ছোটগল্প : শ্যামল সোম
Posted in ছোটগল্প
ছোটগল্প
আজ এই বর্ষার দিনে
শ্যামল সোম
আজ সকাল থেকেই আকাশে মেঘ জমেছে, আধো অন্ধকার হয়ে গেল চারপাশ, মনামী পাঁচ তলার বারান্দা থেকে চেয়ে আছে দূরে আকাশ পানে, আকাশে ঘন আঁধারে ঢাকা মেঘের অন্তরালে তার হারিয়ে যায় মন।
সাতটি বছর আগের সেই স্মৃতি মনের মনি কোঠায় সযত্ন সাজানো রয়েছে। চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে।
অনিমেষ গত কাল তিন দিনের অফিস টুরে চলে গেছে, একলাই আছে এই বিশাল ফ্ল্যাটে, হাঁপিয়ে উঠছে নিঃসঙ্গতায়, দাদার বাড়ি গলফ গ্রীন গিয়ে ক'দিন থাকতে পারতো, কিন্তু বৌদি ঐ বাচ্চা না হওয়ায় এমন খোঁটা দিয়ে কথা বলে, মনামীর ভালো লাগে না।
কোন কাজ নেই, একই ঘর নানা ভাবে সাজায়, কেনা কাটা করে একা একা ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। চাপা স্বভাবের জন্য মিশতে পারে না। বিয়ের পর চাকরী দুম করে ছেড়ে দিয়ে খুব ভুল করেছে। তখন অনিমেষের প্রেমের জোয়ারে ভাসছে, হায় প্রেম! ক্ষণস্থায়ী, এখন আর কিছুই ভালো লাগে না। মানসিক অবসাদে ভুগছে, নিয়মিত ওষুধ খেয়ে যায়।
আকাশে মেঘ জমতেই, আজ গুন গুন করে গাইছে মন, " মেঘের পরে মেঘ জমেছে, আঁধার হয়ে আসে----"
হঠাৎ কলিংবেলের আওয়াজ শুনে, মনামী ঘোর ভাঙে, একবার ভাবে এ অসময় আবার কে এলো, সোফা থেকে উঠে গিয়ে আই হোলে তাকিয়ে দেখে, সিকিউরিটি গার্ডের পাশে ও কে দাঁড়িয়ে? ভরা বুকের ওপর সমুদ্রের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে, দ্রুত শ্বাস পড়ছে, হুহু করে উঠছে মন, আশ্বিনের প্রবল ঝড়ে কোথায় যেন উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাকে, আজ এত বছর পর, জয়কে দেখে আবেগে থর থর করে কাঁপছে শরীর। আবার বেল বাজল, " টুঁন টাঁন টুঁন"
মনামী দরজা খুলে দেয়, জয় দিকে অপলক চোখে চেয়ে থাকে, এতদিনের জমে থাকা ব্যথা, যন্ত্রনা, অভিমানে চোখে জলে আপ্রাণ চেষ্টা করছে সংবরণ করার, জ্বালা করে দু -চোখ !
" তাহলে ঠিক আছে মেম সাহেব আমি যাই।" সিকিউরিটি গার্ডের ডাকে মনামী ফেরে আপন চেতনায়, সম্ভবত সে হারিয়ে গিয়েছিল দশ বছর আগে। মনামীর ঘাড় নেড়ে ইশারায় সিকিউরিটি গার্ড ফিরে যায়।
দরজা ধরে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাবে কী এই দশ বছর পরেও ঠিক আগের মতো, যুবক জয়ের মুখে ফ্যাশনেবল দাড়ি, ফেড জিন্স পড়া, প্রিন্স অফ ক্যালকাটা, 1960 সালে, নর্থ কোলকাতার মিত্রদের বাড়ির কাপ্তেন ছেলে লাল রঙের ফোর্ড মটর গাড়ি নিয়ে প্রেসিডেনসি কলেজে আসতো। সেই 1960 তখন গাড়ি থাকা শ্লাঘনীয় ব্যাপার। ফ্লার্টিং করতে করতে কখন যে পরস্পর পরস্পরকে গভীর ভাবে ভালোবেসে ফেলেছিল জয়।
সেদিন মনামীর জন্ম দিন, একে বারে হাঁটু গেড়ে বসে মনামীকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো জয়, উপহার স্বরূপ দামী হীরের আংটি নীল ভেলভেটের বাক্সেই তার হাতে ধরা রয়েছে। ভালোবাসার আবেগের স্রোতে ভেসে গিয়ে, মনামী তার নরম দুহাতে জয়ের ঐ ঝাঁকড়া চুল গুলো মুঠি করে ধরে, সুতীব্র ভালোলাগার কাতরতায় থর থর সারা শরীর, নির্জন ঘরে দুজনের হৃদয়ে ঢোল ধামা বাজছে নৃত্য ছন্দের তালে তালে, সুনীল সাগরের ঢেউয়ের সাথে শরীর ভাসিয়ে ভেসে ভেসে সাঁতরে যাচ্ছে দুজনে, এ যেন এক অন্তহীন যাত্রা, পৌঁছতে চায় সেই সে এক স্বপ্নের দেশে, চির বসন্ত, সমীরণে সুগন্ধ, পুষ্পবনে নানা রঙের পুষ্পে পুষ্পে ভরা, মৌমাছি, রঙিন ডানা মেলে প্রজাপতি উড়ে। গাছে গাছে পাতার আড়ালে ডাকে কোকিল, দোয়েল শীষ দিয়ে যায়।
হঠাৎ চমকে উঠে মনামী, শোনে, আশ্চর্য জলদ গম্ভীর স্বরে, " আজ এত বছর পরেও তুমি আমাকে দরজার বাইরেই রাখবে নমী ?"
এত ক্ষণ পরে খেয়াল হলো জয় বৃষ্টি জলে ভিজে এক্কেবারে--জয় যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, যেন ছোট নদী এঁকে বেঁকে বহে যাচ্ছে।
দরজা খুলে জয়ের হাত সযত্নে ধরে ড্রয়িং রুমে আনে মনামী---!
হাঁটু গেড়ে বসে জয়ের জুতো খুলে দেয়, বাথরুমে নিয়ে গিয়ে ধীরে ধীরে সার্ট খুলে দিয়ে তোয়ালে হাতে ভালো ভাবেই মাথার ভেজা চুল, ও সারা শরীর, মুছিয়ে দেয়, বেরিয়ে এসে এক জোড়া ধোয়া, সাদা পায়জামা ও পাঞ্জাবী, জয়ের হাতে তুলে দেয় মনামী।
কিচেনে এসে হিটারে কফির জল চাপিয়ে দেয়, একটা প্লেটে নানা রকমের বিস্কুট, চানাচুর সাজিয়ে দিতে দিতে ভাবে রাতে জয় জন্য কি রান্না করবে?
জয় লম্বা সোফায় মনামীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে, জয়ের চুলে মনামীর আঙ্গুল বিলি কাটছে।
জয় Keats এর Isabella কবিতা আবৃত্তি করছে, " Fair Isabel, poor simple Isabel! Lorenzo, a young Palmer in Love's eye! They could not in the self same mansion dwell- Without some stir of heart, some malady; They could not, sit at meals but feel how well It soothed each to be the other by; They could not, sure, beneath the same roof sleep- But to each other dream, and nightly weep.
জয় হাত বাড়িয়ে মনামীর গলাটা দু হাতে জড়িয়ে খুব কাছে টানে, উষ্ণ আগ্রাসী চুম্বনে মনামীর শরীরে চরম উত্তেজনা, আঁকড়ে ধরে জয়কে,
দুরন্ত আবেগে পরস্পরে হারিয়ে যায় এক গভীর থেকে আর গভীরতায়--!
আবার ডোর বেল বেজে ওঠে, টুং টাং টুং, ঘেমে নেয়ে গেছে মনামী, ঘোর ভেঙে সে চারপাশে কাউকে খুঁজে পায় না, একা ঘরে এতক্ষণ আপন মনে সে নিজেই এত সব ভাবছিল, ভীষন ক্লান্ত শরীরে ধীরে ধীরে দরজা খুলে দেয়, কাজের মাসী দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে---!
0 comments: