0

ছোটগল্প : দেবাশিস ঘোষ

Posted in


ছোটগল্প



যমুনা সিদ্দিকী
দেবাশিস ঘোষ


চারদিকে একবার তাকিয়ে দেখল যমুনা সিদ্দিকী। চেনা ছবি, কিন্তু অচেনার দূরত্বে মুখ ফিরিয়ে আছে যেন।কয়েক বছর পর বাপের বাড়িতে পা দিচ্ছে আজ।ভেবেছিল চেনা চালচিত্রে কোথাও একটা অভ্যর্থনার ছবি দেখতে পাবে, যেখানে আজকের গ্লানি, আজকের অসূয়া আগামীকাল অবধি স্থিতি পায় না, যেখানে স্বনির্মিত কোনো নীতি বা নিয়মের ঠাঁই  হয় না। ভেবেছিল সেই উদার প্রকৃতি অদৃশ্য দুই হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলবে "এতো দিন দেরী করতে আছে , বোকার মেয়ে ! ফিরে এসো পুরোনো স্বস্তিতে " ।

দরজা খুললেন মা, বিরজা দেবী। হাবভাবে সন্ত্রস্ত, চোখে মুখে আতঙ্ক আর আশঙ্কা। বললেন, আয়। ভিতরে পা বাড়িয়ে দিতে তবু কেন দ্বিধা ? নিজের কাছেই তা যেন ভীষন কঠিন এক প্রশ্ন। উত্তর জানা নেই তার। আপনা থেকে বেরিয়ে এল প্রশ্ন, আসব ?
--আয়।
পায়ে পায়ে এগিয়ে এল যমুনা। যমুনা সান্যাল থেকে যমুনা সিদ্দিকী সে এখন, তা বেশ কয়েক বছর। এখনও নিঃসন্তান, এখনো কলকাতার স্কুলের ইংরেজির দিদিমণি, এখনো একটি সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদিকা। এখনও সব ঠিক আগের মতো। তবু সমস্ত প্রত্যয়, সমস্ত আত্মমূল্যায়ণ আজ যেন অজান্তে অপসৃত ।

পা টিপে টিপে পদক্ষেপ, যেন নিষিদ্ধ পথে। কার নিষেধ ? নিষেধ তো আর নেই। নীতিন, যমুনার ভাই, সেই রকমই তো জানিয়েছে।এমনকি দোর্দণ্ড প্রতাপ যজ্ঞেশ্বর সান্যালও নাকি নিষেধ তুলে নিয়েছেন। বলেছেন, আসতে চায় আসুক, বাড়িতে তো কত লোকই আসে ।

যখন সে অনেক কাছে চলে এসেছে মায়ের, প্রায় স্পর্শের দূরত্বে, তখন হঠাৎ থমকে দাঁড়াতে হল দুজনকেই। পায়ের শব্দ চেনা। অনতিবিলম্বে দৃশ্যমান হলেন বাবা, যজ্ঞেশ্বর সান্যাল। তাকিয়ে একবার দেখলেন শুধু, মুখে একটি কথাও বললেন না। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে হেঁটে চলে গেলেন পাশ দিয়ে।

দম বন্ধ করা অবস্থা যখন কাটল, তখন প্রথম হাসি ফুটল যমুনার মুখে।"মা" বলে সশব্দে সম্ভাষণ করে নিজের ভিতরের উত্তাল ঢেউ দিল মুক্ত করে, এবং সঙ্গে সঙ্গে দুই হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরল মা'কে। কোনো কালে নিষ্পেষিত হওয়ার স্মৃতি এখন হয়তো আর জেগে নেই মনের মধ্যে, তাই অভিভূত হওয়ার মত নতুন মনে হল এ অভিজ্ঞতা। যমুনার হাবভাব, আচরণ যে বরাবর অন্য রকমের, তা তিনি জানেন। আগে যেমন হতো, এখনো তেমন সেই রকম শঙ্কিত হয়ে পড়ে থাকলেন বাহুবন্ধে। 

মেয়ে এমন করে গলা জড়িয়ে থেকেছে কতদিন। তার সাথে যেন মেলে না আজকের অনুভব। তখন সদৃশ সেই আচরণে প্রাধান্য পেত বিরজা দেবী ।মায়ের মান ভাঙাবার জন্য বা নিজের দোষ স্বীকারের জন্য এমন করে সে জড়িয়ে ধরত মাকে, আর তারপরেই শুরু হত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না। উলটে তখন যমুনাকেই ভোলাতে হতো। কিন্তু এখন তো তা নয়, এখন আর কতটুকুই বা দাম পায় মায়ের কষ্ট, দুঃখ, অভিমান।

আকুল হয়ে কেঁদেছিল সেদিন, দুশ্চিন্তায় আর উদ্বেগে দুই রাত জেগে কাটাবার পর যখন নিশ্চিত ভাবে জানতে পারল যমুনা নিজের জীবনের সুখ সন্ধানে ঘর বেঁধেছে আবুল সিদ্দিকীর সাথে। যে দাবীর কথা প্রায়ই শোনাত, নিজের জীবনের উপর নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করবার সেই দাবী নিজেই পূর্ণ করেছে।খুব কেঁদেছিলেন বিরজা দেবী, মনে মন বলছিলেন, কোনটা তবে আমার অধিকার ? কোনটার প্রতিষ্ঠায় আমার উচিত ছিল নিয়োজিত থাকা ? ।

তার এই কষ্টের কথা তো একবারও ভাবে নি যমুনা। আজ তো সেই উদাসীন এবং নিশ্চিত ভাবে বিচ্ছিন্ন মেয়েটা তার শরীরের উপর পড়ে আছে কাঁধের উপর মাথা রেখে। তাই বোধ হয় পুরোনো সেই অনুভব ফিরে আসছে না।

সেদিনের সেই আলাপচারিতা কিছুতেই ভুলতে পারেন না বিরজা দেবী। যমুনা হটাৎ আহ্লাদি গলায় বলল "কাল কিন্তু আমি ফিরব না মা "
-- কেন ? কোথায় যাবি ?
--আবুল বলেছে কালই বিয়ে করবে। ঢাকায় যেতে হবে ওকে সামনের বুধবার।কবে ফিরবে ঠিক নেই, তাই যাওয়ার আগে বিয়েটা সেরে নেবে।
--বন্ধুর বিয়েতে যাবি সে ভালো কথা, কিন্তু তাই বলে বাড়ি ফিরবি না কেন ?বাকি আর সব বন্ধুরা কী করবে ?
পাগলের মতো হাসতে হাসতে যমুনা বলেছে " ও মা, তারা ফিরবে না কেন ?"
--তাহলে তুই ফিরবি না কেন ? 
আবার হাসির দমক, তুমি কি কিছুই বুঝতে পার না মা ? আবুল তোমাকে সেদিন বলে নি, যমুনাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাব মাসীমা, আপনার আপত্তি নেই তো ?।তুমি বললে, তোমাদের বাড়ি যাবে, তাতে আবার আপত্তি কিসের ! । বলো নি তুমি, বলো ।
--হ্যাঁ, বলেছিলাম তো। বন্ধুর বাড়িতে যাওয়ায় কবে আপত্তি করেছি ? তাই বলে তাদের বাড়িতে রাত কাটানোর কথা তো বলিনি কখনো।
--তা বলো নি, কিন্তু যদি সে না ছাড়ে !
--সে আবার কী কথা ? ছাড়বে না কেন ?
যমুনা তখন বলল, আমি নিজেই যদি আসতে না চাই ?
--আসতে চাইবি না কেন ? 
--কেন, নিজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আমার থাকবে না ?
চিরকাল আমাকে অভিভাবকের অধীন হয়ে থাকতে হবে ? কেন ? 

আর বিশেষ কোনো কথা হয় নি সেদিন, কিন্তু পরদিন সত্যি সত্যি বাড়ি ফিরল না যমুনা। দুই দিন লাগল কথাগুলোর মানে বুঝতে। যখন বুঝতে পারল, তখন শুধু হাহাকার।

হাহাকারের তীব্রতা আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেছে। এখন আছে কেবল হতাশার দাবদাহ, মনের ভিতরের সব আর্দ্রতা তা শুষে নিয়েছে। এই যে হঠাৎ একটা ফোঁপানির আওয়াজ আসতে শুরু করেছে, বিরজা দেবী যা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছেন, তবু কোনো বিকার দেখা যাচ্ছে না তো তার মধ্যে ! একবারও তো ইচ্ছে করল না মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে !

যজ্ঞেশ্বর কে যখন মেয়ের হয়ে বোঝাবার চেষ্টা করছিলেন তখন টের পান নি যে তার নিজের মধ্যেও এতখানি প্রগাঢ় সেই নিস্পৃহতার ছায়া। খবর পেয়েছিলেন মেয়ে কষ্টে আছে, সে আসতে চায় বাড়িতে। নীতিন যোগাযোগ রাখে, তার কাছ থেকেই খবর যত পাওয়া।

সব শুনে যজ্ঞেশ্বর বলেছিলেন, আসতে চায় আসুক, বাড়িতে তো লোক আসেই। কিন্তু সে কষ্টে থাকলে আর কি করার আছে আমাদের ! দুর্গত লোক তো কতই আছে, কার জন্যে কী করতে পারি বল।

বিরজা দেবীর বয়স হয়েছে। ঘাড় এখন টন টন করছে। কতক্ষণ আর পারেন তিনি। দুই হাত দিয়ে ধরে সামনে টেনে আনলেন যমুনাকে ভালো করে তাকিয়ে দেখলেন মুখের দিকে। বুঝবার চেষ্টা করলেন যমুনা সিদ্দিকী কতখানি অন্য রকম যমুনা সান্যালের থেকে। যমুনার দুচোখে তখনও প্রবাহ। শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কাঁদছিস কেন ? তুই তো চাকরী করিস, পত্রিকা চালাস, নিজের অধিকার নিজে প্রতিষ্ঠা করতে পারিস, তাহলে আবার তোর কষ্ট কিসের ?
--মা, ভুল করেছি।

অমনি যেন ফুঁসে উঠলেন বিরজা দেবী। এতদিন পর বুঝতে পারলি সে কথা ? তা শুনি, কী ভুল সেটা ।
--পরাধীনতা । 
সে কথা বোঝা উচিত ছিল। সবাই তো আর বাবা মা নয় যে যখন যা চাইবে তাই তুলে দেবে হাতে ! 
--না, তা বলিনি। নিজেই তো নিজেকে পরাধীন করে রেখেছি। অন্যের দোষ দেব কেন ? নিজের অধিকারের গন্ডির বাইরে যদি নিজেকে দেখতে না পাই, তাহলে সে তো এক বন্দি জীবন কাটানো ! সে তো পরাধীনতা ! ।অন্যের জন্য কষ্ট পেতে হলে স্বাধীনতার দরকার হয়। এতদিন পর তা বুঝতে পারলাম। অন্যের স্নেহ মায়ায় বড় হয়েও যে নিজেকে ছাড়া অন্য কাউকে দেখতে পায় না, তার মতন হতভাগ্য আর কে আছে ?

সত্যি অনেক পাল্টে গেছে মেয়ে। সে দিক দিয়ে যমুনা সান্যালের থেকে যমুনা সিদ্দিকী অনেক বেশি ভালো।

যমুনার সংসারের কথা একবারও মুখে আনেন নি বিরজা দেবী। বরং যমুনা নিজেই বলেছে ।" আবুল আবার বিয়ে করবে,  আমাদের সংসারে সন্তান এল না বলে বাড়ি র লোকজন জোর করছে। আমি আপত্তি করি নি। একসময় আমাকে যে বিয়ে করেছিল, তখন যে এমন একটা শর্ত আড়াল করা ছিল, তা হয়ত আবুল ও জানত না। যখন জানতে পারলাম তখন রুচি হল না বলবার, যে তবু আমি থাকব। আমি আলাদা হয়ে যাচ্ছি। মনে হয় খারাপ থাকব না।

এবার কেন নরম হয়ে গেলেন বিরজা দেবী, বললেন, যা করবি ভেবে করিস।কোনো কিছু চোখের আড়ালে থেকে গেল কিনা, তা একবার খোঁজ করে দেখিস আগে।

যমুনা বলল, দেখব, নিশ্চয়ই দেখব। কিন্তু সে তো ভবিষ্যতের কথা, বিস্তৃত ভবিষ্যৎ জুড়ে তা পালনীয়। তার আগে যা দেখবার, তা বর্তমান এবং সেই মুহূর্তে যা বর্তমান তা তার মা। তার ক্ষোভ, উদ্বেগ, প্রভৃতি অনেকটাই প্রশমিত।তার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে যে পথ ধরেছিল যমুনা, সে পথ যমুনাকে সুখের লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারে নি। শেষ পর্যন্ত সরে আসতে হল তাকে। যার কাছে পরাজয়, তার পরাজয় নিজের পরাজয়ের কষ্ট লাঘব করে অনেক খানি।

যমুনা বলল, আমি আর বেশিক্ষণ থাকব না, মা। এবার যাব।
--কোথায় যাবি এখন ? এই তো এলি ! 

যমুনা কেবল হাসল, মুখে কিছু বলল না। কিছু আগে অমন আকুল কান্নার পর এত দ্রুত এমন ভারমুক্ত হাসি, কোথায় গিয়ে যেন বিঁধল বিরজা দেবীর বুকের ভিতরে। মনে হল আর তো তাহলে বিচ্ছেদ এতটুকু পোড়াতে পারবে না মেয়েকে ! এ যেন আর এক রকমের সর্বনাশ।

আর থাকবে না যমুনা। থাকতে পারবে না। মিটিং আছে একটা, পত্রিকার। বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তা, তারপর রাস্তা শুধু। সে মেয়ে, তাই রাস্তা অতিক্রম করতে করতে রাস্তার চিহ্ন সব গায়ে আঁকা হয়ে যাবে। যমুনা সান্যাল থেকে যমুনা সিদ্দিকী, তারপর কী ?।

0 comments: