প্রচ্ছদ নিবন্ধ
উইলিয়াম কেরি ও বাঙলা গদ্য : একটি অতিকথা
রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য
অধ্যাপক জনার্দন চক্রবর্তী তাঁর কর্মজীবন শুরু করেছিলেন চট্টগ্রামের সরকারি মহাবিদ্যালয়ে। তখন বাঙলা পরীক্ষারও প্রশ্ন হতো ইংরেজিতে। কলেজের পরীক্ষায় জনার্দনবাবু একটি প্রশ্ন দিয়েছিলেন। তার বিষয়: বাঙলা গদ্যর বিকাশে ইওরোপীয় মিশনারিদের দান। প্রশ্নটি পড়ে সায়েব অধ্যক্ষ, রিচার্ড কেরি ব্যাম্স্বটম ঐ বিষয়ে জনার্দনবাবুর কাছে আরও জানতে চান (৯১)।
বাঙলা গদ্যে উইলিয়াম কেরি প্রমুখ মিশনারিদের স্থান ও দানের ব্যাপারে বাঙলা সাহিত্যর প্রায় সব ইতিহাসকারই মোটের ওপর একমত। প্রায় সকলেই বলেন: মিশনারিদের ভাষা যতই অস্থির হোক, বাঙলা গদ্যের গোড়াপত্তন হয়েছিল তাঁদেরই উদ্যোগে। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিত ও মুন্শিদের দিয়ে তাঁরা অনেককটি বই লিখিয়েছিলেন। ছাপাখানাও চালু হলো তাঁদেরই হাতে। আর তার ফলেই বাঙলা গদ্যরচনার প্রকাশ ও প্রচারের পথ খুলে গেল! রামমোহন, বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার, কালীপ্রসন্ন, প্যারীচাঁদ, বঙ্কিম, -এঁরা তারই ধারক।
এখন এর উল্টো কথা শুনলে কেউ কেউ নিশ্চয়ই অবাক হবেন।তবু সবিনয়ে, কিন্ত অবিচলভাবে, বলব : কেরি ও তাঁর পরিজনদের সম্পর্কে প্রচলিত মতটি ভুল; অপাত্রে গৌরব অর্পণ করা হচ্ছে। ঘটনা এই যে, বাঙলা গদ্যরঐতিহাসিক বিকাশে ইওরোপীয় মিশনারি ও তাঁদের আশ্রিত বাঙালি লেখকের দান একেবারেই শূন্য। অবশ্যই বাঙলা গদ্যর কালপঞ্জিতে তাঁদের নাম থাকবে- তথ্যকে অস্বীকার করব কেন? কিন্ত ঐতিহাসিক বিচারে গোটা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ পর্বটি -(১৮০১-৫৪) একটি প্রক্ষিপ্ত অধ্যায় মাত্র। ইংরেজ- পূর্ব বাংলাতেও গদ্য লেখা হতো, শুধু গৌড়বঙ্গে নয়, অসমে, এমনকি ভুটানেও (সুরেন্দ্রনাথ সেন ৮৪)। উনিশ শতকের গোড়া থেকে বাঙলা লেখার এক নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ দেখা দেয়, এখনও সেটিই বহাল। শুধু পশ্চিমবঙ্গে বা সাধারণভাবে ভারতে নয়, পূর্ব পাকিস্তান (পরে বাংলাদেশ) সমেত পৃথিবীর সব প্রান্তে বাঙলা লেখকদের হাতে সেই গদ্যরই অনুবর্তন ও বির্বতন হয়ে চলেছে। ব্যাকরণগত বিচারে সাধু ও চলিত এই দুটি লিখিত রূপ এখনও পাশাপাশি রয়েছে, দুই রূপেই উঁচু, মাঝারি ও নিচু রীতিতে লেখা যায় ও হয়। উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে বাঙলা গদ্যর এই অভিব্যক্তিতে মিশনারিদের গরহাজিরাই সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে।
কেন একথা বলছি? সে-উত্তরে যাওয়ার আগে ঐতিহাসিক আর প্রাচীনত্বর কারবারি (অ্যান্টিক্যুয়ারিয়ান)-র তফাতটা বুঝে নেওয়া দরকার।
তত্বকথার বদলে বরং একটি গল্প বলি। ফরাসি মধ্যযুগ-বিশারদ আঁরি পিরেন একবার সুইডেন-এর রাজধানী স্টকহোল্ম-এ গিয়েছিলেন। সেখানে পৌঁছেই তিনি চললেন নতুন পৌরভবনটি দেখতে। কেন? তাঁর উত্তর: ‘আমি যদি প্রাচীনত্বর কারবারি হতুম তবে আমার নজর থাকত শুধুই পুরনো জিনিসের দিকে; কিন্তু আমি ঐতিহাসিক, জীবনকে আমি তাই ভালোবাসি। যে সব বিশেষজ্ঞ ‘মধ্যযুগ’ ছাড়া আর কিছুই বুঝতেন না তাঁদের কাছে মার্ক ব্লশ তাঁর মাস্টারমশাই-এর এই গল্পটি বলতেন। ঐতিহাসিক অতীতকে দেখেন বর্তমানের চোখ দিয়ে। তাঁকে ঠিকমতো ঘটনা-বাছাই শিখতে হ্য়। কিসের বাছাই? অতীতে রোজ কত কিছু ঘটছে। তার সবই ইতিহাসের উপাদান নয়। তাই যদি হতো তাহলে যে-কোনো এক বছরের খবরের কাগজ আগাপাশতালা ছেপে দিলেই সেটি ইতিহাস হয়ে যেত। কিন্তু তা হয় না। নির্বিচারে সব ঘটনাকেই ‘ঐতিহাসিক’ বলা যায় না। ঘটার পরে যে ঘটনার বিশেষ তাৎপর্য ধরা পড়েছে সেই ঘটনাই ইতিহাস লেখকের কাঁচামাল। তেমন ঘটনা বাছাই করে তিনি তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাস লেখেন। ইতিহাস অনেকটাই ঐতিহাসিকের সৃষ্টি- আগাগোড়া পক্ষপাত শূন্য বিষয়মুখী ইতিহাস বলে কিছু হয় না। ঘটনার বাছাই, শব্দ প্রয়োগ ইত্যাদি দিয়েই বিষয়ীর ঝোঁক ধরা পড়ে যায়।(কার-১৪-২১)
ইংরেজিতে ক্রসিং দ্য রুবিকন (রুবিকন বলে জলধারা পেরনো) একটি চালু প্রবাদ। মানে হলো যে সিদ্ধান্ত নিলে আর ফেরা যায় না। ইতালি আর গল-এর মধ্যে এই জলধারাটি ছিল দু দেশের সীমানা। জুলিয়াস সিজার খ্রিপূ ৪৯-এর একদিন সেটি পেরোলেন। ফলে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠল। সিজার-এর আগে ও পরে হাজার হাজার মানুষ ঐ জলধারা এপার ওপার করেছেন। কিন্তু তার কোনোটিই ইতিহাসের তথ্য নয়। সিজার যখন ঐ জলধারা পেরোলেন তখনই সেটি ইতিহাসের তথ্য হয়ে উঠল। (কার৫)
হাজার হাজার লোকের রুবিকন পেরনোর মতোই কেরি প্রমুখ মিশনারিদের বাঙলা গদ্যচর্চা কথাটি তাৎপর্যহীন ঘটনা।তাঁর আগে ও পরে অনেকেই গদ্য লিখেছেন, কমবেশি নিষ্ঠাভরেই তাঁরা সে কাজ করেছেন, কিন্তু বাঙলা গদ্যর কাঠামো তাতে গড়ে ওঠেনি। তাঁদের রচনাভঙ্গি কেউ অনুসরণ করেননি। কেউ তাঁদের গদ্য নিয়ে চড়া ব্যঙ্গও করেননি। উলটে বলা যায় কেরি ও তাঁর উত্তরসূরিদের বাইবেল- অনুবাদ ও অন্যান্য পুস্তিকা নিয়ে লোকমুখে কিছু কৌতুক চালু হয়েছিল। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তাই লিখতে পেরেছিলেন : ‘মহাপ্রভু পাদ্রি কেরী প্রভৃতি শ্বেতাবতারেরা ঐ সময় বঙ্গভাষায় খ্রীষ্টধর্ম বিষয়ক কয়েকখানা পুস্তক প্রকটন করেন, তাহাতে কেবল সাহেব গন্ধই নির্গত হইত’। (অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ৪৮-এ ঊদ্ধৃত)
শুধু ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত কেন, ব্যাপ্টিস্ট অনুবাদক জন ওয়েঙ্গার, ক্যাথলিক মিশনারি আবে দুবোয়া ও রামমোহন রায় থকে শুরু করে একালে সুকুমার সেন ও মিনতি মিত্রও একই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন।১ তবু কেউ কেউ বলে থাকেন: প্রথম সংস্করণে (১৮০১) বাইবেল- অনুবাদ যেমনই হোক, পরের সংস্করণগুলিতে বারবার শোধন করার ফলে তার ভাষা তুলনায় অনেক প্রাঞ্জল হয়েছে। কেরির কোনো কোনো অনুরাগী তাঁকে বাঙলা বাইবেল-এর উইলিয়াম টিণ্ডাল (১৪৯৪?-১৫৩৬) ও জন উইক্লিফ (আনুঃ১৩৩০-৮৪) বলে দাবি করেছেন। (মিনতি মিত্র ৫৯-এ উল্লিখিত)
এমন সুখ্যাতির মধ্যে সত্য কতটুকু? টিণ্ডাল -এর অনুবাদ ইংরিজি গদ্যর ইতিহাসে দিক্চিহ্ন হয়ে আছে। ১৬১১-য় বহু অনুবাদক ও ভাষাবিদের যৌথ প্রচেষ্টায় যে- অনুবাদ বেরিয়েছিল তার দশভাগের ন ভাগইটিণ্ডাল -এর প্রতিধ্বনি (ব্রুস ৪৪০)। চরম প্রতিকূল পরিবেশে একাটিণ্ডাল যে কাজ করেছিলেন, সতেরো শতকের গোড়ায় অতজন মিলেও তাঁকে ছাড়িয়ে যেতে পারেননি। ১৬১১-র সেই ‘অনুমোদিত অনুবাদ’ (যাকে ‘রাজা জেমস-এর অনুবাদ’ কিং জেমস ভারসন-ও বলা হয়, যদিও দুটি নামই তথ্যর দিক দিয়ে অসত্য) সাধারণভাবে ইংরিজি ভাষার বিকাশকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। কেরি-র অনুবাদ-একা কেরি অবশ্য সব অনুবাদ করেননি, তাঁর সহযোগীও ছিলেন অনেক-এমনকি বাঙালি খ্রিস্টান মহলেও অস্বস্তির কারণ হয়েছিল। বাঙলা গদ্যর বিকাশে কেরি তথা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিত ও মুন্শিদের রচনার কোনো ছাপই পড়েনি। রামমোহন তাঁর নিজের মতো করে বাঙলা গদ্যর ছাঁদ তৈরি করেছিলেন। বিষয়বস্তুর দিকেই তাঁর নজর ছিল পুরোপুরি। প্রসাদগুণ নিয়ে তিনি মাথা ঘামাননি। বিদ্যাসাগর ও অক্ষয়কুমারই প্রথম বাঙলা গদ্যর অন্বয় ধরতে পেরেছিলেন। সেই বোধ তাঁদের আগেকার কোনো লেখকের মধ্যেই দেখা যায় না । প্রমথ চৌধুরী সঠিকভাবেই বিদ্যাসাগরের দিকটিকে শনাক্ত করেছেন (১:৩২৪)।তিনি অবশ্য অক্ষয়কুমারের কথা বলেননি, কিন্তু বিষয় বৈচিত্র্যর কারণে অক্ষয়কুমারও সমান স্মরণীয়।
হালে কেরি সম্পর্কে যথার্থ মূল্যায়ন করেছেন প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্য :‘কেরি বাঙলা ভাষার যত বড়ো সেবক ছিলেন, তত বড়ো লেখক ছিলেন না’ (৯৭)। এমন বলার কারণ কী? প্রদ্যুম্নবাবু দেখিয়েছেনঃ ‘কেরির মৃত্যুর মাত্র বছর খানেক আগে তাঁর অনূদিত বাইবেলের যে শেষ সংস্করণটি (1833)বেরোয়, সেটা পড়লে বুঝতে পারি, নিখাদ বাঙলা বাগ্ভঙ্গি আর বাকস্পন্দ এই শেষ বয়সেও তাঁর ঠিক দখলে আসেনি।’ (৯৮)
কথাটি তার আগে সুকুমার সেনও বলেছিলেন। কেরির নামে ছাপা কথোপকথন প্রসঙ্গে তাঁর মন্তব্য : ‘নাই অর্থে “নহে” পদের অপপ্রয়োগও কেরির সন্দেহ নাই, কেননা কোন দেশীয় লেখক এই ভুল করিতে পারেন না’ (২০)। বাইবেল অনুবাদ প্রথম সংস্করণের (১৮০১) একটি অংশ ও কেরির জীবিতকালের শেষ সংস্করণ (১৮৩২-৩৩)-এ সেই অংশর পাঠ উদ্ধৃত করে তাঁর সংক্ষিপ্ত মন্তব্য : ‘ইহা হইতে বোঝা যাইবে যে রচনা রীতির আশানুরূপ উন্নতি হয় নাই’। (১৬)
প্রদ্যুম্নবাবু একটি উদাহরণ দিয়েছেন ইংরিজিতে কেরির বাঙলা ব্যাকরণ (চতুর্থ সংস্করণ, ১৮১৮)থেকে। সেখানে একটি বাক্য আছে :‘আমার কিছু টাকা নয়’, তার ইংরিজি অনুবাদ : ‘I have no money’।প্রদ্যুম্নবাবু লক্ষ্য করতে বলেন :‘অর্থাৎ “নয়” আর “নেই”-এর তফাত তিনি বুঝতেন না। তাঁর ব্যাকরণের মরণোত্তর পঞ্চম সংস্করণেও (1843) এই একই ভুল পুনরাবৃত্ত’।(৯৮ টি.৯)
শুধু ‘নয়’-ই নয়। ঐ বাক্যে ‘কিছু’ শব্দটির দিকেও নজর দিতে বলি। এই বিশেষণটি পুরোপুরি বেদরকারি। কথিত বাংলার বাগ্ভঙ্গির সঙ্গে একেবারেই খাপ খায় না, ইংরিজি বাক্যটিতেও এমন কোনো শব্দ নেই।
দু-চারটি উদাহরণ দিলে কেউকেউ আপত্তি করতে পারেন। কিন্তু কেরি-র বাইবেল খুলে পাতা উল্টে চললেই এমন অনেক বিচিত্র নমুনা পাওয়া যাবে। ফাদার দ্যতিয়েন অবশ্য এর জন্যে ব্যক্তি কেরি-র চেয়ে বেশি দায়ী করেছেন তাঁর সম্প্রদায়কে :
কেরী যে-ব্যাপ্টিস্ট সম্প্রদায়ের সভ্য ছিলেন, তার মতানুসারে বাইবেলের প্রতিটি শব্দ যেন ঈশ্বরের মুখ থেকে নিঃসৃত বাণী।।....তাই তাঁর কাছে আক্ষরিকতার এত মূল্য! (৩০)
ফাদার দ্যতিয়েন উদাহরণ দিয়েছেন বাইবেল অনুবাদের প্রথম সংস্করণ থেকে : ‘ফারোঙা স্বপ্ন দেখিল দেখ সে ডাণ্ডাইয়া আছে নদীর কিনারায় দেখ নদী হইতে উঠিল সুন্দর হিষ্টপুষ্ট [অবিকল] সাতটা গাভী ও চরিতে লাগিল ধারের উপর দেখ তাহার পরে আর সাতটা গাভী...।’ দ্যতিয়েন বলেছেন : ‘ এই “দেখ” শব্দটির অপপ্রয়োগ নিছক হিব্রুয়ানা-কিং জেমস-এর অনুবাদেও যা রক্ষিত হয়েছেঃ “ and behold he stood by the river… and behold there came out of the river… and behold several other kine…”।'(৩০)
এতে ‘দেখ’-র ব্যাখ্যা পাওয়া যায় কিন্তু বাক্যটি অন্বয়ঘটিত দোষও কি হিব্রুয়ানা কারণে? ‘দেখ’ শব্দটি তুলে দিলেও বাক্যগুলির কি অণুমাত্র উন্নতি হয়? টিন্ডাল থেকে শুরু করে কোনো ইংরিজি অনুবাদকের রচনায় এই দোষ পাওয়া যায় না।
দ্বিতীয়উদাহরণটি ফাদার দ্যতিয়েন দিয়েছেন বাইবেলে-এর প্রথম দুটি পদ (ভার্স অর্থে) থেকে(আদিপুস্তক ১.১-২):
প্রথম ঈশ্বর সৃজন করিলেন স্বর্গ ও পৃথিবী, পৃথিবী শূন্য ও অস্থিরাকার হইল এবং গভীরের উপর অন্ধকার ও ঈশ্বরের আত্মা দোলায়মান হইলেন জলের উপর....।
ফাদার দ্যতিয়েন –এর মতে :‘এই অদ্ভুত শব্দবিন্যাস হিব্রু-অনুযায়ী;সে যে কত অ-বাংলা,কেরী তা অবশ্যই জানতেন, বাইবেলের ভাষার ইতরতা স্বেচ্ছাকৃত’। (৩০)
কথাটা মানতে একটু অসুবিধা আছে। এর পরে তো কেরি-র ধর্ম্মপুস্তক বারবার ছাপা হয়েছে; কয়েক বছর অন্তর অন্তরসংস্করণও হয়েছে। ১৮৩২এর সংস্করণে দেখি : শব্দবিন্যাস আগাগোড়া পাল্টে গেছে, কর্তার পরে ক্রিয়ার বদলে এসেছে কর্ম (বাঙলার পক্ষে যা স্বাভাবিক), অতিরিক্ত বিভক্তি, ক্রিয়া ও বিশেষণে লিঙ্গভেদ যোগ হয়েছে।
প্রথম ঈশ্বর স্বর্গ ও পৃথিবী সৃষ্টি করিলেন। পৃথিবী অস্থিরাকারা এবং শূন্যা এবং গভীরে স্থলের উপরে অন্ধকার ছিল এবং ঈশ্বরের আত্মা জলের উপর দোলায়মান হইলেন। (গোলাম মুরশিদ ১৮৩)
দেখা যাচ্ছে শব্দবিন্যাসের হিব্রুয়ানা ত্যাগ করলেও অ-বাঙলা ভাবটা কাটেনি। হালের একটি অনুবাদের সঙ্গে মিলিয়ে পড়লে ব্যাপারটি আরও স্পষ্ট হবে :
সেই সূচনা-লগ্নে ঈশ্বর আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি করেছিলেন। পৃথিবী তখন ছিল নিরাকার, শূন্যময়। অতলে ওপর প্রসারিত ছিল অন্ধকার আচ্ছাদন, জলরাশির ওপর বইত ঈশ্বরের প্রাণবায়ু। (মঙ্গল বার্তা, ২৯)
দুটি অনুবাদের তুলনা করা অনুচিত। কেরি-র কোনো পূর্বসূরি ছিলেন না আর মিংঙো বন্ধ্যোপাধ্যায়ের পেছনে আছেন বিদ্যাসাগর-বঙ্কিম থেকে রবীন্দ্রনাথ-প্রমথ চৌধুরী পর্যন্ত ব্যাপ্ত এক গদ্য-ঐতিহ্য। দেখবার শুধু এই যে, টীকা-টিপ্পনী ছাড়াই দ্বিতীয় অনুবাদটির মানে করা যায়, কেরির অনুবাদ বড়ই অস্বচ্ছ।
আরও একটি কথা। আদি পুস্তক ১।৩-৪-এর হালের অনুবাদ এই রকম :
ঈশ্বর বললেন : “আলো হোক!” আলো হল। ঈশ্বর দেখলেন, আলো ভালই হয়েছে। ঈশ্বর অন্ধকার থেকে আলকে আলাদা ক’রে রাখলেন।
কেরি-র অনুবাদ ছিল :
পরে ঈশ্বর বলিলেন দীপ্তি হউক তাহাতে দীপ্তি হইল তখন ঈশ্বর সে দীপ্তি বিলক্ষণ দেখিলেন।(১৮০১ সং)
একতিরিশ বছর ধরে নানা সংস্কারের পর এই অংশটি দাঁড়িয়েছিল :
পরে ঈশ্বর বলিলেন যে দীপ্তি হউক তাহাতে দীপ্তি হইল।তখন ঈশ্বর দেখিলেন যে দীপ্তি উত্তম তৎপরে ঈশ্বর দীপ্তি ও অন্ধকার বিভিন্ন করিলেন। (১৮৩২ সং)
মিংঙো-বন্ধ্যোপাধ্যায়ের অনুবাদে যে ছন্দঃস্পন্দ, তার পেছনে ছায়া ফেলেছে রবীন্দ্রনাথের লিপিকা, কেরি-র কাছে অবশ্যই তা আশা করা বৃথা। তাঁর সে- কানই ছিল না; আর কথিত শব্দ ব্যবহারের চেষ্টা বা ইচ্ছেরও অভাব ছিল, ফলে ‘বিলক্ষণ’ ছেড়ে তিনি ‘উত্তম’-এ আসতে পারেন, কিন্তু ‘দীপ্তি হইতে অন্ধকারকে বিভিন্ন করিলেন’ এমন বাক্য লিখতে পারেন না।
ফাদার দ্যতিয়েন মনে করেন :কেরি ইচ্ছে করলেই অ-বাইবেলীয় ভাষায় লিখতে পারতেন। তাঁর যুক্তি এই রকম,
যিনি বাংলা অভিধান সম্পাদন [সম্পাদন] করেছেন, বাংলা ব্যাকরণ রচনা করেছেন, যিনি স্বভাবসিদ্ধ বিনয় ও নম্রতা সত্বেও –সরলভাবে স্বীকার করেছেন বাংলা ভাষা তিনি ভালোই আয়ত্ত করেছেন, তিনি কি ইচ্ছা করলেই, অ-বাইবেলীয় ভাষায় লিখতে পারতেন না?... (৩০)
ইচ্ছে করলেই যদি উপায় বেরুত তবে দুনিয়াটা অনেক সুখের জায়গা হতো, সন্দেহ নেই। কিন্তু ঘটনা এই যে, সবক্ষেত্রে তা হয় না। এছাড়া পরের অনুচ্ছদেই দ্যতিয়েন লিখেছেন :
এদিকে স্বীকার করতে হয়, কেরী তাঁর ব্যাকরণে উদাহরণ স্বরূপ যে-সমস্ত বাক্য উদ্ধৃত করেছেন সেগুলোর মধ্যে ইতিহাসমালার প্রাঞ্জলতা পাওয়া যায় না। তাহলে? (৩১)
শেষ পর্যন্ত ফাদার দ্যতিয়েনকেও তাই মানতে হয় : ‘কেরী সাহিত্যিক ছিলেন না, ইতিহাসমালা রচিত হয়েছে শুধু ভাষা শেখাবার জন্যে, সাহিত্য সৃষ্টি করার জন্যে নয়।’ তিনি এও স্বীকার করেছেন ইতিহাসমালা -র লেখক আসলে একা কেরি নন, একজন ‘অচেনা বাঙালী সন্তান’-এর সাহায্য তিনি পেয়েছিলেন।
এক-এক করেবিষয়গুলি দেখা যাক; কেরি একটি বাঙলা অভিধান সম্পাদন করেছেন ঠিকই। কিন্তু তার কতটা কেরি আর কতটা ফরস্টার-এর? গোলাম মুরশিদ দেখিয়েছেন :
সকল সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, তাঁর অভিধানে ফরস্টার পথিকৃৎ হিসেবে অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন, বস্তুত, তিনি যে-কাঠামো নির্মাণ করেছিলেন, অতঃপর তারই ওপর নির্ভর করে অধিকতর সফল অভিধানগুলো রচিত হয়েছিলো। অন্তত কেরীর বিখ্যাত অভিধানতো [হুবহু] বটেই। বিশেষ করে বাংলা ইংরেজি অংশেই এই সাদৃশ্য বেশি করে চোখে পড়ে। ফরস্টার ইংরেজির যে- প্রতিশব্দ দিয়েছেন, কেরী সামান্য পরিবর্তন করে তাই রেখেছিলেন, তবু ফরস্টারের কাছে তাঁর ঋণ সর্বত্রই স্পষ্ট। (১১৯)
কেরি-র অভিধানে শব্দ অনেক বেশি আছে, কিন্তু কেমন শব্দ? সরস্বতী মিশ্র জানিয়েছেন : তাঁর সংগৃহীত সংস্কৃত শব্দের মধ্যে কিছু শব্দ অবশ্যই বাংলায় প্রচলিত, কিন্তু অধিকাংশ শব্দই কখনও বাংলায় ব্যবহৃত হয়নি। (৫৬)
যেমন, অব্যথা The absence of pain, অমৎস্য not a fish, অমদ not wine। এছাড়া আছে অসাধারণ সব সমাসবদ্ধ পদ : ইতিকর্ত্তব্যতাকলাপ the whole of what ought to be done in a given case, এতচ্ছত্রানুসন্ধানী searching for this umbrella, এতচ্ছায়োৎপাদক producing this shade।শারীরবৃত্তের পারিভাষিক শব্দ কেন এমন অভিধানে আসবে? বিশেষ করে এই ধরণের শব্দ, যেমন, আমাশয়মূর্দ্ধাক্ত রক্তবাহকনাড়ি The coronary stomachic Arteries, নাবাকুত্যাস্থিছিদ্র one of the cavities of the ear, পাদবৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠনমনকারিদীর্ঘ The name of the one of muscles which assists in moving the great toe। (মিশ্র ৫৬)
এছাড়া আছে ব্যবহারিক প্রয়োগ না-জানায় আক্ষরিক অর্থ করার ভুল, যেমন, গলগ্রহ seizing of anyone by the throat, ‘মনস্ত; [মনঃস্থ] situated in the mind or heart, (মিশ্র ৫৮)
অভিধানের আয়তন বাড়ানোর জন্যে কেরি আরও একটি পথ ধরেছিলেন। সেটি হলো : একটি পদ দেওয়ার পর অজস্র সমাসবদ্ধ পদের উল্লেখ। ‘নিয়ম; শব্দটির সঙ্গে আরও ১১৪ টি পদ আছে, তার অনেকগুলিই সে যুগের কোনো বই-এ ব্যবহার হয়নি, তার পরের ১৯৫ বছরেও নয়। যেমন, নিয়মাতি ক্রমার্জিত, নিয়মোল্লঙ্ঘনমিত্তিক, নিয়মোল্লঙ্ঘনসহেতুক।(মুরশিদ ১২১)
আর ব্যুৎপত্তির ক্ষেত্রে তো কেরি প্রায় লাগামছাড়া উৎকল্পনাশক্তির পরিচয় দিয়েছেন।যেমন, গৃহ from গ, a name of Ganesh and ঈহ to desire, কন্দল from কন্দ a root and লাto take (মিশ্র ৫৭)।সরস্বতী মিশ্র এগুলির দায় কেরি-র পণ্ডিতদের ঘাড়ে চাপিয়েছেন। এতে কিন্তু তাঁদের প্রতি অবিচার করা হয়। পর পর এতগুলি লোক-নিরুক্তি (ফোক ইটিমোলজি)জন্মসূত্রে বাঙলাজানা লোকের কীর্তি হতে পারে না।
স্রেফ খুঁত ধারার জন্যে এত কথা বলছি না, বাঙলা ব্যাকরণ নিয়ে কেরি-র কাজটি অনেকটাই হ্যালহেড-নির্ভর। স্ত্রী- প্রত্যয় প্রসঙ্গে তিনি হ্যালহেডকেই অনুসরণ করেছেন, কিন্তু যেখানেই দৃষ্টান্ত দিয়েছেন সেখানে খটকা লাগে, যেমন, বিড়ালের স্ত্রীলিঙ্গ বিড়ালা, মৃগ-মৃগা।বিশেষণ থেকে বিশেষ্য করার ব্যাপারেও তাঁর দৃষ্টান্তগুলি সমান ভুল : মিথ্যা false- মিথ্যতা falsehood। এছাড়া এমন সব শব্দ আছে যেগুলি কেরি-র সংস্কৃত জ্ঞান সম্পর্কে সন্দেহ জাগায় : স্থৈর্যতা, ধৈর্যতা, সৌন্দর্যতা (নির্মল দাশ ৯৭-৯৮)। পরের সংস্করণে কিছু কিছু সংশোধন হলেও সব দোষ দূর হয়নি।
২০ সেপ্টেম্বর ১৮০৪-এ সংস্কৃতয় কেরি যে বক্তৃতাটি দিয়েছিলেন (অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ৫৭-য়ঊদ্ধৃত) তার অন্বয় পুরোপুরি ইংরিজি অন্বয়ের নকলে। ব্যাকরণে ভুল নেই বটে কিন্তু তার ভাষা প্রথম শিক্ষার্থীর অনুবাদের মতো। কেরি-র সমকালীন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দুই কর্মচারী, হেনরি টমাস কোলব্রুক ও হোরেস হেমান উইলসন ছিলেন সত্যিকারের সংস্কৃতবিদ; কেরি তাঁদের ধারে-কাছেও আসেন না। আর তাঁর বাঙলা জ্ঞানের ব্যাপারে বলতে হয়ঃ বারবার সংস্কার করার পরেও তাঁর ভাষা কখনোই সুখপাঠ্য হয়নি, এমন কি সুবোধ্যও নয়। ধর্ম্মপুস্তক-এর ১৮৩২-এর সংস্করণে দেখা যাচ্ছে : সংস্কৃত ও ফার্সি শব্দর মধ্যে সঠিক শব্দটি বেছে নেওয়ার ক্ষমতা তাঁর কোনোদিনই হয়নি, এর আগেও তিনি একই সংস্করণে কোথাও ‘মেহেরবানী’ কেটে ‘অনুগ্রহ’ করেছেন, আবার কোথাও বা ‘অনুগ্রহ’ কেটে ‘মেহেরবানী’। (মুরশিদ ১৮৪)
তাহলে দেখা গেল কেরি-র বাঙলা অভিধান-ব্যাকরণ ইত্যাদি সম্পদনা ও রচনার কৃতিত্ব নিয়ে পঞ্চমুখ হওয়ার কিছু নেই। তাঁর অনেক আগে থেকেই এসব কাজ হচ্ছিল, পরে যোগ্যতর লোকে সে-কাজ করেছেন। চেষ্টার ত্রুটি তিনি করেননি, নিষ্ঠারও অভাব ছিল না, প্রেরণা তো ছিলই (বিধর্মীকে সদ্ধর্মে দীক্ষিত করার অভিলাষ)২। ছিল না একটিই গুণ, আর তার অভাবে সবই মাটি হয়ে যায়। সেটি হলো: যে ভাষার চর্চা করছেন সেই ভাষার স্বভাব বোঝার ক্ষমতা। কেরি একসঙ্গে অনেক ভারতীয় ভাষা শিখেছিলেন একটিই লক্ষ্য নিয়ে : সেই ভাষায় বাইবেল অনুবাদ ও খ্রিস্টীয় প্রচারপুস্তিকা রচনা, মিশনারি জিল (zeal) বলতে যে উৎসাহ-উদ্দীপনা বোঝায়, কেরি ও তাঁর পরিজনদের সেটি ছিল শতকরা একশ পাঁচ ভাগ, কিন্তু ঐ যে বললুম, ছিল না কোনো ভারতীয় ভাষার স্বভাব সম্পর্কে সত্যিকারের বোধ।ভাষা কেরি-র কাছে মাধ্যম মাত্র; যেমন-তেমন করে স্বধর্ম প্রচার করতে পারাই ভাষা শেখার প্রথম ও শেষ উদ্দেশ্য।এমন মনোভাব নিয়ে কোনো ভাষায় সাহিত্যসৃষ্টি কারা যায় না, লেখক হিসেবে কেউ অনুসরণীয় হতে পারেন না। কাশীপ্রসাদ ঘোষ নাকি ঠাট্টা করে মিশনারিদের ভাষাকে ‘শ্রীরামপুরী বাঙলা’ বলতেন (সুনীলকুমার চট্টোপাধ্যায় ১০৭)। অক্ষয় দত্ত ও বিদ্যাসাগরের অভ্যুদয়ের পর কেরি-র বাঙলা এমনকি বঙ্গীয় খ্রিস্টান সমাজেও গ্রাহ্য হলো না; তাঁরাও মূলস্রোতের বাঙলা গদ্যর রীতিনীতি মেনে নিলেন, ‘শ্রীরামপুরী বাঙলা’ হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।
আমার বক্তব্যর সমর্থনে আরও একটি প্রমাণ দিচ্ছি। ধরা যাক, বাঙলা গদ্যসাহিত্যর প্রতিনিধিস্থানীয়দের রচনায় একটি নির্বাচিত সঙ্কলন বার করা হবে। তার সম্পাদকের যদি বিন্দুমাত্র কাণ্ডজ্ঞান থাকে তাহলে কেরি ও তাঁর পরিজন রচনাবলির একটি পাতাও সেখানে ঠাঁই পাবে না। অবশ্যই ভূমিকায় তাঁদের কথা থাকেবে, কিন্তু মূল বই-এ নয়, সম্পাদকের পছন্দ অনুযায়ী রামরাম বসু, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার ও ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অন্যান্য পণ্ডিত-মুনশি্রা সেই সঙ্কলনে জায়গা পেতে পারেন, না- ও পেতে পারেন, রামমোহন রায় সম্পর্কেও একই কথা খাটবে।৩ কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করুন আর না-ই করুন, অক্ষয়কুমার দত্ত ও বিদ্যাসাগকে তিনি কিছুতেই বাদ দিতে পারবেন না, প্রাচীনত্বর কারবারি-র কাছে উনিশ শতকের আগের বাংলায় লেখা চিঠি ও দলিল-দস্তাবেজের যেটুকু মূল্য, সায়েবদের করা আইনের বই ও কোম্পানির নির্দেশনামার অনুবাদ তার চেয়ে বেশি কিছু নয়, কেরি ও তাঁর পরিজনদের বাইবেল- অনুবাদ আর খ্রিস্টীয় পুস্তিকাগুলিও বাঙলা গদ্যর ‘প্রাগ্ইতিহাস’-এর উপাদান।
শেষে একটি প্রশ্ন উঠতে পারে। কেরি ও তাঁর পরিজনদের ভূমিকা যদি এতি নগণ্য হয় তবে সজনীকান্ত দাস তাঁকে নিয়ে এত উচ্ছ্বাস করেছেন কেন?(সজনীকান্ত ৫৩-৫৫)। এর সহজ উত্তর : একা সজনীকান্ত নন, শনিমণ্ডলী (অর্থাৎ শনিবারের চিঠি-র লেখকগোষ্ঠী)-র অনেকই ছিলেন রামমোহন-বিদ্বেষী (শুধু বিরোধী বললে কম বলা হয়)। তাই যে-কোনো উপায়ে রামমোহনকে খর্ব করে অন্য কাউকে নিয়ে গর্ব করার দায় ছিল তাঁদের। তার জন্যেই কেরি তথা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে-এর পণ্ডিত-মুনশি্দের কৃতিত্ব প্রমাণ করতে তাঁরা কোমর বেঁধে নামলেন, (গোপাল হালদার ৩১-৩৩)। তেমনি কোনো কোনো বিদ্যাসাগর- বিদ্বেষী মাঠে নেমে সজনীকান্তদের ব্যাটনই হাতে তুলে নিয়েছিলেন (রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য ২০-২৩)। ‘মারি অরি পারি যে কৌশলে’।কিন্তু কৌশলে কি আর না-কে হ্যাঁ করা যায়? রামমোহন- বিদ্যাসাগর স্বমহিমায় বিরাজ করছেন : কেরি ও তাঁর পরিজনরা, তাঁদের ভক্তদের শত চেষ্টা সত্বেও কোথায় হারিয়ে গেছেন।
টীকাঃ
১. আবে দুবোয়া-র মন্তব্যটি মনে রাখার মতোঃ
Behold The Baptist Missionaries at Serampore; inquire what are their scriptural successes on the shores of the Ganges. ask them whether those extremely incorrect versions, already obtained at an immense expense, have produced the sincere conversion of a single pagan….. রামমোহন রায় ইংরিজি রচনাসমগ্র ৪:৪৭-এ উদ্ধৃত। বাঁকা হরফ যোগ করা হয়েছে)।
রামমোহন রায়ের কাছে এক মার্কিন পাদ্রি লিখিতভাবেজানতে চেয়েছিলেন বাঙলায় বাইবেল-অনুবাদগুলি কি মূলের প্রতি বিশ্বস্ত ও খ্রিস্টান মতবাদ বিষয়ে সম্প্রদায়গত প্রভাব থেকে মুক্ত?উত্তরে রামমোহন জানান :
To both parts of this query my reply must be in the negative. I at the same time acquit these translators of willful neglect or international perversion; They were, I think, too hasty to engage themselves in so difficult an undertaking.(ঐ, ৫১)
এর পরেরামমোহন বাঙলায় ‘নতুন নিয়ম’ অনুবাদ অভিজ্ঞতা নিয়ে মন্তব্য করেন :‘I beg to assure you, that I (though a native of this country) do not recollect having engaged myself once during my life, in so difficult a task (ঐ,৫২)।
২. শ্রীকুমার বন্দোপাধ্যায় লিখেছেনঃ
বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক বাণিজ্য প্রায় সমকালেই এ দেশে প্রসার লাভ করিয়াছিল। এই ধর্ম-যাজকদের ধর্মানুরাগের আন্তরিকতায় সংশয় করিবার কোন হেতু নাই। হতভাগ্য পৌত্তলিকদের মধ্যে সত্যধর্মপ্রচারের কল্যাণময়তায় ইহাদের যে দৃঢ় প্রত্যয় ছিল, তাহা কতকটা স্বার্থবুদ্ধি ও হীন চাতুরীর দ্বারা কলুষিত হইলেও, মোটের ওপর আন্তরিক নিষ্ঠাসঞ্জাত।(৯)
কিন্তু নিষ্ঠা দিয়ে কি অক্ষমতা পূরণ হয়?
৩. যেমন, সুশীলকুমার দে মনে করতেন :‘ Rammohan was the father, not of Bengali prose, but of the particular kind of stilted prose, which he created and which now remains isolated as a mere curiosity.’(545)
ইওরোপীয় মিশনারি ও ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিত-মুনশি্দের গদ্য সম্পর্কে কথাগুলি আরও বেশি প্রযোজ্য।
রচনাপঞ্জি
অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্দ্ধ ও বাংলা সাহিত্য, বুকল্যাণ্ড,১৯৫৯।
কার,ই, এইচ। কাকে বলে ইতিহাস: কে পি বাগচী অ্যাণ্ড কোম্পানী, ২০০৬।
গোপাল হালদার, বনচাঁড়ালের কড়চা। ন্যাশনাল পাবলিশার্স, ১৩৬৭।
গোলাম মুরশিদ। কালান্তরে বাংলা গদ্য, আনন্দ পাবলিশার্স, ১৩৯৯।
জনার্দন চক্রবর্তী। স্মৃতিভারে। জেনারেল প্রিন্টার্স য়্যাণ্ড পাবলিশার্স, ১৩৯৯।
নির্মল দাশ। বাংলা ভাষার ব্যাকারণ ও তার ক্রমবিকাশ, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়,১৩৯৪।
প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্য। টীকা টিপ্পনী। প্যাপিরাস, ১৯৯৮।
প্রমথ চৌধুরী। প্রবন্ধসংগ্রহ, খণ্ড ১, বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়, ১৯৫৭।
ফাদার দ্যতিয়েন সম্পা। কেরী সাহেবের ইতিহাসমালা, ফাদার দ্যতিয়েন, তাং নেই।
মঙ্গলবার্তা। বাইবেল, ভাগ ১, প্রাক্তন সন্ধি, খ্রীস্তিয়াঁ মিংঙো, এস.জে.ও সজল বন্দোপাধ্যায় অনুঃ জেভিয়ার প্রকাশনী.২০০৩
মিনতি মিত্র। বাংলা সাহিত্যের খ্রীস্টীয় রচনা। সাহিত্য প্রকাশ, ২০০৪।
রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য। ‘বাংলা ভাষার ভূত-ভবিষ্যৎ’, অবভাস, ২:১ এপ্রিল ২০০২।
শ্রীকুমার বন্দোপাধ্যায়। বাংলা সাহিত্যের বিকাশের ধারা, খণ্ড ২। ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানি, ১৯৬৪।
সজনীকান্ত দাস, উইলিয়াম কেরী (সাহিত্য-সাধক-চরিতমালা ১৫, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, ১৩৬৩।
সরস্বতী মিশ্র, বাংলা অভিধানের ক্রমবিকাশ। পুস্তক বিপণি, ২০০০।
সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যের গদ্য। ইস্টার্ণ পাবলিশার্স, ১৩৭৩।
সুধাংশুশেখর তুঙ্গ সম্পা.। বাংলার বাইরে বাংলা গদ্যের চর্চাঃ ষোড়শ-অষ্টাদশ শতক। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৮৫।
সুনীল কুমার চট্টোপাধ্যায়। বাংলার নবজাগরণে উইলিয়াম কেরী ও তাঁর পরিজন। রত্না প্রকাশন, ১৯৭৪।
সুরেন্দ্রনাথ সেন সম্পা.। প্রাচীন বাঙ্গালা পত্রসঙ্কলন,কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৪২।
Bhattacharya , Pranab Kumar. Was “ Bengali” the state language of the former Cooch Behar Kingdom? Journal of tyhe Asiatic Society, VOL LIV No.3,2012
Bloch, Marc . Land and Work in Medieval Europe. New York : Harpen Torchbooks,1967.
Bruce . FF .TheEnglish Bible: AHistory of Translations. London: Methuen, 1963.
De, Sushil Kumar. Bengali Litreture in the Nineteenth Century. Firma K.L.M 1962.
Roy Rammohun, The English Works. Eds Kalidas Nag and Debajyoti Burman ( One Volume ed.). Part IV. Sadharan Brahmo Samaj, 1965,47-55.
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ পার্থ মিত্র, বিকাশ রায়, সনৎকুমার মিত্র, সিদ্ধার্থ দত্ত
0 comments: