1

প্রবন্ধ - উত্তম বিশ্বাস

Posted in

প্রবন্ধ


কুয়োতলার কাব্য 
উত্তম বিশ্বাস 



‘ময়লা কাপড় রুক্ষ মাথা / দুঃখ বলে থাকি কোথা! 
কোঁকের কাঁটা ক্যাতার (কাঁথা) সুঁই / কেঁচোর নাড়ি শীতের পুঁই!’ 

বুড়ি আয়ি! বাঁ হাতের তালুতে একঝাকা এঁটো বাসন নিয়ে জলের ধারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কত কাব্যই না করে যায়! বুদবুদের মতো ফেনিয়ে ওঠে কথা। কোনটা ভেসে ওঠে কোনটা হেসে ওঠে; আবার কেউ কেউ ঝিমকেটে বীজ বোনে ঘোলাটে জলের দেশে! কে শোনে কারও কথা! তরিবালা আসে, পেছনে ঘ্যাচড় দিতে দিতে আসে মাজাভাঙ্গা আধমরা ধাই! ক্ষ্যামার মা আসে, পানপাতার মতো থুতনি নাচাতে নাচাতে আসে খয়েরি হরিমতি--- এরা সকলেই কবি! একেবারে সহজাত কবি! যদিও এদের জন্যে সময় অসময়ের একমাত্র সম্মানজনক সাহিত্যের ঠেক হলো কেশেমোড়লের কুয়োতলা! না গো! এরা কস্মিনকালেও কফিহাউসের নাম শোনেনি! বুড়ো বটতলা অথবা ভীষ্মমোড়লের আটচালা মাটির বারান্দাই ছিল এদের যৌবন বার্ধক্যের চুনকামহীন আলোমাটির নন্দন! এত যে উদয় অস্ত কলকল খলখল ছলছল ঝনঝন শনশন কাব্যের লহরি ওঠে তার যোগ্য সমাজ স্বীকৃতি কি ওরা কেউই পেয়েছে! না, পায়নি! রেশমের উত্তরীয় তো দূর অস্ত; মনের সুখে ঠ্যাং ছড়িয়ে মনসার ভাসান শুনতে গিয়েও একমুঠো পলবিচুলির জন্যে ওদের কত না কাড়াকাড়ি হুড়োহুড়ি! অথচ দ্যাখ, বছর বিয়োনে গাভীর মতো কত কবিতার জন্ম দিয়ে গেল ওরা! কেউ আঁতুড়েই এক খামচা নুন পেয়ে চুপ থাকল, কেউ এঁটো বাসনের সাথে কপাল ঠুকে ঠুকে মলো, আবার কেউবা কাস্তের আগায় লাঙলের ফলায় কামারের হাঁপরে জান কয়লা করে দিতে দিতে অলক্ষ্যেই মিলিয়ে গেল মহাকালের অতল তলে! তখন তো শ্বাশুড়ি ভাজের কুরুক্ষেত্র আর কাঁখে একটা কোঁকে একটা, মেঝেয় চারটে গড়াগড়ির যুগ! তার পরেও কোন এনার্জিতে কবিতায় প্রেগন্যান্ট হতো কি জানি বাপু! তবে রহস্য একটা রয়েই যায়; এরাই কি কবিতার আদি জননী, নাকি ধাই---সঠিক বলতে পারেনা কেউ! শুনেছি ইঁদুরের গর্তেই নাকি আদি ফসলের গন্ধ পাওয়া যায়; ঠিক তেমনি ওদের হৃদের ক্ষত থেকে যে ব্যথা, যে উত্তাপ বেরিয়ে আসত তা অন্য কোনও হেঁয়ালি বা খনার বচনে সেই উষ্ণতা পাওয়া যায় না! পুত্রকন্যা পরিবেষ্টিত একান্নবর্তী সংসার; হয়তো ধনেজনে সম্পদশালীও--- তবু তার মাঝেও সূক্ষ্ম ফাটল ধরা পড়ে শাশ্বত সত্যরূপে--- 

‘কাচের গেলাস চিনের বাটি 
এতে শুধু পয়সা মাটি!’ 

প্রাপ্তি আর প্রত্যাশার সঙ্গে বরাবরই ব্যাস্তানুপাতিক সম্পর্ক, এটা আবহমানকাল ধরে বয়ে চলা নিয়ম। কিন্তু অদৃষ্টের এই নিষ্ঠুর গাণিতিক উদাসীনতাকে মানতে চায় না জীবন! তাই তো গরম হাপরের মতো ফুসফুস ঠেলে বেরিয়ে আসে বীতরাগ হাওয়া--- 

‘পুড়া কপালে ভিটের দোষে 
মুততি বসলি হাগা আসে!’ 

ভাবুন একবার! শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়ার সাথে নিয়তি নির্দেশকে একাসনে বসাতে হলে কতখানি উঁচুদরের কবিত্বশক্তির প্রয়োজন হয়! 

আত্মার আলপনায় অন্তরের আঙিনা রঙিন হয়ে ওঠে! উঠোন উঠে আসে অন্দরে; অন্দর আহ্বান করে নিখিলের নিবিড় সখ্যতা! কিন্তু সেখানেও ঝনঝনিয়ে খসে পড়ে মেকি সত্যাসত্যের শার্শি! স্বার্থ আর পরার্থপরতার পরশপাথরের ঘষাঘষিতে উঠে আসে আসল সোনা ---

‘জল আওলাও জল আওলাও 
জল কখনও ঘুলা না। 
হিদের মাছ (মাঝ) কেটে দেখ 
পর কখনও আপন না!’ 

মাঝ’খানটিকে যদি ‘মাছ’ ধরেও পড়া হয়, সেখানেও কী বিচিত্র রঙিন পাখনা নেড়ে যায় জীবন-সমুদ্রের আশাচারলোভী মীনেরা! 

কাঠঘুটের আখা। যেখানে আগুনের চেয়ে ধোঁয়ার হল্লাই বেশি, সেখানে অকারণ সোহাগ সাঁতারে ভাসতে দেখলে হাঁড়ি মাজা কেলে আইবুড়ি দাসীরও অঙ্গে ঝামা ক্ষরিয়ে ওঠে--- 

‘মাগীদের ঠ্যাকার বুঝবে কার বাপে 
কেস্তের ঠোকা মেরে বলে কেমড়েছে আমার সাপে!’ 

কিম্বা--- 

‘ঠ্যাকার ঠ্যাকার করে গা 
আখার মদ্দি দিয়ে পা! 
ঝ্যেকন আসব্যান বাড়ি তুলবান পা 
না ঝদি আসে পুড়ে যাক গা!’ 

ষোলকলার নারী মনস্তত্ত্ব অধ্যয়ন করতে আমাদের মা ঠাকুরমারা আয়িরা তো সেদিন ব্যাতসায়ন কিম্বা ফ্রয়েড অধ্যায়ন করেনি! নিদেন পক্ষে তাদের মধ্যে কেউ কেউ একটা দাশুর পাঁচালিও পড়তে জানত না; তবে কোথায় পেল তারা এই অপূর্ব বিদ্যা! 

তুর্কি তাতার থেকে শুরু করে যুগযুগ ধরে কত দল উপদলের হাতে উঠে এসেছে বাংলার শাসনভার। একদিকে প্রজাপালনে অপদার্থতা, অপরদিকে লাগামহীন স্বৈরাচার! পীড়িত প্রজার তিতিক্ষা যেন গোষ্ঠহীন গাভীর মতো ঝড়বাদলে অবনত মস্তকে ভেজা আর রৌদ্রোজ্জ্বল সকালের জন্য প্রতীক্ষা করা ছাড়া কিছুই থাকে না--- 

‘অভদ্রা বর্ষা কাল 
হরিণ চাটে বাঘের গাল! 
শোনরে হরিণ তোরে কই 
কালগুণে সবই সয়!’ 

এই অমোঘ কথাগুলো সত্যিই কি শুধুমাত্র সাবেক কালের গণ্ডিতে ফেলে রাখা যায়! বর্তমানে রাজনৈতিক কদাচার অশিক্ষিতের হাতে শিক্ষা সংস্কৃতি রুচি আদর্শের আদ্যশ্রাদ্ধ দেখলে আমাদের অন্তরাত্মাও কি আরও একটিবার সম্ভাব্য সুদিনের জন্যে এইভাবে প্রতীক্ষা করে না ? 

‘থাক রে পরাণ সয়ে 
ভাদ্দরমাসে ভাত দেব তোর / ঝিঙের ঝোল দিয়ে!’ 

অপরদিকে আটপৌরে মানুষের জীবনদর্শনও রচনা করে গেছে তারা আটকুঠির নোনালাগা দাওয়ায়... 

‘ভাগের ভুঁই ভাগে দিয়ে / যাওয়া আসা সার!’ 

কিম্বা,

‘ভোগের মা শালিমাগী / আমাকে দেখে গোসা করিল!’ 

ভোগসুখ বঞ্চিতা নিরক্ষরা জগতসংসার এছাড়া আর কিভাবেই বা তার ব্যথার ব্যঞ্জনা রেখে যেতে পারে! 

সাতপাঁচে মুখরিত পাড়া। পাঁচকানে পঞ্চমুখ দেশিয়ালি নেটওয়ার্ক! ওদের মধ্য কেউই হয়তো পড়েনি মন্থরা, জানেনা বড়ায়ি; তবু পাড়াতুত কৌটিল্য আয়িকে চিনতে ভুল করে না কেউ--- 

‘কাক কক্ক কক্কধাড়ি 
কক্ক বেড়ায় বাড়ি বাড়ি। 
হ্যাদে কক্ক শুনে যা 
চাচির ফাড়া গুণে যা! 
চাচি লো চাচি 
এগিয়ে এসে শোন, 
যবন ঘরে বিশ্বাস নেই 
মামাতুত বোন!’ 

অথবা, 

‘মুখ দালালী কাঁঠাল কুশি 
আমার বাড়ি যেও। 
হাঁড়িতে ভাত নেই 
লেবু দিয়ে খেও!’ 

নারীর আত্মমুকুরে চিরবসন্তের তৃষ্ণা লেগে থাকে! বার্ধক্যকে জরাকে সে কখনই স্বীকার করে না! আজকের অরিষ অ্যারমা্থেরাপির জাদু তাদের কতখানি প্রোটেকশান দিতে পেরেছে জানিনা। তবে চিলেকোঠায়, খোলা ছাদে উঠোনের শুকনো পাতায় আজও মর্মরিত হয় হারানো লাবণ্যের দীর্ঘশ্বাস--- 

‘আম শুকোলি আমসি 
আর যৈবন গেলি কানতি বসি!’ 

অথবা,

‘আয় রে যৈবন ফিরে আয় 
বুড়ির দোর দে’ কড়ি যায়!’ 

এই যে প্রচেষ্টা আর ব্যর্থতার বেদনার ইতিহাস নিতান্ত সাদাকালিতে ব্যাখ্যা করা যাবে না বোধহয়! তবে একালের কবিতার ভাষায় এভাবেও হয়তো খানিকটা ধরা যায়--- 

‘কাজল মাখিতে মাখিতে / আয়নার কুচি 
চোখের কোটরে নখ / খুঁটে মরে মিছিমিছি! 
পলক ঝরিয়া যায় / বয়সের তাড়া; 
লাথিঝাঁটা খেয়ে মরে / আয়নার পারা!’ 

সমাজ আর সংস্কার নিয়েই যেসব মানুষের বাঁচতে হয়; তারাও কখনও কখনও সমাজের চোখে ধুলো দিয়ে আপন অস্তিত্ব রক্ষার কৌশল অবলম্বন করে বাঁচে! কিন্তু সেখানেও জহুরি চোখ আতস কাচ হাতে নিয়ে হাজির হয়,

ধান নেই পান নেই / গোলাভরা ইঁদুর; 
ভাতার নেই পুত নেই / সিঁথি ভরা সিঁদুর!’ 

কিম্বা,-- 

‘কোনদিন দ্যাখলাম না কাত হয়ে শুতি 
নিত্য দেখি মাদুর ক্যাতা (কাঁথা) ধুতি!’ 

একদিকে পরকীয়া, অপর দিকে সমাজের রক্তচক্ষুর শাসানি; উভয়ের যাঁতাকলে পিষ্ট হয় জীবন... 

‘ধরিছি স্বপন পাখি / সব ছেড়ে দে’ একটা রাখি!’ 

অপর পক্ষের আন্তরিক অথচ নিষ্ঠুর সতর্কতা---

‘নাঙ মলে কেঁদো না / চুরা ধন চেও না!’ 

আসক্তি বাসি হতে হতেও একসময় বাসনা শুকিয়ে আসে; ঘরদোর গ্রাস করে বৈরাগ্যের ব্যথা, 

‘গোঁসাই তুমি ব্যালক হও / আমি আপ্ত(আত্ম ?) রেখে আছি!’ 

অথবা, 

‘আশা করে বাঁধলাম বাসা / না রাখিলাম দোর! 
অগ্নিতে পুড়ে মরলাম / জলের ভেতর!’ 

বুড়ি আয়ি তরিবালা হরিমতি খ্যামার মা, আজ আর কেউই নেই মহাকালের নিয়মকে মাথাপেতে নিয়ে ওরাও বিদায় নিয়েছে কুয়োতলা থেকে! ছ্যাতলা পড়া ঘাটে, এঁটো বাসনের কানায় ঘাসপাতার নুড়োতে রেখে গেছে যে বিপুল কাব্য সম্ভার তার কি মৃত্যু আছে; মৃত্যু নেই! ঘোলা ঘাটের ছলাতছল ঢেউ বলে আদি নিয়মের কথা--- 

‘হউত মউত বিয়ে 
তিন দেবতা নিয়ে। 
হউত লেখে গায় 
মউত লেখে পায়; 
যার যেখানে মরণ 
পায়ে হেঁটে যায়!’ 

সবশেষে বলি, আমাদের আয়ি, মা খুড়িরা প্রথাগত অর্থে আদৌ কেউ কবি নন! কবিতার আদি আঁতুড়ঘর ছিলেন মাত্র! আজকে আমরা যারা বাংরেজি বাগদত্তার বাহুবন্ধনে আবদ্ধ শিরোমণি চূড়োমণি বাক্যবাগিশ যে যা’ই হই না কেন; তাদের সঞ্চিত সঞ্চয় আজ আমরা রক্ষা করতে পারি আর না পারি; শ্রদ্ধার সদিচ্ছা থাক আর না থাক--- ফ্যাশান আর মোশানের ঠাটে এটুকু স্বীকার করতে আমরা যেন কেউই এতটুকু কুণ্ঠিত না হই!


1 comment:

  1. প্রচ্ছদ শিল্পীকে আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ! ভাবতেই পারিনি এমন একটি ছবি এই প্রবন্ধটি উপহার পাবে !

    ReplyDelete