ধারাবাহিক : নন্দিনী সেনগুপ্ত
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
ছুটি কথা ৪
নন্দিনী সেনগুপ্ত
আমি যেমন মামাবাড়ি যেতে ভীষণ ভালবাসতাম, তেমনি আমার মাসতুতো ভাই বুবাইও খুব ভালবাসত মামাবাড়ি যেতে। বুবাই সেজমাসির ছেলে, আমার থেকে বছরদুয়েকের বড়। মা আমাকে অনেকবার বুঝিয়ে বাগে আনবার চেষ্টা করেছে বুবাইকে ‘বুবাইদাদা’ বলে সম্বোধন করার জন্য । ফুঃ, দু বছরের বড় আবার বড় নাকি? আমার বয়ে গেছে বুবাইদাদা বলতে। সোজাসুজি বুবাই। ওরা চুঁচুড়ায় থাকে। আমরা যখন দুজনেই আরও ছোট ছিলাম, এতটাই ছোট যে কিছু কিছু কথা আবছা আবছা মনে থাকে এরকম, তখন বুবাইরা কুমারডুবিতে (ধানবাদের কাছে অবস্থিত শহর, বর্তমানে ঝাড়খণ্ড প্রদেশে) থাকত। সেখানে আমি গিয়েছিলাম একবার। ওদের কুমারডুবির বাড়ির সামনে একটা ফুলের বাগান ছিল, সেখানে প্রজাপতি উড়ছিল, আমার এইটুকুই মনে আছে। যাকগে, যা বলছিলাম বুবাইও খুব ভালবাসত মামাবাড়ি যেতে। অনেকসময় এরকম হত যে আমি আর বুবাই দুজনেই একই সময়ে মামাবাড়িতে বেড়াতে গিয়েছি ইস্কুলের ছুটি পড়বার পর। আমরা দুজনেই আলাদা-আলাদা ভাবে শান্ত বাচ্চার প্রকারভেদের মধ্যে পড়তাম, কিন্তু দুজন একত্র হলে কিরকম যেন চঞ্চলতার আবহ তৈরি হত, সে এক ভারি অদ্ভুত ব্যাপার। আমার ধারণা প্রথম শুরুটা বুবাই করত, এটা আমার ধারণা! অন্যরকম কিছু ঘটে থাকলে বুবাইকেও ছুটিকথা লেখা শুরু করতে হবে। বুবাই এখন নামীদামী কোম্পানির বিরাট উচ্চপদে কাজ করে, গাড়ি এবং ভুঁড়ি হাঁকিয়ে অফিস যায়। এখনও ফোনে কথা শুরু করলে বা কখনও দেখা হলে শুরুটা বুবাইই করে। শুরু, অর্থাৎ বদমায়েশির শুরু করে আমার ছোটবেলার গপ্পো বলে। ও শুরু করে, সেই ছোটবেলা থেকেই এমনটি করত, ‘আরেএএএ,--এ তো আমাদের রঞ্জনা! (আমার মামাবাড়ির দেওয়া নাম রঞ্জনা) সেই যে মনে আছে? সেই যে তুই কুমারডুবিতে গিয়েছিলি, তারপর ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে পাঁউরুটি খাচ্ছিলি!’ আমি একটু একটু রাগতে থাকি। যারা পাঠক-পাঠিকা, তারা ভাবতেই পারেন যে ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে পাঁউরুটি খাবার কথায় রেগে যাওয়ার কি হল? তাহলে শুনুন, তার পরের বাক্যটা বুবাই বলে ওঠে, ‘খাচ্ছিলি—কিংবা খাচ্ছিলি না’। স্বাভাবিকভাবেই আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন প্রশ্ন করতাম, ‘মানে? খাওয়া এবং না খাওয়া—দুটো একসঙ্গে কিভাবে হতে পারে?’ বুবাই উত্তর দেয়, ‘হতেই পারে, আমরা ভাবছিলাম তুই খাচ্ছিস, আসলে-- তুই প্রথমে আঙুল দিয়ে পাঁউরুটির স্লাইসের ঠিক মাঝখানে একটা ফুটো করতিস’। আমি রেগে গিয়ে বলতাম, ‘তারপর?’ বুবাই তখন উত্তর দিত, ‘না মানে- আমি তো শ্রীকৃষ্ণকে কখনও দেখিনি! শ্রীকৃষ্ণ বোধহয় সুদর্শনচক্র ঐভাবেই চালাতো! তুই ঐ পাঁউরুটির স্লাইসের ফুটোর মধ্যে তর্জনী ঢুকিয়ে বাঁইবাঁই করে ঘুরাতে থাকতিস, তারপর ঐ পাঁউরুটির মধ্যিখানে একটা বড় ফুটো হয়ে যেত, শুধু ধারের চৌকোণা অংশটা পড়ে থাকতো! মাসিমণি ভাবতো তুই ধারের অংশটা বাদ দিয়ে খেয়েছিস, কিন্তু আসল গল্পটা আমি জানি এবং তারপর তুই ধারের চৌকোণা অংশটার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে বালার মত করে পরে বসে থাকতিস! বাহবা, এখনও ওইরকম গয়না পরিস তুই?’
এইপর্যন্ত পড়ে এইবার বলুন তো পাঠক-পাঠিকারা, যে- রেগে গিয়ে মানুষ মানুষকে কামড়ে দিতে পারে কিনা এইরকম ইয়ার্কিতে! ঠিক ধরেছেন, আমি সত্যি সত্যি বুবাইকে ছোটবেলায় একবার কামড়ে দিয়েছিলাম। তবে ইয়ার্কিতে ক্ষেপে গিয়ে নয়, ভয়ানক মারামারি করে। আমরা শান্ত বাচ্চা হলেও অদ্ভুতভাবে নিজেদের মধ্যে ভীষণ মারামারিতে জড়িয়ে পড়তাম। সেটা শুরু হত ন’মামার নবজাতক পুত্র শুভর বিছানা থেকে দুখানা ছোট ছোট পাশবালিশ তুলে নিয়ে গদাযুদ্ধ করবার সাথে সাথে। এরকম হয়েছিল যে আমরা দুজনে গদাযুদ্ধ করে শুভর পাশবালিশ ফাটিয়ে দিয়েছিলাম এবং পরে দিদা সেই কোলবালিশ আবার ঠিকঠাক সেলাই করে দিয়েছিলেন। কি হাসিমুখে দিদা সামলাতেন নাতিনাতনিদের দৌরাত্ম্য সে এক দেখবার জিনিস! দিদা আমাদের বদমায়েশিতে বিপর্যস্ত হয়ে বাঙাল ভাষা ভুলে গিয়ে কলকাত্তাই টানে বলতেন, ‘ও সোনামণিরা, তোমরা কেন দুষ্টুমি করছো? তোমরা একটু শান্ত হয়ে বস না’। এই অবধি বলে দিদা অনেকসময় আমাদের দুজনের হাতে কাগজ আর পেন্সিল ধরিয়ে দিয়ে বলতেন ‘ছবি আঁকো, সোনামণিরা!’ হ্যাঁ, এই কায়দাটায় বেশ কাজ হত, কারণ আমার মনে আছে, আমরা দুজনেই ছোটবেলায় ছবি আঁকতে খুব পছন্দ করতাম। আমি আঁকতাম রাজা-রানি অথবা গ্রামের ছবি যেখানে নারকেলগাছ থাকবেই থাকবে। বুবাই আঁকতো কার্টুনের চরিত্রগুলো। খুব ছোট বয়সেই বুবাই খুব সুন্দর আঁকতে পারতো হুবহু একরকম বাঁটুল দি গ্রেট, হাঁদা, ভোঁদা, টিনটিন বা ক্যাপ্টেন হ্যাডকের চেহারা। শুধু অরণ্যদেবটা ঠিকঠাক পারতো না। জিজ্ঞাসা করলে বলতো, ‘ধুস, কিরকম গুলি গুলি মাসল্ দ্যাখ! কিরকম বিচ্ছিরি, ভাল্লাগেনা, তার চেয়ে বরং দ্যাখ আমার বাবার ছবি আঁকি’। একথা বলেই সঙ্গে সঙ্গে এক টানে বুবাই ইয়া মোটা গোঁফওয়ালা, মাথায় পাগড়ি, হাতে বন্দুক, গলায় টোটার মালা, এইরকম একটা লোকের ছবি এঁকে ফেলত। আমি দেখে খুব ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, ‘এবাবা, এটা সেজমেসো কোথায়? এটা তো তুই একটা চম্বলের ডাকু মানসিং আঁকলি!’ এবার বুবাই কিরকম দুঃখদুঃখ মুখ করে বলতো, ‘ডাকুই তো! তুই জানিস না, বাবা আসলে ডাকু মানসিং। একটু লক্ষ কর, বাবার গোঁফটা কিন্তু এইরকমই কতকটা, আর মাথার টাকটা যদি তুই পাগড়ি দিয়ে ঢেকে দিস, এইরকমই কিন্তু দেখাবে’। আমি পুরোপুরি ফেলে দিতে পারি না ওর কথাটা। কিন্তু সেজমেসোর মত পরিশীলিত, মৃদুভাষী মানুষ কি করে ডাকু মানসিং হবেন, সেইটাও আমি ঠিক ভেবে পাইনা। বরঞ্চ আমার বাবা একবার ‘বাল্মীকি প্রতিভা’য় ‘দস্যু রত্নাকর’ সেজেছিল, হু-হু-হু-হা-হা-হা-হা-হা-হা করে ডাকাতদের মতো অট্টহাসিও হাসতে পারে। সেজমেসো অত জোরে হাসি তো দূরের কথা, বাক্যালাপও করেন অত্যন্ত ধীরে এবং নীচুগ্রামে। কিন্তু বুবাই বলেই চলে, ‘শুধু চেহারা? নামেরও মিল আছে। ভাব একবার, বাবার ভাল নাম কি? না-মানবেন্দ্র। মানবেন্দ্রই মানসিং। এইটাই আসল কথা, বুঝলি? আর আস্তে কথা বলা? জানবি যারা ডাকাত, তারা ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ খুন করে দেয়। আমার বাবা আস্তে আস্তে কথা বলে যখন শাসন করে, তখন মনে হয় এর থেকে মায়ের হাতের পাখার ডাঁটের পাঁচটা ঘা অনেক ভালো’। এতদূর বলে বুবাই উদাস ভঙ্গীতে পুকুরের জলের দিকে চেয়ে থাকে। আমি খুব ধন্দে পড়ে যাই, ভাবতে থাকি এ কি করে সম্ভব? চম্বলের ডাকু মানসিং? দুত্তোর, আর কাউকে জিজ্ঞাসাও করতে পারিনা, বুবাই যে আমায় দিব্যি দিয়েছে, কাউকে না বলতে এই কথা। বাব্বা, এই এদ্দিন পরে, এত বচ্ছর পরে, দিব্যির দোষগুণ সব কেটে গিয়েছে ধরে নিয়ে এই ছুটিকথায় এসব গোপন কথা বিবৃত করলাম।
-চলবে
ভীষন ভালো লাগলো আপনার লেখা।শুভেচ্ছা জানাই।
ReplyDeleteভালো লাগলো ! চলুক !
ReplyDelete