2

গল্প - রাজা সিংহ

Posted in


গল্প


যীশু
রাজা সিংহ 



১।

কাঠের জানালার পাল্লা খুলতেই নাগকেশরের হালকা গন্ধ আলতো করে ভেসে এলো ঘরের বাতাসে। লিনসিড, থিনার আর তেল রঙের গন্ধে ভারী বদ্ধ বাতাস সরিয়ে সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ল স্টুডিয়োর ভেতর। বাবা এনে লাগিয়েছিলেন আসাম থেকে। পাহাড় অঞ্চলের গাছ তবু মানিয়ে নিয়েছে সমতলে। নিজের ইচ্ছে মত ফুল ফুটিয়ে চলেছে সময় অসময়।

সুধাময় জলের ঝাপটা দিলেন চোখে মুখে। মুছলেন না। সদ্য পাপড়ি মেলা ফুল আর সবুজ গন্ধ হালকা বাতাস মৃদু ঝাপটা মারল মুখে। জলকণায় মাখামাখি হয়ে বাতাস ঢুকল ত্বকের ভেতরে। ভারি আরাম লাগল সুধাময়ের। চোখ বুজে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলেন তিনি। মাথাটা হালকা হয়ে গেল। খুব ধীরে ধীরে কয়েকবার নিঃশ্বাস প্রশ্বাস ছাড়লেন সুধাময় নিয়মিত অভ্যাসে। নাগকেশরের গন্ধ মেশা ভোরে মনটা ভাল হয়ে গেল তার। 

মন দিয়ে কিছুক্ষণ ক্যানভাসটার দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। এখনও ক্যানভাসে কোনও অবয়বের রেখা পড়েনি। শুধু কিছু রঙের প্রলেপ। সামান্য কালচে লাল ক্যাডমিয়াম রেড আর হালকা কমলা রঙের একটা স্তর চাপানো হয়েছে ক্যানভাসের নিচের অংশে। সেটা ভারি হতে হতে মিশে গেছে গেরুয়া রঙকণায়। সেই গেরুয়া ক্রমশ বাদামি হয়ে মিলিয়ে গেছে দিগন্তে। ক্যানভাস জুড়ে ঠিক যেন রক্ত সন্ধ্যা। সূর্যের বেলা শেষের রশ্মি। কমলা থেকে আগুন রঙা লাল মেঘপুঞ্জের সাথে মাখামাখি বেগুনি রং। 

নিপুণ ভাবে রঙের স্তর মিলিয়ে দিয়েছেন সুধাময় একের পর এক। সে দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকলে বুক কেঁপে ওঠে। এ কোনও সাধারণ পশ্চাৎপট নয়। এ যেন আকাশময় ছড়িয়ে থাকা অমঙ্গলের আশঙ্কা। যেন কালবেলার সংকেত।

ফাদার ফিলিপ দু মাসের সময় দিয়েছিলেন, সে সময় তিনমাস পেরিয়ে গিয়ে চতুর্থ মাসও প্রায় শেষ হতে চলল। কয়েকদিন আগে একটু যেন মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে ফিরে গেছেন ফাদার ফিলিপ। দু হাতের মাঝে মাথা চেপে বসে থাকেন সুধাময়। এত বড় কাজ এই প্রথম এল সুধাময়ের কাছে। সম্মান, স্বীকৃতি, অর্থ সব হতে পারে এ কাজে। দু নম্বর কলোনির কাছে গড়ে উঠেছে নতুন চার্চ। সেই চার্চে টাঙ্গানো হবে সোনালী ফ্রেমে বাঁধান এই বিশাল পেন্টিং - ক্রুসিফিক্সন।

কত শিল্পীই তো এঁকেছেন যীশু। রেনেসাঁর শিল্পীদের তুলিতে বাইবেলের বিভিন্ন গাথা বার বার উঠে এসেছে চার্চের পৃষ্ঠপোষকতায়। মাতিস, জোত্ত, লুকাস আর সুধাময়ের সবচেয়ে প্রিয় শিল্পী রেমব্রা পর্যন্ত এঁকেছেন ক্রুসিফিক্সন বা যীশুর ক্রুশারোহণের ছবি। সব শিল্পীর তুলিতেই কিন্তু ফুটে উঠেছে যীশুর দৈবিক মোহময় রূপ। যন্ত্রণার মাঝেও ঠোঁটে লেগে আছে প্রশান্তির হাসি। মাথার চারপাশে স্বর্গীয় দ্যুতি। ঋজু নগ্ন শরীরে সূক্ষ্ম কটিবাস। অর্ধনিমীলিত টানা চোখ। মসৃণ ত্বক। মৃত্যুযন্ত্রণা স্পর্শ করেনি অমৃতের পুত্রকে। সে ছবিতে মহিমা আছে যন্ত্রণা নেই। 

সে ভাবে চান না সুধাময়। সুধাময় চান আগাপাশতলা মানুষ যীশুকে আঁকতে। যার যন্ত্রণা হয়, কষ্ট হয়। আর্তনাদ বেরিয়ে আসে বুক চিরে। তিনদিন ক্রুশে ঝুলে থাকার পর জর্জর হয় ত্বক। নিজেরই শরীরের ভারে গেঁথে যায় গজাল, ত্বক আর মাংসপেশি ভেদ করে আরও গভীরে। সুধাময় আঁকবেন সেই যীশুকে যিনি প্রতি মূহুর্তে অনুভব করেছেন মৃত্যু যন্ত্রণা। 

একের পর এক খাতা ভরে উঠেছে স্কেচে কিন্তু কিছুতেই ফুটে উঠছে না যীশুর মুখাবয়ব। কিছুতেই পারছেন না সুধাময়। ক্যানভাসের অন্য সব চরিত্রগুলিতে রঙ চেপেছে। নিখুঁত দক্ষতায় গড়ে উঠেছে এক একটি চরিত্র। পুঙ্খানুপুঙ্খ বিস্তারে। শুধু ফাঁকা রয়েছে ক্রুসিফিক্সনের মূল চরিত্র, সুধাময়ের পেন্টিং এর মুখ্য আকর্ষণ - বেথেলহেমের মেষপালক যীশু।

দু হাতের মাঝে মাথা চেপে বসে থাকেন সুধাময়। আজকাল আর সুধাময়ের ঘুম আসে না। নিরন্তর অসাফল্যে ছটফট করেন। দিন আসে দিন যায়। 

দরজাটা সাবধানে বন্ধ করতে গিয়ে খেয়াল করলেন টুলের উপর খাবার ঢাকা দেওয়া। রাতে খোকা ফেরেনি তার মানে। প্রায়ই ফেরে না আজকাল। চোখাচোখি হয় না ছেলের সাথে বিশেষ। 

ভেতরের ঘরে হালকা ফ্যানের হাওয়ায় মশারীটা দুলছে। দুহাত ভাঁজ করে বুকের উপর রেখে ঘুমোচ্ছে হৈমন্তী। তার পাশে চাদরে ঢেকে গুটিসুটি দিতি। ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালেন সুধাময়। হৈমন্তীর ফরসা রঙ যেন রক্তশূন্য, সাদা। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে করোটি রেখা। হালকা আলোতে দেখা যায় কপাল জুড়ে অজস্র বলিরেখা। ফাঁকা হয়ে আসা চুলের ফাঁকে ল্যাপটানো সিঁদুর। খুব বয়স্ক দেখাচ্ছে হৈমন্তিকে। হঠাৎ সুধাময়ের মনে হলো অনন্তকাল পড়ে তিনি হৈমন্তিকে দেখলেন। একসাথে থেকেও যেন পরবাসে থাকেন সুধাময়।

সাবধানে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে দু’পা পিছিয়ে গিয়ে ক্যানভাসের দিকে চাইলেন সুধাময়।

ক্যানভাসে পশ্চাৎপটে থাকা লঘু চরিত্রগুলোর এক একটা ছায়া চাপিয়ে রেখেছেন সুধাময়, পোড়া বাদামি রঙে। প্রাকৃতিক বাদামি রঙের সাথে লোহা আর ম্যাঙ্গানিজের সূক্ষ্ম খনিজ চূর্ণ মিশে তৈরি হয় এমন পোড়া বাদামি রং। পোশাকি নাম বার্নট অ্যাম্বার। তেমনি আছে বাদামির সাথে পোড়া লালের মিশ্রণ- বার্নট সিয়েনা। 

বিভিন্ন রং মিশ্রণের কৌশল আর মানুষের দেহতত্ব বা অ্যানাটমি সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান সুধাময়ের। ডাক্তারদের মত করেই অ্যানাটমি ঘেঁটেছেন তিনি। শরীরের প্রতিটি হাড় আর মাংসপেশির কার্যকারিতা, গঠন, স্তর সম্পর্কে বিশেষজ্ঞের সমান ওয়াকিবহাল তিনি। শুধু মানুষ কেন পশুরও। শরীরের গঠনমূলক বৈশিষ্ট্য না জানলে পোট্রেট আর্টিস্ট হওয়া যায় না। সুধাময়ের আঁকা চরিত্রগুলো তাই বেরিয়ে আসে ছবি থেকে। হাত বাড়ালেই যেন ছোঁয়া যায়। টেবিলের উপর রাখা মাটির আবক্ষ ভাস্কর্য মূর্তি। মূল চরিত্র আঁকার আগে মাটি কিংবা প্লাস্টার প্যারিস দিয়ে সুধাময় তার অবয়ব গড়ে নেন। দুটো সুবিধে হয় তাতে। সেই মূর্তির আদল ছবিতে রক্তমাংসের রূপ পায় আর চরিত্রগুলির ওপর পড়া আলোছায়াগুলি হয় নির্ভুল। রেনেসাঁর গ্রেট মাস্টার্স পেন্টিং-এর মতই তাঁর আঁকা ছবিতে থাকে অনির্বচনীয় আলোর ব্যবহার। 

ছাদের সাথে লাগানো জোরালো পাওয়ারের ফোকাস লাইটটা জ্বেলে দিলেন সুধাময়। মৃৎ-অবয়বের মুখের একটা দিক আলোকিত হলো সেই আলোয়। আবক্ষ মূর্তির বুকের সমান উচ্চতায় একটা চৌকো থার্মোকলের টুকরো সামান্য বেঁকিয়ে লাগানো আছে একটা লোহার স্ট্যান্ডের সাথে। থার্মোকলে প্রতিফলিত হয়ে সেই আলো একটা আবছায়া সৃষ্টি করছে মুখের অপর দিকে। 

ফোকাস লাইটটা নিজের হাতে বিশেষ ভাবে তৈরি করেছেন সুধাময়। সেটা রেগুলেটরের মত কিছুটা কমিয়ে দিতে অপর দিকে আরও গাঢ় হলো আবছায়া। নাক আর চোখের অংশ বিশেষ যেন ত্রিভুজাকৃতি আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। ছায়া গভীর হলো, স্পষ্ট হোল গালের উঁচু হনু, চিবুকের নিচে প্রতিফলিত হয়ে স্পষ্ট হলো চিবুক-রেখা বা জ-লাইন আর ডানদিকের গ্রীবার কিছুটা অংশ।

একই আলোকরশ্মিকে প্রতিফলিত করে এক পাশে আলো আর এক পাশে আঁধার। এক স্বপ্নময় আলো-আঁধার গাম্ভীর্য তৈরি হয়েছে মাটির অবয়বে। দুচোখ আর নাকের অংশটুকু আলোকিত শুধু। উজ্জ্বল আর নিখুঁত ভাবে ধরা পড়ছে চোখের চারপাশের সূক্ষ্মতম অভিব্যক্তি। রেমব্রার তৈরি এই আলো আধাঁরির কৌশল সুধাময় আত্মস্থ করেছেন বহুদিনের সাধনায়। কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে নিবিড় দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করলেন সেই মায়াময় জাদু আলো।

তারপর তৃপ্ত মুখে প্রাচীন রেকর্ড প্লেয়ারটাতে তার প্রিয় পিয়ানোর রেকর্ড চাপালেন সুধাময়। ফ্রেডরিক চপিন। পোলিশ সঙ্গীতস্রষ্টা, সম্ভবত: আঠারো শতকের। পিয়ানোর কি বোর্ডে যেন ছবি আঁকেন তিনি। এ সুধাময়ের বহুকালের অভ্যাস। সুর ছাড়া যেন তুলি চলে না। তবে শুধু সুর। কথা নয়। কথা এ সময় মনোনিবেশ নষ্ট করে। বিব্রত করে সুধাময়কে। মানুষের রোজকার জগতে সুধাময় অপাংক্তেয়, বড় বেমানান।

মূল ছবির জন্য আঁকা পেন্সিল স্কেচে মনোনিবেশ করলেন সুধাময়।

তিনটি স্তরে আঁকা ছবি। গলগথের বিস্তীর্ণ মারণভূমি। ছবির সামান্য ডানদিক ঘেঁসে প্রধান ক্রস, তাতে ক্রুশবিদ্ধ খ্রিস্ট, এটাই প্রধান স্তর। দ্বিতীয় স্তরে আঁকা এটা। তৃতীয় স্তর বা ব্যাকগ্রাউন্ডে আরও দুটি ক্রস খ্রিষ্টের দু পাশে। দুই তস্কর, এরাও ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিল একই সাথে। ডানদিকের ক্রসে ভাল তস্কর ডিসমাস, সমাহিত, শান্ত। বাঁদিকের ক্রসে ঝুলছে মন্দ তস্কর গেস্টাস। যন্ত্রণা আর ক্রোধ তার সমস্ত মুখমণ্ডলে। একদম প্রথম স্তর বা ফোরগ্রাউনন্ডে, খ্রিস্টের ডানপাশে শোকাকুল ভার্জিন মেরি এক হাতে বেষ্টন করেছেন খ্রিস্টের পা, বাঁ দিকে সেন্ট জন আরও একটু নিচে যীশুর প্রেমিকা মেরি ম্যাকডেলিন। রক্ত লাল ক্লোক পরিহিতা ম্যাকডেলিন হাঁটু গেড়ে বসেছেন খ্রিস্টের পায়ের কাছে মাথার চুল দিয়ে মুছিয়ে দিচ্ছেন পা থেকে গড়িয়ে পরা রক্ত ধারা। আর আছে রোমান সৈন্যরা। তারা সমানে বিদ্রুপবাণে বিদ্ধ করছে ইহুদি যীশুকে। ক্রুশের যন্ত্রণার মতই তা তীক্ষ্ণ বাক্যবাণ, নির্মম আর যন্ত্রণাদায়ক।

টিচার্স রুমে এক কোণে বসে ছিলেন সুধাময়। মাধ্যমিক স্কুলের ড্রইং শিক্ষক। শিক্ষক কুলেও গৌণ। ক্লাস ফাইভ-সিক্স পর্যন্তই যা ড্রয়িং ক্লাস হয়। তিনি রিটায়ার করলে হয়ত উঠেই যাবে ড্রয়িং টিচারের পোষ্ট।

এক বাক্স তালশাঁস সন্দেশ নিয়ে সামনে ধরে দেবু। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকান সুধাময়। ‘গাড়ি কিনেছেন অনির্বাণ স্যর, নতুন মারুতি গাড়ি’। একটা তাচ্ছিল্যের হাসি টেনে সুধাময়ের দিকে তাকায় ফোর্থ স্টাফ দেবু।

উজ্জ্বল চোখে বসে আছেন অংকের শিক্ষক অনির্বাণ। সম্ভাবনাময়, সদ্য তিরিশ। দেবুকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে কাছে গিয়ে হাতে হাত রাখেন সুধাময়, ‘কংগ্রাচুলেশনস’।

উষ্ণ হাতে হাত খানা জড়িয়ে ধরে অনির্বাণ ‘আপনার আশীর্বাদ স্যর।' 

অনির্বাণকে বেশ লাগে সুধাময়ের। আধুনিক শিক্ষিত আর বুদ্ধিমান ছেলে, কিন্তু উদ্ধত নয়। ছাত্রদের চেয়েও ছাত্রদের বাবা মায়ের কাছে বেশি প্রিয়। এমন শিক্ষক স্কুলের গর্ব। দিতির সাথে মানাত ভাল। মনে মনে দিতি আর অনির্বাণের একটা যুগল স্কেচ করে ফেললেন সুধাময়।

অবজ্ঞায় অভ্যস্ত হয়ে গেছেন সুধাময়, ঘরে বাইরে। মাছের দোকানে শেষের দিকের সারিতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেন। সামনে দাঁড়িয়ে পুরুষ্ঠ দামি খদ্দের। সোনায় বাঁধানো আঙুল আর কব্জি নেড়ে মাছ কেনে তারা। 

‘একটু দাঁড়াতে হবে স্যর।' মাছের নাড়িভুঁড়ি বেড়ালটার দিকে ছুড়ে দিতে দিতে বলে মাছওয়ালা বাসব। দাঁড়িয়ে থাকেন সুধাময়, মানুষ দেখেন। 

ফেরার রাস্তায় দেখা হয় প্রমোটার ভবেশ পালের সাথে, 'কি স্যর? কি ঠিক করলেন? ও ভাঙা বাড়ি আর কে কিনবে? মাগ্যি গণ্ডার বাজার। জমিটুকুরই যা দাম'। অদ্ভুত কায়দায় ঠোঁট বেঁকায় ভবেশ পাল। সোনা বাঁধানো দাঁত ঝিলিক মারে। একসময় ছাত্র ছিল তার। উত্তর দেন না সুধাময়। নিপুণ হাতে ব্রাশ চালান আর আশে পাশের চেনা অবজ্ঞাগুলো এক এক করে ঢুকে পড়ে ছবির চরিত্রে। রোমান সৈন্যদের মুখে, সমাজপতিদের মুখে পরিচিত অবজ্ঞা ফুটিয়ে তোলেন সুধাময়। শ্লেষ আর দম্ভ ফুটে ওঠে চরিত্রের হাবভাব আর আকার ইঙ্গিতে।

রবিবার হুটোপুটি করে আসে নীলু, রিখি, কুসুম আর কচিকাঁচার দল। ড্রয়িং খাতা আর রঙ পেন্সিল নিয়ে। সুধাময় খাতায় আঁচড় কাটেন না, বাগানে পাঠান পাতা কুড়িয়ে আনতে। বিভিন্ন আয়তনের পাতা। সুধাময় দেখতে শেখান। সবুজের রকম ফের। রঙ নিয়ে মাতামাতি করে তারা। মাখায় কাগজে, মেঝেতে, গায়ে মাথায় কোমল থেকে গাঢ় সবুজ। সুধাময় গাঢ় চোখে লক্ষ্য করেন তারপর ছবির জমিতে বসিয়ে দেন সবুজ দেব শিশু হালকা স্বচ্ছ পাখা মেলে তার বিচরণ করে খ্রিস্টের মাথার উপর। খ্রিস্ট? কোথায় খ্রিস্ট? সুধাময়ের তুলিতে যেন খরা। এক দৈবচরিত্রে উন্নীত হওয়া অবয়বকে মানুষের সীমাবদ্ধতায় নামিয়ে আনা। মানুষের যন্ত্রণা ফুটিয়ে তোলা যে কি দুঃসাধ্য তা প্রতিমুহূর্তে অনুভব করছেন সুধাময়।

দিতির ডাকে সম্বিৎ ফিরে এল। চা রেখে গেছে দিতি, সঙ্গে টোষ্ট বিস্কুট। সূর্য ততক্ষণে লাল মেঝের উপর বিছিয়ে দিয়েছে ঝিরি-কাটা রোদ চাদর।

২।

মসমস করে ঘরময় পায়চারি করছে অজয় প্রতাপ সিং। সুরার প্রভাবে চোখ অস্বাভাবিক লাল। বিশাল শরীরে ঢোলা খাদির কুর্তা পাজামা। পায়ে মোজা। সহজেই ঠাণ্ডা লেগে যায় তার। প্রচণ্ড আক্রোশে ঘরের একপাশ থেকে আরেক পাশ পায়চারি করে চলেছে অজয় প্রতাপ সিং।

বিরাট ছড়ানো কৌচে পা মুড়ে বসে আছে সারস্বত মিশ্রা। মুখময় খোঁচা সাদা দাড়ি, সাদা কদম-ছাট চুল। মেদহীন, একঠেরে চেহারা। গৌর বর্ণ। গভীরে বসা তীক্ষ্ণ উজ্জ্বল চোখ। 

‘উপায় বের করুন মিশ্রাজী। কিছু উপায় তো হবেই। হতেই হবে।' এক চুমুকে গ্লাসের বাকি তরলটুকু গলায় ঢেলে দিল অজয় প্রতাপ সিং। 

কোনও উত্তর করল না সারস্বত মিশ্রা, ভ্রূকুটি কুটিল চোখে এক দৃষ্টে দেওয়ালে ঝোলান বিশাল বাইসনের মাথাটার দিকে তাকিয়ে রইল শুধু।

কাল রাত থেকে দাঁতে কুটো পর্যন্ত কাটেনি অজয় প্রতাপ। সান্ধ্য মজলিশে খবরটা আসার পর কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে ছিল সে। হাতের ভর্তি গেলাসটা দেওয়ালে ছুঁড়ে চুরমার করতেই, বেগতিক বুঝে একে একে সরে পড়েছিল ইয়ার-দোস্ত সব। কিছুক্ষণ নিঃসাড় বসে থেকে একটা নতুন বোতল এক নিঃশ্বাসে খালি করে ফেলল অজয় প্রতাপ। তারপর টলতে টলতে উঠোনের জলনিকাশি নালির সামনে দাঁড়িয়ে ছ্যাড় ছ্যাড় করে পেচ্ছাপ করতে করতে ডেকে উঠল,

‘ছগন…এ ছগনওআ, এ হরামি কে আওলাদ, এ মাদারচোদ।‘ ছগন একলাফে নিচে এসে তড়িঘড়ি প্রভুর সামনে দাঁড়াল।

‘মিশ্রাজী কো খবর কর। অভি, তুরন্ত।‘

কারণটা যে জরুরী আর মারাত্মক সেটা না জেনেই বুঝতে পেরেছিল রাজনীতির চাণক্য সারস্বত মিশ্রা, বি এ, এল এল বি। কোনও দুবিধা বা ভয়াবহ সঙ্কটে না পড়লে এত জরুরী তলব হয় না তার। রাজনৈতিক বা তত রাজনৈতিক নয় এমন সব সমস্যার সমাধান মিশ্রাজী দেন অসীম মেধা আর দূরদর্শিতায়। তার জন্য অবশ্য মুহ-মাঙ্গা মূল্য দিতে কার্পণ্য করে না অজয় প্রতাপ সিং। 

আজকের সমস্যাটা বেশ জটিল আর গভীর।

পর পর দু-বার ইলেকশানে জেতা অজয় প্রতাপকে টিকিট দেয়নি পার্টি হাই-কমান্ড। গত ইলেকশনে অজয় প্রতাপের অখণ্ড প্রতাপেই পার্টি বহুল ভোটে জিতেছিল কাটিহার কন্সটিট্যুয়েন্সি থেকে। গত দশ বছরের পুরোনো সরকারকে উপড়ে ফেলে যেন তেন প্রকারেণ সরকারে আসাই ছিল পার্টি হাইকমান্ডের একমাত্র লক্ষ্য। হ্যাঁ, যেন তেন প্রকারেণ। তাই অজয় প্রতাপের মাফিয়ারাজ কাজে লাগিয়ে জিতে নিয়েছিল কাটিহার থেকে সিওয়ান পর্যন্ত বেশিরভাগ আসন। তা সে উপকারের ভরপাই দিয়েছে বটে সরকার পাঁচ বছর ধরে। নইলে এতগুলো অপহরণ, ধর্ষণ আর অবৈধ আদায়-জুলুম করেও সে কি করে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়?

কিন্তু এবার পার্টি সচেতন হয়েছে। বদলে ফেলছে খোল-নলচে। বদলে ফেলতেই হবে পার্টির ভাবমূর্তি। তাই এবার পার্টি তাকে টিকিট দেয়নি। টিকিট দিয়েছে সেদিনকার ছোকরা প্রফেসর দ্বারকাপতি যাদবকে। 

রাগে মাথার শিরা দপদপ করছে অজয় প্রতাপ সিংয়ের। 

মিশ্রাজী এতক্ষণে মুখ খুললেন, ‘রাস্তা খুব বেশি নেই সিং সাহেব। একদম ক্লীন এই প্রফেসর ছোকরা, পড়া লিখা, স্টুডেন্ট রাজনীতি করেছে অনেক বছর। বাবা, মা সব টিচিং লাইনের লোক। কোনও স্ক্যান্ডেল নেই। ঘুষ-ঘোটালা কিচ্ছু নেই।'

রক্ত চোখে মিশ্রাজীর দিকে চাইল অজয় প্রতাপ। সে সবের তোয়াক্কা না করে তার স্বভাবসিদ্ধ অবিচল ভঙ্গিতে বলে উঠল সারস্বত মিশ্রা, ‘শুধু একটা উপায় আছে।'

‘কি উপায় মিশ্রাজী?’ বাঘের মত লাফ মেরে মিশ্রাজীর সামনের সোফায় এসে বসল অজয় প্রতাপ।

‘যদি কোনও ভাবে এই প্রফেসরের কোনও ক্রিমিনাল কন্সপিরেসি পাওয়া যায়। মতলব কোই ভারি ক্রিমিনাল অফেন্স, জ্যায়সে কি মান লিজিয়ে – মার্ডর।' 

দুহাত সামনে ঝুলিয়ে হতাশ হয়ে দাঁড়াল অজয় প্রতাপ। স্পষ্টতই ধৈর্য হারিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘ইয়ে ক্যায়সা বেহুদা মজাক হ্যাঁয়, মিশ্রাজী। আপনি জানেন ছোকরা ওসবের ধারে কাছেও নেই। নিজেই বললেন ক্লিন রেকর্ড'।

বিরল হাসি ফুটল মিশ্রাজীর ঠোঁটে। ‘উপায় নিকালনা পড়তা হ্যায় সিংজী, অপনে আপ গোদি মে আকর নহি গিরতা হ্যায়।'

‘উমাশঙ্কর’ সামান্য গলা উঁচিয়ে হাঁক ছাড়ল সারস্বত মিশ্রা।

ভেতরে ঢুকল বছর তিরিশের এক যুবক। পেশীবহুল, চওড়া কাঁধ আর গলা। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে মাথা নুইয়ে দাঁড়াল উমাশঙ্কর। 

‘শুনলাম সেদিন পার্টি অফিসে দ্বারকা যাদবের সাথে নাকি কি গণ্ডগোল হয়েছে?’ একবার পুরোটা বল দেখি শুনি।‘

‘কার সাথে গণ্ডগোল হয়েছে।'

‘জী মালিক, রানা বোসের সাথে’ 

‘রানা বোস? বঙ্গালি?’

‘জী হজুর। লড়কানিয়া টোলায় বাড়ি।’

পার্টিতে আছে তিন চার সাল। দলন, রাওতারা, রানিপতরা, পূর্নিয়া এই সব জায়গাগুলোতে কাজ করে।’

‘কি নিয়ে হলো গণ্ডগোল?’ 

‘জী রানা বোস চিট-ফাণ্ডের বিজনেস শুরু করেছিল হুজুর। এই তিন সালে কালেক্ট করেছে ক্রোড় সে উপর। ‘কিষান, মজদুর, দোকানদার, ছোটা ব্যাপারী, সবার থেকে। বেশি সুদ দেবে। বোনাস দেবে। তারপর কোনও সাড়া শব্দ নেই।‘ গাঁওয়ে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে রানা, বদলে নিয়েছে সিম কার্ড।

‘তারপর মুখিয়াজীকে নিয়ে বেওসাদাররা এসে দরবার করল দ্বারকাজীর কাছে।’

‘তারপর?’

‘তারপর দ্বারকাজীর সামনে সবাই টাকার পুর্জা নিয়ে দেখাল, আর চেপে ধরল রানাকে।’

‘ফের কি হোলো?’

‘রানা তবু মানছিল না। তখন জোড় সে এক ঝাপর মারল দ্বারকাজী। একদম আগ ববুলা হয়ে বলল… ’হরামখোর প্যয়সা নিকাল নহি তো হটা দেঙ্গে।’

'ফির সে বোল ক্যা বোলা দ্বারকা নে?'

‘জী দ্বারকাজী নে বোলা কি 'উসনে বোলা, প্যায়সা নিকাল নহি তো হটা দেঙ্গে।‘

‘গলত শুনা তু নে’ সশব্দে টেবিল চাপড়ে ধ্মকে উঠল সারস্বত মিশ্রা। ‘ফির সে বোল ক্যা বোলা দ্বারকা নে?’

হকচকিয়ে গেল উমাশঙ্কর ‘জী উসনে বোলা, প্যায়সা নিকাল নহি তো…’

‘নহি তো দুনিয়া সে হটা দুঙ্গা।’ মুখের কথা কেড়ে নিয়ে দৃঢ় গলায় বলল সারস্বত মিশ্রা। 

‘প্যায়সা নিকাল, নহি তো দুনিয়া সে হটা দেঙ্গে।’ য়হী বোলা দ্বারকানে, ই বাত দিমাগ মে গাঁঠ বাঁন্ধ লো উমাশঙ্কর।‘

‘বুঝলন কি নাহি? ইয়া অলগ সে সমঝাওয়েকে পড়ি?’ 

মিশ্রাজীর শীতল স্বরে ভেতর অবধি কেঁপে উঠল উমাশঙ্করের।

‘চিট ফাণ্ডের বখরা নিয়ে গণ্ডগোল তাই দ্বারকাপতি যাদব সমস্ত লোকের সামনে রানা বোসকে থাপ্পড় মেরে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার ধমকি দিয়েছে সিং সাহেব, আর সাক্ষী আছে উমাশঙ্কর।’ 

অজয় সিং-এর চোখে চোখ রেখে কথা শেষ করে উঠে দাঁড়াল সারস্বত মিশ্রা। 

৩।

রামদায় শান দিচ্ছিল বসির, সুধাময়ের সাথে একই ক্লাসে, ক্লাস এইটে। একসাথে ফুটবল খেলত এই মাস খানেক আগে। এখন খেলে না। রমেনকাকা, ঘর ছাড়লেন চুপিচুপি। কাকিমা, বুলবুলি আর কালোর হাত ধরে। যেন বেড়াতে যাচ্ছেন পাশের গ্রামে। বাবার কাছে এসে ফিস ফিস করে বলে গেলেন, 'পালান দাদা, পলায়ে যান, এহানে জান মান লইয়ে থাইকতে পাইরবেন না আর।‘ বসির হাসল, 'আজ সবকটাকে জবাই করুম।' সে রাতেই লুট হয়ে গেল রমেনকাকার বাড়ি। হিন্দু বাড়িগুলো খড়ির দাগ দিয়ে গেছিল আগে থেকেই। জ্বলে উঠল দাউদাউ করে নোয়াখালি, টাঙ্গাইল, আমলাসদরপুর। বাবা ঘরের দরজা শক্ত করে বন্ধ করে একটা শাবল নিয়ে দাঁড়ালেন সামনে। কারা যেন কড়া নাড়ছে সমানে। মা ভাইকে জড়িয়ে কাঁপছে ঠকঠক করে। বেড়ে চলেছে কড়া নাড়ার শব্দ। এবার বুঝি ভেঙ্গেই ফেলবে দরজাটা। সুধাময় দু হাতে আঁকড়ে ধরেছে বাবাকে। কড়া নাড়ার শব্দ বেড়ে উঠছে ক্রমশঃ। জোরে, আরও জোরে।

ধড়ফড়িয়ে জেগে উঠলেন সুধাময়। গত তিনরাত দুচোখের পাতা এক করেননি। সারা ঘরে ছড়ানো দোমড়ান মোচড়ানো কাগজ। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে স্কেচ করে গেছেন যীশুর মুখাবয়ব। হচ্ছে না, কিচ্ছু হচ্ছে না। কিছুতেই আসছে না। একটা চিনচিনে ব্যথা ছড়িয়ে পড়ে বুকের পাশ থেকে।

'কি হলো দরজাটা খোল। কেউ ধাক্কা দিচ্ছে বাইরে থেকে, শুনতে পাচ্ছ না?' ভেতর ঘর থেকে ছুটে এসেছে দিতি আর হৈমন্তী। আচমকা ঘুম থেকে উঠে কেমন থমকে গেছেন সুধাময়। অতীত বর্তমান মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। ঠাওর করতে পারছেন না কিছু। আঁধার-ভোরে দরজায় কড়া নাড়ছে কেউ একটানা।

দিতি এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলল। খুব সম্ভ্রমের সাথে ঘরে ঢুকে এলেন পুলিশ অফিসার। সুধাময়ের দিকে চেয়ে পরিচিতের হাসি হাসলেন যেন। ছাত্র ছিল কি তার? মনে করার চেষ্টা করলেন সুধাময়। হৈমন্তীর মুখ চোখ আতঙ্কে মাখামাখি। খুব মৃদু স্বরে অফিসার কথা বলছেন দিতির সাথে। যেতে হবে? কোথায় যেতে হবে? সব কিছু আবার গুলিয়ে যাচ্ছে সুধাময়ের। তারা তো কিছু করেনি। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন তিনি অফিসারের দিকে। কেউ কিছু বলল না। হ্যাঁচকা টানে সুধাময়ের হাত ধরে দিতি ছুটল দাঁড়িয়ে থাকা জিপের দিকে।

জীপটা হুহু করে ছুটে চলেছে ফাঁকা রাস্তায়। হালকা অন্ধকারে স্বচ্ছ ওড়নার মত কুয়াশার চাদর জীপের হেডলাইটের সামনে দিয়ে পাক খেয়ে উঠে যাচ্ছে ওপরে। শিশির ভেজা রাস্তায় পিছলে যাচ্ছে আলো। সদ্য শীতের সকালে রাস্তায় লোকজন নেই বিশেষ। প্রত্যেক শহরের ভোরের নিজস্ব গন্ধ থাকে। সুধাময় শীত সকালের গন্ধ টেনে নিলেন বুক ভরে। জীপটা বসন্ত টকিজের ফ্লাইওভার, রেল কো-অপারেটিভ পেরিয়ে সাহেব পাড়ার দিকে ঢুকল। দু পাশে রেল অফিসারদের লাল ইটের বাংলো। কেয়ারি করা ফুলের লন, রাস্তার দুপাশে সার দিয়ে সিরিস, ছাতিম, অর্জুন। সুধাময় দেখতে লাগলেন দু চোখ ভরে। চকচকে পিচরাস্তা ধরে ছুটে চলেছে জীপটা। খুব ছোটবেলায় আসতেন সুধাময় এদিকে, ফুল চুরি করতে। কতদিন পর এলেন শহরের এপাশটাতে। এই অঞ্চলটার পুরোটাই রেলকর্মচারীদের বাস। সিনিয়র ইন্সটিট্যুট অডিটোরিয়াম থেকে বাঁক ঘুরতেই বিরাট ফুটবল মাঠ। চারপাশ উঁচু পাঁচিলে ঘেরা। সবাই বলে রেলের মাঠ। একপাশে গ্যালারি আর এক পাশে ঘেরা গাছ। দুপাশে দুই গোলপোস্ট। ওপাশে রেলের ইয়ার্ড থেকে ভেসে আসছে রেলের ভোঁপু। তার পাশে লোকো শেড। প্রতি পনের আগস্ট আর ছাব্বিশ জানুয়ারিতে লোকো শেডে দাঁড়িয়ে থাকা সব কয়লার ইঞ্জিনগুলো একসাথে সাইরেন বাজাত ঠিক সকাল আটটায়।

দিতি ছুটল হাত ছাড়িয়ে, পেছন পেছন হৈমন্তি। 'হৈমন্তি...হৈমন্তি, দাঁড়াও আসছি আমি' কোনওরকমে যেন ঘোরের মধ্যে বললেন সুধাময়। হৈমন্তি দাঁড়াল না। বিশাল মাঠ পেরোতে হাঁটতে লাগলেন সুধাময়। ভোরের শিশিরে ভিজে যাচ্ছে পা। আকাশে কমে আসছে গাঢ় বেগুনি রঙ। ছড়িয়ে পড়েছে গোলাপি আভা। আশে পাসের ঝুপুস কালো গাছগুলোর গায়ে স্পষ্ট হচ্ছে সবুজের প্রলেপ। একটানা কিচির মিচির শব্দে কান ঝালাপালা করছে পাখিগুলো। আবার মাথার মধ্যে সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে সুধাময়ের। রানা শুয়ে আছে ঘাসের উপর, ইটের উপর মাথা রেখে। চারপাশ ঘিরে ছোট জটলা। থরথর করে কেঁপে উঠলেন সুধাময়। হৈমন্তি কাঁদছে পাগলের মত। দিতিও। 

সবকিছু কেমন ওলটপালট হয়ে গেল সুধাময়ের। দম আটকে আসছে। যেন জলে ডুবতে লাগলেন সুধাময়। একটু বাতাসের জন্য কোনওরকমে মুখ তুললেন তিনি। সমগ্র দৃশ্যপট যেন ক্যানভাস হয়ে গেল সহসা। ওপরে নিরন্তর খোলা আকাশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে গাঢ় রক্তাক্ত মেঘ। ক্রিমসন রেড থেকে স্কারলেট রেড। লো অকটেভে পিয়ানোয় সুর তুলছেন চপিন সাহেব। সুধাময় যেন দেখতে পেলেন দিগন্তবিস্তৃত সীমাহীন প্রান্তর। আকাশ পৃথিবী মিলে মিশে একাকার। মাটির উপর কিলবিল করছে লক্ষ লক্ষ, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মানুষ। একে অপরকে মারছে, কাটছে। রক্ত লাল আভায় ভরে যাচ্ছে প্রান্তর। আর সেই আদিগন্ত প্রান্তরে শুয়ে আছেন সুধাময়ের যীশু। ইটের উপর মাথা রেখে। মাথার বাঁ দিকে গভীর ক্ষত। মৃত্যুযন্ত্রণায় বিকৃত মুখ। দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরেছে অধরোষ্ঠ। মৃত্যু কামড়ে রক্তাক্ত ঠোঁট। আধখোলা চোখ। শক্ত মুঠিতে আঁকড়ে ধরেছেন একমুঠো ঘাস। অপার্থিব লাল আভা ছড়িয়ে পড়ছে যীশুর প্রাণহীন অবয়বে। দ্রুত লয়ে বাজিয়ে চলেছেন চপিন সাহেব। মাথার ভেতর জমে উঠছে পিয়ানোর সুর। নিটোল বুদ্বুদের মতো। তারপর হঠাৎ বুদ্বুদ ফেটে গিয়ে রাঙিয়ে দিচ্ছে ক্যানভাস। ফুটে উঠছে যন্ত্রণাক্লিষ্ট মেষপালক যীশুর মুখ। অবিকল নশ্বর মানুষের অসহায় মুখ, স্থির হয়ে যাওয়া আধখোলা দু’চোখ ঘিরে যন্ত্রণার অভিব্যক্তি। মৃত্যুযন্ত্রণায় নীল অবয়ব। পায়ের কাছে শব্দহীন বিলাপে শোক-বিহ্বল দুই নারী। 

হঠাৎ বড় খুশি উঠলেন সুধাময়। মাঠ পেরিয়ে দ্রুত পা চালালেন। পৌঁছুতে হবে তাঁর ছবি-ঘরে। মস্তিষ্ক জুড়ে এখন শুধুই নাগকেশরের গন্ধ।


2 comments:

  1. অদ্ভুত দৃষ্টিকোণ চমকে গেলাম শেষটুকুতে

    ReplyDelete
  2. asadharn lekha. khub sundar

    ReplyDelete