0

ধারাবাহিক - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

Posted in


ধারাবাহিক


দিনমণি 
ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়




পূর্বকথা--

দেশে তখন ইংরাজ রাজত্ব চলিতেছে, তৎসত্ত্বেও নানা স্থানে স্বাধীন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজা ও জমিদারেরা বসবাস করিতেছিলেন, তাঁহারা নিজেদের মতো করিয়া রাজ্য শাসন করিতেন, রাজন্য প্রথার বিলুপ্তি ঘটে নাই। যদিও দেশের সর্বত্র স্বাধীনতার আগুন জ্বলিয়া উঠিয়াছিল।

সেই সময়ে অখ্যাত এক গ্রামের সম্পন্ন গৃহস্থ হইতে এক বালক গৃহত্যাগ করে। এই গৃহত্যাগের সাক্ষী ও সহায়ক ছিলেন ওই পরিবারেরই আশ্রিতা, অনাথা এক বৃদ্ধা রমণী। বালকটির পিতামাতা অপেক্ষাও তিনি ছিলেন তাহার আপন। বালকটী আর কেহ নহে, সেই সম্পন্ন পরিবারের গৃহকর্তার চতুর্থ ও কনিষ্ঠ সন্তান জ্ঞানতোষ। একই দিনে বালকের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার কারণে গৃহে পুলিশের পদার্পণ ঘটে, যুবকটি ফেরার হয়, কোনও সন্ধান পাওয়া যায় না। ভ্রাতাটির বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সাহায্য করার এবং স্থানীয় রেললাইনে বোমা রাখার অভিযোগ পাওয়া যায়।

কিন্তু গৃহসুখে প্রতিপালিত বালকটির গৃহত্যাগের কারণ কি? তবে কি সেও ভ্রাতার ন্যায় স্বদেশী সংগ্রামে লিপ্ত? 

গৃহত্যাগী বালকের সংবাদ বেলা বাড়িবার সঙ্গে সঙ্গে বাটীস্থ সকলের কর্ণে প্রবেশ করিয়াছে, গৃহকর্তা পারুলবালা নামক বধূটিকে ডাকাইয়া জিজ্ঞাসাবাদ করিতে বধূটি ভয়ে সংজ্ঞা লুপ্ত হইয়াছেন। বালকের সংবাদ এখনও পাওয়া যায় নাই, কিন্তু যে বৃদ্ধার সহিত বালকটির এত অন্তরঙ্গতা, সেই দিনমণি ভয়ে, দুশ্চিন্তায় দুর্বল শরীরে সংজ্ঞা লুপ্ত হইলেন।

অন্দর মহলেও ভারি ঝড় উঠিল। শিবতোষ দারুণ রোষে সকলকে জিজ্ঞাসাবাদ করিবার জন্য ডাকাডাকি করিলেও পারুলবালার কাণ্ড-কারখানা দেখিয়া ভীত হইলেন, পরে বিস্তর চ্যাঁচামেচি করিতে লাগিলেন। বাটিস্থ সকলে তাঁহার ব্যবহারে ভীত সন্ত্রস্ত হইল। বাস্তবিক সকলকে জিজ্ঞাসাবাদ করিলেও দিনমনিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় নাই। সেকথা মনে পড়িতেই শিবতোষ বহির্বাটিতে যাইয়াও ক্রোধে অগ্নিশর্মা হইয়া পুনরায় অন্দরে প্রবেশ করিলেন।

অতঃপর...



পর্ব - ৯


শিবতোষের হাঁকডাক শুনিয়া হন্তদন্ত হইয়া মালতী অন্দরের উঠানে বাহির হইয়া আসিল। বেলা প্রায় দ্বিপ্রহর হইয়াছে কিন্তু শিবতোষ বৈঠকখানা হইতে এখনও ভিতরে আসেন নাই। ইহারই মধ্যে এমন কি হইল যে তিনি উচ্চৈঃস্বরে হাঁক পাড়িতেছেন! প্রত্যুষ হইতেই আজিকার সংসারে যেন কি এক দুর্বিপাকে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটিয়া চলিয়াছে। তবে কি তাহারও কিছু ভুল হইল, নচেৎ তিনি এইরূপ আচরণ করিবেন কেন? মালতী শিবতোষের সহিত সম্পর্কে দূর অথবা নিকট যেমন প্রকারেরই আত্মীয়া হউক না কেন, আদতে আশ্রিতা। শিবতোষ কিংবা গৃহিণী কখনই একতলার কুঠুরিবাসীগণের সহিত অন্তরঙ্গতার সম্পর্ক স্থাপন করেন নাই, অন্তরঙ্গতা হউক তাহাও চাহেন না। বস্তুতঃ সম্পর্ক অনেকাংশেই প্রভু-ভৃত্যের। কিন্তু এক্ষণে শিবতোষ যে ভঙ্গিতে ছুটিয়া আসিতেছেন এবং মালতীকে ডাকিতেছেন তাহাতে অন্তরঙ্গতা নাকি প্রভুত্ব কোনটি বেশী ফুটিয়া উঠিতেছে, মালতী ঠিক বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছে না। সে সভয়ে শিবতোষের সমুখে আসিয়া দাঁড়াইল।

শিবতোষ মালতীকে সমুখে দেখিয়া ক্রুদ্ধ গর্জন করিয়া উঠিলেন—একতলার সবাইকে ডাকা হয়েছিল?’

বিস্মিত মালতী নীরবে মাথা নাড়িল। শিবতোষ আরও গর্জিয়া উঠিলেন---পিসি কোথায়, দিনু পিসির কথা বলছি! কই সে, ডাক তাকে...হারামজাদী মেয়ে, কথা না শুনলে এখানে বাস তোমার ঘুচিয়ে দেব, ঘাড় ধরে রাস্তায় বার করে দেব। সবাইকে ডেকেছিলি তো দিনু পিসি বাদ গেল কি করে? আবার মাথা নাড়া হচ্ছে..! পিটিয়ে গায়ের চামড়া তুলেল দেব তোমার...ডাক তাকে, এক্ষুণি ডাক...!’ বলিতে বলিতেই স্মরণ হইল বাহিরের বৈঠকখানায় অতিথি বসিয়া আছেন। পিছন ফিরিলেন। আবার ঘুরিয়া দাঁড়াইলেন--- খাবার পর যেন পিসি আমার সঙ্গে দেখা করে, নিয়ে আসবি তাকে। আমারই খাচ্ছ, আমারই পরছ, আবার আমারই দুষ্ট চিন্তা!...দয়া করে দুষ্ট চিন্তা না করে, যাদের দয়ায় আছ, যাদের খাচ্ছ, তাদের কথা ভাব, ধিঙ্গি মেয়ে কোথাকার...!’ আর দাঁড়াইলেন না। অতিথিকে বিদায় দিয়া অন্দরে আসিতে হইবে, বেলা যায়। শিবতোষের রাগকে সকলেই ভয় করে। কতকগুলি মুখ আড়ালে উঁকিঝুঁকি মারিতেছিল, কেহ কেহ সামনে আসিল, তাহাদের মধ্যে সোনা পিসি সর্বাগ্রে। শিবতোষ মালতীকে ধমক দিয়াছেন, তাহাতে কিঞ্চিৎ খুশি হইয়াছেন কিন্তু মুখে আসিয়া আপনমনে বলিতে লাগিলেন—তা বাছা, তোমার অন্যায় তো হয়েইছে, দিনু পিসি কর্তার পিসি। তেমনভাবে ধরলে তিনিই হলেন গিয়ে এবাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠা, তাঁকে বাদ দিলে তো শিবুর রাগ হবেই!’ বলিয়াই ফিস্‌ফিস্‌ করিয়া বলিয়া উঠিলেন---আ মর্‌! ছুঁড়ী কেঁদেই ভাসাচ্ছে...বলতে পারিস্‌নি, দিনু পিসি ঘরে নেই, তাইলে তো চুকে যেত!’ 

মালতী নিজের ভুল বুঝিতে পারিয়াছিল। তাহারই পার্শ্ববর্তী ঘরে দিনমণির অবস্থান। প্রত্যহ তিনিই তাহাকে জাগাইয়া দেন, কিন্তু আজ সকালে তো তিনি আসেন নাই। এতক্ষণে মালতীর মনে পড়িল, তাঁহাকে সারাদিনে গৃহের কোথাও দেখিতে পায় নাই। তাহা হইলে তিনি কোথায় গিয়াছেন? ঠাকুরঘরের কাজগুলি কে করিল, পূজার ফুল কে তুলিয়া দিল! সুন্দরিকে হতবাক করিয়া মালতী ত্র্যস্তপায়ে ঠাকুরদালানের দিকে চলিল।

ঠাকুরদালানে গিয়া দেখিতে পাইল দেবতার পূজা, স্নান অন্যান্যদিনের মতো সবই সমাপ্ত হইয়াছে। আগেকার দিনের বাসি ফুলগুলিও যথাস্থানে ফেলিয়া দেওয়া হইয়াছে। মন্দিরের দ্বার রূদ্ধ। অর্থাৎ মন্দিরের পূজারী বামুন পূজা সমাপনান্তে ফিরিয়া গিয়াছেন। তাহা হইলে পিস্‌ঠাকুমাকে কোথাও দেখা যাইতেছে না কেন? চারিদিক আরও একবার ভাল করিয়া দেখিয়া অন্দরের উঠানে ফিরিয়া আসিল মালতী। তাহার বিস্ময় তখনও কাটে নাই। ত্বরিতপদে একতলার দিনমণির ঘরখানিতে প্রবেশ করিল। দেখিল দিনমণি তথায় আপন শয্যায় উপুড় হইয়া পড়িয়া আছেন, একপ্রকার সংজ্ঞাহীন। মালতী কি করিবে বুঝিতে পারিল না। পিস্‌ঠাকুমা কতক্ষণ এইরূপ পড়িয়া আছে, কে জানে! একবার ভাবিল কাহাকেও ডাকিবে। পরক্ষণেই কি মনে করিয়া দিনমণির হাত ধরিয়া নাড়া দিল, প্রবল জ্বরে গা পুড়িয়া যাইতেছে। দিনমণিকে ধরিয়া এইবার অল্প ঝাঁকুনি দিল, তাঁহার কোনও হুঁশ নাই। মালতী চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল---পিস্‌ঠাকুমা... ও পিস্‌ঠাকুমা...পিস্‌ঠাকুমা গো...!

(ক্রমশঃ)

0 comments: