প্রবন্ধ - দীপারুণ ভট্টাচার্য্য
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
চা-পান উদর
দীপারুণ ভট্টাচার্য্য
অনেকদিন আগের কথা। একজন দেওয়ালে লিখেছিলেন, "বাঙালী জাগুন।" পরদিন দেখা গেলো কেউ লিখেছেন তার পাশে, "জেগেছি, চা দিন।" আমাদের দিন শুরু হয় চা দিয়ে। কবীর সুমন তাঁর গানে তুলেছিলেন সেই অমোঘ প্রশ্নটি, "একটু ভালো চা পাওয়া যায় কোন দোকানে?" আহা সত্যিই তো, চা ছাড়া কি বাঙালীদের চলে? বিশেষ করে, আড্ডাবাজ বাঙালীদের জন্য চা এক উৎসাহবর্ধক টনিক বটে। তবে ঐ একটু ভালোর কিন্তু কোনও মাপকাঠি নেই। চায়ের গুণমান ও গুণাগুণ নিয়ে বহু চাচা চাচিকেই চোখ রাঙিয়ে গলা ফাটাতে দেখেছি। চা নিয়ে চাপান উতোর আজকের নয়। বাংলা সাহিত্যর বহু রথী-মহারথীও এই রসের রসিক। রবি বাবু শান্তিনিকেতনে চা চক্র বা চায়ের আড্ডার নাম দিয়েছিলেন "চাক্র"। এবাদে নজরুল, ডি এল রায় থেকে পরশুরাম এমনকি স্বামী বিবেকানন্দও এই একই পথের পথিক।
চা প্রথম চাষ হয় চীনে। ১৭৭৪ এ ইংরেজরা চীন থেকে বীজ এনে ভুটানে চা চাষের চেষ্টা করেন। ১৭৮৮ সনে কলকাতার বোটানিক্যাল গার্ডেনেও চাষের চেষ্টা হয়। ১৮২৩ সালে মেজর চার্লস রবার্ট ব্রুস আসামে প্রথম ভারতীয় প্রজাতির চা গাছ আবিষ্কার করেন। উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ১৮৩৫ সালে গঠন করেন চা সমিতি। দুই বাঙালী রাধাকান্ত দেব ও রামকমল সেন ছিলেন এই সমিতির অন্যতম সদস্য। ১৮৩৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি আসামে চা চাষের মধ্যে দিয়ে ভারতে চা শিল্পের গোড়াপত্তন করে। ১৮৪০ নাগাদ আবার চীনের বীজ এনে চা চাষের চেষ্টা হয় বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের পাহাড়ী অঞ্চলগুলিতে। ১৮৪৭ সালে দার্জিলিং অঞ্চলে চা চাষ শুরু হয়।
এখন ভারতে মূলত দার্জিলিং-সহ উত্তরবঙ্গ, আসাম ও উত্তর পূর্বের কিছু রাজ্য, যেমন, ত্রিপুরা এবং দক্ষিণের কেরালায় চা চাষ হয়। সম্প্রতি ঘুরতে গিয়ে দেখেছি উত্তরাখণ্ডের কৌশানীতেও আছে চায়ের বাগান। চায়ের বিজ্ঞান সম্মত নাম ক্যামেলিয়া সাইনেনসিস (Camellia Sinensis)। আর দার্জিলিং ও আসামের চা গাছের নাম যথাক্রমে ক্যামেলিয়া চায়নিকা ও ক্যামেলিয়া আসামিকা।
CTC শব্দটি চায়ের বাজারে পরিচিত। এর অর্থ Cut, Tear, Curl. এই পদ্ধিতিতে তৈরি হয় আসামের চা। তাই তা দেখতে ছোট ছোট বলের মতো। আসাম চায়ে মেশাতে হয় দুধ ও চিনি। সারা ভারতে এর ব্যবহারই সব চাইতে বেশি। যদিও "একটু ভালো চা" বলতে আমার কিন্তু দার্জিলিং চায়ের কথাই মনে হয়। তাই সেই চা পান করিয়েই সকলের উদর ভরাতে চাই।
কলকাতার লাল বাজার এলাকায় আছে পর পর চায়ের দোকান। মনে হয় এত চায়ের দোকান সারা ভারতে এক সঙ্গে আর কোথাও নেই। এর মধ্যে একটি দোকান ধ্রুবদার দোকান বলে পরিচিত। বিভিন্ন দামের চা পাওয়া যায় সেখানে। অনেককে দেখেছি কেনার আগে শুকনো চা শুকে দেখেন। অনেকটা সুকুমার রায়ের গন্ধ বিচারের ভঙ্গিতে। ভারতে যে চা পাওয়া যায় তাকে উৎস, গন্ধ, স্বাদ ও বর্ণ অনুসারে ভাগ করলে প্রায় ত্রিশ লক্ষ রকমের হবে। মূলত চা তিন রকম, কালো চা বা ব্ল্যাক টি, সবুজ চা বা গ্রীন টি এবং সাদা চা বা হোয়াইট টি।
আগে আমার ধারণা ছিলো ব্ল্যাক টি আর গ্রীন টি বুঝি আলাদা আলাদা গাছ থেকে হয়। এই ধারণা সঠিক নয়। একই গাছ ও পাতা থেকে বিভিন্ন ধরনের চা আমরা পাই। পার্থক্য শুধু কারখানার পদ্ধতিতে। এ বিষয়ে আলোচনা হবে, তার আগে প্রশ্ন হলো, চা পাতা কখন তোলা হয়? আগে ধারণা ছিলো, মহিলা শ্রমিকেরা বুঝি সারা বছর পাতা তোলেন। এ ধারণাও সঠিক নয়। পাতা মূলত চারটি সময়ে তোলা হয়। শীতকাল মানে নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পাতা তোলা হয়না। কেননা এই সময় সেভাবে পাতা জন্মায়না। মনে রাখার জন্য বলি দুর্গা পুজো ও কালী পুজোর পর পর পাতা তোলা বন্ধ হয়ে যায় আর সরস্বতী পুজোর আগে পিছে আবার পাতা তোলা শুরু হয়। যদিও সব বাগানে শীত এক সময় আসেনা। যে সব বাগান পাহাড়ের উপরে সেখানে শীত আসে আগে। শীতের সময় বাগানের মহিলা শ্রমিকেরা খুব সাজগোজ করেন। কেননা অন্য সময় তারা নেলপলিশ বা সুগন্ধী ব্যবহার করতে পারেন না। এতে চায়ের গন্ধ নষ্ট হয়ে যায়।
প্রায় তিন চার মাস পর ফেব্রুয়ারীতে আবার পাতা তোলা শুরু হয়। এত দিন পর তোলা হয় বলে এই পাতা স্বাদে গন্ধে ভরপুর হয়। তাই এই চায়ের দামও হয় সব থেকে বেশি। এই চায়ের পোশাকি নাম First Flush. কেজি প্রতি আট-দশ হাজার টাকার নীচে বিশুদ্ধ First Flush পাওয়া যায়না। স্বাদ গন্ধ থাকলেও এই চা লিকার ততটা দিতে পারেনা। কেননা শীত কালের রোদের অভাব। মার্চের শেষের থেকে বাড়তে থাকে রোদ্দুর। তখন যে পাতা তোলা হয় তাকে বলে Second Flush. এই চায়ের গন্ধ একটু কম তবে লিকার বেশ ভালো। ভালো বাগানের Second Flush চার-পাঁচ হাজার টাকা কেজি দরে পাওয়া যায়। দার্জিলিংয়ের সব বাগানের গাছ কিন্তু একই, তবে চা বাগান কতটা উপরে, পাহাড়ের কোন দিকে মানে কেমন রোদ্দুর পায়, কারখানা বাগানের কাছাকাছি কিনা, ইত্যাদি অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে কোন বাগানের চা কত দামি হবে। তবে মার্কেটিং ও একটা বড় ব্যাপার। ভারতের প্রধানমন্ত্রী গেলেন রানী ভিক্টোরিয়ার সাথে দেখা করতে। উপহার দিলেন 'মকাইবাড়ির চা'। এই খবর বাজারে আসতেই মকাইবাড়ির চায়ের দাম বাড়তে বাধ্য।
জুন জুলাই পাহাড়ে বৃষ্টির সময়। এই সময় গাছ পাতা দেয় সব থেকে বেশি। তবে সে পাতায় তেমন সুগন্ধ বা লিকার থাকেনা। কাজেই 3rd Flush এর চা আপনি বাজারে পাবেন না। এই চা মূলত অন্য সুগন্ধির সাথে ব্লেন্ডিং করে বিক্রি হয়। যেমন, তুলসী, জুঁই, গোলাপ, এলাচ, লবঙ্গ, ইত্যাদি। এর পর আসে শরৎ কাল সেপ্টেম্বর অক্টোবর। এই 4th Flush-এর চা তুলনায় প্রায় 2nd Flush-এর কাছাকাছি।
দার্জিলিং ব্ল্যাক বা কালো চায়ের জন্য পরিচিত। ছোট বেলা থেকে শুনেছি 'হ্যাপি ভ্যলি' বাগানের চা নাকি জগৎ বিখ্যাত। তবে একই চা পাতা কি ভাবে কালো, সবুজ ও সাদা চায়েতে পরিণত হয় এটা একটা প্রশ্ন বটে। প্রথমে বলি কালো চা কিভাবে তৈরি হয়। চায়ের পাতায় কিছু এনজাইম থাকে যেগুলো বাতাসের অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে সৃষ্টি করে গন্ধ ও বর্ণ। এক জন মহিলা শ্রমিক প্রতিদিন গড়ে আট থেকে দশ কেজি পাতা তোলেন। আমাদের ধারণা আছে দুটি পাতা একটি কুঁড়ির। আসল সত্য হলো সব কচি পাতাই তোলা হয়। সাথে থাকা কচি ডালের অংশও। চায়ের পাত্রে মাঝে মধ্যে এমন দু’একটা ডালপালা পাওয়া যায়।
চীনের সনাতন পদ্ধতি ছিলো চা পাতা তুলে তাকে খানিকটা রোদে শুকানো। তার পর দু’হাতের তালুর মধ্যে ঘষা, যেভাবে সলতে পাকানো হয়। এখনও দার্জিলিংয়ে এই সনাতন বা অর্থোডক্স পদ্ধতিতেই চা তৈরি হয়। শুধু সময় বাঁচাতে এসেছে মেশিন। সারাদিনের তোলা পাতা একটা তার জালের উপর বিছিয়ে রাখা হয়। নিচে থেকে দেওয়া হয় ঠাণ্ডা ও গরম হাওয়া। ঠাণ্ডা মানে প্রাকৃতিক আর গরম মানে ৩০℃. ১২-১৮ ঘন্টা চলার পর পাতা হারায় ৬০% জল। সেই নরম পাতাকে তখন মেশিনে দিয়ে আলতো ভাবে ঘষা হয় যাতে এনজাইমগুলো বেরিয়ে আসতে পারে। তার পর ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে জানালা খুলে দেওয়া হয়। এতে অক্সিজেন পাতার এনজাইমের সাথে বিক্রিয়া করে তৈরি করে বর্ণ ও গন্ধ। অক্সিডেশন যত বেশি হবে তত বর্ণ বাড়বে আর গন্ধ কমবে। কারখানার ম্যানেজার অভিজ্ঞতা ও প্রয়োজন অনুসারে সময় নির্ধারণ করেন। মোটামুটি ৩-৬ ঘন্টা সময় লাগে এখানে।
গ্রীন-টিকে অক্সিডেশনে দেওয়া হয়না তাই সেটা কালো হতে পারেনা। হোয়াইট-টিকে আগের পদ্ধতি মানে ঘষাও হয়না। তাই এটি বর্ণ বা গন্ধ তেমন দিতে পারেনা। এটিতে থাকে অনেক এন্টিঅক্সিডেন্ট। যদি কোনও চা কারখানা বাগান সংলগ্ন না হয়ে শহরের মাঝে হয়, তবে সব কিছু ভালো হাওয়া সত্ত্বেও চায়ের মান খারাপ হয়। এটা শহরের দূষণের মাত্রা ও অক্সিজেনের জন্য। অক্সিডেশনের পর একটি মেশিন তাপ প্রয়োগ করে পাতা থেকে শুষে নেয় ৯৮% জল। ২% জল তবু থেকে যায়। তাই চায়ের পাত্র বার বার খুললে অক্সিডেশনের জন্য চা স্বাদ ও গন্ধ হারায়।
এরপর থাকে চা ভাগ করার পালা। কেননা বিভিন্ন স্তরে কিছু কিছু পাতা ভেঙ্গে যায়। একটি যন্ত্রের সাহায্যে আকার অনুসারে চার ভাগে চা ভাগ হয়। হোল লিফ বা গোটা পাতা, ব্রোকেন বা ভাঙা, ফিনিক্স বা খুব ছোট ছোট পাতা আর টি ডাস্ট বা চায়ের গুঁড়ো। অনেকে চা বানানোর কষ্ট এড়াতে "টি ব্যাগ" ব্যাবহার করেন। সাধারণত বাজারে যত রকম "টি ব্যাগ" পাওয়া যায় সবই তৈরি হয় এই চায়ের গুঁড়ো দিয়ে। সম্প্রতি বড় পাতার "টি ব্যাগ" বাজারে এসেছে। এগুলো দেখতে তিন কোনা, ত্রিভুজের মতো। এই ব্যাগ গরম জলে পড়লে পাতা খুলে যাওয়ার সুযোগ পায়।
গাছ থেকে তোলা একশো কেজি পাতা থেকে মাত্র ১৮-২০ কেজি চা তৈরি হয়। চায়ের অধিক দামের জন্য এটাও একটা কারণ। তবে এই শিল্পে প্রায় কিছুই নষ্ট হয়না। যাই হোক আলাদা আলাদা হবার পর প্রায় সব চা আসে কলকাতাতে। এখন দার্জিলিং অঞ্চলে প্রায় ৭৮টি উল্লেখযোগ্য চা বাগান রয়েছে। সবার অফিস আছে কলকাতাতে। বড় বাগানের আছে নিজস্ব টি টেস্টার। যারা বিভিন্ন ধরনের চা মিলিয়ে মিশিয়ে তার বর্ণ, গন্ধ, স্বাদ ও মূল্যকে করে তোলেন আমাদের মনের মতন।
ইতিহাস খুঁজলে পাওয়া যায় দ্বারকানাথ ঠাকুরের উদ্যোগে গড়ে উঠেছিলো "The Bengal Tea Association" ১৮৩৯ সালে। ১৯০০ সালে প্রথম বাংলা ভাষার চা পুস্তক প্রকাশ পায়। লেখক গিরিশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আর বইটির নাম "চা প্রস্তুত প্রণালী শিক্ষা"। এরপর বিগত ১১৫ বছরে চা নিয়ে অনেক লেখালিখি হয়েছে। নিশ্চয়ই আগামী দিনেও হবে। এই লেখার সাথে রইলো চা বাগানের ছবি, চা ফুলের ছবি ও একটু ভালো চায়ের ছবি। এই লেখা পড়তে পড়তে দার্জিলিং চায়ে চুমুক দিয়ে যদি নিজের অজান্তে কন্ঠ বলে ওঠে, "আঃ" তবেই এ লেখা সার্থক। কেননা মদ খেয়ে মাতাল হওয়া যতটা সোজা, চা খেয়ে চাতাল হওয়া ততটা সহজ নয়।
Khub valo laglo lekha ta pare.
ReplyDeleteThanks.
Deleteলেখাটা পড়ে খুব ভালো লাগল । ভারতের চা বিশ্বের সব দেশে পাওয়া যায়। তার প্রস্তুতির কারিগরী বর্ণনা এই লেখাটায় কিছুটা পেলাম। আমি একটা বই রিভিউ করেছিলাম "Chai: The Experience of Indian Tea", by Rekha Sarin and Rajan Kapoor। তবে এই লেখাটা অনেক বেশি কমপ্যাক্ট।
ReplyDeleteThanks Dada.
DeleteThis comment has been removed by the author.
ReplyDeleteSuperb Diparun... for bringing our original Bengali essence and blend through this 'Chaa', mon bhore gelo .. :)!!!
ReplyDelete