ধারাবাহিক - সুবল দত্ত
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
প্রতিস্রোত
সুবল দত্ত
॥৭॥
‘ওরা এল দেখল তুলে নিয়ে গেল গলিত কুষ্ঠের আঁধার কোল থেকে এক আনন্দময় উজ্জ্বল অমৃত’
পেরো
দুপুর থাকতে থাকতেই পাহাড়ের রাক্ষুসে ছায়া গিলে ফেলে বস্তি। সূর্য উত্তরায়ণে থাকুক বা দক্ষিনায়ণে, দুপুর থেকেই অন্ধকার বস্তি পরিসর সুনসান। ঠাণ্ডায় কুঁকড়ে থাকে মানুষগুলো বেশিরভাগ সময়েই। সকালবেলায় এক আধজনকে দেখা যায় মাটির দেওয়ালে সেঁটে চিত্রার্পিত দাঁড়িয়ে থেকে সূর্যের সেঁক নিতে। আর প্রতি ঘরে এক দু’জন অসূর্যম্পশ্যা। সেই মানুষগুলোর সঙ্কোচ। বিকলাঙ্গ, অশুচি এবং ঘৃণা ও তাচ্ছিল্যের ভয়। কখনও বাইরে বেরোয়না। ঘরের ভিতরেই দিনদিন ক্ষয়ে যাচ্ছে দেহ।
সেনারা যখন মহড়ায় এসে তাঁবু ফেলে, তখন বস্তির খুব একটা কাছে ঘেঁষে থাকে না। এবারেও তাই। ভারতীয় সেনারা ওদের ছোঁয়াচ থেকে বেশ কিছুটা দূরে সবুজ ময়দানের দিকে শিবির করেছে আর রাশিয়ানদের দিয়েছে বস্তির কাছাকাছি। তবে বস্তি দরিদ্র জরাজীর্ণ হলেও নোংরা নয়, বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ঘরগুলো নিচু, লম্বা বুনোঘাস দিয়ে ছাওয়া চালা, দেওয়ালগুলো ও আঙিনা পরিষ্কার নিকানো। শহুরে বস্তির ঘরগুলোর মতো দুর্গন্ধময় নর্দমা ঘেরা নয়। প্রতি ঘরে চাঁচর দিয়ে ঘেরা পায়খানা ও স্নানঘর করে দিয়েছেন গোরাচাঁদ। যে কজন কুষ্ঠরোগী আছে, তাদের অঙ্গহীন বিকৃত চেহারার হলে কি হবে তাদের সংক্রামকহীন করে দিয়েছেন তিনি। একদুজন যক্ষারুগীও রয়েছে। তাদের একটা আলাদা থাকার ঘর করে দেওয়া হয়েছে। তারাও প্রায় আরোগ্যের মুখে। শিমুলিয়ার এই অদ্ভুদ পাহাড় দেখতে এক জিয়লোজিক্যাল সার্ভে টিম এসেছিল। ওরা এখানের জল পরীক্ষা করে গোরাচাঁদকে বলেছিল জলে আর্সেনিক পাওয়া গেছে। যার জন্যে এই দুর্গতি। সেই থেকে বস্তির লোকেরা খাবার জলের জন্যে প্রায় দু’ মাইল দূরে এক ঝর্ণার স্রোত থেকে জল ভরতে যায়। পেরো সেখানেই চালমগরা ও আকন্দ গাছের সন্ধান পেয়েছিল। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে আকন্দ ফুলের গাছ। মাঝে মাঝে ধুতুরা গাছ ভর্তি। বড়বড় ঘন্টার মতো সাদা ধুতুরা ফুল ফুটে থাকে। ওই সব ভেষজ ঔষধি পেরো তুলে আনে আর দেখায় গোরাচাঁদকে। গোরাচাঁদ ওকে চিনিয়ে দেয় কোনটা কি রোগের ওষুধ আর তার কিরকম ব্যাবহার।
মাঝে মাঝেই পেরোকে গোরাচাঁদ বলেন, জানিস তো প্রকৃতি যেমন মারণ রোগ দিয়েছে তেমনি তার পাশাপাশি উপাচারও দিয়েছে। একটা মজার ধাঁধার মতন। বুঝতে হবে, খুঁজতে হবে, খেলতে হবে। এইযে এখানে কুষ্ঠ রোগের মড়ক। ওরা ভালোভাবে খেতে থাকতে পায়না, তাই তো ওদের এই রোগ! কিন্তু তার একটু কাছেই দ্যাখ আকন্দ গাছের বন রয়েছে। আকন্দ দুধ দিয়েই এই রোগ নিরাময়ের একমাত্র অব্যর্থ ওষুধ তৈরি হয়। ড্যাপসোন। এ ছাড়া পৃথিবীতে মুখ্য আর অন্য ওষুধ নেই। আর কী আশ্চর্য প্রকৃতির খেলা! তার পাশেই চালমগরার গাছ! হরতুকির মতো ওর ফলগুলো থেকে তেল বার করে সেই তেলের প্রলেপ কুষ্ঠরোগীর ঘায়ে লাগলে সেই ঘা তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়! পাহাড়ের উপরে ওই অর্জুন গাছের রক্তের মতো রস টিবি আর লেপ্রসি দুই রোগেরই ওষুধ। আর ওই শিমুল গাছটার ছাল বেঁটে ওদের ঘায়ে লাগিয়েছিলাম, তাই দেখেছিস তো কত তাড়াতাড়ি ওরা ভালো হয়ে গেল! বড়ই আফসোস রে, পেরো, এইসব আগে জানতে পারিনি।
পেরো দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সত্যিই তো। যখন জানলাম তখন আমার এই মানুষজন আর এই জমিন ছেড়ে পালিয়ে পালিয়ে বেড়ানোর সময় হলো। রোজ রাত হতেই মনে হয় আগামীকাল বেঁচে থাকার জন্যে আর কোনও গোপন জায়গা এবার খুঁজতে হবে।
পেরো আর ওর সঙ্গী দুজনে মিলে পালাপালি করে জেরকাকে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যেখানে নামাল সেখানটায় ঘন অন্ধকার। খুব উঁচু উঁচু পাথর আর উইঢিবি। পেরো নাক ঘুরিয়ে শুঁকে আশ্বস্ত হলো এখানে সাপের ভয় নেই। একটা বড়ো উইঢিবির আড়ালে থেকে উঁকি মেরে গোরাচাঁদ বললেন, -না পেরো। আমার ওখানে যাওয়া আর হলো না। আমি জানতাম না ওরা বস্তির এত কাছ ঘেঁষে তাঁবু ফেলবে। এর আগে তো এরকমটা কখনও হয়নি। ওদের ছাউনি বস্তি থেকে দূরেই থাকতো। এখন তো আমার ঘর অব্দি জেরকাকে নিয়ে যাওয়া যাবেনা। তার আগেই টহলদার ধরে ফেলবে আমাদের। তারপর যা হবে, তা তো তুই জানিস? সমু তোকে ধরতে পারলে সিধা গুলি করবে। আর আমি তোকে কোনওমতেই হারাতে চাইনা পেরো। আচ্ছা, এদিকে আয় একবার। নিচে একবার উঁকি মেরে দ্যাখ, কেমন ফুটফুট করছে চাঁদের আলো। ঘরগুলো সব দৃশ্যমান। দিনে পাহাড়ের ছায়াতে অন্ধকার হয়ে থাকে কিন্তু এখন তো আলো। এই আলোতে আমাদের তো ওরা দেখে ফেলবে!
-লেকিন স্যারজী। ওই টিবি রোগীদের ঘরটা কাছেই আছে। একেবারে কিনারা ঘেঁষে। ওখানে তো আরামসে যেতে পারি। আমি জেরকাকে পিঠে নিয়ে উবু হয়ে একেবারে মাটি ঘেঁষে বয়ে নিয়ে যাব। কেউ দেখতেই পাবেনা। আপ ক্যা বোলতে হ্যাঁয়?
-হ্যাঁ। কথাটা মন্দ বলনি। আর এছাড়া কোনও উপায় নেই। অনেকদূরে ছাউনি থেকে একটু একটু আলো আসছে। ওদেরতো এটা মহড়া। তাই খুব একটা টাইট সিকিউরিটি হবেনা নিশ্চয়ই।
গোরাচাঁদ শুয়ে থাকা জেরকার হাত টেনে নিয়ে নাড়ি টিপে দেখতে দেখতে খুব জোরে জোরে মাথা নাড়তে লাগলেন। -পেরো! কুইক। তোর মধু সুরার অসর(প্রভাব) কেটে যাচ্ছে। নাড়ি খুব ক্ষীণ। এখানে বেশিক্ষণ রাখা যাবেনা। চল এগিয়ে যাই। যা হবার তা হবে।
খুব সাবধানে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে ওরা যক্ষারুগীর কুটিরের কাছে পৌঁছে গেল। দরজা বলে তো কিছু নেই। বাঁশের তৈরি একটা আড়ি ঝাঁপি দুয়ারে ঠেসানো আছে। গোরাচাঁদ সেটা টেনে সরালেন আর তক্ষুনি পাঁচসেলের দুটো টর্চ একসাথে ওদের মুখের উপর ঝলসে উঠল। হল্ট!
0 comments: