2

ধারাবাহিক - সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

Posted in


ধারাবাহিক

এক কিশোরীর রোজনামচা - ১২
সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়


Diary Entry - 09
8th. July, 1942, Wednesday.


প্রিয় কিটী,

মনে হচ্ছে, গত রবিবার থেকে আজ পর্যন্ত আমি যেন নিজের অজ্ঞাতে গোটা একটা বছর কাটিয়ে এসেছি। এর মধ্যে এত কিছু ঘটে গেছে, যে মনে হয়, আমার চারদিকের পৃথিবীটা আর আগের মত নেই। আমার সামনের পৃথিবীর সবকিছু পুরো উলটে পালটে গেছে। তবুও দ্যাখ কিটী, আমি কিন্তু ঠিক বেঁচে আছি। চারদিকের এই ওলোট-পালোট পৃথিবীটাকে দেখে চলেছি। এটাকেই বাবা বেঁচে থাকা বলেন। বাবা বলেন, ‘এই বেঁচে থাকার বোধটাই হলো জীবনের সব থেকে বড় কথা বা বড় বোধ।’ 

এই সেই অ্যানির টেবিল, যেখানে বসে অ্যানি তার প্রিয় ডাইরি লিখত।

ঠিকই ত’ আমি এখনও আগের মতোই বেঁচে আছি আর তোমাকে চিঠি লিখছি। শুধু জিজ্ঞাসা কোরো না, কোথায় আর কি ভাবে বেঁচে আছি। আমার কথা তোমার হয়ত ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না। তারচেয়ে বরং রবিবার বিকেল থেকে ঠিক কি কি হয়েছিল, বা, কি কি ঘটাছিল, কিভাবে ঘটেছিল, সেটাই তোমাকে বলা ভাল। তাতে হয়ত তুমি কিছুটা হলেও, বুঝতে পারবে গত রবিবার বিকাল থেকে আমার ও আমার পরিবারের জীবনে কি কি ঘটেছিল, এবং তার প্রভাবে এখন আমার ও আমার পরিবারের চারদিকের অবস্থাটা ঠিক কি! 

তখন বিকেল তিনটে, (একটু আগেই হ্যারী চলে গেছে, অবশ্য পরে সে আবার এসেছিল) হঠাৎ বাইরে থেকে কেউ একজন বাড়ির সামনের দরজায় কলিং বেল বাজালো। আমি তখন কাছাকাছি ছিলাম না; ভিতরের বারান্দার অল্প রৌদ্রালোকে একটু অলস ভাবে বসে একটা বই পড়ছিলাম। আমার অন্য দিকে খেয়ালই ছিল না। তাই হয়তঃ আওয়াজটা কানে এলেও, কোন প্রতিক্রিয়া হয়নি। তারপর হঠাৎ কিছুক্ষণ পরে দেখি, মারগট রান্নাঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। তার চোখে মুখে প্রবল উত্তেজনা আর ভয়। সে বারান্দার দিকে তাকিয়ে, আমায় উদ্দেশ্য করে ফিস ফিস করে চাপা স্বরে বলল, “মা এক্ষুনি ব্যাস্ততার সঙ্গে মিঃ ভ্যান ড্যানের (Mr. Van Dunn) কাছে গেছেন, দেখা করতে। “মিঃ ভ্যান ড্যান হলেন বাবার বিশিষ্ট বন্ধু। বাবার সাথে একসাথে ব্যবসা করেন।

হ্যারম্যান ভ্যান পেলস - অ্যানি তার ডাইরিতে হ্যারম্যান ভ্যান পেলসকে হ্যারম্যান ভ্যান ড্যান নামে উল্লেখ করেছে। প্রথমে একে অ্যানি হ্যান্স বলে উল্লেখ করেছিল, পরে নামটি সংশোধন করে। হ্যারম্যান ভ্যান পেলস বা হ্যারম্যান ভ্যান ড্যানকে Auschwitz বন্দী শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানেই তাকে জার্মানরা গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে মারে। এক প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকে জানা যায় যে, হ্যারম্যান ভ্যানকে যেদিন শিবিরে নিয়ে যাওয়া সেদিনই তাকে মারা হয়নি, তবে, শিবিরে যাওয়ার পর থেকেই হ্যারম্যান জীবনের আশা ছেড়ে দেন। নিতান্ত হতাশার সাথে কাজ করতে থাকেন। এইভাবে কাজ করতে গিয়ে, তিনি হাতে চোট পান। তখন শিবির কতৃপক্ষ তাকে অসুস্থ শিবিরে পাঠায়। সেই শিবির যে দেখভাল করত, সে হ্যারম্যনাকে অসুস্থ শিবিরে ঢোকানোর পরিবর্তে গ্যাস চেম্বারে ঢুকেয়ে দেওয়াকে শ্রেয় বলে মনে করে। এই ঘটনা ওই শিবিরে যাওয়ার প্রায় তিন সপ্তাহ পরে ঘটে। এই ঘটনার সাক্ষী যেমন সাল দে লিএমা (Sal de Liema ) তেমনি ওটো ফ্রাঙ্ক ও হ্যারম্যানের পুত্র পিটারও এই ঘটনার সাক্ষী ছিল।

হ্যারম্যান ভ্যান পেলস, ৩১শে মার্চ ১৮৯৮ সালে জার্মানির ওসনাব্রুক (Osnabruck) শহরে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর বাবার কসাই খানার ব্যবসা ছিল। প্রথম জীবনে তিনি বাবার সাথে কসাই খানার ব্যবসাতে কাজ শুরু করেন। কিন্তু ১৯৩৩ সালে নাৎসি সরকার ইহুদি বিরোধী আইন প্রণয়ন করলে, জার্মানির সাধারণ মানুষ বাধ্য হয়, তাঁদের কসাই খানা এড়িয়ে চলতে। অল্পদিনের মধ্যেই হ্যারম্যান পেলস্-কে তাঁর পৈতৃক ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে হয়। এবং নাৎসির ভয়ে হ্যারম্যান ১৯৩৭ সালে জার্মান ছেড়ে আমস্টারডামে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। সেখানে তিনি ওটো ফ্রাঙ্কের ব্যবসায় যোগ দেন। তিনি সাসেজ ও হারবস জাতীয় খাদ্য তৈরীর বিশেষজ্ঞ হিসাবে কাজ করতেন। 


দিদির কাছে কথাটা শুনে আমি সত্যিই একটা বড় ধাক্কা খেলাম। ভয় পেয়ে গেলাম। কারণ সবাই জানে বর্তমান অবস্থায় আমাদের মতো ইহুদি পরিবারের বড়রা হঠাৎ করে কারুর সাথে দেখা করতে যাওয়ার অর্থ অন্য কিছু! আমার চোখের সামনে তাৎক্ষনিক ভাবে ছবির মতো ফুটে উঠল অসামরিক বন্দী শিবির, আর তার নিঃসঙ্গ সেল। তবে কি আমাদের বা ওদের (ভ্যান ড্যানের পরিবারের) পরের জীবনটা এভাবেই শেষ হবে! আমাদের মধ্যেকার হঠাৎ তৈরী হওয়া ক্ষণিকের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে কিছুটা স্বগতোক্তির ভঙ্গীতে মারগট বলল, “ওরা নিশ্চয়ই একা ওখানে যাবে না!” অর্থাৎ আমরাও যাব। কিছুক্ষণ আমরা দুজনই চুপচাপ নিজেদের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। এছাড়া আর কিছুই আমাদের করার ছিল না। তারপর মারগট বলল, “আমার মনে হয়, আগামীকালই আমাদের গুপ্ত আশ্রয়ে চলে যেতে হবে কি’না বা চলে যাওয়া দরকার কি’না, সে সব বিষয়ে আলোচনা করার জন্যই মা ভ্যান ড্যানের কাছে গেছেন। ভ্যান ড্যান আর তার পরিবারও আমাদের সঙ্গে যাবেন অর্থাৎ আমাদের দুই পরিবারের মোট সাতজনকেই গুপ্ত আশ্রয়ে চলে যেতে হবে।” 

ছবিটি ১৩-০৭-১৯৪২-এ তোলা। ছবিতে একদম বাম দিকে অগস্টেঁ ভ্যান ড্যান, ডানদিকে তার স্ত্রী হ্যারম্যান তাঁদের বন্ধুদের সাথে দাঁড়িয়ে। এই পরিবারও অ্যানিদের সঙ্গে একই সাথে আত্মগোপন করে ছিলেন । অ্যানি তার ডাইরিতে এঁদেরকেই ভ্যান ড্যন পরিবার বলেছে।

এরপর আমাদের মধ্যে আর কোনও কথা ছিল না। আমরা কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কিছুক্ষণ সব কথা বন্ধ, একেবারে নিস্তব্ধ। কেউ কোনও কথা বলতে পারছিলাম না। আসলে বলার মতো কিছুই ছিল না। শুধু বাবার কথাই চিন্তা করছিলাম। বাবা বাড়িতে নেই। তিনি এসব কিছুই জানেন না। এবং পরিস্কারভাবে কিছু না জেনেই, তিনি নিশ্চিন্ত ও খোলা মনে জোডসি ইনভ্যালিডে (Joodse Invalide) তাঁর কিছু পরিচিত বয়স্ক বন্ধুর সাথে দেখা করতে ও আড্ডা মারতে গেছেন। আমাদের কিছুই করার ছিল না। আমরা এক উষ্ণ আর নীরব ভয়ে ভরা অনিশ্চয়তার মধ্যে মায়ের আসার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আসলে আনেকের কাছে অসামরিক বন্দী শিবিরের সেলের কথা শুনেছি। শুনেছি সেখানকার বীভৎসতার কথা। আমাদের চোখের সামনে যেন সেগুলোই ঘুরেফিরে আসছিল। আর যত আসছিল, ততই আমরা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ছিলাম। আমাদের মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরোচ্ছিল না।

এমন সময় নীচের ডোর বেলটা বেজে উঠল। আমি কেমন আনমনে নীচু গলায় বললাম, “এটা নিশ্চয় হ্যারী।” মারগট তাড়াতাড়ি আমার হাত চেপে ধরে তার দিকে আমায় টেনে নিয়ে বলল, “দরজা কিন্তু একদম খুলে দিও না।” অবশ্য কথাটা বলার দরকার ছিল না। কারণ আমরা দুজনেই শুনতে পেলাম, নীচে মা আর মিঃ ভ্যান ড্যান, হ্যারীর সাথে কথা বলছেন। মা আর ভ্যান ড্যান যে কখন ফিরে এসেছেন সেটাই আমরা খেয়াল করি নি। ভয় আমাদের এতটাই বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল যে আমাদের আশপাশের কিছুই আমাদের কানে আসছিল না। আমাদের সব ইন্দ্রিয় বন্দী শিবির আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। তবে ডোর বেলের আওয়াজে আমাদের আনমনা ভাবটা কেটে গেল। আমরা শুনতে পেলাম মা আর মিঃ ভ্যান ড্যান হ্যারীকে ভিতরে ঢুকিয়ে নিয়ে, সন্তর্পণে দরজা বন্ধ করে দিলেন। এরপর থেকে যখনই ডোর বেল বেজে উঠছিল, তখনই আমি আর মারগট নিঃশব্দে চুপি চুপি উপর থেকে উঁকি মেরে দেখছিলাম বাবা এলেন কি’না! আর দেখছিলাম মা আর মিঃ ভ্যান ড্যান আর কাউকে দরজা খুলে দিচ্ছেন কি’না! আর কেউ ভিতরে আসছে কি’না! আমরা কেমন যেন এক অচেনা ভয়ের মধ্যে ক্রমেই ডুবে যাচ্ছিলাম। 

এরই মধ্যে আমাকে আর মারগটকে বেশ রাশভারী স্বরে ঘর থেকে চলে যেতে বলা হলো। কারণ, ভ্যান ড্যান একা মায়ের সাথে কথা বলতে চান। আমরা শোওয়ার ঘরে গিয়ে এক আচ্ছন্ন অনুভূতি নিয়ে বসলাম। জানি না আজই এই শোওয়ার ঘরে শেষ বারের মতো ঢুকছি কি’না!! মারগট আর আমি যখন শোওয়ার ঘরে বসে, তখন মারগট খুব ধীর ও শীতল স্বরে বলল, “আসলে রক্ষী বাহিনী বাবাকে ডাকেনি, রক্ষী বাহিনী তাকেই ডেকেছিল।” ওর কথাটা শুনে আমি সত্যিই খুব ভয় পেয়ে গেলাম। ওর গলার স্বরের শীতলতা আমার দেহের ভিতরের শিঁড়দাড়া বেয়ে যেন ঠাণ্ডা জলের স্রোতের মতো নেমে গেল। গলার ভিতর যেন আওয়াজ হারিয়ে গেছে! আমি ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলাম। মারগট, আমার দিদি, বয়স মাত্র ষোল। ওরা কি সত্যি এই বয়সের মেয়েকে একা ধরে নিয়ে যাবে? কোথায় নিয়ে যাবে? কেন নিয়ে যাবে? ও’ কি অপরাধ করেছে? ও’ ইহুদি বলেই ও’কে নিয়ে যাবে? 

একটু পরে, মা যেন নিজেকেই নিজে বললেন, মারগটকে ওরা ধরে নিয়ে যাবে না। ঈশ্বর তোমাকে ধন্যবাদ। তুমি জান ওর বয়স মাত্র ষোল, ও’ একা থাকতে পারবে না। এখন মনে হলো, বাবা যখন আমাদের আত্মগোপন করার কথা বলেছিলেন, তখনও হয়ত এ’রকমই কোনও কথা ভেবেছিলেন। হয়ত ভেবেছিলেন এ’ভাবেই আমাদের লুকিয়ে পড়তে হবে, কিংবা আমদের কাউকে নিয়ে চলে যাবে। 

বুঝতে পারলাম, আমাদের আত্মগোপন করতেই হবে। এটাই একমাত্র পথ। বাঁচার জন্যে, না বেঁচে থাকার জন্যে, তা’জানি না’! যদি না লুকোই, তাহলেই বা’ আমাদের কি’হবে, তা’ও জানিনা। আমরা কোথায় যাব? এই শহরের কোনও গোপন জায়গায়, না’কি মফঃস্বলের কোথাও? কোনও বাড়িতে, না’কি কোনও ঘুপচি কুঁড়ে ঘরে? কখন যাব? কোথায় যাব? কবে যাব? আমরা কিছুই জানি না। শুধু বুঝতে পারছি, আমরা এখন থেকে আর ইচ্ছামত আকাশ দেখতে পারব না, মানুষের সাথে কথা বলতে পারব না। আমরা শুধুই লুকিয়ে থাকব। আর লুকিয়ে থাকতে পারলেই বাঁচতে পারব। হয়ত বাঁচতে পারব!! কারণ আমরা ইহুদি!! 

মনের মধ্যে এই সব প্রশ্ন নিজের মধ্যে নিজেকেই কুঁকড়ে দিচ্ছিল। ভয় দেখাচ্ছিল। কিন্তু কাউকে এগুলো নিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করার কোনও অনুমতি ছিল না। মন থেকে হাজার চেষ্টা করেও, প্রশ্নগুলোকে কিছুতেই সরাতে পারছিলাম না। শুধু মায়ের ইশারায়, আমি আর মারগট, মাথা নিচু করে, আমাদের স্কুল ব্যাগে আমাদের দামি জরুরী জিনিষগুলো একটু একটু করে গোছাতে শুরু করলাম। প্রথমেই আমি আমার ব্যাগ আর আমার এই ডাইরিটা রাখলাম। মনে হলো তোমাকে ছাড়া আমি কোথাও যেতে পারব না। বা, একমাত্র তুমিই আছ, যাকে আমি সব জায়গায় নিয়ে যেতে পারি। আমার জীবনের সব দিনগুলোকে দেখাতে পারি। যাই হোক, এরপর আস্তে আস্তে, কিন্তু প্রত্যয়ের সাথে, চুল কোঁচকানোর যন্ত্র, রুমাল, স্কুলের বই, একটা চিরুনী, পুরানো চিঠিগুলো সব গুছিয়ে ফেললাম। কেমন যেন বিভ্রান্তিকর অবস্থার মধ্যে তাড়াহুড়া করে আমি আমার জিনিষগুলো ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলাম। কারণ মাথায় ছিল, আমরা আত্মগোপন করতে যাচ্ছি। জানি না, আবার কখনও বাইরে বেরিয়ে আসব কি’না? শুধু এক আজানা প্রত্যয়ে মনকে সাহস দিচ্ছিলাম, আমরা বাঁচতে চলেছি, আমরা বাঁচতে চাই। বেঁচে থেকেই, জীবনটাকে নিয়ে বেরিয়ে আসব সবার মাঝে, আজ না’হয় কাল! বিষয়টা বেশ রোমাঞ্চকর। তাই এর জন্য আমার খুব একটা দুঃখ ছিল না। শুধু ছিল আজানা এক ভয়, বাঁচার ভয়!! আসলে আমার কাছে স্মৃতি বলতে ত’ কেবল আমার পোষাকগুলো নয়, স্মৃতি ত’ তার থেকে অনেক বেশী। আমার জীবনটাই ত’ আমার স্মৃতি, তাকে হারিয়ে ফেললে, ত’ আমিই আর থাকব না। ভাল করে দেখে নিলাম, আমার ডাইরিটা নিয়েছি কি’না!! 

শেষ পর্যন্ত বিকাল পাঁচটার সময় বাবা ফিরলেন। বাবা আমাদের মিঃ কোপহিউসকে (Mr. Koophuis) ফোন করে জিজ্ঞাসা করতে বললেন, তিনি আমাদের এখানে সন্ধ্যেবেলায় ক’টা নাগাদ আসতে পারবেন? বা, পারবেন কি’না? 

মিঃ কোওফুইস এ’ভাবেই অ্যানি ফ্রাঙ্ক তাঁকে উল্লেখ করেছে। আসল নাম, জোহান্নেস ক্লেলম্যান (Johannes Klelman); জন্ম ১৭-০৮-১৮৯৬, মৃত্যু ২৮-০১-১৯৫৯। জন্ম সূত্রে তিনি ছিলেন ডাচ নাগরিক। তিনি ও মিঃ ক্রেলার (আসল নামঃ ভিক্টর ক্যুগ্লার - Victor Kuglar, অ্যানি তার ডাইরিতে ক্যুগ্লারকে মিঃ ক্রেলার নামে উল্লেখ করেছে)। ফ্রাঙ্ক ও ভ্যান ড্যানের সঙ্গে একসাথে ব্যবসার দেখাশুনা করতেন। নেদারল্যান্ডের শাসক যখন হিটলারের নির্দেশে ইহুদি গোষ্ঠীভুক্ত ব্যক্তিদের চাকরি ও ব্যবসা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে, তখন তিনি ফ্রাঙ্কের সমুদয় ব্যবসার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ’ছাড়াও যে সমস্ত ব্যক্তি আত্মগোপন করতে বাধ্য হয়েছিল তাদেরকে তিনি নিয়মিত খাদ্য সরবরাহ করতেন। 

অন্যদিকে ভ্যান ড্যান দ্রুত বেরিয়ে গেলেন, এবং মিয়েপকে নিয়ে এলেন। মিয়েপ প্রায় ১৯৩৩ সাল থেকে বাবার ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। শুধু তাই নয়, মিয়েপের সঙ্গে বাবাদের ব্যবসার সাথে যারাই যুক্ত ছিলেন, তাদের সঙ্গে খুব ভাল সম্পর্ক ছিল। তাই সবাই মিয়েপকে শুধু বিশ্বাসই করতেন না, তার উপর ভরসাও করতেন। আর মিয়েপ তার যোগ্যও ছিলেন। 

মিয়েপ (Miep), অ্যানির বাবা ওটো ফ্রাঙ্কের অফিসে ১৯৩৩ সাল কাজ করতেন। মিয়েপ ছিলেন ওটো ফ্রাঙ্কের আফিসের টাইপিস্ট। পরবর্তীকালে, যখন ইহুদি পরিবারগুলি নাৎসি বাহিনীর ভয়ে অন্তরালে যেতে বাধ্য হয়, তখন মিয়েপও অন্য অনেকের সাথে অন্তরালে থাকা পরিবারগুলিকে খাবার সরবরাহ করতেন, এই সব পরিবারগুলি যাতে মানসিকভাবে ভেঙ্গে না পড়ে, সে দিকেও মিয়েপ বিশেষ নজর দিতেন, তাঁর স্বামী হেঙ্ক মিয়েপ (Henk Miep) তাঁর এই কাজকে শুধু সমর্থনই করতেন না, উপরন্তু সাহায্যও করতেন। 

মিয়েপ ১৯৩৩ সাল থেকে আমার বাবার সাথে একই ব্যবসায় যুক্ত আছেন। শুধু তাই নয় আমার বাবার সাথে মিয়েপ-এর নতুন স্বামী হেঙ্ক-এর বেশ ভাল গভীর সম্পর্ক ছিল। আমাদের এই ঘটনার কিছুদিন মাত্র আগে মিয়েপ, হেঙ্ককে বিয়ে করেছিলেন। দুজনেই খুব হাসি খুশী আর আনন্দে ছিল। 

মিয়েপ ও তার স্বামী হেঙ্ক গিয়েসের ছবি। ছবিটি বিয়ের অল্প কিছু দিন পর তোলা।

মিয়েপকে ডাকা মাত্র চলে এলেন। তিনি এসে বেশ কিছু ভাল জুতো, ভাল পোষাক, কোট, অন্তর্বাস এবং মোজা নিজের ব্যাগে যত্ন করে গুছিয়ে নিলেন। তার কাছে থাকলে বাইরে কেউ সন্দেহ করতে পারবে না। আমাদের কথা দিলেন, ঠিক সন্ধ্যেবেলায় তিনি জিনিষগুলো নিয়ে আসবেন। সারা বাড়িটা কেমন যেন অচেনা নিস্তব্ধটায় ভরে গেল। 

ভ্যান হেঙ্ক সান্টেন ( Henk Van Santen ) / মিয়েপ গিয়েসের স্বামী


অকস্মাৎ বাড়ির সব আলো নিভিয়ে গেলে, বা আসুস্থ আত্মীয়ের স্বাস্থ্য বিষয়ে আনিশ্চিত খবর এলে, যেমন ঘরের লোকের অবস্থা হয়, আমাদের অবস্থাও ঠিক তেমনি হয়ে গেল। সারা বাড়ির নিস্তব্ধতা এত বেশী করে আমাদের আচ্ছন্ন করে ফেলল, যে রাত্রের খাবারগুলো আমাদের সামনে গরম অবস্থায় খাবার টেবিলে থাকা সত্ত্বেও আমাদের কারুরই খেতে ইচ্ছা করছিল না। আমাদের চারদিকের সব চেনা জিনিষগুলোকেও কেমন যেন অচেনা অজানা বলে মনে হচ্ছিল। কিছুদিন আগেই আমরা আমাদের ওপর তলাটা মিঃ গোউডস্মিট-কে (Mr. Goudsmit) ভাড়া দিয়েছিলাম। মিঃ গোউডস্মিট এক ত্রিশ বছরের বিবাহ বিচ্ছিন্ন মানুষ। সে-দিন আমারা না চাওয়া সত্ত্বেও মিঃ গোউডস্মিট সারাক্ষণ আমাদের সঙ্গে ছিলেন। নিতান্ত এক বাড়ির বাসিন্দা হিসাবেই ছিলেন। তাঁর এই ব্যপারে কিছুই করার ছিল না। তবুও তিনি ছিলেন। হয়তঃ কৌতূহলের বশে, অথবা পড়শি হিসাবে! কিন্তু সেই মুহূর্তে আমরা চাইছিলাম না যে, তিনি আমাদের মধ্যে থাকুন। তাঁর হাত থেকে নিস্কৃতি পাওয়ার একমাত্র পথ ছিল তাঁর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা। হয়ত তিনি বুঝতে পারছিলেন, তবুও তিনি সেদিন প্রায় রাত দশটা পর্যন্ত অকারণে অত্যন্ত বিরক্তিকরভাবে আমাদের সঙ্গে প্রায় ঝুলে রইলেন। তারপর তিনি ওপরে গেলেন।

মিঃ গোউডস্মিট (Mr. Goudsmit)

প্রায় রাত এগারোটা নাগাদ মিয়েপ আর হ্যাঙ্ক ভ্যান সান্তেন (Hank Van Santen) [ইনি মিয়েপের স্বামী] এসে পৌঁছালেন আমাদের বাড়িতে। আবার তাঁরা আগেরবারের মতো বেশ কিছু জুতো, মোজা, অন্তর্বাসের অংশ বিনা বাক্যব্যায়ে নিজেদের ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলেন। কিছু ঢুকল মিয়েপের ব্যাগে আর কিছু ভ্যান সান্তেন তাঁর ভিতরের পকেটে ঢুকিয়ে নিলেন। তারপর ঠিক সাড়ে এগারোটা নাগাদ তাঁরা যেমন এসেছিলেন, তেমনি চলে গেলেন। আমার প্রচণ্ড ক্লান্ত লাগছিল। আমি ইতিমধ্যেই জেনে গিয়েছিলাম যে হয়ত আজকের রাত্রির মতো, আমি আমার বিছানায় শোব। কাল থেকে কোথায়, জানি না। তবু বিছানায় শোওয়ার পরই, আমার ক্লান্তি আমায় সে সব কথা ভাবার সময়ই দিল না। আমি গভীর ঘুমে ডুবে গেলাম। একেবারে ঘুম ভাঙল পরের দিন সকাল সাড়ে পাঁচটার সময়। মা তখনই ডাকল। ভাগ্যভাল রবিবারের মতো সোমবারেও বেশী গরম ছিল না। আবহাওয়া ছিল ঈষদুষ্ণ, সারাদিন অল্প-বিস্তর বৃষ্টি হচ্ছিল। আমরাও মা-এর কথায় যতগুলো সম্ভব জামা প্যান্ট পরে নিয়েছিলাম। আমাদের দেখে মনে হচ্ছিল, আমরা যেন উত্তর মেরু অঞ্চলে অভিযান করতে যাচ্ছি। আসলে আমাদের উদ্দেশ্য ছিল, যত বেশী সংখ্যক জামা প্যান্ট আমাদের সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা। পরার অন্য একটা কারণও ছিল। আমাদের মতো অবস্থায় কোনও ইহুদি যাওয়ার পথে সঙ্গে সুটকেশ ভর্তি জামা-কাপড় নিয়ে রাস্তা দিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারে না। আমি দুটো জামা দুটো প্যান্ট পড়ে তার ওপর আরও একটা পোষাক চাপিয়ে, তারও ওপর একটা ঘাঘড়া, একটা কোর্ট ও গ্রীষ্মকালীন কোর্ট চাপালাম। পায়ে দু-জোড়া মোজা ও লেস দেওয়া জুতোটা পড়লাম, মাথায় উলের টুপির ওপর একটা বড় মাফলার জড়ালাম। আরও কিছু হয়ত ছিল। মোটামুটি যাত্রা শুরু করার আগে, আমার পোষাকের ভারে প্রায় শ্বাসবন্ধ হওয়ার জোগাড়। কিন্তু আমার অসুবিধার কথা জিজ্ঞাসা বা সে নিয়ে চিন্তা করার মতো মানসিকতা কারুর ছিল না। 

মারগট তার সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিষ স্কুলের বই-এর সঙ্গে স্কুল ব্যাগে পুরে নিয়ে, তার সাইকেল বাইরে বের করে এনে, মিয়েপের সঙ্গে সাইকেলের পিছনে বসে আগেই এক অচেনা লক্ষ্যের দিকে চলে গেল। জানি না, মারগটের সাথে আর দেখা হবে কি’না!! অন্ততঃ আমি তার গন্তব্যস্থল চিনতাম না। তোমায় সত্যিই বলছি, আমাদের আত্মগোপন করে থাকার জায়গাটা ঠিক কোথায় তা’ আমি জানতাম না! ঠিক সকাল সাড়ে সাতটার সময়, আমরা আমাদের সদর দরজাটা বন্ধ করে তাকে পিছনে রেখে পথে নামলাম। বাড়ি থেকে আমাদের বিদায় জানানোর জন্য পিছনে তখন শুধু পড়ে থাকল আমাদের ছোট্ট বিড়াল। মোরটজী (Moortje) আশা করি কয়েকদিনের দিনের মধ্যেই সে তার থাকার জন্য আমাদের প্রতিবেশীদের বাড়িগুলোর মধ্যে সবথেকে ভাল বাড়িটাকে খুঁজে নেবে। এ’সব কিছুই, একটা চিঠিতে লিখে, মিঃ গৌডস্মিটের নামে ছেড়ে রেখে এলাম। 

রান্নাঘরে তখন মোরটজীর জন্য এক কিলো মতো মাংস রাখা ছিল। প্রাতঃভ্রমনের পরের খাবারগুলো টেবিলের ওপর পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখা হলো, এক ফালি বিছানা করে রাখা হলো। এগুলো এমনভাবে রাখা হলো, যাতে হঠাৎ করে কেউ এলে তার মনে হবে, আমরা, অর্থাৎ বাড়ির লোকেরা, এ’দিক ও’দিক কোথাও বেরিয়েছে। কিন্তু আমাদের কাছে এই সব চিত্রের কোনও ছাপ বা এই স্মৃতির অদৌ কোনও মূল্য ছিল না। আমরা কেবল চাইছিলাম দূরে আরও দূরে কোনও এক গোপন অচেনা আজানা জায়গায় চলে যেতে। আমরা কেবল পালাতে চাইছিলাম। নিরাপদ কোনও এক অজানা জায়গায় পৌঁছাতে চাইছিলাম। এর বাইরে আর কিছুই আমাদের চাওয়ার ছিল না। এর বাইরে কিছুই আর ভাবার ছিল না। আজ থাক। আবার কাল লিখব। অবশ্য সত্যিই যদি লেখার মতো কিছু থাকে!! বা, লেখার জন্যে কিছু থেকে থাকে!! 

ইতি,

তোমার অ্যানি

2 comments: