1

মুক্তগদ্য - শালিনী ঘোষ

Posted in


মুক্তগদ্য


চক্রব্যূহ
শালিনী ঘোষ


পৃথিবীর সব পথ প্রবলভাবে ঘরের দিকে টানতে থাকে। নিয়নের সেপিয়া গলি, ঘষটানো পিচ, খোয়া ওঠা ধুলো ধুলো - সবার গন্তব্য সেই এক। ঘর বলতে চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক পালঙ্ক মাত্র। মিশকালো পালিশ। আর পায়ের গোড়া বেয়ে নেমে গেছে চৌকি। পালঙ্কের তলার অন্ধকার খোঁদল জুড়ে অনায়াস পরিপাটি আরও একটা সংসার হওয়ায় বাধা নেই কোনও। ভীড়ের মধ্যে অসহায় একা নিস্তরঙ্গ মানুষকে প্রতিটা পরিচিত ঘর থেকে ওই পালঙ্ক হাতছানি দেয়। মাথার পাশে বড় কাঁসার গ্লাসটা জল ভরাই থেকে যায় অনন্ত। যেন সীমাহীন উৎসমুখ। অমনই খানিক মলিন ঘিয়েটে চাদর আর চূড়ো করা মশারির তাল আর শ্বাস টের পাওয়ার সতর্কতায় ঘুণপোকার কিট কিট হঠকারি হতে দেয়না। শিকড়ে ঘরের টান বুনে দেয় আজীবন।

প্রতিটা ঘরের নিজস্ব গন্ধ থাকে কিছু, মানুষের চুলের মতন, যোনিঘ্রাণের মতোই আলাদা করা যায় সহজে; আলমারির পিছনে কোণাঘুঁপচিতে জমতে থাকা ঝুলেরা, মেঝের কোনায় কোনায়- ঠিক যেখানে ভেজা ছোঁয়া পড়েনি, পড়েনা বহুকাল এসবের টান তীব্র, বড় তীব্র মনে হয় কখনও। চান করতে গিয়ে পা হড়কে যাওয়ার প্রিয় গোলাপি পাথর, ভোররাতে কাঁচের ফাঁকটুকু দিয়ে টুপটাপ বেয়ে আসা হিম আর স্বপ্ন থেকে উঠে আসা আজান -সব স্মৃতি গায়ে মেখে চায়ের দোকানে প্রথম আগুনের আঁচ আসে, প্রথম ট্রেন শহর ছোঁয়ার ব্যস্ততায় ঈষৎ নড়েচড়ে বসা হয় খানিক। এসব দিনে, এসব অন্য মানুষের অন্য জীবনে ঘোর লাগে নেশার পরত বেয়ে বেয়ে। 

মহাশূন্যের মাঝে পৃথিবী নামের যে গ্রহে প্রাণগুলো নড়েচড়ে জীবনকে সাড়া দেয়, কখনও নিযুত আলোকবর্ষ পেরিয়ে তাতে পা রাখে ভিনগ্রহী। যে অসীম বিশ্বব্রক্ষ্মাণ্ড তারও গভীরে বৃত্তের প্রসারে ক্রমাগত সংকোচন ঘটাতে থাকলে বিন্দু স্থির হয় এই নগরীতে। চৌপেয়ে প্রাণী যাবতীয় কবিতার খাতা গিলে ফেলে প্রতি গ্রাসে। গায়ে মেখে নেয় সৃষ্টিকালীন সুর- যা কিছু গান হতে পারত, রমণেচ্ছু আর্তি হতে পারত, হতে পারত প্রাণের প্রবল ঘোষণা, মৃত্যুর তীক্ষ্ণ হাহাকার।

প্রতিটা মৃত্যু এসব সময়ে বড় প্রিয় হয়ে ওঠে। সৃষ্টির তাগিদ ফুরোলে, রাগমোচন হলে, এমন কী সংশয়ী মানুষ যখন আচমকা জীবনের লক্ষ্য খুঁজে পায়, আজীবনের দ্বন্দ্ব যখন ফুরিয়ে যায় - শ্রান্তি নামে। সর্বগ্রাসী অপূর্ণতা, যন্ত্রণা যখন তাড়নাকে ছাপিয়ে নির্লিপ্তি এনে দেয়, সে মুহূর্তে দাঁড়িয়ে থাকে অন্তহীন শূন্যতা। সে মাটির রস নিতে অক্ষম গাছ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে নিধনের অপেক্ষায়।

এইসব গল্পে পালঙ্কের কারুকাজের সায় থাকেনা কোনওদিন, তার সূক্ষ্মতার পাঁজর চিরে অনাগ্রহের রঙচটা ছাপ ধরে ধীরে। প্রতিটা ঘরের পিছুটান বড় আনুষ্ঠানিক এমন বন্ধ্যা দিনে। মিশকালো পালঙ্ক আর চৌকির সিঁড়ি আর ভরা গ্লাস আর নীচের অন্ধকার আর তুলে রাখা মশারির চূড়ো আর ঘিয়েটে মলিন ভাঁজ পড়া চাদর বহুভাগ হয়ে ভাঙতে থাকে নিয়নের গলি আর ঘষটানো পিচ,খোয়া ধুলো ফেলে আরও। নতুন বৃত্তের দিকে।


1 comment:

  1. শক্তিশালী, অতি শক্তিশালী গদ্য।

    ReplyDelete