0

ছোটগল্প - সঞ্চয়িতা বিশ্বাস

Posted in


ছোটগল্প


অব্যক্ত
সঞ্চয়িতা বিশ্বাস


১.
সিগনালের রং বদলে গেছে। এক্ষুনি ট্রেন ছাড়বে। অয়ন ট্রেনের জানলা দিয়ে তাড়াতাড়ি টিকিটটা দিলো মনীষার হাতে। তক্ষুনি নড়ে উঠলো গাড়িটা। অয়ন তাকিয়ে আছে মনীষা আর ঝিলমিলের দিকে।সেও ট্রেনের সাথে চলতে শুরু করেছে। মনীষা বেশ বুঝতে পারছে ট্রেনটা দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেলেই অয়নের চোখ ভিজে উঠবে।ফাঁকা স্টেশনে সে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াবে কিছুক্ষণ।মনীষার কষ্ট হচ্ছে…প্রতিবারই হয়। সে গলা তুলে বললো, "খাওয়াদাওয়ার অনিয়ম করবে না কিন্তু। আমরা লক্ষ্মীপুজোর পর ফিরে আসবো।…সাবধানে থেকো।…তাকাও আমার দিকে। "অয়নকে নিজের দুইচোখে বন্দী করে মনীষা ছুটে চললো ট্রেনের গতিতে। মনে মনে অসংখ্যবার বললো, "ভালবাসি… তোমায় ভালবাসি।"

ঝিলমিলের খুব মজা।উঃ,মামার বাড়ি যাচ্ছে…দিদুনের কাছে।আনন্দের চোটে সে চিপ্সের প্যাকেটটাই খুলে ফেললো। মা বাইরের দিকে তাকিয়ে বসেছিল। প্যাকেট খোলার শব্দেই ফিরে তাকিয়েছে, "এই তো সবে বাবা দিলো চিপ্সটা। পরে খেলে পারতিস না! এতটা পথ যাবি! "ঝিলমিল মায়ের কথার উত্তরে কড়মড় করে একটা চিপ্স চিবোতে লাগলো। মা-টা যে কি! বাবাকে ছেড়ে যেখানে যায়, সেখানে যাবার পথে মুখ গোমড়া করে বসে থাকে! বাবাও তেমনি! কি একটা পচা অফিসে চাকরি করে, ছুটির সময় ছুটি দেয় না! ধুস! ঝিলমিল বড়ো হলে ওরকম চাকরি করবেই না। সে ছুটি হলেই দিদুনের কাছে চলে যাবে। দিদুনের সাথে তার "দোস্তি"টাই অন্যরকম। আনন্দে মচরমচর চিপ্স চিবোয় ঝিলমিল।

আকাশটা অসহ্যরকমের নীল। মনীষা তবুও ট্রেনের জানলা দিয়ে তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে। অয়নকে একা রেখে কোথাও যেতে তার ভালো লাগে না। কিন্তু ঝিলমিলের জন্য আসতেই হলো। সে আর ঝিলমিল আনন্দ করবে…আর অয়ন অফিস থেকে ফিরে ফাঁকা বাড়িতে বসে থাকবে! মনীষা দীর্ঘশ্বাস চাপে। ঝিলমিল চিপ্সের প্যাকেট থেকে চোখ না তুলেই বলে, "মা,তুমি এত মনখারাপ কোরো না। আমার মনে হচ্ছে বাবা কাল-পরশুর মধ্যেই আমাদের কাছে চলে আসবে। যত কষ্টই হোক, ওখান থেকে অফিস করবে। "মনীষা চোখ পাকায়, "বেশী পেকেছো না!" থোকা থোকা ঝুঁটিদুটো নাচিয়ে হেসে ওঠে বছর নয়েকের বাচ্চাটা, "সত্যি! দেখো মা…"

২.
দুপুরবেলার ট্রেনগুলোর কোনও তাড়া থাকে না। শরতের রোদ্দুর মাখতে মাখতে ঢিমেতালে এগিয়ে চলেছে…যেন যেতে হবে, তাই যাচ্ছি! গন্তব্যে পৌঁছনোটাই বড়ো কথা…সময় বা গতি খুব তুচ্ছ বিষয়। চিপ্স শেষ করে ঝিলমিল প্রকৃতি দেখায় মন দিয়েছে।আকাশ…আকাশ…আরও আকাশ…আরও মেঘ…গাছের পর গাছ…বিশাল বিশাল বিল…তাতে কত্ত কচুরীপানা…পানিফলের চাষ…ধানখেত…উফ্, ঝিলমিলের দারুণ লাগছে। সে অনবরত মাকে 'এটা কি' 'ওটা ওরম কেন' জিগ্যেস করে যাচ্ছে। মনীষার মনখারাপ ভাবটা কেটে গেছে মেয়ের কথায়। সে মেয়ের সব প্রশ্নের উত্তর দেবার চেষ্টা করছে। ফাঁকা ট্রেন…হু হু হাওয়া…হকারদের বিকিকিনি…সব মিলিয়ে খুব ভালো লাগছে মনীষার।

আধঘন্টা দেরী করে ট্রেন শিয়ালদা পৌঁছলো। প্রায় সাথে সাথেই ট্রেন পেয়েছে মা-মেয়ে। দ্বিপ্রাহরিক প্রায় জনশূন্য ট্রেন। ধীরে সুস্থে হাওয়ার দিকের জানলাটা দখল করে বসলো ঝিলমিল। মনীষা বাঙ্কে বড়ো ব্যাগটা রেখে বসেছে মেয়ের পাশে। মোবাইলে অয়নের নম্বরটা ডায়াল করতে করতে ট্রেনের ভোঁ বেজে উঠেছে। রিঙের শব্দটা ডুবে গেছে ট্রেনের শব্দে। মনীষা বুঝতে পারছে না অয়ন ফোনটা ধরেছে কি না। ভীষণ হন্তদন্ত হয়ে একজন উল্টোদিকের জানলার ধার দখল করলো। মনীষা তাকিয়েছে তার দিকে। তক্ষুণি দুলে উঠলো ট্রেনের মেঝে। ফোনের ওপাশে অয়নের গলা, "হ্যালো হ্যালো…ট্রেন পেয়েছো? "নতুন সহযাত্রীর চোখে চোখ রেখে ঠাণ্ডা গলায় উত্তর দিলো মনীষা, "পেয়েছি।"

৩.
পলাশ কি করবে বুঝতে পারছে না। উল্টোদিকের সিটে মনীষা বসে আছে…সাথে একটা বাচ্চা। বাচ্চাটা যে মনীষার, সে কথা বলে দিতে হয় না। আর বছর তিন-চার পর এই মেয়ে একদম কিশোরী মনীষার রূপ পাবে…যে মনীষাকে পলাশ চিনতো। পলাশের অস্বস্তি হচ্ছে।সে কি উঠে অন্য কোথাও বসবে? সেটা কি উচিত হবে? পলাশ একটা সিগারেট ধরায়। বাচ্চাটা তক্ষুণি বলে উঠেছে, "passive smoking is injurious to health." পলাশ থমকে যায়। মলিন হেসে সিগারেটটা বাইরে ফেলে দেয়, "দুঃখিত।" একটু থেমে বাচ্চাটাকে জিগ্যেস করে, "তোমার নাম কি গো?" মেয়েটা তার মায়ের হাতব্যাগ থেকে একটা 'আনন্দমেলা' বের করতে করতে বলে, "সুনৃতা রায়।" পলাশ মনীষার দিকে এক পলক তাকায়। চোয়াল শক্ত করে বসে আছে মনীষা। পলাশ ঝিলমিলের দিকে ফেরে, "বাহ্,কি সুন্দর নাম!তোমার নামের অর্থ কি?" ঝিলমিল ভালো করে তাকায় পলাশের দিকে। কি সুন্দর দেখতে লোকটা! কি আগ্রহ করে তাকিয়ে আছে তার দিকে।ঝিলমিল স্পষ্টকন্ঠে উত্তর দেয়, "মানে 'সত্য অথচ প্রিয় বাক্য'।" পলাশ চমকে ওঠে। সত্য কি প্রিয়ভাবে বলা যায়?

পলাশ দীর্ঘদিন পর বাড়ি ফিরছে পুজোয়। মনটা এত ভাল লাগছিল।কি দরকার ছিল মনীষার সঙ্গে দেখা হওয়ার?! ও নিশ্চয়ই বাড়ি যাচ্ছে পুজোয়। তার মানে আবার দেখা হতে পারে! পলাশের ভীষণ অস্বস্তি লাগছে। শিমুলতলা এসে গেছে। আর মোটে তিনটে স্টেশন! পলাশ কি করবে? কথা বলবে না? কিন্তু অপরাধটা তো তারই ছিল।নত তো তারই হওয়া উচিত। সে ইতস্তত করে মনীষার দিকে ফিরলো, "কেমন আছিস?" মনীষা তীক্ষ্ণচোখে তাকিয়েছে পলাশের দিকে, "ভালো।" ঝিলমিল মাকে দেখছে। মা এত রেগে আছে কেন লোকটার উপর? লোকটা কে? কি দোষ ওর? পেটের মধ্যে প্রশ্নগুলো গুড়গুড় করে ওঠে ঝিলমিলের। মনীষা উঠে দাঁড়িয়েছে। ব্যাগ নামিয়ে মেয়ের হাত ধরে দরজার দিকে এগোয় সে। ঝিলমিল মৃদুস্বরে মাকে জিগ্যেস করে, "ও মা, তুমি লোকটাকে চেনো?" মনীষা ব্যাগ সামলাতে সামলাতে উত্তর দেয়, "চিনতাম।" ঝিলমিল পিছন ফিরে পলাশকে জিগ্যেস করে, "তোমার নাম কি গো?" পলাশ রুকস্যাকটা কাঁধে ফেলতে ফেলতে উত্তর দেয়,"পলাশ।" স্টেশন এসে গেছে। মনীষা ঝিলমিলকে নিয়ে নেমে সোজা হাঁটা শুরু করেছে রিকশাস্ট্যান্ডের দিকে।ঝিলমিল পিছন ফিরে পলাশকে একবার দেখে। লোকটা স্টেশনে দাঁড়িয়েই আছে। তাদের দিকে কেমন অসহায়ভাবে তাকিয়ে আছে। ঝিলমিল মনীষাকে ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করে, "ও মা, ঐ পলাশকাকু কি দোষ করেছে গো? তুমি ওরম রেগে আছো কেন?" মনীষা ঘাড় ঘুরিয়ে তীব্রচোখে মেয়েকে জরিপ করে, "ও তোমার 'কাকু' বা 'মামা' কোনওটাই নয়। ও পলাশ…শুধু পলাশ।" ঝিলমিল ভয় পায় মায়ের রণমূর্তিকে। সে চুপ করে মাকে অনুসরণ করে।

৪.
নিয়মভঙ্গের শেষে সব আত্মীয়রা বিদায় নিয়েছে। মনীষার মালা পরানো ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে অয়ন। ঝিলমিল বাবার পাশে এসে দাঁড়ায়। অয়নের চোখে জল। ঝিলমিল বাবার কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনাসূচক শব্দ খুঁজতে থাকে। এমন সময় কলিংবেল বেজে ওঠে।মালতীমাসি দরজা খুলে দিয়েছে। বাবাকে মায়ের কাছে রেখে ঝিলমিল বসবার ঘরের দিকে এগোয়। খুব সুন্দর দেখতে এক প্রৌঢ় বসে আছে সোফায়। ঝিলমিলকে দেখেই উনি উঠে দাঁড়িয়েছেন ,"নমস্কার। তুমি আমায় চিনবে না হয়তো…তোমার মা আমাকে চিনতেন। আমার নাম…"। ঝিলমিল কথা শেষ করতে দেয় না, "আমি চিনি আপনাকে। আপনি পলাশ…শুধু পলাশ।" পলাশ কি বলবে বুঝে পায় না। এই মেয়ের ভিতরে একটা কাঠিন্য আছে…যেমনটি ছিল মনীষার মধ্যে। সে ইতস্তত করে শুরু করে, "আমি দীর্ঘদিন বাইরে আছি। তোমার মায়ের খবরটা পেয়ে গতকাল এসেছি। আমি খুব দুঃখিত।" ঝিলমিল চুপ করে দেখছে লোকটাকে।পলাশ কয়েক মুহূর্ত বসে এলোমেলোভাবে উঠে দাঁড়ায়, "আমি আসি।" ঝিলমিল দেখছে লোকটার চলে যাওয়া। দরজায় পৌঁছে গেছে লোকটা। ঝিলমিল হঠাৎ ডেকে ফেলে, "শুনুন।" পলাশ থমকে পিছু ফেরে। ঝিলমিল তাকিয়ে আছে ওর চোখের দিকে, "আপনি আমার মায়ের কাছে কি দোষ করেছিলেন?" পলাশ থতমত খায়…শব্দ খোঁজে। ঝিলমিল দরজাটা খুলে দিতে দিতে মৃদুকন্ঠে বলে, "থাক্ আপনাকে বলতে হবে না। আপনি আসুন।" পলাশ মন্ত্রমুগ্ধের মতো বের হয়ে আসে। দরজাটা মুখের ওপর বন্ধ হয়ে যায়।



0 comments: