0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in




ধারাবাহিক


জলরেখা 
নন্দিনী সেনগুপ্ত



চোদ্দ

খাবার পরে সুনন্দ নয়নকে ডাক দেন ‘আয় রে দাদুভাই!’ বালিশ এগিয়ে দেন সেই কিশোরবেলার মতো। নয়ন হাসে। মনে পড়ে যায় সেই কঠিন দিনগুলোর কথা। যখন সে বাবা-মা হারানোর ব্যথা ভুলতে দাদু ঠাকুমাকে আঁকড়ে ধরেছিল। দাদু আর ঠাকুমার মাঝে শুয়ে ঘুমাত সে। দাদুর দিক থেকে হাল্কা নিকোটিনের গন্ধ আর ঠাম্মার দিক থেকে জবাকুসুম তেল আর পান-জর্দার মিলিত সৌরভের মাঝে সে কতকটা নিশ্চিন্ত বোধ করত। এই ঘরে সেই সবগুলো সুগন্ধ আছে। হাল্কা নাক টেনে অনুভব করল সে। সেইরকম কিছুটা ভাললাগা ঘিরে রাখছে তাকে। নয়ন আবার হেসে উঠে বলে, ‘না গো দাদু, দুপুরে ঘুমাই না তো। আর আজ তো ঘুমাবই না। এখন ঘুমালেই সময় নষ্ট। তোমাদের সাথে আড্ডা হবেনা। বিকেলের ট্রেনে ফিরতে হবে যে’... বলতে বলতে খাবার ঘর থেকে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে আসে নয়ন। ‘তোমার শরীর ভাল না। তুমি নাহয় একটু ঘুমিয়ে নাও দাদু’... খাটের পাশে চেয়ারে বসে নয়ন খবরের কাগজ হাতে তুলে নেয়। 

সুনন্দ বিছানায় শুয়ে নয়নের দিকে পাশ ফেরেন। বলে ওঠেন, ‘বল দাদুভাই, কমল কি বলে পাঠিয়েছে?’ নয়ন চমকে ওঠে। হাত থেকে কাগজ খসে পড়ে মাটিতে। ‘তুমি কি করে জানলে?’ অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলে নয়ন। ‘জানি গো দাদুভাই। সবই জানি’। মুচকি হাসেন সুনন্দ। ‘আর তুমি যে বলতে পারছ না, দোনোমনো করছ-- সেটাও বুঝতে পারছি’। ... ‘না, তুমি বুঝতে পারছ না’। হঠাৎ আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে নয়ন... ‘আমাকে বলতে বলা হয়েছে এটা ঠিক। কিন্তু, আমি এসব বলতে আসিনি। আমি তোমাদের দেখতে এসেছি। তোমাদের ছাড়া যে আমি কি কষ্টে আছি, সেটা কি তুমি বুঝতে পারছ?’ চেয়ার ছেড়ে খাটে উঠে সুনন্দর হাত চেপে ধরে নয়ন। ‘কি হলো? দাদু-নাতিতে আমাকে বাদ দিয়ে কি ষড়যন্ত্র করছিস তোরা শুনি?’ বলতে বলতে ঘরে ঢোকেন এষা, এবং নয়ন চুপ করে যায়। ঘরের নৈঃশব্দে এষা আঁচ করতে পারেন যে কিছু একটা হয়েছে। আবার প্রশ্ন করেন, ‘কি হয়েছে?’ এবার সুনন্দ মুখ খোলেন,... ‘কিচ্ছু হয়নি। দাও দেখি আমায় একটা পান দাও’... একটু লঘু সুরে বলেন সুনন্দ। ‘যাব্বাবা, তুমি তো সাতজন্মে পান খাও না। আজ আমার মিঠে পাতা বাড়ন্ত... আর আজই? দাঁড়াও, দেখি...’ । সুপুরি কুচোতে কুচোতে চিন্তিত মুখে বলেন এষা, ‘হ্যাঁ রে নয়ন, তুইই বল না কি হয়েছে? কিছু তো একটা হয়েছে নির্ঘাৎ। তোর দাদু নির্ঘাৎ কথা ঘোরাবার জন্য পান খেতে চাইছে’। 

সুনন্দ বলে ওঠেন, ‘নয়ন, তুই কিছু বলবিনা। হ্যাঁ, আমিই বলব। আগে তুমি একজায়গায় স্থির হয়ে বস। নীরু কোথায়? ঘুমাচ্ছে?’ এষা কাঁপা কাঁপা গলায় বলেন, ‘হ্যাঁ, ঘুমোচ্ছে। কি হয়েছে তুমি আগে বল’। 

সুনন্দ বলেন, ‘না, সেরকম কিছু নয়। অত ঘাবড়াবার ব্যাপার কিছু নয়। আমাদের কলকাতার বাড়ি ভেঙ্গে কমল ফ্ল্যাটবাড়ি বানাতে চায়। সেই মর্মে ও আমাদের পাড়ার দেবাশিসের সঙ্গে কথা বলেছে। দেবাশিসকে মনে আছে তোমার? একসঙ্গে ভলিবল খেলত যে দলটা পাড়ায়, দিলীপের ভাই সুবিমল এরা, রবিও ছিল ওদের দলে। দেবাশিস ... সেই যে কালো মতো, লম্বা। খুব ভালো স্ম্যাস করত।... এষা সম্মতিসূচক মাথা নাড়েন। সুনন্দ বলে যান... ‘দেবাশিস ঠিক আমাদের পাড়ার ছেলে নয়। মনসাতলার দিকে থাকত। ও নাকি এখন কনস্ট্রাকশানের ব্যবসা করে। নতুন অফিস খুলেছে আমাদের পাড়ায়। ওই যে আজকাল যাকে বলে ‘প্রোমোটিং’। আমাকে কমল কিছুদিন আগেই ফোন করেছিল এই ব্যাপারে...’ হাত তুলে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে এষা বলেন, ‘কবে? কবে ফোন করেছিল ঠাকুরপো? তুমি তো আমাকে কিছু বলনি!’ ক্ষোভ ঝরে পড়ে এষার কণ্ঠে। ‘সময় পাইনি বলার। তার পরদিন থেকেই আমি হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম’। মুখ নিচু করেন সুনন্দ। 

এষা চুপ করে যান। মনে মনে সাজাবার চেষ্টা করেন জিগ-স পাজলের মতো না মেলা হেঁয়ালির টুকরোগুলো। সুনন্দর হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকের কারণটা হয়ত কিছুটা তার কাছে পরিষ্কার ঠেকে। কমলের কাছ থেকে বসতবাড়ি ভেঙ্গে ফ্ল্যাট বানাবার প্রস্তাবে কি সুনন্দ কিছুটা হলেও বিচলিত হয়েছিলেন? ওই বাড়ির সঙ্গে সুনন্দর মা-বাবার অনেক স্মৃতি জড়িত। তিনিও তো বধূবেশে প্রথম ওই বাড়ির দরজায় পা রেখেছিলেন। কিছুদিন হলো ছেড়ে এসেছেন, সেটা ঠিক। ছেড়ে আসতে কষ্ট হয়েছে, সেটাও মিথ্যে নয়। কিন্তু মনের মধ্যে কোথাও কি এরকম একটা ভাবনা নেই যে প্রয়োজনে বা ইচ্ছে হলেই যেকোনও দিন ফিরে যেতে পারেন আবার ওই বাড়িতে। কিন্তু... ওই বাড়িটাই যদি ভেঙ্গে ফেলা হয়... নাহ... এষা আর কিছু কল্পনা করতে পারেন না। 

এবার নয়ন বলে ওঠে, ‘দাদু, আমি কিন্তু এসব বলতে এখানে আসিনি। ইন ফ্যাক্ট, আমার যথেষ্ট আপত্তি আছে বাড়ি ভেঙ্গে ফ্ল্যাট বানাবার ব্যাপারে। ওই বাড়িতে আমি জন্ম থেকে রয়েছি। অনেক, অনেক স্মৃতি আমার ওই বাড়িতে। আমি কক্ষনও চাইব না বাড়িটা ভেঙ্গে ফেলা হোক’। সুনন্দ হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করেন নয়নকে...... কিছুক্ষণ পরে প্রায় ফিসফিসিয়ে বলেন, ‘জানি রে দাদুভাই’। তারপর উঠে বসে এষার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘কি হলো? দিলে না একখানা পান? খয়ের দিও না যেন!’ এষা নিজের মনে কি যেন বলেন অনুচ্চ স্বরে, তারপর অগোছালোভাবে পড়ে থাকা পানের ডিবে গুছিয়ে নিয়ে সাজতে থাকেন পান। 

সুনন্দ স্বগতোক্তির মতো বলে যান, ‘সমস্যা তো সেটা নয়। সমস্যা অন্য জায়গায়। বাড়ি ভেঙ্গে মোট আটখানা ফ্ল্যাট হতে পারে বলে জানিয়েছে। এর মধ্যে চারখানা ফ্ল্যাট আমাদের দেবে। বাকি চারখানা ডেভেলপার, মানে দেবাশিস নিজে অন্য ক্রেতাকে বিক্রি করবে। এখন এই আমাদের চারটের মধ্যে কমল নিজে দুটো নেবে এবং আমাকে দুটো দেবে বলে জানিয়েছিল। সেই ভাগাভাগিতে আমার যথেষ্ট আপত্তি আছে। কারণ, কলকাতার বাড়ির ভাগ থেকে রবি সম্পূর্ণভাবে বঞ্চিত হবে, সেটা কোনওভাবেই হতে পারে না। এই বাড়িতে, মানে এই হুগলীর বাড়িতেও কমল এবং রবি এরাও অংশীদার। আমি এই মুহূর্তে একটা অংশে একটু সারিয়ে-সুরিয়ে নিয়ে বসবাস করছি, এটা ঠিক... কিন্তু এখানেও তো ওদের দুজনেরই ভাগ রয়েছে। আবেগের ব্যাপার দূরে সরিয়ে একটু প্র্যাকটিকালভাবে ভাবা প্রয়োজন। আজ ভাগাভাগির সুবিধের জন্য কলকাতার বাড়ি ভাঙ্গা যেতেই পারে। দুদিন পরে কালের নিয়মে এই বাড়িতেও হাত পড়তে পারে। কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই আমাদের তিনভাইয়ের মধ্যে সমান ভাগাভাগি হওয়া দরকার। কমল পুরো ব্যাপারটা উড়িয়ে দিতে চাইছে। রবির অস্তিত্ব ও যেন একরকম অস্বীকার করতে চাইছে। বলছে, ওর তো সংসার নেই। আরে... সংসার নেই মানেটা কি? ওর টাকার প্রয়োজন নেই? ও যে কর্মকাণ্ডে হাত দিয়েছে, ওই আশ্রমের ব্যাপারে... সেখানে তো ওর সত্যিই আরও টাকা দরকার। বাড়ির ভাগ যদি নাও দেওয়া হয়, সমান মূল্যের অর্থ তাকে অবশ্যই দিতে হবে’। একটানা এতগুলো কথা বলে যেন হাঁপিয়ে যান সুনন্দ। নয়ন এগিয়ে এসে আবার ধরে তাকে... অনুনয়ের সুরে বলে... ‘প্লিজ দাদু, তুমি একদম এটা নিয়ে উত্তেজিত হবে না। এতটা উত্তেজনা তোমার শরীরের জন্য ঠিক নয়। প্লিজ, এবার একটু শুয়ে পড়ো’। এষা কাঁপা কাঁপা গলায় বলে ওঠেন, ‘দ্যাখ নয়ন, এসব জিনিস আমার মাথায় ঠিকঠাক ঢোকে না। একটু শান্তিতে থাকব বলেই সবসুদ্ধু একেবারে শিকড় উপড়ে নিয়ে এসে বুড়োবয়সে এখানে থাকা শুরু করলাম। ঠাকুরপোর কি তাতেও শান্তি নেই? এখন ওই বাড়ি ভাঙবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে!’ 

নয়ন এই দুই বিচলিত এবং উত্তেজিত বৃদ্ধ-বৃদ্ধার মাঝে চরম অপ্রস্তুত বোধ করে। ভেবে পায়না কাকে আগে শান্ত করবে? তাড়াতাড়ি কথা চাপা দেবার জন্য প্রশ্ন করে... ‘আচ্ছা গাগার কি খবর? অনেকদিন দেখিনি তো! কবে আসবে গাগা?’ ... নিরূপের প্রসঙ্গ ওঠায় এষা আরও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। হঠাৎ গলার স্বর চড়িয়ে বলেন, ‘জানি না। জানি না আমি সে কবে আসবে!’... ... সবাই চুপ হয়ে যায়। নিস্তব্ধতার মাঝে একটা মিষ্টি রিনরিনে গলা শোনা যায়, ‘আসবে। বাবা বলেছে বাবা খুব তাড়াতাড়ি আসবে’... সবাই চমকে ওঠে। এষা বলে ওঠেন, ‘নীরু! --- তুই ঘুমাসনি?’



0 comments: