ধারাবাহিক - রাজর্ষি পি দাস
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
ফেরা - ৬
রাজর্ষি পি দাস
১৬।০৪। ২০১১
জন্মদিনগুলো অদ্ভুদ, শুধু ছোটবেলাতে বুঁদ হতে চায় আর রাতে মদ আর যৌনতা!
বাঁটুল দ্য গ্রেট
সেই সুশান্তদের বাড়ি থেকে প্রায় উবু হয়ে একটা মোটা মাগুর মাছের পিছন পিছন পিকলুদের বাগানে ঢুকে গোলাপ-গাঁদা–তুলসীর গোড়া লণ্ডভণ্ড করে কাদাজল আর বৃষ্টিতে একাকার হয়ে থমকে গেলাম এক মেয়ে গলার ধাতানিতে– কেরে ওখানে? বৃষ্টির জলে সব ঝাপসা দেখছি। সুন্দরী ঝাপসা হলেও সুন্দর, চিনতে পারলাম চিত্রাদি।
চিত্রাদি আমাদের পাড়ার সবচেয়ে সুন্দর মেয়ে, মেয়ে বলছি কারণ মেয়ে বলতে ভাল লাগছে। আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়। ওর বাড়ির সবাই ভীষণ সুন্দর দেখতে। বর্মণ, দে আর চ্যাটার্জী বাড়ির মতো। কিন্তু চিত্রাদি সবার থেকে আলাদা। ওর হাঁটা, ঘুরে তাকানো, কানের উপরের চুল সরিয়ে সারসের মতো গ্রীবা নিয়ে দেবী-চিবুক আকাশে তোলা, কণ্ঠস্বর, তার উপর আবার বইয়ের ভাষায় কথা বলে। বাঁটুল, নন্টে-ফন্টেরা যে ভাষায় কথা বলে চিত্রাদির পুরো পরিবার ঐ ভাষায় কথা বলে। কিশরকুমারের ‘কি দারুণ দেখতে’ গানটা মনে হতো চিত্রাদির জন্যই লেখা। এবং চিত্রাদি জানত সেটা, পাড়ার বেশ কয়েকজন দাদারা ‘কি দারুণ দেখতে’ গানটা দিয়ে যেন চিত্রাদিকে পুনারবিস্কার করল। ‘চোখ দুটো টানাটানা’ - চিত্রাদির প্রেমিকের সংখ্যা দুটো ফুটবল টীম থেকেও বেশি হয়ে দাঁড়াল- আঃ ‘কি দারুন দেখতে!’ আমরা ছোটরা রুব্বান দাদুর মতো মুখ করে হাসি। চিত্রাদি ঐ প্রায় নিহত দাদাদের সামনে আমাদের সঙ্গে কথা বলত। কি ভঙ্গি। কথা বলতে বাগানের ফুল চুরি, আচার চুরি, পিকলুর পড়াশুনা, সুঁই হারান আর পুরো কথাবার্তা একতরফাই হতো, আমাদের উত্তর বা মতামত ব্রাত্য। আমরা মাঝেমধ্যেই হাফপ্যান্ট টেনে তুলে মুখ তুলে - হুঁ আর হ্যাঁ! ভিতরে ভয়, আমাদের চোর ভাবছে নাতো! বিশেষ করে ফুল! পিছনে দাদাদের করুণ মুখ, কখন একবার চিত্রাদি তাকাবে। গুনগুন শুরু হয়ে গেছে – পরেছে লাল শাড়ি যাবে সে কোন বাড়ি- চিত্রাদি প্রায় একটা উঁচু গাছের দিকে বাঁ আকাশের দিকে ২-৩ মিনিট তাকিয়ে কথা শেষ করে কখন যে চলে যেত আমরা বুঝতে পারতাম না- শ্বশুর বাড়ি! কারণ আমরা গাছের দিকে বা আকাশের দিকে তাকিয়ে, পিছনের দাদারাও বুঝতে পারত না কারণ ওরাও আমাদের মতো গাছ কিংবা আকাশ।
সেই চিত্রাদি জানতে চাইছে কে এখানে! আবার চিত্রাদির চীৎকার – কে ওখানে? আরে আমি এখানে, থপথপ করতে করতে হাঁসের মতো চিত্রাদির সামনে দাঁড়ালাম। চিত্রাদি বারান্দায়, আমি বৃষ্টির নীচে। চিত্রদি একটা নীল হাতকাটা কি একটা পড়ে আছে। এই প্রথম চিত্রাদির হাত দেখছি, না বাহু। একটি মেয়ের বাহু এত সুন্দর হতে পারে! চিত্রাদি ওর বিস্ফারিত চোখ নরম করে – তুই রাজা না! কি করছিলি ওখানে? মজুমদার ব্যারাকে...
আমি স্থির। আমার কান্না পেয়ে গেছে। যদি মা জানতে পারে- ওহ, বাবা ডিকম বাজার থেকে নতুন বেত এনেছে।
চিত্রাদি চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলল- কি করছিলি ওখানে?
আমি ন্যাড়া কলাগাছের মতো দাঁড়িয়ে। মুখের জল মুছে – মাগুর মাছ ধরতাছিলাম।
চিত্রাদি হাসিতে এঁকেবেঁকে উঠল। এই ধরনের হাসিতে তলপেটে ব্যাথা শুরু হয়।
চিত্রাদি হাসতে হাসতে – পেলি?
আমি মাথা নাড়লাম- না!
চিত্রাদি - ভিতরে আয়, আর মাগুর ধরতে হবে না! জ্বর এসে যাবে। আয় ভিতরে আয়।
আমি পা টিপে টিপে বারান্দায়। মা আর মার খাবার কথা মনে পড়তেই আর কিছু ভাল লাগছে না। বারান্দায় এখন চারপাঁচ বালতি জল, আমার শরীর থেকে।
চিত্রাদি ভ্রু কুচকে – দাঁড়া, এখানেই দাঁড়া। বলে ভিতরে চলে গেল।
ওদিকে মাগুর মাছ্টা আটকে গেছে গাঁদা ফুলের শেকড়ে, লেজের ঝাপ্টা দিচ্ছে। লেজের ঝাপটার শব্দে নিমেষে আমার শরীরে বুনো ঝিলিক। আমিও দৌড়ে আবার বৃষ্টি, কাদা, গাঁদা শেকড় আর মাগুর। তারপর মাগুরের জায়গায় মাগুরের কাঁটা! আহা কি যন্ত্রণা। প্রথমে আরাম তারপর সোজা মাথায় ঝাঁক ভীমরুলের কামড়, বেঁকে কাদায় পড়ে গেলাম। অরে বাবা, মাগো! মাগুর মাছটা ছড়ছড় করতে করতে পুকুরের দিকে চলে গেল! আমি মাথা গুঁজে পড়ে আছি।
চিত্রাদির গলার শব্দে চোখ খুলে চিত্রাদিকে দেখলাম হংকং মার্কেটের পিঙ্ক ছাতা নিয়ে ঝুঁকে উত্তেজিত –কিরে কি হয়েছে তোর! কি হয়েছে, কি হয়েছে তোর!
কি হয়েছে বলতে গিয়ে চোখ আটকে গেল চিত্রাদির বুকে, যন্ত্রণা হাওয়া, ধবধবে দুটো উন্মুখ স্তন, পিঙ্ক আলোতে আবাস্তব মনে হচ্ছে। আমার নির্বাক মুখের দিকে তাকিয়ে তারপর আমার চোখে চোখ পড়তেই চিত্রাদি বুকে হাত দিয়ে ঢেকে নাকের পাটা ফুলিয়ে – অসভ্য ছেলে, কি হয়েছে বলবি তো। স্তন ঢাকা পড়তেই যন্ত্রণা ফিরে এল, আমি আবার কুঁকড়ে, ক্যাঁতরে – মাগুর মাছে কাঁটা ঢুকাইছে!
নতুন বৃষ্টি পুরোনো বৃষ্টিতে যোগ দিল। সাথে হাওয়া!
আসলে আমি একটু বেশিবেশি করছি। চিত্রাদির প্রায় শরীর ছুঁয়ে থাকতে পারাটা তো স্বপ্নের ব্যাপার। আমার গোঙানি থামছিল না বা থামাচ্ছিলাম না! চিত্রাদি সোফায় বসিয়ে হাতে ফুঁ দেওয়া আর মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়া কি আর হবে। আমি আর তাকাচ্ছি না, চোখ বুজে আছি, চোখ খুললে আবার যদি ওদিকে চোখ চলে যায়।
ওদিকে চিত্রাদি অধৈর্য হয়ে পড়ছে – মা, স্নান হলো তোমার...
মাসীমা– আই বা, র র...ওত চিল্লাইরার কেনে? মাগুর মাছের কাঁটাত কিছু থাকে না...শিঙ্গি মাছ হইলে মাত ছিল!
ঐ মাগুরব্যাথার মধ্যেও আমি চমকে উঠলাম। সিলেটী ভাষা শুনে! এত বুড়াদের ভাষা। চিত্রাদিরা সিলেটী! ঐ দিকে পথেঘাটে কেল্কিসিয়ান কয়!
চিত্রাদি – আজ্ঞা মা, চুণ হলুদ গরম করতে এত সময় লাগছে কেন?
প্রথম কোনও নারীর ওমে উষ্ণ হচ্ছি। এত আরাম, না আরাম নয়, শান্তি জানতাম না। মনে হচ্ছে এভাবেই বিষাক্ত পড়ে থাকি আমি চিত্রাদির কোলে, বৃষ্টি থামবে না, তারপর সূর্য উঠুক না উঠুক আমি যেন আর বড় না হই। কারণ দেখেছি চিত্রাদি বড়দের খুব একটা কাছে ঘেঁষতে দেয় না!
কিন্তু গল্প শেষ হলো দুমিনিটের মধ্যেই। চিত্রাদি আমার মাথা মুছিয়ে গামছা হাতে দিয়ে বলল- বস। একটু শুকনো হয়ে যা। ভিতরে চলে গেল। আমার ভয় ফিরে এল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম ১১ টা বাজে আমি ১০ তার সময় দশ পয়সার হলুদ আনতে বেরিয়েছিলাম। আরে, আমার হাতে তো একটা ছাতা ছিল! কি সাংঘাতিক! ছাতা কোথায়?
ভিতর থেকে চিত্রাদির গলা – টেবিলের নীচে শুকতারা আর কিশোর ভারতী আছে।
কি এগুলো? আমি ঝুঁকে একটা দেওঘরের ‘আলোচনা’-র মতো একটা বই বের করলাম। দেখলাম শুকতারা লেখা! এই প্রথম আলোচনা আর পড়ার বই ছাড়া কোনও বই হাতে। পৃষ্ঠা ওলটাতে মানুষের ছবি, ছোটছোট বক্সে লালা সাদা কালোতে কিছু মানুষ। একটা বেঁটে মোটা মানুষ আর দুটো রোগা পাতলা চেহারার বিচ্ছুর গল্প, শুধু কথার গল্প। প্রথমে পড়ে নিলাম কথাগুলো। তারপর আবার। রেখে দিলাম। বাঁটুল নাম লোকটার, কোনও কিছুতেই দমে যায় না, আর মারপিট, সবাই লোকটাকে মারছে কিন্তু লোকটার কিছু হচ্ছে না। গাছের ডাল, লোহার রড ভেঙে যাচ্ছে, এমনকি বন্দুকের গুলি ফেরত যাচ্ছে! নিজে কাউকে মারছে না, শুধু আটকাচ্ছে আর তাতেই বাকীরা দুর্দান্ত ভাবে আহত হয়ে পড়ছে।
আবার তুললাম বইটা, বাটুলকে ভাল করে লক্ষ্য করলাম, মাথা বড় দেহ ছোট- আরে কথাটা রিঙ্কুদি আর বুড়া বলে না আমাকে। আমাকে ক্ষেপায় আর আমি দুঃখিত হয়ে পড়ি। কি বোকা আমি, বাঁটুল তো এখানে মাস্তান, না মাস্তান ঠিক নয়, হিরো। আবার গোড়া থেকে পড়া শুরু করি, এই তো আমি, আমি তো আসলে এরকম হতে চাই। কতবার কল্পনা করেছি মিঠু সুবীর নন্তুকে এভাবে ধোলাই দিচ্ছি। মা আর মণি স্যার আমাকে যা দিয়েই মারুক সব ভেঙে যাবে, তারপর একদিন আসবে আমাকে মারলেই ওদের নিজের হাতে লাগবে। আমি ভয় পাব না ওরা ভয় পাবে।
২-৩ মুহূর্তের মধ্যে আমার নবজন্ম হয়ে গেল। আমার ভিতর থেকে সব ভয় ফুস। চিত্রাদিকে দেখতে ইচ্ছে করছে। আমি ভেজা জামাকাপড়ে বেরিয়ে গেলাম। মায়ের সামনে দাঁড়াতে হবে। আর ভয় নয়।
বাড়ি ঢুকতেই মায়ের প্রশ্ন – কোথায় গেছিলি...তারপর ছাতা কই – মার শুরু। মারের মধ্যেই জিজ্ঞাসা - আবার বৃষ্টিতে ভিজ্জা নালায় গেছিলি মাছ ধরতে!
মারের মাত্রা বাড়ল।
মারের মধ্যে বকা চলছে – মরতে পারস না, ট্রেনে গলা দিতে পারস না... হারামজাদা...
মারের তীব্রতা বাড়ছে। অন্যদিন হলে আমি পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতাম কিন্তু আজ নয়, আমি এখন বাঁটুল দ্য গ্রেট। কত মারবে মারো, দেখো আমি একবারও কাঁদব না!
0 comments: