প্রবন্ধ : অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
আইনের সিঁদুরবিন্দু
অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী
ভারতীয় দণ্ডবিধির ধারা নং ৪৯৭। পৃথিবীর আর কোন দেশের দণ্ডবিধিতে এই একবিংশ শতাব্দে এমন চিত্তাকর্ষক দ্বিতীয় কোন ধারা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কেন চিত্তাকর্ষক সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে বরং যে অপরাধের শাস্তির জন্যে এই ধারাটি বরাদ্দ সেই অপরাধটি নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।
ইংরাজিতে অপরাধটিকে বলে adultery। ল্যাটিন adulterium থেকে আগত এই ইংরাজি শব্দটির অর্থ হল, কোন বিবাহিত ব্যক্তির নিজ স্বামী বা স্ত্রী ব্যতীত অন্য ব্যক্তির সঙ্গে স্বেচ্ছাকৃত যৌনসংগম। বিবাহিত ব্যক্তিটি পুরুষ হলে তিনি adulterer, মহিলা হলে তিনি adulteress। নিজের এই অনুবাদটির ওপর ভরসা না করে আমি অক্সফোর্ড এবং কেমব্রিজ, দুটি অভিধান থেকেই adultery শব্দটির অর্থ তুলে দিচ্ছি:
1. Voluntary sexual intercourse of married person other than with spouse [Oxford].
2. Sex between a married man or woman and someone who is not their wife or husband [Cambridge].
ভারতবর্ষ বাদে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের আইনি পরিভাষা(law lexicon)-য় এই শব্দটি উল্লিখিত অর্থে গৃহীত হয়েছে। বাংলা ভাষায় এই শব্দটির যথার্থ প্রতিশব্দ নেই। ‘ব্যভিচার’ শব্দটি এই অর্থে আমরা ব্যবহার করে থাকি ঠিকই, কিন্তু ‘ব্যভিচার’ শব্দের আভিধানিক অর্থ অনেক বিস্তৃত। সেখানে যে কোন ধরনের অনাচারকেই ব্যভিচার বলা হয়; যৌন অনাচারের ক্ষেত্রে ‘বিবাহিত/বিবাহিতা’ ও ‘অবিবাহিত/ অবিবাহিতা’র কোন ভেদ এই অর্থের মধ্যে অনুপস্থিত। ‘পরকীয় গমন’(‘পরকীয়’ উভয় লিঙ্গার্থে ধরে) বললে বরং adultery শব্দের সঠিক অর্থটি পাওয়া যায়।
বিভিন্ন দেশের দণ্ডবিধির প্রসঙ্গে আসার আগে আমি law lexicon -এ গৃহীত adultery -র সংজ্ঞাটি উল্লেখ করছিঃ
Adultery is voluntary sexual intercourse between a married person and someone other than the lawful spouse.
অর্থাৎ, আভিধানিক ও আইনি – দুটি অর্থেই পরকীয়গামী (adulterer) তিনিই যিনি বিবাহিত হয়েও নিজের স্ত্রী ব্যতীত অন্য মহিলার সঙ্গে যৌনসংগম করেছেন বা যিনি অন্যের স্ত্রী-তে উপগত হয়েছেন। আবার, পরকীয়গামিনী (adulteress) তিনিই যিনি বিবাহিতা হয়েও নিজের স্বামী ব্যতীত অন্য পুরুষের সঙ্গে যৌনাচার করেছেন বা যিনি অন্যের স্বামীর সঙ্গে যৌনসংগম করেছেন।
শব্দার্থ বা বাক্যার্থ নিয়ে এতখানি পরিসর খরচ করার উদ্দেশ্য একটাই – দণ্ডবিধিতে এই কার্যটিকে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসাবে গণ্য করার অন্তর্নিহিত মূল নীতিটি খুঁজে বের করা। আশা করি এতক্ষণে বোঝা গেছে যে অপরাধটি মূলত বিশ্বাসভঙ্গের। তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ‘বিবাহ’ নামক প্রতিষ্ঠানটির পবিত্রতা রক্ষা করা। একদিকে ধর্মীয় ও নৈতিক বিচার, বংশধারা ও উত্তরাধিকারের বিশুদ্ধতা, অন্যদিকে মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি ও ব্যক্তি স্বাধীনতা – এই দুই টানাপড়েনে বিষয়টি জটিল ও তর্কসাপেক্ষ। এ নিয়ে বিশদ আলোচনা এই নিবন্ধে অপ্রাসঙ্গিক। তবুও এটি উল্লেখ করার হেতু এই যে, এই বিতর্কের কারণেই যুক্তরাজ্য সমেত ইউরোপের সব দেশগুলিই গত শতাব্দের মাঝামাঝি থেকে তাদের দণ্ডবিধি থেকে ‘পরকীয়গমন’-কে রেহাই দিয়েছে। ওই দেশগুলিতে তা এখন ব্যক্তিক অপরাধ (personal offence) মাত্র। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে আজও এই বিতর্কের মীমাংসা হয়নি। ফলে সে দেশের ২৩টি রাজ্যে এখনও ‘পরকীয়গমন’ আইনত দণ্ডার্হ অপরাধ। তবে সেই সব রাজ্যের দণ্ডবিধিতে এটি বিবাহের অনেকগুলি চুক্তির মধ্যে যে চুক্তিটি ভঙ্গের অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হয় তা হল দম্পতির পরস্পরের প্রতি একনিষ্ঠ যৌনতায় আবদ্ধ থাকার চুক্তি। তৃতীয় কোন ব্যক্তি যদি বিবাহিত দম্পতির এই একনিষ্ঠতা ভঙ্গের কারণ হন, তিনিও একই অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত হবেন। অপরাধী প্রমাণিত হলে এই কর্মে লিপ্ত দুই ব্যক্তির শাস্তি সমমাত্রিক, নারী-পুরুষের ভেদরেখা এই সব রাজ্যের দণ্ডবিধিতে অনুপস্থিত।
এবার ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারাটি মূল ভাষায় একবার পড়ে নেওয়া যাকঃ
Indian Penal Code
Section 497: Adultery
Whoever has sexual intercourse with a person who is and whom he knows or has reason to believe to be the wife of another man, without the consent or connivance of that man, such sexual intercourse not amounting to the offence of rape, is guilty of the offence of adultery, and shall be punished with imprisonment of either description for a term which may extend to five years, or with fine, or with both. In such case the wife shall not be punishable as an abettor.
দেখুন দেখি, এই না হলে আইন! একেবারে সোজা-সাপটা, জলবত্তরলম্; এদিক-ওদিক কিচ্ছু নেই, এর একটাই দিক। অন্য দেশের আইনটি বুঝতে এবং বোঝাতে গিয়ে এতক্ষণ আমার মাথাটি বন্বন্ করে ঘুরছিল। adultery, adulteror, adulteress, বিবাহিত, বিবাহিতা, কে কার স্বামী বা স্ত্রী, কে কার বিশ্বাসভঙ্গ, অধিকার-লঙ্ঘন ইত্যাদি করল – সেসব ভাবতে গিয়ে এমনই খেই হারিয়ে ফেলছিলাম যে আমাকে ওই ইংরাজি শব্দগুলির বিশ্রী কতগুলি বাংলা প্রতিশব্দ পর্যন্ত তৈরি করতে হল।
এখানে আর সেসব ঝামেলা নেই। আমরা এখন অন্য দেশে, অন্য যুগে চলে এসেছি। আপনি যদি পর-এর অনুমতি বা প্রশ্রয় বিনা জেনেবুঝে পরদার গমন করেন, এবং আপনার এই কম্মটি ধর্ষণ বলে পরিগণিত না হয়, তাহলে আপনি adultery বা আমার বদজবানিতে, পরকীয়াগমন অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত হবেন, এবং আপনার পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাবাস, বা জরিমানা, বা দুটোই হতে পারে। আপনার দুষ্কর্মে সহযোগী হিসাবে পরদারটি কিন্তু শাস্তিযোগ্য হবেন না।
শেষ লাইনটি পড়ে যদি আপনার আক্কেল গুড়ুম হয়ে যায়, তাহলে ধরে নিতে বাধ্য হব এই দেশে আপনি ভুল করে একশ বছর আগে নিয়ে ফেলেছেন! এ দেশের বিয়েতে চুক্তি বা বিশ্বাসের কোন প্রশ্ন নেই; কেননা, ওসব দুটি সচেতন মানুষের মধ্যে হয়। নারী তো অচেতন পদার্থ মাত্র। সুতরাং এখানে চুক্তি বা বিশ্বাসভঙ্গ অবান্তর কথা। তবে পরকীয়াগামী পুরুষটি অবশ্যই শাস্তিযোগ্য, যেহেতু সে বিনা অনুমতিতে অপরের সম্পত্তিতে প্রবেশ করেছে (মাতৃবৎ পরদারেসু পরদ্রব্যেসু লৌস্ট্রবৎ - এই ঋষিবাক্যটি সাফ্ল করে পরদারেসু লৌস্ট্রবৎ গণ্য যদি না করতে পারেন তো কারাবাস অর্জনই আপনার নিয়তি)। কিন্তু নারীটি তার স্বামী এবং প্রভুর সম্পত্তিমাত্র, তার শাস্তির প্রশ্ন অবান্তর! আবার, স্বামী চাইলে তাঁর সম্পত্তিটি অন্য কাউকে ব্যবহার করতেও দিতে পারেন; তাতে কোন অপরাধ সংঘটিত হবে না, বরং মহাভারত শুদ্ধ হবে – ক্ষেত্রজ সন্তানের কথা পাঠকেরা অবশ্যই অবগত আছেন।
ভাবলে সত্যই অবাক হয়ে যেতে হয় ভারতীয় দণ্ডবিধিতে এমনই একটি ধারা আজও সগৌরবে বিদ্যমান! ইংরেজদের তৈরি করা এই ধারাটি তারা নিজেদের দেশে কবেই ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে আর আমরা সেটিকে এখনও দিব্যি বয়ে নিয়ে চলেছি! জাতীয় মহিলা কমিশন ধারাটির সমালোচনা করে এটিকে বাতিল অথবা দেওয়ানি অপরাধের সামিল করার দাবি অবশ্যই জানিয়েছেন, কিন্তু বিস্তর যে সব নারীবাদী সংগঠন আছেন, যাঁরা বিভিন্ন অকিঞ্চিৎকর ব্যাপারে প্রায়ই প্রবল শোরগোল তোলেন, তাঁরা নারীর পক্ষে তীব্র অবমাননাকর এই ধারাটির প্রতি এতটা সহিষ্ণু কেন সেটা তাঁরাই জানেন!
তথ্যসুত্রঃ 1. Indian Penal Code
2. Adultery: A Comparison of Military Law and State Law and the Controversy by Melissa Ash Haggard
3. Laws on Infidelity and Adultery(website: www.epis.us
ভালো লাগ্ল ! ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের তৈরী এমন আরো অনেক আইনি ই এখনো চলছে !
ReplyDelete