ছোটগল্প - রুখসানা কাজল
Posted in ছোটগল্প
ছোটগল্প
কাঁটাতার
রুখসানা কাজল
আমি আমার বড় বোনের শ্বশুরবাড়ির বারান্দায় কালো সিমেন্টের বেঞ্চে বসে আছি। বড় উঠোনের চারপাশে অনেকগুলো বাড়ি। মূল বাড়িতে জিজুর মা ছোট ছেলে আর তার বউকে নিয়ে থাকে। বড় ছেলেরও আলাদা বাড়ি। একটেরে একটি ছোট্ট সুন্দর দোতলা বাড়িতে জিজু একাই থাকে। পুরো বাড়িটার একটাই গেট, ঠিক যেমন বাংলাদেশে ছিল তেমন করেই এখানেও সবকিছু সাজিয়ে নিয়েছে ওরা।
মাঝে মাঝে আমার আপুলি অফিসের ছুটি ছাটায় ছেলেমেয়েদের নিয়ে এসে ঘুরে যায়। মাঝে মাঝে জিজুও চলে আসে বাংলাদেশে। আমাদের ছোট শহরে জিজুকে দেখে তেমন আলোড়ন সৃষ্টি হয় না। কারণ উনি এই শহরেরই ছেলে। কিছু কূট স্বভাবের মানুষ বাদে সকলের মনে খুব সম্প্রীতি এই শহরে। তবে মজা হয় যখন আমার বোন চলে আসে শ্বশুরবাড়িতে। পশ্চিম বাংলার এই জেলা শহরে আমার আপুলিকে দেখতে প্রায় প্রতিদিন ছেলেবুড়ো সধবা বিধবা মানুষ আসতেই থাকে। তারা জিজুর মায়ের ঘরের দিকে একবারের জন্যেও উঁকি দেয় না। সবাই জড়ো হয় জিজুর উঠোনে। আপুলিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। কেউ কোনও খুঁত পেলেই নরম হয়ে বুঝিয়ে দেয়, ও বউমা, সলতে পেচাবা এই ভাবে! কেউ কেউ আবার হেসে পরের দিন কতগুলো নতুন পাকানো সলতে দিয়ে যায়।
যে ক'দিন আপু থাকে একবারের জন্যেও ওর শাশুড়ি জানালা খোলেন না, উঠোনে বসেন না। ভোর ভোর স্নান করে ঠাকুর ঘরে গিয়ে বসে থাকেন। ঠাকুরই সব। খাওয়া বলো ঘুমানো, পান ছেঁচা সব ওই ঘরে। জিজুর ফুটফুটে দুটো ছেলেমেয়েকে একবারের জন্যেও কাছে ডাকেন না, ছুঁয়েও দেখেন না। অলিখিত নিষেধ আছে ছেলেমেয়েরা তা জানে বলে ওরাও ওদিকে খুব একটা যায় না। তবে মাঝে মাঝে কি যেন দেখার জন্যে ঘুরতে আসে। আর তখন ঝনঝন করে শিকল তুলে দেয় জিজুর মার কাজের লোক।
ছেলেমেয়ে দুটোও খুব চালাক চতুর হয়েছে। বনগাঁয় ঢুকলেই পানিকে জল বলতে শুরু করে। সালামের বদলে নমস্কার। আপুলিও টুক করে শাঁখা পরে নেয়, টিপ তো আগেই পরে থাকে। ফেস্টিবল ছাড়া সিঁদুর এখন হিন্দু মহিলারাও পরে না। আপুও তাই ফলো করে। বাপি পরিস্কার বলে দিয়েছে, যাকে স্বামী বলে মেনে নিয়েছ তার সবটা মেনে নিয়েই তো গ্রহণ করেছ। সুতরাং তোমার ইচ্ছা হলে শাখা সিঁদুর পূজা পার্বণ করতে পার। আমার কাছে ধর্ম স্রেফ একটি পোশাক ছাড়া আর কিছু নয়। তাই জিজুও এসে মসজিদে নামাজ পড়ে। নামাজীদের সাথে হাত মেলায়, বুকে বুক মিলিয়ে সবার খোঁজ খবর নেয়। রোজার সময় পাজামা পাঞ্জাবী টুপি পরে ইফতারের দাওয়াতে যায়। নিজেও দাওয়াত দিয়ে ইফতারি খাওয়ায় আত্মীয় বন্ধুদের।
জিজুর বাড়ির সিমেন্টের বেঞ্চে আমার সাথে বসে আছে অনেকেই। এবার সবাই এসেছে আমাকে দেখতে। বড় বোনের হিন্দু স্বামীর বাসায় বেড়াতে আসা শ্যালিকা খুব আশ্চর্যের বলে মনে করেছে এখানকার অনেকেই। খুব সাধারণ মহিলারা বাচ্চা কোলে বা হাতে ধরে এসে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিজেদের ভেতর কথা বলে, আমাদের বউমাই সুন্দরী। রঙ কি দেখেছো তো মাসি। মুসলমানের ঘরে বেমানান বলেই না হিন্দুর ঘরে বে হয়েছে। আর এই মেয়ে তো কালো কুচ্ছিত!
শুনে আমরা হাসি। হাসির ভেতরেও দেখি আপুলির মুখ কালো হয়ে গেছে। স্বভাবসুলভ মাস্টারনি গলায় বলে উঠে, ও কালো বটে। কিন্তু কি সুন্দর মুখশ্রী দেখেছেন মাইমা। মাইমা মানে আপুলির মামি শাশুড়ি খুব প্রীতির চোখে না দেখে বলে বসেন, ফর্সা মেয়ের দামই আলাদা। এই দেখো তুমি মুসলমান কিন্তু কেমন দুগগা ঠাকুরনির মতো দেখতে। কত মানুষ তোমাকে দেখতে আসছে ভাবো একবার! আপুলি এবার ওর মেয়েকে বকা দেয়, কি বসে আছিস বুড়িদের মতো। যা তোরা ঘুরে আয় বাইরে থেকে। আমি আর আপুলির মেয়ে বাইরে এসে হাসিতে ভেঙ্গে পড়ি। এই আমার আপুলি। ছোটকালে আমার গালে পিঠে মাথায় টাস টাস করে মার দিয়ে বলতো, তুই জন্মালি কেন রে কাল্লু। কি আরামে ছিলাম এত বছর বাড়ির ছোটমেয়ে হয়ে!
জিজুর মুখে হাসি নেই। স্থানীয় কলেজের অনেক ছেলে ছোকরা, জিজুর দু’একজন বন্ধু জিজুকে অলরেডি বলে গেছে, শ্যালিকা আর ফেরত যাচ্ছে না বাংলাদেশে। রীতিমত শাঁখ বাজিয়ে সাতপাক ঘুরে বিয়ে করে রাখব এই বলে দিচ্ছি কিন্তু। জিজু হাসে, আরে যা যা আমার শালির নখের যোগ্য নাকি তুই। যা ভাগ! ঠাট্টাছলে বললেও জিজুর কপালে ভাঁজ পড়ে। বাম ঘরানা সবে ভেঙ্গে পড়ছে। তখনও ভাঙ্গার শব্দ চারদেয়ালের ভেতরে হলেও তার কিছু আঁচ পাওয়া যাচ্ছিল এখানে সেখানে। তাছাড়া ওই জেলা শহর সীমান্তের খুব কাছে হওয়ায় উগ্রপন্থীদের যাতায়াত দু’দেশেই সমানভাবে সরব ছিল। এক বিকেলে দোতলা থেকে নামতে নামতে শুনি জিজু রাগী গলায় বলছে, ওকে আনতে গেলি কেন? আপুলিও সমান গলায় রাগ দেখায়, আনবো না কেন? কেমন আছি দেখে যাক। আমি বেড়াল পায়ে উঠে যাই উপরে। রাতে ক্ষুধা নাই বলে খেতে নামিনি। বিকেলে দোতলার বারান্দা থেকে স্পষ্ট দেখেছি জিজুর মুখ কালো। আপুলিও স্বভাব হাসি ঠাট্টা করছে না অন্যদের সাথে। আমি বুঝে যাই আমার এখানে আসা একেবারে ঠিক হয়নি।
খুব সকালে দরজা ঠক ঠক করে আপুলি বলে, এই খোল। কথা আছে। আমি ঢুলতে ঢুলতে ভাবি দুচ্ছাই কি আবার। ওদের তো দক্ষিণেশ্বর যাওয়ার কথা। আপুলির শাশুড়ি গোপনে কড়া করে কড়কে দিয়েছে বড় বউমাকে, মেজ বউমা যেন সব আচার ঠিক মতো করে। কেউ যেন না বোঝে মুসলমান! বড় বউমা আবার আপুলিকে শর্ট পাসে বলে দিয়েছে সে কথা। খুব কেয়ারফুলি গুছিয়ে নিচ্ছে সবকিছু। আপুলির ট্রায়ালে জিজু ক্ষেপে আগুন, পূজো আবার কিরে। যতসব রংবাজি। যাচ্ছি বেড়াতে। ঘুরে ফিরে দেখে চলে আসবো। আপুলি খুব নেকু নেকু হয়ে যায়, কি যে বলিস। ভগবান দুঃখ পাবে রে!
দরজা খুলে দেখি ভোরের মতো দাঁড়িয়ে আছে আপুলি। সিঁথিতে চওড়া সিঁদুর, মঙ্গলসূত্র আর শাখা পলার পাশে গোলাপবালায় অপূর্ব লাগছে। যাওয়ার আগে সাবধান করে যায়, শোন তোরা ঘরেই থাকবি। অচেনা কেউ এলে পাশের বাসার মাসির কাছে চলে যাবি। মোবাইল চার্জ রাখবি সব সময় মনে রাখিস কিন্তু। আমি হুঁ হা করে ভাল করে দরজা লাগিয়ে শুয়ে পড়ি। ঘুমের ভেতরেও প্রচণ্ড হাসি পায়। বেচারা আপুলি! সারা জীবন নিয়ম ভাঙ্গার খেলা খেলে এখন নিজের বোনকে নিয়ে ভয় খাচ্ছে। ওদিকে আমরা প্ল্যান করেছিলাম ওরা চলে গেলেই বারাসাত মধ্যমগ্রাম চই চই করে ঘুরে আসব। তাছাড়া শুনেছি বাংলাদেশ থেকে আসা মানুষরা তাদের ছেড়ে আসা গ্রামের নামে এখানে গ্রামের নামকরণ করেছে গোপালগঞ্জ, সোনাকুঁড়, বেতগ্রাম, হরিদাসপুর -সেগুলোও সত্যি সত্যি খুঁজে দেখব।
বরাবরের বুনো আমি। মানুষের গল্প শুনতে আমার ভীষণ ভাল লাগে। আস্তো মানুষ, ভাঙ্গা মানুষ, গরীব মানুষ, ভিখিরী মানুষ, চোর ছ্যাচ্চড়, ধনী মানুষ সবার কিছু না কিছু গল্প থাকে। সেই গল্পগুলো কুড়িয়ে আমি মনে রাখি। তাছাড়া বাপির নাম জানলে এখনও অনেকেই সজল চোখে ছুটে আসে। পুরনো মানুষরা গায়ে মাথায় হাত দিয়ে বলে, কি মানুষের মেয়ে তুমি মা! আর আমি টুক টুক করে সালাম করি দু ফিতার পা, ছেঁড়াফাটা সেলাই ফিতের পা, খালি পা, টাকা পা আলতা পা, গোবর পা, বাহারী পা, ক্ষমতা পা, ধূলামাটি পা। আমার বাপির ধনসম্পদ ছিলনা, কিন্তু এঁরা জানতেন মানুষটা ভালবাসতে জানে! সব প্ল্যান ভণ্ডুল হয়ে গেলো। ঘুম ঘুম চোখে দেখেছি কড়া কাজলের পাশে আপুলির চোখদুটো চিকচিক করছিল। ইস আমার জন্যে এবার ওর শ্বশুরবাড়ি বেড়ানোটা যাচ্ছেতাই হলো।
আমি মনে মনে ভেবে রাখি জিজুকে ধরব। ওরা যখন বিয়ে করে আমি তখন নিতান্তই বালিকা। বাপি মাকে দেখেছি জিজুকে প্রচণ্ড আদর করতে। জিজুও কতবার বলেছে ওঁদের বাসায় আসতে। এখন এরকম সংকুচিত বিরক্ত হয়ে আছে কেন? হিন্দু মুসলিম বিয়ে করে যারা সংসার করে তাদের আমার কেমন বীর বীর লড়াকু আর সত্যবাদী সাহসী লাগত। এখন দেখি ধারণাটা পালটে যাচ্ছে। আমাকে দেখে জিজু মুখের উপর পাতলা মেঘের পর্দা ঝুলিয়েছে। তবে কি সব কথার কথা! ভীষণ বিরক্ত লাগছে। আমি হাত পা ছড়িয়ে কখনও রাগ দেখাই না। কিন্তু মনে মনে রাগ হলে নিজেও বুঝতে পারিনা কি করছি তখন। হয়ত ব্যাগ গুছিয়ে চলে যেতেও পারি। ভার্সিটির রোকেয়া হলে সন্ধ্যার অন্ধকারে একজনকে দেখে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলাম বলে পয়লা বৈশাখে তার নাম দিয়েছিলাম দস্যুরানী। ভিসি স্যার পর্যন্ত মৃদু নালিশ পৌঁছেছিল। স্যার নালিশকারিনীকে দেখে হাসি চেপে আমাকে বলেছিলেন সাবধান মেয়ে, ওরা জাগছে। কন্ট্রোল ইয়োরসেলফ। আমি কুল বেবি কুল করে নিজেকে সামলে রাখি।
দোতলায় অন্তাক্ষরি খেলছি। আপুর মেয়ে এসে আস্তে আস্তে বলে, ব্যাগ গোছাও। কালকে আমরা চলে যাব। সবাই হাহা করে উঠে। কেন কেন। ইসস কাল না সবার নদী দেখার কথা। মন খারাপ করে চলে যায় ওরা। এই দুদিনে বেশ বন্ধু হয়ে গেছিল ওরা। নীচে নেমে দেখি থম থম করছে সবাই। আপুর ছেলের এক গাল লাল হয়ে আছে। বড় বউদি উঠোনে দাঁড়িয়েই আপুকে বুঝাচ্ছে রাগ করো না। জানোই তো ছুৎ মার্গ আছে ওনার। আপু কিছু বলছে না। জিজু রাগে লাফাচ্ছে। জিজুস ব্র্যান্ড। ছেলেটাকে নিয়ে উপরে আসি। কিছু না বুঝেই খেলতে খেলতে ও ছুঁয়ে দিয়েছে জিজুর মাকে যিনি কিনা ওর আপন ঠাকুমা। একটা চীৎকার দিয়ে ছেলেটাকে ঠেলে দিয়ে ওই সময়েই উনি স্নান করেছেন। ফলে যে অ্যাজমা দমিত ছিল সেটা বেড়ে সাংঘাতিক আকার নিয়েছে। তার মধ্যেও বড় ছেলেকে ডেকে বলে দিয়েছেন, টাকা না থাকলে এই নাও গয়না। এটা বেচে কালকেই দেয়াল তুলে দিবা, অজাত কুজাতের ছেলেমেয়েরা যেন না আসতে পারে এ বাড়িতে।
বেনাপোলের ওপারে ভাঙ্গা মানুষের মতো দাঁড়িয়ে আছে জিজু। ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে ছিল অনেকক্ষণ। যে গালে কাল সন্ধ্যায় চড় মেরেছিল তাতে আদর করেছে বহুবার। ছেলের হাত উপচে পড়ছে যা চাই তাই-তে। আপুলির মুখে হাসি নেই। ওদের প্রেম এত গভীর যে বহুবার বহু চেষ্টা করা হয়েছে ভেঙ্গে দেওয়ার কেউ পারেনি। কোথাও কি ভাঙ্গন খেলে গেল! ছেলেটাকে অনেক করে শিখিয়ে রেখেছি আমরা যেন ওর নানুকে একথা না বলে। এক সময় বান্ধবী ছিল দুজন। লাউ চিংড়ির তরকারি রান্না থেকে শাড়ি চুড়ির গয়নার গল্পে মুখর থাকত একেকটা বিকেল। আপুলি জিজুও ছেলেবেলার বন্ধু। নিজেদের ভেতর এখনও তুই করে কথা বলে। জিজুর ফাটকা রাগ। রেগেমেগে চেঁচামেচি করে আর আসবো না বলে বেরিয়ে গিয়ে ঘন্টা কয়েক পরে ঠিক ফিরে আসে। আপুলি ফুট কাটলে, জিজু আরামসে সোফায় বসে জম্পেশ এক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে পা নাচায়, তোর কিরে লালপরি। আমি আমার বউয়ের কাছে ফিরে এসেছি, একশ বার আসবো। এনি প্রবলেম! প্রবলেম? আপুলি অসীম যত্নে চা বানাতে বসে যায়।
বাস চলছে তীব্র গতিতে। যাত্রীরা জানালা খুলে রাখার পক্ষে। সাঁই সাঁই করে পেরিয়ে যাচ্ছে ঘরবাড়ি, গাছপালা, পুকুর, জাংলায় ঝুলানো লাউ কুমড়ো, গাঁদাফুলের বাগান, মাধুরিলতার গেট, নতুন বানানো বিল্ডিং, পথ চলতি মানুষ। পেছনের দিকের সিটের কেউ একজন পুরুষ হুহু করে কেঁদে উঠল। একজন মধ্যবয়সী মহিলাও ছলছলে চোখ মুছতে মুছতে বলল, নিজের দেশ, নিজের জন্মভুমিতে পাসপোর্ট ভিসা নিয়ে আসতে হলো। এত পর হয়ে গেছি আমরা। বাসের পেছনটা এখন ভালবাসার উঠোন। আপুলি টলটলে চোখে খুব নিঃশব্দে বলে, এরকম বিয়ে করতে নেই রে!
আমি থমকে যাই। আপুলির চোখে ডানা ভাঙ্গা প্রজাপতিদের শেষ উড়ান চেষ্টা। পরাজয়ের পতাকা কি নেমে আসছে বাঁধনের গিঁট খুলে!
0 comments: