল্লিকাট্টু’ বন্ধ করার প্রতিবাদে আন্দোলনে অংশ নেন। অবশেষে সরকার তাদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়।

লক্ষণীয় যে এই সমস্ত ছাত্র আন্দোলনগুলি ছিল মূলতঃ ইস্যুভিত্তিক। এগুলির মধ্যে কোনোটিই কোনো বৃহত্তর সামাজিক বা রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারেনি। সুতরাং এগুলি তাদের নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যেই সাময়িকভাবে সফল, অর্ধসফল বা অসফল হয়েই শেষ হয়ে যায়। কোনো আন্দোলনই সামগ্রিকভাবে জাতীয় স্বার্থে বৃহত্তর আন্দোলনে উন্নীত হতে পারেনি। 

এবারে আসি নকশাল আন্দোলন সংক্রান্ত আলোচনায়। ১৯৬৯ সালে নকশালবাড়িতে এবং শ্রীকাকুলামে কম্যুনিস্ট নেতৃত্বে কৃষক অভ্যুত্থানের অব্যবহিত পরেই তদানীন্তন সি পি আই এম দ্বিধাভিবক্ত হয়ে যায়। সংসদীয় রাজনীতির পথ থেকে সরে এসে চীনের কম্যুনিস্ট বিপ্লবের আদলে গ্রামকেন্দ্রিক সশস্ত্র আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে সি পি আই এম এল নামে একটি পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়। নকশালবাড়ির আন্দোলন সাময়িক সাফল্য লাভ করার ফলে দেশের অনেক জায়গা জুড়ে এই আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। এর ফলে সি পি আই এম এল নতুন করে ভারতের শ্রেণীচরিত্র নির্ধারণ করে এবং শ্রেণীশত্রুদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের পথে এগিয়ে চলে। আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ, সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া এবং সামন্তবাদ শ্রেণীশত্রু এবং আক্রমণের লক্ষ্য হিসেবে চিহ্ণিত হয়। পশ্চিমবঙ্গের বিশেষ করে কলকাতার ছাত্রসমাজ এই আন্দোলনে সামিল হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এই আন্দোলন শহুরে আন্দোলনে পরিণত হয় এবং নেতৃত্বের বিভ্রান্তিকর প্ররোচনায় শ্রেণীশত্রু খতমের নামে শহরাঞ্চলে সাধারণ মানুষ, শিক্ষক, পুলিশকর্মীদের নির্বিচারে হত্যা শুরু হয়। শিক্ষা এবং শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের নামে স্কুল, কলেজ, সিনেমা হল, থানায় আগুন লাগানো, বোমাবাজি নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। জনজীবন সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সাধারণ মানুষের রুটি রোজগার প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। তার ওপরে এই বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে সমাজবিরোধীরা নকশাল নাম ভাঙ্গিয়ে শুরু করে চুরি ডাকাতি এবং লুঠপাট। পুলিশ এবং সাধারণ মানুষ যৌথভাবে এই আন্দোলনের নামে প্রহসনকে বন্ধ করতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। পুলিশের গুলিতে বহু স্বল্পবয়সী অপরিণতমনস্ক ছাত্রের অকালমৃত্যু ঘটে । অনেক ছাত্র শহরছাড়া হয়ে কোনোক্রমে প্রাণে বাঁচে। গ্রামকেন্দ্রিক সশস্ত্র আন্দোলনকে শক্তি জোগানো তো দূরের কথা সম্পূর্ণ দিশাহীন এই আন্দোলন অচিরেই মুখ থুবড়ে পড়ে। যে আন্দোলনের নেতৃত্ব কৃষক শ্রমিকের দেওয়ার কথা সেই আন্দোলনকে কিছু শহুরে মধ্যবিত্ত যে চালনা করতে পারবে না সেটাই স্বাভাবিক। নকশাল আন্দোলনের তৎকালীন অনেক নেতাই পরে মধ্যবিত্ত জীবনে ফিরে আসেন এবং কেউ কেউ সংসদীয় রাজনীতিতেও যোগদান করেন । 

এবার আসি বর্তমানে ছাত্র রাজনীতি কি চেহারা নিয়েছে সেই প্রসঙ্গে। রাজনৈতিক দলগুলি শুধুমাত্র ছাত্রদের আবেগকে কাজে লাগিয়ে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর চেষ্টা করে। অনেক ক্ষেত্রে ইউনিয়ন দখলের পাশাপাশি প্রশাসনের উচ্চস্তরে নিজেদের লোক নিয়োগ করে এই নিয়ন্ত্রণকে আরো জোরদার করে। সব আমলেই এর ভূরি ভূরি নিদর্শন আমরা দেখেছি। অল্পবয়েসি ছাত্ররা পড়াশোনা ব্যাহত করে’এই কর্মকান্ডে জড়িয়ে যায় মূলত তিনটি কারণে, নেতৃত্বের লোভ, অ্যাডভেঞ্চারের নেশা এবং ব্যক্তিগত রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খা। শতকরা ৯৮ ভাগ সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক জীবনের শুরু এবং শেষ ছাত্রজীবনেই সীমাবদ্ধ। সাংসারিক এবং পেশাদারী জগতেই জীবনের বেশীরভাগ সময় কেটে যায়, আজও নিজের গতিতে।

আমার মতে যে সব ছাত্রের রাজনীতিতে উৎসাহ আছে তারা সচেতনভাবেই এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্যে অংশগ্রহণ করতে পারে তবে কোনওভাবেই নিয়মিত পড়াশোনার বিনিময়ে নয়। এই পরিস্থিতে রাজনীতির জন্যে পড়াশোনার সঙ্গে সমঝোতা আত্মহননের সামিল। কোনো ব্যক্তির বা দলের রাজনৈতিক উচ্চাশার শিকার হওয়ার থেকে সাবধান থাকা বাঞ্ছনীয়। ছাত্রাবস্থায় অন্তরের তাগিদকে যুক্তির কষ্টিপাথরে যাচাই করেই কোনো রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। নয়তো পদস্খলনের সম্ভাবনাই সমধিক।

যদি এ কথা মানতেই হয় যে ভারতবর্ষকে এই অবস্থা থেকে মুক্ত করার জন্য কম্যুনিস্ট আন্দোলন একান্তই প্রয়োজন সে ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে ভারতবর্ষে প্রকৃত অর্থে এই মুহূর্তে কোনো কম্যুনিস্ট পার্টির গুরুত্বপূর্ণ অস্তিত্ব নেই। যারা নিজেদের কম্যুনিস্ট বলেন তারা সংসদীয় বা অসংসদীয় দু ক্ষেত্রেই নানাবিধ কারণে চূড়ান্ত অসফল। একথা বলা বাহুল্য যে অন্তর্দন্দ্বে দীর্ণ এই কম্যুনিস্টরা এই মুহূর্তে একটি বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি।

যে কম্যুনিস্টরা ভোটের রাজনীতির প্রতি অনাস্থা প্রদর্শন করে সংসদীয় কম্যুনিস্টদের থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নতুন দল গঠন করে’ বিপ্লবের নতুন পথে হাঁটতে শুরু করলো তাঁরা নকশালবাড়ী আন্দোলনের সাময়িক জয়ের অব্যবহিত পরেই সাংগঠনিক ব্যর্থতার শিকার হয়ে একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে গেলো। শুনেছি বহুভাগে বিভক্ত এই পার্টির মধ্যে অনৈক্য মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল এবং ঐক্য আর পুনর্স্থাপিত হয়নি। 

বিগত ৫০ বছরে ভারতবর্ষের কম্যুনিস্ট আন্দোলনের পাতা জুড়ে একটা বিশাল শূন্য। বিপ্লবোত্তর চীন এবং রাশিয়ার শ্রেনীভিত্তিক অর্থনৈতিক অসামঞ্জস্য ক্রমশ বেড়ে চলেছে। যদিও দ্বন্দ্বমূলক ও ঐতিহাসিক বস্ত্তুবাদের উপরে আধারিত মার্ক্সীয় দর্শন যথার্থই যুক্তিভিত্তিক এবং সর্বাঙ্গীন বিপ্লবের অবিসংবাদিত চালিকাশক্তি তবুও দুই প্রধান কম্যুনিস্ট দেশের বর্তমান অবস্থার নিরিখে বিশ্ব জুড়ে কম্যুনিস্ট আন্দোলন এক বিশাল প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে।

গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষে এই মুহূর্তে শাসকশ্রেনীর প্রতিনিধিরা যদিও কয়েকটি দলে বিভক্ত তবুও নীতিহীন ভাবে ক্ষমতা ভাগ করে একত্রে ভোগ করার ব্যাপারে প্রকৃতই সংহত। অন্যদিকে শ্রেণীহীন ও শোষণহীন সমাজ গড়ার লক্ষ্যে এমন কোনো শক্তি সংগঠিত হয়নি যারা এই ব্যবস্থাকে বদল করার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ ও স্থিরপ্রতিজ্ঞ। সুতরাং প্রকৃত অর্থে ছাত্র আন্দোলনকে মূল রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করার উপযুক্ত নেতৃত্ব এইমুহুর্তে অনুপস্থিত। এই কারণেই বর্তমান প্রেক্ষাপটে যেনতেনপ্রকরেণ ক্ষমতাদখলের রাজনীতিতে ছাত্রদের সক্রিয় অংশগ্রহণ না করাই শ্রেয়।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - পৃথা কুণ্ডু

Posted in

‘যাওয়া তো নয় যাওয়া’
পৃথা কুণ্ডু

গঙ্গাযাত্রা করতে চাইছেন এক বৃদ্ধা। দীর্ঘদিন রোগভোগের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে ‘চান্দ্রায়ণ’-এর বিধান রয়েছে। কিন্তু পরিবার-পরিজন সবাই দ্বিধায় – চান্দ্রায়ণের পরও যদি দেহে প্রাণ থাকে, তাহলে ত আর বাড়ি ফিরে যাবার উপায় নেই। গঙ্গার ধারেই আটচালা বেঁধে কাটাতে হবে আমৃত্যু। কিন্তু বৃদ্ধা নিজেই যে অস্থির হয়ে উঠছেন সংসার থেকে ছুটি পেতে। অগত্যা আত্মীয় স্বজন, গ্রামের লোকজন সবাই মিলে যাত্রা করে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল গঙ্গার ঘাটে। দিনভর চলল পুজোপাঠ। তারপর বেলা গড়াতে বৃদ্ধা নিজেই সজ্ঞানে বললেন, আর দেরি নয় – এবার তোরা আমায় অন্তর্জলি কর। সবাই কাঁদল, শেষবারের মত পায়ের ধুলো নিল তাঁর। তারপর, গঙ্গার জলে তাঁর শরীর স্পর্শ করা মাত্রই সব শেষ। 

অবাক বিস্ময়ে ঠাকুমার জীবনের এই ‘মহাসুন্দর শেষ’-এর সাক্ষী হয়ে ছিল বছর পাঁচেকের ছেলেটি। বড় হয়ে সে লিখল, “ঠাকুমার মৃত্যু আমাদের সংসারে একটা বিরাট ছন্দপতন। কিন্তু ঠাকুমা তো সেটা বুঝতে দিলেন না কাউকে। কত সুন্দরভাবে, সুর লয় ঠিক রেখে শেষ করলেন তাঁর জীবনের পর্ব। জীবনকেও তাহলে সুরে বাঁধা যায়।... সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনা, হতাশা - এর কোনটাই সুরের আওতার বাইরে নয়। প্রচণ্ড আনন্দ, প্রকাশটা ঠিক সুরে না হলে সেটা মিষ্টি না লেগে তেতো লাগবে। তেমনি দুঃখের কান্নাটাও বীভৎস ঠেকবে যদি না বিলাপটা সুরে সুরে বেরিয়ে আসে।... সেই সুরের সন্ধানেই আজও এগিয়ে চলেছি”।

এই উপলব্ধির কথা লিখেছেন যিনি, তাঁর সুরের যাদুতে মেতেছে পাঁচ প্রজন্ম। তিনি নামে হেমন্ত, কণ্ঠে চিরবসন্ত। রবীন্দ্রসংগীত থেকে গণসংগীত, বাংলা আধুনিক থেকে হিন্দি গীত-গজল, ছায়াছবির রোমান্টিক গান থেকে পুজোর গান, মেঠো সুরের আদলে লোকগান থেকে উদাত্ত-গভীর স্তোত্রগীতি – কি নেই তাঁর সুরের ভাণ্ডারে? শ্রোতাদের আনন্দ দিতে নানা ধরনের গান তিনি গেয়েছেন জীবনভর। শিল্পীর ব্যক্তিগত অনুভূতির খোঁজ অনেকসময়ই পাওয়া যায় না বৃহত্তর জনসমাজের জন্য নিবেদিত তাঁর সৃষ্টিতে - একথা ঠিক, তবু মনে হয় – শেষের গানে, চলে যাবার গানে কি আলাদা মাত্রা পেত তাঁর মরমি পরিবেশন, গভীরতর কোন বোধের আবেদনে সাড়া দিত তাঁর দেবকণ্ঠ? তাঁর সারা জীবনের সুরসর্বস্ব অনুভবের পেছনে যে ঘটনার কথা তিনি নিজে স্বীকার করে গেছেন – তার অবচেতন বা পরোক্ষ প্রভাব কি পড়েনি এই ধরনের গানে?

ভিন্ন ভিন্ন শ্রোতার বোধ ও রসগ্রাহিতা হয়তো আলাদা কথা বলবে। ‘আমিও পথের মত হারিয়ে যাব’ হয়তো কারও কাছে শুধুই একটি ভাললাগার, মন-উদাস করা গান, আবার কারও কাছে ‘চোখের আলো নিভল যখন মনের আলো জ্বেলে/ একলা এসেছি আমি একলা যাব চলে’ – কথাগুলোর সুর আর উচ্চারণ জীবনের চরমতম সত্য। ‘গাঁয়ের বধূ’র শেষে যখন ‘ভাঙা কুটিরের সারি’ আর ‘আশা স্বপনের সমাধি’ শব্দগুলো আসে, কেমন যেন বুকছেঁড়া, স্বজন হারানোর ব্যথা ঘনিয়ে ওঠে হেমন্তকণ্ঠে। যারা শোনে, তাদেরও হয়ত – কে জানে কোন ফেলে আসা, চিরদিনের মত হারিয়ে ফেলা পুরনো বেদনার স্মৃতিতে ভারি হয়ে ওঠে মন।

ছায়াছবিতে ‘সিচুয়েশন’ অনুযায়ী গান পরিবেশন যে কোন পেশাদার শিল্পীর দায়বদ্ধতা। এ নিয়ে হয়ত আলাদা করে বলার কিছু নেই। ‘লালন ফকির’ ছবিতে ‘সব লোকে কয়’ বা ‘আমি আছি কোথায়’-এর মত বহুল প্রচারিত না হলেও, ‘চিরদিন কাঁচা বাঁশের খাঁচা থাকবে না’ গানটি আলাদা মাত্রা পেয়েছিল হেমন্তর গলায়। লালনের গুরু ফকিরসাহেব এই গানটি শুনতে শুনতে পাড়ি দেন দুনিয়াদারি ছেড়ে। তেমনই ‘নাগিন’-এ ‘ও জিন্দেগি কে দেনেওয়ালে/ জিন্দেগি কে লেনেওয়ালে’, ‘প্রতিমা’ ছবিতে ‘কবর দাও বা চিতায় পোড়াও’ বা ‘কাল তুমি আলেয়া’র ‘যাই চলে যাই’ তো বিশেষ ভাবে মৃত্যুর অনুষঙ্গেই লেখা গান – সচেতন শিল্পী এই ধরনের গানের প্রতি সুবিচার করবেন, এটাই স্বাভাবিক – হয়ত বলবেন অনেকে । তাহলে একটু অন্যরকম গানের কথা মনে করে দেখি – যেমন ‘অগ্নীশ্বর’ ছবিতে ‘পুরানো সেই দিনের কথা’ গানটি। অতি-পরিচিত এই রবীন্দ্রসংগীত পাড়ার জলসায়, ঘরোয়া অনুষ্ঠানে, বিশেষ করে পুনর্মিলন জাতীয় উৎসবে সকলে মিলে, সুরে-বেসুরে এতবার গাওয়া হয় যে গানের ভাব বা বাণী নিয়ে অন্যরকম কিছু ভাবার কথা মনেই আসে না। ‘অগ্নীশ্বর’-এ হেমন্তর গলায় গানটি যখন পর্দায় এল, বয়স্ক নায়ককে দেখতে আসা পুরনো বন্ধুদের মত দর্শকও নতুন করে ভাবতে বসল – বাইরে থেকে কড়া মেজাজি, বেপরোয়া, বিশাল ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন ডাক্তারবাবুর মধ্যে যে অসহায় বিপত্নীকের প্রাণ এমন করে লুকিয়ে ছিল, কে জানত? এ ছবির শেষ দৃশ্যেও আর এক অভিনব সংগীতায়ন। ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’ তো দেশাত্মবোধক গান হিসেবেই জেনেছি এতদিন। অগ্নীশ্বরের হাত কেঁপে ফুলগুলো পড়ে যাওয়া, উঠোনে লোকের ভিড়, তারপর পর্দা জুড়ে চিতা জ্বলে ওঠার অপেক্ষা – সব কিছুর সঙ্গে অদ্ভুত ভাবে মানিয়ে যায় সম্পূর্ণ অন্য মেজাজের একটি গানের শেষ স্তবক – ‘ও মা তোমার চরণ দুটি বক্ষে আমার ধরি / আমার এই দেশেতেই জন্ম যেন এই দেশেতেই মরি’। সৌজন্যে সেই অনুপম কণ্ঠ – যার আবেদনে মৃত্যু হয়ে ওঠে অমৃত।

একজনের কথা মনে পড়ে, সাউণ্ড এফেক্ট-এর কারিকুরি নিয়ে গবেষণা করত। গান শুনত কান খাড়া করে, কিন্তু চুলচেরা বিশ্লেষণের মানসিকতা নিয়ে। একদিন ‘পলাতক’-এর শেষ অংশের অডিও চালিয়েছে ল্যাপটপে, নোট করে রাখছে শব্দপ্রয়োগের খুঁটিনাটি। ‘বসন্ত-ও ও’ বলে বৌদির আকুল চিৎকারের পর সন্ধ্যার মত ঘনিয়ে এল ধীর লয়ে, টানা সুরে সেই গান – কোন আবহ বা যন্ত্রানুষঙ্গ ছাড়াই খালি গলায় - ‘তোমার ঘরে সুখের বাতি যেন নেভে না কো/ আনন্দ পাখিটা বন্ধু বন্দী করে রাখো/ সুখে থাকো তুমি বন্ধু আমি চলে যাই/ আমি চলে যা—ই’… গবেষকের আঙুল আলগা হয়ে পেনটা খসে পড়ল টেবিলে, সমর্পণের ভঙ্গিতে শুধু শুনতে লাগল - এ গান কি বিশ্লেষণ করা যায়!

মানুষের জন্য নানা ধরনের গান গেয়ে যাওয়া তাঁর ‘কাজ’, তবু হেমন্তর নিজের কথায়, তিনি সবচেয়ে বেশি তৃপ্তি পেতেন রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে। বিভিন্ন স্মরণসভায় তাঁর গলায় বাছাই করা কয়েকটি রবীন্দ্রসংগীত অন্যরকম গভীরতা এনে দিত সামগ্রিক পরিবেশে। সমরেশ বসুর স্মৃতিসভায় নিজের অসুস্থতা, ক্লান্তিকে হার মানিয়ে গেয়েছিলেন ‘দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ওপারে…’ দর্শকের আসনে বসা তাঁর কবি-বন্ধু সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কথায় – ‘সারা হল স্তব্ধ। কারও মুখে কথা নেই’। মাতৃবিয়োগের পর ভেঙ্গে পড়া আর এক বন্ধুকে একান্তে সান্ত্বনা দিতে, শত ব্যস্ততার মধ্যেও সময় বার করে তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন নিরিবিলি গঙ্গার ঘাটে; বন্ধুকে বুকে চেপে ধরে শুনিয়েছিলেন একের পর এক মৃত্যুঞ্জয়ী রবীন্দ্রসংগীত। পরে সেই বন্ধুর স্বীকারোক্তি – ওই দিনটা তিনি কোনদিন ভুলতে পারবেন না।

‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন’, ‘তুমি কি কেবলই ছবি’, ‘আমার যাবার বেলা পিছু ডাকে’, ‘যখন ভাঙল মিলনমেলা’, ‘মরণের মুখে রেখে দূরে যাও চলে’, বা ‘কে বলে যাও যাও আমার যাওয়া ত নয় যাওয়া’-র মত গান অন্য শিল্পীরাও গেয়েছেন, কিন্তু কিভাবে যেন এক অননুকরণীয় হৈমন্তী বৈশিষ্ট্যের ছাপ পড়ে গেছে এই সব অশেষ-করা গানে – যেমন ‘আছে দুঃখ আছে মৃত্যু’ বা ‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু’ অনেকের কাছেই ‘দেবব্রত বিশ্বাসের গান’। একজনের দাদুর মৃত্যুদিন ১৬ জুন – প্রতিবছর সে ওইদিন ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’ গানটি চালিয়ে, হেমন্তর সঙ্গে নিজে গলা মেলায়। এসবই মূলত বক্তিগত অনুভূতি, তা বলার অপেক্ষা নেই – কিন্তু তার বেশি কিছুই কি নয়!

হেমন্ত-অনুরাগীদের বিচারে জনপ্রিয়তার তালিকায় বরাবর উপরের দিকে থাকা ‘আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে’ গানটি নাকি প্রথমে অন্য একজন শিল্পীর গাওয়ার কথা ছিল। বিভিন্ন কারণে তা হয়ে ওঠেনি। হেমন্তর রেকর্ড বেরোবার পর গান শুনে সেই শিল্পীর নিজেরই মনে হয়েছিল, ‘আমি যদি আর নাই আসি হেথা ফিরে’র কথা ও সুর তিনি এমনভাবে লাগাতে পারতেন না। আরও এক আশ্চর্য সমাপতন – হেমন্তর শেষ রেকর্ড করা গান ‘একটাই শুধু প্রশ্ন আমার… শ্মশানেতে কত লোক হবে’। গানটি গাওয়ার পর মজার ছলে নাকি কথা আদায় করে নিয়েছিলেন অনুজ সুরকারের কাছ থেকে – ‘কি সব গান গাওয়াচ্ছিস আমায় দিয়ে! তাহলে আমি চলে গেলে এই গানটা বাজাবি তো’? তিনি নিজে কি বুঝতে পেরেছিলেন কিছু? তার কয়েকদিন আগে, জীবনে শেষবার বাংলাদেশ সফরে গিয়ে খোঁজ করেছিলেন এক পূর্বপরিচিত অনুরাগীর। জানতে পারলেন, ভদ্রলোক আর বেঁচে নেই। তাই কাউকে কিছু না জানিয়ে একা চলে গিয়েছিলেন তাঁর কবরের পাশে। ভক্তের সমাধির পাশে বসে কোন গান শুনিয়েছিলেন কিনা, সেকথা জানা নেই।

শেষের গান নিয়ে বলতে শুরু করে, শেষ করা সত্যি বড় কঠিন মনে হচ্ছে। আরও একটা গল্প দিয়েই না হয় শেষ করা যাক। একটি ছেলে আর একটি মেয়ে। পাতানো ভাইবোন। ছেলেটি লতাজির গানে পাগল, মেয়েটি হেমন্ত-ভক্ত। গলায় সুর থাক বা না থাক, ছেলেটি গাইত ‘সারাদিন রিমঝিম কত বৃষ্টি/ কত বৃষ্টি হয়েছে মন জুড়ে’ – মেয়েটি পাশ থেকে ধরত পরের লাইন। মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সে দুরারোগ্য ব্যাধি ছিনিয়ে নিল দাদাকে; বোন পাথর হয়ে গেল যেন। গান শুনতেও ভাল লাগত না অনেক বছর; কাউকে বলে বোঝাতে পারত না কিছু। কেবল যন্ত্রের মত কাজ আর দিনগুলো কাটিয়ে যাওয়া। রাতের পর রাত ঘুম হত না। কয়েক বছর পর ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তার চোখ আটকে গেল একটি সিডিতে। লন্ডনে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের লাইভ রেকর্ডিং-এর সংকলন। মেয়েটি কিসের টানে যেন আর থাকতে পারল না – মাসের শেষ, তবু কিনে ফেলল। সন্ধ্যেবেলা সিডিটা চালাল সে একলা ঘরে। প্রথম গানটি আগেও শোনা, দ্বিতীয়টি ‘জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে’। হেমন্তর গলায় এ গান তার শোনা ছিল না। ‘বন্ধু হে আমার রয়েছ দাঁড়ায়ে …দু বাহু বাড়ায়ে’ শুনতে শুনতে সে কাঁপল, কাঁদল – দুঃখে নয়, আনন্দে – কে বলে সবকিছু শেষ, কে বলে তার আপনজন ছেড়ে গেছে তাকে? সে তো রয়েছে সমস্ত অস্তিত্বে মিশে। জীবনদেবতা সেদিন বোধহয় গানের রাজার অশরীরী কণ্ঠে ভর করে তাকে ফিরিয়ে এনেছিলেন জীবনে, তুলে এনেছিলেন চরম মানসিক যন্ত্রণার গভীরে তলিয়ে যাওয়া থেকে। 

তিরিশ বছর হয়ে গেল – হাজার হাজার অনুরাগীর প্রিয়জন হারানোর বিষাদে ঘেরা ২৬ সেপ্টেম্বর ফিরে আসবে আবার। কিন্তু এবছর যে তাঁর শতবার্ষিকীও। ক্ষয়, লয়, বেদনা, শোক, স্মৃতি-বিস্মৃতি সবকিছু ছাপিয়ে তাই সত্য হযে থাকবে তাঁর কণ্ঠে – 

কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি
সকল খেলায় করবে খেলা এই আমি।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - পৌলোমী

Posted in

সংঘর্ষ থেকে সংহতি
পৌলোমী

দয়া নদীর জলে স্নান সেরে উঠলেন সম্রাট অশোক। একি স্নান নাকি রক্তস্নান! জানা নেই তাঁর। স্বচ্ছ নদীর জলে এখন আর নীলিমারর নীল দেখা যাচ্ছে না। দয়া নদী আজ পরিণত হয়েছে রক্ত নদীতে। সাম্রাজ্য বিস্তার আর প্রতিহিংসায় অন্ধ হয়ে রাজা ভুলে গিয়েছিলেন বাকি সব মানুষের মত তাঁরও রক্তের রঙ লাল। দেড়লক্ষ কলিঙ্গ সেনা, দশ হাজার মগধী সেনা আর অগণিত নিরীহ শিশু, নারী হত্যার পর রাজার দুহাতের তালু ভরে গেছে রক্তে। এই পাপ থেকে মুক্তি দিতে পারেন একমাত্র তথাগত। তাই সম্রাট শরণাগত হলেন বুদ্ধের। আঁকড়ে ধরলেন শান্তির পথ। চণ্ডাশোক হলেন ধর্মাশোক।
"ওঁ সহনাববতু সহ নৌ ভুনকতু
সহ বির্যং করবাব হই
তেজস্বী নব ধীত মস্তু মা বিদিস্বাব হই
ওঁ শান্তি শান্তি শান্তি হি..."
শান্তির বার্তা দিয়েই আজকের প্রবন্ধ শুরু করলাম। যদিও পৃথিবী সৃষ্টির মুহূর্তকাল থেকে সংঘাতই আমাদের জীবনের মূল ধারক। সেই সংঘাত পৃথিবী সৃষ্টির লগ্নে অনু-পরমাণুর সংঘাত থেকে শুরু করে আদিম মানবের সাথে প্রকৃতি ও জীবজন্তুর বেঁচে থাকার নিরন্তর লড়াই, মানব শরীরে জীবনের স্পন্দন আনার জন্য শুক্রাণুর দৌড় সব ব্যাপারেই লক্ষ্য করা যায়। সংঘাত ছাড়া জীবন এক মুহূর্তও চলে না। মহামতী ডারউইন 1959 সালে তাঁর 'origin of species by means of natural selection' বইতে 'স্ট্রাগল ফর এগজিস্টেন্স' বা অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম নামে একটি তত্ত্বের উদ্ভাবন করেন। আর তাতেই আমরা দেখি প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে যোগ্যতমের উদবর্তন হয়। কাজেই সংঘাত অবিশ্যম্ভাবী।
কিন্তু সেই সংঘাত যদি অস্তিত্বের প্রয়োজন ছাপিয়ে ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থে আরও কিছু আগ্রাসনের জন্য যেমন সম্পদ এবং শ্রম লুন্ঠনের জন্য হয় তাহলে তা মেনে নেওয়া যায় না। আজকে বিশ্ব জুড়ে লুন্ঠনের পদ্ধতি পাল্টেছে।বিশ্বায়নী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা লুন্ঠন প্রক্রিয়াকে সর্বজনীন চরিত্র দিয়েছে। গত কয়েক শতাব্দী ধরেই বহুযুদ্ধ এবং গত শতাব্দীর দুটি বিশ্বযুদ্ধ বলা যায় চরমতম লুন্ঠন এবং আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া। এই স্বার্থান্বেষী, পুঁজিবাদী লুঠতরাজঘটিত সংঘাত কখনোই কাম্য নয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে শতকরা পাঁচ ভাগ মানুষ মারা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় শতকরা ছেষট্টি ভাগ। আজকের দিনে যে কোন আঞ্চলিক যুদ্ধে আশি থেকে নব্বই ভাগ নাগরিক জনসাধারণের সম্পদ ও জীবন বিনষ্ট হয়। গত তিন দশক ধরে ভিয়েতনাম, আফগানিস্তান, ইরাক, লেবানন কবরস্তানে পরিণত হয়েছে। প্রতিমুহূর্তে যুদ্ধের আবহাওয়া ছড়িয়ে পড়ছে সিরিয়া, ইরান, উত্তর কোরিয়ায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধ কমেনি বরং ধ্বংস এবং মৃত্যু ব্যপকতা লাভ করেছে। উচ্চশ্রেণীর প্রযুক্তি, বিষাক্ত গ্যাসের ব্যবহার বেড়েছে। আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্রের পরীক্ষাগার হয়েছে এশিয়া, আফ্রিকার দেশগুলো। মহামারীর মত প্রায়শই যুদ্ধ লেগে রয়েছে। ধর্মীয় সংঘাত, গণতান্ত্রিক সংঘাত লেগেই রয়েছে। পরিবেশ দূষিত হচ্ছে অকাতরে। অথচ এর কোনোটাই কাম্য নয়।
সামাজিক জীব হিসাবে মানুষ শান্তিতে বাস করতে চায়। বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও সংঘর্ষ এড়ানোর জন্য জাতিপুঞ্জ, জাতিসঙ্ঘসহ বহু সংস্থা গড়ে উঠেছে। কিন্তু শান্তি কি, সংঘর্ষ বলতে আমরা কোন ধরনের সংঘাত বুঝবো এ সব ব্যাখ্যার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় জাতিসঙ্ঘের পিস ইউনিভার্সিটি। তথ্যানুযায়ী, বিশ্বে শান্তিপূর্ণ দেশের তালিকায় স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো ওপরের দিকে থাকে।
যদিও আমাদের তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির কাছে আজ সংহতি শব্দটা প্রহসনেরই নামান্তর। অথচ বারে বারে এই তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন মহাদেশে বিশেষত এশিয়া, আফ্রিকার দেশগুলিতে যুগে যুগে জন্ম নিয়েছেন বিভিন্ন মহাপুরুষের দল। পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে দিয়েছেন শান্তির বাণী। বুদ্ধ, মহম্মদ, যীশুখ্রীষ্ট থেকে শুরু করে মহাত্মা, ম্যান্ডেলা, মালালা নিজেদের সুখ জলাঞ্জলী দিয়ে জীবনের বিনিময়ে আমাদের মধ্যে আনতে চেয়েছেন সংহতিকে। আমরা ক্ষুদ্রস্বার্থ মানুষ তা হেলায় ভুলতে বসেছি। আর তাই সংহতি ফিরিয়ে আনতে 'শান্তি ও সংঘর্ষ' অধ্যয়ন সামাজিক বিজ্ঞান পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত একটি শাখা ও গবেষণার অংশ হিসাবে স্থান পেয়েছে। পৃথিবীর প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক ও শিক্ষার্থীগণ বহু আগে থেকেই সংহতি অধ্যয়ন করে আসছেন। এটি এমন একটি পাঠক্রম যেখানে অহিংস ও হিংসাত্মক উভয় ধরনের আচরণ এবং তাদের কার্যাবলী নির্ণয় ও বিশ্লেষণ করা হয়ে থাকে। এছাড়া সংঘর্ষের বিভিন্ন কাঠামোগত গঠন যেগুলো মানুষের সঠিক উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে সেগুলি নিয়েও আলোচনা করে। এটি একটি সমন্বিত অধ্যয়ন ব্যবস্থা। এর মূল উদ্দেশ্য শান্তিপূর্ণ উপায়ে যেকোন সংঘর্ষের তীব্রতা কমিয়ে আনা, সমাধান এবং নির্মূল করা।যুক্তরাষ্ট্রে গৃহযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মার্কিন কলেজগুলিতে এই বিষয় অধ্যয়নের উৎসাহ দেখা যায়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ বছরে সুইডেনে একই ধরনের আন্দোলন পরিলক্ষিত হয়। পরবর্তীতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তা ছড়িয়ে পড়ে।
সংঘর্ষ থেকে সংহতি এক সুবিশাল কর্মযজ্ঞ। পৃথিবী সৃষ্টির আদিকাল থেকে মানব, দানব, দেবতা এই কর্মযজ্ঞের ক্রীড়ানক মাত্র। হিন্দু শাস্ত্রে স্বয়ং দেবাদিদেব মহাদেব এই কর্মকান্ডের বাইরে নন। ধ্বংসের দেবতা বলা হয় তাঁকে। তবে এই সংঘর্ষ কেবলমাত্র নতুন ভালো কিছু সৃষ্টির জন্য। তাই প্রকারন্তরে বলা যেতে পারে সংঘর্ষ থেকে সংহতি একটি সুবিশাল প্রক্রিয়া যা-'বহে নিরন্তর'। তবে এই সংঘর্ষ ক্ষুদ্র স্বার্থের প্রয়োজনে না হয়ে তা কেবলমাত্র প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে, পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে, ধর্মীয় হানাহানির বিরুদ্ধে, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, শিশু ও নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে এবং জগতে আর যা কিছু খারাপ আছে তার বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে হতে হবে। তাই মানুষ হিসাবে আবারও বুদ্ধ, মহম্মদ, যীশু, চৈতন্যের মতন মহামানবের অপেক্ষায় দিন কাটাই। যাঁরা মানুষের মধ্যে 'প্রেমের বাণী' প্রচার করবেন, তাঁদের মধ্যে সংহতির মানব বন্ধন রচনা করে ঐক্যবদ্ধ করবেন। কেননা, যুগে যুগে যখনই সভ্যতা বিপন্ন হয়েছে তাঁর আবির্ভাব হয়েছে জ্যোতির্ময় রূপে _______

"যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত ।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্
পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।

0 comments:

0

ওবাড়ির চিঠি -শতরূপা দত্ত

Posted in

সম্প্রীতি ও সৌহার্দে বাংলাদেশের দুর্গাপূজা

বাংলাদেশে সম্প্রতি ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ স্লোগান জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। স্লোগানটি আজকালকার হলেও, এর অসাম্প্রদায়িক ভাবটি কিন্তু বহু যুগ আগের, বাংলার জল-মাটি-হাওয়ায় মানুষে মানুষে এই মেলবন্ধন শতাব্দী-প্রাচীন। তাই বাংলাদেশের প্রধান উৎসবগুলোর মধ্যে দুটি ঈদ, পহেলা বৈশাখ আর শারদীয় দুর্গাপূজা এক নিঃশ্বাসে উচ্চারণযোগ্য।

পঞ্চাশের দশকেও বাংলাদেশে দুর্গাপূজা ছিল গ্রামকেন্দ্রিক আনন্দঘন আয়োজন। পূজামন্ডপের আঙ্গিনায় রামায়ণ কীর্তন, পালাগান, কবির লড়াই অনুষ্ঠিত হতো। দুর্গাপূজা উপলক্ষে আয়োজিত হতো মেলা। মেলাপ্রাঙ্গনে থাকতো নাগরদোলা, মোরগের লড়াই থেকে শুরু করে নানা আয়োজন। এসব আয়োজনে ধর্মীয় বৈপরীত্য ভুলে গ্রামের সব মানুষ উৎসাহের সাথে অংশগ্রহণ করতো। 

পাকিস্তান আমলে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ছড়িয়ে দেয়া সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প বাঙালির সংস্কৃতিতে যে আঘাত করেছিলো, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা থাকলেও তাকে পুরোপুরি পরাস্ত করা যায়নি। ধর্মান্ধ মৌলবাদের বিষবৃক্ষ থেকে কিছু অনাকাঙ্খিত ফল তাই মাঝেমধ্যেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের চেষ্টা চালিয়ে যায়। তাই এখন আর গ্রামে-গঞ্জে দুর্গাপূজার তেমন বড় আয়োজন দেখা যায় না। দুর্গাপূজা এখন অনেকটাই শহরকেন্দ্রিক। তবে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, খুলনাসহ বড় বড় মহানগরে ধুমধামের সাথে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা থাকে চারপাশ। যেমন নিরাপত্তা বাড়াতে হয় ঈদের নামাজে, তাজিয়া মিছিলে, পহেলা বৈশাখের প্রভাতী আয়োজনে।

এসবের মাঝেও দুর্গাপূজা যেভাবে উৎসবের আমেজে ও সম্প্রীতির বন্ধনে বাংলাদেশের মানুষকে একীভূত করে, এমনটি অন্য কোনো দেশে দেখা যায় না। পাড়ায়-পাড়ায়, মণ্ডপে-মণ্ডপে মানুষের যে ঢল নামে তা যে শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষেরই ঢল নয়, সে কথা হলফ করে বলা যায়।

মার্কণ্ডেয় পুরাণ-এর একটি নির্বাচিত অংশ শ্রীশ্রীচণ্ডী বা দেবীমাহাত্ম্যম। এতে তেরোটি অধ্যায়ে মোট সাতশোটি শ্লোকে দুর্গাকে নিয়ে প্রচলিত তিনটি গল্প- মধু-কৈটভের কাহিনী, মহিষাসুরের কাহিনী ও শুম্ভ-নিশুম্ভের কাহিনী রয়েছে। আর আছে মর্ত্যে বা পৃথিবীতে প্রথম দুর্গাপূজা প্রচলনের কাহিনী। এই কাহিনী রাজা সুরথ ও সমাধি নামের এক বণিকের। সুশাসক ও যোদ্ধা হিসেবে রাজা সুরথের যথেষ্ট খ্যাতি ছিল। কিন্তু একবার এক যুদ্ধে তাঁর পরাজয় ঘটে। সেই সুযোগে তাঁর মন্ত্রী ও সভাসদেরা তাঁর ধনসম্পদ ও সেনাবাহিনীর দখল নেন। মনের দুঃখে বনে বনে ঘুরতে ঘুরতে রাজা মেধা নামে এক ঋষির আশ্রমে এসে উপস্থিত হন। মেধা মুনি রাজাকে নিজের আশ্রমে আশ্রয় দেন। একদিন বনের মধ্যে রাজা সমাধি নামে এক বণিকের দেখা পেলেন। সমাধির স্ত্রী ও ছেলেরা তাঁর সব টাকাপয়সা ও বিষয়সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে তাঁকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। মেধা ঋষির উপদেশে তাঁরা দুজন দুর্গাপূজা করলেন। দেবীর বরে তাদের মনস্কামনা পূর্ণ হলো। 

পুরাণে বর্ণিত এই মেধা ঋষির আশ্রমটি অবস্থিত বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালীর করলডেঙ্গা পাহাড়ে। বর্তমানে এটি মেধষ মুনির আশ্রম নামে পরিচিত। ১৯০০ সালে স্বামী বেদানন্দ নামে এক সাধক দৈবাদেশ পান কড়লডেঙ্গার বেতসা নদীর তীরে যাওয়ার জন্য। আদেশানুসারে সেখানে এসে মেধষ মুনির আশ্রমকে অবলুপ্তির হাত থেকে বাঁচান স্বামী বেদানন্দ। ১৯৭১ সালের ১৬ জুন পাকিস্তানী সেনারা এই আশ্রমে লুটপাট চালায় এবং গান পাউডার দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মন্দিরে পাথরের প্রতিমা প্রতিস্থাপন করে আবার পূজা শুরু হয়।

বলা হয়ে থাকে, অবিভক্ত বাংলায় প্রথম দুর্গাপূজার প্রচলন করেন রাজশাহী জেলার তাহিরপুরের সামন্ত রাজা কংস নারায়ণ। সম্রাট আকবরের শাসনামলে (ষোড়শ শতকে) বাংলার দেওয়ান হন তিনি। এতো বড় এক পদ পাওয়ার আনন্দে রাজা চাইলেন পৌরণিক যুগের মতো এক মহাযজ্ঞ করতে। রাজার পুরোহিত বাসুদেবপুরের ভট্টাচার্য বংশের রমেশ শাস্ত্রী জানালেন, বিশ্বজিৎ, রাজসূর্য, অশ্বমেধ ও গোমেধ- এই চার রকমের যজ্ঞ করার নিয়ম আছে। কিন্তু রাজার জন্য এই চার যজ্ঞের কোনোটাই করা সম্ভব নয়। যজ্ঞের বদলে তাই দুর্গাপূজা করার পরামর্শ দিলেন রাজপুরোহিত। রাজা খুশি মনে দুর্গাপূজার আয়োজন করলেন। সেইসময় এই পূজার জন্য খরচ হয়েছিল আট থেকে নয় লক্ষ টাকা। বর্তমানে যে পারিবারিক কাঠামো সমেত পূজিত হন দেবী, তার সূচনা হয় তখন থেকেই। 

রাজা কংসনারায়ণের সভাপণ্ডিত ছিলেন কৃত্তিবাস পণ্ডিত। তিনি ছিলেন নদীয়ার ব্রাহ্মণ। রাজার অনুরোধে ১৪৬০ শকাব্দে বাংলায় রামায়ণ রচনা করেন তিনি, যা ‘কৃত্তিবাসী রামায়ণ’ নামে বাংলার ঘরে ঘরে নতুন এক আলোড়ন সৃষ্টি করে। 

বাংলায় দুর্গাপূজা শুরু হলেও আপামর হিন্দুদের কাছে তখনই এটি বৃহত্তর পূজা হয়ে উঠেনি। উনিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত বিভিন্নজনের আত্মজীবনীতে এ পূজার তেমন একটা বর্ণনাও পাওয়া যায় না। সে হিসেবে বলা যায়, তখনও এটি হিন্দুদের প্রধান উৎসবে পরিণত হতে পারেনি।

ঢাকার সিভিল সার্জন জেমস টেলর ১৮৩৯ সালে লেখা তাঁর ‘ট্রপোগ্রাফি অব ঢাকা’ বইতে ঢাকার প্রধান ধর্মীয় উৎসব হিসেবে- ‘মহররম’, ‘বেরা’ এবং ‘বৈষ্ণ’ উৎসবের কথা বললেও দুর্গাপূজার ব্যাপারে ছিলেন নিশ্চুপ। ঢাকার বাসিন্দা হৃদয়নাথ মজুমদার উনিশ শতকের সত্তর দশকেও দুর্গাপূজার ব্যাপারে কিছু বলেননি। বরং বলেছেন ‘হোলি’, ‘ঝুলন’, ‘মহররম’-এর মতো ধর্মীয় উৎসবের কথা।

প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্ত তাঁর ‘আট দশক’ বইতে লিখেছেন, “ঢাকার মতো বৈষ্ণব প্রধান শহরে সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজা নয়। আসল উৎসব ছিল ঝুলন আর জন্মাষ্টমী। শহরে অনেক মন্দির ছিল, সেগুলো ঝুলনের সময়ে উৎসবের সাজে সাজানো হতো।”

তাই বলে যে ঢাকাতে দুর্গাপূজা একদমই হতো না তা কিন্তু নয়। ভবতোষ বাবু আরও লিখেছেন, “বারোয়ারি দুর্গাপূজার প্রচলন তখনও হয়নি অন্তত ঢাকাতে। পূজা দেখতে যেতাম সূত্রাপুরের ঢাকার বাবু নন্দলালের বাড়িতে যেখানে দোতালা প্রমাণ বড় প্রতিমা হতো। সবচেয়ে বেশি যেতাম টিকাটুলি ছাড়িয়ে রামকৃষ্ণ মিশনের পূজোয়। আমরা সবাই মিলে কাজ করতাম। ভিড় সামলানো থেকে দর্শনার্থীদের জুতোর খবরদারি করা পর্যন্ত। সন্ন্যাসীরা কীর্তন করতেন: আমরাও তাতে যোগ দিতাম।”

পরবর্তীতে দেখা যায়, দুর্গাপূজা উপলক্ষে খবরের কাগজগুলো পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে যেতো। ১৯০২ সালে ঢাকার প্রভাবশালী বাংলা পত্রিকা ‘ঢাকা প্রকাশ’ থেকে জানা যায়, ‘শারদীয় পূজা উপলক্ষে আগামী সপ্তাহ হইতে চার সপ্তাহের নিমিত্ত ঢাকা প্রকাশ বন্ধ থাকিবে। গ্রাহক, অনুগ্রাহক এবং পৃষ্ঠপোষকবর্গের যথাযোগ্য অভিবাদন ও সাদর সম্ভাষণ করিয়া আমরা অবকাশ গ্রহণ করিতেছি। মা সর্ব্বমঙ্গলী সকলের মঙ্গল বিধান করুন।’ বোঝা যায়, বিস্তৃত হচ্ছে দুর্গাপূজার আয়ো্জন। তবে, তখনও এসব পূজার অধিকাংশই ছিল পারিবারিক।

সার্বজনীন পূজা ব্যাপক আকারে শুরু হয় ১৯৪৭ এর দেশ বিভাগের পর। দেশ ভাগের পর এককভাবে পূজা করাটা বেশ ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে ওঠে। এর ফলে ব্রাক্ষণ-অব্রাক্ষণ নির্বিশেষে মিলেমিশে পূজা করার চল শুরু হয়। তবে এখনো পারিবারিক পূজার চল রয়ে গেছে পুরানো ঢাকার বিভিন্ন এলাকায়। ‘৭১ এ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকেশ্বরী মন্দিরে শুরু হয় দেশের কেন্দ্রীয় দুর্গা পূজা। 

বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁওয়ে উপমহাদেশের একমাত্র রক্তবর্ণের প্রতিমায় দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় ৩০০ বছরের পুরোনো এই পূজা। আয়োজকরা জানান, তাদের পূর্বপুরুষ সর্বানন্দ দাস আসামের শিবসাগরে মুন্সিপদে চাকরি করতেন। তিনি ছিলেন সাধক পুরুষ। একবার কামরূপ-কামাক্ষ্যায় পূজার জন্য পাঁচ বছরের একটি মেয়ে চাইলে স্থানীয়রা তাকে একটি মেয়ে দেন। মহাষ্টমীর দিনে কুমারী পূজা শেষে সর্বানন্দ দাস দেখেন, কুমারীর গায়ের রং পরিবর্তন হয়ে লালবর্ণ ধারণ করেছে। এই দৃশ্য দেখে তিনি কুমারীরূপী দেবীকে জিজ্ঞাসা করেন, মা আমার পূজা সুসম্পন্ন হয়েছে কি? উত্তরে ভগবতী বলেন, হ্যাঁ, তোর পূজা সিদ্ধ হয়েছে। এখন থেকে ভগবতীকে লাল বর্ণে পূজা করবি। পরবর্তী বছর সর্বানন্দ দাস তার নিজ বাড়ি মৌলভীবাজারের পাঁচগাঁওয়ে রক্তবর্ণের প্রতিমায় শারদীয় দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। আজো সেই ঐতিহ্য বজায় রয়েছে। ব্যতিক্রমী এই দুর্গা প্রতিমা দেখতে পূজার ক’দিন মানুষের ঢল নামে এই প্রত্যন্ত অঞ্চলটিতে।

২০১০ সাল থেকে বাগেরহাট সদরের হাকিমপুর গ্রামের শিকদার বাড়িতে ব্যক্তিউদ্যোগে দেশের বৃহত্তম দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়। প্রতিমার সংখ্যার দিক দিয়ে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পূজামণ্ডপ বলে দাবি করেন পূজার আয়োজক ডা. দুলাল শিকদার ও তার ছেলে লিটন শিকদার। প্রতিবছর এখানকার প্রতিমা সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এ বছর (২০১৯) এই মণ্ডপে ৮০১টি প্রতিমা নির্মাণ করা হয়েছে। 

দুর্গাপূজার আনন্দ দ্বিগুণ হয় তা সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশে দুর্গাপূজা সূচনালগ্ন থেকেই সকল ধর্ম ও বিশ্বাসের মানুষের মধ্যে ঐক্য ও সম্প্রীতির মিলনমেলা হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল। শারদীয় এই ধর্মীয় অনুষ্ঠান বাংলার প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে মানুষের মধ্যে এক সৌহার্দ্যের বাতাবরণ সৃষ্টিতে অসামান্য অবদান রেখে আসছে। এভাবেই দুর্গাপূজা বাঙালির অন্যতম একটি জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে।

0 comments:

0

বইপোকার বইঘর - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in

এক ডজন সাম্য
সাম্য দত্ত

আলোচ্য বইটি এক নবীন লেখকের লেখা। সাহিত্যের কোনও প্রথাগত শিক্ষায় দীক্ষিত না হয়েও পাতায় পাতায় এক অদ্ভুত কল্পবিশ্ব গড়ে তুলেছেন তিনি। খুব আশ্চর্য হতে হয় এই ভেবে, যে লেখকের বিচরণ অতি অনায়াস এবং সাবলীলভাবে তিনি নানা কালস্তরকে ছুঁয়ে সৃষ্টি করে গেছেন একেকটি কাহিনীর। এ বইয়ের প্রথম সাতটি গল্পে পাঠক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় কিংবা সত্যজিৎ রায়ের কথনশৈলী ও কাহিনী বুননের আভাস পেতে পারেন। এটি বিশেষ আনন্দের। এখনও কোনও নবীন যে এমনভাবে পূর্বসূরিদের সৃষ্টিতে প্রভাবিত ও আপ্লুত তা আমাদের আশা দেয়।

লেখকের শেষ গল্পগুলিতে বিচরণ করেছেন কথামৃত প্রণেতা শ্রীম, অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফী, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, রবীন্দ্রনাথ, সুকুমার রায়, সত্যজিত রায়, এবং মারাঠা রাজনীতির এক জটিল ও শোকাবহ অধ্যায়। এই সব গল্পগুলিতেই তিনি আধুনিক কালকে মিশিয়েছেন স্বচ্ছন্দে। কোনও কোনও গল্প পড়তে পড়তে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। কোনওটিতে চোখের জল ধরে রাখা দায় হয়। লেখকের সাহিত্যজীবন উজ্জ্বল।

0 comments:

0

জংলা ডায়েরি - শিবাংশু দে

Posted in


 ৭

"সুন্দরের কাছ থেকে ভিক্ষা নিতে বসেছে হৃদয়
নদীতীরে, বৃক্ষমূলে, হেমন্তের পাতাঝরা ঘাসে
সুন্দর, সময় হলে, বৃক্ষের নিকট চলে আসে
শিকড়ে পাতে না কান, শোনায় না শান্ত গান
করতপ্ত ভিক্ষা দিতে বৃক্ষের নিকট চলে আসে..."
(শক্তি)

কমলদা একবার লিখেছিলেন, সিংভূম পেরিয়ে গেলে কবিতার রম্যভূমি শেষ। বড়ো সত্যি কথা। দক্ষিণ পশ্চিম সিংভূমের সীমান্তের ঐ সাতশো নীল পাহাড় চূড়া আর নিচের দিকে তাকালে সবুজ বনজঙ্গলের মাঝে কেওঁঝরের বোলানি, মহিষানি, বড়বিলের লাল হিমাটাইটের খাদান। সাহেবরা তাকে ব্লাড ওরও বলে থাকে। প্রায় আবিরের মতই রাঙিয়ে দেয় সারা শরীর। মনও রাঙায়। নাহ, এ রাঢ় পৃথিবীর লাল ধুলো নয়। অন্য লাল। সব রক্তই কি একই রকম লাল? বৃক্ষের নিকটে কোন শান্তি, স্বস্তি পেতে যাওয়া? শ্যামলছায়া না বোধির শিকড়?

চিরিয়া মাইন্সের কাছে নদীতে এখন ব্রিজ তৈরি হয়ে গেছে, এবার সারান্ডা পেরোবো লাল মাটির পথ দিয়ে। আগে মাইন্সের মালগাড়ির গার্ডের সঙ্গে গপ্পো করতে করতে ঝিক ঝিক যেতুম সারান্ডার পার। এবার অন্য পথে।

চক্রধরপুর পেরোলেই একটু একটু করে জঙ্গল কাছে আসতে থাকে। প্রথমে ছাড়া ছাড়া, চাবি ঘুরিয়ে তানপুরো বাঁধার সময় সুর-বেসুর যেমন তার বেয়ে এক সঙ্গে গড়িয়ে পড়ে, ঠিক তেমন স্লো মোশনে সবুজ বনস্পতিরা এগিয়ে আসে। লালমাটি, ধূসর ঘাসজমি, মোরমফেলা রাস্তা, খাপরাছাওয়া কুঁড়ে, ইতস্তত মোরগ, ছাগলছানা, শ্যামলা মানুষদের জটলার গুয়াশ পটচিত্র। শালবীথির ছায়া মেলা পথের পাশে অ্যালুমিনিয়মের হাঁড়ি সাজিয়ে বসে থাকা শাদা শাড়ি, উজ্জ্বল কৃষ্ণা ধরিত্রীকন্যারা। তারা হাঁড়িয়ার পসারিনী। সব কথাতেই হেসে আকুল, কিন্তু সহজাত সম্ভ্রমের কাচের দেওয়াল ভাঙেনা সচরাচর। সোনুয়া, টুনিয়া, গইলকেরা, পোসাইটা.... ছবির মতো ইস্টিশন সব, লালসবুজ পথে জলরঙে আঁকা লেভেল ক্রসিং, লাইনের দুধারে সাজানো গিট্টিপাথর-চুনাপাথরের বেড পেরিয়ে, সার সার কৃষ্ণচূড়ার আগুনলাগা বীথিকাদের দুলিয়ে দিয়ে, টানেলের পর টানেল আরপার, ছুটে যায় বি এন আর লাইনের ট্রেন। পোসাইটার পরেই এসে থামে আমাদের জঙ্গল রাজধানী, মনোহরপুর।

মনোহরপুর স্টেশনের বাইরেই একটা তেমাথা। উত্তরের রাস্তাটা নন্দপুর হয়ে চলে গেছে পোসাইটা আর অন্য রাস্তাটা সোজা পূবদিকে একটু গিয়ে ঘুরে গেছে দক্ষিণে। কোলেবিরা- হাটগামারিয়া শীর্ণ সড়ক। এই রাস্তাটা সমানে সঙ্গ দিয়ে গেছে কোয়না নদীটিকে। মনোহরপুরেই কোয়্না এসে মিলিয়ে গেছে কোয়েল নদীতে। এই কোয়েল দক্ষিণের কোয়েল। উত্তরে ডাল্টনগঞ্জে যে রয়েছে সে উত্তর কোয়েল। এই দুই কোয়েলের মতো মায়াময় স্রোতস্বিনী আমি তো আর দেখিনি কোথাও। খুব ক্লিশে উপমা বার বার ঘুরে ফিরে আসে, নদী আর নারী। হে শব্দফতুর কবি, নদীকে দেখো, নারীকে ছোঁও, ডুব দিও নিভৃতে, একা। তার পর ভেবে দেখো। কারো,কোয়েল, কোয়না, খড়কাই, সুবর্ণরেখা,.... অতো সহজে ধরা দেয় না।

সালাই পর্যন্ত গিয়ে হাটগামারিয়ার রাস্তা ছেড়ে ধরতে হলো ছোটা নাগরার ভাঙাপথের রাঙা ধুলোর সড়ক। কোয়না চলেছে পাশে পাশে। ছোটা নাগরা পেরিয়ে সোজা দখিনে উঠে গেছে পাহাড়ের পথ। কোয়নার উপর ব্রিজ পেরিয়ে বরাইবুরুর ঘাটি। এখান থেকে আবার সঙ্গী হবে কোয়নার সখি কারো।

এইখান থেকে শুরু হলো সারান্ডাসুন্দরীর চেহলসুতুন। অন্দরমহলের দেউড়ি। ঢুকতে গেলে পাসওয়র্ড লাগে। খুব ছোট্টো। লিখে রাখার দরকার নেই। বুকের ভিতর খুঁজলেই পাওয়া যাবে। 'ভালোবাসা'।


"দূরত্ব নিকটে আসে , আমি তার শরীরের বিচ্ছুরিত আলো
পান করি প্রাণপনে মদিরার মতো করে ক্রমশ নেশায়
ধবল হবার পর টের পাই সে আমার ঊরুর উপরে
হাত রেখে বলে 'নদী যখন সংকীর্ণ থাকে, তখনি তো তাকে
লোভনীয় মনে হয়....." (দূরত্ব- বিনয়)

ভূগোল বইয়ের বাইরে প্রথম গল্প শুনি তার। লীলা মজুমদারের 'আর কোনোখানে'। পতাকার তিরঙ্গার মতো পাশাপাশি তিনটে পাহাড়ের রেঞ্জ। গারো, খাসি, জয়ন্তিয়া। পশ্চিম থেকে পূবের দিকে টানা। সম্ভবত দেশের সব চেয়ে ঘন জঙ্গলহৃদয় রাজ্য। নাম মেঘালয়। কজনই বা জানে? সারা অবিভক্ত উত্তরপূর্বাঞ্চলের সদর ছিলো চেরাপুঞ্জি। এখন যার নাম সোহরা। সিলেটের সমভূমি ছাড়িয়ে সাহেবরা দখল করেছিলো শেষ খাসি সিয়েমের (রাজা) রাজপাট। নাম দিয়েছিলো চেরাপুঞ্জি, কমলার বাগান। তার পর ভিজতে ভিজতে অস্থির হয়ে সেখান থেকে সদর তুলে নিয়ে এলো শিলঙে। শিলং অনেকদিন ছিলো সারা উত্তরপূর্বের মহারানি। জঙ্গল যাদের টানে, সোহরা, মওসমাই আর মাওমলুহ, অরণ্যসাম্রাজ্যের টান তাদের ডুবিয়ে দেবে। মধ্য মেঘালয়, অর্থাৎ খাসিপাহাড়ের এলাকা পৌঁছোনো সহজ। কিন্তু মওসিনরাম রিজার্ভ ফরেস্ট মাশা'আল্লাহ। হায়, পূবদিকে গারোপাহাড়ের রাজ্যে বহিরাগত 'দিকু'দের জন্য দরজা খোলা থাকে না। গেটক্র্যাশ করে যাওয়া যায় বটে। কিন্তু দুঃসাহস করা খতরনাক হতে পারে। না হয় মাওসমাই, মাওলং, মওসিনরাম, মাওলিনলঙের জঙ্গলে ঘোরাফেরা করেই খুশি থাকি । সারাজীবনেও ফুরোনো যাবে না ঐ সবুজের টেবলস্প্রেড। 


গুয়াহাটি শহরটা আমার ভালো লাগে। নানা কারণেই। তা নিয়ে কথা পরে। এই শহরটার মেরুদণ্ড হলো জি এস রোড। গুয়াহাটি শিলং রোড। উত্তরে পল্টন বাজার থেকে দক্ষিণ পূর্বে গড়াতে গড়াতে জোড়াবট মেঘালয় বর্ডার। এবার সোজা দক্ষিণ। উমলিং পেরোলেই রাস্তার ডানদিকে নংখাইলেম অভয়ারণ্য শুরু হয়ে গেলো। শুরু হয়ে গেলো পাহাড়ের চড়াই। ফার্ন, কনিফার আর অর্কিডের রাজত্ব। মাওলিংখং এসে গেলো মানেই উমিয়াম লেক। 'স্বর্গ যদি কোথাও থাকে'র এলাকা। তার পরেই ক্যান্টনমেন্ট পেরিয়ে শিলং। লীলা মজুমদার বা অমিত রে'র শিলং তো আর নেই। তবু যা আছে, তাকে মাত দেয় কে? চারদিকেই পাহাড় আর কত রকম সবুজ। যেদিকেই যাই নানা মুডের জঙ্গল বিছিয়ে রেখেছে তাদের সংসার। কিন্তু যাবো তো নিশ্চিন্দিপুর। আরো দক্ষিণে। 


শিলং থেকে মাইলিয়েম হয়ে উমলিমপং। সেখান থেকে রাস্তা দুভাগ। ডানদিকে সোহরা-শেলা রোড আর বাঁদিকে ২০৬ জাতীয় সড়ক চলে যাবে সোজা ডাউকি বর্ডার। যেখান থেকে হাত বাড়ালেই জিলা সিলেট। জাফলং জিরো পয়েন্ট। ছবির মতো সুন্দর ডাউকি নদীর দেশ বদলে নামও পাল্টে যায়। গোয়াই। খাসি পাহাড়ের পূর্বদিক দিয়ে এঁকেবেঁকে গড়িয়ে যাওয়া এই রাস্তার ডানদিকে রঙ্গেন, লাইটিং, পংটুং নানা নামের জঙ্গলমহল। জঙ্গলের কী আর নাম হয়? নদীর মতো'ই। সির্ফ এহসাস হ্যাঁয় জো রূহ সে মহসুস করো। মানুষ নাম দেয় তার। জাত'ও দেয় নিজেদের মতন করে। 


বাঁদিকের রাস্তাটা ধরে এগিয়ে গেলেই উমটিংগর নদীর তন্বী ধারার উপর একটি মারাত্মক বাঁক। আড়াআড়ি পাহাড়ি নদীর ব্রিজ। শাদা রেল। নীচে খ্যাপা স্রোত ছোটোবড়ো পাথরের গোল গোল নুড়ি কাঁপিয়ে ছুটে যাচ্ছে মাওফলং বাঁধের দিকে। পশ্চিমে। এই রাস্তাটিই চলে যাবে সোহরারিম পাহাড়জঙ্গল। দুয়ান সিং সিয়েম ডিম্পেপ উপত্যকাটি এলেই টের পাওয়া যায় এদেশি পাহাড় আর জঙ্গলের আসল চেহারা। খুবলেই অরণ্যের দেশ। ঢেউয়ের মতো সবুজ পাহাড়ের স্রোত। তারা মাথায় উঁচু নয়। কিন্তু তাতার সৈন্যদের মতো ঘনপিনদ্ধ আর নানা শেডের সবুজ ইউনিফর্মে স্থির হয়ে অপেক্ষা করছে সমঝদারদের জন্য। উত্তর দিক থেকে রাশি রাশি চণ্ড পর্যটক সুমো আর কোয়ালিস সওয়ার, চোখের সামনে স্মার্টফোনে ভিডিও ধরতে বেশি ব্যস্ত। ঘড়ি মেপে ড্রাইভারকে তাড়া, আলো কমার আগে শিলং ফিরতে হবে। তার উপর গাড়ির জাম লাগলেই চিত্তির। কখনও কখনও তো রাত ভোর হয়ে যায়। তার উপর কখন যে ছিঁচকাঁদুনে বৃষ্টি শুরু হয়ে যাবে, তারও ঠিক নেই। হে অস্থির পথিকবর, একটু থামো। গাড়ি থেকে নামো। বাঁদিকের ঢাল রাস্তায় যতোদূর নেমে যাওয়া যায়, নেমে যাও। পা'য়ে জড়িয়ে যাবে সিলভার ফার্ণ, পিচার প্ল্যান্ট আর লেমন ঘাস। উপরি পাওনা তার সঙ্গে জড়াজড়ি করে থাকা জলবিন্দুর স্বগত আশ্লেষ।


জঙ্গল আসলে উমিয়াম থেকেই পুরোদস্তুর চার্জ নিয়ে নেয়। ঘরদোর, গাড়িবাড়ি, মানুষফানুস সব গৌণ লসাগু। থাকলেও হয়। না থাকলেই বোধ হয় ভালো। ঐ হ্রদটা একটা মায়াবী আয়োজন। শিলং ঢোকার আগেই প্রেমিকদের হাত বাড়িয়ে টেনে নেয়। সেখান থেকে শিলং হয়ে সোহরা-শেলা রাস্তার সব দিকই চোখ মজিয়ে রাখে। দক্ষিণের পথে অরেঞ্জ রুট নামের একটা সরাইখানার কাছে একটা হেয়ার পিন বেন্ড। পৌঁছে গেলো চেরাপুঞ্জি। 


গাড়ির ড্রাইভার আঙুলের কর গুণে গুণে বলে দেবে কোথায় কোথায় যেতে হবে। সে সব জায়গায় যাওয়াই যায়। যেতেও হয়। এতোদিন পরেও কিন্তু সোহরা পুরোনো হয়না। তার কৌমার্যের জাদু মানুষের পাপস্পর্শকে ধুয়ে দেয় অবিরল বৃষ্টিধারায়। এখানের অরণ্যচরাচর দেশের অন্য সব প্রান্ত থেকে এভাবেই আলাদা, অনন্য। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ভরে থাকা সবুজের ঢেউ হয়তো ধরাছোঁয়ার থেকে একটু দূর। সারান্ডার মতো, সাতপুরার মতো, পঞ্চগনির মতো বৃক্ষকে জড়িয়ে ধরা যায়না এখানে। কিন্তু তাদের সত্ত্বাকে অনুভব করা যায়। তাদের প্রাণস্পন্দনকেও। পরজীবী, এপিফাইটস, অর্কিড আর ফার্নবনের উপর ঝরে পড়ে কনিফারের পাতা গড়ানো টুপটাপ ফোঁটা। আনাচে কানাচে প্রপাত থেকে মুক্তধারায় উৎফুল্ল জলের ঝাঁপ। জামা ভিজে যাওয়া, সপসপে জুতো আর কুয়াশার ওপারে চশমার কাঁচে শুধুই ক্লোরোফিলের রামধনু। সাতটা রং'ই তো সবুজ। তবু তারা আলাদা। হরি কা ভেদ না পায়ো, কুদরত রঙ্গীবেরঙ্গী ।


".... করবো না অরণ্যে রোদন, না কী দরকার,
অরণ্য নিজেই আজন্ম রোদনে বাঁধা, তাই নিয়ে তার 
পাখিদের সাথে গেরস্থালী, গাছপালাদের ভরণপোষণ,
তাই নিয়ে তার রোদে পোড়া, জলে ভেজা, ঝড়ে ওপড়ানো......"
( অনাদি অরণ্য যেন-হাসান হাফিজুর রহমান)


(ক্রমশ)

0 comments: