বিশেষ রচনা : শৌনক দত্ত
Posted in বিশেষ রচনা
বিশেষ রচনা
নিঃসঙ্গ সৃষ্টিতে...
শৌনক দত্ত
সুস্মিতার সাথে অভিমানের পর্ব যখন চরম, বাসু তখন ছাদে। পঞ্চমীর চাঁদ তখন আধখাওয়া রুটির মত একা। বাসু তখন কবিতা বলতে থাকে নিঃসঙ্গ আকাশের দিকে চেয়ে। বাসু জানে সুস্মিতা এখনই জীবনানন্দ শুনে উঠে আসবে অভিমান ভেঙ্গে পড়বে জীবনানন্দীয় বোধে আর নিঃসঙ্গতায়। সুস্মিতাও নিজের পছন্দের কবিতা জুড়ে দেবে।
বেশ কিছু কবিতা আওড়ানোর পর ও যখন সুস্মিতা এলো না, বাসু অবাকই হলো। অনিচ্ছায় নেমে এলো। ঘরের কোথাও সুস্মিতা নেই, বিছানায় পড়ে আছে কমলকুমার মজুমদার আর জীবনানন্দ দাশের পাশে নির্জনতা। বাসু এ ঘর সে ঘর দেখে আর অবাক হয় সুস্মিতা কোত্থাও নেই। গন্ধ খোঁজে বাসু।জীবাননন্দের বইটি তুলে নিতেই তার মনে পড়ে জীবনানন্দ দাশের অন্তত বারো কিংবা চৌদ্দোটি উপন্যাসের সন্ধান পাওয়া গেছে। সম্ভবত আরো চারটি লুক্কায়িত আছে তার পান্ডুলিপির জীর্ণ স্তুপে। ছোটগল্প প্রায় একশ কুড়িটি।রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের সংখ্যা বারটি এবং ছোটগল্প একশোর কমই হবে।রবীন্দ্রনাথ সবই দেখে গেছেন মুদ্রিত অবস্থায়। জীবনানন্দের মত একজন আপাদমস্তক কবি কোন রকম পাঠক প্রত্যাশা না করেও কেন একটিও গদ্য কাহিনী প্রকাশ করতে চাননি, সে রহস্য আর বোধহয় উদঘাটিত হবার নয়।বাসু সুস্মিতা কে ডাকতে থাকে..
সুস্মিতার মত হাস্যোজ্জ্বল একটি ব্যক্তিত্ব মনের কোথাও কোনো গহীনে কি একা ছিলো? আজ এ প্রশ্ন জেগে ওঠে কমলকুমার মজুমদারের বইটি তুলে নিতেই। সুস্মিতার খুব প্রিয় দুটি বই বড় পছন্দের দুজন স্রষ্টা, অথচ দুজনেই বড় বিচিত্র। কমলকুমার মজুমদার উপন্যাস লিখেছেন আটটি এবং কিছু গল্প। উপন্যাসগুলি এবং প্রায় সব গল্পই প্রকাশিত হয়েছে এক্ষণ, কৃত্তিবাসের মতন পত্রিকায়। কমলকুমার জীবনানন্দের মতন নিঃসঙ্গতা বিলাসী ছিলেন না। সুস্মিতা কমলকুমার মজুমদার নিয়ে কিসব যেন লিখেছিলো। বাসু সুস্মিতার ডাইরী হাতড়ে বেড়ায় সেলফে, টেবিলে, ড্রয়ারে কোথাও নেই তখনই চোখে পড়ে ডাইরীটা পড়ে আছে বাসী দৈনিক পত্রিকার পাশে ধুলোময়। সযত্নে বাসু ডাইরীটা বুকে চেপে ধরে রাখে অনেকক্ষণ তারপর পাতা উল্টেপাল্টে পড়তে থাকে সুস্মিতার লেখা-
কমলকুমার মজুমদার[১৯১৪-১৯৭৯]বাংলা সাহিত্যে বিতর্কে কন্টকাকীর্ণ, নির্মাণে নিঃসঙ্গ এক নাম। স্বতন্ত্র শিল্পরীতি আর বর্ণাঢ্য যাপিতজীবন মিলিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সবার চেয়ে আলাদা, মহামহিম। জীবদ্দশায়ই হয়ে উঠেছিলেন কিংবদন্তি পুরুষ। আড্ডায়, পান্ডিত্যে, রসিকতায়, পরনিন্দা, পরচর্চায় ও নতুন নতুন কাহিনী সৃষ্টিতে তিনি নিজেই কাহিনী পুরুষ হয়ে উঠেছিলেন।
লেখাটা পড়তে পড়তেই বাসু উঠে দাঁড়ায় রান্না ঘরে উঁকি দেয়। সুস্মিতা নেই।দুই মগ ব্ল্যাক কফি বানিয়ে ফিরে আসে। কফির গন্ধ ছাপিয়ে সুস্মিতার গন্ধ নাকে লাগে বাসু তার লেখা সুস্মিতার খুব প্রিয় দুটি লাইন আনমনেই বলে ওঠে 'তোমাকে খোঁজার বেদনায় দেখো ফুটে আছে বয়স, আমার খুব গভীর মৌন রাতে তোমায় মনে পড়ে, সব মনে পড়ে তোমার রোদগন্ধ নাকে এসে লাগে!' একটা দীর্ঘশ্বাস কফি মগে রেখে অন্য একটি মগে ঠোঁট রাখে বাসু আর চোখে ভেসে উঠে সুস্মিতার ছায়া অক্ষর।
কমলকুমার অল্প সংখ্যক পাঠক পেয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন, পরনিন্দা, পরচর্চা ও অপরের চরিত্রহরণকে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন শৈল্পিকতায় আর সাহিত্যকে নিয়ে গিয়েছিলেন এমন এক পর্যায়ে যা আমাদের বোধ, অনুভূতি ও পরিপার্শ্বের সব রঙ, রেখা ও উচ্চতাকে ধারণ করে হয়ে উঠেছে এক ভিন্ন উচ্চতর সৃষ্টি।হয়তো তিনি সচেতন ছিলেন, তার রচনারীতি বৃহত্তর পাঠক সমাজের জন্য নয়। সেই জন্যই হয়ত তিনি একটার পর একটা উপন্যাস ছোট পত্রিকায় লিখে গেলেও রচনাগুলি গ্রন্থাকারে প্রকাশের ব্যাপারে তার আগ্রহ ছিল না, যতদূর জানা যায় তার একটি মাত্র উপন্যাস 'অন্তর্জলী যাত্রা' এবং একটি গল্প সংকলন 'নিম অন্নপূর্ণা' প্রকাশিত হয়েছিল তার জীবিতকালে।
খ্যাতির আকাঙ্ক্ষায় লেখেননি কমলকুমার, অর্থের জন্য তো নয়ই। যতদূর জানা যায় এক্ষণ পত্রিকায় সন্মানী দেবার রেওয়াজ ছিল না, কমলকুমার কিছু পেয়েছিলেন কিনা জানা যায়নি, তবে কৃত্তিবাস থেকে তিনি যে একটিবার চেয়ে তিরিশ টাকার নিয়েছিলেন, তা জানা যায়, আর জানা যায় যে গুটিকয়েক বিদ্যার্থী কে তিনি ফরাসী ভাষা শিক্ষা দিতেন, তাদের কাছ থেকে গুরুদক্ষিণা নিতেন মাসিক একটি টাকা। কফি শেষ হয়। দীর্ঘশ্বাস মাখা মগের কফি তখনো ঝিমুচ্ছে। সুস্মিতা আসেনি। বাসু নিজের সাথে কমলকুমার কিংবা জীবনানন্দ কে মেলাতে মনের শ্লেটে অংক কষে তার ও তো কোন খ্যাতি নেই। অর্থের জন্য সেও তো লেখেনা। তবে সে কে জীবনানন্দ নাকি কমলকুমার? সুস্মিতাই বা কে লাবণ্য নাকি দয়াময়ী? দ্বান্দিকতার বুদবুদ বাড়তে থাকে সুস্মিতাকে তার দয়াময়ী মনে হয়। কমলকুমারের স্ত্রী দয়াময়ী মজুমদার স্বয়ং বিদুষী এবং সুলেখিকা। কিন্তু কোনো বিচিত্র কারণে সধবা অবস্থায় তার এইসব পরিচয় কিছুই জানা যায়নি, তিনি ছিলেন অন্তরালবর্তিনী। এমনকী কমলকুমার তার প্রথম উপন্যাস গ্রন্থটি পত্নীকে উত্সর্গ করলেও সেখানে সহধর্মিনীর নাম উল্লেখ করেননি, শুধু লিখেছিলেন 'স্ত্রী কে', সেই দয়াময়ীই কমলকুমারের অকালমৃত্যুর পর উপন্যাসগুলি পত্রিকার পৃষ্ঠা থেকে উদ্ধার করেন।
বাসু ছাদে উঠে আসে হাতে সুস্মিতার ডাইরী। বারকতক ডাকে, সুস্মি, এই সুস্মি, তুমি কোথায় সামনে এসো। কান ধরছি এবার ক্ষমা করে দাও প্লীজ। সুস্মিতার প্রিয় হাসনাহেনা গাছে ফুল ফুটেছে দেখেই সে দৌড়ে নীচে নেমে আসে বলতে গিয়েও আবেগটা খানিক লাগাম টেনে বলে, তোমার লাগানো হাসনাহেনায় আজ প্রথম ফুল এসেছে দেখবে এসো। উত্তর আসেনা একরাশ নির্জনতার হাওয়া ফিসফিস বয়ে যায়। ডাইরীটা বুকে চেপে বসে পড়ে বাসু। সুস্মিতার লেখা এর আগে তার এত মন দিয়ে পড়া হয়নি আজ ভীষন কষ্ট হচ্ছে। এত ভাল লেখা এর আগে কেন পড়েনি এই আক্ষেপ বোধ তাকে ঘুনপোকার মত কুড়ে কুড়ে খায়।ডাইরীর পাতা উল্টে আবার সুস্মিতাকে ছুঁয়ে দেয় বাসু। কমলকুমারের সাহিত্য রচনার প্রেরণা খুঁজে গেলে প্রথমেই চোখে পড়বে তিনি ছিলেন উত্তম পড়ুয়া, তাঁর সময়ে, একশো বছরের বাংলা গদ্য সাহিত্য ছিলো তার নখের ডগায়, বিশেষ অনুরাগী ছিলেন বঙ্কিম এবং রাজশেখর বসুর, এই ভাষার ঐশ্বর্য নিয়ে তার গর্ব ছিল, তবু কিছু একটা অভাববোধ ও ছিল। অদ্ভুত, সব কিছুকে আপাতভাবে ব্যাখ্যার মধ্যে নেওয়া যায় এমন এক জীবন যাপন করেছেন তিনি।
কমলকুমার শুধু সাহিত্য রচনায় প্রবৃত্ত হননি, তিনি নতুন ধারার প্রবর্তনে উদ্যত হয়েছিলেন, তার প্রথম উপন্যাস অন্তর্জলী যাত্রা বাংলা সাহিত্যে এসে পড়েছে কোন পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া সহসা, এই গদ্যরীতি ও কাহিনী বিন্যাস একদম নতুন। এমন রচনার মাঝে ডুবে যাবার জন্য বাংলার পাঠকরা ডুবসাঁতারে পারঙ্গম নয়। তার ভাষা শুধু সাধু বাংলা নয়, বাক্য বিন্যাস ও ছিলো একেবারে স্বতন্ত্র। কমলকুমারের সমস্ত রচনার উপাদান দেশজ এবং মূলত গ্রাম ভিত্তিক।আমাদের সাহিত্যে গ্রাম বাস্তবতা বড় বেশি গ্রাম্য এবং আঞ্চলিক শব্দে কন্টকিত। কমলকুমার গ্রামের মানুষদের তুলে দিয়েছেন উচ্চ পর্যায়ে, তারা হয়ে গেছে চিরকালীন মানুষ। খেলার প্রতিভা উপন্যাসে একটি মৃত ভিখিরির লাঠিটা নিতেও যাদের বিবেক দ্বন্দ হয়, তারা অনায়াসেই মহাভারতীয় চরিত্র হয়ে ওঠে।সত্যজিত্ রায় বলেছেন 'আপাতবিরোধী এতগুলো দিক তার মধ্যে ছিল যেমন আর কোনো মানুষের মধ্যে দেখিনি'। রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম ছিলেন বলে তিনি রবীন্দ্রনাথ কে 'বেম্মো' বলে অবজ্ঞা করতেন, অথচ শানু লাহিড়ী লিখছেন, দাদা প্রায় সময় হেলেদুলে রবীন্দ্রনাথের গান গাইতেন। রবীন্দ্র উপন্যাস নিয়ে চলচ্চিত্র করার কথা ভেবেছিলেন। রবীবাবুর নাটক অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে মঞ্চায়ন করেছেন।
কমলকুমার বাক্য বিন্যাসে স্বতন্ত্র। তিনি যে সাবলীল, ঝকঝকে চলিত ভাষাও লিখতে পারতেন, তার অনেক নিদর্শন আছে। বড় পত্র পত্রিকায় শিল্প সমালোচনা এবং নানা বিষয়ে নিবন্ধ লিখতেন চলিত ভাষায়। উপন্যাস গল্পের ভাষা সম্পর্কে তার বিশেষ চিন্তা ছিল, এ ভাষায় দায় নেই সহজ বোধ্যতার, এ শিল্প নির্মাণের ভাষা, যে কোনো উচ্চাঙ্গ শিল্পের মতনই এর রস গ্রহণ করার জন্য পাঠকদের দীক্ষিত হতে হবে। যেহেতু কমলকুমারের ভাষার কোনো পূর্ব নজির নেই, অন্য কোন লেখকের সাথে তার তাই ভাষার তুলনা চলেনা। তাই তাকে বারবার পড়েই লেখার মর্ম উদ্ধার করতে হবে। আর তাই কমলকুমারকে বারবার পড়তে হয়। তিনি নিজে অনেকসময় বলতেন, বাংলা গদ্যের সিনট্যাক্স হুবহু ইংরেজি গদ্যের অনুকরণে, তিনি সেই প্রথা ভেঙে ফেলে ফরাসি গদ্যের প্রকরণ আনতে চান। তার এই উক্তি আক্ষরিক অর্থে গ্রহন না করেও বলা যায় কমলকুমার এক আশ্চর্য মিনার যা বাংলা সাহিত্যে চিরকাল স্বতন্ত্র হয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকবে। জীবনানন্দ দাশ আর কমলকুমার মজুমদারের তুলনা এ কারণেই আমায় ভাবায়। গদ্য নয়, দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ থেকে জীবনানন্দ যে কাব্যভাষা গ্রহণ করেছিলেন তা অননুসরণীয় এবং বাংলা কবিতায় তা পূর্বাপর রহিত। জীবনানন্দীয় গোত্রের দ্বিতীয় কোনো কবিকে খোঁজা যেমন নিরর্থক তেমনি একটি ছোট অথচ মনোযোগী পাঠকগোষ্ঠী তৈরী করবেন বলেই যেন কমলকুমার কাহিনীগুলিতে ভাষার বর্ম দিন দিন আরো সুদৃঢ় করেছেন। তিনি সব পাঠককে সহজে তার লিখনবিশ্বে ঢুকতে দিতে চান না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় উপমা দিয়ে বলেছিলেন, ফুলবাগানের চারপাশে যেন কাঁটার বেড়া দিয়ে রেখেছিলেন। যাতে অনাকাঙ্খিতরা প্রবেশ করতে না পারে। কমলকুমার কে একবার এত কঠিন করে কেন লিখেন জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন 'বলা কঠিন'। তারপর একটু থেমে বলেছিলেন, 'আমার যে খুব সহজ, তরতরে লেখা পড়তেও কষ্ট হয়, হোঁচট খাই।' কিন্তু আমার বারবার মনে হয় যারা কাব্যপাঠে অভ্যস্ত, তারাই পাঠক হবার জন্য এগিয়ে যেতে পারে। এ ঠিক গদ্য নয়, কাব্যের সৌরভ সর্বত্র অথচ চকিতে এক একটি দেশজ শব্দ এসে ঘোর ভেঙে দেয়। এক কথায় বললে শব্দের বাচকতা, এটা কমলকুমারের সঠিক পরিচয় আর তার লেখা উপন্যাসগুলো আসলে আধুনিক চম্পু। রাত কেটে সূর্যের প্রথম কিরণ পর্দার ফাঁক গলে দেয়ালে টাঙ্গানো ছবিতে বিচ্ছুরিত হচ্ছে বাসুর ঘোর কেটে যায় টেবিলের খালি মগটির পাশে শীতল ব্ল্যাক কফির মগটি দীর্ঘশ্বাস মুছে ফেলে উঠে দাঁড়ায়। বাসুর চোখের তারায় তখন সুস্মিতা, গত পরশুই সুস্মিতা ছবি হয়ে গেছে। ছবিতে এখনো আধ শুকনো ফুলের মালা। বাসুর চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে। সে কি অশ্রু নাকি বিচ্ছেদ শিশির..?
অসম্ভব সুন্দর লেখনভঙ্গী !
ReplyDelete