2

প্রাচীন কথা - সুষমা ব্যানার্জী

Posted in


প্রাচীন কথা


লক্ষ্মণ-চরিত
সুষমা ব্যানার্জী


একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস লক্ষ্মণের বক্ষ বিদীর্ণ করিয়া নির্গত হইল। সরযূতীরে সূর্য অস্ত যাইতেছে। গোধুলিবেলায় পক্ষীকুল আপন নীড়ে ফিরিতে অকারণ কলকাকলি করিতেছে। চারিপাশে জনমানবের চিহ্নমাত্র নাই। দু’একটি গোবৎস মাতার সন্ধানে ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল, মাতার আহবান পাইবামাত্র ছুটিয়া আলয়ে ফিরিল। লক্ষ্মণের অশ্রু বাঁধ মানিল না। আজ তাঁহার ফিরিবার স্থান নাই। তাঁহার একমাত্র আশ্রয় আজ তাঁহাকে পরিত্যাগ করিয়াছেন। তাঁহার বিন্দুমাত্র ক্ষোভ নাই অগ্রজের প্রতি। ধর্মপ্রাণ শ্রীরামচন্দ্রের প্রতি রাগ বা অভিমান তাঁহার স্বভাববিরুদ্ধ। কিন্তু অপরিসীম যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত হইতেছে তাঁহার হৃদয়। এ কেমন ধর্ম যাহা কায়া হইতে ছায়া পৃথক করিয়া দেয়? এ সংশয় মনে উঠিবামাত্র নিজের মনকে ধিক্কৃত করিলেন লক্ষ্মণ। দেবতার প্রতি সংশয়! ইহা অপেক্ষা মৃত্যুও বুঝি কাম্য। আর বিলম্বে কাজ নাই। আচমন করিয়া সরযূ তীরে যোগমগ্ন হইলেন তিনি। 

"সৌমিত্রি, তোমাকে বিসর্জন দিলাম।"
কে বলিল একথা? আপন কর্ণকে অবিশ্বাস করিতে চাহিলেন তিনি। রামের পক্ষে লক্ষ্মণ বর্জন? ইহা যে অতি অসম্ভব ঘটনা। অতঃপর যাহা শুনিলেন তাহা কি সত্যই রামচন্দ্রের মুখনিঃসৃত বাণী? 

"প্রিয়জন কর্তৃক ত্যাগ বা মৃত্যু, সাধুদের পক্ষে দুই সমান" -কেন বারংবার কথাগুলি কানে বাজিতেছে? কেন মনঃসংযোগ করিতে পারিতেছেন না? অগ্রজ কি পরোক্ষে মৃত্যুকে বরণ করিতে বলিলেন? এমন মৃত্যুই কি কাম্য ছিল? সারা জীবন রামচন্দ্রের ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দিয়াছেন, মৃতুও কি তাঁহারই ইচ্ছাধীন? 

আবার সংশয়! কেন বারংবার মন বিরোধিতা করিতেছে? তবে কি রামচন্দ্রকে সম্পূর্ণরূপে দেহে মনে সমর্পণ করেন নাই তিনি? পুনরায় আচমন করিয়া ধ্যানমগ্ন হইলেন। 

কিন্তু দেবদর্শনের পরিবর্তে কী দেখিতেছেন রামানুজ? চোখের সামনে দৃশ্যগুলি ভাসিয়া যাইতেছে যেন.... 

মহর্ষি বিশ্বামিত্র রাজদর্শনে আসিয়াছেন। দুই কামরূপী শক্তিশালী রাক্ষস মারীচ এবং সুবাহু নানাবিধ বিঘ্ন সৃষ্টি করিয়া যজ্ঞ বিনষ্ট করিতেছে বারংবার। মহামুনি বিশ্বামিত্র তাই রামচন্দ্রকে লইয়া যাইবেন রাক্ষসদের বিনাশ করিবার নিমিত্ত। কিন্তু, লক্ষ্মণ কেমন করিয়া রামচন্দ্রকে একাকী ছাড়িয়া দিতে পারেন? সঙ্গী হইলেন অগ্রজের। দুষ্টচারিণী তাড়কাকে বধ করিবার পর মুনিশ্রেষ্ঠ বিশ্বামিত্র পরিতুষ্ট হইয়া রামচন্দ্রকে যখন অদ্ভুত শক্তিশালী দিব্যাস্ত্রসমূহ দান করিলেন, সেই সময় অগ্রজের প্রাপ্তিকে আপন প্রাপ্তি বলিয়া মানিয়াই অনাবিল আনন্দিত হইয়াছিলেন। আজ, এত বছর অতিক্রান্ত হইবার পর কেবলি নিজেকে বঞ্চিত মনে হইতেছে কেন? কেন মনে হইতেছে তাঁহারও কিছু প্রাপ্য ছিল ঋষি বিশ্বামিত্রের পক্ষ হইতে? শিশুকাল হইতে যে অগ্রজের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলিয়াই আপনাকে ভাবিয়াছেন, আজ তবে কেন পৃথক সত্তা মাথা তুলিতে চায়? 

অস্থির, চঞ্চল লক্ষ্মণ ধ্যানভঙ্গ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। রামচন্দ্রের সহিত বিচ্ছেদের আঘাত সহ্যাতীত হইয়াছিল বলিয়া তৎক্ষণাৎ অযোধ্যা ত্যাগ করিয়াছিলেন। সহধর্মিণী ঊর্মিলার সহিত সাক্ষাতের কথা মনে করিবার অবকাশ ছিলনা তাঁহার। চিরটাকাল তাহাকে বঞ্চিত করিয়াই কাটাইয়া দিলেন। আজ যে মুহূর্ত হইতে নিজেকে বঞ্চিত মনে হইতেছে, সে হতভাগিনীকে বড় বেশী মনে পড়িতেছে। জীবনে প্রথমবার স্ত্রী ও পুত্রদ্বয়ের জন্য অশ্রুবিসর্জন করিলেন লক্ষ্মণ। 

ক্রমাগত অগ্রজের কথাই স্মরণ হইতেছে কেন? পিতৃসত্য পালনার্থে রামচন্দ্রের বনবাসে কে ক্ষুব্ধ হইয়াছিলেন সর্বাধিক? এমনকি পিতাকে কামুক বুদ্ধিভ্রষ্ট বলিয়া সমগ্র অযোধ্যা নির্মনুষ্য করিবার সংকল্প কাহার ছিল? অরণ্যযাত্রার প্রভূত কষ্ট এবং শ্রম মাথায় পাতিয়া লইয়াছিলেন কে? দিবসরজনী অতন্দ্রভাবে রাম-সীতাকে রক্ষা করিবার ভার কে স্বেচ্ছায় গ্রহণ করিয়াছিলেন? স্ত্রীর সজলনেত্র, মাতার বক্ষবিদারী ক্রন্দন উপেক্ষা করিয়া দিনের পর দিন অরণ্যমধ্যে গৃহনির্মাণ করিয়া শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্যকে বাসযোগ্য করিয়া তুলিবার মধ্যে কাহার স্বার্থ নিহিত ছিল? তাঁহার তো পিতৃবাক্য পালনের বাধ্যবাধকতা ছিল না! শুধু ছিল রামচন্দ্রের প্রতি প্রগাঢ় প্রীতি। অগ্রজের সঙ্গে তাঁহার বন্ধন অচ্ছেদ্য বলিয়াই জানিতেন তিনি। ইহা কি তাঁহার অপরাধ? 

লক্ষ্মণ পুনঃপুনঃ ব্যর্থ হইয়া ধ্যানের প্রচেষ্টা ত্যাগ করিলেন। একটি বৃক্ষতলে বসিয়া পূর্বকথা স্মরণ করিতে লাগিলেন তিনি। দীর্ঘসময় অশ্রু বিসর্জনের পরে তাঁহার মনের ভার কিছুটা লাঘব হইল। অতীতকথা যেন গতজনমের কথা বলিয়া ভ্রম হয়। 

অপরাধ? …কিছু ছিল নিশ্চয়ই। দণ্ডকারণ্যে অবস্থানকালে শূর্পণখার সহিত তাঁহাদের আচরণ সমীচীন ছিল কি? পরিহাসের ছলে তাহাকে অপমানিত করা হইয়াছিল বলিয়াই আজ বিবেচনা হয়। স্বেচ্ছায় ভর্তাগ্রহণ অনার্যজাতির পক্ষে স্বাভাবিক; বিশেষত সে যখন হতভর্তা। তাই বোধকরি সে প্রথমে শ্রী রামচন্দ্র এবং পরে তাঁহাকে বিবাহপ্রস্তাব দিয়াছিল। সেদিক হইতে তাহার আচরণ বিসদৃশ কিছুই নয়, কিন্তু তাঁহারা স্ত্রীজাতির প্রতি যে কোমলতা দেখানো যাইত, তাহা না করিয়া বিদ্রূপ করিয়াছিলেন তাহাকে। তাই বোধকরি ঈর্ষান্বিত হইয়া সে দেবী সীতাকে আক্রমণ করিয়াছিল। প্রবৃত্তিদমন তাহাদের স্বভাববিরূদ্ধ। শূর্পনখার নাসাকর্ণ ছেদনের অপরাধবোধ আজও লক্ষ্মণকে সংকুচিত করিয়া দেয়। যক্ষিণী তাড়কাকে হত্যা করিবার মধ্যে ঋষিসমাজকে সুরক্ষিত করিবার ভাবনা ছিল, মহামুনি বিশ্বামিত্রের আদেশ ছিল, তদুপরি প্রাণ বাঁচাইবার তাগিদ ছিল। শূর্পনখার ক্ষেত্রে এসকল কিছুই ছিল না। আরও কিছুটা সংবেদনশীল হইলে বোধকরি সীতাহরণের ঘটনাটি এড়ানো যাইত। 

সত্যই যাইত কি? সোনার হরিণের পিছনে রামচন্দ্রকে ছুটিতে বাধ্য করিয়াছিলেন দেবী সীতা। লক্ষ্মণের বহু নিষেধ অমান্য করিয়া। দৈত্যদানব পরিবেষ্টিত অরণ্যে এজাতীয় চিত্তচাঞ্চল্য কাম্য নয়। হয়ত বিপদ অন্য প্রান্ত হইতে আসিত। আর দেবী সীতা কর্তৃক কি চরম অপমান! লক্ষ্মণ দেবীকে একা রাখিয়া যাইতে অস্বীকৃত হইলে দেবী তাঁহাকে আপনার প্রণয়প্রার্থী সন্দেহ করিয়াছেন। সারাজীবন দেবীজ্ঞানে সেবা করার কি চরম প্রাপ্তি! 

আজ কেবল অপমান আর অপ্রাপ্তির কথাই স্মরণে আসিতেছে কেন? তবে কী লক্ষ্মণের সত্যই লোভ হইয়াছিল? লোভ হইয়াছিল খ্যাতির প্রতি? রামচন্দ্রের সুকীর্তির কিছু খণ্ডাংশ পাইবার আশা কি তাঁহারও ছিল? তাই কি রামচন্দ্র কর্তৃক পরিত্যাজ্য হইয়া খ্যাতিহীন হইবার আশংকা হৃদয়ের গোপনে রক্ষিত আবেগগুলি নিংড়াইয়া বাহির করিতেছে? 

ধিক্‌ কষ্ট! এসকল কেমন কথা চিত্তদাহ ঘটাইতেছে? দুঃখের অনলে পুড়িয়া শুদ্ধ না হইয়া এসকল মনের ক্লেদ কোথা হইতে নির্গত হইতেছে? কিন্তু, না, আজ হৃদয় সংবরণ করিবেন না তিনি। হৃদগতি যেইদিকে ইচ্ছা যাউক! 

সীতা অন্বেষণে রামচন্দ্র বানর জাতির সহায়তা লইলেন। কিন্তু কিরূপে? বালীকে অন্যায্যভাবে হত্যা করিয়া। অবশ্য, বানররাজ্যে গিয়া বানররাজ বালীকে সম্মুখসমরে আহ্বান করা আর আত্মহত্যা সমান। তবুও আড়ালে দাঁড়াইয়া শত্রুহত্যা করা ছাড়া বিকল্প কি কিছু ছিল না? 

সব চিন্তাভাবনা একসূত্রে গ্রথিত করিতে পারিতেছেন না লক্ষ্মণ। কেবলই এলোমেলো হইয়া যাইতেছে। আজ কেন প্রভু রামের ত্রুটিগুলিই দৃষ্টিগোচর হইতেছে? ভালো কি লক্ষ্মণকে বাসেন নাই তিনি? সারাজীবন পার্শ্বে থাকিয়া সুখদুঃখের ভাগীদার হন নাই? লক্ষ্মণের দুই পুত্র অঙ্গদ এবং চন্দ্রকেতুকে প্রতিষ্ঠিত করেন নাই কারুদেশ এবং চন্দ্রকান্ত দেশে? রাবণ নিক্ষিপ্ত অষ্টঘন্টাযুক্ত শক্তি যখন লক্ষ্মণের হৃদয়ে প্রবিষ্ট হইল, রামচন্দ্রের সে আকুল ক্রন্দন, তাঁহাকে জীবনদানের ব্যাকুল প্রয়াস, এসকল তো অসত্য নয়! 

ক্রোধসংবরণ লক্ষ্মণের প্রকৃতিবিরুদ্ধ। রামচন্দ্রের বনবাসের কথা শুনিয়া ভরতের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা, তদুপরি পিতা দশরথকে হত্যা করিবার যে ঘৃণ্য চিন্তা তাঁহার মস্তিষ্কে আসিয়াছিল, সেসকল দোষ নিজগুণে ক্ষমা করেন নাই রামচন্দ্র? 

তবু কেন সংশয় জাগে সকল অপ্রিয় কাজগুলি তাঁহারই স্কন্ধে ন্যস্ত করিয়াছিলেন রাঘব? বালী হত্যার পর কিষ্কিন্ধাপতি হইয়া সুগ্রীব যখন সীতা অন্বেষণ ভুলিয়া বিলাসে ডুবিয়া ছিলেন, লক্ষ্মণকে দূত করিয়া রাজসভায় প্রেরণ করিয়াছিলেন তিনি। একাকী লক্ষ্মণ ক্রোধোন্মত্ত হইয়া বহু কুকথা বলিয়াছিলেন সুগ্রীবকে। বানরসৈন্য তাঁহাকে হত্যা করিলেও কি কিছু করিবার ছিল তাঁহার? নাকি অপরিসীম আস্থা ছিল লক্ষ্মণের শক্তি এবং বিচারবুদ্ধির উপর? তাই বোধকরি রাবণপুত্র মহাশক্তিধর অতিকায় এবং মায়াবী ইন্দ্রজিতের হত্যার ভার তাঁহার উপরেই ন্যস্ত করিয়াছিলেন শ্রীরাম! 

কিন্তু একি কেবলই আস্থা? রামচন্দ্র কি পারিতেন না এই সকল রাক্ষসকে হত্যা করিতে? বিশেষত মহাবীর হনুমান, মহাশক্তিধর সুগ্রীব যখন তাঁহার সহায় ছিল? আবার, একথাও কি সত্য নয় যে মহান বীর ইন্দ্রজিত বধের ভার লক্ষ্মণকে দিয়া পক্ষান্তরে তাঁহার বীরত্বকে সম্মান জানাইয়াছিলেন শ্রীরামচন্দ্র? লঙ্কাবিজয়ের কাহিনীতে লক্ষ্মণের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখার জন্যই এই কর্তব্য তাঁহাকে দেওয়া হইয়াছিল? 

এপথের ভাবনাটিই সঠিক। এতক্ষণে লক্ষ্মণ আশ্বস্ত হইলেন। দেবতা রামের প্রতি সন্দেহের অগ্নি যা তাঁহাকে অদ্যবধি দগ্ধ করিতেছিল, তাহা শীতল বারিধারা লাভ করিল যেন। 

কিছু প্রশ্ন তবু স্ফুলিঙ্গের ন্যায় মনে উড়িতেছে। সীতামাতার প্রতি রামচন্দ্রের আচরণ। ধর্মপালনের পথ কি কঠোর! স্বর্ণলঙ্কা বিজয় সম্পূর্ণ হইয়াছে। বিভীষণকে লঙ্কাধিপতি ঘোষণা করিলেন শ্রীরামচন্দ্র। সীতাদেবী স্বয়ং ভর্তাকে দেখিতে তাঁহার ইচ্ছা ব্যক্ত করিয়াছেন মহাবীর হনুমানের নিকট। রামচন্দ্রের আদেশে অশোকবন হইতে আনীতা হইলেন জানকী। শিবিকা হইতে অবতরণ করিয়া রাজনন্দিনীকে পদব্রজে আসিবার নির্দেশ দিলেন কৌশল্যানন্দন। এ কেমন আদেশ? দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর নির্জনে আলাপই কি বাঞ্ছনীয় নয়? রামচন্দ্রের আদেশে সীতামাতা সমস্ত বনবাসী, বানরভল্লুকাদির সমীপে রাজদর্শনে আসিলেন। লজ্জায় নিজের দেহেই লীন হইয়া যাইতেছিলেন বৈদেহী। এখানেই অন্ত হয় নাই। নিষ্পাপ সীতামাতার চরিত্রের প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করিয়া তাঁহাকে পরিত্যাগ করিয়াছেন রঘুকুলপতি। সীতা উদ্ধারের মাধ্যমে তিনি রাজধর্ম পালন করিয়াছিলেন মাত্র। রাবণের হস্তে সীতার নিপীড়ন রামচন্দ্রের বংশগৌরব ক্ষুণ্ণ করিয়াছে। তাই সীতাকে মুক্ত করিয়া লক্ষ্মণ, ভরত, শত্রুঘ্ন, সুগ্রীব অথবা রাক্ষস বিভীষণ যাহাকে ইচ্ছা তাহাকে গ্রহণের আজ্ঞা দিয়াছেন। কিন্তু মাতাসীতা অভিমানবশতঃ সত্যই বিভীষণের অঙ্কশায়িনী হইলে বংশগৌরব বৃদ্ধি পাইত কি? ইহা যেন পতিধর্ম পদদলিত করিয়া রাজধর্ম পালন! সীতাদেবী কিন্তু বংশের মর্যাদা এবং পত্নীর স্বাভিমান উভয়ই নিরঙ্কুশ রাখিতে অগ্নিতে প্রবেশ করাই স্থির করিলেন। সেই অগ্নি প্রজ্জ্বলনের ভার পড়িল লক্ষ্মণের উপর। কেহ রামচন্দ্রকে অনুনয় করিতে সাহস করিলেন না। দেবগণ আসিয়া সীতা উদ্ধার না করিলে লঙ্কায় সীতা বিসর্জন করিয়াই আসিতে হইত। 

কিন্তু সম্পূর্ণ ভাবে গ্রহণ করিয়াছিলেন কি তিনি বৈদেহীকে? নতুবা পুনরায় রাজধর্ম পালনার্থে সন্তানসম্ভবা জানকীকে পরিত্যাগ করিলেন কেন? সীতাকে নির্বাসনের ভার পড়িল পুনরায় সৌমিত্রির উপর। কি নিদারুণ কঠিন দায়িত্ব! সহায় সম্বলহীনা একাকী সন্তানসম্ভবা নারীকে অরণ্যে নির্বাসন। কী আকুলভাবে কাঁদিতেছিলেন বৈদেহী! তখনই কি স্থির হইয়া যায় নাই সৌমিত্রির ভাগ্য? প্রাণপ্রিয়া সীতাদেবীকে হেলায় পরিত্যাগ করিতে পারিলে তাঁহাকেও জীর্ণ বস্ত্রের ন্যায় পরিত্যাগ করিতে পারেন ধর্মাত্মা রামচন্দ্র! 

এসব কী ভাবিতেছেন লক্ষ্মণ? তাঁহার চিন্তাশক্তি লোপ পাইতেছে কি? ধর্মের নিমিত্ত সকল কিছু পরিত্যাগ করিতে পারা যায়, কিন্তু কোনও মূল্যেই ধর্মকে পরিত্যাগ করা যায়না- এই শিক্ষাই তো পাইয়াছেন চিরকাল। তবে কেন সংশয়? ব্রহ্মার দূতের সহিত গোপনে পরামর্শ করিতেছিলেন রামচন্দ্র। প্রতিহারীকে সরাইয়া লক্ষ্মণকে দ্বাররক্ষার ভার দিয়াছিলেন। দুর্বাসা মুনি আসিয়া সেই গোপনীয়তা ভঙ্গ করিয়া দেন। দ্বাররক্ষক লক্ষ্মণ গোপনীয়তা রক্ষার প্রতিজ্ঞাপালনে ব্যর্থ হইয়াছিলেন। তাইতো এই দণ্ড। রাজাজ্ঞা পালনের ব্যর্থতার দায় তো লক্ষ্মণ স্বীকার করিয়াছেন। তবে কেন দুর্বলতা মনকে অধিকার করিতেছে? দেবতাকে সন্দেহ করিবার মতো ঘৃণ্য কাজ করিয়াছেন লক্ষ্মণ। রামচন্দ্র আপন ধর্মপালন করিয়াছেন, এক্ষণে তাঁহার পালা। 

মনস্থির করিয়া আচমন করিলেন লক্ষ্মণ। রামচন্দ্রের ধ্যান করিলেন। সমস্ত ইন্দ্রিয়দমন দমন করিয়া শ্বাসরুদ্ধ করিলেন। লক্ষ্মণের সংজ্ঞাহীন দেহ যখন খরস্রোতা সরযূ নদীতে বহিয়া গেল, কেহ তাহার সাক্ষী রহিল না।




2 comments: