4

বইঘর - কস্তুরী সেন

Posted in


বইঘর


জয় গোস্বামী : নিজস্ব পাঠ
কস্তুরী সেন



--গদ্য? অসম্ভব!
--কারণ? জানা যায়?
--কারণ আমি কবিতার। কারণ আমি আদতে ধৈর্যহীন। কারণ গদ্যরচনায় মনঃসংযোগের একটা বড় ভূমিকা থাকে।
--মন ও সংযোগ, বেশ,(সামান্য বিশদ হন প্রতিপক্ষ এইবার)...এ দুটোকে যদি মেলানো যায়?
--অর্থাৎ?
--অর্থাৎ জয় গোস্বামী। ব্যক্তিগত জয়?

কাট টু উনিশশো সাতানব্বই, বা আটানব্বই। অর্থাৎ ফ্ল্যাশব্যাক দৃশ্য। নবম নয়, তবে অষ্টম শ্রেণি, কিংবা সপ্তম, এবং একটি পাড়ার পুজোর নাটকের রিহার্সাল রুম, ভিতরে কেউ জোরে জোরে পড়ে যাচ্ছে কবিতা। সামান্য কটি লাইন।

'পাগলী, তোমার সঙ্গে বই দেখব প্যারামাউন্ট হলে
মাঝে মাঝে মুখ বদলে য়্যাকাডেমি, রবীন্দ্রসদন
পাগলী, তোমার সঙ্গে নাইট্যশালা জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে কলাকেন্দ্র কাটাব জীবন!'

অর্থাৎ? নাইট্যশালা জীবন? কীভাবে? কীভাবে! এবং সেই অষ্টম শ্রেণি মন্ত্রমুগ্ধের মতো পা মুড়ে বসে পড়ছে ঘরে ঢুকে, মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসে পড়ছে লাইনগুলির সামনে, মন্ত্রমুগ্ধের মতো, নতজানু, বলা চলে এইবার তার পাঠকজন্মের নিয়ন্তার মুখোমুখি হচ্ছে সে, আগামীর সমস্ত দিনগুলি, প্রায় তার অদ্যাবধি জীবন, সে উৎসর্গ করছে, প্রায় বলিপ্রদত্ত হতেই, এক কবির হাতে। জয় গোস্বামীর হাতে।

জয় গোস্বামীর সঙ্গে, সেই আমার প্রথম সাক্ষাৎ। এবং সেই সময়ে, তার পূর্ববর্তী, পরবর্তী বহু মানুষের মতোই, আমরা অনেকেই, সাক্ষাৎমাত্রেই জয়কে চিনতে পেরেছিলাম। আমাদের সৌভাগ্য। জয়, অন্তত তাঁর স্বভাবসিদ্ধ মৃদুতার সঙ্গে হলেও, আলাপ, জোড়, ঝালা, সবটা সমেত তাঁর নিজস্ব পাঠকবৃত্তের সামনে, মুহূর্তেই উদ্ভাসিত হন। বিষয়টা অনেকটা এই যে, জয়ের সঙ্গে প্রতিটি প্রেমই, পাঠকের, ঘটে প্রথম সাক্ষাৎমাত্র। জয় গোস্বামী, যদি সত্যিই তাঁকে আমার ব্যক্তি অভিজ্ঞতায় ধরি, তবে তিনি সময় দেওয়ার লোক নন। তাঁর চর্চা সম্ভব না। তাঁর চর্বিতচর্বণ সম্ভব না, তাঁর কবিতাগুলির সমালোচনা প'ড়ে, তাঁকে দিনানুদৈনিক অভ্যাস করে, ধীরে ধীরে, ধীরে ধীরে তাঁর প্রতি আগ্রহ জন্মে ওঠার মতো কবি তিনি নন। না জয় সঞ্জয় ভট্টাচার্য নন, জয় বিনয় মজুমদার নন, বিষ্ণু দে? প্রশ্নই নেই, সমর সেন, সুধীন্দ্রনাথ, এই অংশটাতেই তাঁকে ধরা সম্ভব না। সম্ভব না প্রতিভা বা ক্ষমতার অর্থে আদৌ নয়, তুলনা সম্ভব নয় তার আদত কারণ ওই একই, জয় সময় দেন না। জয়ের কবিতার মধ্যে একটা সর্বগ্রাসী বিষয় থাকে, থেকেছে বরাবর, পাঠক মুহূর্তমাত্রে সর্বস্ব সমর্পণ করেন, এবং যাঁর হলো না তাঁর হলো না, জয় গোস্বামী সে পাঠকের নন।

তবে জয় কোন্ পাঠকের? বেশ, এটা ভালো প্রশ্ন। জয় গোস্বামী লিখছেন সত্তরের দশক থেকে। প্রথম কবিতার বই, 'ক্রিসমাস ও শীতের সনেটগুচ্ছ'-র প্রকাশকাল ১৯৭৬। কবিতাসংখ্যা আট। দ্বিতীয় 'প্রত্নজীব'(১৯৭৮), তৃতীয় 'আলেয়া হ্রদ'(১৯৮১) পার হয়ে 'উন্মাদের পাঠক্রম'-এ(১৯৮৬) এসে আস্তে আস্তে জয় যখন নিজের 'ফোর্টে' তৈরি করছেন, তখন, সেই আটের দশক, নয়ের দশক জুড়ে আমরা জানিই, সত্তরের উত্তাল রাজনীতির পর, খানিক মোক্ষণের সময় এসেছে। খানিক স্থিরতা, খানিক নিস্তরঙ্গতা, সামান্য দম নেবার সময়, একে অন্যের মুখের দিকে তাকানোরও কি নয়? কাছাকাছি সময়ে, এতদিনকার জমে থাকা গুমোট মুহূর্তে তছনছ করে দিতে, প্রায় বলতে গেলে হাত ধরে বাংলা সংস্কৃতিকে একটা অন্য পর্বের মুখোমুখি করে দিতে, তীরের বেগে দিগন্তের দখল নিচ্ছেন গিটার কাঁধে অপর একজন, কলকাতা কাঁপছে, জেলা-মফস্বল কাঁপছে তাঁর 'তোমাকে চাই'-এর, 'প্রিয়তমা, তোমাকে অভিবাদন'-এর অভিঘাতে। বাংলা কবিতা, বাংলা গান তার দিক বদলাচ্ছে। জয় এই দিক বদলেরই কবি। জয়, তাঁর রানাঘাটবাসের প্রেক্ষাপট সমেত, তাঁর সামান্য অগেরস্ত, সুরপাগল 'মধুবাবু' পিতার প্রভাবে (যাঁকে আমরা পরবর্তীতে অজস্রবার পড়ব, কবির স্কুলশিক্ষয়িত্রী মা'কে ও, রানাঘাট লোকাল কি গোঁসাইবাগানে) নিজস্ব একটি গানের, গান শোনার প্রেক্ষাপট সমেত, একটি আক্ষরিক অর্থে সমকালীন মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনের প্রেক্ষাপট সমেত, তাঁর সমস্ত অসাধারণ সাধারণত্ব সমেত এসে দাঁড়াচ্ছেন এই সময়টি সামনে, বলছেন--

'তোমাকে নিশ্চয়ই আমি পুত্ররূপে চাইতাম ঠাকুর,
কিন্তু তুমি এই জন্মে কোথাকার কোন এক মেয়ে হয়ে এসে
যেভাবে আমার মন কেড়েছো, তুলনা হয় না তার।
আজ পুনঃ পুনঃ মরি ওই হাতে, পরিচর্যা করো মৃত্যুখানি....' (মহৎ)

পাঠকের কাছে বিকল্প কী? চন্দ্রাহত হওয়া ছাড়া? জয় এই চন্দ্রাহত পাঠকের কবি। যাঁরা জয় গোস্বামীকে আদ্যন্ত রোমান্স ছাড়া আর কোনওকিছু বলে মানতে চাইবেন না, যাঁরা তাঁকে, সমসময় থেকে বিযুক্ত বলে অভিযুক্ত করবেন প্রায়শই, না 'শাসকের প্রতি', 'নন্দর মা', 'সোজা কথা' তাঁদের উত্তর নয়। বরং যদি শিরোনামে ফিরে গিয়ে ব্যক্তি অভিজ্ঞতাই বলতে হয় আবারও, আমি বহুদূর একমত হব এই দ্বিতীয় অংশের পাঠকের সঙ্গেই, যাঁরা রোমান্স বলছেন। জয় রোমান্সধর্মিতার প্রধান শর্ত, অর্থাৎ মর্মবিদারণ, মর্মে মর্মে মেনে চলেছেন তাঁর প্রতিটি আঙ্গিকের, প্রতিটি বিষয়ের কবিতায়। এসব পঙক্তিই দেখা যাচ্ছে তার সার্থক উদাহরণ--

'খানিকটা নাম বেড়ায় আটকে গেল
খানিকটা গোঁজা রইল খড়ের বাতায়
খানিকটা নাম কাঁটাতারে তারে বেঁধা,
খানিকটা যায় ইমিগ্রেশন খাতায়।
একটা বয়েস সে দেশে ছেড়ে এলাম,
একটা বয়েস নিয়ে ছেড়ে দিল স্বামী
একটা বয়েস ছেলে বড় করে শেষ
ছেলের নামেই আজ চেনা দি এই আমি-
......................................................
ছেলেকে ভাবিনা,
ভাবিনা স্বামীর-ও নাম
শুধু মনে পড়ে আমরা যাচ্ছিলাম 
সেই কোন দেশে পালিয়ে যাচ্ছিলাম!'
                                                    (নন্দর মা)

বিনাশর্তে। বিনাপ্রশ্নে। মর্মবিদারণ। নয় কেন রোমান্স। এবং কি সার্থক রোমান্স।

ব্যক্তিগত জয় গোস্বামী নতজানু করবেনই। এক্ষেত্রে বলা সামান্য ভুল হলো 'ব্যক্তিগত' শব্দটি। জয় আসলে একটা সময়কে নতজানু করেছেন, মোহিত করেছেন, অস্ত্রত্যাগ করতে বাধ্য করেছেন তাঁর কবিতাগুলির সামনে। বিশেষ শ্রেণি, মনন ও মেধার যে অনুশীলিত গণ্ডি, তা থেকে মুক্ত করে, সেভাবে দেখতে গেলে জয়ই প্রথম বাংলা আধুনিক কবিতাকে এনে দাঁড় করিয়েছেন সাধারণ মানুষের চৌহদ্দিতে। যে সাধারণ মানুষ ছেলে পড়ায়, নিজের না মেটা সাধের ভার তর্কাতীতভাবে চাপিয়ে দেয় সন্তানের মাথায়--

'তোমাকে পেতেই হবে শতকরা অন্তত নব্বই(বা নব্বইয়ের বেশি)
তোমাকে হতেই হবে একদম প্রথম,
তার বদলে মাত্র পঁচাশি!
পাঁচটা নম্বর কম কেন? কেন কম?
এইজন্য আমি রোজ মুখে রক্ত তুলে খেটে আসি?'
                                                                (টিউটোরিয়াল)

ঘরে ঘরে যে সাধারণ মেয়েটি ভুলতে পারে না নিজের বাধ্য হয়ে ছেড়ে আসা সংসার, বাধ্য হয়ে ছেড়ে আসা মানুষ--

'কে তাহলে ভাত বেড়ে দেয়?
কে ডেকে দেয় সকাল সকাল?
রাত্তিরে কে দরজা খোলে?
ঝক্কি পোহায় হাজাররকম?
কার বিছানায় ঘুমোয় তবে?
কার গায়ে হাত তোলে এখন
কার গায়ে হাত তোলে এখন?'
                                        (প্রাক্তন)

অথবা সত্যিই জনস্রোত স্তব্ধ করে দেওয়া তাঁর অবিনশ্বর, প্রেমের পঙক্তিগুলি--

'মা আমার এক দীঘি জল
সারা গ্রাম করে ছলোচ্ছল....
   "পোড়ামুখী, দু চক্ষের বিষ
    ফের তুই প্রেমে পড়েছিস"?'
                                 (মা আর মেয়েটি)

'ফার্স্ট পার্সন'-এ ঋতুপর্ণ লিখেছিলেন--'এ-ও জানিনা, আজ থেকে অনেক বছর পর, 'স্ত্রী'র পত্র'র মাখন বড়াল লেনের মতো, মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়ও বাংলা সাহিত্যে উইমেন স্টাডিজের একটি নতুন উৎসমুখ হয়ে উঠবে কি না!'---আমরা কি সামান্য বেশি জোর দিয়ে বলব, বিশেষ কোনও কবিতা নয়, 'বেণীমাধব বেণীমাধব'-এর কবি স্বয়ংই বাংলা কবিতার একটি নতুন স্রোতপথের উদ্ভাবকের আসনটি অধিকার করে নেবেন উত্তরযুগের কাছ থেকে?... উত্তর, জানেন প্রায় সকলেই। সর্বাধিক জানে, জয় গোস্বামীরই কবিতা---

'অনেক পরিবারের মধ্যে মিলিয়ে গেছে আমার পরিবার
পাঠক, আমি তোমার পায়ের কাছে বসে পড়লাম।
আমার কিছু বলবার নেই আর.....'
                  (অনেক : আমরা সেই চারজন)
                   দেশ পত্রিকা, নভেম্বর,২০১৬।

4 comments: