2

স্মৃতির সরণী - সব্যসাচী ভট্টাচার্য

Posted in


স্মৃতির সরণী


সুর যায় - সুর ভাসে
সব্যসাচী ভট্টাচার্য

তখন শুদ্ধবসন্তহীন পরাহ্ন রোদ্দুর। হলুদ গোলাপ ছুঁয়ে কখনও ভাটিয়ার, কখনও হেমন্ত, মেঘ বা উদাসী মাণ্ড্। কয়কদিন আগে জানুয়ারীর ২৭ তারিখে অনন্ত সম্মেলনে বাজাতে চলে গিয়েছেন নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়। সাল ১৯৮৬। তার ছিঁড়ে গেছে মাঝপথে। 

আমরা, তাঁর অনুরাগীর দল, জমা হয়েছি তাঁর দেহ ঘিরে মহাশ্মশানে; স্বতঃস্ফূর্ততায়। ওই অঞ্চলের বহু প্রাচীন বাড়ীগুলির একটির বাসিন্দা এবং নিখিলবাবুর ঘনিষ্ঠ আমার সঙ্গীতগুরু শ্রী সুশীল সরকার মহাশয় ব্যক্তিগত শোক চেপে রেখে আশ্চর্য দক্ষতায় শেষকৃত্যের আয়োজনে ব্যস্ত। আমার কোলে নিখিলবাবুর ছোট মেয়ে দত্তা। বিকচমান প্রতিভা, পরবর্তীকালের বিশিষ্ট তবলাবাদক শুভেন চট্টোপাধ্যায় এবং আরও অনেকের নিখিলবাবুর বাজনা নিয়ে আলোচনা, স্মৃতিচারণা শুনছি। 

এমন সময়, আমার মাস্টারমশাই আমায় একান্তে ডেকে নিয়ে আলাপ করিয়ে দিলেন একজনের সঙ্গে। জনান্তিকে বললেন, "তুমি একটু ওঁকে সামলাও।" দেখলাম বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়ক চিন্ময় চট্টোপাধ্যায় যথেষ্টই স্খলিতপদ। শোক এবং অন্যকারণে। দাঁড়িয়ে থাকতে তাঁর কষ্ট হচ্ছিল। এখানে একটা কথা বলি। তখন কেওড়াতলা শ্মশানে পুরনো জঙ্গলাবৃত বিষ্ণুমন্দিরে (বর্তমানে নবকলেবরে মাইশোর গার্ডেন্) মাস্টারমশাই আমাদের কয়েকজনকে তালিম দিতেন গভীর রাত পর্যন্ত। আমার মতো ক্ষীণতনুর পক্ষে চিন্ময়বাবুর মতো দীর্ঘদেহী ও স্খলিতচরণ একজনকে সামলানো প্রায় অসম্ভব মনে হওয়ায় আমি ওঁকে নিয়ে সেই মন্দিরে গেলাম। মন্দিরের মধ্যে সেতার, তানপুরা, তবলা দেখে জিজ্ঞাসা করলেন,

---"তোরা এখানে রেয়াজ করিস?" বললাম, "হ্যাঁ, অনেক রাত পর্যন্ত।" একটুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, "জানিস, আমি আর নিখিল ছোটবেলায় একসঙ্গে পড়তাম। গানবাজনা করতাম।" বলেই হাউ হাউ ক'রে কাঁদতে লাগলেন। 

বলার মতো কিছুই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। একটু পরে বলতে শুরু করলেন, 

"ও সেতার শিখত, আর আমি গান শিখতাম ভীষ্মদেব চট্যোপাধ্যায়ের কাছে। ও যা শিখত আমাকে শোনাত, আমি যা শিখতাম ওকে শোনাতাম। পরের দিকে ও যখন পরিপূর্ণভাবে আসরে বাজাতে শুরু করল, কলকাতার কোনও আসরই আমি মিস্ করতাম না। বড় ভালো সুরের বন্ধু ছিল ও আমার। ... ও এখন পুড়ছে... ওইখানে...।" আবার বাঁধভাঙা কান্না। 

এরপর যেটা ঘটল, সেটা আমার মতো একজনের কাছে একজীবনের অভিজ্ঞতা। 

তানপুরা টেনে নিয়ে, সুর মিলিয়ে ভয়রোঁ আলাপ। দশ পনেরো মিনিট ধরে, খোলা আওয়াজে। এ এক অন্য, অনন্য চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়! এঁকে সাধারণ মানুষ চেনে না। শেষের দিকে কান্নায় গলা বুজে আসছিল...।

আমার মুখে কথা ছিল না কোনও। ইতোমধ্যে, একজন এসে বললেন, "চিন্ময়দা', গাড়ীর মধ্যে সব রেডি হয়ে গিয়েছে, চলুন।" উনি বললেন, "তুই যা, আমি আসছি একটু পরে...।" অর্থাৎ, আবার জলে ভাসা, ওই দুপুরে। আমাকে বললেন, "ওঠ্ আমাকে ধ'রে নিয়ে চল্।"

হঠাৎ, আমাকে জড়িয়ে ধ'রে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন বার বার ----

"হ্যাঁ রে, আমি চলে গেলে এই রকম চারদিকে সাজিয়ে আমার গাওয়া গান বাজাবি তো? বল্? ভুলিস না কিন্তু।" 

বললাম, "এসব কেন বলছেন?"

---"খুব লোভ হচ্ছে রে।... ভুলিস না বাবা।"

ওদিকে তখন সব শেষের পথে। চিন্ময়বাবুকে পৌঁছে দিলাম গাড়ী পর্যন্ত। ঘোরের মধ্যে তখন উনি --- সুর, সুরা আর সুরস্মৃতি...।

পরে ওঁর মৃত্যুসংবাদ পেয়েও যেতে পারিনি অফিসের কারণে। শুনেছিলাম, শেষ হয়েছে চলে যাওয়া "তেমন অসাধারণভাবে নয়।"

মনে মনে দেওয়া প্রতিশ্রুতি­­­­ রাখতে পারিনি।

2 comments:

  1. আরো চাই এমন স্মৃতিকথন।

    ReplyDelete
  2. সব্যসাচী আমার বন্ধু। ও এরকম লেখা আরও লিখতে পারে। লিখলে পড়তে পারব, ভালো লাগবে।

    ReplyDelete