0

ছোটগল্প - সার্থক মজুমদার

Posted in


ছোটগল্প


ডাক্তারবাবু 
সার্থক মজুমদার

ডাক্তারবাবুর বয়স হয়েছে। আজকাল আর রুগী দেখায় তত মন লাগেনা। রুগীরা যদিও ছাড়ে না, আসতেই থাকে। তবু তারই মধ্যে যেটুকু সময় পান ডাক্তারবাবু নেমে পড়েন বাগান করার কাজে। বাগান করার বড্ড নেশা ধরেছে আজকাল। বাড়ির তিন ধার ঘিরে এক চিলতে একটুখানি জমি। আর ছাদে একগাদা গাছের টব। এই নিয়েই মেতে থাকেন ডাক্তারবাবু।

সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন কয়েক বছর হলো। এখন মনটা যেন আর আগের মতো নেই। বাড়িতে তবুও রুগীর দল এসে ভিড় করে। বাড়িতে পয়সা নেন না ডাক্তারবাবু। কাজেই রুগীর মেলা লেগে থাকে। সারা গঞ্জের যত আধপেটা, রোগাভোগা গরীব মানুষেরা জানে, কিছু যদি হলো তো চলো ডাক্তারবাবুর বাড়ি। শুধু রুগী দেখেই শান্তি হয় না, তারপরে ওষুধ চায় মানুষে। অনেকে ভেতরপানে এসে গিন্নিমাকে খোঁজে। শাড়িটা, ধুতিটা কি শীতকালে পুরনো চাদর সবই জোগান দিতে হয় প্রয়োজনমতো। তা সবাই যে শুধু নিতেই আসে তা নয়। গাছের কলা, নারকেল থেকে নিদেন শুষনি শাক কি না নিয়ে আসে মানুষজন। ডাক্তারবাবুকে বাজার যেতে হয় না প্রায়। এইসব উপহারের ঠেলায়। নয়তো সকাল থেকে ভিড় করা রুগীদেরই কোনও না কোনও আত্মীয় গিন্নিমার কাছ থেকে থলি আর পয়সা নিয়ে বাজারটা করে আনে। ততক্ষণে পাঁচটা রুগী দেখেন ডাক্তার।

আজকাল ডাক্তারবাবু প্যান্ট শার্ট ছেড়ে ধুতি ধরেছেন। সঙ্গে ফতুয়া। প্যান্ট শার্ট পরে গাছ করা যায়না। লুঙ্গি পরে ডাক্তারিও না। তাই মাঝামাঝি অবস্থান। বাড়ির সামনের দিকে রাস্তাটা ছেড়ে তিনদিক ঘিরে এক চিলতে জমি। এক চিলতে মানে বাস্তবিকই এক চিলতে। তাতেই গাছ করেছেন ডাক্তারবাবু। কলমের আমগাছ দুটো। ছোট গাছ, দু-মানুষ লম্বা। দেখতে রোগা পাতলা কিশোরী। ফল হয় যখন ভারে নুয়ে পরে গাছদুটো। এছাড়াও পেঁপে। বাকি জমিতে কখনও টমেটো গাছের লতার ঝাড়, কখনও বেগুন, পুজোর জন্য লাল সাদা জবা আর একটা শিউলি ফুলগাছ। পেঁপে গাছ বেয়ে উঠে যায় উচ্ছের লতা, কাঁকরোল। বাড়ির আলসেতে শুয়ে থাকে কুমড়ো লতা। যা লাগান তাই ফনফন করে বাড়ে। মাটির গুণ। আজকাল বড় আফসোস হয় ডাক্তারবাবুর। আর কিছুটা জমি যদি থাকতো। আর একটু ভালো করে বাগান করা যেত। বড় কষ্ট করে বাড়িটা বানিয়েছিলেন তিনি। সরকারি চাকরির সামান্য সঞ্চয়ে ছোট এই জমিটা কিনে ধাপে ধাপে একটু একটু করে। এর বেশী তাঁর সামর্থ্য ছিল না। এখন বাড়িটা দেখতে বড় লাগে। তিনি জানেন, স্ত্রী স্বপ্না জানেন এই বাড়ির গড়ে ওঠা।

বাড়ির ছাদে একগুচ্ছ মাটির টব। সারা শীতকালটা ডাক্তারবাবুর ফুলগাছ করার সময়। কোন ভোর থেকে উঠে ছাদে গিয়ে শুরু করেন গাছের পরিচর্যা। মাটি তৈরি, তাতে প্রয়োজনমতো জৈব সার দেওয়া। ছোট ছোট বাখারি কেটে জোগাড় করা, গাছগুলো যাতে সোজা থাকে। কখনও কখনও রুগী কম থাকলে নীচে আর নামেন না ডাক্তারবাবু। ছাদেই ডেকে নেন রুগীদের। রোদে পিঠ দিয়ে চিকিৎসাও চলে, সেই সাথে চলে গাছের কাজ। গাঁ গঞ্জ জায়গা। রুগীদের মধ্যেও অনেকেই এটা সেটা জানে গাছের ব্যাপারে, তারাও হাত লাগায় গাছে। হয়তো ডালগুলো ছেঁটে দিল, কি এটার বাল্ব নিয়ে ওই টবে বসিয়ে দিল। শীতকালে ডাক্তারবাবুর ছাদ একটা দেখার মতো বিষয়। একদিকে নানা রঙের ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা আবার বাহারি লাল, গোলাপি জারভেরা, গোলাপ আর নানা রঙের গ্লাডিওলাস ছাদটাকে যেন আলো করে রাখে। আবার টবেও বিন, বেগুন, কাচালঙ্কা টুকটাক সবজি গাছও লাগান। সব মিলিয়ে শীতকালে ডাক্তারবাবু বেজায় ব্যস্ত।

স্ত্রী স্বপ্না মাঝে মাঝে বিরক্ত হন। সারাদিন ডাক্তারবাবু ছাদে উঠে বসে আছেন। স্বপ্নার পায়ে বাত, ছাদে উঠতে বেজায় কষ্ট, সচরাচর ওঠেন না। লোকে এত সুখ্যাতি করে গাছের, ফুলের, স্বপ্না দেখতেও পান না। জনান্তিকে বলেন ডাক্তারবাবুকে, ‘তোমার এত সৃষ্টি, কিছুই দেখতে পাইনা আমি। কি হয় গাছে এত ফুল ফুটিয়ে!’ ডাক্তারবাবু চুপচাপ। ভাবেন, আমাদের দুজনের যে সৃষ্টি, তাকেই বা আমরা কোথায় দেখতে পাই স্বপ্না। মুখে বলেন, ‘কেন ফুল যে তুলে আনি, পুজোয় লাগে, তুমি ঘর সাজাও’।

ডাক্তারবাবুর একটিই সন্তান। মেয়ে। সে ছিল এই গঞ্জের গর্বের বিষয়। পড়াশোনা, নাচগান সবেতে তুখোড়। বরাবর ভালো রেজাল্ট করতে করতে সে এখন নামকরা রিসার্চ করছে ক্যান্সারের কি সব জটিল কলাকৌশল নিয়ে। বিদেশে থাকে। বিয়েও করেছে সেদেশেরই এক সহকর্মীকে। ফুটফুটে সন্তানও একটি, বাপের মতো নীল চোখ। মেয়ে প্রায়ই বলে, তার কাছে গিয়ে কিছুদিন কাটিয়ে আসতে। পারেন না ডাক্তারবাবু। এই ছোট শহর, এই সব রুগীরা, এই গাছপালা সব বড্ড পিছু টেনে ধরে। কত রুগীকে মাসে মাসে দেখতে হয়, কারুর কারুর যক্ষ্মা, ওজন বাড়ছে কিনা, উপকার হচ্ছে কিনা, কে বা দেখে। গাছগুলোও কিচ্ছু বাঁচবে না, ফিরে এসে নতুন করে করতে হবে ফের, এইসব ভেবে আটকে থাকেন ডাক্তারবাবু। 

ডাক্তারবাবুর ছাদে গল্প করার সঙ্গী পাশের ছাদের গুল্লু। বছর তিন বয়স, এখনও স্কুলে ভর্তি হয়নি। মাঝে মাঝে ওপাশের ছাদে উঠে মাদুরে বসে একব্যাগ খেলনা নিয়ে খেলা করে আর রেলিঙের ফাঁক দিয়ে পা ঝুলিয়ে বসে ডাক্তারবাবুর সাথে গল্প করে। তারও অনেক কথা, হাজার প্রশ্ন। 

‘তুমি সারাদিন গাছ করো কেন?’

ডাক্তারবাবু ভাবেন, কেন যে তিনি গাছ করেন, সে কি আর সহজে বলা যায়। এই যে মাটি, সবই তো এক। এতেই একেকরকম ফুল ধরছে, ফল হচ্ছে। কতরকম রং তার, কতরকম আকৃতি, স্বাদ, গন্ধ। একই তো মাটি, একই তো জল! এসব তফাত কেমন করে হলো, কে করে দিল। কোন গাছ এক বছর ফুল দিয়ে শেষ, কোনটা আবার সেবছরের মতো ফুল ফল দেওয়া শেষ হলে বিশ্রাম নেয়, পরের বছর আবার ভরে ওঠে ফুলে। কে বলে দেয় তাদের, সময় হয়েছে ফুল ফোটানোর। এসবই দেখেন তিনি বাগানের গাছের মধ্যে। দেখেন সময়ের যাত্রাপথ, ধরার চেষ্টা করেন কোন অধরা ইঙ্গিত, যেন সমস্ত কিছুর মধ্যে কিছু একটা যোগ রয়েছে। অনুভব করা যায় শুধু, ধরা যায় না।

ডাক্তারবাবু হাসেন, বলেন ‘কি করবো বল ভাই, আমি তো বুড়ো হয়ে গেছি। আমায় তো আর তোমার মা-বাবার মতো অফিস যেতে হয়না। তাই গাছ করি’। অনেক সময় বায়না ধরে গুল্লু। পাশের বাড়ি থেকে চলে আসে এ বাড়িতে। ডাক্তারবাবুর সাথে ছাদে ঘুরে বেড়ায়, এটা সেটা বকে। স্বপ্না বলেন, ‘সাবধান, পরের খুন’। ডাক্তারবাবু হাসেন। খুন, অর্থাৎ রক্ত। পরের এবং নিজের। এই যে শিশুটা, তার পাশে পাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ছুটে এসে দাদু, দিদা বলে আদর করছে এর গায়ে পরের রক্ত। এ পর। আর যে শিশুটির ছবি দেখেছেন তাঁরা, নীল চোখ, সাত সাগরের পারে থাকে, তার শরীরে তাঁর নিজের রক্ত, সে আপন! বড় বিস্ময়!

একদিন গুল্লু বেড়াতে এসে বলল, ‘তোমায় সবাই ডাক্তারবাবু বলে কেন! বাবা মা-কে বলছিল তুমি নাকি আসলে ডাক্তার নও!’

স্বপ্নার মুখ গম্ভীর হয়। ডাক্তারবাবু হাসেন, বলেন ‘সবাই জানে না তো, তাই ডাক্তারবাবু বলে। তোমার বাবা জানে, তাই আমায় জ্যেঠু বলে ডাকে, দেখনি’।

স্বপ্না বলেন, ‘যে যা পারে বলে। কিছুই গায়ে মাখো না’। ডাক্তারবাবু বলেন, ‘কত পুরনো স্মৃতি মনে করিয়ে দিয়ে গেল বলতো, একটি কথায়!’

আজকাল ডাক্তারবাবুর বড় পুরনো কথা মনে পড়ে। সাত ভাই বোনের মধ্যে, তিনি দ্বিতীয়। পরবর্তীদের মেজদা। বাবার ছোট মুদির দোকান। কতদিন চালিয়েছেন তিনি। বাবা গেছেন বড়বাজারে মাল আনতে। মাথাটা ভালো ছিল। মুদির দোকানের মুখে মুখে হিসেব থেকেই পড়াশোনায় মাথা। ইচ্ছে ছিল ডাক্তারি পড়বেন, হলো না। ডাক্তারি পড়ার খরচ অনেক বেশী। কোনওরকমে টাউনের কলেজ থেকে একটা পাশ দিয়ে এটা সেটা করতে করতে শিকে ছেঁড়ার মতো সরকারী চাকরি। হাসপাতালের ক্লার্ক। সে সময় এসব গাঁ গঞ্জ জায়গায় কলেরার বড় উপদ্রব। যে বাড়িতে ঢোকে, সকলকে কাবু করে ছাড়ে। সে সময় বন্ধু বান্ধব জোগাড় করে এসব মড়কে অনেক খেটেছেন তিনি। রুগীর সেবা করা। কেউ মারা গেলে দাহ করতে যাওয়া। রাতের পর রাত বাড়ির বাইরে। হয় রুগীর সেবায়, নয়তো শ্মশানে। সেই থেকে কীভাবে যেন এই ডাক্তারবাবু তকমাটা তাঁর জুটে গেল। নাচাড় মানুষজন, কারুর কিছু হয়েছে শুনলে খবর পাঠায়। বিবেকের তাড়নায় না করতে পারেন না তিনি। ডাক্তারি বই কিনে ডাক্তারি শেখার চেষ্টা করেছেন সাধ্যমতো। হাসপাতালের সাপ্লাই ওষুধপত্র নিয়ে আসতেন গরীব গুর্বোদের জন্য। কিন্তু তিনি পাশ করা ডাক্তার নন। তাই কোনওদিন কারুর থেকে একটা পয়সা নেননি ডাক্তারি করে। অনেকে বলেছে মেডিক্যাল প্র্যাকটিসনারের সার্টিফিকেট জোগাড় করে নিতে। কিছুই গা করেননি তিনি। ডাক্তার তিনি নিজে হননি, মানুষ তাঁকে ডাক্তারবাবু বানিয়েছে। অনেকে বলেছে, সমাজসেবা করছো, একটা সংস্থা বানাও, সেসব পথেও হাঁটেননি তিনি। নিজের কাজ করে গেছেন নিজেরমতো করে।

এখন বাগানও করেন সেভাবেই। লোকে ফুলের প্রশংসা করে। ডাক্তারবাবু শুনেও শোনেন না। তিনি শুধু ফুল ফুটিয়ে যান। আকাশের মেঘ বাড়ির ওপর দিয়ে ভেসে যেতে যেতে সেই ফুল দেখে। দেখে ডাক্তারবাবুকে। একমাথা সাদা চুল তিনি ঝুঁকে পরে কাজ করছেন মাটি নিয়ে। দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে হয়তো সে খানিকটা ছায়া দিয়ে যায়। নারকেল গাছের মাথায় টিয়ার ঝাঁক সারাদিন চক্কর খায়। দেখে ডাক্তারবাবু কাজ করছেন। হাতদুটো রোদে পোড়া, বিকেলে এক স্কুল পড়ুয়া ছেলে এসে তাঁকে সাহায্য করছে। গুল্লু, সৌম্যদীপ। এখন সে উঁচু ক্লাসে পড়ে। প্রতিদিন একটিবার আসেই সে দাদুর কাছে, সকালে নয়তো সন্ধ্যায়। ডাক্তারবাবুর আরও বয়স হয়েছে। কানেও ভালো শোনেন না। ডাক্তারবাবু ভাবেন, শুধু বোধহয় মাটিই নয়, একটা মানুষও হয়তো গড়তে পারলাম। বীজ বুনেছি, জল, সার, ছায়া দিয়ে। অঙ্কুরটিও এসেছে। গাছ কি হবে! গাছ কি হবে! তাঁর ভাবনাটাই যেন প্রতিধ্বনি তুলে ফেরে সন্ধ্যার দখিনা বাতাস, ডাক্তারবাবু ইজিচেয়ারে শুয়ে থাকেন নীচের বারান্দায়, হাওয়া এসে গাছ গাছালির ফাঁকে ফিসফিস করে বলে হবে, হবে! 

একদিন ডাক্তারবাবু থাকবেন না। এসব গাছগুলি, মাটিটুকু হয়তো বা অযত্নে শুকিয়ে যাবে। কিংবা হয়তো তিনি বীজ বুনে দিয়েছেন অনেক গভীরে। হয়তো সেখানে ডালপালা মেলছে এক মহীরুহ। হয়তো, হয়তো।

0 comments: